অচেনা অতিথি - পর্ব ০২ - সিজন ২ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


সবাই চলে গেছে। সমস্ত কিছু দেখাশোনা করতে গিয়ে পুরোদিন মাহাদ তিতিরের কাছে একবারও আসতে পারেনি। পুরোদিনের ধকলে আজ যেন সবাই ক্লান্ত। তিতিরের পাশে সাদ ঘুমিয়ে পড়েছে। বেডে তেমন জায়গা না থাকার কারনে গোলাব তিতিরের পায়ের নিচে জায়গা করে নিয়ে সুয়ে পড়েছে। অতিথীকে কোলে নিয়ে মাহাদের জন্য অপেক্ষা করছে তিতির। এত রাত হল কিন্তু মেয়ের চোখে ঘুম নেই। শুনেছি মেয়েরা বাবাকে খুব ভালোবাসে। তুমিও কি তোমার বাবার জন্য অপেক্ষা করছো মা! যেমনটা আমি তোমার বাবার জন্য অপেক্ষা করছি? কথাগুলো বলতেই তিতির দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখলো মাহাদকে। 

মাহাদকে দেখে তিতিরের শরীর দিয়ে যেন প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল। এই একটা মানুষের ভালোবাসা তিতিরের জন্য যথেষ্ট। কথাগুলো মনে মনে ভাবতেই মাহাদ রুমে এসে বলল-

~" সবার জায়গা হল তোমার কাছে আর আমার জায়গা কোথায় হুম? আমার তো মনে হয়, সবার আগে আমার জায়গা তোমার কাছে সবচেয়ে আগে। কি ঠিক বললাম?"

তিতির মুচকি হেসে মাহাদের হাত দুটি কাছে এনে তাতে কিস করে নিজের গালের সাথে ঘষিয়ে বলল-

~" আজ আপনার খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে তাই না!"

মাহাদ চিয়ারটা তিতিরের কাছে আনলো কোন শব্দ ছাড়াই। তারপর চেয়ারে বসে স্বস্তির একটা শ্বাস ফেলে বলল-

~" তা অবশ্যই একটু কষ্ট করতে হয়েছে, কিন্তু নিজের প্রিয় মানুষের জন্য পরিশ্রম করার মধ্যও অনেক তৃপ্তি রয়েছে।"

তিতির অপলক ভাবে মাহাদের দিকে চেয়ে আছে। সে যদি সুস্থ থাকতো তাহলে মাহাদকে কোন কাজেই হাত দিতে দিতনা। তিতিরের এমন চাহোনি দেখে মাহাদ উঠে রুম থেকে বের হয়ে গেল। মাহাদ হয়ত তিতিরের চাহোনির ভাষা পড়ে ফেলেছে। মাহাদ বেশ দ্রুতই খাবার হাতে চলে আসলো। অতিথীকে তিতিরের কোল থেকে নিয়ে মেয়েকে একটা কিস করে দোলনায় সুয়ে দিল। মেয়েটা এখনো ঘুমাইনি। বাবার দিকে অপলক ভাবে চেয়ে আছে। প্রচন্ড একটা শান্ত মেয়ে অতিথী। কিন্তু হাত-পা ধীরে ধীরে নড়াচড়া করছে। 

মাহাদ তিতিরকে কোলে তুলে নিতেই ব্যাথায় কুকড়ে উঠলো তিতির। মাহাদের গলা আর একটু শক্ত করে ধরলো। মাহাদ সব কিছু বুঝতে পেরে বলল-

~" খুব কি কষ্ট হচ্ছে!"

ব্যাথায় যেন তিতির জর্জিরিত হচ্ছে। কপাল জড়িয়ে উঠায় রগ গুলো নীলচে হয়ে গেছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তবুও মাহাদ যাতে কষ্ট বা টেনশন না করে তার জন্য মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে মাথা শুধু নাড়িয়ে না বলল।

~" আচ্ছা আগে খাবার খাও, তারপর মেডিসিন নাও, ইনশাল্লাহ্ ঠিক হয়ে যাবে।"

মাহাদের কথায় তিতির শুধু ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। এর মধ্য মাহাদ ওকে সোফায় বসে দিয়ে খাবার প্লেটে ভাত মেখে নিজে এক লোকমা ভাত মুখে নিয়ে তারপর তিতিরের দিকে তুলে দিল। তিতির মাহাদের হাতে একটা কিস করে মুখে ভাত পুরে নিল। খেতে খেতে চট করে বলেই ফেলল তিতির, 
আমরা ঐ বাসায় গেলে কেমন হয় মাহাদ! সবার সাথে মিলেমিশে থাকবো। তাছাড়া বাবা-মাকে রেখে এভাবে আলাদা থাকলে আল্লাহ্ সুবহানাতালা নারাজ হয়ে যাবেন আমাদের উপর। আমি চাইনা প্রভুর ক্রোধের শিকার হই আমরা। আপনি কি আমার কথা শুনছেন?

মাহাদ তিতিরের মুখে আরো এক লোকমা ভাত তুলে দিল কিন্তু এ ব্যাপারে কোন কথায় বললোনা। মাহাদের নিঃস্তব্ধতা তিতিরকে জানান দিচ্ছে, এ বিষয়ে কোন কথা বলে লাভ নেই। মাহাদ এবিষয়ে কোন কথায় শুনতে চাচ্ছেনা। তাই তিতির আর কিছু বলার সাহস পেলোনা। চুপচাপ শুধু খাবার খেয়ে গেল।

খাবার শেষ হলে মাহাদ কাজের মেয়ে টিয়াকে ডেকে সব নিয়ে যেতে বলল। তারপর ঘুমন্ত সাদকে কোলে নিয়ে গোলাবের গায়ে হাত দিয়ে ঝাকিয়েই, গোলাব কামিং বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। গোলাবও একলাফে বিছানা থেকে নেমে মাহাদের পিছু পিছু চলে গেল।
কিছুক্ষন পরে এসে বিছানা একবার ঝেড়ে তিতিরকে  বলল,

~" ওয়াসরুমে যাবা!"

~" না।"

তিতিরকে কোলে করে নিয়ে বিছানায় সুয়ে দিল। তারপর অতিথীকে দোলনা থেকে তুলে তিতিরের পাশে শুয়ে দিল। মশারি খাটিয়ে তিতিরের কপালে একটা কিস করেই বলল-

~" লাইট জ্বালানোই থাকলো। কষ্ট করে কটাদিন লাইট জ্বালিয়েই থাকতে হবে। "টিয়া" তোমার এখানেই থাকবে। কিছু দরকার হলে ওকে দিয়ে আমাকে ডাকিয়ে পাঠিও। এখন ঘুমাও।"

মাহাদ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তিতির বলল,

~" আর একটু থাকেন না!"

মাহাদ কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। মাহাদের এমন ব্যবহারে তিতির খুব কষ্ট পেল। আমার ওনাকে ওমন কথা হয়ত বলা উচিত হয়নি। দুঃখিত মাহাদ, আমায় ক্ষমা করে দিয়েন। তিতির কথাগুলো বলতেই দেখলো, মাহাদ সাদকে নিয়ে চলে এসেছে রুমে। সাথে গোলাবও এসেছে। গোলাব গিয়ে অতিথীর পাশে চুপচাপ গুটিসুটি মেরে বসে পড়লো। তিতির তুমি ঘুমাও বলে মাহাদ দরজা বন্ধ করে দিয়ে সাদকে বুকে নিয়ে সোফায় শুয়ে পড়লো। 

মাহাদের এমন ছোট ছোট সারপ্রাইজ গুলো তিতিরকে খুব সুখ দেয়। তিতির কি চায় মাহাদ যেন সব বুঝে যায়। স্বামী-সন্তানকে অন্য রুমে রেখে একা একা থাকা যায় নাকি! ওদের ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে এতক্ষন তিতিরের যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কিন্তু এখন সব ঠিকঠাক। নিজের চিন্তা ভাবনাকে ক্লজ করে কেটে কেটে বলে উঠলো তিতির-

~"মাহাদ, সাদ কে না হয় আমার কাছে দিয়ে যান। আপনারতো কষ্ট হবে ওভাবে ওকে নিয়ে থাকতে!"

সন্তান বুকে নিয়ে ঘুমানোর মত এমন শান্তি অন্য কোথায়ও পাওয়া যাবেনা। আমি ঠিক আছি। তুমি ঘুমাও বলে মাহাদ চোখ বন্ধ করলো এবং কিছুক্ষনের মধ্য ঘুমিয়ে পড়লো।


দুই মাস পরে,

আকাশ মেঘলা। কয়েকবার দফায় দফায় বৃষ্টি হয়েছে। ৫দিন একটানা বর্ষনে চারপাশের এলাকায় বেশ পানি জমে ছোটখাটো বন্যায় পরিনিত হয়েছে। বাসার পিছন দিকে বাগানের ধারে একটা ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। বাড়ির মালি আগে জায়গাটা দেখেছে। মাহাদ অফিস যাওয়ার সময় সে কথা মালি ওকে জানিয়েছে। মাহাদ তিতিরকে বিষয়টি ফোনে জানিয়েছে। সাদ যেন ঐ দিকে না যায়।

দুপুরের সময় আসতেই ফাটলের জায়গার সমস্ত মাটি ধসে হঠাৎই নিচে পড়ে যায়। মনে হয় অনেক আগে সেখানে পুরনো কোন কূপ ছিল।  অতিরিক্ত বর্ষনে মাটি নরম হয়ে আলগা হয়ে গেছে। বৃষ্টি বাদলের দিন তাই ওদিকটাই কেউ আর যায়নি বলে মাটি আলগা হওয়ার বিষয়টিও কেউ জানেনা। তাছাড়া কূয়াটি অনেক গভীর। দুপুরের পর আর একবার ভারি বর্ষনে কুপে বেশ পানি জমেছে।

দুপুরের পর স্কুল থেকে এসে সাদ মায়ের সাথে নামায পড়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর ঘুম থেকে উঠে আসরের নামায পড়ে গোলাবকে নিয়ে খেলতে যায় বাহিরে। বাগানের কথাটি তিতিরের স্মরনে ছিলোনা সাদকে বলতে। আর সাদ ঐ বাগানের দিকটাই গোলাবকে নিয়ে খেলতে যায়।

সাদ তার বলটা দুরে ছুড়তেই গোলাব বলটি কুড়িয়ে আনছে। এমন করতে করতে বলটি একদম কুয়ার মধ্য পড়ে যায়। 

গোলাব কুয়ার কাছে গিয়ে দাড়াতেই দেখলো বলটি অনেক নিচে গিয়ে পানিতে ভেসে আছে। দুর থেকে সাদ জোড়ে চিৎকার দিয়ে বলল-

~"গোলাব ভাইয়া কামিং।"

গোলাব লেজ নাড়িয়ে সাদের দিকে একবার ফিরে চেয়েই আবার কুয়ার পাড়ে একটু ঝুকে বলটি দেখতে গিয়েই মাটি সহ ও ধসে পড়লো কুয়ার ভিতর। ঝপ করে জোড়ে একটা শব্দ হতেই সাদের বুকে ছাৎ করে উঠলো। গোলাব ভাইয়া বলেই কুয়ার পাশে দাড়িয়ে দেখলো, তার গোলাব ভাইয়া অদ্ভুদ রকমের শব্দ করে   উপরে উঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু বার বার সে পিছলে পড়ে যাচ্ছে। গোলাবের কাছ থেকে পানি আরও নিচে ছিল। ও পানি থেকে একটু সমান্তরাল মাটিতে পড়েছিল। সেখান থেকেই উঠার চেষ্টা করছিল।

ছোট্ট সাদ কোন চিন্তা না করেই অস্থির হয়ে বলল-

~" ভাইয়া আমি আপনাকে নিতে আসছি।"

সাদ এক'পা দু'পা করে নেমে যেতেই সে একদম গভীর খাদে পানির মধ্যে পড়ে যায়। পানিতে পড়েই সে হাবুডুবু খেতে লাগলো। যা দেখে দ্রুত পানিতে ঝাপ দেয় গোলাব। নিজের শরীর দিয়ে যতটুকু পরছে সাদকে উপরে ঠেলে তোলার চেষ্টা করছে গোলাব। কিন্তু বার বার চেষ্টা করেও সে ব্যার্থ হচ্ছিল। সাদকে ছেড়ে দিয়ে ও পানির মধ্যেই হাপাতে লাগলো। এদিকে সাদের অবস্থা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। পানি খেতে লাগলো সে। গোলাব আবার বড় একটা শ্বাস নিয়ে গায়ের শক্তি দিয়ে সাদকে উপড়ে তুলে ধরলো। সাদও সাথে সাথে হাত দিয়ে যেন মাটি খামচে ধরলো। নিজের পুরো শরীর দিয়ে সাদকে উপরের দিকে ঠেলে ধরে আছে গোলাব। আর মুখটা শুধু সামান্য পরিমান পানির উপর রেখেছে শুধু শ্বাস নেওয়ার জন্য।

দু'জনেই কাদা আর পানিতে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। অসময়ের বৃষ্টি মানুষ ও প্রানী দুটোর জন্যই বেশ অস্বাস্থ্যকর হয়। গোলাব মাটির সাথে সাদকে খানিকটা চেপে ধরে আছে।


মাগরিবের নামাযের ওয়াক্ত হয়ে আসছে কিন্তু সাদ আর গোলাবের কোন খবর নেই। তিতির অতিথীকে নিয়ে একটু ব্যস্থ ছিল। মেয়েটার গায়ে বেশ জ্বর এসেছে। কাজের মেয়ে টিয়াকে ডেকে তিতির বেশ চিন্তিত হয়ে বলল-

~" টিয়া দেখতো! সাদ বাহিরে আছে কিনা! ওকে দেখছিনা। এতক্ষনে তো ওর বাহিরে থাকার কথা নয়!"

সাদ বাবাতো বাহিরে গেল তখন দেখলাম। আমি এখুনি ডেকে আনছি বলেই টিয়া চলে গেল। এই ভর সন্ধ্যায় মেয়েকে নিয়ে বের হওয়া ঠিক হবেনা ভেবে তিতির আর বের হলোনা। এর মধ্যেই মাগরিবের আযান পড়ে গেল। তিতির ছটপট করতে লাগলো। সাদ কোথায় তুমি বলে বার বার ডাকতে লাগলো। নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেছে বলে ওযু করে এসে সালাতে দাড়ালো তিতির। তিতির জায়নামাযে দাড়াতেই টিয়া দৌড়ে এসে বলল-

~" আপা, সাদকে তো পাওয়া যাচ্ছেনা। দাড়োয়ান বলছে ও নাকি বাসা থেকে বেরই হয়নি।"

কথাটা যেন তিতিরের কানের দোড় গোড়ায় এসে ধাক্কা খেল। সুরা আল ফাতিহা পড়তেই চোখ উপচে পানি পড়তে লাগলো। নিজেকে কঠোর করে সেজদায় চলে গেল। ছেলের কখনও নামায কাযা হয়না। আজ সেই নামায কাযা হয়ে যাচ্ছে এর থেকে কষ্টের আর কি আছে! আল্লাহ্ আমার দুটা সন্তানকেই রক্ষা করেন। ওদের হেফাযতে রাখেন আল্লাহ্।
নামায শেষ করে উঠে টর্চ লাইটা নিয়ে বাহিরে যেতেই মাহাদ বাসায় আসে। তিতির ভয়ে যেন কুকড়ে গেল। মাহাদকে এখন কি জবাব দিবে!  ততক্ষনে পুরো বাসায় খোজ করা শেষ সাদ আর গোলাবকে।  এমনকি কুপেও খোজা হয়েছে। সবাই বেশ অবাক হয়ে গেছে কূপ কোথা থেকে বের হল!

মাহাদ এসে যখন শুনলো সাদকে পাওয়া যাচ্ছেনা তখন ওর মাথা যেন ঘুরে গেল। সাদ নেই! কখন থেকে ও মিসিং! 

ভাইজান,  বিকেলে বল নিয়ে সাদ ও গোলাব  খেলতে বের হয়েছিল। তারপর আর বাসায় আসেনি। দাড়োয়ানও বলল, তারা বাসা থেকে নাকি বেরই হয়নি। কথাগুলো কাজের মেয়ে টিয়া মাহাদকে বলল।

এবার মাহাদ কিছুটা রেগে গিয়ে তিতিরের দিকে কঠোর চোখে তাকাতেই তিতির মাহাদের চোখের ভাষা বুঝতে পারে যে মাহাদ তিতিরকে কি বলতে চাচ্ছে। মাহাদ তিতিরকে বার বার বলেছিল সাদকে যেন বাসার বাহিরে না যেতে দেয়। কিন্তু সে মাহাদের কথাকে গুরুত্ব দেয়নি। নিজের সন্তানের খেয়াল পর্যন্ত সে রাখতে পারেনি।

মাহাদ আর দেরি না করে জলদি টর্চ হাতে নিয়ে বাহিরে দৌড়ে চলে গেল। টিয়াকে অতিথীর কাছে যেতে বলেই পিছনে তিতিরও দৌড়ে গেল। 

মাহাদ প্রথমে বাগানের পিছনে গিয়ে দেখে বড় একটা কূপ বের হয়েছে। এটা কখন হল বলেই সাবধানে নিচে টর্চের আলো ফেলেই সাদ বলে কয়েকবার ডাক দিল কিন্তু কোন রেসপন্স এলোনা। আরও কয়েকবার ডেকে যখন কোন রেসপন্স পেলোনা তখন মাহাদ অন্যদিকে দৌড় দিয়ে খুঁজতে লাগলো। বাসার দাড়োয়ান সহ আরও একজন কাজের লোক মাহাদের সাথে আবার খুজতে লাগলো। শেষে তারা বাসার বাহিরে আসেপাশে খুজতে লাগলো।

মায়ের মন কখনো মিথ্যা হয়! তিতিরের মনে হচ্ছে সাদ এই কুপের ভিতরই আছে। সাদ বাবা আমার, আপনি কোথায়! আপনাকে ছাড়া আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। আপনি কোথায় বাবা বলেই কাঁদতে লাগলো তিতির। গোলাবের নাম ধরেও কয়েকবার ডাকলো তিতির। কিন্তু সাদ বা গোলাব কারো কোন খবর পেলোনা।
 নাহ্ আমার মন বলছে আমার ছেলে এখানেই আছে বলে তিতির ডিসিশন নিল ও এই কুপে নামবে। 

তিতির যখন কুপে নামার প্রস্তুতি নেয় তখন সেটা ব্যালকোনি থেকে দেখতে পায় কাজের মেয়ে টিয়া। ওখান থেকেই টিয়া জোড়ে জোড়ে চিৎকার দিয়ে ডাকতে লাগলো মাহাদকে। ভাইজান দেখেন, আপা কুয়ার ভিতর নামতেছে। কুয়ার আসেপাশের মাটি এমনি নরম তার উপর তিতির সেখানে নামার চেষ্টা করছে। সেটা দেখে মাহাদ দৌড়ে আসে তিতিরের কাছে। আসে পাশে কেউ না থাকাতে তিতিরের উপর এবার প্রচন্ড রেগে গেল মাহাদ। একে তো ওকে নিষেধ করেছিল আজ যেন সাদকে বাহিরে যেতে না দেওয়া হয় তার উপর এমন পাগলামো। তিতির নিচে পড়ে যেতে যেতেই মাহাদ ওর হাতটা টেনে ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের কাছে আনতেই তিতিরের পাগলামো যেন আরও বেড়ে গেল। আমাকে ছেড়ে দিন, আমার ছেলে এখানেই আছে বলতেই মাহাদ এত জোড়ে তিতিরকে একটা ধমক দেয় যে উপরে ব্যলকোনিতে থাকা টিয়া অবদি কেঁপে উঠলো।

মাহাদ তিতিরকে ছেড়ে দিয়ে আবার ধমক দিয়ে বলল-

~" তোমাকে যেন এখানে একমুহুত্বও দাড়িয়ে থাকতে না দেখি। এক্ষুনি যেন বাসার ভিতর যাওয়া হয়!"

মাহাদের ধমকে তিতির স্তব্ধ হয়ে যায়। অভিমান আর কষ্ট এক সাথে এসে যেন ওকে চেঁপে ধরলো। তাই ঢোক চিপে বলল-

~" আমি কোথাও যাবোনা। আমার ছেলেদের আমার চাই।"

তিতির আবার সাদ আর গোলাবের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। কুপে যে নামবে তার জন্য দড়ি লাগবে। মাহাদ আর তিতিরকে বাধা না দিয়ে বরং ওকে এক হাতে শক্ত করে ধরল। কারন ও নিচে নামার জন্য ছটপট করেই চলছে। মাহাদ চিৎকার দিয়ে দাড়োয়ানকে ডেকে বলল-

~" চাচা গ্যারেজ থেকে প্লিজ দড়িটা নিয়ে আসেনতো! একটু জলদি করে দড়িটা আনেন।"

দাড়োয়ান আর দেড়ি না করে খুব দ্রুতই দড়ি নিয়ে এলে মাহাদ দেখলো দড়িটা খুব একটা বড় নয়। আরো দড়ি আনেন বলেই তিতিরের হাতে দড়ি দিয়ে অপর প্রান্তের দড়ি কোমড়ে বেধেই মুখে টর্চ নিয়ে সড়সড় করে কুপের ভিতর নেমে যায়। 

এমন সময় দাড়োয়ান আরও দড়ি আনতেই অন্যগুলো দড়ির সাথে মাহাদের দড়িটি বেঁধেই দড়ির অন্য প্রান্ত নিয়ে গিয়ে অদুরে একটা গাছের সাথে কষে বেঁধেই আবার কুপের কাছে আসলো তিতির। তারপর চিৎকার দিয়ে বলল-

~" মাহাদ, ওদের পেয়েছেন?"

~"""""""""""""""""""""""?

কোন রিপ্লাই আসেনা। তিতির এবার যেন পাগল হয়ে যায়। মাহাদ আপনি ঠিক আছেন বলেই জোড়ে জোড়ে কাঁদতে লাগলো। না ওরা ঠিক নেই বলেই তিতির কারও কথার তোয়াক্কা না করেই দড়ি বেয়ে সড় সড় করে নিচে নেমে গেল।

সাদের কোন জ্ঞান নেই। মাটি ওভাবেই খামচি দিয়ে ধরে আছে আর গোলাব তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে সাদকে কুপের দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে আছে। সেটা দেখে মাহাদ দ্রুতই একদম ওদের কাছে আসে। আগে গোলাবকে পানি থেকে তুলে বুকের ভিতর চেপে নেয় আর অন্যহাতে সাদকে মাটি থেকে টেনে বের করে। এর মধ্য তিতির নিচে নেমে এসেছে। মাহাদ তিতিরকে দেখেই জোড়ে চিৎকার দিয়ে দাড়োয়ানকে  বলল-

~" চাচা, দ্রুত মিল্টনকে কল দিয়ে বলেন ডক্টরকে আনতে। আমার ছেলেরা একদম ভালো নেই চাচা! দ্রুত খবর দেন তাকে।"

মাহাদের চিৎকারময়  আদেশ শুনেই দাড়োয়ান দৌড়ে সেখানে থেকে চলে যায়। মাহাদের চিৎকার শুনে তিতিরও স্থির হয়ে যায়। যা আশা করেছিল তার থেকেও করুন অবস্থা তার সন্তানদের। তিতির লাইটের আলোয় দেখলো, গোলাবের মুখ দিয়ে রক্ত আর সাদা ফেপড়া বের হচ্ছে। গোলাবের অবস্থা সাদের থেকেও খারাপ। মাহাদের চোখে দিয়ে অঝোড়ে  জল বয়ে চলছে। এমন অবস্থায় মাহাদ তিতিরের কোলে সাদকে দিয়েই বলল-

~" দ্রুত, খুব দ্রুত উঠে যাও। একদম আমাদের হাতে সময় নেই।"

সাদকে বুকে নিতেই মাহাদ নিচ থেকে তিতিরকে উপরে ঠেলে দিল। কিন্তু মাঝ পথে সাদকে সহ তিতির পিছলে পড়ে গেল।  নিচে মাহাদ থাকাতে তিতিরকে শক্ত করে ধরে ফেলল মাহাদ। মাহাদের মুখ থেকে শুধু একবার তিতির নাম বের হতেই তিতির নিজের ওড়নাটা খুলে সাদকে বুকের সাথে বেঁধে তড়তড় করে উপড়ে উঠে গেল।  তিতির গাছে উঠতে পারে বলে কাজটা ওর জন্য খুব সহজ ছিল।

উপরে উঠে এসেই সাদকে উপর করে সুয়ে দিয়ে পিঠে বার কয়েক চাপ দিতেই সাদের মুখ দিয়ে গলগল করে দু'বার পানি বের হল। এদিকে মাহাদ গোলাবকে নিয়ে উপরে উঠেই তিতিরকে বাসায় পাঠিয়ে দিল। কাজের লোকটা ততক্ষনে দুইটা টাওয়াল নিয়ে এসেছে মাহাদের কাছে। মাহাদ গোলাবের গায়ে টাওয়াল দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে বার বার ঝাকাতে লাগলো। গোলাব, গোলাব! বাবা, তুই অন্তত আমাকে একা রেখে ছেড়ে যাসনা! গোলাবকে নিয়ে ঐ অবস্থায় মাহাদ গাড়ীতে উঠেই গাড়ী স্টার্ট দিল। উদ্দেশ্য পশু হসপিটালে। মাহাদ গোলাবকে বুকের মধ্য নিয়ে গাড়ী ড্রাইভ করছে। গোলাব শুধু মুখ দিয়ে একটু শব্দ করলো। তারপর মাহাদের দিকে চেয়েই ওর বুকের ভিতর যেন আরো লেপ্টে গেল। হয়ত গোলাব বলার চেষ্টা করছে, তার জিবন দিয়ে হলেও সে সাদকে নিরাপদে রেখেছে। সে কখনোই বেঈমানী করেনি। সে একজন ট্রেনিং প্রাপ্ত কুকুর। তাই সে চেষ্টা করে ঐ কুপ থেকে উঠতে পারতো। কিন্তু চোখের সামনে সাদ পড়ে যাওয়াতে ও আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। ঝাপিয়ে পড়ে সাদকে বাঁচানোর জন্য। নিজের শেষ নিঃশ্বাস দিয়ে সে সাদকে ওর নিজের উপর রাখার চেষ্টা করেছে। প্রভু ভক্ত কুকুরেরা বুঝি এমনই হয়। 

এই প্রথম কোন পশু যে জ্ঞান হারায় সেটা দেখলো মাহাদ। মাহাদ গোলাবকে আবার ঝাকালো, কিন্তু গোলাব আর কোন সাড়াশব্দ করলোনা। মাহাদ সাথে সাথে শক্ত করে গাড়ীর ব্রেক কষলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন