অচেনা অতিথি - পর্ব ৩০ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


তিতির ড্রাম ভর্তি রাগ মাথায় করে নিয়ে মাহাদের উপর ঢালার জন্য মাহাদের কাছে উপস্থিত হতেই মাহাদ বলল, " আপনার ক্লাস শেষ!
তিতির আপনার সাথে পরিচয় করে দেই। আমার কাজিন "পারিজা"। আমরা এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম আপনাকে নিয়েই যাই। 


তিতির পারিজাকে সালাম দিয়ে কোন কথা না বলে গাড়ীর পিছনে গিয়ে বসলো। শুধু মেয়েটা মাহাদের কাজিন বলে ও আজ বেঁচে গেল । কারন এখানে কিছু বললে শেষে বাসায় সমস্যা হতে পারে।


মাহাদ পারিজাকে নিয়ে গাড়ীতে উঠেই সামনের গ্লাসে তাকিয়ে দেখলো, তিতির বোতলের সব পানি  ওর মাথায় ঢেলে দিচ্ছে। তিতিরের এহন কান্ড দেখে মাহাদ কিছুটা ভয় পেল। শেষে না জানি পারিজার সামনে সিনক্রিয়েট করে। আল্লাহ্ রক্ষা করো এবারের মত। আর কোনদিনও এমন কাজ করবোনা।


তিতির ওর বোতলের সব পানি মাথায় ঢেলে বোতল ব্যাগে ভরলো তারপর সামনের দিকে তাকালো।
মাহাদ ততক্ষনে গাড়ী স্টার্ট দিতেই গাড়ী চলতে লাগলো। 


মাহাদ এখানে একটা রেস্টুরেন্ট ছিলনা! এখন দেখছি পুরো প্লেসই চেঞ্জ। রেস্টুরেন্টটা কি এখনো আছে?

" মাহাদ গম্ভীর গলায় বলল," হুম"

" তাহলে চলনা রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসি। সেই কবে তোর সাথে এখানে এসেছিলাম!"

" মাহাদ মনে মনে পারিজাকে ঝাড়ি দিয়ে বলল," আরে চুপ করে থাকনা মা। কেন ঝাপি থেকে বিড়াল বের করছিস! আমার সুখের সংসার দেখছি তুই তছনছ করে ছাড়বি।"

" কি হল মাহাদ! কথা বলছিসনা যে? কোনদিকে তোর মন!"

" আজরাঈল, আজরাঈলের দিকে মন আমার। তাতে তোর কোন সমস্যা আছে! কোন রেস্টুরেন্ট-ফেস্টুরেন্টে যাওয়ার দরকার নেই। বাসায় চল, আমার হাতে অনেক কাজ আছে।"

পারিজা মাহাদের কাধেঁ চাপড় দিয়ে বলল," তুই খুব কিপ্টা হয়ে গেছিস মাহাদ। আগেতো এমন ছিলিনা! 

" আগে ছিলাম সিঙ্গেল আর এখন ডাকুরানীর সাথে বসবাস আমার। এমনি এমন করছি। বাসায় গিয়ে যে কি পরিস্থিতি সামলাতে হবে সেটা শুধু আমিই জানি। আয়নায় তিতিরকে দেখে মনে মনে বলল," বোম ফাটলো বলে।" মাহাদ সব কথা মনে মনেই বললো। "

" কিরে গাড়ী থামাবি তো! না আমি কিছু করবো!"

" মাহাদ বাধ্য ছেলের মত গাড়ী ব্রেক করলো। এই মেয়ে আজ আমায় চিরিত্রহীন করেই ছাড়বে।"

পারিজা পিছন ফিরে তিতিরকে বলল," তিতির, তুমি আমাদের সাথে যাবে তো!"

" ওর ওখানে যাওয়ার কি দরকার! ও গাড়ীতেই থাক। আমরা যাবো আর আসবো তো।"

" তিতির চট করে নিকাব খুলে বলল, " আপু আমার নিকাব ভিজে গেছে। আপনার স্কার্ফ টা দিবেন! তাহলে আমিও আপনাদের সাথে যেতে পারতাম।"

তিতিরের কথা মাহাদের কানে বোমা বিষ্ফোরনের মত শোনাল। তিতির কি করতে যাচ্ছে!

" ওকে বলে পারিজা তিতিরকে ওর লম্বা স্কার্ফটা দিয়ে মাহাদকে নিয়ে গাড়ী হতে বের হল।"

তিতির এই সুযোগে বোরখা খুলে চুল একপাশে দিয়ে স্কার্ফটা একদিকে ফেলে দিয়ে গাড়ী থেকে বের হল।

এবার মাহাদকে দেখার মত আর অবস্থায়  নেই। প্রচন্ড রেগে চোখমুখ লাল হয়ে গেল। কোন কথা না বলে রেস্টুরেন্টের ভিতর চলে গেল।

পারিজা তিতিরের দিকে চেয়ে বলল," তিতির তোমার এগুলো কি আসল চুল!"

তিতির মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল, " আপু গায়ের শক্তি দিয়ে টেনে দেখতে পারেন।"

" নাহ্ ঠিক আছে। তুমি অনেক কিউট একটা মেয়ে।"

তিতিরকে নিয়ে পারিজা রেস্টুরেন্টের ভিতর চলে গেল। গিয়ে দেখলো কর্নারের টেবিলে মাহাদ বসে আছে চুপ করে। পারিজা আর তিতির বসতেই ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো।

পারিজা হেঁসে বলল," আমি কি পছন্দ করি তুই দেখি কিছুই ভুলিসনি।"

মাহাদ কঠিন গলায় বলল," কিছু কিছু  জিনিস আছে যা কিছুতেই ভোলা যায়না আর কাউকে ক্ষমাও করা যায়না।"

পারিজা কথাগুলো না বুঝতে পারলেও তিতির ঠিকিই বুঝতে পেরেছে। মাহাদ কথাগুলো ওকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে।

তিতিরের এবার নিজেরই খুব খারাপ লাগলো। মাথা নিচু করে খেয়েই চলছে। তিতিরের একটা খারাপ অভ্যাস আছে সেটা হল খুব খারাপ লাগলে অথবা টেনশন করলে ও আনলিমিটেড খেতে পছন্দ করে। এতে নাকি কিছুটা হলেও সে শান্তি পায়। এখানেও তার ব্যাতিক্রম ঘটছেনা।

ইতিমধ্য অনেক ছেলে মাহাদের সামনে থাকা দু'টি মেয়ের দিকে নজর দিয়েছে। মাহাদ উঠে গিয়ে বিলটা মিটিয়ে এসে তিতিরের হাত ধরে ওকে তুলে পারিজাকে বলল,"অনেক খেয়েছিস ওঠ এবার।"

তিতির এবার ভয়ে শেষ। ওপেনপ্লেসে যদি মাহাদ ওর হাত ধরতে পারে তাহলে ও এখন সব কিছু করতে পারে মানে সব কিছু। তারমানে ও এবার তিতিরের অবস্থা খারাপ করে ছাড়বে। কি করতে কি হয়ে গেল.............

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে এসে তিতিরকে গাড়ীর সামনে দার করিয়ে মাহাদ সবার সামনেই তিতিরের থুতনিটা শক্ত করে চেঁপে ধরে বলল, " আমিতো দেখছি, আমার ভয়েই তুমি এতদিন ধরে পর্দা করতে! নিশ্চয় আল্লাহ্ কে ভালবেসে করতে না?"

পারিজা এসে মাহাদ কে ধমক দিয়ে বলল," কি করছিস তুই! রাস্তার সবার দেখছে। ছাড় ওকে....."

চুপ......।  পোষাকের কোন শালীনতা নেই। এই পোষাকে যদি কোনদিন আমার সামনে আসিস তাহলে ওখানেই তোকে মাটির নিচে পুঁতে ফেলব।

মাহাদ গাড়ী থেকে বোরখা নিয়ে তিতিরের দিকে ছুড়ে মারলো। কখনো যদি দেখেছি তুমি আমাকে রাগানোর জন্য এসব নোংরামি কাজ করছো তাহলে আমি মাহাদ কি করবো সেটা আমার নিজেরও জানা নাই। 

তোকে রাগানো মানে! তিতির তোর কে হয়? এভাবে কনফিডেন্স সহকারে ওর সাথে এত খারাপ ব্যবহার করার তুই কে! তোদের স্বাধীনতা আছে আর আমাদের স্বাধীনতা নেই!

পারিজার কথা শুনে মাহাদ আরো রেগে গেল। মাহাদ পারিজার সামনে ডিক্লেয়ার দিয়ে বলল, " তিতির আমার বিয়ে করা বউ । এই জন্য ওর উপর শুধু একমাত্র আমারই অধিকার আছে আর আমার উপর ওর। 

নারীর স্বাধীনতা মানে এই নয় যে, সব পর-পুরুষকে নিজের রুপ দেখিয়ে বেরাতে হবে। আর পুরুষের চোখের লালসার শিকার হতে হবে। আর এতই স্বাধীনতা স্বাধীনতা যদি করিস তাহলে মুসলিম ধর্ম আর নাম দুটাই লাইফ থেকে বের করে দে। কারন বেপর্দা হতে ইসলামে নিষেধ আছে। যেখানে তুই সৃষ্টিকর্তার কথা মানবিনা সেখানে শুধু শুধু নিজেকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেওয়াটা একদম বেমানান পারিজা। 

তোদের এরকম চলাফেরার কারনে, তোর মত পারিজার কিছু না হলেও রাস্তার নিঃস্পাপ শিশুরা ঠিকিই দিনের পর দিন ধর্ষন হচ্ছে।

মাহাদের কথা শুনে পারিজার চোখ বিষ্ফোরিত হয়ে গেল। মাহাদ, তুই বিবাহিত?  ফুফু জানে তুই এই মেয়েকে বিয়ে করেছিস! তাও একই বাসায় দু'জনে  বসবাস করছিস! 
আল্লাহ্ আমি কি শুনলাম। ফুয়াদ ভাইয়ার কথা ভুলে গেছিস? আমি আর তোদের বাসায় যাব না। আমাকে বাসায় নেমে দিয়ে আয়। আমার মুখ ফসকে কি না কি বের হবে সেটা জানা নেই। আমি তোদের চোখের সামনে না থাকলেই বরং তোরা সেভ থাকবি বলে পারিজা গাড়ীতে উঠে বলল," তিতির আসো।"

ওরে নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবেনা। চল তোকে ড্রপ করে আসি বলে মাহাদ তিতিরকে রেখে গাড়ীতে উঠে পারিজাকে নিয়ে চলে গেল।

♦♦♦♦

পারিজাকে বাসায় নামিয়ে দিতেই মাহাদের মামা ব্যালকুনি থেকে মাহাদকে বাসায় ডাকলো। মাহাদ আর কি করবে বাধ্য হয়ে বাসার ভিতর ঢুকলো। তিতিরকে ওখানে দাড়িয়ে রেখে আসছে তাই তিতিরকে কয়েকবার কল দিল কিন্তু রিসিভ হয়না। মাহাদ ভাবলো হয়ত রাগ করে এতক্ষন বাসায় চলে গিয়েছে তিতির। 
বাসায় ঢুকতেই মাহাদের নানী এসে বলল," মাহাদ, ভুলে এই বাসায় আসছিস নাকি!

মাহাদ ওর নানীকে সালাম দিয়ে বলল," কেমন আছেন নানী আপি!"

" আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। বাসার সবাই ভালো আছে! তোর মা কেমন আছে?"

" জ্বী আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছে।  বসে কিছুক্ষন গল্প করতেই পারিজা সালোয়ার কামিজ পড়ে এসে দাড়ালো মাহাদের সামনে। তারপর বলল," এবার ঠিক আছে?"

" মাহাদ কিছু না বলে ওর মামাকে জিঙ্গাসা করলো," মামা, পারিজাকে বিয়ে করাচ্ছেন কবে? আমরা সবাই অপেক্ষায় আছি পারিজার বিয়ে খাবো বলে।"

পারিজা ফোঁস করে উঠলো। আমার বিয়ের চিন্তা তোকে করতে হবেনা। আমি তোর মত না বলে জ্বিভে কামড় দিল পারিজা।

মাহাদ সাথে সাথে চোখ গরম করে পারিজার দিকে তাকালো। তারপর বলল," তোর জন্য চিন্তা করতে যাবো কোন দুঃখে! আমিতো বিয়েতে মজা করার ভাবনা ভাবছি।

মাহাদ সবার সাথে অনেক গল্প আর মজা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তিনটা মামার ৭ জন ছেলেমেয়ে। অনেকদিন এখানে আসা হয়না।
বিকাল অবদি ওখানেই কাটিয়ে দিল।  

কিছুক্ষন আগে নিসার কল আসলো। নিসার কান্নার শব্দে মাহাদের বুকটা কেঁপে উঠলো। মাহাদ আর একমুহুত্বও দেরি না করে গাড়ী নিয়ে ছুটে চললো। ওদের বাসায় যখন পৌছালো তখন মাগরিবের  আযান হচ্ছিল চারদিকে। মাহাদ দ্রুত সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে কলিংবেল বাজাতেই নিশা ঝট করে দরজা খুলে দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

মাহাদ নিসাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিতেই নিধি এসে মাহাদের হাতটা ধরে চুপ করে দাড়িয়ে রইল। নিধির এমন আচরনে মাহাদের অবস্থা শেষ। কি হল এদের। মাহাদ নিধিকে কোলে তুলে সোফায় বসে বলল," কি হয়েছে নিসা! এমন করে কাঁদছিস কেন!"

নিসা ওর রুমে দৌড়ে চলে গেল। তারপর একটু পড়ে বের হয়ে এসে মাহাদের হাতে ৭টা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলল," দেখনা মাহাদ, তোর ভাইকে কারা যেন মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। প্রতিটা চিঠির শুরুতে নিধিকে হত্যার পরিকল্পনার কথা আগে বলেছে।"
নিসা কেঁদেই চলছে আর মাহাদ এক এক করে  সব চিঠি পড়ছে।

চিঠিগুলোতে খুব কঠোর ভাষায় হুমকি দেওয়া হয়েছে। মাহাদ চিন্তিত স্বরে বলল," ভাইয়া কোথায়!"

" ওতো এখনো অফিসে আছে। তোর ভাইয়াতো হাসি দিয়ে উড়ে দিছে সব কথা। বলে এই ডিপার্টমেন্টে থাকলে নাকি এই রকম ধুমকি সবাই মারে। আমি ওকে কিছু দিয়েই কিছু বোঝাতে পারছিনা। "

মাহাদ নিধিকে রেখে বলল," ভালো করে দরজা জানালা সব কিছু বন্ধ করে রাখ। আর আমি কলিং বেল বাজাতেই পিপহোলে না দেখেই কেন খুলে দিছিস! তুই যদি সাবধান না হস তাহলে নিধিকে প্রট্রেক্ট করবি ক্যামনে! এত কেয়ারলেস হলে চলবে! যতই কেউ কলিংবেল বাজাক না কেন! আমি কল না দেওয়া অবদি দরজার সামনে পযর্ন্ত আসবিনা।

মাহাদ চলে যেতেই নিসা দরজা জানালা সব কিছু বন্ধ করে রেখে নিধিকে নিয়ে ওর রুমের খাটে গিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

♦♦♦♦

মাহাদ হাজারো চিন্তা ভাবনা করতে করতে ফুয়াদের অফিসে গিয়ে পৌছালো। তখন প্রায় রাত আটটার কাছাকাছি। সবাই মোটামুটি মাহাদকে চিনে তাই ভিতরে যেতে কোন রকম বেগ পেতে হলনা। ফুয়াদের কামরা থেকে চিৎকার চেঁচামিচির শব্দ আসছে। মাহাদ দ্রুত কামরার সামনে যেতেই দেখলো, একদল লোক ফুয়াদের সাথে ঝগড়াতে লিপ্ত হয়েছে। তারা ফুয়াদকে নানান ভাবে হুমকি দিচ্ছে। এদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব ক্ষমতাশালী লোক এরা। সাথে একজন নেতাও আছে। তাই দাপটটা একটু বেশিই দেখাচ্ছে। শেষে এক নেতা বলল," আমার শালাকে ছেড়ে দে। আজ যদি তোর জন্য আমার বউয়ের চোখ থেকে আর এক ফোঁটা জল পড়েছে তাহলে কাল তোর লাশ এই পুলিশ স্টেশনের সামনে পড়ে থাকবে। কয়েকদিন ধরে ভালো করে বলছি কথা কানে যাচ্ছেনা! 
কথা গুলো বলার পর একজন প্রকাশ্যতে ফুয়াদকে একটা ধারালো অস্ত্র দেখালো।


মাহাদ আর সহ্য করতে পারলোনা। সামনে এক হাবিলদার লাঠি নিয়ে দাড়িয়ে ছিল। সেখান থেকে লাঠি নিয়ে ওদের সামনে গেল। যে ফুয়াদকে মারার হুমকি দিয়েছিল তাকে বুক বরাবর একটা লাথি মারতেই সে চিয়ার সহ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। মাহাদ চিৎকার করে বলল," একজন সৎ পুলিশ অফিসার হতে বুকের পাঠা দরকার। আর তোরা সেই অফিসারকে এধরনের কথাবার্তা বলিস কোন সাহসে!"

মাহাদের অচমকায় আগমনে ফুয়াদ পর্যন্ত অবাক হয়ে গেল। এই পাগল এখানে কখন আসলো! এখন তো সব কিছু তছনছ করে দিবে। ফুয়াদ চিয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো।

আর বাঁকি সব নেতার চ্যালারা মাহাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মাহাদকে এবার পায় কে। লাঠি দিয়ে যাকে সামনে পেল তাকেই এলোপাথারি বাড়ি মারতে লাগলো। ওরা জানেনা মাহাদ একজন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কমান্ড আর্মি অফিসার ছিল। এমন মানুষের হাতে ম্যার যে কি হতে পারে সেটা তারা হারে হারে টের পেল। মাহাদ ওদের ফুয়াদের রুম থেকে মাইর শুরু করেছে আর পুলিশ স্টেশনের বাহিরে এসে ম্যার থামিয়েছে। মাহাদ ওর আঙ্গুল ঘুরিয়ে বলল," এখানে যদি আর এক মিনিট থাকিস তাহলে আবার প্রথম থেকে শুরু করবো।"

" শ্যালা তোদের দেখে ছাড়ব বলে খোড়াতে খোড়াতে তারা চলে গেল।"

মাহাদ ফুয়াদকে নিয়ে বাসায় চলে আসলো। রাস্তায় ফুয়াদ মাহাদকে  অনেকগুলো বকা দিল। কেন মাথা গরম করিস। সব জায়গাতে মাথা গরম করতে নেই সেটা জানিসনা?

দুই ভাই এসে দরজায় দাড়াতেই শুনলো এই বাসার দাড়োয়ানকে কারা জানি প্রচুর মেরেছে কিছুক্ষন আগে। ফুয়াদ সব বুঝতে পেরেই দৌড় দিল উপরে, পিছে মাহাদও।

দরজায় গিয়ে বার বার কলিংবেল বাজানোর পরও দরজা খুলছেনা নিসা। আশেপাশে ফ্লাটের সবাই বের হয়ে আসলো তবুও দরজা খুলছেনা নিসা। শেষে মাহাদ নিসাকে কয়েকবার কল দিতেই নিসা কল রিসিভ করে বলল," মাহাদ তুই কই! তোর ভাইয়া ঠিক আছে তো?"

" সবাই ঠিক আছে। তুই আগে দরজা খোল। আমরা দরজার বাহিরেই দাড়িয়ে আছি। এবার নিসার বুকে যেন সাহস ফিরে এলো। নিধিকে কোলে নিয়ে ডাইনিং রুমে এসে দরজা খুলে দিতেই ফুয়াদ এসে নিসাকে সহ নিধিকে একসাথে  জড়িয়ে ধরলো। এর পর ফুয়াদ নিধিকে কিসের উপর কিস করে বলল, " মা তুমি ঠিক আছো? এই তো বাবা এসে গেছে আর কোন ভয় নেই।  বাবা সব কিছু ঠিক করে দিবে।"

মাহাদ ভিতরে ঢুকতেই নিসা কাঁদতে কাঁদতে বলল," মানুষ এত নির্দয় আর পশুর মত স্বভাবের কি করে হয়! আমার চোখের সামনেই বুদ্ধ দাড়োয়ান চাচাকে কিভাবে এলোপাথারি ছুড়ি মারলো। জানিনা উনি কেমন আছেন।"

"উনি ঠিক আছেন। ওনাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। টেনশন করিসনা নিশা, সব ঠিক হয়ে যাবে। "

মাহাদের কথা  শুনে নিসা চিৎকার করে বলল," কোন কিছু ঠিক হয়ে যায়নি, আর ঠিক হয়েও যাবেনা। তুই কিছু জানিস! আজ দিয়ে ১০টা দিন হল আমি ঠিকমত ঘুমাতে পারিনা। তোকে ফোন করে যে কিছু বলবো সেটাও তোর ভাই বলতে নিষেধ করেছে। প্রতিদিন নামাযের বিছানায় বসে থাকি ছোট মেয়েটাকে নিয়ে তোর ভাইয়া না আসা পর্যন্ত। ওকে বলে দে, ওর এই জব করতে হবেনা। আমার কিছু দরকার নাই।  আমি না খেয়ে থাকবো কিন্তু স্বামী সন্তান নিয়ে নির্ভয়ে বিছানায় ঘুমাতে যেতে পারবো তো! আমার এতকিছু দরকার নেই।"


নিশা এসব কি হচ্ছে! তুমি আমার জিবনে আসার আগে থেকে এই জবটা করছি। তুমি জেনে শুনেই আমার কাছে এসেছো। এখন এসব কেন বলছো! তুমি তো আগে থেকেই জানতে আমাদের এই পথে নিজেদের জিবন হাতে নিয়ে চলাফিরা করতে হয়।


চুপ করবা তুমি! আগে তোমার জিবন একা ছিল। এখন তোমার জিবনের সাথে তোমার স্ত্রী-সন্তান জড়িয়ে আছে। তুমি একবারের জন্যও ভেবে দেখেছ! তোমার কিছু হয়ে আমাদের কি হবে। মাহাদ তোর ভাইকে অহেতুক যুক্তি দেখাতে নিষেধ কর। তুইও তো জব করতি তুই যদি সেটা ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জিবনে ফিরে আসিস তাহলে ও কেন পারবেনা। দুনিয়াতে কি কাজের অভাব আছে! আর টেনশন নিতে পারছিনা মাহাদ। আমাদের আশেপাশে সাহার্য্য করার মত কেউ নেই।


এবার মাহাদ নিসাকে জোড়ে একটা ধমক দিয়ে বলল," যার নামে তুই এত অভিযোগ করছিস, ভুলে যাসনা সে তোর হ্যাসব্যান্ড এর আগে আমার বড় ভাইয়া। তোর থেকে আমার বা আমাদের বিন্দু পরিমানে চিন্তা কম নেই।"
মাহাদের এক ধমকে নিসা সহ নিধি চমকে উঠেছে। মাহাদ মাথা ঠান্ডা করে বলল," চিন্তা করিসনা, আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করছি।"

মাহাদ দুরে সরে গিয়ে কাকে যেন কল করলো। তারপর নিসাকে বলল, " ইনশাল্লাহ্ সমস্যা সমাধান করেই বাসায় ফিরবো।"

কথাটা বলে মাহাদ বাসা থেকে চলে গেল। ফুয়াদ নিষেধ করা সত্ত্বেও মাহাদ চলে গেল। 

মাহাদ ওর কয়েকজন ফ্রেন্ডকে  নিয়ে প্রথমে বাসার তারপর পুলিশ স্টেশনের সিসি ফুটেজ সংগ্রহ করে আরো উপর লেবেলের কর্মকর্তার কাছে দরখাস্ত করে পাঠিয়ে দিল। তারপর সব কিছু নিয়ে থানায় একটা এ্যাটেম টু মার্ডারের  ডাইরী করলো। সবকিছু কাজ কমপ্লিট করে বাসায় ফিরার পথে মাহাদের ফোনে একটা কল আসলো।
মাহাদ কল রিসিভ করেই লাউড স্পীকারে রাখল।

" আজ থেকে মৃত্যুর দিন গুনতে শুরু কর। রাস্তা-ঘাট, জলে-স্থলে যেখানেই থাকিসনা কেন পারলে তুই তোর মৃত্যুকে ঠেকাস। কোনো স্থানে তুই নিরাপদ না। প্রয়োজন হলে তোর বাসার গেটের সামনেও তোকে মার্ডার করে রাখবো। আজ আমার শরীরে তোর দেওয়া যতগুলো আঘাত পড়েছে,  খোদার কসম করে বলছি সেই ঘা গুলো শুখানোর আগেই তোকে দুনিয়া থেকে বিদায়ের ব্যবস্থা করবো। আমার প্রথম টার্গেট এখন তুই। ফোনের ওপাশ থেকে অত্যান্ত ক্রোধের সাথে কথাগুলো ভেঁসে আসলো।

" কার মারা কে মারে, যার রব তাকে নিজে সয়ং রক্ষা করবে তাকে কারো মারার সাধ্য নেই। আমার রিযিক দুনিয়া থেকে শেষ হয়ে গেলে তখন এই মাহাদের দিন এমনি ফুরিয়ে যাবে। তুই কি ভেবেছিস তোর ভয়ে আমি তোর হাত-পা ধরবো! ভাই আমার প্রান ভিক্ষা দেন! থু্,,,,,,হ্ বলেই মাহাদ গর্জে উঠলো। বাবা-মা আমার নাম মাহাদ রেখে আফসোস করে। কারন মাহাদ নামের অর্থ মৃত্যু। আমি নিজেই মৃত্যুর নাম নিয়ে দুনিয়াতে অবস্থান করছি। এই মাহাদকে তুই কি মৃত্যুর  ভয় দেখাবি!
জিবনে অনেক পাপ করেছিস।  তুই আমাকে কি করবি জানিনা কিন্তু এবার তুই নিজেকে বাঁচা তারপর আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস। 

মাহাদ গাড়িতে একটা থাবা দিয়ে বলল, " ভুল জায়গায় এবং ভুল মানুষের পিছে লেগেছিস। ছোট ছোট খেলোয়ারের সাথে এতদিন খেলেছিস। আমার মত প্রতিপক্ষের সাথে খেলতেও যোগ্যতা লাগে। সেই যোগ্যতা এখনো তোর হয়ে ওঠেনি। মাঝ রাস্তায় মারা পরবি। তুই জানিস তো পাপ বাপকেও ছাড়েনা। নেতা হয়েছিস! তোর মতো নেতাকে আমার........ কাটিনা।"

কথাগুলো বলেই কল কেটে দিল মাহাদ। 


মাহাদ যাই বলিসনা কেন! এই লোকটা ভিষন খারাপ। এই শয়তান লোকটা মানুষের লাশের উপর ওর ক্ষমতা দাড় করিয়েছে। তাহলে ভাব কতটা ডেঞ্জারাস এই লোকটা। তোর ওভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। যদিও আমরা জানি তুই অত্যাধিক একটা ট্যালেন্ট ছেলে। মেধা দিয়ে তোকে পরাস্ত করা খুব কঠিন। কিন্তু মানুষের ভাগ্য কোথায় কি ফের ফেলায় সেটা উপরওয়ালা ছাড়া কেউ বলতে পারবেনা। ( মোতালেব)

মাহাদ গম্ভীর মুখে ড্রাইভ করে আবার ফুয়াদের বাসায় আসলো।  ফ্রেস হয়ে ডাইনিংরুমে এসে দেখলো, সবাই বসে আছে আর নিধি ওর বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে।

মাহাদ সোফায় বসে বলল," ভালয় ভালয় রাতটা কাটাতে পারলেই দুঃশ্চিন্তা কমে যেত। ইনশাল্লাহ্ কাল খুব ভালো একটা রেজাল্ট পাওয়া যাবে।"

সবাই মিলে রাতের খাবার খেয়ে মাহাদ আর ওর চার ফ্রেন্ড এক রুমে ঘুমাতে গেল। ফ্রেন্ডরা মিলে কিছুক্ষন পরামর্শ করে কেবল মাহাদের চোখটা লেগেছে এমন সময় ওর ফোন বেজে উঠলো। মাহাদ চোখ বন্ধ করা অবস্থায় কলটা কেটে দিয়ে  ঘুমানোর চেষ্টা করতেই আবার কল বেজে উঠলো। মাহাদ এবার বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে ফোনের স্কীনে দেখলো আসমার নাম ভেসে উঠেছে। এতরাতে আসমা! 
মাহাদ কলটা রিসিভ করে বলল," আসমা, এতরাতে কল দিয়েছো কেন!"

" ভাইজান, আপা কি আপনার কাছে আছে!"

" মাহাদ ধড়পড় করে উঠে বসে বলল," না তো! বাসার সব কিছু ঠিক আছে তো!"

" ভাইজান কিচ্ছু ঠিক নাই। সেই সকালে তিতির আপা বাসা থেকে বের হয়েছে এখন অবদি বাসায় আসেনি। বাসার সবায় জানে আপা মৌ ভাবীর বাসায় গেছে। কিন্তু আমি আর ভাবিতো নিজেও জানিনা আপা কই?"

" তিতির বাসায় ফিরেনি আর তুমি এখন সেটা আমায় বলছো! একটা মাত্র তোমাকে কাজ দিয়েছি সেটাও তুমি ঠিকমত পালন করতে পারোনা!"

" ভাইজান আমাকে মাফ করে দেন বলে কেঁদে উঠলো আসমা। মৌ ভাবীকে বলেছিলাম। তিনি ভেবেছিলেন আপা হয়ত আপনার সাথে আছে। তাই আপাকে সেভ করার জন্যই তিনি সবাইকে বলেছেন আপা ওনার বাবার বাসায় গেছে। আর আপনিও তো সেই সকালে বের হয়ে গেছেন। তারপর আর আসেননি। আমি ভাবছি আপনার সাথেই আপা আছেন।"

" এই তোমার মাথা পাগল হয়ে গেছে বলে জোড়ে একটা ধমক দিল মাহাদ আসমাকে। যেই মৌ ওর নিজের বাচ্চারই খেয়াল রাখতে জানে সে তিতিরের খেয়াল রাখবে সেটা তুমি কি করে ভাবলে!"

মাহাদ ঠাস করে কলটা কেটে দিল। বিপদের উপর বিপদ। তিতিরের মিসিং হওয়াটা মাহাদকে ভেঙ্গেচুরে চুরমার করে দিল। মাহাদের চিৎকারে রুমের সবাই জেগে উঠেছে ততক্ষনে। কারো আর অজানা রইলোনা, ইতিমধ্য কি ঘটনা ঘটে গেছে। এ যেন ফোটের উপর বিষফোঁড়া।

মাহাদ কোনরকমে গায়ে শার্ট জড়িয়ে রুম থেকে বের হতেই ওর ফ্রেন্ডরা বলল," তুই এতরাতে একা যাসনা। আমরা তোর সাথে যাবো।"

" তোদের এখানে থাকাটা বেশি জরুরি। তাছাড়া আমি চাই তোরা মায়ের ছেলে মায়ের কোলে সহিসালামতে ফিরে যা। আমার কিছু হয়ে গেলে আমার বাসায় যেন কিছু বলিসনা। অনেক সময় নিয়ে বলিস।" কথাগুলো বলে মাহাদ ডাইনিংরুমে আসতেই দেখলো, নিসা কিচেনে কাজ করছে। সারাদিন করতে পারেনি। তাই এখন সব গুছিয়ে রাখছে।"

মাহাদ নিসাকে ডেকে বলল, দরজাটা ভালোভাবে  বন্ধ করে দে।"

" এই তুই এতরাতে কোথায় যাচ্ছিস!"

" ভাবি ওকে যেতে দেন। ওর যাওয়া খুব জরুরি।"

" সোহাগের কথা শুনে নিসা চিৎকার দিয়ে ফুয়াদকে ডাকতে লাগলো। মাহাদের এক হাত ধরে ফুয়াদকে ডেকেই নিসা কেঁদে ফেললো। মাহাদ এত রাতে প্লিজ তুই যাসনা। পুরো রাত আমি ঘুমাতে পারবোনা। তার উপর তোর ভাইয়া আরো ঘুমাতে পারবেনা। ফুয়াদ কই তুমি। দেখ, মাহাদ এতরাতে কই যেন যাচ্ছে।"

" ফুয়াদ সাথে সাথে অন্য রুম থেকে বের হয়ে এসে বলল," মাহাদ এত রাতে কই যাচ্ছিস!"

মাহাদের আর মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছেনা। সোহাগ তিতিরের মিসিং হওয়ার কথাটা ফুয়াদকে জানালো। শেষে ফুয়াদ বলল, " মাহাদ আমিও তোর সাথে যাই।"

নিসা কাঁদতে কাঁদতে বলল," তোর বউই তোর কাছে সব! আমরা তোর কেউ না? এই বৃষ্টির রাতে তুই কই যাবি ওকে খুঁজতে!"

" নিসা, তোদের জন্য ভাবার অনেক কেউ আছে কিন্তু আমার তিতিরের জন্য আমি ছাড়া আর কেউ নেই।  "

 মাহাদ আর একমুহুত্বও দেরি করলোনা। দরজার বাহিরে আসতেই টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল পড়ে গেল মাহাদের চোখ দিয়ে। কারো আর পিছু ডাক মাহাদের কানে গেলনা। সমস্ত বিপদ আর ক্লান্তকে তোয়াক্কা না করে বেরিয়ে পড়লো অজানা পথে। কোথায় খুঁজবে তার প্রিয় মানবীটাকে। মাহাদ তিতিরের ফোনে কল দিতেই গাড়ীর পিছন সিটে তিতিরের ফোন বেজে উঠলো। দুপুরের কথাগুলো বড্ড পোড়াচ্ছে মাহাদকে । অজানা বিপদের ঝড়গুলো মাহাদের বুকে  আছড়ে আছড়ে পড়ছে। মাহাদ গাড়ীর স্প্রিট এত বাড়িয়ে দিল যে কারো সাথে একবার ধাকা লাগলেই কোন কৈফিয়ত ছাড়াই স্পর্ট ডেড........

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন