৩৯!!
বেশ অনেক বেলা করেই মায়রার ঘুমটা ভাঙলো। ঠিক ঘুম ভেঙেছে বলা যাবে না যদিও। কানের কাছে অনেকক্ষণ ধরে মোবাইলের প্যানপ্যানিতে বহু কষ্টে চোখ মেলতে বাধ্য হয়েছে মায়রা। চোখ থেকে ঘুমের রাশটা কিছুতেই কাটছে না। কলটা অনেকক্ষণ বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আবার ঘুম এসে ভর করছিলো চোখ জুড়ে। কিন্তু মায়রার এই ক্লান্তির ঘুমটা কাটিয়ে দেয়ার জন্যই হয়তো মোবাইলটা আবার সশব্দে চেচিয়ে উঠলো। মায়রা এবারে চমকে উঠে প্রায় লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। ঘুমের ঘোরটা কাটিয়ে তাড়াতাড়ি মোবাইলটা হাতে নিতেই আয়ানের নামটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো মায়রার৷ আর সাথে সাথেই মায়রার ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো। আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে কলটা রিসিভ করলো মায়রা।
-হ্যালো ম্যাডাম? গুড মর্নিং। আপনার এতো সাধের ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলাম নাকি গো?
-হুম---। গুড মর্নিং।
-মায়রা?
-হুম।
-উঠবে না? অনেক বেলা হলো তো বাবা? আজকে না আমাদের বিয়ে? আমি সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। আর তুমি এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছো? ঠিক না এগুলা বুঝসো?
-কেন? তোমাকে ঘুমাতে কে বারণ করেছে?
-আজকে এই লাজুক পরীটা আমার বউ হয়ে আসবে৷ সেই এক্সসাইটমেন্টে তো ঘুমই আসে নি সারা রাত। এখন কি ঘুম পাচ্ছে! ওফ!
-তো ঘুমাও তুমিও--।
-ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে যায় যদি? সেই ভয়েই তো ঘুম পালিয়ে যাচ্ছে। ধ্যাত! ইচ্ছে করছে এখনই টুপ করে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসি। দুপুর পর্যন্ত এতো অপেক্ষা করার কি আছে? অসহ্য--।
-হি হি। তুমি পাগল হয়ে গেছো আয়ান।
-হ্যাঁ হ্যাঁ। পাগলই হয়ে গেছি। সব তোমার দোষ৷ তুমি-তুমি- তুমি ভিষণ পচা। এখন মজা পেয়ে আবার হাসছো?
-এখন কয়েক ঘন্টা ঘুমাও প্লিজ? পরে টায়ার্ডনেসের কারণে---।
-আরে কিছুই হবে না। যখন তুমি ছিলে না-কতো কতো রাত এক ফোঁটাও না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি জানো? দুচোখের পাতা এক করলেই তোমার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতো। তাই ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসলেও ঘুমাতে পারতাম না। কেমন করে যে সেই ছয়টা মাস আমার কেটেছে সেটা আমি তোমাকে বলেও বোঝাতে পারবো না মায়রা--।
-সরি----।
-আম---। সরি বলে তো কাজ হবে না ম্যাডাম। একবার বিয়ে করে আনি। তারপর দেখবা তো কেমন করে তোমার ঘুমও আমি কেড়ে নেই। আমাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তি হলো তোমাকে একটা রাতও ঘুমাতে দিবো না।
-দেখা যাবে। এখন চুপ করে ঘুমাও। আমিও ঘুমাই। কাল ওরা হলুদ আর মেহেদি লাগিয়ে আড্ডা দিয়ে এতো দেরি করে ফেলেছে যে ঘুমিয়ে বোধহয় ভোরের সময়। এখন ঘুমাবো। রাখো এখন।
-এই এই মায়রা? এখন আবার ঘুমাবে? কতো বেলা হলো?
-হোক বেলা। আমি ঘুমাই।
-আরে বাবা! আজ আমাদের বিয়ে। তোমাকে সাজাতে আরিশারা যাবে। আর তুমি ঘুমাবা!
-হুম---।
-কি মুশকিল! দেখা যাবে এদিকে আমি বরযাত্রী নিয়ে বিয়ে করতে গিয়ে বসে আছি, আর তুমি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছো! হায় কপাল! এ কাকে বিয়ে করছি আমি?, আমার মায়রাটাকে কে চুরি করে নিয়ে গিয়ে এ কোন ভূতনিকে দিয়ে গেল! এ আমার কি সর্বনাশ হলো গো? ওগো তোমরা কেউ আমার বউটারে খুঁজে এনে দাও!
-আয়ান?
-বাপরে! কি গলা! কানের পর্দা ফেটে গেল আমার! ওগো মায়রা? তুমি আমাকে কোন পেত্নীর হাতে ফেলে কোথায় চলে গেলে?
-আয়ান? বেশি বেশি হচ্ছে কিন্তু এবার? কি বলছো এসব?
-ঠিকই বলছি। তুমি আমার মায়রা হতেই পারো না। বলো কে তুমি? কোন বহুরূপিনী? আমার একটা মাত্র বউকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ? বলো বলো বলো?
-তুমি কি যাত্রাদলে নাম লিখিয়েছ? এমন নাটক করছ কেন?
-দেখলে তো প্রমাণ হয়েই গেল। আমার মায়রা কখনোই আমাকে এভাবে অপমান করতে পারতো না। আহ! মায়রা? তুমি কোথায়?
-আমি মায়রা না তাই তো?
-হুম। তুমি জাদুকরী। জাদু বলে আমার সহজ সরল বউটাকে কোথায়---।
-তাহলে আমাকে বিয়ে করতেও হবে না যাও। তুমি গিয়ে তোমার মায়রাকে খোঁজো। আমি যেদিকে দু চোখ যায় চলে যাবো। হুহ---।
-আরে আরে? বউটা গোস্সা করে না প্লিজ? আমি তো দুষ্টুমি করছিলাম। তুমি তো আমার পাগলি মায়রামনিটা। এই দেখো কান ধরছি। আর দুষ্টুমি করবো না। প্রমিস।
-হুহ--।
-মায়রা? এখন প্লিজ উঠো? আরু তো রওনা দিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। তুমি ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে নাও না? সাজের সময় তো খেতেও পারবে না কিছু। তখন আবার উপোস করে বসে থাকবে--। উঠো এখন? লক্ষী না?
-এই? তুমি এতো খাই খাই করো কেন?
-আমার পাটকাঠি বউটা যে খাওয়ার নামও করে না। তাই আমাকেই বলতে হয় আর কি৷ এখন উঠো তো? অনেক্ষণ ঝগড়াঝাটি হলো। আর না। এখন উঠো?
-হুম। তুমি একটু ঘুমাও।
-ওক্কে ম্যাডাম---।
কলটা কেটে মায়রা আড়মোড় ভেঙে বিছানায় উঠে বসলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সত্যি অনেক বেলা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠে শাওয়ার নিতে ঢুকলো মায়রা। মেহেদিরাঙা হাতে শাওয়ারের পানিগুলো এসে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে। মায়রা সব ভুলে সেটাই হা করে দেখছে আর শাওয়ারের ঠান্ডা পানিতে ভিজছে।
এদিকে আয়ানের বিয়ের দায়িত্বের সবটাই এসে পড়েছে আরিশা আর তাওহীদের উপরে। মায়রার জন্য বিয়ের সাজের ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে আয়ানের গায়ে হলুদের আয়োজন সবটাই সামলাতে হচ্ছে ওদের দুজনকে। এদিকে নিজের পিচ্চিটাকে নিয়ে আয়ানের বিয়ের সামাল দিতে দিতে আরিশা কাহিল। বেচারি একা হাতে আর কতদিক সামলাবে! আরশিকে নিয়েই মায়রাকে সাজানোর জন্য বের হতে হয়েছে আরিশাকে। নইলে মেয়েটা এতোক্ষণে মেয়েটা পুরো মাথায় তুলতো।
মায়রাদের বাড়িতে আসতে প্রায় বারোটার কাছাকাছি সময় হয়ে গেছে আরিশার। এসে দেখলো তাথৈ মায়রাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। আরশিকে আরিশার কোলে দেখেই বাঁধন কোথা থেকে ঝড়ের গতিতে সামনে এসে দাঁড়ালো।
-এই যে এই যে। পুতুলটা চলে এসেছে। মায়রাপু আমার পুতুল--।
বাঁধনের এমন নাচানাচিতে সবাই হেসে ফেললো। আরিশাও আরশিকে কোল থেকে নামিয়ে খাটে শুইয়ে দিলো। বাঁধন অবাক অবাক চোখে তার ছোট্ট পুতুলটার হাতের ছোট্ট আঙ্গুলগুলো নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছে। পিচ্চি কি বুঝে এমন হেসে কুটিকুটি হচ্ছে সেটাই বেচারা বুঝতে পারছে না। আরশি আর কোন জ্বালাতন করছে না দেখে আরিশাও নিশ্চিন্তে মায়রাকে সাজানোয় মন দিতে পারলো। সাথে আভা আর তাথৈও যোগ দিয়েছে৷
আরিশা বড় লাগেজটা থেকে গোল্ডেন সুতায় পান পাতা ছাপানো টকটকে লাল বেনারসি বের করলো। সাথে লাল ভারি কাতানের ব্লাউজ আর ব্লাড রেড কালারের কনের ওড়না। ওড়নাটার চারপাশে মোটা করে গোল্ডেন লেইসের কাজ। মায়রার গায়ে বেনারসিটা টেনে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো আরিশা আর আভা। বাকি তিনজনেই মায়রাকে অবাক চোখে দেখছে। ওদের এমন চাহনিতে মায়রা একটু লাজুক হেসে বেনারসিটা নিজেই পড়ায় মন দিল। বেনারসিটা পড়ার পর মায়রাকে কোন সাজ ছাড়াই টুকটুকে একটা লাল পরীর মতো লাগছে। বিয়ের সাজের আগেই মেয়েটাকে এতোটা সুন্দর লাগছে, না জানি সাজানোর পর কতটা গর্জিয়াস লাগবে দেখতে! আরিশা আর তাথৈ মায়রার গায়ে হালকা করে ধাক্কা দিয়ে দুষ্টুমি করতে লাগলো। বর তো আজ নতুন বউয়ের দিক থেকে চোখই ফিরাতে পারবে না। ওরা দুজনেই এসব বলাবলি করছে আর মায়রা লজ্জায় লাল হয়ে আভার পিছনে এসে মুখ লুকালো। এভাবে কেউ বলে!
টুকটুকে লাল বেনারসির সাথে আরিশা মায়রাকে হাতে বালা, পাঞ্জা, হাতপদ্ম, মান্তাসা পড়িয়ে দিয়েছে। আঙুলে আংটি। গলায় সীতাহার, পাতিহার। কোমড়ে বিছা হার।। নাকে নথ।। কানে ঝুল ঝুমকো। পাফ করে আধো ফুলানো চুলে গোল্ডের টিকলি আর টায়রা।।
আভা আর তাথৈও খুব যত্ন করে মায়রাকে সাজাতে শুরু করেছে। পাফ করে চুলগুলোকে হালকা ফুলিয়ে খোঁপা করছে একজন। আরেকজন মোটা করে আইলাইনার আর কাজল দিয়ে মায়রার চোখ সাজাতে ব্যস্ত। ঠোঁটে টকটকে লাল ম্যাট লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁটের কাজটা ভালো করে ফুটিয়ে ট্যাডিশনাল একটা লুক দিল ওরা। সাজ শেষ হলে মায়রা আয়নায় নিজেকে দেখলো। কপালে কুমকুম টিপের ফোঁটাগুলোও আজ অসম্ভব ভালো লাগছে ওর। কুমকুম টিপের ফোঁটার মাঝে টকটকে লাল টিপ। সেটাতেও বহু কারিগরি করে নকশা করেছে তিন জন কারিগর। নিজেকে চিনতেই যেন হিমশিম খাচ্ছে মায়রা। সাজতে তো বরাবরই খুব একটা পছন্দ করে না মায়রা। তবে আজকের এই ভারি মেকাপ- এতো এতো ফাউন্ডেশন- পাউডার- কাজল- কুমকুম-সবই বেশ লাগছে ওর কাছে।। মেহেদী রাঙা হাতের সদা স্বচ্ছ নখে আজ টকটকে লাল নেইলপালিশটাও বেশ লাগছে ওর এখন।। বিয়ে বিয়ে একটা অনুভূতিটাই আসছে ওর। খানিকটা লজ্জা, খানিক ভয়, খানিক সংকোচ আর ঢের খানিকটা আবেগ- সব মিলিয়ে অন্য কোন দুনিয়ায় আছে মায়রা৷
মায়রার খোঁপা বাঁধা চুলে খোঁপার জালি পড়িয়ে বকুল ফুলের একটা মালা পড়িয়ে দিলো আরিশা। তারপর কনের ওড়নাটা মাথার উপরে দিয়ে সাজটা কমপ্লিট করলো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কয়েকটা কথা বললো।
-মায়রা? আমি কিন্তু বেলি ফুলই নিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার বর কোন ফাঁকে সেটা পালটে দিয়ে বকুল ফুলের মালা রেখে দিয়েছে। এভাবে করলে চলে বলো তো?
মায়রা আবার লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নামিয়ে নিলো। এই মেয়েটাও কেন যে এতো কথায় কথায় লজ্জা দেয়! সাজ হতে বেশ অনেকটাই সময় লেগেছে। এখন কেবল মায়রার অপেক্ষার পালা। কারো আসার অপেক্ষা। আর সেই মানুষটার ওকে দেখে কি রিএ্যাকশন দেবে সেটা দেখার জন্য বুকের মধ্যে ছটফটানি।
আভাদের বাড়ির বড় কম্পাউন্ডেই বিয়ের স্টেজ সাজানো হয়েছে। আয়ান বরযাত্রী নিয়ে আসার পর আরিশা আর তাথৈ দুজনে মিলে মায়রাকেও স্টেজে এনে বসালো স্টেজে। আয়ানের পাশে বসে থেকে মায়রা বেশ বুঝতে পারছে মানুষটা ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় বেচারি আর মুখ তুলে আয়ানের দিকে তাকাতেই পারলো না। একটু পরেই কাজী সাহেব এসে বিয়ের আচার শুরু করলেন। তিনবার কবুল শব্দটা বলতে মায়রার বুকের ভিতরে তুমুল ঝড় বয়ে গেল। আর আয়ানের দৃঢ় কণ্ঠের তিনবার 'কবুল' শুনে আনন্দের ঝিলিক দেখা দিলো মায়রার চোখে মুখে। রেজিস্ট্রিতে সাইন করতে গিয়েও আবার একই অবস্থা হলো মায়রার। রাজ্যের আবেগ এসে যেন ভর করেছে মায়রার আঙুলগুলোয়। কাঁপা কাঁপা হাতে কোনমতে সাইন করলো মায়রা। আর আয়ান সম্ভবত খুশির চোটে এক নিঃশ্বাসে সাইন করে ফেললো। এতো যুদ্ধের পর যে সে মায়রাকে পেয়েছে সেটা আয়ানের যেন বিশ্বাসই হতে চাইছে না। মায়রাও সেটা বুঝতে পেরে লজ্জা পেল। লোকটার এমন অবাক করা চাহনি দেখতেও ভালো লাগছে মায়রার। মনের মধ্যে ফুরফুরে একটা বাতাসের সাথে একটা কথাই মাথায় ঘুরছে মায়রার। হাজার ঝড় ঝাপ্টা পার করে মিলেমিশে এক হয়েছে ওরা। এবার হয়তো ভাগ্য মুখ তুলে চাইবে ওদের দিকে। হয়তো এবার সুখপাখি এসে ধরা দিবে ওদের ঝুলিতে।
৪০!!
কাজী সাহেবের বিয়ে পড়ানো আর ম্যারেজ রেজিস্ট্রিতে সাইন করানো শেষ হলে খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ হলো। তারপর ছোট করে নতুন বর বউয়ের মুখ দেখানোর আর পান চিনির একটা অনুষ্ঠান হলো। তারপর বর পক্ষ আর কনে পক্ষদের মধ্যে ছোট্ট একটা প্রতিযোগিতার মতো করে নাচ আর গানের অনুষ্ঠান। বিয়ের এমন আরো খুঁটিনাটি আবদারগুলো মিটিয়ে ওরা ছাড়া পেতে পেতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলো। আয়ান আর মায়রা যখন ফুলে সাজানো গাড়িতে এসে উঠেছে তখন প্রায় আটটা সাড়ে আটটা বাজে। আভা, সামি, বাঁধন, তাথৈ সবাইকে একে একে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলে বিদায় নিয়েছে মায়রা। মামা মামি আয়ানের হাতে মায়রাকে তুলে দিয়ে চোখের পানি লুকালেন। আজ তাদের মেয়েটা তার নতুন জীবন শুরু করতে পা বাড়াচ্ছে। কাঁদলে কষ্ট পাবে না ও? তাই মায়রার বিদায়ের সময় চোখে এক ফোঁটাও পানি আনতে চায় না আভা আর সামি৷
ফুলে ফুলে সাজানো গাড়িটার পেছনের সিটে আয়ানের পাশে বসেছে মায়রা। সামনের সিটে রিহানের পাশে ঘুমন্ত আরশিকে কোলে নিয়ে বসেছে আরিশা। মায়রা একটু একটু করে আভাদের বাসা থেকে দূরে সরে যাওয়া দেখছে৷ বাঁধনের হাত পা ছুঁড়ে কান্না করা, বা তাথৈয়ের বাঁধনকে দু হাতে বুকে জড়িয়ে শান্ত করার চেষ্টা -কিছুই চোখ এড়াচ্ছে না মায়রার৷ বাড়িটার থেকে অনেকটা দূরে সরে যাওয়ার পরও মায়রা মাথা নিচু করে কাঁদছে। এই কান্নার বিন্দুগুলো কিসের সেটা মায়রা জানে না। হয়তো কিছু হারানোর, অথবা আজীবনের জন্য কিছু প্রাপ্তির। সমস্ত অনুভূতিগুলো একসাথে মিলে মিশে বুকে একটা চাপা ব্যথা সৃষ্টি করছে মায়রার। আর তারই পরিনামই হলো এই অশ্রু বিন্দুগুলো।
হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে চমকে পাশে তাকালো মায়রা। আয়ান ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলো। মুখে কিছু না বললেও লোকটার চোখেমুখে নিজের কষ্টগুলোকে যেন পড়তে পারছে মায়রা৷ কাঁদতে কাঁদতে যে ওর হেঁচকি উঠে গেছে সেটা মায়রা এখন কথা বলতে গিয়ে টের পেল। কোনমতে হেঁচকি তুলে কান্না সামলাতে সামলাতে আয়ানকে দেখছে মায়রা। লোকটাকে সোনালী রঙা শেরওয়ানিতে কি যে সুন্দর লাগছে! একেবারে চোখ আটকে গেছে মায়রার। আয়ান মায়রাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে কাঁধে মায়রার মাথাটা যত্ন করে রাখলো।
-মায়রু? কাঁদতে কাঁদতে তো একেবারে হেঁচকি তুলে ফেলেছ? পানি খাবা একটু?
-উঁহু---।
-এতো কাঁদছো কেন গো বউটা? এমনভাবে কাঁদছ মনে হচ্ছে আমি তোমাকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করছি? এমন কেউ কাঁদে বলো তো?
-হুম?
-এমন করে কেঁদো না প্লিজ? আমার খুব খারাপ লাগছে তোমাকে এভাবে দেখে--। তোমার ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসিটা দেখেই আমি অভ্যস্থ। এই কান্নাটা না। প্লিজ? কান্নাটা বন্ধ করো এবার? তুমি চাইলে কাল একদম সকাল সকাল আমরা মামা মামনির সাথে দেখা করতে চলে আসবো। পাক্কা প্রমিস। চাইলে বাঁধনকে নিয়ে আসবো আসার সময়। তবু প্লিজ কেঁদো না---।
মায়রা আয়ানের কাঁধে মাথা রেখে অবাক চোখে আয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করলো। এই লোকটা এতো পাগল কেন? ভালোবাসে বলেই কি এতো পাগলামি? নাকি লোকটা এতো পাগল বলেই মায়রা ওকে এতোটা ভালোবাসে? নাকি সে এতো পাগল বলেই এতো কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও মায়রাকে ঠিক আগের মতোই ভালোবাসে? বা আগের চেয়েও বেশি? আয়ান আলতো করে মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে মায়রাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো। আজ থেকে এই পাগলি লাজুক পরীটা শুধুই তার। এরচেয়ে খুশির কিছু এই দুনিয়ায় ঘটেছে বলে আয়ানের জানা নেই।
শ্বশুরবাড়িতে এসে মায়রাকে এক দফা অবাক হতে হলো। বাড়িটা সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আয়ানের মা এতোটা অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে আগলো নিয়েছে যে মায়রার নিজের মায়ের অভাবটুকু যেন ভুলেই গেছে একনিমিষে। আর আয়ানের বাবা? একজন বাবা যে এতোটা ফ্রেন্ডলি, কেয়ারিং আর রসিক লোক হতে পারে সেটা উনাকে না দেখলে হয়তো মায়রা কখনো জানতোই না। লোকটা এমন ভাবে আয়ান আর আয়ানের বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে আড্ডা দিচ্ছে যে মনে হচ্ছে না তিনি আয়ানের বাবা বা কোন বয়স্ক মানুষ। উল্টো উনার এক একটা কথা শুনে মায়রার মনে হচ্ছে তিনি যেন আয়ানের বন্ধুদেরই একজন। যেমন হাসিখুশি একটা পরিবারের স্বপ্ন মায়রা দেখেছিল, আয়ানের পরিবারটা ঠিক যেন সেরকমই৷ মায়রার মনে হচ্ছে ওর স্বপ্নের রাজ্য থেকে কেউ যেন ওদেরকে বাস্তবে এনে রেখে দিয়েছে।
-এই? তোমাদের এতো আড্ডা দেয়া লাগে কেন আমি তো বুঝি না? মেয়েটাকে এতোক্ষণ ধরে এখানে বসিয়ে রেখেছ? একটু মায়া দয়া নেই নাকি তোমাদের? আর এই যে মা জননীরা আপনারা কি এখানে বসে বসে গল্পই করবেন? নাকি মেয়েটাকে একটু রুমে নিয়ে যাবেন? নাকি আমি শাশুড়ি হয়ে ছেলের বউকে বাসরে নিয়ে যেতে হবে?
আয়ানের মায়ের কথাটা শুনে আরিশা জিভ কেটে উঠে দাঁড়ালো। ঘুমন্ত আরশিকে তাওহীদের কোলে দিয়ে উঠে এসে আয়ানের মাকে জড়িয়ে ধরলো।
-ও আন্টি? তুমি শাশুড়িও হয়ে গেছ? ইশ! তোমাকে দেখে শাশুড়ি মনে হয়? এখনও তোমাকে আমার ছোট বোন বলে চালিয়ে দেয়া যাবে৷ আর আয়ানের বউকে তুমি নিয়ে গেলেও আমরা কেউ কিচ্ছু মনে করবো না। পাক্কা---।
-তবে রে আরু? বেশি পাকনা হয়ে গেছ না? মেয়ের মা হয়ে গেলি তবু দুষ্টুমি যায় নি তোর?
-আরে আন্টি? কি করো? এভাবে কান ধরবা না। আমার মেয়েটা দুদিন পরে বড় হবে। মেয়ের সামনেও তো ইজ্জতের ফালুদা বানায়া দিবা তখন? ছি ছি! কি ভাববে আমার মেয়েটা?
-আরু?
-আরে বাবা? তোমার ছেলের চেয়েও দেখছি তোমার ছেলের বউয়ের জন্য ভালোবাসা বেশি? মাঝখান থেকে আমি ভিলেন! বাবা?
-তোমাকে কিছু করতে হবে না মা। তুমি আপাতত আমার আরশি দাদুভাইকে শুইয়ে দাও গে।
-আরে? যাচ্ছি তো? এই মায়রা এসো? তোমার শাশুড়ি পরে আমাকে বলবে আমি তার আদরের বউমাকে এতোক্ষণ বসিয়ে রেখে কষ্ট দিয়েছি। না বাবা৷ চলো চলো?
মায়রা এতোক্ষণ শাশুড়ি আর আরিশার খুনসুটি দেখছিলো। এবারে মুচকি একটা হাসি দিয়ে আরিশার সাথে পা বাড়ালো রুমের দিকে। আয়ানের রুমে এসে আরিশা আর মায়রা দুজনেই কিছুটা অবাক হলো। রুমে একটা মেয়ে বিছানায় গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে। আরিশা মায়রাকে নিয়ে রুমে ঢুকে একনজর কাঠবেলি আর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো বিছানাটার দিকে তাকিয়ে আবার মেয়েটার দিকে তাকালো।
-সায়না? কি করছো তুমি এখানে?
-আরে? আরিশা আপু? হ্যালো নতুন বউ? আমি এসে দেখলাম বাসরের খাট সাজানো হয় নি। তাই খালামনি বললো সাজিয়ে দিতে। তাই----।
-ওহ! তা তোমার কাজ শেষ?
-হ্যাঁ এইতো শেষ। এই যে নতুন বউ? আমি আপনার ননদ৷ ঠিক ননদও না। আয়ান আর আমি খালাতো ভাই বোন।
-সায়না? তুই নাকি ঢাকায় ছিলি? এলি কবে?
-আয়ানের বিয়ে আমি কি মিস করতে পারি বলো?
আরিশা খানিকটা ইতস্তত করে মায়রাকে নিয়ে ফুলে সাজানো বিছানায় বসিয়ে দিয়ে লাগেজটা খুঁজতে লাগলো। লাগেজটা রুমে আনা হয়নি দেখে কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো আরিশা। এই শাঁকচুন্নি সায়নার সাথে মায়রাকে একা রেখে যেতেও ইচ্ছে করছে না আরিশার৷ কিন্তু লাগেজটা না আনলে মায়রা চেইঞ্জ করে কি পড়বে ভেবে উঠে দাঁড়ালো।
-সায়না? তোমার তো আর কোন কাজ নেই এখানে? আমার সাথে একটু চলো? মায়রার লাগেজটা আনতে হবে---।
-তুমি যাও না প্লিজ? আমি একটু আমাদের নতুন বউয়ের সাথে একটু গল্প করি? একটু পর তো আয়ানও চলে আসবে? আর গল্প করাও হবে না আমার----।
-আচ্ছা। তুমি বসো তাহলে--। মায়রা? তুমি দু মিনিট বসো? আমি তোমার লাগেজটা নিয়ে আসি--।
মায়রা মাথা নেড়ে সায় জানাতেই আরিশা তড়িঘড়ি করে ছুটলো। সায়না মায়রার দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু হাসলো।
-বাহ! তুমি তো দেখতে অনেক সুন্দর? আমি ভাবিই নি আয়ান এতো সুন্দর একটা বউ পাবে। তুমি করেই বলছি। রাগ করো না কেমন?
-আরে না না---। ঠিক আছে।
-তা বিয়ের আগে কারো সাথে প্রেম ট্রেম ছিল নাকি গো বউ? থাকলে বলতে পারো৷ আমাকে ফ্রেন্ড ভাবতে পারো। আমি কাউকে বলবো না। ভয় নেই একদম---।
মায়রা থতমত খেয়ে সায়নার দিকে তাকালো। এই মেয়েটা কি বলছে সেটাই মায়রার মাথায় ঢুকছে না।
-অবশ্য আয়ান যে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলবে সেটা আমি ভাবতেই পারি নি।
-কেন?
-আরে বেচারা কি যে ছ্যাঁকাটা খেয়েছে। তাও আবার একবার না দু দু বার! ওই যে মেয়েটাকে দেখলে? আরিশা? আমরা সবাই তো ভেবেছিলাম ওকেই বিয়ে করবে আয়ান। শেষমেশ সে নিজেই দাঁড়িয়ে থেকে তাওহীদের সাথে বিয়ে দিলো আরিশার। হাহ। আবার কোন এক মেয়ে তাকে এমন ছ্যাঁকা দিলো যে সে তো মেয়েদের নাম শুনলেই তেড়ে মারতে আসে৷ কি বিশ্রি অবস্থা! বাবা গো? খালামনি কতো করে চাইছিলো ওর সাথে আমার বিয়েটা হোক। কিন্তু যে ছেলে মেয়েদের সম্মান পর্যন্ত করতে পারে না তাকে বিয়ে? ইম্পসিবল। কি বলো?
মায়রা সায়নার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এমন সময় দরকার কাছ থেকে কারো দৃঢ় একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
-তুই কি মায়রাকে আমার সম্পর্কে কিছু বলছিস সায়না?