অচেনা অতিথি - পর্ব ৪২ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


বাতাসি গেটের কাছে যেতে যেতে কামরান সাহেব তার গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাতাসি চিক্কুর দিয়া দাড়োয়ানকে বলল," হারামজাদা দাড়োয়ান, এই দুপুর রাইতে তোরে দরজা খুলতে কেডাই কইছে। আর পুতের যদি কিছু হয় তাইলে জ্যান্ত তোরে মাটিতে পুতোম।"

দাড়োয়ান খুব ভয় পেয়ে গেল। কারন তিনি ভালো করে জানেন, এই মহিলাটা কতটা ভয়ঙ্কর।  মালিক বললো দেখেইতো গেট খুলে দিলাম। 

বাতাসি ফুসতে ফুসতে বাসার ভিতর এসেই লাবিবার সাথে ঝগড়া বেঁধে গেল। এই তুমি অ্যার পুতরে কি কইছ কও! কামু  অ্যার কথার কোনদিনও অমান্য করে নাই। আর আইজ হেই অ্যার কথা পর্যন্ত শুনলো না! ব্যাবাক দোষ তোমার। তোমারে সারা জিবন টানতে টানতে অ্যার জিবনডা শেষ হইয়া গেল। আজ আর পুতের যদি কিছু হইছে তয় আগে, তোমারে বাড়ি ছাড়া করমু। আজ বাতাসি প্রচন্ড খেপে গেছে। তার ঐ একখানই জাহানের টুকরা পোলা। সে কি কাউরে ছেড়ে কথা বলবে?

লাবিবা চুপ করে সোফাতে বসে চোখের পানি ফেলছে। বাসার সবাই হাজির। সবার টেনশন, এতরাতে ঐ ভাবে কামরান সাহেব কই গেলেন? মাহাদ ও টেনশনে পড়ে গেল। কারন ওর বাবার নাম্বারটা বন্ধ দেখাচ্ছে। 

মাহাদ নিচে আসতেই বাতাসি ওর কাছে দৌড়ে গিয়ে বলল," মাহাদ, অ্যাই তোরে কোনদিন আর জ্বালামুনা। অ্যার পুতটারে তুই আইনা দে। হের নাকি অ্যাই ছাড়াও আরো একখান আম্মাজান আছে।"

" তুমি চুপ করবা! সে আমারও বাবা। আমার কি চিন্তা হচ্ছেনা! আর মাকে এত বকাবকি করছো কেন? মাথা কি তোমার পাগল হয়ে গেছে?"

" তুই বুঝবুনা, আপনজন চইলা গেলে কি কষ্ট হয়। অ্যার মনে হয় তোর দাদা ইমতিয়াজ আরো একখান বিয়া কইরা বৌ লুইকা রাইখা গেছে। অ্যার কামু হের কাছে গেছে। ও বাপ কামুরে......  তোর বাতাসি আম্মাজানরে রাইখা কই গেলিরে। অ্যাই তোরে ছাইড়া ক্যামনে থাকুম। বাতাসি বিবি এবার সেন্সলেস হয়ে পড়ে যায়।"

এমনি বাবাকে পাওয়া যাচ্ছেনা তার ভিতর আবার বাতাসির এই অবস্থা মাহাদ যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে। 

রেজওয়ান এসে বাতাসিকে তুলে রুমে নিয়ে গেল। এত রাতে ডাক্তার পাওয়াও দুষ্কর ব্যাপার। তবুও রেজওয়ান ডাক্তারকে কল দিল। বাতাসির অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগল। 

♦♦♦♦

কামরান সাহেব হিনুদের বাসার গেটের কাছে এসে গাড়ীর হর্ন বাজাতেই দাড়োয়ান জোড়ে বলল," কে?"

কামরান সাহেব গাড়ী থেকে বের হয়ে এসে বলল," আমি মাহাদের বাবা, গেটটা খুলে দাও।"

দাড়োয়ান গেট খুলে দিল। কামরান সাহেব গাড়ী নিয়ে বাসায় ঢুকে সিড়িতে উঠতেই হিনু টর্চ লাইট নিয়ে ওদের ফ্লাট থেকে বের হয়ে আসলো। সিড়ির লাইটটা নষ্ট হয়ে গেছে ঠিক করা হয়নি। তাই কোন কিছু না ভেবেই বলে উঠলো, "কে ওখানে"?
মাহাদের বাবাকে দেখে রিতিমত চমকে উঠলো হিনু। আঙ্কেল আপনি এত রাতে! তাও এই অবস্থায়?  কিছু সমস্যা হয়েছে?

আরে মা আর বলোনা, সেদিন এসে আমার একটা জরুরি ফাইল ফেলে রেখে গেছি। ওটা একটা বিদেশি প্রজেক্টের ডিল করা ফাইল। রাতে ফোন করে বলল," ওটা সকালেই দরকার। বোঝই তো আমরা জিবনে বিজনেসকে কতটা গুরুত্ব দেই, তাই ওটা ছাড়া আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নাই। তাই বাধ্য হয়ে এত কষ্ট করেও এই রাতে আসতে হল।"

অহ্, তিতিরদের ফ্লাটে কলিংবেল বাজাল হিনু। কয়েকবার বাজাল। আসমা পিপহোলে দেখলো সব কিছু অন্ধকার। তাই চিৎকার করে বলল," কে?"

আসমা আমি তোমার হিনু আপু। দরজাটা খোল। কামরান আঙ্কেল এসেছেন।

আসমা চট করে দরজা খুলল। তারপর হিনু ওদের নিজেদের ফ্লাটে চলে গেল। কামরান সাহেব ভিতরে ঢুকেই বলল," আসমা, তিতির কোথায়?"

সাহেব, আপাতো সেই কখন থেকে দরজা বন্ধ করে আছে। রাতে খাবারও খায়নি। আজ গোলাবকে পর্যন্ত রুমে নেয়নি। বেচারা গোলাব দরজার সামনে মুখ গুজে বসে আছে। 

" আচ্ছা, আমি দেখছি। নিশ্চয় তোমরা খাবার খাওনি? আমরা সবাই একসাথে খাবো। তুমি সব রেডী করো।

" জ্বী সাহেব।"

কামরান সাহেব দরজার সামনে গিয়ে তিতিরকে ডাকলো। তিতির, বাবা দরজাটা খোল। আমি এসেছি....।

" কোন রিপ্লাই আসেনা তিতিরের।"

কামরান সাহেবের দুঃশ্চিন্তা বেড়েই চলছে। তিতির, কত দুর থেকে আসলাম আর তুমি দরজা খুলছোনা? এটা কেমন অসভ্যতামি?  বাবার বয়সী একজন মানুষকে কষ্ট দেওয়া!

" তিতির খট করে দরজা খুলে দিতেই আগে গোলাব রুমের ভিতর ঢুকলো। তিতিরের চোখ দু'টো ভিষন ফোলা আর লাল হয়ে আছে। মাহাদ এই অবস্থায় তিতিরকে দেখলে হয়ত শেষ হয়ে যেত।"

কামরান সাহেব মুচকি একটা হাঁসি দিয়ে বলল," তিতির দেখ! তোমার বুড়ো বাবাটা গায়ে  জামা পড়ার সময়টুকুও পায়নি। আমার আম্মাজান ডেকেছে বলে কথা। আমি কি সেটা ফেলতে পারি?"

তিতিরের কষ্টগুলো বুকের ভিতর যেন দলা পাকিয়ে রয়েছে। এবার তিতির ফুফিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,"
বাবা, আপনি  এত ভালো কেন? কেনো আপনি নিষ্ঠুর নন! কেনো আপনি এত সহজে আমাদের বিয়েটা মেনে নিলেন? কেনো আমার গালে কয়েকটা থাপ্পড় মেরে বললেননা যে আমি মাটি হয়ে চাঁদের পানে হাত বাড়িয়েছি? কেন আপনি এত নিয়মের মধ্য নিজেকে ভালো হিসেবে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন? আপনারতো এত ভালো হওয়ার কথা ছিলনা! আপনি কেনো এত ভালো হতে গেলেন? আর আপনার ছেলেই বা এত পারফেক্ট কেন? আমি আগে কখনো আমার চোখের সামনে  এত ভালো মানুষ দেখিনাই বাবা।"

কামরান সাহেব অত্যন্ত বিচক্ষণ মানুষ তাই সহজে সব কিছু ধরে ফেললেন। 
মা, আমি রাতে কোনো খাবার খাইনি। তোমার শাশুড়ি আমাকে শুধু লেবুর শরবত দিয়েছে। তুমি কি আমাকে খাবার দিবা? আমার খুব খুদা পেয়েছে। আমার তো মনে হয়, মাঝে মাঝে নিয়ম ভাঙ্গার মজাই আলাদা তাইনা?

তিতির আর কথা না বাড়িয়ে চোখের পানি মুছে চলে গেল এবং আসমার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে দ্রুত কাজ করতে লাগল। এদিকে কামরান সাহেব ফোনটা বের করে অন করল। তারপর মাহাদকে মাসেজ করলো সে জরুরি কাজে তার এক বন্ধুর বাসায় এসেছে। কারন মাহাদকে যদি ভুলেও বলা হয় সে তিতিরের এখানে এসেছে তাহলে হাজারটা টেনশন নিয়ে এই রাতেই ছুটে আসবে এখানে। যা বলার কাল সকালে গিয়ে বললেও চলবে।

চারজনে একসাথেই খেল। আসমা ঘুমাতে গেল। কামরান সাহেব তিতিরের রুমে যেতেই তিতির বলল," বাবা, আপনি এখানে এসেছেন দাদী বা মা কিছু বললো না!"

কামরান সাহেব বিছানায় বসে তিতিরকে কাছে ডাকলো। তিতির কাছে গিয়ে পাশে বসতেই উনি বললেন," তিতির, তুমি কিছু না বললে আমি বুঝবো কিভাবে তোমার কি হয়েছে। তুমি অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছ সেটা বুঝতে পারছি। তুমি মাহাদকে বলতে না চাইলে আমাকে বলো। আমি নিজের মধ্য কথা চেপে রাখতে পারি। তাই নির্ভয়ে আমাকে বলতে পারো।

তিতির আর কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পারলোনা। ঝড়ঝড় করে চোখের পানি পড়তে লাগলো। ধীরে ধীরে মনের যত কষ্ট ছিল সব খুলে বললেন।

কামরান সাহেব সব কিছু শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। এতকিছু তার জানা ছিলনা। সবকিছু হঠাৎ করেই এলোমেল হয়ে গেল। কামরান সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বললেন," মা একটা কথা বলি, মনে কিছু নিওনা। তোমার কাহিনী শুনে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে,  মাহাদের জিবনের সব থেকে বড় ধাক্কাটা তুমি ওকে দিতে চলেছ। আমার অভিঙ্গতা বলছে, মাহাদ তোমার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে। 
আমি জানি, আমার ছেলে অত্যন্ত স্ট্রংম্যান কিন্তু মানুষের সবচেয়ে দুুর্বল জায়গায় কেউ আঘাত করলে, কোন মানুষের সাধ্য নাই সেখান থেকে ঘুরে দাড়ানোর। যদিনা আল্লাহ্ তার ব্যাপারে অন্য ইচ্ছা পোষন না করে। তাই তোমাকে হাত জোড় করে বলছি আর যাই হোক, আমার ছেলেকে কখনো কষ্ট দিওনা।"

তিতির কোন কথা বলতে পারেনা। ওর মনের ভিতর কি চলছে সেটা শুধু ও ভালো জানে। 

"মা, রাত করোনা। কাল তোমার হয়ত ক্লাস আছে। সুয়ে পড়।"

এর মধ্য গোলাব এসে তিতিরের কোলে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। কামরান সাহেব গোলাবকে দেখে একটু গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল," তিতির, তোমারতো দেখছি অনেক দায়িত্ব। এত দায়িত্ব নিয়ে তুমি দুঃশ্চিন্তা করো কিভাবে? দেখ, পৃথিবীটা ভাল-মন্দ নিয়েই গঠিত। তাই সবাই যে তোমার মনের মত হবে সেটাতো তুমি আশা করতে পারোনা। এত কঠিন পরিস্থিতির মাঝে নিজেকে টিকিয়ে রাখাটাই সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।  তুমি তোমার জন্য এই পৃথিবীতে এমন একটা মজবুত প্লাটর্ফম তৈরি কর যেখানে শুধু তোমারই রাজত্ব চলবে। তোমাকে দেখে আরো ১০ জন শিক্ষা লাভ করবে। এটা মনে করো, তুমি পৃথিবীতে হেরে যাওয়ার জন্য আসোনি। তুমি এসেছ তোমার মজবুত অবস্থান সবাইকে দেখিয়ে দিতে।"

তিতির গোলাবকে নিয়ে বিছানায় সুয়ে পড়লো। তারপর কামরান সাহেবের হাতটি নিজের মাথার উপর রেখে বলল," বাবা, আমি কয়েকরাত ধরে ভালকরে ঘুমাতে পারিনা। আমার খুব ঘুমাতে ইচ্ছা করে কিন্তু ঘুমাতে পারিনা আমি।"

কামরান সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল," আজ আমাকে মনে কর, তোমার ঘুমের পাহাড়াদার আমি। তোমার যত দুঃখ কষ্ট আছে সব আমার কাছে জমা দিয়েছ। তোমার সব কিছুর দায়িত্ব আজ থেকে আমি নিলাম। তুমি আজ নিঃশ্চিতে ঘুমাও।"

সত্যই একটু পরে আজ তিতির ঘুমিয়ে পড়লো। নিঃশ্চিতে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে সে।

♦♦♦♦

এদিকে বাতাসি বিবিকে ডাক্তার দেখে বলল," তেমন কোন সমস্যা নেই, মনের ভয় থেকে এমন ঘটনা ঘটেছে। একটু পরই ঠিক হয়ে যাবে।"

কিছুক্ষন পর বাতাসির সেন্স ফিরে আসলে আবার কামু বলে একটা চিক্কুর দিয়ে ভেটকি মাছের মত বিছানায় পড়ে রইল। তারপর চোখ দুটো পিটপিট করে ডাক্তারের দিকে চাইল। ঐ ডাক্তর তুই এহানে ক্যান? অ্যার কি হইছে?

রেজওয়ান ডাক্তার কে নিয়ে বাহিরে চলে গেল। মাহাদ রুমে এসে দেখল বাতাসি সুর তুলে কাঁদছে। তারপর মাহাদকে দেখে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। ঐ সোয়ামী অ্যার পোলাডারে আইনা দে। তোদের কারো দেখচি অ্যার পোলার লায় দরদ নাই। 

রুমে লাবীবা সহ সাবিনা, রুপালি, মৌ সবাই রয়েছে। লাবিবা তো এক কান্নায় আছে। কয়েকদিন আগেই মানুষটার সাথে ঝগড়া হয়েছে ঐ মেয়েটাকে নিয়ে। আজ সে ওভাবে কই গেল?

বাতাসি, তোমার এই কান্না থামাবা? বাবার কিচ্ছু হয়নি। বাবা কোন এক জরুরি কাজে তার বন্ধুর বাসায় গেছে। সকালেই চলে আসবে। এখন তুমি ঘুমাও। সকালে ঘুম ভেঙ্গেই তাকে দেখতে পাবে তুমি। বাবা আমাকে মাসেজ করেছে। 

মাহাদের কথা শুনে মনে শান্তি নিয়ে যে যার রুমে চলে গেল। কিন্তু বাতাসি আবার বলল," অ্যার পুত আইবো তো?"

মাহাদ বিরক্ত হয়ে বলল," না আসলে না আসবে। তাতে তোমার এত সমস্যা কোথায়। শুধু শুধু এতরাত্রে সবার সাথে ঝামেলা বাধাইছো। শেষে দাড়োয়ান চাচাকেও বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়েছ? তোমার বাঁধলোনা ওমন একটা বৃদ্ধ মানুষকে গালি দিতে?"

ঐ কানপড়া দিতে আইবি না। হেই দরজা খুলে না দিলে কামু যাইতোনা। ব্যাবাক দোষ হের। গাল দিচি বেশ করচি। আরো গাল্যামু, পারলে ঠেকেই দেকিস।

এর সাথে কথা বলাই বেকার বলে মাহাদ চলে যেতেই বাতাসি আবার কইল, " সোয়ামী, অ্যার পোলা আইবো তো?"

মাহাদ পিছন ফিরে বাতাসির কাছে তেড়ে এসে বলল," না আসলে তুমিতো আছো ? পাঁচ বছরে তুমি আর আমি মিলে পুরো খাট বাচ্চা দিয়ে ভরে ফেলব। 
শোন, আর একটা কথাও যেন না শুনি।"

তোর বৌ পারবোনা বলে অ্যার উপর নির্যাতন করবি! তোর বৌয়ের কাছে যা। ১০ বছরেও একখান ছাওয়াল পয়দা করতে পারোস কিনা দেখ।

মাহাদ বাতাসির কথায় বাক্কেল বনে গেল। এই না সে পুত্র শোকে কাতর ছিল! আর এখন কোমড়ে শাড়ীর আঁচল পেঁচিয়ে ঝগড়া করছে। বাহ্ বাহ্ তোমার মুখের বুলির প্রসংসা না করে পারছিনা। তুমি পারোও বটে। 
বৌ পারবে কি পারবেনা সেটা আল্লাহ্ সুবহানাতালা দেখবে। তোমার এত ভাবনা আসে কোথা থেকে? তোমাকে আমি ভাবতে বলেছি? তোমার সাথে কথা বলাটায় বেকার। মাহাদ আর এক মুহুত্বও দেরি করেনা। রুম থেকে বের হয়ে যায়।

"কান করেছি ঢোল
 যতখুঁশি তত বোল
 পিঠ করেছি দুরা 
 যত ইচ্ছা তত গুড়া।
দেইখা নিস, ঐ মাইয়া তোর জিনডা কয়লা বানায় ছাইড়া দিব। তুই সুখ পাবিনা মাহাদ। তোর নিজের বংশের বাতি দেওয়ার মত কেউ থাকবোনা। আর ভুল করিসনা মাহাদ। জাত কূল দেইখাও তো বিয়া করা উচিত ছিল। তোর জিবনডা তুই নিজেই শেষ কইড়া দিতাছোস। পরে অ্যার কথা বুঝবি। বাতাসি রুমের ভিতরই কথা গুলো চিল্লায় বলে। 

♦♦♦♦

মধ্যরাতে মাহাদ তিতিরকে ফোন দিল। কামরান সাহেব চট করে ফোন সাইলেন্ট করল। যাতে কলের শব্দে তিতিরের ঘুম না ভাঙ্গে। মাহাদ আরো কয়েকবার কল দিল কিন্তু রিসিভ হলনা। শেষে কামরান সাহেব মাসেজ করলো, আমার প্রচন্ড ঘুম এসেছে কাল কথা হবে।"

মাহাদ এমন মাসেজ পেয়ে মনে খটকা লাগল। বাবা শেষে তিতিরের ওখানে যায়নি তো? নানান প্রশ্ন মাহাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। শেষে আসমাকে কল দিল মাহাদ। আসমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। স্কীনে মাহাদের নাম্বার দেখেই আসমা কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। ফোনটা নিয়ে দৌড়ে তিতিরের রুমে এসে মাহাদের বাবাকে বলল," সাহেব, ভাইজানতো কল দিচ্ছে বারবার। আপনি কথা বলেন।"

" তুমিই কথা বল। বল যে তোমার আপা ঘুমাচ্ছে। আজ তুমি আপার কাছেই আছ।"

কামরান সাহেব আসমাকে যা শিখে দিল আসমা তাই বলল মাহাদকে। মাহাদও আর কিছু না বলে কলটা কেটে দিল।

কামরান সাহেব পুরো রাত ঘুমাইনি। ওভাবেই বসে আছে। ফযরের আযানে তিতিরের ঘুম ভেঙ্গে গেল। একি বাবা, আপনি সারা রাত্রি এভাবে জেগে আছেন? 

কামরান সাহেব তিতিরের কথার জবাব না দিয়ে বলল,"  আম্মাজান, নামায পড়ে আমার জন্য মজার মজার কয়েকপদের নাস্তা বানাও তো? সকাল সকাল খেয়ে বাসায় যাব। আজ তোমার শাশুড়ী মনে হয়না আমার পাতে খাবার বাড়বে। চলজলদি কাজে লেগে যাও।"

তিতির মুচকি হেঁসে বলল," মা না দিলে আমার এখানে একবারে চলে আসেন। আপনাকে মজার মজার খাবার রান্না করে খাওয়াবো। আমি অনেক ভালো রান্না পারি। আঙ্গুল চেটেপুটে খাবেন।"

আমি জানি তুমি ভালো রান্না পারো। কিন্তু আমি তোমার এখানে একেবারে আসবো কেন? আমি তোমাকে আমাদের বাসায় একেবারে নিয়ে যাবো। তারপর তোমার ভালোবাসার শাসন, রান্না, আবদার সব কিছু সহ্য করবো।
তোমাকে যে বালা দিয়েছি সেটা এখনো পড়োনি কেন? বালাগুলো কি তোমার পছন্দ হয়নি তিতির?

না মানে বাবা, আমি চাইছিলাম যেদিন ঐ বাসায় একে বারে ঢুকবো সেদিন ঐ বালা দুটি পড়ে সগৌরবে ঢুকবো। আপনি সেদিন আমাকে রিসিভ করবেন। আমি মাহাদের হাত ধরে যেতে চাইনা বাসায়। আমি তো আপনার একহাত জড়িয়ে ধরে অতি যত্নে সেই বাসায় যেতে চাই।

তিতিরের কথা শুনে কামরান সাহেবের চোখ ঝলমল করে উঠলো। খুশির ঠেলায় বলেই ফেলল," তিতির, তোমার  জন্ম  আমার ঘরে নেওয়া উচিত ছিল।"

বাবা, আপনার ঘরে জন্ম নিলে মাহাদের মত এত ভালো স্বামী, আপনার মত বাবা আমি কোথায় পাইতাম বলেন? আল্লাহ্ সুবহানাতালা  যা করেন পরিকল্পনা মাফিকই করেন। শুধু আমরাই না বুঝে অভিমান করি।

তিতির সালাত আদায় করে সোজা কিচেনে চলে গেল। যাওয়ার আগে আসমাকে তুলে দিল সালাত আদায় করার জন্য। তারপর কাজে মনযোগ দিল। একে একে পাঁচপদের নাস্তা তৈরি করে সব কাজ শেষ করে টেবিলে সাজিয়ে শশুড় মসাইকে ডাকলো তিতির।

সবাই মিলে একসাথে নাস্তা সেড়ে তিতির ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে মাহাদের একটা পাঞ্জাবী বের করে দিল শশুড় মসাইকে। বাবা এটা ওর পাঞ্জাবি। আশা করি এটা আপনার হবে। ও এটা এখনো পড়েনি। তাই ফিটিং ও করে নেয়নি। 

কামরান সাহেব খুঁশি মনে পাঞ্জাবী পড়ে তিতিরকে নিয়ে বের হলেন।
তিতিরকে ভার্সিটিতে ড্রপ করে বাসায় চলে গেলেন।

♦♦♦♦

কামরান সাহেব যখন বাসায় আসেন তখন বাসার পরিস্থিতি মোটেও ভাল নয়। বাতাসি তো সেই আল্লাহর সক্কাল থেকে এক চিক্কুরে আছে। আশে পাশের মানুষদের কান ঝালা পালা করে দিয়েছে ততক্ষনে।  কামরান সাহেবকে দেখে বাতাসি দৌড়ে এসে বলল," বাপ অ্যারে ছাইড়া কই গিছিলি?"

" আম্মাজান একটু কাজ ছিল। আমি তো মাহাদকে মাসেজে সব বলে দিয়েছি।"

" আম্মা, আপনার ছেলেকে বলেন! কাল রাতে টাওয়াল পড়ে গিয়েছিল কিন্তু আজ পাঞ্জাবী কেনো পড়ে আসলো? তারে সত্যি কথা বলতে বলেন!"

" বাতাসি লাবীবার কথা শুনে আহম্মক বনে গেল। তাইতো, ঐ তুই কাল গেছিলি গামছা ফিন্দে আর আজ আইলি পাঞ্জেবীতে! তোর ভাবসাব অ্যার কিছুই ঠেকছে না। সত্যি কতা ক কইচি কামু। বিয়া শাদী কইরা আসোস নাই তো? তোর বাপও এই বয়সে কুকাম করছে। আর তুইতো তার পোলা। তুই করতে ট্যাক!"

" আম্মাজান, কি বলেন এসব কথা? আমার কি বিয়ের বয়স আছে নাকি! ছেলেমেয়েদের সামনে আর লজ্জা দিয়েন না তো? আমি সারারাত ঘুমাইনি। এখন ঘুমাবো তাই কেউ যেন আমায় বিরক্ত না করে বলে কামরান সাহেব উপড়ে চলে গেলেন। কিন্তু নিজের রুমে না গিয়ে মাহাদের রুমে চলে গেলেন।

" আম্মা, কিছু বুঝতে পারলেন! আপনার ছেলে নষ্টামি করে বাসায় আসছে। আমি কি জানতাম আমার শশুড়ও এমন ছিল? আগে জানলে বিয়ের দিনই নিজে বিয়ে নিজেই ভেঙ্গে দিতাম তবুও এই বাসায় বৌ হয়ে আসতাম  না।"

" এই চুপ করো! সেই বিয়ানবেলা থাইকা বকরবকর বকরবকর কইরা অ্যার কানডা ঝালাপালা কইরা দিছে। তোমার শশুড় আরে পছন্দ না করলেও তার চরিত্র ভালা ছিল। আই তো কথায় কথা এমন বেহুদা কতা কই। তুমি এই বাড়িতে কি আইতা না!  আই যদি জানতাম তুমি এমডা তাইলে আই আনতাম ন তোমারে কামুর বৌ বানাইয়া। দুনিয়ার পাগল ছাগল অ্যার কপালে আইয়া জোডে। অ্যার পোলার মত সোয়ামী পাওয়া নসিব দরকার বুঝছো! যাও এহান থাইকা। দেহ, অ্যার পোলার কি দরকার। সেবা করোগা।

♦♦♦♦

মাহাদের এখনো ঘুম ভাঙ্গেনি।  কামরান সাহেব কয়েকবার ডাকতেই মাহেদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। মাহাদ চোখ মেলে ফ্যালফালিয়ে বাবার দিকে চেয়ে রইলো।

" এই কি দেখিস ওমন করে?"

" আমার পাঞ্জাবী আপনার গায়ে কেন? তার মানে আপনি তিতিরের কাছে গিয়েছিলেন! মাহাদ চট করে বিছানা থেকে উঠে পড়লো। তিতির ঠিক আছে বাবা?"

" ওকে ভার্সিটিতে ড্রপ করে আসলাম। তোকে কিছু বলার ছিলো। মনযোগ দিয়ে শোন। আর আমার কথাগুলো শুধু সামান্য কথা নয়, সেগুলো উপদেশ হিসেবে নিস।"

" জ্বী.....!"

" তিতির যদি না চায় তাহলে তুই ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওর কাছে যেন কখনো যাসনা। কথাগুলো তোর শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি আমি।  ওর পুরো জিবন ভেঙ্গে চুরে তছনছ হয়ে গেছে এত বছরে। তাই সব নতুন করে সাজাতে অনেক কাঠখড় পুড়তে হবে তোকে। ওর মনের অবস্থা খুব একটা ভালো না। ও নিমিষেই ভূল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর সেটা ওর আর তোর জন্য অনেক ভয়াভয়। ওর কথা বলা, চাহোনি সব কিছু অন্য কথা বলে। ও মুখে এক কথা বলে কিন্তু অন্তরে অন্য পরিকল্পনা করে। কাল ওর ব্যবহারে আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি ওর হৃদয় পুড়ে কাঠের কয়লার মত হয়ে গেছে। যেখানে হতাশা ছাড়া আর কিছুই নেই। ওর  বাবার নাম্বারটা আমাকে একটু কালেক্ট করে দিস তো? এবার বুঝি বাপ বেটা দুইজন কেই মাঠে নামতে হবে।
কথাগুলো বলে কামরান সাহেব মাহাদের রুম থেকে চলে গেলেন। মাহাদ জানেনা কাল কি হয়েছে কিন্তু বাবার কথা শুনে এটা বুঝতে পেরেছে ওকে এখন কি করতে হবে। মাহাদ অনেকক্ষন চুপ করে বসে রইল। ও নিজেও জানেনা পরবর্তীতে ওদের সাথে কি ঘটতে চলছে।

♦♦♦

তিনদিন পর,

মাহাদ এই তিনদিনে একবারও তিতিরের খোঁজ নেয়নি। সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিছে। তিতিরও অভিমানে মাহাদকে আর কল দেয়নি। নিজের ভিতর একাকীত্বটা পাহাড় সমান উঁচু হয়ে গেছে। রুমের ভিতর বসে থাকে শুধু। আসমাকে এই তিন দিনে ঘন্টায় ঘন্টায় প্রশ্ন করেছে সে। আসমা, তোমার ভাইজান কি তোমায় ফোন দিয়েছিল!

" আসমা ভেবে পায়না এর কি জবাব দিবে। আসমা ভাল করে বুঝতে পেরেছে তাদের ভিতর কিছু একটা হয়েছে। আসমা কয়েকবার মাহাদকে কল দিয়েছে কিন্তু বারবারই মাহাদ কল কেটে দিয়েছে। তাই ভয়ে আর কল দিতে সাহস পায়নি আসমা।"

" তিতির রুমে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। দেখেছিস গোলাব, তোর বাবা আমার সাথে সম্পূর্ন যোগাযোগ বন্ধ করে দিছে। আমার অপরাধ কোথায় সেটাই আমি বুঝতে পারছিনা। কেন আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছে। সে তো জানে তিতির তাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। তাহলে কেন সে ইচ্ছা করে এমন কাজ করছে।"

" অবলা গোলাব তিতিরের মুখের দিকে একধানে চেয়ে রইলো। হয়ত সে তিতিরকে বুঝার চেষ্টা করছে।"
কয়েকদিন ধরে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। এবছর বন্যা পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আজও বৃষ্টি হচ্ছে। তিতির গোলাবকে রেখে রুম থেকে বের হয়ে ছাদে এসে দাড়ালো। কিছুক্ষন পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।  কিছুক্ষনের জন্য যতদুর যায় ততদুর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে। 
তিতির হঠাৎ দেখতে পায় ওদের বাসা থেকে কিছুটা দুরে একটা গাড়ী দাড়িয়ে  আছে। আর একটা ছেলে রেইনকোর্ট পড়ে গাড়ীর ছাদে বসে আছে। এক ঝলকে এইটুকুই দেখতে পায় সে। তিতির স্থির হয়ে যায়। আবেশে গা কাঁপছে একটু একটু করে। মাহাদ........
হ্যাঁ ওটা মাহাদ ছাড়া আর কেউ হবেনা। তিতির আর এক মুহুত্বও দেরী না করে নিচে নেমে এল। তারপর  দৌড়ে গেটের কাছে গিয়ে দরজা খুলতে লাগলো। কিন্তু দরজায় চাবি দেওয়া।

" এই তিতির এত রাতে দরজা খুলছো কেন? কি হয়েছে তোমার?"

" আঙ্কেল, মাহাদ রাস্তায় দাড়িয়ে আছে। আমি  ওর সাথে দেখা করতে যাব। আপনি একটু দরজা খুলে দেন।"

" মাহাদ যদি আসে তাহলে ভিতরে আসবে।  ও কেন রাস্তায় দাড়িয়ে থাকবে? অনেক রাত হয়েছে রুমে যাও। এতরাতে তোমাকে বাহিরে যেতে হবেনা। দুঃখিত আমি দরজা খুলতে পারছিনা।"

দাড়োয়ানের না সূচক জবাব পেয়ে তিতির রেগে গিয়ে বলল," আপনি দরজা না খুললে আমার বয়েই গেল। এমন ১০ টা দরজা টপকানো এই তিতিরের বা হাতকা খেল। "

তিতির তরতর করে এই বৃষ্টির মধ্য দরজা বেয়ে উপরে উঠেই ওপারে লাফ দিল। দাড়োয়ানের হাজার বারন করা পিছু ডাক তিতির শুনেও যেন শুনলোনা। বেচারা দাড়োয়ানও তুমুল বৃষ্টির ভিতর তার জায়গা ছেড়ে বের হতে পারলোনা। কিন্তু তিতিরের এহেন কান্ডে দাড়োয়ান বেশ অবাক হয়ে গেল এবং কিছুটা ভয়ও পেয়ে গেল। শেষে ভুতটুত নয় তো আবার?

তিতির এক দৌড়ে গাড়ীর কাছে এসে দাড়ালো। বৃষ্টির পানি তিতিরের গাল বেয়ে বেয়ে নামছে। তিতির কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো, " মাহাদ......!"

" তাহলে এতদিন পর তোমার মনে হল কেউ একজন তোমার অপেক্ষায় এখানে থাকবে!"

মাহাদের এমন কথায় তিতির অপরাধীর মত মাথা নিচু করে রইল। কারন তিতির বুঝে গেছে, মাহাদ এই তিনদিন এমন ভাবেই তিতিরের অপেক্ষা করেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন