সবুজ কাজলের কৌটো - অন্তিম পর্ব ১০ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


১৯!! 

দুদিন ওই বাড়িতে থেকে আয়ান মায়রাকে নিয়েই বাড়ি ফিরেছে। তাথৈ প্রথমে কিছতেই রাজি হলো না।।পরে অবশ্য মায়রার করুণ মুখটা দেখে রাজি হয়েছে শেষমেষ। মেয়েটা আয়ানকে ছাড়া বাঁচতেই পারবে না-কথাটা বেশ ভালোই বুঝে তাথৈ। তাই আর কথা বাড়ায় নি।শেষ একটা সুযোগ দিয়েছে আয়ানকে।। আয়ান অবশ্য তাতেই খুশি।। তার পিচ্চি পরীটাকে সে আর কখনো কষ্ট দিবে না।।কখনো না।।। এর মধ্যে নেহার সাথে কথা হয়েছিল মায়রার। কিছু একটা পার্সেল করেছে নেহা। আয়ানও সারাদিন মায়রার খেয়াল রেখেছে। খাইয়ে দিয়েছে। মায়রাকে বুকে জড়িয়ে দুজনেই শান্তিতে ঘুমিয়েছে। 

বাসায় ফিরে আয়ান মায়রাকে গাড়ি থেকে নামতেই পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। একেবারে সোজা এনে খাটে শুইয়ে দিলো। মায়রা হেসে রুমটা দেখছে। সারা ঘরটায় এটা ওটা ছড়ানো।। মায়রা হেসে ফেললো।কটা দিন ছিল না সে।। তাতেই বাসার যা অবস্থা হয়েছে!! উঠে ফ্লোরে পড়ে থাকা আয়ানের শার্ট উঠাতেই আয়ান মায়রাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ ডুবালো।৷ আয়ানের হঠাৎ এমন স্পর্শে মায়রা কেঁপে উঠলো।।

-মায়রা সোনা?? রাগ নেমেছে পচা বরটার উপর থেকে???

মায়রা কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলো।৷আয়ান আলতো করে মায়রার ঘাড়ের কাছের চুল সরিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। মায়রা কেঁপে উঠে আয়ানের দিকে ঘুরেই আয়ানকে জড়িয়ে ধরলো। 
মায়রার মুখের সামনে চলে আসা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে মুখটা একটু তুলে ধরে কপালে চুমো খেল আয়ান। 

-সরি গো মিষ্টি পরীটা--।। আর কখনো বকবো না।। আর কষ্ট দিয়ে কাঁদাবো না বউটাকে।। সরি???

মায়রা মুচকি হেসে আয়ানের বুকে মুখ ডুবালো। আয়ান আবার মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিলো।। 

-আবার উঠবে না খবরদার।।চুপটি করে বসে থাকো।। আমি একটু বের হচ্ছি।। দুপুরের মধ্যে ফিরে আসবো। ফিরতে দেরি হলে খেয়ে নিও পাগলীটা।। প্রমিস করো??

-উহু---।

-কি?? 

-আচ্ছা---।। তাড়াতাড়ি এসো তুমি।৷ 

-হ্যাঁ গো পরীবউ।। তাড়াতাড়ি ফিরার চেষ্টা করবো।।

মায়রার কপালে ছোট্ট করে চুমো এঁকে বেরিয়ে গেল আয়ান। আজ তার বহু কাজ। কাজটা যে করেই হোক দুপুরের মধ্যেই সারতে হবে। নইলে পাগলীটা না খেয়েই বসে থাকবে ওর জন্য।। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ করার চেষ্টা করছে আয়ান। এর মধ্যেই ফোনে কল এলো। দুবার কল হতে হতে কেটে গেলো। পরের বার আবার বেজে উঠতেই রিসিভ করলো আয়ান। নাম্বারটার আরিশার। তাই কলটা দেখেও রিসিভ করছিল না এতোক্ষণ। মায়রাদের বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে আর অফিসে যায় নি আয়ান। কি বলবে সেটাই ভাবতে ভাবতে কানে 'হ্যালো' শব্দটা ভেসে এলো।।

-হ্যালো ম্যাম--।। কেমন আছেন?

-আমি ভালো আছি।৷ আপনি?? অফিসে আসছেন না বহুদিন??

-আমি ভালো আছি ম্যাম। আসলে ওয়াইফ একটু অসুস্থ ম্যাম৷ সময় একদম দেয়া হচ্ছে না ওকে।।  তাই একটু বাসায়---।।

-ঠিক আছে।৷ মিসেস এর কেয়ার করুন।৷ তবে আপনার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।৷ আপনি যে প্রজেক্টটা নিয়ে কাজ করছিলেন সেটা ক্লাইন্টদের ভিষণ পছন্দ হয়েছে। ডিলটা গতকাল ফাইনাল হয়েছে। আজকে তাই একটা গেট টুগেদার টাইপ পার্টি আছে অফিসে।৷ আপনাকেও ইনভিটেশন দিয়েছিলাম। রিপ্লাই না দেখে কলই করলাম।।

-সরি ম্যাম। আমি খেয়াল করিনি। আর আসতেও পারবো না। বউটাকে নিয়ে একটু বের হবো---।। 

-আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড।৷ তবে আসলে একটা সারপ্রাইজ দেয়া যেত আপনাদের দুজনকেই।।

-সরি ম্যাম বুঝলাম না ঠিক--।।

-আমি আজকের পার্টিতে আমার বিয়ের ডেইট আর পার্টনার এ্যানাউন্স করবো। তাওহীদ-। চিনেন হয়তো আপনিও-।।আমার কলেজ ফ্রেন্ড---।। ওকেই বিয়ে করতে যাচ্ছি---।।

-ওয়াও--। কংগ্রাচুলেশনস ম্যাম। তাওহীদ স্যার মানুষটা আসলেই আপনার জন্য পারফেক্ট---।।

-আপনাকে আর মায়রাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিলেও কম হবে।। বিয়ে ব্যাপারটাতে কখনোই আমার রুচি ছিলো না।৷ নিজের পরিবারের অবস্থা তো দেখেছি---। বাবা বিজনেসের নাম করে কতো মেয়ের সাথে--বাজেভাবে সম্পর্কে জড়িয়েছে।। আর মা??? মা ঘরে একলা অসহায় কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়েছে--।। মায়ের মতো ভবিষ্যত আমি কখনোই চাই নি।। আর বিয়ে নামক শব্দটা- সম্পর্ক- ব্যাপারগুলোকে নেহায়েতই ছেলেখেলা মনে হতো---। আপনার বিয়েতে দাওয়াতটা পেয়ে আমি যখন গেলাম--আপনাদের দুজনকে দেখে আমি অবাকই হয়ে রইলাম। আপনাদের বিয়ের প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে তাই এ্যাটেন্ড করেছি আমি।আর অবাক হয়ে আপনাকে আর মায়রাকে দেখেছি।৷ কি আশ্চর্য জুটি!! দুজন মানুষ এতোটা ভালোবাসতে পারে জানাই ছিল না আমার। অফিসেও বহুদিন আপনাকে লক্ষ্য করেছি। বাজে কোন অভ্যাস আপনার মধ্যে দেখিনি৷ কাজের জন্য যতটা লয়াল- ততটা ওয়াইফের জন্যও---।।

-কি যে বলেন ম্যাম??!! 

-আপনার চোখে মায়রার জন্য যেমন মুগ্ধতা দেখেছি তেমন মুগ্ধতা আমি আগে কারো চোখে দেখিনি। সাদামাটা হোক বা চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য-সবটাতেই মায়রার জন্য আপনার চোখে অন্যরকম একটা ভালোবাসা ফুটতে দেখেছি।। তাওহীদও যে আমাকে এতোটা ভালোবাসে বুঝতে পেরেছি তখন। সবাই আমার মেকাপ করা মুখের রঙচঙে ভাবটা দেখেই একটু বিস্মিত হয় সর্বোচ্চ।। শুধু তাওহীদকেই দেখেছি আমার মেকাপ ছাড়া তামাটে মুখটার দিকেও অবাক চোখে মিনিটের পর মিনিট তাকিয়ে থাকতে।। তাই সময়টা হারিয়ে যাওয়ার আগেই তার সাথে নিজেকে বেঁধে ফেলতে চাচ্ছি।। 

-হাউ সুইট ম্যাম--!! আপনাকেও তাহলে শিকল মোবারক--।।

-হা হা--।। ভালো বলেছেন--।। নিন-- তাওহীদ একটু কথা বলবে আপনার সাথে--৷  

-হ্যালো স্যার? কংগ্রাচুলেশনস।।

-থ্যাংকু মিস্টার আয়ান। আপনার প্রেম কাহিনী দেখে আমার এতো বছরের পুরোনো ভালোবাসটা যে আরুর চোখে পড়েছে তার জন্য আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো-তার ভাষাই আমি খুঁজে পাচ্ছি না  ভাই--।

-আরে স্যার?? কি বলছেন??

-আর হ্যাঁ?? একটা কথা মনে রাখবেন--। স্টাইল-বাহ্যিক সৌন্দর্য  এসব দেখে একটু উল্টাপাল্টা খেয়াল মাথায় আসতেই পারে।। তবে সেটাকে মাথায় চেপে বসতে দিবেন না। ভালোবাসার মানুষটার মুখটা কল্পনা করে দেখবেন।৷ সেই মানুষটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর।সেটা তার কাজে, নয়তো মনের দিক থেকে-নয়তো ব্যবহারে-নয়তোবা আপনাকে ভালোবাসার দিক দিয়ে--। সেই সৌন্দর্যটা কখনো মিস করবেন না। হারিয়ে ফেলে পরে কপাল চাপড়ে তো কাজ হবে না।৷ তবে আপনাকেও কনগ্রাটস ম্যান।। নিজেকে সামলে নিতে পেরেছেন বলে--। নইলে আমার পরীটার থেকে নিজেকে বাঁচানো ততোটাও সহজ ব্যাপার না-----।। আচ্ছা আচ্ছা বাবা-।। চুপ করলাম আরু ম্যাডাম।। সরি ভাই।। অনেক বকবক করলাম।। ম্যাডাম আবার রেগে গিয়ে বিয়ে করবে না বললে শেষ আমি--।। বায়।। টেইক কেয়ার।।

আরিশা আর তাওহীদের সাথে কথা বলে ভালো লাগলো আয়ানের। দুটো মানুষ নিজেদের ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে এতোদিনে। আর সে নিজেও নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে খুশি। 

এদিকের কাজ শেষ করে ২ টোর দিকে বাড়ি ফিরলো আয়ান। যা ভেবেছিল তাই।। না খেয়েই বসে আছে মায়রাটা এখনো। মায়রাকে বুকে টেনে নিয়ে নিজের মনে হাসছে আয়ান। আজকে তার মায়াপরীর জন্য বড় একটা সারপ্রাইজ ওয়েট করছে।।

মায়রাকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিয়েছে আয়ান। এখন মায়রার চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।। ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে মায়রার। এই মানুষটার স্পর্শগুলো এতো ভয়ংকর নেশা জাগায় কেন ওর মধ্যে!!? মানুষটার শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ, হাতের কোমল স্পর্শ, ঠোঁটের আলতো ছোঁয়া- সবই মায়রাকে বারবার আয়ানের দিকে চুম্বকের মতো টানে কেন এমন করে?! লোকটার উপরে তো অভিমান করেছে মায়রা।। প্রচন্ড প্রচন্ড অভিমান।৷ তবু কেন একটুও মানুষটার কাছ থেকে দূরে থাকতেই পারে না!?? মানুষটা কি বুঝে না এসব!!?? সব কথাই কি বলে বুঝাতে হবে!!?? কতোটা ভালোবাসে মায়রা আয়ানকে-সেটাও বলে বোঝানো ছাড়াও কি বুঝবে না মানুষটা!?? 

এসব ভাবতে ভাবতেই মায়রা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। আয়ানের বুকে মাথা রাখতে পেরে শান্তিতেই ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটা। বেশ কিছুক্ষণ মায়রার চুলে বিলি কেটে দিলো আয়ান। মায়রার ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসিটা দেখতে অসম্ভব রকমের ভালো লাগছে আয়ানের কাছে। আরো কিছুক্ষণ মায়রাকে দেখে আলতো করে বালিশে মাথাটা নামিয়ে রাখলো আয়ান। গায়ে আলতো চাদর টেনে দিয়ে মায়রার চুলটা একটু ঠিক করে দিয়ে একটা নোট লিখতে বসলো আয়ান। নোটটা মায়রার মোবাইল দিয়ে চাপা দিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।। মেয়েটার রাগ ভাঙানোর জিনিসটা যে আনতে যেতে হবে।। সে ও বেশ অনেকটা সময়ই লাগবে।। মেয়েটাকে সারপ্রাইজ যখন দিবে ঠিক করেছে তাহলে একদম তাক লাগানো সারপ্রাইজ দিতে হবে।। এটাই আপাতত আয়ানের মাথায় চলছে।। 

যতটা সম্ভব দ্রুত গাড়ি চালিয়ে শপিংমলে আসলো আয়ান। গাড়িটা পার্ক করে একপাশে রেখে পাশের গলি দিয়ে হাঁটা শুরু করলো। এই গলিতে দুটো মানুষই ঠিক মতো পাশাপাশি করে হাঁটতে পারে না।।গাড়ি-রিকশা তো বহু দূরের কথা। অনেকটা পথ হেঁটে তারপর খুপরি মতন একটা দোকান পাওয়া যাবে। নাম- 'নয়ন কাজল ঘর'। এইটাই একমাত্র দোকান যেখানে পাওয়া যাবে মায়রার রাগ ভাঙানোর ওষুধ।  মায়রা আর আয়ান দুজনের পছন্দের #সবুজ_কাজলের_কৌটো।

 এতো তথ্য আয়ানের জানার কথা নয়। মায়রার বেস্টফ্রেন্ড নেহাকে কল করে জেনেছে আয়ান। আগেরবার নেহাই এনে দিয়েছিল কাজলটা। এবার আজ আয়ান নিজেই যাচ্ছে।। তার হাতে সময় নেই।৷ কাজলটা তার জলদিই চাই।৷ মায়রাটার ঘুম ভাঙলেই সারপ্রাইজটা দেয়া লাগবে। সো জলদি জলদি জলদি পা চালালো আয়ান। ২০ মিনিটের রাস্তা মোটামুটি ১৫ মিনিটে শেষ করে দোকানটা দেখতে পেলো।

ছোট্ট খুপরি মতো দোকান ঘর। একটা কাঠের বোর্ডে সবুজ পেইন্ট দিয়ে দোকানের নাম লেখা। দোকানটা খোলা দেখে আয়ানের শান্তি শান্তি লাগছে। এতোক্ষণ বারবার মনে হচ্ছিল যদি দোকানটা খোলা না থাকে!! তখন কি হবে!!! যাক--। শেষমেষ দোকান যে খোলা সেই ঢের।।

-ভাই--। এক কৌটো সবুজ কাজল দিয়েন তো--।।

-আরে আপনে আয়ান ভাই না??

-জি!!?? হ্যাঁ---।।

-মায়রা ম্যাডামের জইন্যি কাজল কিনতে আইছেন ভাই??

-হ্যাঁ-------।

-আরে ভাই--। ম্যাডামে আপনের কথা এতো এতো কইসে যে আমি তো দেইখাই চিইন্না ফালাইসি আপনেরে---।।এক্কেরে রাজাগো মতো সুন্দর জামাই পাইসে মায়রা ম্যাডামে----।।

-ও আচ্ছা----।। তাই বলুন--।

-ম্যাডাম দিখি এতো দিন ধইরা আহে না--।।

-আসলে বিয়ের পর আমরা সিটির দিকে শিফ্ট করেছি।। অনেকটা রাস্তা তো--।। তাই আর কি--।।

-ও আইচ্ছা--।। আপনে খালি এই একটা কাজলের জইন্যি এতোখান রাস্তা আইছেন??

-কি আর করবো বলুন?? এই জিনিস তো নাকি শুধু আপনার এই দোকান ছাড়া কোথাও পাওয়াই যায় না--।। আর ওর খুব পছন্দের।। আসতে তো হবেই---।।

-এই লন ভাই---।।আপনের কাজল।। দাম মাত্র ১০ টাকা ১০ টাকা ১০ টাকা---।।

-জি।। 

আয়ান হেসে ফেললো দোকানির কথায়।। তারপর দাম চুকিয়ে হাঁটা শুরু করেছে।। অনেকটা রাস্তা হেঁটে তারপর গাড়িতে উঠতে হবে।। পাগলীটার ঘুম ছুটে গেছে নিশ্চয়ই এর মধ্যে!!?? এসব ভাবতে ভাবতেই হাঁটছে আয়ান।।এর মধ্যেই দোকানদারটা আবার ডাক দিলো আয়ানকে।।

-এই যে আয়ান ভাই??

-জি??

-ধরেন ভাই--।এইডা লন--।। আরেক কৌটা সবুজ কাজল লইয়া যান ম্যাডামের জইন্যি---।।

-আপনি নাকি ১ কৌটোর বেশি বিক্রি করেন না??!!

-কেউ তো এতোডা সময় খরচ কইরা শুধু বউয়ের এক কৌটা কাজল নিবার জইন্যি এতোটা রাস্তাও আহে না ভাই।।

আয়ান টাকা দিতে চাইলেও এবারের কোটোটার দাম দোকানি কিছুতেই নিলো না। আয়ানও আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটা ধরলো।। আবার ১৫-২০ মিনিট হাঁটতে হবে। তারপর ঘন্টা খানেকের রাস্তা পাড়ি দিয়ে তবেই ফিরতে পারবে।।

মায়রার ঘুম ছুটতেই দেখলো ৫ঃ৩০ টা বাজে। পাশে আয়ানকে না দেখে কল দেয়ার জন্য মোবাইলটা হাতে নিতে গিয়ে ছোট্ট একটা চিরকুট টাইপের নোট পেল।।

"আমার পাগলী পরীটার ঘুম ভেঙে গেছে? ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে রেডি হও পরী। একটা সারপ্রাইজ আছে আমার মায়াপরীটার জন্য।। আমি চলে আসবো।। তুমি রেডি থেকো।।"

নোটটা পড়েই মায়রার ওইদিনের পার্টিতে যাবার ঘটনাটা মনে পড়ে গেলো। কোথায় যাওয়ার জন্য রেডি হতে হবে মায়রাকে বলে নি আয়ান। তবে মায়রা ধরেই নিলো আজও অফিসের পার্টিতে যাবে। আগের দিনই আয়ানের ফোনে আরিশার ইনভিটেশনটা দেখেছে মায়রা। মায়রা তখনই মনে মনে ঠিক করেছিল।।এবার আর কিছুতেই আয়ানকে নিরাশ করবে না সে। আয়ানের মাথা নিচু হতে সে কিছুতেই দিবে না। আর তারচেয়ে বড় কথা আজকের পার্টিটা আয়ানের সাফল্যের পার্টি। তার কঠোর পরিশ্রমের উপহার।। আজ তো মায়রা আয়ানের পছন্দেই নিজেকে রাঙাবে।।সেটা যতোটা কষ্টকর বা অস্বস্তিকর হোক না কেন মায়রার জন্য।। তবুও--।।

আলমারিটা খুলে নেহার পার্সেলের প্যাকেটটা নিলো মায়রা। মায়রাই নেহাকে বলে আনিয়েছে জিনিসটা। জিনিসটা আজ কাজে লাগবে মায়রার।। 

ধীরে ধীরে রেডি হচ্ছে মায়রা। চোখের কোণে দু ফোঁটা পানি চিকচিক করছে ওর। সেটাকে পাত্তা না দিয়েই মায়রা রেডি হচ্ছে। ফোঁপানোর মতো করে একটু হেঁচকি উঠছে।৷ সেটাও সামলে নিয়ে নিজের কাজটা মন দিয়ে করার চেষ্টা করছে মায়রা। সাজটা শেষ হলে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো মায়রা।। আয়নায় চোখ পড়তেই দেখলো মায়রার পিছনেই দাঁড়ানো আয়ান।৷ অসহায় চোখে মায়রার দিকেই তাকিয়ে আছে সে।

২০!! 

লাল টুকটুকে জর্জেটের একটা শাড়ি পড়েছে মায়রা। থ্রি কোয়ার্টার হাতাওয়ালা জরি আর ফুলের লেইসের কাজ করা ব্লাউজটাও ফিনফিনে জর্জেটের শাড়িটার মধ্য থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছে।। রেড পার্লের হালকা কানের দুল আর গলায় রেড পার্লের লকেট, হাতে মোটা ব্যাঙ্গেল, মুখে ভারি মেকাপ, চোখে মোটা করে আইলাইনার-আই শ্যাডো, আর ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক- সব মিলিয়ে মায়রাকে লাল পরী লাগছে ঠিকই। তবে আরিশার কপি মনে হচ্ছে আয়ানের কাছে। মেয়েটা কখনোই এতোটা সাজে না। আর খোলা চুলে মায়রাকে দেখে আয়ানের হার্টবিট বাড়ার বদলে সূক্ষ্ম একটা ব্যথা জেগে উঠছে বুকের ভেতরে। ঠিক কতোটা কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা সেটা আয়ান হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এই মূহুর্তে। তখন কি চেপেছিল মাথায়!! মায়রাকে সব রূপেই তো তার ভালো লাগে!!?? তবে কারো কার্বনকপি রূপে!!না না। কখনো নয়।। নিজের উপরেই রাগ লাগছে আয়ানের। তার মায়াপরীটার মনে কষ্টটা যে রয়ে গেছে ব্যাপারটা তো সে বুঝতেই পারেনি।। কখনো ভুলতে পারবে কি মেয়েটা!! কখনো মাফ করতে পারবে আয়ানকে!!??

আয়ানকে দেখে লাজুক হাসল মায়রা। আয়ানের চোখে বিস্ময়ের বদলে অন্য কিছু খেলা করছে। ব্যাপারটা মায়রার চোখ এড়ালো না। কিন্তু আয়ানের মুখটা দেখে মায়রা ওর অনুভূতিটা বুঝতে পারছে না।। 
আজও কি মায়রাকে ভালো লাগছে না?? পার্টি গেটআপ কি আজও হয় নি?? এসব ভাবতে ভাবতে মায়রার চোখ দুটো ভিজে এলো। আজও কি আয়ান ওকে রেখেই চলে যাবে?? আায়ানের মাথাটা আজও নিচু হয়েছে ওর জন্য-ভাবতেই কান্না পাচ্ছে মায়রার। মানুষটার পাশে দাঁড়ানোর কোন যোগ্যতাই নেই ওর।। এবারে মায়রার চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। সেটা আয়ানের একেবারে বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে দিলো।।
মায়রার সামনে এসে মুখটা তুলে চোখে চোখ রাখলো আয়ান।।

-কি হয়েছে পিচ্চি?? কাঁদছে কেন আমার পরীটা??

-আই এম সরি---।। বেশি খারাপ লাগছে??? আজও হয়নি ঠিক করে------??!!

কান্নায় মায়রার গলাটা বন্ধ হয়ে এলো। পরের কথাটা আর বলতে পারলো না। আয়ানও আর কিছু না বলে মায়রার চোখ দুটো আলতো করে মুছে দিলো।।

-পরী?? চেইঞ্জ করে এসো-----।।

-বেশি বিশ্রি লাগছে???

-আমার মায়াপরীটাকে কখনো বিশ্রি বা অসুন্দর লাগতে পারে পাগলী?? কিন্তু এভাবে যাওয়া লাগবে না গো পাগলী----।।। তুমি আমার নীল পরীটা হয়ে এসো---।। যাও---।।

-না না---।। পার্টিতে এভাবে না গেলে-----।।৷ তোমার জন্য পার্টি আর আমি--------।।।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কথাগুলো কোনরকমে বললো মায়রা।। আয়ান বেশ কিছুক্ষণ মায়রার দিকে তাকিয়ে থেকে হালকা করে বুকে টেনে নিলো।

-আমার পরীটাকে এভাবে অন্য কেউ দেখলে যে আমার সহ্য হবে না গো।। আমার পরীটা কেন বুঝতে পারছে না কথাটা???!!!

-সাতটা বেজে গেছে তো?? চলো না??? 

কি ভেবে আয়ান একটু হেসে মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো।।

-চলো পরী---?? পরে কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবে না বলে দিলাম----।।

মায়রাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজেও এসে গাড়িতে বসলো। সিটবেল্টটা লাগিয়ে দিয়ে আলতো করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ড্রাইভিং এ মন দিলো আয়ান। মেয়েটার মনের মধ্যে কি চলছে আয়ান সেটা বুঝতে পারছে। একটু পর পরই আয়ান মায়রার দিকে তাকাচ্ছে।। মায়রা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।। গাড়ির জানলাটা খোলা।। খোলা জানালা দিয়ে আসা বাতাসে মায়রার চুলগুলো বড্ড বেসামাল হয়ে উড়ছে। ব্যাপারটা দেখতে ভালো লাগছে আয়ানের। মেয়েটাকে নিজের মনটা গুছিয়ে নেয়ার সময় দেয়া দরকার।৷ তাই আর মায়রাকে ঘাটালো না। এর মধ্যে একবারের জন্যও মায়রা আয়ানের দিকে তাকায় নি। তাকালেই যদি চোখের পানিগুলো আয়ানের চোখে পড়ে তাই।। আয়ান অবশ্য মায়রার শরীরের হালকা হালকা দুলে ওঠা দেখে বুঝতে পারছে-যে মায়রা কাঁদছে।৷ তবুও একটা কথাও বললো না আয়ান। আজকের পর আর সে তার মায়াপরীটাকে কাঁদতেই দিবে না।। এটাই মায়রার শেষ কান্না।।

ঘন্টাখানেক পর গাড়িটা হালকা ব্রেক করে থামালো আয়ান। বিশাল বাংলো টাইপের বাড়ি। কেমন যেন চেনাচেনা লাগছে মায়রার। অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছে না।। তবু মায়রার মনে হলো।। বাড়িটা তার খুব পরিচিত।। তবে আর যাই হোক।। এখানে পার্টি তো অবশ্যই নেই। তবে এখানে কেন নিয়ে এসেছে আয়ান ওকে???!! আয়ানও ততক্ষণে মায়রার আর নিজের সিটবেল্ট দুটো খুলেছে। হালকা করে টেনে মায়রাকে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো আয়ান। 

-আমার ছোট্ট পরীটা এখনো রাগ করে আছে???

-আমরা কোথায় এসেছি???

-চিনতে পারছো না?? ভালো করে চেয়ে দেখো???--- তোমার শ্বশুড়বাড়ি এটা পরীবউ----।।।

-ওওওও।। তাই তো চেনাচেনা লাগছিল----।।। কি করছো???

আয়ান একবার মায়রার ঘাড়ে আলতো করে চুমো খাচ্ছে।৷ আবার মায়রার কানে ফুঁ দিচ্ছে।। কখনো হালকা করে কানে ঠোঁট বুলাচ্ছে।। 

-আমরা তোমার অফিসের পার্টিতে যাচ্ছিলাম---!!??

-কে বলেছে এসব বাজে কথা!?

-কে বলেছে মানে??!! আর বাজে কথা মানে কি!!?? তোমার অনারে পার্টি দিচ্ছে আরিশা ম্যাম আজকে----??!!

-ও আচ্ছা।। তাই নাকি!?? ভালো কথা মনে করেছ। ম্যাম আর উনার উড বি হাসবেন্ড তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে---।।আজ পার্টিতে উনাদের বিয়ের ডেইট ঘোষণা হবে----।।

-কি??!!!

আয়ান মায়রার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে চুলের ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত।। আয়ানের এমন স্পর্শে বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছে মায়রা।। মানুষটা এমন করে কেন!!??

-কি করছো কি তুমি???

-কি করছি দেখতে পাচ্ছো না?? তোমাকে তো বলেছিলাম চেইঞ্জ করে নিতে--।। তুমিই তো শুনলে না।। এখন আমাকে বকে কি হবে!!??

-সরো---।। বলছি না আমরা পার্টিতে যাবো??!!

-ধুরো---।। তোমার পার্টি পার্টি--।। এই মেয়ে--? সময়টা আমি শুধু তোমার সাথে কাটাতে চাচ্ছি--কেন বুঝতে চাইছো না?? 

-আমি তোমার অফিসের পার্টিতে যাবো।। ব্যাস----।।

-আর একবার পার্টিতে যাওয়ার কথা বললে খুব খারাপ হবে মায়রা।। তোমাকে এভাবে শুধু আমি দেখবো। আর কেউ তোমাকে এভাবে দেখবে-সেটা আমার কখনো সহ্য হবে না।। মরে গেলেও না---।। 

-কিন্তু তুমিই তো বলেছ--পার্টির গেট আপ ছাড়া---।।

-ধুর--।। তুমিই যাও পার্টিতে।। আমি মানুষকে একটা সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য এনেছি।। ধুর।।ভালো লাগে না--।। লাগবে না যাও---।।।

আয়ান রাগ করে মায়রাকে সিটে বসিয়ে দিয়ে নিজেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও একটা চলে গেলো। মায়রা মাথা নিচু করে কাঁদছে অনেকক্ষণ ধরে।। আজও একবার ওকে একা রেখেই মানুষটা চলে গেলো!! 

বেশ অনেকক্ষণ পর মায়রা চোখ মুছে গাড়ি থেকে নামলো।। মানুষটা কোথায় চলে গেছে!! চারপাশটা নিরব।। তার উপরে অন্ধকার হয়ে এসেছে।। একটু ভয় ভয় করছে মায়রার।। আয়ান কোথায় আছে ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারছে না মায়রা।। মানুষটা কি ওকে রেখে চলে যাবে!! আবার!!! মনে তো হয় না। তবে!? রাগ করে কোথাও গিয়ে বসে আছে!!?? বাড়ির ভিতরে!!? নাকি বাগানে!!! 

এসব ভাবতে ভাবতেই মায়রা আয়ানের খোঁজে বের হলো।। বাড়ির মেইন দরজার কাছে একটু থামলো মায়রা। কি ভেবে বাড়ির পিছনে বাগানের দিকেই রওনা হলো।। আয়ান বাগানে থাক না থাক জায়গাটা একটু দেখে যেতে ইচ্ছে করছে মায়রার।। মানুষটা সেখানেও তো থাকতে পারে।। বাবা মা আর তিথির কবরের কাছাকাছি আসতেই আয়ানকে দেখতে পেল মায়রা।কবরের সামনে বসে মুখ নিচু করে আছে আয়ান।। কি করছে মানুষটা এখানে!!

-জানিস তিথি?? তোর পিচ্চি পরী ভাবীটাকে বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছে তোর পচা ভাইটা। একটু ওকে বল না প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দিতে!!?? প্লিজ??? আর কখনো এমন ভুল করবো না রে।। বলে দে না প্লিজ ওকে----??!! পরীটাকে বহু কষ্ট দিয়ে ফেলেছি যে।। তোমরা সবাই একটু বলো না ও যেন আমাকে ফেলে না যায়---।। ও চলে গেলে আমি বাঁচব কি নিয়ে?? প্লিজ?? বাবা-- মা-- তিথি?? বল না ওকে একটু?? প্লিজ???!!

আয়ানের ভাঙা গলায় কথাগুলো শুনে থমকে দাঁড়িয়ে আছে মায়রা।। মানুষটা নিজের ভুলটা তো বুঝতে পেরেছে।। নিজেকে সামলে নিয়েছে- শুধরে নিয়েছে।। এখন ও পুরোনো কথাগুলো ধরে বসে থাকা কি ঠিক হবে ওর!!?? 

মায়রা ধীরে ধীরে এসে আয়ানের পাশে বাগানের মাটিতেই বসে পড়লো। একটা হাত দিয়ে আয়ানের একটা বাহু জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে মুখের দিকে তাকালো। আয়ানও অবাক অবাক চোখে মায়রার দিকে তাকিয়ে আছে।। চোখ মুখ ভিজে আছে মানুষটার। মায়রা মুখটা আয়ানের কাঁধ থেকে না সরিয়েই আয়ানের চোখ মুছে দিলো।।

-আমি কি মরে গেছি যে তুমি এভাবে কাঁদছো??!

আয়ান আর নিজেকে সামলাতে না পেরে মায়রাকে জাপটে ধরে কেঁদে ফেললো।।

-বাজে কথা বলবে তো আমিই মেরে ফেলবো একদম---।। মাফ করে দাও না পরীটা!! আর এমন ভুল কখনো করবো না। প্রমিস তো!??

মায়রা হেসে আয়ানের চোখ মুখ আবার মুছিয়ে দিলো।। আলতো করে আয়ানের কানের কাছে মুখ নিল।।

-আর এভাবে বাচ্চাদের মতো কান্না কাটি করলে মাফ টাফ একদম করবো না বলে দিচ্ছি জনাব----।।

মায়রার কথায় আয়ানও হেসে ফেললো।। নিজে উঠে দাঁড়িয়ে হাত ধরে মায়রাকেও উঠালো আয়ান। আলতো করে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।।

-পরীটার জন্য ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ ছিলো--। চলো পরী??

-হুম-----।।

আয়ানের কাঁধে হাত ঝুলিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মায়রা। চুলগুলো এ কয়দিনে একটু বেশি বড় হয়েছে আয়ানের। কিছুতেই নিজেদের জায়গায় থাকছে না।। বাতাসের জোরে দুলে দুলে চোখ মুখের সামনে চলে আসছে বারবার। কয়েকদিনের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি মুখে। বেশি বড়ো হয়নি। তবে দেখতে একটু বেশিই কিউট লাগছে মানুষটাকে।।কালো সুতার ডিজাইন করা নেভি ব্লু কালারের পাঞ্জাবির উপরে হাতাকাটা কালো কোট।। সাথে কুচকুচে কালো পাজামা, কালো সু, কালো চামড়ার বেল্টের ঘড়ি। সব মিলিয়ে ব্ল্যাক প্রিন্স লাগছে মানুষটাকে।। আর নিজের এতো কাছে আয়ানের পিংকিস ঠোঁট জোড়ার দিকে তাকিয়ে মায়রার নিজেরই ঘোর ঘোর লাগছে।। আয়ান কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেদিকে হুঁশ নেই মায়রার।। তবে এই মানুষটা তাকে যেখানেই নিক না কেন নির্দ্বিধায় সেখানে পাড়ি জমাতে পারবে মায়রা।।

মায়রা এসব ভাবতে ভাবতেই আয়ান মায়রাকে বাড়ির দরজার সামনে নামিয়ে আলতো করে একটা হাত ধরলো।। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি খেলা করে যাচ্ছে আয়ানের।। আর মায়রার চোখে কৌতূহল।।

-এসো পাগলীটা?? বাকিটা পরে ভাবো কেমন??!!

আয়ানকে দেখতে দেখতে কিসে যেন পা দিয়েছে খেয়াল নেই মায়রার।। পা ভিজে যেতেই নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলো আলতা ভরা একটা কাঁসার প্লেটে পা দিয়ে দিয়েছে।। ড্যাবড্যাব করে আয়ানের দিকে তাকালো মায়রা। ওর পায়ে জুতো ছিল।। সেটা গেল কোথায়!!! আর আলতা কোথা থেকে এলো!!?? এদিকে মায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে হালকা করে মায়রার হাত ধরে এনে কিছু একটার উপরে দাঁড় করালো।। সেখানে খুব সুন্দর করে মায়রার পায়ের ছাপ বসে গেছে। আয়ান জিনিসটা দেয়ালে টাঙিয়ে এসে মায়রাকে আবার তুলে নিল পাঁজাকোলা করে। 

একটা রুমে এনে মায়রাকে নামিয়ে দিলো আয়ান।। এই রুমটাও মায়রাদের বেডরুমের ধাঁচেই সাজানো। একপাশ ভর্তি করে বুক শেল্ফ, চেয়ার, রকিং চেয়ার, বড় একটা কাঁচের টেবিল।। অন্য পাশে বেড, ওয়ারড্রব, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল-আরো খুঁটিনাটি জিনিস।। মায়রা আয়ানের মুখের দিকে তাকাতেই একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিলো আয়ান।। মায়রার মুখের একদম কাছে এসে মুখটা আলতো করে তুলে ধরলো।।

-তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ছাদে এসো পরী।। দেরি করলে কিন্তু পরে আমি এসে রেডি করাতে হলে----।।

-যাও-----।।

শপিং ব্যাগটা খুলে অবাক হয়ে গেলো মায়রা।কালো লেইস বসানো নেভি ব্লু কালারের একটা কাতান শাড়ি ব্যাগে। সাথে নীল অপরাজিতা ফুলের তৈরী নানা রকমের গয়না।। হাতের বালা, মাথার টিকলি, কানের দুল, নাকের নথ, কোমড়ের বিছা হার- সবটাই নীল অপরাজিতা ফুলের তৈরী।। আর সাথে আয়ানের দেয়া লকেট।। শাড়ি আর ফুলের সাজে একদম রেডি হয়ে আয়নায় নিজেকে দেখলো মায়রা। নিজেকে দেখে নিজেই লজ্জা পেল।। তবে কিছু জিনিস মিসিং আজকে। সবুজ কাজল, নীল টিপ-- এসব দিতে ভুলে গেছে মানুষটা!!? 

আলতো পায়ে ধীরে ধীরে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো মায়রা। ছাদে এসে এতোটা অবাক হতে হবে ভাবতেই পারেনি মেয়েটা। ছাদের রেলিংগুলোয় ছোট ছোট মোমবাতি আর বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। ছাদের মাঝামাঝিতে বেডিয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।। তার একটা পাশেই একটা ছোট্ট টেবিল আর একটা চেয়ার রাখা।। টেবিলের উপরও মোমবাতি জ্বলছে।। এখানে আলোটা একটু বেশি।। টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে  আয়ানকে খুঁজছে মায়রা।। মানুষটা কোথায় গেল!!! ভাবতে ভাবতেই কেউ একজন হাত টেনে মায়রাকে নিয়েই চেয়ারে বসে পড়লো।। 

-আরে!!!???

-ম্যাডাম?? আমি তো!! হা করেন তো একটু?? না খেয়ে কিছু করার কথা ভুলে যান---।।

-আমি কিছু-----!!??

কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই আয়ান মায়রার মুখে চামচ পুরে দিলো। আজও মায়রার পছন্দের নুডুলস করেছে আয়ান। সেই মায়ের হাতের রেসেপির মতো হয়েছে আজও টেস্ট। খাওয়া শেষ করে মায়রার মুখে হাত দিয়ে মুখটা তুলে ধরলো।।

-আজকে পাগলীটার সাজে ফিনিশিং টাচটা আমিই নাহয় দিই??!

-হুম!!??? 

আয়ান পকেট থেকে কিছু একটা নিয়ে টেবিলের উপর রাখলো। মোমের আলোয় প্যাকেটটা দেখলো মায়রা। একটা নীল টিপের পাতা। আয়ান সেখান থেকে একটা টিপ মায়রার কপালে পড়িয়ে দিয়ে কপালে আলতো করে চুমো খেল।।  তারপর একটা কৌটো খুলে হালকা করে কালো আইলাইনার দিয়ে সবুজ কাজলটা পড়িয়ে দিলো।। সবুজ কালো মিলে অন্যরকম একটা রঙ মায়রার চোখ দুটোকে আরো মায়াবী করে তুলেছে।। দেখতে দেখতে নেশা ধরে যাচ্ছে আয়ানের। আর আয়ানের মুগ্ধ বিস্মিত চোখের চাহনিতে মায়রার ঘোর লাগছে বারবার।।

বেশ অনেকক্ষণ রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে আয়ান আর মায়রা আকাশের চাঁদটাকে দেখছে।। অবশ্য আয়ানও দেখছে বললে ভুল হবে।। সে তার মায়াপরীটাকে দেখছে। পরীটা আজ নীলপরী হয়ে তাকে ধরা দিয়েছে-সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে- ভাবতেই আয়ানের বেশ লাগছে।। আর মায়রা লজ্জায় টুকটুকে লাল হয়ে যাচ্ছে।। মানুষটা এভাবে তাকিয়ে থাকলে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে না ওর??! তবু কেন তাকিয়ে থাকতে হয় তার সারাদিন!!?? 

মায়রার চুলগুলোও আজ খোলা।। বাতাসের ঝাপটায় চুলগুলো বারবার এসে আয়ানের মুখে এসে লাগছে। কোনমতেই ধরে রেখেও সেটা আটকাতে পারছে না মায়রা। আর মায়রার এতো চেষ্টা দেখে হেসে ফেললো আয়ান। আলতো করে মায়রাকে আবার পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।।টেবিলের উপরে থাকা রঙিন  মোমবাতিগুলো ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে মায়রাকে ফোমের বেডিং এর উপরে শুইয়ে দিলো আয়ান। রেলিঙের উপরে জ্বলতে থাকা ছোট্ট  মোমবাতিগুলো মিটিমিটি করে নিজেদের শেষ সময়ের আলোটা জ্বালাচ্ছে।। আধো মোম আর চাঁদের আলোয় আয়ান মায়রার পাশে বসে অপলকে দেখছে।। মেয়েটার সাজহীন আনকোরা মুখটা আয়ানের বুকের ভেতরটায় কাঁপন ধরাচ্ছে বারবার।।কাজলে রাঙানো চোখের লাজুক চাহনি যেন আয়ানকে মায়রার দিকে আহ্বান জানাচ্ছে হাত বাড়িয়ে।।। আয়ানও আর দেরি না করে মায়রার সাথে পাড়ি জমালো ভালোবাসার সমুদ্রে।।

দুটো মানুষের ভালোবাসার সাক্ষী হয়েই যেন চাঁদটা মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে।। তারাগুলো মিটিমিটি হাসছে যেন দূর আকাশে। মিটিমিটি মোমবাতিগুলোও যেন লজ্জা পেয়ে নিভে গেছে।। ওদের দুজনের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে টেবিলের উপরে জেগে রইলো চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করা এক জোড়া সবুজ কাজলের কৌটো।৷ 



                                           ***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন