ষোড়শীর শান্ত বাক্যে কি জানি ছিলো। কঠিন রুদ্রের চোখের কোনায় আবেগ জমলো। আপ্লুত হৃদয় যেনো আজ বাধ মানছে না। হাতের খোলা বাধন হলো শক্ত, সুগভীর। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“সর্বগ্রাসী অগ্নির ন্যায় তুমি
যতবার ছুয়ে যাও
ততবার পুড়ি
ছারখার হই
তবুও খেই হারা পথিকের ন্যায় বারে বারে তোমার কাছে আসি
চরম অবহেলায় বুজে আসা আখির নেত্রে শুধু তোমাকেই রাখি
ভঙ্গুর হৃদয়ের শুধু একটাই বুলি
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি”
রুদ্রের চোখের পানে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো উমা। চোখ থেকে নোনাজলের স্রোত গড়িয়ে পড়লো, কোমল গাল জোড়া ভিজে এলো। এই জলের উৎস কোনো বেদনা কিংবা বিষাদ নয় বরং প্রশান্তির উষ্ণ পরশ। রুদ্র উমার দিকে আবেগপ্রবন চাহনীতে তাকিয়ে রইলো। প্রবল আকাঙ্ক্ষায় তৃষিত হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠলো। তীব্রর নিষিদ্ধ ইচ্ছা ডানা মেললো সংগোপনে। বাধাহীন মিলনে লিপ্ত হলো কপোত কপোতী। শীতল মাঘের প্রকোপের মাঝে দুটি হৃদয়ের অবাধ্য ভালোবাসায় উষ্ণ হয়ে উঠলো শীতল ঘরটি।
এখানের হেসেলটি গ্রামের মতো না, গ্যাসের চুলো অথচ ম্যাচ লাগে না। বেশ দাম দিয়ে কিনেছে রুদ্র। শহরের ধাচে অনেকটাই সাজানো গুছানো। উমা রান্না সেরে তারপর যায় কলেজে। রুদ্র নির্বাচনের কাজে তাড়াতাড়ি বের হয়। তাকে খাবার প্যাকেট করে দিতে হয়। নয়তো বান্দা বাসায় আসে সেই রাতে, কাজের টানে খেতেই ভুলে যায় সে। বেশ কর্মঠ হয়েছে রুদ্র। সকাল সকাল বেরিয়ে দোকানে যায়, সেখানে কাজ সেরে পরিষদের অফিসে যায়। আগের ন্যায় বেলা অবধি ঘুমোয় না সে। উমার তাই রান্নাটা সকালেই সেরে ফেলতে হয়। উমার কলেজ শেষ হয় একটা নাগাদ, তারপর প্রাকটিক্যাল থাকলে থাকতে হয় নয়তো বাড়ি চলে আসে সে। বাসায় এসে একা একা ই খেতে হয় তার। রুদ্র টেলিফোন লাইন নিয়েছে, তাই মাঝে মাঝে রাজশ্রী এবং গোপালের কন্ঠটি শোনার ভাগ্য হয় তার। আগে মনে হতো চেয়ারম্যান বাড়ি বন্দী শালা কিন্তু এখন এই বাড়িটিকে বন্দীশালা লাগে তার। ও বাড়িতে শাশুড়ী ছিলেন, পিসি ছিলেন, সবথেকে বড় ফুলির মা ছিলেন। ফুলির মা মানুষটার সাথে সুখ দুঃখ ভাগ করতে ভালোই লাগতো তার। কিন্তু এখানে সারা বাড়ি জুড়ে দুটো জীব। একজন কাজের মহিলা আছেন, কিন্তু সে ছোটা কাজ করে। তার নখরা অন্যরকম। উমা কতোবার বললো,
“মাসি, স্নান করে পুজোর ঘর কুড়িয়ো”
কিসের কি, চল্লিশোর্ধ্ব মহিলা হিনহিনে স্বরে সাফ মানা করে দিলেন,
“তোমার এক ঘর কুড়োতে আমার স্নান করতে হবে? দুবার স্নান করবো নাকি?”
উমাও তেজ দেখিয়ে বলেছে,
“তাহলে আমার পুজোর ঘরে তুমি পা দিবে না।“
উমাকে আজকাল গিন্নী গিন্নী ঠেকে রুদ্রের কাছে। ও বাড়িতে একটা মোবাইল কিনে পাঠিয়েছে, কিন্তু নে্টওয়ার্ক না পাবার কারণে পনেরো হাজার টাকার যন্ত্রটি হয়ে গেছে নির্জীব জড় পদার্থ। উমা চিঠি লেখে, তার চিঠি লিখতে খুব ভালো লাগে। রাজশ্বীর বেশ ভালোভাবে পড়তে পারে বিধায় তার দায়িত্ব চিঠি পড়ে সবাইকে শোনানো। লক্ষী দেবী ছেলের জন্য ব্যাকুল হয়েছেন। কিন্তু কাজের চাপে রুদ্রের ও বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। যদিও কারণটি সেটি নয়। আসল কারণটি উমার জানা নেই। রুদ্র স্নান সেড়ে কালো একখানা শার্ট পড়েছে। লোকটিকে দেখতে একেবারে উত্তম কুমারের ন্যায় লাগছে। ফর্সা মুখে চাপ দাঁড়িটি বেশ চমৎকার বানিয়ে। উপরে ঘোলাটে চোখে এক অজানা আকর্ষন। টেবিলে বসে সে হাক দিলো,
“কই গো, নাস্তা দাও। দেরী হয়ে যাচ্ছে তো।“
“দেরী টি কি আমার জন্য হচ্ছে?”
“বাহ রে আমি কি করলুম?"
" সকালে দুবার স্নান আমার কার জন্য করা লেগেছে শুনি?”
উমা চোখ গরম করে ঈষৎ রাগান্বিত কন্ঠে রুদ্র দমলো। হ্যা, দোষটি বেশিরভাগ ই তার। কিন্তু উমার ও রয়েছে, কে বলেছে এতো মায়াবিনী হতে? রুদ্র অপরাধীর ন্যায় মাথা নত করে বলল,
“নব্বই ভাগ নিলেও দশ ভাগ দোষ তোমার আছে”
“কি করে শুনি?”
“এতো সুন্দরী বউ থাকলে ভালোবাসতে ইচ্ছে হবে না?”
“তাহলে হোক দেরী, আমি তো মা দূর্গা নই। আমার দুটো হাত।“
স্পষ্ট স্বরে কথাটা বললো উমা। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“এজন্যই বাবাকে বলেছিলাম, বাচ্চামেয়ে বিয়ে দিয়ো না। এরা বড্ড ঝগরুটে”
“তা কে বলেছিলো শুনি, ভরা লোকের সামনে আমাকে সিঁদুর পরাতে?”
উমা ছেড়ে দেবার পাত্রীটি নয়। সে তার বিতর্ক যুদ্ধে আজ রুদ্রকে পরাজিত করবেই। রুদ্র উঠে তার পেছনে দাঁড়িয়ে বললো,
“সেখানেও কোথাও না কোথাও তোমার দোষ, কে বলেছে এতো মায়াবন বিহারিনী হতে?”
“হয়েছে, টেবিলে বসুন। আলুরদম হয়ে গিয়েছে।“
“আজ, লুচি আলুর দম?”
“হ্যা, ভাত হতে একটু দেরি হবে। হলেই টিফিনে পুরে দিচ্ছি।“
ঠিক সেই সময়ে বসার ঘরে রাখা ফোনটি বেজে উঠে। রুদ্র ফোনটি ধরে। পরমূহুর্তে তার মুখোভাব পালটে যায়। ধীর স্বরে বলে,
“বিকালে দোকানে আসিস, সেখানেই তোর সাথে কথা বলবো আমি।“
ফোন রেখে দিতেই উমা প্রশ্ন করে উঠে,
“কার ফোন এসেছে? গ্রাম থেকে?”
“না গো, নির্বাচনের কাজে”
পুরোপুরি কথাটা এড়িয়ে যায় রুদ্র। উমা সেদিকে মনোবেশ না করে বলে,
“নির্বাচনের কেন্দ্র আমাদের কলেজ ও হয়েছে জানেন?”
“জানি, সেদিন তো তোমার বন্ধ।“
“হ্যা, সারাদিন বাসায় ই তাকতে হবে।“
“আচ্ছা, পড়ালেখা ভালো হচ্ছে তো? মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া কিন্তু চারটে খানি কথা না? বহু মানুষের মধ্যে বাছাই হয়। আর লেটার না পেলে কিন্তু চলবেই না। এখন নতুন কি এক গ্রেড সিস্টেম করেছে। জিপিএ ফাইভ বলে। তাই কিন্তু ভালো করে পড়তে হবে।“
উমা বোকা হাসি দিলো, লোকটির সবকিছুর মাঝেও উমার পড়ালেখার দিকে খোঁজ আছে দেখে বেশ খুশি ই হলো সে। রুদ্র চলে যাবার পর সব গুছিয়ে নিলো। নয়টা বাজলেই রওনা দিবে। আজ নয়টার ক্লাসটি হবে না। নতুন সই, নতুন পরিবেশে মন্দ লাগছে না উমার। পড়াশোনার বেগ ও মন্দ নয়। শুধু একটু বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে কারণ সে বড্ড পিছিয়ে আছে।
সূর্য পশ্চিমে হেলে গেছে। চারটা বাজতেই আজকাল বিকেল হয়ে যায়। দোকানে অপেক্ষা করছে রুদ্র। অপেক্ষা শাশ্বতের। শাশ্বত টেলিফোন করেছিলো। খবর নিয়ে জেনেছে শাশ্বত নাকি সাতক্ষীরাতেই বদলি হয়ে এসেছে। তার মনোবাঞ্ছা এখনো জানতে পারে নি যদিও তবে এটা তার জন্য যে শুভ নয় সেটা রুদ্র জানে। শাশ্বত এলো সাড়ে চারটার দিকে,
এসেই হেসে বললো,
“আসলে কাজের জন্য দেরি হয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলি কি?”
রুদ্র বিরক্তি প্রকাশ করলো। চোখ কুচকে বললো,
“কেনো এতো জরুরী তলপ?”
“আরে দাঁড়া এতো তাড়া কেনো? একটু বসতে দে। সময় তো আছে”
“দেখ শাশ্বত অহেতুক সময় নষ্ট করার সময় আমার নেই, আজ কাজ শেষ দ্রুত যাবো বাড়ি। উমা একা রয়েছে বাসায়।“
“ওহ, তাহলে ছোট করে বলি। কান টানলে মাথা আসে জানিস তো?”
শাশ্বতের প্যাচানো কথায় চোখ কুচকে আসে রুদ্রের। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,
“সোজাসোজি বল কি বলতে চাস?”
“এতোকাল অভিনব সিংহ অর্থাৎ মামা মশাই কি কি কার্য সাধন করেছে তার সকল প্রমাণ আমার কাছে আসে। আমি সেটা নিয়ে কাজ করতেই পারি, যেহেতু এখন আমি একজন সিনিয়র রিপোর্টার। কিন্তু আমি সেটা নিয়ে কাজ করলে তোর রাজনীতি জীবনের অংকুরেই বিনাস হবে। আমি বড্ড দ্বিধায় আছি কি করব?”
“আমার থেকে কি চাস, ঝেড়ে কাশ তো”
“মামা মশাই এর পতন গোড়া থেকে। আমি চাইলেও তাকে নাড়াতে পারবো সরাতে নয়, আর তাকে নাড়ালে তোর পতন হবে। আমি চাই না সেটা। কারণ তুই আমার তুরুপের এক্কা।“
“বাবার পেছনে লাগার কারণ?”
“তোকেও তো আমি জিজ্ঞেস করি নি মামার বিরুদ্ধে এতো ষড়যন্ত্র কেনো করছিস?”
রুদ্র বাকা হাসি হাসলো। তার হাসি দেখে শাশ্বত স্পষ্ট স্বরে বলল,
“তাহলে আমাকে সাহায্য করছিস?”
“শর্ত আছে?’
“কি?”
“আমার ঢাল হতে হবে, আমার জন্য নয় উমার জন্য। সেদিন বলেছিলি না সময় হলে ওকে বলি দিবো কি না, আমি সেটা পারব না। কিন্তু শেয়াল কুকুরের ত অভাব নেই, তাই আমার ঢাল হতে হবে।“
“যদি কোন অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকিস তবেই আমার সাহায্য পাবি।“
স্পষ্ট কন্ঠে শাশ্বত কথাটা বললো, রুদ্র উত্তর দিলো না। শুধু হাসলো। তার মস্তিষ্কের ভেতর কি চলছে তা শাশ্বতের অজানা। হয়তো শাশ্বত কখনো জানবেও না এই মাতালটি যে জাতে মাতাল তালে ঠিক_______
১৮!!
নির্বাচনের দিন,
অবস্থা ভালো নয়, দেশের রাজনীতি দলের মাঝে এক অরাজকতা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবার এবং না হবার জন্য সকল ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। অভিনব সিংহ ছেলের প্রথম নির্বাচনে তাকে সাহস দিতে এসেছে। এদিকে নিজের মনে এক ছাই ছাপা আগুন জ্বলছে। এই প্রথম সে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছে না। কিন্তু তাতে কিছুই হবে না, অভিনব সিংহ কাঁচা খেলোয়াড় নন। তিনি তার ভিত্তি মজবুত রাখার জন্য সকল পদক্ষেপ নিয়ে রেখেছেন। নির্বাচন শুরু হয়েছে, রুদ্র ভোট দিয়ে পার্টির লোকের সাথে কথা বলছিলো, তখন বাদল এসে তাকে এক পাশে টেনে বলে,
“রুদ্র, সর্বনাশ হয়েছে”
“কি হয়েছে?”
অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে রুদ্র। বাদল বলে,
“উমা বৌদি বাড়ি নেই……………
—————
অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে রুদ্র। বাদল বলে,
“উমা বৌদি বাড়ি নেই, সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে খুজেছি কিন্তু তাকে কোথাও পাইনি।”
বাদল হাফাতে হাফাতে কথাটি বললো, এদিকে বাদলের চিন্তিত কন্ঠের বলা কথাটি শুনে চমকে উঠলো রুদ্র। ব্যাগ্র কন্ঠে বলল,
“কোথাও পাওয়া যায় নি মানে?”
বাদল এক নিঃশ্বাসে সব কিছু খুলে বলতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পূর্বে,
মাঘের প্রকোপে রোদের কঠিন তেজ মিইয়ে যাচ্ছে, দক্ষিণের শীতল হিনহিনে বাতাসে উড়ছে উমার কোকড়া চুল গুলো। পদার্থবিজ্ঞানের বইটি খোলা। খাতাটা অবহেলায় তার দিকে চেয়ে আছে, কিন্তু উমার যেনো সেদিকে মোটেই মনোযোগ নেই। মহাকর্ষের অংক কষতে কষতে তার অবুঝ মন খানা অন্য অংক কষতে ব্যস্ত। রুদ্র বেড়িয়ে যাবার পর থেকে একাকীত্বের কালো মেঘ হর্তালে নেমেছে। একাগ্রতা যেনো বাস্পের মতো উড়ে গেছে। ও বাড়িতে থাকলে এতো কষ্ট হতো না। হবে কেনো, সকাল হতেই লক্ষী দেবীর হিনহিনে স্বরটা কর্নকুহরে যেয়ে উত্তেজনা তৈরি করতো। মালিনী দেবীর ঠেস মারা বাক্য আর ফুলির মার মুখড়া স্বভাব। উমার যেনো সবকিছুই বড্ড মনে পড়ছে। ক্লেশ থাকলেও অবাড়িতে মানুষ তো ছিলো, কিন্তু এ বাড়িতে সেই মানুষের বড্ড অভাব। বই এ মুখ গুজে রাখলেও বেশিক্ষন থাকতে পারে না সে। এই তো বিগত এক ঘন্টা যাবৎ কেবল পাঁচ খানা অংক করেছে সে। চিন্তা ছিলো রুদ্রের আসার আগে পুরো অধ্যায় শেষ করবে, কিন্তু হলো কোথায়। সাদা তুলোর মতো উড়ে যাওয়া মেঘের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এক রাশ উদাসীনতা নিয়ে। উমার উদাসীনতা বাড়ার আগেই নিচের কলিংবেল বাজলো। এ এক অন্য জিনিস, গ্রামে থাকতে এই কলিংবেলটি শুধু ভ্যান এবং রিক্সাতে দেখেছিলো সে। এখানে একটা কলিংবেল আছে। রুদ্র তাকে সর্বদা দরজা আটকে রাখতে বলেছে। যে আসে সে এই কলিংবেল বাজায় উমা “কে” বলে হাক দেয়। বাহিরের মানুষটির কন্ঠ চেনা মনে হলেই সে দরজা খুলে। উমার বইটি বন্ধ করে নিচে নামে। কোমল কন্ঠে বলে,
“কে?”
“বৌদি আমি, শাবীব”
শাবীবের রুদ্রের বন্ধু, শুধু বন্ধুটি বললে কম হবে। তার দোকানের হিসাব ও সেই দেখে। বাদল, রক্তিম, শাবীব এই তিনজন যেনো রুদ্রের তিনটি ঢাল। বাদলের সাথে রুদ্রের মারপিট লাগলেও সে ক্ষমা চাইবার পর সে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। কালীগঞ্জের দোকানটিতে তারা তিনজন কর্মরত। শাবীবের কন্ঠ শুনে খানিকটা অবাক হলো উমা। এই সময়টাতে তাদের রুদ্রের সাথে থাকার কথা বলেই তার জানা ছিলো। কিন্তু হুট করেই তার এখানে আগমনটি বেশ অবাক করলো উমাকে। উমা দরজা খুলে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“এ কি শাবীব দাদা আপনি এখানে?”
“বৌদি, আপনাকে নিতে আসলাম, তৈরি হয়ে নিন”
শাবীবের কথায় চোখজোড়া কুচকে আসলো উমার। বিস্ময় যেনো দ্বিগুন হলো। কোথায় যাবে তারা? কে পাঠিয়েছে শাবীবকে? অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“নিতে আসলেন? কোথায় যাবো আমরা?”
“রুদ্র পাঠিয়েছে, আসলে আজ তো নির্বাচন তাই ওকে বাহিরেই থাকতে হবে। কেন্দ্রে গ্যাঞ্জাম হবার একটা সম্ভাবনা আছে। তাই ও পাঠালো আপনাকে নিতে। বাড়িতে একা একা থাকাটা ঠিক হবে না আপনার”
উমার মনে ঈষৎ সন্দেহ জাগলো। রুদ্র তাকে এমন কিছু বলে নি। তাহলে হুট করে কেনো শাবীবকে পাঠালো। কিন্তু মানা ও করতে পারছে না, রুদ্র অকারণে তো তাকে পাঠাবে না। আর শাবীব রুদ্রের বিশ্বস্ত একজন বন্ধু। সে উমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তাই ক্ষীন সন্দেহের রেখাটি মুছে ফেললো সে। স্মিত হেসে বললো,
“আপনি দাঁড়ান, আমি তৈরি হয়ে আসছি।“
ঘন্টা খানেক বাদে উমা শাড়ি বদলে এলো। শাবীব একটা জীপ গাড়িতে করে এসেছে। গাড়িটা বেশ নতুন। হয়তো নেতাদের কারোর হবে। তাই বেশী সন্দেহ করলো না উমা। এদিকে, বাদল তার মিনিট পনেরো বাদেই রুদ্রের বাড়ি আসে। বাসার দ্বারে ঝুলতে থাকা তালা তাকে চিন্তায় ফেলে। আশেপাশে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে একটি জীপে করে উমা চলে গিয়েছে। ভয়ের চোটে সে ছুটে যায় রুদ্রের কাছে।
রুদ্র শান্ত চিত্তে সবকিছু শুনলো। কিছুক্ষণ থেমে সে উলটো বাদলকে প্রশ্ন করে উঠলো,
“তুই আমার বাড়ি কেনো গিয়েছিলি?”
রুদ্রের প্রশ্নে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলো বাদল। আমতা আমতা করে বললো,
“আমি গিয়েছিলাম দোকানের চাবি নিতে। তুই তো বলেছিলি বৌদিকে দিয়ে আসবি”
রুদ্র শান্ত দৃষ্টিতে বাদলের দিকে তাকিয়ে রইলো, তার কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না রুদ্রের। কিন্তু এখন সবথেকে প্রধান প্রশ্ন উমা কোথায়? কার জীপে উঠেছে উমা? উমা এতটা বোকা নয় যে অপরিচিত কারোর সাথে চলে যাবে। রুদ্রের চোখ গেলো অভিনব সিংহের দিকে। তিনি নির্বাচন অফিসারের সাথে বেশ হেসে হেসেই কথা বলছেন। রুদ্র জায়গা থেকে নড়তে পারছে না। নিজের মেম্বার হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। ভয়টি রকিবুল মাস্টারকে নিয়ে। রকিবুল মাস্টারের বিরোধীরা ভোট চুরির পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে আছে। তার মাঝে তার বাবাও রয়েছে। অভিনব সিংহ চান না নির্বাচন টি সুষ্ঠুভাবে হোক। রকিবুল মাস্টার চেয়ারম্যান হোক সেটা সে কখনোই চান না। অপর পক্ষে রুদ্র চায় যেনো রকিবুল মাস্টার চেয়ারম্যান হন। এই মানুষটি গোবেচারা দেখালেও চরম ধূর্ত, সেকারণে সে চায় যেনো এই মানুষটি তার বাবার জায়গায় আসুক। তাই সে এখান থেকে সরতে চাচ্ছে না। কিছুক্ষন পর নির্বাচন শেষ হবে, ব্যালোট গোনা হবে। তাই চাইলেও রুদ্র সরতে পারছে না। বাদল চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“বৌদিকে খুজতে যাবি না?
“দেখছি”
শান্ত কন্ঠে কথাটা বললো রুদ্র। রুদ্রের মস্তিষ্কে কি চলছে তা আন্দাজ করতে পারলো না বাদল। এদিকে শাশ্বত এই কেন্দের রিপোর্টিং এর জন্য সকল কেন্দ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই কেন্দ্রেও এলো সে। তাকে দেখেই রুদ্র গেলো তার কাছে। বাদল তার সাথে আসতে চাইলে রুদ্র করা কন্ঠে মানা করে দিলো। শাশ্বত রুদ্রকে দেখেই বলল,
“কি অবস্থা? কে জিতবে?”
“মাস্টার জেতার সম্ভাবনা বেশী। কিন্তু একটা ঝামেলা হয়েছে”
“কি?”
রুদ্র খানিকটা বসা গলায় বললো,
“কেউ উমাকে অপহরন করেছে”
কথাটা শুনতেই থমকে গেলো শাশ্বত। রুদ্রের চোখজোড়া এক অজানা ভীতি দেখতে পেলো শাশ্বত। কিন্তু ভীতিটি উমার জন্য কি না ঠাহর করতে পারলো না।
জিপ থামলো অজানা এক জায়গায়। উমার জায়গাটি চেনা নেই। শাবীব গম্ভীর স্বরে বললো,
“বৌদি, থেমে পড়ুন”
শাবীবের কন্ঠে গায়ে কাটা দিলো উমার। বক্ষস্থলে এক অজানা ভয় তাকে আষ্টেপিষ্টে ধরলো। কন্ঠে জড়তা এলো উমার। কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“এটা কোথায় শাবীব দা?”
“নামুন, জেনে যাবেন”
“উনি কোথায়? উনাকে তো দেখছি না”
“রুদ্র সময় হলে ঠিক আসবে। আপনি ভয় পাবেন না। থেমে আসুন”
শাবীবের কন্ঠে শীতল, শীতল কন্ঠ উমার হৃদয়কে আরোও বেশি ভীতু করে তুললো। তার সন্দেহ হলো, শাবীব এখানে তাকে শুধু শুধু আনে নি। খুব বড় কিছু ঘটতে চলেছে। উমা মাথানত করে জীপ থেকে নামলো। খুব পুরোনো একটি জায়গা, ভাঙ্গা বাড়ি। সূর্যালোকেই গা ছমছম করছে, না জানি সন্ধ্যের পর কিরুপ দেখাবে। লাল বাড়িটির জানালা, দরজা কিছুই নেই। ভাঙ্গা অংশে মস, ফার্ণের বসবাস। পরগাছা থেমে এসেছে দেয়াল ভেদ করে। এই বাড়িতে কোনো শুভ মতলবে তাকে আনা হয় নি সেটা বুঝতে বাকি রইলো না উমার। উমার নিজের মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করলো তার পালাতে হবে। শাবীব তার পাশেই চলছিলো। তার খেয়াল অন্যদিকে যেতেই উমা পালানোর জন্য ছুট লাগালো। কিন্তু তার ইচ্ছে থাকলেও সফল হতে পারলো না। যেই না পালাতে যাবে অমনি পেছন থেকে সজোরে কেউ আঘাত করলো তাকে। প্রচন্ড ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো উমা। চাহনী ঝাপসা হতে লাগলো। ক্রমেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে…………………