১৩!!
বাসার নিচে গাড়ির সামনে এসেই মনটা খারাপ হয়ে গেল মাইশার। নাহ, ধ্রুব নিতে আসে নি। ধ্রুবর তো আসার কথা ছিল না। তবে কি মাইশার অবচেতন মনটা চাইছিল ধ্রুব আসুক ওকে নিতে! কেন? লোকটাকে প্রতিদিন দেখার কি একটা বাজে অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে ওর! কোথাও বের হলেই আনমনে চোখ জোড়া এদিক সেদিক খুঁজে বেড়ায় ওকে! এসব কেন হচ্ছে মাইশার! নিজেও বুঝতে পারছে না ও। তবে এটুকু বুঝতে পারছে যে মানুষটার উপর একটা নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে। সাথে অনেকখানি বিশ্বাস আর আস্থা। সেটা কেমন করে হয়ে গেল সেটাও মাইশার অজানা। জানতে ইচ্ছেও করছে না। কিছু প্রশ্নের জবাব না হয় অজানাই থাক!
ড্রাইভার দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ির বাইরে। দরজা খুলে দিতেই মাইশা উঠে বসল। অবাক কান্ড! এই লোক তো আজকেই প্রথম দেখল মাইশাকে! আর মাইশাও কিছু বলে নি। তবে চিনলো কি করে ওকে লোকটা! কি সব উল্টাপাল্টা প্যাঁচে জড়াচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না বেচারি। ড্রাইভারকে কি জিজ্ঞেস করবে কিছু! নাহ থাক!
বাড়িটার সামনে গাড়িটা থাকতেই ড্রাইভার নেমে দরজা খুলে দিলো। মাইশা গাড়ি থেকে নামতেই মিষ্টি মেয়েটা এসে ওকে জড়িয়ে ধরল।
-ভাবিইইইই!
-শুভ জন্মদিন মেহেরমনি।
-থ্যাংকু গো লক্ষী ভাবিটা---। চলো চলো--? মা বাবার সাথে দেখা করে আসবা। আজকে তোমাকে অনেক গুলা কিউটি লাগছে গো। কেউ একজনের তো মাথা ঘুরে যাবে। হি হি হি---।
মেহেরের কথা শুনে মাইশা লজ্জা পেল। কার মাথা ঘুরবে সেটা ও জানে। মেহেরের হাত ধরে মাইশা বাড়ির ভিতর ঢুকলো। ড্রইংরুমটা অনেক সুন্দর করে কালো রঙা সেগুন কাঠের ফার্নিচারে সাজানো। টি টেবিলটায় কাঁচের পাটাতন। সেখানে কয়েকটা বই রাখা। আর কোণায় একটা বুকশেল্ফ। আর কিছু নেই রুমটায়। কিন্তু বাড়ির আর মানুষগুলো গেল কোথায়!
-ভাবি! কি চিন্তা করো?
-হুম? আঙ্কেল আন্টি কোথায় মেহের?
-হি হি হি। রান্নাঘরে---।
-তো কিচেনে যাই চলো?
-এই না না না----।
-কি হলো?
-আজকে কারো কিচেনে ঢুকা নিষেধ। শুক্রবার শুধু আব্বু আম্মু যাবে কিচেনে--। বাকি কেউ এ্যালাউড না।
-ওমা! কেন?
-সিক্রেট সিক্রেট--। তবে তোমার তো জানতে হবে--। একটু পরে দেখাবো দাঁড়াও--। হি হি।
-এতো হাসছো কেন মেহেরমনি?
-সিক্রেট জানার পর তোমার রিএ্যাকশনের কথা চিন্তা করে--। হি হি।
-হুম?
------বাবা--মা---। দেখে যাও--? ভাবি আসছে----।
ধ্রুবর বাবা মা তাওহীদ আর সাহেবা তড়িঘড়ি করে এসে মাইশাকে দেখে অনেক খুশি হলেন। অনেকক্ষণ গল্প করে পরে আবার কাজে গেলেন। মাইশা আর মেহের দুজনে বসে কিছুক্ষণ গল্প করলো। ঠিক গল্প না মেহের দুনিয়ার গল্প করছে আর মাইশা সেসব মুগ্ধ হয়ে শুনছে। তবে ওর মনটা এদিক সেদিক একটা মানুষকে খুঁজছে। মানুষটা কি বাসায় নেই! কোথায় গেছে! কখন আসবে!
এসব ভাবছে এর মধ্যে মেহের মাইশার হাত ধরে টানছে।
-এই ভাবি? আসো আসো?
-কোথায়?
-বললাম না সিক্রেট?
-হুম। চলো।
-হুসসসসস। সাউন্ড করো না। আস্তে আস্তে আসো আমার সাথে..।
মেহের আর মাইশা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভিতরে উঁকি দিচ্ছে। উঁকি দিয়ে যা দেখলো মাইশার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। আর মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। আর মেহের মাইশার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। বেচারি মাইশার লজ্জা দেখে কিছুতেই হাসি চাপতে পারছে না। খুব কষ্ট করে মুখে হাত দিয়ে হাসির শব্দটা ঠেকাচ্ছে।
মেহেরের দিকে তাকিয়ে মাইশা আরো লজ্জা পেল। মেয়েটা বড্ড বেশি ফাজিল৷ নইলে এমন লজ্জায় ফেলছে কেন! ধ্রুবর মা সাহেবা রান্না করছে। আর বাবা তাওহীদ পিছন থেকে জাপটে ধরে আছে তাকে। মুখটা একবার চুলে ডুবাচ্ছে। আর একবার ঠোঁট দিয়ে কান ছুঁইয়ে দিচ্ছে। কখনো ঘাড়ে নাক মুখ ডুবিয়ে দিচ্ছে। সাহেবার ঠোঁটের কোণে লাজুক লাজুক হাসি ফুটে আছে। দেখতে ভালোও লাগছে আবার লজ্জাও লাগছে। তাওহীদ সাহেবাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতেই মাইশা মেহেরের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলো রান্নাঘরের দরজার সামনে থেকে।
কোনমতে গিয়ে সোফায় বসে পড়লো মাইশা। লজ্জায় প্রাণ যায় যায় অবস্থা বেচারির। আর মেহের সেটা দেখে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। মাইশা মেহেরের দিকে অবাক চোখে তাকাল।
-শোন ভাবি--। শুক্রবার হলো আব্বু আম্মুর প্রেম দিবস। ওই দিন রান্নাঘরে সবার জন্য কারফিউ। তবে তোমরা চাইলে বাকি ছয়দিন রান্নাঘরে প্রেম করতেই পারো। শুধু শুক্রবারটা বাদ---। আমি কিছুই দেখবো না--। হি হি।
-কি বলো এসব মেহেরমনি?
-ওরে লজ্জাবতী ভাবিটা! আমার ভাইয়াটা এত্তো লাজুক লাজুক। তাই ভাবলাম তোমাকেই রোমান্স করা শিখাই--। তোমার ও তো দেখি একই অবস্থা! কি যে হবে তোমাদের দুইটার!
মেহেরের কথায় মাইশার ইচ্ছে করছে মাটি খুঁড়ে ঢুকে পড়তে। এই মেয়েটা এতো দুষ্টু! তার ভাইটা কেমন দুষ্টু হবে! কিন্তু ধ্রুবটা গেল কোথায়! মানুষটা কি খুব ব্যস্ত আজকে! একবারও তো বললো না! আর সকাল থেকে কথাও হয়নি একবারও! ধ্রুবর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে মাইশার। হয়তো কাছ থেকে একটু দেখতেও ইচ্ছে হচ্ছে। কি হচ্ছে ওর!
১৪!!
মেহেরের সাথে ওর রুমে এসে বসেছে মাইশা। সুন্দর করে গোছানো রুম। বিছানায় এসে বসতেই মেহের মাইশাকে এসে জড়িয়ে ধরলো।
-ভাবি? তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে বলেছিলাম না?
-হুম---।
-তুমি দু মিনিট বসো। আমি তোমার সারপ্রাইজ নিয়ে আসি--।
-আচ্ছা---।
মিষ্টি মেয়েটাকে কি দেওয়া যায় সেটা নিয়ে অনেক ভেবে শেষমেষ দুটো পারফিউম, অনেকগুলো রঙ বেরঙের কাঁচের চুড়ি, টিপ, কাজল, লিপস্টিক, চকলেট, কানের দুল, লাভ শেইপের একটা লকেট, নূপুর, নথ, টিকলি-এসব কিনে একটা গিফ্টবক্সে র্যাপিং করিয়ে এনেছে মাইশা। কিন্তু দেয়া হয়নি এখনো। খাটের উপরে বক্সটা রাখল মাইশা। গিফ্ট পছন্দ হবে কিনা কে জানে! আর গিফ্ট দেখার পর মেয়েটার রিএ্যাকশনই বা কি হবে কে জানে!
মাইশা এসব ভাবতে ভাবতেই মেহের এসে একটা ডায়েরি মাইশাকে ধরিয়ে দিল। মাইশা অবাক হয়ে মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কার ডায়েরি! আর ওকেই বা কেন দিল মেহের!
-এটা ভাইয়ার ডায়েরি ভাবি। সে তো তার মনের কথা জীবনেও বলতে পারবে বলে মনে হয় না আমার--। তুমি নাহয় নিজে থেকেই জেনে নাও---?
-এটা কিন্তু ঠিক না বাবু--। অন্যের পারসোনাল জিনিসে----।
-আরে বাবা--৷ বর বউয়ের মধ্যে এতো পারসোনালের কি আছে? পড়ে ফেলো তো তুমি--?
-কিন্তু?
-পড়ার পর বইলো কি বুঝলা---।
-হুম? মেহের ওখানে একটা বক্স আছে--৷ একটু দেখো তুমি ওটা--।
-ইয়েএএএএএ---। আমার গিফ্ট! থ্যাংকু মিষ্টি ভাবি-। উম্মাহ।
-দেখো আগে। পছন্দ হয়েছে কিনা-----।
-হুম হুম। তুমিও দেখো।
মাইশা নীল মলাটের ডায়েরিটা হাতে নিয়ে ভাবছে দেখাটা কি ঠিক হবে! ধ্রুব যদি রাগ করে! তবে মনে হচ্ছে ডায়েরিটায় ওর অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। যে প্রশ্নগুলো এতোগুলো দিনে মাইশা ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারে নি৷ এই যেমন তিন বছরের ব্যাপারটা কি! অনেক ভেবে শেষমেশ ডায়েরিটা পড়া শুরু করলো মাইশা। ডায়েরিটায় তেমন বেশি কিছু লেখায় হয় নি। ছোট ছোট কিছু লেখা। উপরে তারিখ দেয়া আছে৷ প্রথম পৃষ্ঠায় তিনবছর আগের একটা তারিখ।
"আজকে একটা মেঘপরীকে দেখলাম। প্যাঁজা তুলতুলে মেঘের মতো সাদা একটা জামা পড়নে। তার উপরে সাদা ফুলহাতা কটি। ঢুলুমুলু পাজামা আর তুষারশুভ্র ওড়না। দু হাত ভর্তি করে সাদা রেশমি চুড়ি। আর কাজল টানা সাদামাটা মুখ। সব মিলিয়ে সাদাপরী। মনে হচ্ছে মেঘের দেশ থেকে সবেই পৃথিবীতে নেমে এসেছে। কাউকে তো এতো খুঁটিয়ে দেখা হয় না। তবে মেঘপরীটাকে দেখতে বেশ লাগছে। তার নেশায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি।"
"আজ দুদিন ধরে খুঁজেও মেঘপরীটাকে পাচ্ছি না। অসহ্য লাগছে। ধুর---।"
"আজ মেঘপরীটাকে দেখেছি জলপরী রূপে। বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে জবুথবু হয়ে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। মানুষটাকেও দেখলাম। নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করছি সেই কখন থেকে। পরী তো কেবল ভাগ্যবানদের কপালেই জোটে---। অতো ভাগ্য করে হয়তো আসিনি পৃথিবীতে -----।"
"মেঘপরীটাকে না দেখেও থাকতে পারিনা৷ প্রতিদিনই তো দেখি৷ দেখার পরে আরো দেখার লোভ জেগে যায়। অফিস বদলেছি পরীটাকে প্রতিদিন একনজর করে দেখব বলে। কফিশপটায় বসে থেকে পরীটাকে দেখি আর ভাবি- মেয়েটা কি কখনো জানবে আমার মনের কথা!"
এর পরে বেশ অনেকগুলো সাদা পৃষ্ঠা। কিছুই লেখা নেই তাতে। তারপর আবার লেখা।
"বাবার কাছে ধরা পড়ে গেছি। বাবা নাকি পরীটার বাড়িতে কথা বলবে! কিন্তু পরীটা তো অন্য কারো। বুঝে না কেন এরা?"
"একটাবার পরীটাকে কাছ থেকে দেখবো বলে বাবার কথায় রাজী হয়ে গেলাম। আমার ভাগ্যে নেই তুমি। তাতে কি হয়েছে? আমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে তো আছো।"
"কি হলো পরীটার! কেমন যেন এলোমেলো লাগছে ওকে! গতকালও তো কতো হাসিহাসি মুখটা দেখেছি! একদিনে কিইবা এমন হলো?"
"নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। পরীটা কি সত্যিই আমার ভাগ্যে আছে?"
"তোমার হাতটা ধরে আর ছাড়তে মন চায় না কেন পরী? তোমার চুলের মিষ্টি ঘ্রাণ কেন এতোটা নেশা ধরায়! কেন তোমার সামনে এলেই সময়রা নিমিষে হারিয়ে যায় অজানায়?"
"কাল শুক্রবার। সপ্তাহের এই দিনটাকে একদমই ভালো লাগে না। পরীটাকে যে দেখা হয় না৷ কাল সারাদিন ঘুম হবে।"
ডায়েরিটায় আর কিছু লেখা নেই। শেষ লেখাটা গতকালের। মলাট বন্ধ করেই মাইশার খেয়াল হল আলতো কাঁপন ধরেছে ওর। হাত পাগুলো যেন থরথর করে কাঁপছে। ধ্রুব এতোগুলো দিন ধরে ওকে দিনে! কই বলে নি তো কখনো? আর রাতুলের কথাই কি বলেছে ডায়েরিতে! তবে কেন একবারও জিজ্ঞেস করে নি কি ঘটেছিল? ও কি সবটা জানে! ভাবতেই গলা শুকিয়ে কাঠ হচ্ছে মাইশার। যদি কি হয়েছে না জানে তবে একসময় ওর মনে হবে না যে মাইশা ওকে ঠকিয়েছে? নাকি সমস্ত ব্যাপারটা জেনে ভালোমানুষ সেজে মাইশার জীবনে আসছে সে! তার এই ভালোমানুষির মুখোশটা ফেলে আসল রূপটা দেখাতে শুরু করবে ধীরে ধীরে! তাহলে! তখন কি করবে মাইশা? আসলেই কি রাতুলের কথাগুলোই ঠিক! এসব কি শুধু বইয়ের পাতায় থাকার জন্য করা নিয়ম! আর শুধু লোক দেখানোর জন্যই এই ভালোমানুষির মুখোশটা?