অস্পষ্ট প্রেমাবেগ - পর্ব ০৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৯!! 

তামান্না হতভম্ব হয়ে বসে থাকতে থাকতে কিশোর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছে। নিজের অদ্ভুত ব্যবহারের জন্য নিজের কাছেই কেমন একটা লাগছে কিশোরের। কিশোর নিজের মনের দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তামান্নার ব্যাপারে ভাবায় মনোযোগ দিলো। আপাতত নিজের অদ্ভুত বিহেভিয়ার নিয়ে চিন্তা করার মতো যথেষ্ট সময় পাবে তামান্নার সাথে কথা বলা শেষ হলে। আপাতত তামান্নাকে নিয়ে কনসেন্ট্রেইট করা যাক। 

-আপনি আপাতত এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি ব্যাপারটা দেখছি। তবে আশা করি একা একা বা হুট করে বাড়ির বাইরে যাবেন না৷

-বাড়ির বাইরে যাবো কেন?

-আপনাদের মেয়েদের যা স্বভাব হয় আর কি--। যা মানা করা হবে সেটাই বেশি করে করবেন---।

-আপনার কি মেয়েতে এ্যালার্জি আছে? কথায় কথায় মেয়ে বলে খোঁটা দেন? আজব!!

-কি করবো বলুন? কিছু কালো অতীত মনের কোণে এই ঘৃণাটাকে তুষের আগুনের মতো জ্বালিয়ে রেখেছে। 

-কি হয়েছিল বলবেন প্লিজ? দীপ্তির মা ই বা কে? কোথায়? আর সুপ্তি নামে কার কথা বলছিলেন-।

-ওই রাক্ষসীর নামটা দয়া করে আমার সামনে নিবেন না। আমি ওই প্রতারকের নামটাও শুনতে চাই না আর।

-বললে হয়তো আপনারও একটু হালকা লাগবে। হৃদয়ের বোঝাটা একটু হলেও কমবে হয়তো আমার মতো----।

-------------------------------

-আচ্ছা। আপনার ইচ্ছে না করলে বলতে হবে না। রাত তো অনেক হয়েছে----। চলুন ওঠা যাক?

-আরেকটু বসবেন প্লিজ?

-জি---। বসা যায়------।

-আজ থেকে ছয় সাত বছর আগের ঘটনা৷ অনার্স করার পাশাপাশি ব্যবসারও হাল ধরেছি কেবল। ওই বছরই বাবা মারা গেছে। আর মাও সিক থাকে প্রায়ই। তাই পড়া অবস্থায়ই ব্যবসায় নামা---। সুপ্তি নাম ছিল মেয়েটার। ওকে প্রথম দেখি একদিন অফিস থেকে ফেরার সময়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো। ও কোথা থেকে ছুটে এসে একেবারে পড়লো আমার গাড়ির সামনে। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম এক্সিডেন্ট হয়েছে ভেবে। তবে ওর কিছুই হয়নি। আমি গাড়িটা স্লো করে গাড়ির বাইরে আসার আগে ও নিজেই দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসলো। আর তাড়া দিতে লাগলো তাড়াতাড়ি গাড়ি চালানোর জন্য। আমি তো ওকে দেখেই পুরো থ হয়ে গিয়েছিলাম--।

-কেন?

-কেন সেটা বলা মুশকিল। ওকে দেখে মনে হয়েছিল স্বর্গলোক থেকে কোন অপ্সরা পৃথিবীতে নেমে এসেছে। কিসের যেন এক চাঞ্চল্য খেলা করছিল ওর চোখেমুখে। লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলে যদি কিছু সত্যি থেকে থাকে, তবে সেটাই হয়েছিল আমার। তখনো জানতাম না ওর দিকে আকৃষ্ট হয়ে ওর কথাটা মেনে নিয়ে জীবনের কত বড় ভুলটা করেছি আমি----।

-উনি এতো তাড়াহুড়ো করছিলেন কেন??

-ওর কথায় গাড়িটা ফুলস্পিডে চালিয়ে বেশ কিছুটা দূরে এসে একই প্রশ্ন করেছিলাম আমিও। জবাবটা শুনে এতোটা অবাক হয়েছিলাম যে বলার মতো না---। এইচ এস সি দেয়ার পরেই ওর পরিবার ওকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইছিলো বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে এসেছে মেয়েটা। আমি তো শুনে পুরোই স্তব্ধ হয়ে গেলাম৷ আমি ভাবলাম হয়তো কারো সাথে রিলেশন আছে তাই পালিয়েছে৷ ও ঠিক তখনই আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে, ওকে একটু কয়েকটা দিনের জন্য থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবো কিনা। কারো জন্য নাকি পালায় নি। নিজের পরিচয় নিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য পালিয়েছে যাতে বিয়ে নামের শিকলে বাঁধা না পড়ে--। 

-তারপর??

-তারপর? জানেন? ভালোবাসা জিনিসটা খুবই খারাপ। অযাচিত একটা মায়া বসে যায় ভালোবাসার মানুষটার প্রতি। হয়তো আমারও তাই হয়েছিল। সুপ্তিকে সোজা বাসায় নিয়ে আসলাম। অন্তত যতদিন চায় থাকতে পারবে নিশ্চিন্তে, আর আমিও ওকে চোখের সামনে দেখতে পারবো---। কয়েকটা মাসেই ও কি সুন্দর করে আমাকে আর মাকে আপন করে নিয়েছিল ভাবতেও পারবেন না। একদিন হুট করে এসে আমাকে বললো, ও বাড়ি ফিরে যাবে। আমার তো মাথায় হাত। অনেক ভেবে শেষমেশ নিজের ভালোবাসার কথাটা ওকে বলেই দিলাম। ও রহস্যময়ী একটা হাসি দিয়ে পালালো। এরপর প্রায় সপ্তাহ খানেক ওর দেখাই পেলাম না। আমার সাথে ইচ্ছে করেই লুকোচুরি করছিল মেয়েটা। আর আমিও ওকে না দেখে পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিলাম। 

-হুম-----।

-এক সপ্তাহ পর বাসায় ফিরে আমি পুরো বেকুব বনে গেলাম৷ বাসা ভর্তি মেহমান। আর সুপ্তি টুকটুকে লাল বেনারসিতে বউ সেজে বসা। মা আর সুপ্তি দুজনেই আমাকে দেখে মিটিমিটি হাসছে---।

-ওহ--। তারপর??

-দিনগুলো ভিষণ ভালোই কাটছিলো জানেন? ওর জন্য এতোটা পাগল ছিলাম যে ও এক প্রকার জোর করে অফিসে পাঠাতো। ততদিনে অনার্স কমপ্লিট করেছি। মাস্টার্সেও ভর্তি হই নি, আর অফিসেও প্রায় যাই না বললেই চলে। প্রায় একটা বছর এসব করেই কেটেছে। একদিন অফিসে কাজ করার সময় খবর পাই সুপ্তি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে বাসায় এসে ডক্টরের কাছে জানতে পারলাম সুপ্তি প্রেগন্যান্ট। প্রেগ্ন্যাসির খবরটা পাওয়ার পর থেকেই ও যেন কেমন চুপচাপ হয়ে গেল। কথা বলে না ঠিক করে, খায় না। খিটখিটে মেজাজের হয়ে গেছে কেমন। 

-এটা তো নরমাল। 

-আমিও তাই ভেবেছিলাম। হয়তো প্রেগ্ন্যাসির কারণে মন মেজাজ খারাপ---। কিন্তু নাহ। ও আসলে বাচ্চাটাই চায় নি। একদিন সরাসরি বললো ও বাচ্চাটা এবোর্ট করে দিবে--। আমি তো পুরো হা। ও কিছুতেই বেবি রাখবে না৷ ওকে অনেক বুঝালাম।

-এবোরশন কেন?

-ও চায় নি বাচ্চা হওয়ার পর ওর ফিগার নষ্ট হোক। 

-হোয়াট??

-ওকে অনেক বুঝিয়েছি। তবে কাজ হয়নি। এবোরশন করায় মানা করায় ও নিজের হাতের অনেকটা কেটে ফেলেছিল--। শেষে আমিও ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম---। 

-আপনিও বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন!! একবারও বুকে বিঁধলো না যে সে আপনারই একটা অংশ??

-এবোর্ট করতে নিয়ে যাইনি আমি সুপ্তিকে। নিয়ে গিয়েছিলাম যাতে অন্তত ডাক্তার ওকে বললে ও এবোরশনটা না করে---। ও যদিও মানলো না ডাক্তারের কথাও। তবু কথায় আছে না আল্লাহ যাকে বাঁচাতে চান তাকে মারার সাধ্য এই মানবজাতির নেই। ওর জোরাজুরিতে ডাক্তাররা চেকাপ করে জানায়, তিনমাস পেরিয়ে গেছে, এবোরশন করতে গেলে ওর নিজেরই জীবন ঝুঁকির সম্ভবনা আছে। শেষে কোন উপায় না দেখে ও রাজি হলো বাচ্চাটাকে জন্ম দিতে। এই ঘটনাটার পর আমাদের দুজনের মধ্যে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে যায়। না ও আমাকে কিছু বলে, না আমি। এক বাড়িতে এক ছাদের নিচে থেকেও যেন কত শত মাইল দূরের দুজন মানুষ। মনের দূরত্বটাই আসল বুঝলেন? যাকে একসময় পাগলের মতো ভালোবেসেছি তার জন্যই ধীরে ধীরে এক ধরনের ঘৃণা জন্ম নিতে শুরু করলো বুকের গভীরে। 

-আপনাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?

-ছাড়াছাড়ি?! হুম বলতে পারেন সেরকমই। আটমাস শেষ হয়ে নয়মাসে পড়তেই দীপ্তির জন্ম হয়। প্রিম্যাচিউর বেবি। তাই ডাক্তার, নার্স, আমি, মা সবাই দীপ্তিকে নিয়েই ব্যস্ত। তার উপরে ওর ওয়েটও অবেকটাই কম ছিল। একবার একটার দরকার পড়ছিল। আমিও তাই তাড়াহুড়োয় সুপ্তির কাছে যেতেও পারছিলাম না। অবশ্য নিজের সন্তানকে প্রথমবার কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরার পর সুপ্তির উপরে আমার রাগটা নিমিষেই হারিয়ে গেল। বহুদিন পর ওকে একটা নজর দেখার জন্য আবার আগের মতো ছটফটানি অনুভব করতে লাগলাম। শেষে ইনটেনসিভ কেয়ারে নেয়ার পর আমি সুপ্তিকে দেখতে কেবিনে গেলাম৷ সেখানে সুপ্তি ছিল না। শুধু ছিল ওর লিখে যাওয়া একটা চিঠি। ও এতোগুলো দিন অনিচ্ছা স্বত্বেও এই বাচ্চাটা ক্যারি করেছে। বাচ্চার জন্য ওর অলরেডি অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আর কোন ক্ষতি ও নিতে পারবে না। তাই আবার নিজের বাড়িতে ফিরে গেছে সুপ্তি। ওকে যেন আর না খুঁজে নিজের মতো করে জীবন শুরু করি এমন লেখা  চিঠিটায়। চিঠিটা পড়ে মনে হয়েছিল কেউ কি করে এতো ঘৃণ্য হতে পারে! কি করে নিজের সদ্যজাত সন্তানকে এমন বাঁচামরা অবস্থায় রেখে চলে যেতে পারে!?

-------------------------------

-আশা করি এবার বুঝতে পেরেছেন কেন আমি মহিলা, মেয়েদেরকে এতোটা ঘৃণা করি!?

কিশোরের বলা কথাগুলো শুনে তামান্নার চোখের পানিরা টপটপ করে কান্নার বাঁধ ভাঙছিলো। কিশোরের শেষের বলা কথাগুলো শুনে তামান্না চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো।

-এখানে তো একা সুপ্তির দোষ নেই। আপনারও দোষ আছে, মানবেন নিশ্চয়ই?

-দেখলেন তো? আপনিও এতো কিছু শোনার পর সুপ্তির পক্ষেই বলবেন। হাজার হোক মেয়েদের জাত কিনা---।

-জি ঠিক বলেছেন। আমি মেয়ে। আজীবন এই পরিচয় নিয়েই মাথা তুলে বাঁচার চেষ্টা করবো। কিন্তু আপনার দোষ কোথায় জানেন? আপনাদের মতো মানুষগুলো ভুল একটা মানুষকে পাগলের মতো ভালোবেসে কষ্ট পায়। আর পরে ভাবে পৃথিবীর সমস্ত মেয়েই ধোঁকাবাজ, ঠগ---। আর এসব করে নিজের জীবনটাই নষ্ট করে দেয়। সবার সাথে দূরত্ব বাড়ে। আর যে তার জন্য পারফেক্ট তাকেও এরা দূরে সরিয়ে রাখে আজীবন। নিজেও কষ্ট পায় এসব করে। আর সাথে কষ্ট দেয় সবাইকে।

-------------------------------

-বাবা আর সোলেমানের শেখের মতো মানুষ আমার জীবনে আসার পর আমার কখনো মনে হয়নি জগতের সব পুুরুষ খারাপ বা এমন কিছু। সেরকম মনে হলে হয়তো এখন এই মূহুর্তে আপনার পাশে বসে থাকার সাহস হতো না। কিন্তু আমি জানি পৃথিবীতে আমার বাবা আর সোলেমান শেখের মতো হাজারটা পুরুষ থাকলে তাদের চেয়েও হাজার গুণ ভালো মানুষও আছে৷ আপনিও সেরকম বিশ্বাস করুন দেখবেন জীবনটা ততোটাও খারাপ না যে মদ, সিগারেট খেয়ে সেটাকে নষ্ট করতে হবে। কারো জন্য না হোক আপনার সেই ছোট্ট মেয়েটার জন্য হলেও একবার নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করুন৷ হাজার হোক সে তো আপনারও অংশ----। আসছি--।

তামান্না কথাগুলো শেষ করে আর দাঁড়ালো না। হনহনিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল। আর কিশোর তামান্নার কথাগুলো শুনে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল এতোক্ষণ। মেয়েটার চোখের কোণের ছলছলানিটা দেখছিল কিশোর৷ কথা শেষ করে এভাবে তামান্নার চলে যাওয়ায় কিশোর শুধু ওর যাওয়ার দিকে হা করে তাকিয়েই রইলো। কিছু বলতেও পারলো না, অথবা ডাকতেও পারলো না। কিসের একটা শূন্যতা নিয়েই উদাস ভঙ্গিতে সেখানেই বসে রইলো কিশোর। 

১০!! 

-মামনি? ও মামনি? ওঠো না? ও মামনি?

ছোট্ট কোন বাচ্চার কণ্ঠের এমন ডাক শুনে তামান্নার ঘুমটা ছুটে গেল। কে এতো মিষ্টি করে ওকে মামনি বলে ডাকছে দেখার ভিষণ কৌতূহল হলো তামান্নার৷ কিন্তু চোখের পাতারা একে অন্যকে এতো নিবিড় করে জড়িয়ে রেখেছে যে তামান্না চোখ মেলে তাকাতেই পারলো না। কিন্তু ঘুমের ঘোরের মধ্যেই টের পেল ছোট্ট গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এসে কেউ তামান্নার মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়ে তামান্নার ঘুমন্ত মুখটা দেখলো। তারপর তামান্নার পাশে এসে শুয়ে তামান্নার গালে আদরের চুমো এঁকে দিয়ে শক্ত করে তামান্নাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকালো। ঘুমের ঘোরের মাঝেও তামান্নার মস্তিষ্ক ভাবার চেষ্টা করছে কে এই বাচ্চাটা?

কিছুক্ষণ পরে তামান্নার গায়ে একটু জোরে জোরে নাড়া দিলো কেউ৷ তামান্নার ঘুমের রেশটুকু এবার চোখ থেকে কেটে গেল। হকচকিয়ে উঠে বসে দেখলো দীপ্তি বসে আছে।

-কি হয়েছে দীপ্তি? ঘুম ভেঙে গেছে?

-মিইইইসসস? তাড়াতাড়ি উঠো না? নইলে আজকে বকা খাবা তো--। আম্মি স্কুল যাবো তো আজকে---। রেডি করিয়ে দিবে না? ৭ঃ৩০ টা বাজে----।

-সে কি!! উফফস! সরি বাবুটা। মিস এক্ষুণি রেডি করিয়ে দিচ্ছি--। উঠো মামনি, মিস ব্রাশ করিয়ে দিয়ে--।

-না মিস। তুমি আমার টিফিন আর ব্রেকফাস্ট বানাও---। আমি নিজে নিজে ব্রাশ করে নিবো----।

-না মামনি--। মিস করে দিচ্ছি--।

-উফফফ। মিস!! আমি বড় হয়েছি না? আমি পারবো। তুমি নিচে যাও--।

-আচ্ছা। লক্ষী বাবুটা---।

তামান্না তাড়াতাড়ি উঠে হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে ছুটলো। তাড়াহুড়ো করে ব্রেড, ডিম, ফল, দুধ যা পেল তা দিয়েই স্যান্ডুইচ আর ফ্রুট কাস্টার্ড করে দিলো। তারপর দীপ্তির টিফিনবক্স রেডি করে দিয়ে রুমে এসে দেখলো দীপ্তি লক্ষী মেয়ের মতো হাত মুখ ধুয়ে, স্কুলের ইউনিফর্ম পড়ে নিয়ে এখন চুল আঁচড়ানোর চেষ্টা করছে। তামান্না হেসে এগিয়ে এসে দীপ্তির চুলগুলো ছোট্ট ঝুঁটি করে দিলো দুপাশে। ছোট্ট একটা কিউট পুতুলের মতো লাগছে দীপ্তিকে। চুল বাঁধার পর দীপ্তি ছুটলো স্কুল শু পড়তে। শু লেইস হাতে করে তামান্নার সামনে এসে দাঁড়ালো কাঁচুমাচু মুখে। তামান্নার দিকে শু লেইস বাড়িয়ে দিয়ে লাজুক একটা হাসি দিলো দীপ্তি।

-মিস? আমি তো ছোট্ট বাবু। আমি জুতোর ফিতে বাঁধতে পারি না। একটু করে দাও না প্লিজ??

-ওলে বাবুটা---। পাকনি বুড়িটা আমার। মিস প্রতিদিন তোমাকে রেডি করিয়ে দিব বাবু। কেমন? আজকের জন্য সরি বাবু----।

-মিস? তুমি কি রাতে কান্না করেছ?

-না তো দীপু--। কেন বাবু?

-নাহ। আমি ভাবলাম তুমিও আমার মতো রাতে কান্না করলে সকালে উঠতে পারো না---। 

-না বাবু। আর তুমি কাঁদবে কেন? কাঁদবে না একদম কেমন?

-আমার একা একা ভয় লাগে। ওই ফাজিল মেয়েটা আমাকে খালি বলে দুষ্টুমি করলে বাবাইয়ের কাছে মাইর খাওয়াবে--। আমি তাই কান্না করি।

-কোন পচা মেয়ে আমার দীপুকে এসব বলে ভয় দেখায় হ্যাঁ?? বাবাই কি তোমায় কখনো বকে বলো?

-না তো। 

-তাহলে বাবাই মারবে কেন আমাদের লক্ষী দীপুরাণীকে? হুম?

-হ্যাঁ তাইতো!

-আর এখন তো মিস আছি। আর কেউ বকবে না৷ বকলেই মিস তাকেও বকে দিবে কেমন?

-তুমি ওই ফাজিল শয়তান পচা মেয়েটাকেও মাইর দিবা বলো? খালি পচা পচা স্যুপ খাওয়ায় আর বকা দেয় আমাকে। 

-আচ্ছা বাবু। বকে দিবো। মাইরও দিবো আর আমার দীপুমনিটাকে বকলে। কেমন? খুশি তো?

-ইয়েএএএএ। অনেক খুশি---। সেদিন জানো বলেছে তুমি নাকি আমাকে রেখে চলে গেছ--। আমি কতো কেঁদেছি জানো মিস? পরে তো তুমি এলে----।

-কি!! এতো বড় সাহস! আমার দীপুবাবুকে কান্না করায়? আজকে দিবো বকা। 

-হি হি। হি হি। মজা হবে। পচা মেয়ে সাজা পাবে। কি মজা!!

-এখন চলো বাবু। ব্রেকফাস্ট করে স্কুলে যেতে হবে তো। সব ফিনিশ করতে হবে কিন্তু--। ওকে?

-ওকে মিস---।

তামান্না দীপ্তিকে জুতো পড়িয়ে দিয়ে ওর রুটিন দেখে ব্যাগে বই খাতা, রঙ পেন্সিল এসব রাখছিল আর দীপ্তি তামান্নার চারদিকে ঘুরে ঘুরে এসব বলে যাচ্ছে। তামান্না ধরেই নিলো দীপ্তি নিছক ছেলেমানুষি করেই এসব বলছে। তাই তেমন কিছু চিন্তা না করে একহাতে দীপ্তির ব্যাগ নিয়ে অন্যহাতে দীপ্তিকে ধরে নিচে নেমে এলো। ডাইনিং রুমে এসে দেখলো আজ ফালেহা চৌধুরী একাই নাস্তার টেবিলে বসে আছেন। কিশোর নেই। তামান্না ফালেহা চৌধুরীকে গুড মর্নিং উইশ করে দীপ্তিকে একটা চেয়ার টেনে বসিয়ে দিয়ে পাশে বসলো। দীপ্তির ব্যাগটা পাশে রাখলো। দীপ্তিও দিম্মাকে গুড মর্নিং বলে তামান্নার হাতে চুপচাপ খেয়ে নিলো। তারপর তামান্না আর ফালেহা চৌধুরী দুজন দাঁড়িয়ে থেকে দীপ্তিকে গাড়িতে নিয়ে তুলে দিলো। দীপ্তিও এক গাল হেসে 'টা টা টা টা' করতে করতেই গাড়ি গেইট দিয়ে বেরিয়ে গেল।

দীপ্তি স্কুলে চলে যাওয়ার পর ফালেহা চৌধুরী নিজের রুমে গেলেন। আর তামান্না বাগানে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো। বাগানে অনেক রকমের ফুল, ফলের গাছ লাগানো৷ সেগুলো হেঁটে হেঁটে দেখলো তামান্না। আব্বাস নামের বয়স্ক কাজের লোকটি তামান্নাকে দেখে গাছের পরিচর্যা করার ফাঁকে ফাঁকে অমুক গাছের নাম, তমুক গাছ  কোথায় জন্মে, সমুক গাছ কেন শরীরের জন্য ভালো এসব নিয়ে বড়সড় একটা লেকচার দিয়ে ফেললো। তার পাশাপাশি গাছে কি করে পানি ছিটাতে হয়, আগাছা পরিস্কার করতে হয় আর কিভাবে কি পরিমাণে কীটনাশক দিতে হয় তাও শিখিয়ে দিলো।

বাড়ির ভিতরে আব্বাসের ডাক পড়ায় তামান্নাকে একা বাগান ঘুরতে বলে আব্বাস বাড়ির ভিতরে চলে গেল। তামান্নাও সুযোগ পেয়ে পানির পাইপটা হাতে নিয়ে গাছে পানি ছিটাতে ছিটাতে বকবক করতে লাগলো। এদিকে আরেকজন দূর থেকে তামান্নার গাছে পানি দেয়া আর কথা বলা দেখে হাসলো একটু। কি এতো কথা বলছে গাছের সাথে সেটা শোনার জন্য মানুষটা একপা দুপা করে এগিয়ে এসে তামান্নার কাছে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু তামান্না সেটা টেরও পেল না। সে নিজের মনেই বকবক করে চলেছে। 

-এই গাছ? তোর নাম কি? আজ থেকে তুই আমার বন্ধু কেমন? আমরা অনেক কথা বলবো কেমন? আচ্ছা তুইও কথা বলবি কেমন? ওই খারুসটার মতো গাল ফুলিয়ে বসে থাকবি না বুঝলি?

-----------------------

-কি রে? কথা বলিস না কেন? তুইও কি খারুসের মতো থ হয়ে বসে থাকবি নাকি!? আরে কি মুশকিল! এ বাড়িতে সবাই এতো গুম মেরে বসে থাকে কেন? যেন বোম মারলেও একটা শব্দ বের হয় না। হুহ--। আমার দীপ্তিটাই সবচেয়ে ভালো। ও আমার সাথে কতো কথা বলে। ইশ! ও স্কুলে কি যে করছে!! কখন যে ফিরবে দীপুটা!!

-----------------------

-উফফ!! তুইও চুপ করেই থাকবি? তুই একটা জুনিয়র খারুস। হুহ। তবে খারুসটা কিউট আছে অনেক। হিহি৷ 

-কে খারুস মিস তামান্না??

-আরে আছে না এই বাড়িতে একজন------?

কথাটা পুরো শেষ করার আগেই তামান্নার খেয়াল হলো গাছ তো কথা বলবে না৷ কথাটা মানুষই বলেছে। তাই চমকে গিয়ে তামান্না কে কথা বলেছে শোনার জন্য পিছনের দিকে ফিরলো। তাতে কাজের মধ্যে হলো তামান্নার হাতে ধরা পানির পাইপটা থেকে পানি ছিটিয়ে সোজা গিয়ে সোজা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার গায়ে গিয়ে পড়লো। ঘটনাটা এতো আচমকা ঘটলো যে তামান্নার পাইপটা সরানোর কথা মনেই হলো না। ফলে মানুষটা একেবারে কাকভেজা হয়ে গেল। আর তাকে দেখেই তামান্নার মুখ থেকে একটা কথাই বের হলো।

-মিস্টার খারুস!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন