!!৪৬!!
মাহা চিৎকার করে উঠে বসলো। নার্স নাজমা বিরক্ত হলেন। মাহা উঠে বসে হাঁপাচ্ছে।
"পানি, পানি।"
নার্স নাজমা পানি এগিয়ে দিলেন। সকাল আটটা বাজে। চারিদিকে রোগী আর আত্মীয় স্বজনের আহাজারির আওয়াজ। নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিলো মাহা। গলাটা প্রচুর ব্যথা করছে তার। ঢকঢক শব্দ তুলে পানি খেলো সে। পানি গিলতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। পানির মগটা পাশে রেখে আশেপাশে তাকালো মাহা। ততক্ষণে নার্স নাজমা বেড়িয়ে গেছেন। মাহার শরীরটা প্রচন্ড দুর্বল লাগছে। উঠে দাঁড়ালো মাহা। বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। মাথায় উড়না পেঁচিয়ে নিজেকে ঢেকে নিলো। উদ্দেশ্য মর্গে যাবে। তিনতালা থেকে দুতালায় নেমে এলো মাহা। দুইপাশেই যাওয়ার রাস্তা। মাঝ বরাবর সিঁড়ি। ডানে যাবে না বাঁয়ে! দ্বিধায় পড়লো সে। ডানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। পা বাড়ানোর আগেই পুরুষালি আওয়াজ।
"মাহা।"
রেজওয়ান সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। উঠে মাহার কাছে এসে দাঁড়ালো। নরম কন্ঠে বললো,
"কোথায় যাচ্ছো?"
মাহা মাথা নিচু করে রইলো। আস্তে করে বললো,
"আমায় বাড়ি নিয়ে চলুন, রেজওয়ান ভাই।"
"ঠিক আছে। চলো। হাঁটতে পারবে?"
"হুম।"
ব্যস, কথা এতটুকুই। রেজওয়ানের সাথে বাইরে এসে দাঁড়ালো মাহা।
"তুমি দাঁড়াও। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।"
মাহার বেহায়া হৃদপিণ্ড ছলাৎ ছলাৎ করছে। কি এক তৃষ্ণা মিটাতে চাচ্ছে। ঝাঁকড়া চুলের মানুষটা। ঝাঁকড়া চুলের মানুষটা কি তবে মন বন্দী করার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে! মর্গে যাওয়ার কথা ভুলে গেলো মাহা। কেবল সেরিব্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভারী পুরুষালি কন্ঠের মানুষটার কন্ঠ। ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। হর্নের আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো মাহার।
"গাড়িতে উঠো।"
"হুম।"
বলেই গাড়িতে উঠে পড়লো মাহা। হসপিটাল ছেড়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে বহুদূর। আবারো হৃদয় নিঙড়ানো ব্যথা অনুভব করলো মাহা। তাদের গাড়ি বের হওয়ার সময় পাশ দিয়েই ভিতরে ঢুকলো সার্থকের গাড়ি। ভোরের দিকে মাহার পাশ থেকে উঠে জরুরি কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল তাকে। রেজওয়ান আপনমনে গাড়ি চালাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষ পাশে বসলে হৃদয় হয়ে উঠে প্রজাপতির মতো। উড়ে বেড়ায় দিগন্ত থেকে দিগন্তে। রেজওয়ানের মনেও লেগেছে সেই হাওয়া। হৃদকম্পন বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ। বিড়বিড় করলো রেজওয়ান,
"কবে তুমি আমার হবে?"
মুখের অভিব্যক্তি সব সময়ের মতো। দেখে বুঝার উপায় নেই তার ভিতরে কি চলছে। মাহার অবশ্য এসব খুঁজার সময় নেই। সে চেয়ে আছে বাইরে। সাদা ধবধবে আকাশের পানে। মনের বিরুদ্ধে সে লড়ছে নাকি মন তার বিরুদ্ধে লড়ছে? গাড়িটা থেমে গেলো। বাকিটা পথ হেঁটে যেতে হবে। রেজওয়ানের জরুরি কাজ আছে। থানায় যাওয়া প্রয়োজন। বাকিটা পথ ইচ্ছে ছিলো একসাথে যাওয়ার। মানুষের কিছু কিছু ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে যায়। একেবারে নিরবে নিভৃতে।
"মাহা। আমার কাজ আছে। বাকিটা পথ তুমি একা যেতে পারবে?"
"পারবো, ভাইয়া।"
"ঠিক আছে। সাবধানে যেও। আর মা অনেকদিন যাবত তোমার কথা বলছিলেন। বিকালে যদি পারো তাহলে একটু মায়ের সাথে দেখা করে এসো।"
"আচ্ছা।"
"তাহলে আমি যাই।"
কথোপকথন শেষে মাহাকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো রেজওয়ান। মাহা চলেছে বাড়ির পথে। হঠাৎ করেই রাস্তায় পা রাখার পর বাবার জন্য মন কেমন করে উঠেছে মাহার। দ্রুত বাড়ির দিকে ছুটলো মাহা।
!!৪৭!!
"স্যার। মিঃ শাওন এই কেস থেকে বিরতি নিতে চাচ্ছেন। উনার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা।"
প্রলয় খানিকটা মনক্ষুন্ন হলেন। যদিও তার কঠিন চেহারায় সেই অভিব্যক্তি প্রকাশ পেলোনা। উনি অনেক ভেবে চিন্তে তিনজন তেজস্বী পুলিশ অফিসার নিযুক্ত করেছিলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে উনি বললেন,
"সম্পূর্ণটা বলুন রেজওয়ান।"
প্রলয় তেজস্বী মস্তিষ্কের মানুষ। রেজওয়ান ভালোই জানে। তাই বললো,
"স্যার, আমরা মিস তাজকে আমাদের সাথে নিতে চাচ্ছি।"
কথাটা শুনে ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কপালের একপাশ ঘষলেন প্রলয়। এটা তার মুদ্রাদোষ। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন,
"ঠিক আছে।"
স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো রেজওয়ান। কেস নিয়ে কিছু কথা বলে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। অনেক পরিকল্পনা করতে হবে। মোবারকের কল।
"সালাম, মিঃ রেজওয়ান।"
"সালাম।"
"আমি সিলেট পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছি। কিছুক্ষণের মাঝেই টিম নিয়ে বেরিয়ে পড়বো স্পটের উদ্দেশ্যে।"
"গুড। মিঃ মোবারক। খেয়াল রাখবেন একটা ক্লু। একটা ক্লুই পারে আমাদের সঠিক দিশা দেখাতে।"
"সর্বাত্মক চেষ্টা করবো মিঃ রেজওয়ান। আপনি মিস তাজের সাথে কথা বলে নিবেন। আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী এগুতে হবে।"
"জ্বি।"
কথা শেষে কল কেটে দিলো রেজওয়ান। কোথ থেকে কি শুরু করবে! কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। এটা অনেকটা অন্ধকারে সুঁই খোঁজার মতো। নিজের চেয়ারে বসে ঘটনাটুকু বিশ্লেষণ করলো রেজওয়ান।
'মাহা-চৈতির সিলেট ঘুরতে যাওয়া। হঠাৎ করেই রাতের বেলা মাহার ফোন। চৈতির হারিয়ে যাওয়া। চৈতির খোঁজ করা। মাহার সবকিছু ভুলে যাওয়া। আগুন পাহাড় থেকে একটা অজানা নারীর পায়ের অংশ খুঁজে পাওয়া। প্রাথমিক শনাক্তকরণে যা বুঝা গেলো এটা চৈতির দেহের অংশ। খুনের ধরন সেই ২০১২ সালের সিরিয়াল কিলার মাতব্বর শরীফের মতো। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব! মাতব্বর শরীফ তো জেলে। তার বিচার কাজ এখনো ঝুলে আছে। তাহলে কে আছে এর পিছনে? আদোও মাতব্বর শরীফ কি আসল খুনি? নাকি তাকে কেবল ব্যবহার করা হয়েছে? ঘটনার পিছনের ঘটনা কি? কিন্তু শরীফকে ধরার পর থেকেই তো খুন বন্ধ হয়েছিলো। তাছাড়া আজিজ ছিলেন ২০১২ সালের ঘটনার তদন্তে। সমস্ত উত্তর মিলতো তার কাছে। তিনি তো মৃত। উনার মৃত্যু হয়েছে অগ্নিকান্ডে। সেটা কি আদোও এক্সিডেন্ট!'
অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রেজওয়ানের মস্তিষ্কে। একটারও সঠিক উত্তর নেই। আঙুলের ডগায় কলম নিয়ে একমনে চিন্তা করছিলো রেজওয়ান।
"আসবো, মিঃ রেজওয়ান?"
মিস তাজ এসেছেন। মাথা তুলে তাকালো রেজওয়ান। বললো,
"আসুন। মিস তাজ।"
তাজ চেয়ারে এসে বসলেন। আটাশ বছর বয়সী চৌকস পুলিশ অফিসার। মুখে টানটান ভাব। গাঁয়ে বাংলাদেশ পুলিশের ইউনিফর্ম। চুলে খোঁপা। শান্ত চেহারার এই তরুণী ভয়ংকর। যতটা শান্ত তাকে দেখা যায় ততটাই অশান্ত তিনি। আসামির কলিজা কেঁপে উঠে দ্বিতীয়বার তার সাক্ষাৎ পেলে। প্রথমবার তাকে অবলা ভেবে অনেকেই ভুল করে। যারা আসল রূপ দেখেছে তাদের গাঁয়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় এই নারীর দ্বিতীয় দর্শনে। ঘোড়া দৌড়ে স্বর্ণপদক জয়ী এই তেজস্বী।
!!৪৮!!
"চলে গেছেন মানে?"
"উনি সকালে পুলিশ অফিসারের সাথে চলে গেছেন।"
নার্স নাজমার কথায় অনেকটা অবাক হলো সার্থক। মানে মাহা তাকে না বলে চলে গেলো! মাহার কাছে এতটা পর সার্থক! আবার পালালো তার থেকে? সেই প্রথমবারের মতো এবারেও। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সার্থক। নিজের চেয়ারে হেলান দিলো এবার। নার্স নাজমা দাঁড়িয়ে আছেন।
"স্যার, আমি কি আসতে পারি?"
"হুম।"
গম্ভীর শোনায় সার্থকের গলার আওয়াজ। কি ভেবে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তাঁর। পুলিশ অফিসার মানে! রেজওয়ানের সাথে বেরিয়েছে মাহা! অজানা কারণে সার্থক রেজওয়ানকে পছন্দ করেনা। মাহার প্রতি রেজওয়ানের দৃষ্টিভঙ্গী অন্যরকম। মাহার কাছে রেজওয়ানকে দেখলেই সার্থকের রাগ উঠে যায়। প্রচন্ড রকমের রাগ। শান্ত, ঠান্ডা মস্তিষ্কে রক্তের বুদবুদ ফুটে যেনো।
"তোমাকে আমি নাহয় ছিনিয়ে নিলাম দুনিয়া থেকে।"
_________________
এই মিনিট কয়েকের পথটাও হাজার মাইলের লাগছে মাহার কাছে। রাস্তাটা শেষ হচ্ছেনা যেন। ধীর পায়ে দুর্বল শরীরে বাড়ির সামনে পৌঁছালো মাহা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই কান্নার আওয়াজ পেলো সে। বাবার জন্য মন কেমন করে উঠলো মাহার। নিজের কথা না ভেবে দৌড়ে উপরে উঠছে মাহা। এই পৃথিবীতে একমাত্র আপন মানুষটা কি ঠিক আছে? তিনতালা পেরিয়ে চারতালায় উঠতেই আহাজারি স্পষ্ট হলো মাহার কাছে। দিনা কাঁদছেন। সেই সাথে মাহার সৎ ভাই মাহিন, বোন দিয়ারও কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। ভিতরে প্রবেশ করলো মাহা। ড্রয়িং রুমে কিছু মানুষের ভিড়। মাহা হতভম্ব হয়ে দৌড়ে গেলো বাবার ঘরের দিকে। খাটের উপর আজাদ হোসেন শুয়ে আছেন। আর হয়তো কোনোদিন চোখ খুলে তাকাবেন না তিনি। ঘরে আমেনা, দিয়া, মাহিন, দিনা, এশা সহ অনেকে। কিছুক্ষণ আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আজাদ হোসেন। মাহা অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো বাবার নিথর দেহের দিকে। চোখ ফেটে জল বেরুলো না এবার। হৃদপিণ্ড নিমিষেই পাথর হয়ে উঠলো তার। চোখ দুটো ইটের খন্ড। সবাই কান্না করছে। সে চেয়ে আছে। তার চোখে কোনো পানি নেই। গলায় কোনো আওয়াজ নেই। দিনা হঠাৎ খেয়াল করলেন মাহাকে। আহাজারি থামিয়ে এসে মাহার সামনে দাঁড়ালেন। কিছু বুঝে উঠার আগেই গালে চড় পড়লো মাহার। মাহা কোনো প্রতিক্রিয়াই করলোনা। তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ।
"তুই রাস্তায় মরতে পারলি না? আমার স্বামীকে খাইয়া শান্তি হয় নাই তোর? আরো খাইতে চাস? আমাকে খাবি। নে, আমাকে খা। মুখপুড়ী গিল আমারে।"
দিনা চিৎকার করে উঠলেন। আমেনা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন দিনাকে।
"মা, শান্ত হ।"
"কেমনে শান্ত হই। আজ কেবল এই কলঙ্কিনীর কারনে আমি বিধবা হইছে। আমি মাইরা ফেলবো ওরে।"
দিনা আবারো তেড়ে এলেন মাহার দিকে। মাহা ঠায় দাঁড়িয়ে। কোনো নড়চড় নাই। এদিকে কয়েকজন মিলেও ধরে রাখতে পারছেনা দিনাকে। এবারে দিনার বড় ভাই অর্থাৎ এশার বাবা এগিয়ে এসে থামাতে চাইলেন দিনাকে। দিনা থামলেন না। কারো কথা শুনলেন না। মাহার হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নেমে এলেন। মাহা অনুভূতিহীন।
.
.
.
চলবে..........................