অচেনা অতিথি - পর্ব ৩৬ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


তিতির ডাইনিংরুম থেকে বের হতেই আসমা এসে বলল," আপা আপনি কই যান? যেখানেই যান আমাকে নিয়ে যান। তাছাড়া ভাইজান এসে এখানে যে তান্ডপ শুরু করবে সেটা দেখার মত সাধ্য আমার নেই।"

তিতির আসমার গালে হাত বুলিয়ে বলল," ইনশাল্লাহ্ শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে।" তিতির বের হয়ে চলে এলো।


গোলাব লাবীবার দিকে চেয়ে ডেকেই যাচ্ছে। গোলাবের এমন ব্যবহারে লাবীবা কিছুটা ভয় পেল। বাতাসি চিক্কুর দিয়া বলল," সাবিনা আর লাডিডা লইয়া আয়তো! আজ এরেই সোজা করুম।"

আন্নের লাডি আন্নে লইয়া আহেন। সাবিনা লাবীবার কাছে গিয়ে বলল," আম্মা, আপনে কামডা ঠিক করেন নাই। এই ভর সন্ধায় কেউ কারে খেদায় দেয়না। একদিন খুব পস্তাবেন। আজ আন্নের চোখে মুখে শুধু ডেমাগের ছাপ পইড়া আছে। কামটা ঠিক করেন নায়। মাথার উপর আল্লাহ্ বলে কেউ আছেন।"

সাবিনা গোলাবের দিকে চেয়ে বলল," কার লায় ঝগড়া করোস। হেই কি বাড়িত আছে?"

সাবিনার কথা বলতে দেরি কিন্তু গোলাবের দৌড় দিতে দেড়ি নাই। এক দৌড়ে বাসার বাহিরে চলে গেল। তিতির তখন ওড়না দিয়ে ওর মুখটা সুন্দর করে বেঁধে ফেলেছে। কারন মাহাদের অনুমতি নাই বাহিরে খোলা মুখে যাওয়ার। গোলাব এসে শক্ত করে তিতিরের কামিজ ধরে টেনে বাসায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। 

আমি বাসায় আর ঢুকতে পারবোনা গোলাব। তুই চলে যা। কিন্তু গোলাব নাছোড়বান্দা সে তিতিরকে ছাড়া কিছুতেই যাবেনা। শেষে তিতির ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেই ও তিতিরকে ছেড়ে দিল। তিতির সোজা দাড়োয়ান চাচার কাছে গেল। এই সুযোগে গোলাব এক লাফে গেট পেরিয়ে বাহিরে চলে গেল। 
চাচা আপনার কাছে পাঁচশত টাকা হবে! আমার খুব দরকার ছিল। ধার হিসেবে যদি দিতেন খুব উপকার হত।

দাড়োয়ান চাচা সন্দেহের চোখে তিতিরকে খুব ভালো করে দেখে বলল," তিতির! এভাবে আছো কেন? আর এই সন্ধ্যা বেলায় কই যাও! "

আমার কাজিনের কাছে যাচ্ছি। আমার খুব দরকার ছিল বলে তিতির আর কিছু না বলে বাহিরে এসে দেখল গোলাব তার জন্য অপেক্ষা করছে। 
গোলাব বাসায় যা। আমি কই যাবো ঠিক নাই আর এই অবস্থায় তোরে কই রাখবো বল! 

দাড়োয়ান চাচা টাকা নিয়ে এসে বলল," ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পোষা কুকুর। ওকে যা আদেশ করা হয়েছে ও তাই করবে। ওকে চুল পরিমানও সরাতে পারবেনা তোমার কাছ থেকে। ও নিজে ভেঙ্গে শেষ হয়ে যাবে কিন্তু ওর মালিককে কখনো হারতে দিবেনা। ওকে তোমার সাথেই নিয়ে যাও। নিশ্চয় কোন কারন আছে যার জন্য ও তোমার কাছে থাকতে চায়।"

তিতিরের হাতে পাঁচশত টাকা গুজিয়ে দিল। আমি কি তোমায় ট্যাক্সিতে তুলে দিব?

"না চাচা দরকার নেই, আমি নিজে ঠিক করে নিব।"

তবুও দাড়োয়ান চাচা একটা ভালো ট্যাক্সি দেখে তুলে দিল তিতিরকে।

তিতির আর গোলাব চলে গেল অজানা পথে। কিন্তু কপাল খারাপ, মাঝপথেই ট্যাক্সি থেমে গেল। ডাইভার চেক করে বলল," আপা, গাড়ী মনে হইতাছে নষ্ট হয়ে গেছে। আপনাকে একটা ট্যাক্সি ধইরা দেই আপনি বরং সেটাতে চলে যান।"

তিতির নেমে পড়লো। সাথে গোলাবও.....

কেউ ঐ দিকে যেতে চাইনা। গেলেও ভাড়া আরো বেশি চায়। শেষে সাধ্যর মধ্য একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল কিন্তু গোলাব উঠতে রাজি না। কিছুতেই গোলাবরে উঠানো গেলনা। 

ট্যাক্সি ডাইভার ক্ষেপে গিয়ে বলল, " কুত্তার ঢং দেখলে বাঁচিনা। আপনার আর দায়িত্ব নিতে পারলামনা। আপনি আপনার রাস্তা দেখেন।"

তিতির গোলাবকে নিয়ে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে পড়ল। এমন সময় একটা লোক এসে বলল," এই তোর রেট কত!

গোলাব এমন জোড়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো আর ওর এক পা দিয়ে মাটি আচড়াতে লাগলো লোকটির দিকে তাকিয়ে। লোকটির আর সাহস হলনা সেখানে দাড়িয়ে থাকতে। দ্রুত সরে গেল লোকটি।

প্রায় ১৫ মিনিট যাওয়ার পর হঠাৎ নিজের দু'পা উচু করে গোলাব রাস্তার সামনে দাড়ালো। আর সাথে সাথে  একটা ট্যাক্সি এসে ওর সামনে দাড়ালো। ট্যাক্সির ডোর খুলে একটা মহিলা ডাইভার বেরিয়ে এসেই গোলাবকে আদর করে বলল,' কি গোলাব মামু,  আজ কোন পাসেঞ্জারকে সাথে করে নিয়ে আসছো।

তিতির বিস্ফোরিত চোখে গোলাবের কর্মকান্ড দেখছিল। গোলাব তিতিরকে দেখিয়ে দিয়ে একদম সোজা ট্যাক্সিতে উঠলো। মহিলাটি তিতিরকে ইশারা করে ডেকে বলল," গোলাব কি এখন আপনার সাথে থাকে?"

" আমার হ্যাসব্যান্ড ওকে চারমাস আগে এনেছিল। খুব সমস্যায় পড়েছি। আপনি কি যাবেন বলে লোকেশন বলল তিতির।"

" আসুন বলে মহিলাটি  ট্যাক্সিতে উঠে বলল," আপনার কি গোলাব সম্পর্কে ধারনা আছে!"

" তিতির ট্যাক্সিতে উঠে বলল, " না।"

আপনি হয়ত জানেন না, গোলাবের আসল মালিকের নাম ইব্রাহীম। উনি একজন অবসর প্রাপ্ত কর্নেল ছিলেন। সে অত্যান্ত কঠোর ভাবে গোলাবকে লালন-পালন করেছে। আমি যতদুর জানি ওর বয়স আড়াই বছর ।  ঢাকা শহরের প্রায় তিন হাজার বিভিন্ন গাড়ী চালকের সাথে ওকে পরিচয় করে দেওয়া হয়েছে এই আড়াই বছরে। কোন প্রশাসনের কাছেও এমন প্রশক্ষিন প্রাপ্ত কুকুর নেই। শুধু গাড়ী চালক না ১২৫টি কাজের উপর ওকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। ও কাছে থাকা মানে আপনি সম্পূর্ন নিরাপত্তায় থাকা। কিন্তু এটা মাথায় আসছেনা ইব্রাহিম স্যার কেন এত মূল্যবান জিনিস নিজের কাছ ছাড়া করবেন? 

তাছাড়া একে জোড় করে কেউ রাখতেও পারবেনা। কিন্তু আপনার সাথে ওর সম্পর্ক দেখে মনে হচ্ছে ও স্ব-ইচ্ছায় এখানে আছে। ওর চেনা গাড়ী না হলে, ও কখনো এখান থেকে আপনাকে নিয়ে যেতনা। কারন এত রাতে আপনার দায়িত্ব তার উপর পড়েছিল। আপনার ভাগ্য আছে বলতে হয়, ওর মত একটা সঙ্গী পেয়েছেন। 
আমি বাসায় চলে যাচ্ছিলাম তাই গাড়ী থামাতাম না।কিন্তু ওরে দেখে থামাতে হল। আপনি বিপদে আছেন ওকে দেখেই বুঝতে পারলাম। আমার জায়গায় ওর পরিচিত যে কোন ট্যাক্সি থাকলেও তারা আমার মত একই কাজ করত।

তিতির গোলাবের গায়ে হাত দিতেই গোলাব তিতিরের কোলের মধ্য ঢুকে গুটিসুটি হয়ে বসলো।

গন্তব্য স্থানে এসে মহিলাটির ফোন নিয়ে তিতির রবিনকে কল দিল। গোলাব ওর এক পা দিয়ে মহিলার  হাত আলিঙ্গন করলো। মহিলা হাসি মুখে গোলাবের সাথে কথা বলছিল আর গোলাব লেজ নাড়িয়ে কেমন জানি সুর তুলে কথা বলতে লাগলো। গোলাবের এমন স্বভাব তিতির কখনো দেখেনি। মনে হয় কত দিনের পরিচিত তারা।

প্রায় ১০ মিনিট পর রবিন এসে তিতির আর গোলাব কে নিয়ে গেল।

♦♦♦♦

এতকিছু হয়ে যাওয়ায় গোলাবের দিকে নজর পড়ল না লাবীবার। কিন্তু পরক্ষনে মনে হতেই ভয় পেয়ে গেল। গোলাবকে না পেলে মাহাদ কাউকে আস্ত রাখবেনা। সেটা মাহাদ স্পেনে যাওয়ার আগে ওর মাকে বার বার করে বলে গেছে।

এই গোলাব কোথায় বলে পুরো বাসা সহ সব কিছু তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল কিন্তু ওকে কোথায়ও পাওয়া গেলনা।

পরের দিন মৌয়ের মাকে কল দিয়ে ডাকা হল। সাথে মৌতুসিও আসলো। লাবীবা ভদ্র মহিলাকে  ইচ্ছা মত কথা শুনালো। মৌয়ের মা মাথা নিচু করে সব কথা হজম করতে লাগল।

কিন্তু মৌতুসি লাবীবার কথা কেড়ে নিয়ে বলল," আপনি এত কথা যে বলছেন, আপনি কি জানেন তিতির সম্পর্কে! আপনার ছেলে কি দুধে ধোয়া তুলশি পাতা! আপনার ছেলে ওর পিছে না লাগা  পর্যন্ত এমন কাজ তিতির কখনো করবেনা। শাসন করতে হলে আগে আপনার ছেলেকে শাসন করেন তারপর তিতিরের দিকে হাত তুলবেন। আজ যদি তিতিরের কিছু হয় তাহলে আপনাদের বৌ-শাশুড়ীর বিরুদ্ধে আমি আগে মামলা করবো। মেয়ে বিয়ে দিছি বলে আপনারা আমাদের মাথা কিনে নিছেন নাকি?
তিতিরের পরিবার সম্পর্কে আপনি কি জানেন? ওর বাবা এলাকার একজন সুনামধন্য মানুষ। যার টাকার কোন অভাব নেই। তিতিরের আপন মা অত্যান্ত সৌখিন মানুষ ছিল। সে যদি বেঁচে থাকতো তাহলে তার মেয়েকে সেই ভাবেই তৈরি করতো। সেখানে আপনার ছেলের পাত্তা থাকতোনা। আজ ভাগ্যর ফেরে ওমন ঘরের মেয়ে আজ আপনার বাসায় ছিল। কষ্টি পাথরের মূল্য আপনি ধোপা হয়ে কিভাবে বুঝবেন। ওর মূল্য একজন খাঁটি স্বর্নকারই বুঝবে।"

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মৌতুসি থামল। আমার আপুকে আমাদের বাসায় স্ব-সম্মানে ফেরত দিয়ে যাবেন আর পরের দিন পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে থাকবেন। মৌতুসি ওর এক আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল," একজনকেও ছাড় দিবনা।"

মা চল এখান থেকে। মনুষত্ব্য আর হৃদয়হীন মানুষদের কাছে কখনো সহানুভূতি পাওয়া যায় না বলে মৌতুসি ওর মাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

♦♦♦♦

মাহাদ স্পেনের মাটিতে পা দিয়ে প্রথমে ওর বাবাকে কল দিয়ে জানিয়েছে। তারপর তিতিরের নাম্বারে বহুবার কল দিয়েছে কিন্তু বারবার নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছিল। প্রথমে খানিকটা রেগে গেলেও পরে ওর হিসাব গড়মিল হতে লাগলো। নাহ্ তিতির কখনো এমন কাজ করবেনা। তারমানে তিতির ঠিক নেই। না না কিছু তো একটা হয়েছে। আমার জিবনটা ঠিক নেই। মাহাদ সবার সাথে কথা বলেছে কিন্তু কাউকে তিতিরের কথা আর বলতে পারলোনা। শেষে আসমাকে কল দিল। 

আসমা কল রিসিভ করার সাথে সাথে মাহাদ বলে উঠলো," তিতিরকে ফোনটা দাও এক্ষুনি।"

" ভাইজান, সামনে আপনার মা আর দাদী আছে। আপনি চিন্তা করেন না আপা ঠিক আছে। ওনার ফোন নষ্ট হয়ে গেছে। আপনি বাসায় এসে ওনার সাথে কথা বলেন বলে কল কেটে দিল আসমা।"

♦♦♦♦

নাহ্ কিছুতো হয়েছে। মাহাদ ওর মনটা একদিকে রেখে কাজে মনযোগ দিল। যত দ্রুত কাজ শেষ করতে পারবে তত দ্রুত সে দেশে ফিরতে পারবে। ৪ দিন স্পেনে অবস্থান করে বার্সেলোনায় পাড়ি জমালো। তার একদিন পর সম্মোলনে যোগদান করে ওর কম্পানিকে সবার সামনে অতিচমৎকার ভাবে উপস্থাপন করে হোটলে ফিরে আসলো। হোটেলে এসে রুমে ঢুকেই ওর ব্লেজারটা খুলে ফ্লোরে ছুড়ে মেরে ফোনটা হাতে নিয়ে কল দিয়ে সমস্ত ট্যুর বাতিল করে দিল।

কাতালুনিয়া প্রদেশের কাতালন সঙ্গীত প্রাসাদ, সাগ্রাদা ফামিলিয়া, পার্ক গুইল, রাম্বালা সহ আরো কিছু স্থানে যাওয়ার জন্য আগেই বুকিং দেওয়া ছিল। তাছাড়া আরো কয়েকটা মিটিং এ এ্যাটেন্ড করার কথা ছিল। কিন্তু মাহাদ মনে মনে বলল, " লাক যদি ভালো থাকে তাহলে এই একটা প্লেস থেকেই তার কম্পানিকে ডাকা হবে। বাঁকি সময় নষ্ট করার কোন মানেই হয়না।"
সমস্ত কিছু ক্যান্সেল করে সেই দিনেই বাংলাদেশে পাড়ি জমালো মাহাদ। যদি নিজের দুটি ডানা থাকতো তাহলে এত সময় নিত না মাহাদ।

মাহাদ ফোনে ওর বাবাকে ফিরে আসার কথাটা জানাতেই কামরান সাহেব অত্যান্ত রেগে গেলেন। বাঁকি মিটিং এ কেন সে এ্যাটেন্ড করেনি! এমন সুযোগ জিবনে আসবে না। এতবড় ভুল কাজ সে কিভাবে করল? তার মত এত ম্যাচুরিয়েট ছেলের ভুল হওয়ার কথা তো না, তাহলে কি ও ইচ্ছা করে এগুলো করলো?

" বাবা টেনশন করেন না, কাজ হলে একটা দিয়েই হবে। সবথেকে বড় একটা কাজেই হাত দিব আর ইনশাল্লাহ্ একটা দিয়েই বাজিমাত করবো।"

" বিজনেসে বড় বড় কথা মানায় না মাহাদ। এখানে কাজ করে দেখাতে হয়। তুই যেই কাজের সাফল্যর আশা করছিস সেখানে পৌছাতে আমাদের আরও দশ বছর লাগবে। কোন সম্মলনে যোগদান করা মানে এই নয় যে তোর কম্পানিকে ওরা ডাকবে। এটা একটা ছোট দেশ। কত বড় বড় দেশ আর বিজনেসম্যানরা সেখানে কাজের জন্য মুখিয়ে থাকে। আর আমরা তো তাদের তুলনায় নিতান্ত ছোট। কামরান সাহেব অনেক কথা শুনালো।"

" মাহাদ নিরবে সব কথা হজম করলো। ওর কোন কথায় কানে আসছেনা। ওর একটাই কথা মনে হচ্ছে তিতির ঠিক আছে তো?"

" কামরান সাহেব মাহাদকে একটা ধমক দিয়ে বলল," দুবাইয়ে বিমান ল্যান্ড করলে সেখানে অবস্থান করবি। ওখানে কিছু ক্লাইন্ড আছে তাদের সাথে মিট করবি। আশা করি এই কাজটা অন্তত সঠিকভাবে করবি।"

" মাহাদের মাথা মনে হয় ব্রাস হয়ে গেল। কিন্তু বাবাকে কিছু না বলে চুপ করে রইলো।"

সব কিছু কমপ্লিট করে ১০ দিনের মাথায় সন্ধ্যায় মাহাদ ওর বাসায় এসে হাজির হল। গাড়ী কোনমতে বাসায় ঢুকতে মাহাদ ডোর খুলেই দ্রুত বাসায় ঢুকে দেখতে পেল ওর মা ডাইনিং রুমে বসে আছে। সাথে দাদী, ফুপি আর মৌও বসে আছে। আজই রুমকি এসেছে সেও তাদের সঙ্গে গল্প করছে।

মাহাদকে দেখে লাবীবা চমকে উঠলো। কারন আরো দু'দিন পরে তার ফিরার কথা ছিল। সে আজ কেন ফিরলো। লাবীবা অত্যান্ত ভয় পেল।

মাহাদ সবাইকে সালাম দিয়েই বলল," আলহামদুলিল্লাহ্  আশা করি সবাই  ভালয় আছেন।"
তাদের কথার জবাবের আগেই মাহাদ একহাতে ওর টাইটা খুলতে খুলতে উপরে উঠে গেল। উপরে গিয়েই মাহাদ গোলাবের খোঁজ নিল। গোলাব, বাবা কই তুই!

কিন্তু গোলাব কাছে থাকলে তো মাহাদের কাছে আসবে। মাহাদের ভিতরের হৃদপিন্ডটা দ্রুত নড়তে লাগলো। মা...... গোলাব কই?

ডাইভার এক এক করে ১২ টা ল্যাগেজ এনে ডাইনিং রুমে রেখে চলে গেল। মাহাদ মন একদিকে রেখে সবার জন্য সপিং করেছে।

মাহাদ গোলাবকে না পেয়ে তিতিরের রুমে গিয়ে দেখলো ১০ দিন আগে যেমন রুমটা দেখে গেছে ঠিক তেমন ভাবেই রুমটা আছে। তিতির বলে ডাক দিতেই সাবিনা এসে রুমে ঢুকলো। ভাইজান আফা থাকলে তো আন্নের কথার জবাব দিব।

" আপা নাই মানে! তোর আপা কই? "

" ভাইজান, আন্নের বাড়ির সব মানুষগুলান খুব খারাপ। আই এহানে থাকুম না। সাবিনা কান্না করতে করতে তিতিরের সব ঘটনা খুলে বললো। এতদিন সাবিনা কোন কথা বলেনি। শুধু মাহাদের জন্য অপেক্ষা করেছে। যেখানে বোমা ফাটালে কাজ হবে  সেখানেই বোমা ফাটিয়েছে সাবিনা। "

মাহাদ রুম থেকে বের হয়ে এসে ওর মায়ের সামনে দাড়াতেই আসমা বলে উঠলো, ভাইজান।

চুপপপ...!  তোমাকে এখানে কেন রাখা হয়েছে? কেন রাখা হয়েছে এখানে? আজ যদি ওকে সহিসালামতে না পাই তাহলে একজনকেও আস্ত রাখবোনা।

এবার মৌ মুখ খুলল। মৌ হাতে তালি দিয়ে বলল, রাগ কার উপর দেখাচ্ছেন? আসমা তো কাজের মেয়ে। আপনি নিজে তার জন্য কতখানি সেফটির ব্যবস্থা করে গেছেন! আগে আমি ভাবতাম, আমি নিচ, লোভী, স্বার্থপর কিন্তু এখন দেখছি এখানকার মানুষগনের থেকেও আমি অনেক ভালো আছি। আপনি নিজে তাকে কাছে টেনেছেন তারপর মায়ের কাছে রেখে গেছেন অপমান করতে? আপনি জানেন না আপনার মা তার কি হাল করবে? একটা সহজ সরল এতিম মেয়েকে নিয়ে আপনি আর আপনার পরিবার খেলায় মেতে উঠেছিলেন? সে চলে গেছে। জানিনা কোন অবস্থায় আছে সে। 

" মৌ তুমি কিন্তু একটু বেশিই কথা বলছো। মুখে লাগাম দাও।"

ও বেশি কথা বলেনি, তুমি অতিরিক্ত কাজ করে দেখিয়েছ মা বলে সামনে ট্রী টেবিলে একটা থাবা বসালো মাহাদ। 
থাবাটা এত জোড়ে ছিল যে ট্রী টেবিলের কাঁচ চুরমার হয়ে কিছু কাঁচ মাহাদের হাতে ঢুকে গেল।

মাহাদের এমন পাগলামো কাজ দেখে সবাই উঠে দাড়াল। মাহাদের হাত দিয়ে টপ টপ করে রক্ত পড়তে দেখে লাবীবা কেঁদে উঠলো। মাহাদ ঠান্ডা হ বাবা। তোর হাতে প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। এমন কেন করছিস?

মাহাদ ওর মায়ের কথা শুনে ক্ষেপে গেল। হাতের কাঁচ গুলো একটা একটা করে তুলতেই ক্ষত স্থান থেকে রক্তর ফোয়ারা ছুটল। মা, এর থেকে বেশি রক্ত ক্ষরন হচ্ছে আমার এই বুকের মধ্য।
মাহাদের চোখগুলো লাল বর্ন ধারন করলো।

" আসমা, মেডিসিন বক্স নিয়ে এসো। ওর হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে। লাবীবা এবার জোড়ে জোড়ে কেঁদে উঠলো। বাতাসিও বলল," মাহাদ পাগলামি করিসনা।"

রাতে একটা মেয়েকে বাসা থেকে বের করে দিয়ে এখন দরদ দেখাতে এসেছ! তুমি না মেয়ে! তুমি না আমার মা! এত কিছু হয়েও তুমি কেমন করে একজন মেয়ে হয়ে অন্য মেয়েকে রাতে বাসা হতে বের করে দিয়েছ! তোমার একবারও খারাপ লাগেনি, তোমার মনুষ্যত্ব একবারও জেগে ওঠেনি এই রাতে ও কোথায় যাবে!
"এক ছেলেকে একই কারনে হারিয়েছ। আর আমার জন্য কাফন রেডী করে রেখ।"

 এই হাতের রক্ত তখনি থামবে যখন আমি ঐ মেয়েকে খুজে পাবো। মা, তুমি খুব বড় ভুল করেছ । তুমি না কিছু জেনেই খুব বড় ভুল করেছ। এই ভুলের কোন ক্ষমা নেই। যেই কারনে তুমি ভয় পেয়ে ওর সাথে কাজটা করেছ সেই কাজটাই আমি মাহাদ করে দেখাবো।

মাহাদ দ্রুত বাসা থেকে বের হল। সিসি ক্যামেরা দেখার তার সময় নেই।  এখন মেধা খাটানো ছাড়া কোন উপায় নেই। গেটের দাড়োয়ানকে জিঙ্গাসা করলো মাহাদ। চাচা তিতির সেদিন কই গিয়েছিল! আর গোলাব!  ও তিতিরের সাথে ছিলতো?

দাড়োয়ান চাচা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আমি নিজে ওকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছি বলে লোকেশন জানালো মাহাদকে। সব ঘটনা খুলে বললো মাহাদকে। তারপর আফসোস করে বললো, একটা মেয়েকে ঐ রাতে  বাসা থেকে এভাবে বের করে দেওয়া ঠিক হয় নাই। নিজের কাছেও তাকে রাখতে পারলাম না। তোমার গোলাব ওর সাথেই আছে তাই কিছুটা নিঃশ্চিতে ওকে যেতে দিছি।

মাহাদ তিতিরের ধারের টাকা পকেট থেকে  বের করে দিতেই উনি বলল," মাহাদ তোমার হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে কেন?"

চাচা গেটটা খুলে দেন বলে মাহাদ আর কোন কথার জবাব না দিয়ে গাড়ী বের করে চলে গেল। গোলাব তিতিরের সাথে আছে তাই মাহাদ কিছুটা ঠান্ডা হয়ে ড্রাইভ করছে।

♦♦♦♦

গোলাব দুতলার ব্যালকুনিতে দু'পা তুলে প্রতিদিনের মত আজও অধীর আগ্রহে রাস্তার পানে চেয়ে আছে মাহাদের অপেক্ষায়। আজ তার অপেক্ষার পালা শেষ। দুরে মাহাদের গাড়ী আসতে দেখে গোলাবের চোখ চকচক করে উঠল। গোলাব দৌড়ে তিতিরের কাছে এসে ডাকতে লাগলো। তিতিরের গায়ে জ্বর এসেছে তাই ও বিছানায় সুয়ে ছিল। তিতির চোখ খুলে গোলাবের দিকে চাইতেই গোলাব দৌড়ে চলে গেল। গোলাবের ভাষা তিতিরের বুঝতে আর দেরী হল না। তিতির এত খুঁশি জিবনেও হয়নি।

তিতির খুশি হয়ে চিৎকার দিয়ে বলল, "শান্তা ডাইনিংরুমের দরজাটা এক্ষুনি খুলে দাও।"

ওড়না টা বুকে জড়িয়ে নিয়ে বেড থেকে উঠতেই তিতিরের মাথা ঘুরে এলো। তিতির থেমে গেল। শান্তা দরজা খুলে দিল আর রবিন তিতিরের কাছে এসে ওকে ধরে বলল," শরীর কি খুব খারাপ লাগছে। "

"রবিন উনি এসেছেন।"

" রবিন ব্যালকুনিতে গিয়ে দেখলো মাহাদ গেটের ওপারে দাড়িয়ে আছে আর গোলাব গেট টপকে মাহাদের কোলে ঝাঁপ দিল।"

" মাহাদ গোলাবকে আদর করতে লাগলো আর গোলাব মাহাদের হাত,গাল, ঘাড় ওর জিহ্বা দিয়ে আলিঙ্গন করতে লাগলো। এ যেন দু'জনের মধ্য অটুট ভালোবাসার বন্ধন।"

গোলাব গেট টপকাতেই দাড়োয়ান গেট খুলে মাহাদকে দেখল। রবিন উপর থেকে বলল," চাচা, উনি আমার অতিথী । ওনাকে ভিতরে আসতে দিন।"

তিতির শরীরের অসুস্থকে পাত্তা না দিয়ে দৌড়ে ডাইনিংরুমে এসে শান্তাকে বলল," শান্তা আমার আর থাকার অনুমতি নেই, আমি চলে যাচ্ছি। আল্লাহ্ চাইলে তোমার ভাইয়াকে নিয়ে আবার আসবো আর তোমার হাতের রান্না খাবো। 
আমার ভাইকে দেখে রেখ বলে শান্তাকে একটু জড়িয়ে ধরেই বের হয়ে গেল তিতির। জুতা পড়তেও ভুলে গেছে তিতির। এতটুকু রাস্তাও যেন অনেক দুর লাগছে তিতিরের। কাঁচি গেট পাড় হয়ে এসে তিতির দাড়িয়ে গেল। গোলাব অলরেডি গাড়ীর মধ্য ঢুকে পা দুটি জানালা উপর রেখে দাড়িয়ে এদিকেই চেয়ে আছে। সে খুব খুশি কারন আজ সে বাড়ি যাবে।

মাহাদকে গেটের সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সব কিছু ভুলে তিতির জোরে দৌড় দিয়ে মাহাদের কাছে গিয়েই ঝাঁপ দিল মাহাদের বুকে। এমন জোড়ে তিতিরের শরীরের ধাক্কা খেয়ে অপ্রস্তুত মাহাদ দু'ধাপ পিছনে সরে গিয়ে একহাতে গেট শক্ত করে ধরলো। এ যেন বেদনাময় শক্তিশালী সুখ।

মাহাদ এক হাত দিয়ে তিতিরকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে  ইশারা করে শুকরিয়া জানালো তার কলিজা নামক তিতিরকে এতদিন সহিসালামতে সামলিয়ে রাখার জন্য ব্যালকুনিতে দাড়িয়ে থাকা রবিনকে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন