অচেনা অতিথি - পর্ব ৩৫ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


সংগত কারনে কুকুরের নাম পিন্টু বদলে "গোলাব" রাখা হল। আশা করি, কারো সমস্যা হবে না।


দাড়োয়ান মাহাদের ব্যালকুনির নিচে এসে দাড়াতেই মাহাদ দরজা খুলে ব্যালকুনিতে চলে আসলো। মাহাদের মনে তখন নানা চিন্তা। যখন শব্দ হল তখন কেনো বের হলাম না। আল্লাহ্ ও যেন ধরা না পড়ে।

এমন সময় "গোলাব"  মাহাদের রুম থেকে ডাকতে ডাকতে বের হইলো। ব্যালকুনিতে এসেই উপর থেকে দাড়োয়ানের গায়ে ঝাঁপ দিল।

ওবাবাগো মাগো বলে জোড়ে দুইটা চিৎকার দিয়ে ৩ হাত দুরে লাফিয়ে পিছনে সরে গেল। গোলাব মাটিতে পড়েই ভুগ ভুগ করে চিৎকার দিয়ে ডাকতে লাগলো।

"চাচা কি খোঁজেন এমন করে!"

" বাবা আগে তোমার কুত্তাটারে সরাও। আমার এতটুকু জিবনের পিছনে কুত্তা লাগলে বাচুম ক্যামতে?"

" গোলাব কামিং বলতেই গোলাব মাহাদের কাছে না গিয়ে ওখানেই ঘাসের উপর বসে পড়লো। তারপর দু'বার মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে মাহাদকে জানিয়ে দিল সে এখন যাবেনা। দাড়োয়ানের সার্কাস দেখতে তার হয়ত ভালো লাগছে।"

মাহাদ কি আর করবে শেষ পযর্ন্ত দরজা খুলে রুমের ভিতর গিয়ে টাওয়ালটা গায়ে জড়িয়ে আবার এসে ব্যালকুনিতে দাড়ালো।

♦♦

৫/৬ জন গার্ড এসে এদিক ওদিক লাইট মেরে খুঁজতে লাগলো। শেষে রজনী ফুফু বের হয়ে এলো।
কি হয়েছে?

" ম্যাডাম, কিছু ঢিল পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম এদিক থেকে। কিন্তু এসে দেখি কিছু না। মনের ভূল না অন্য কিছু বুঝতে পারছিনা আমরা, বলে পুরো বাসার বাহিরে চেক করলো তারা।"

" রুপালী আর কিছু না বলে বাসায় চলে আসলো।"

এদিকে গার্ডরা কিছু না পেয়ে চলে গেল। সবাই চলে যেতে গোলাব এদিক ওদিক কিছু খুঁজতে লাগলো। এবার মাহদ নিঃশব্দে হাঁসতে লাগল।

ঝোপের আড়ালে বসে থাকা তিতিরকে ঠিকি খুঁজে বের করলো গোলাব। তিতিরের কাছে এসে ওর পায়ের কাছে বসে লেজ নাড়তে লাগলো।

তিতির প্রথমে ভয় পেয়ে যায় কিন্তু পরক্ষনে দেখলো মাহাদ ব্যালকুনিতে দাড়িয়ে আছে তাই তিতির ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে এল। সাথে সাথে গোলাবও বের হল।

ব্যালকুনির নিচে দাড়াতেই মাহাদ বলল," আমি নিষেধ করিনি রুম থেকে বাহির হতে? কেন বের হয়েছ!"

তিতির একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল," আপনাকে দেখতে মন চেয়েছিলো তাই চলে আসলাম।"

" মাহাদ ওর শাহাদাত আঙ্গুল নিজের চেহারার দিকে ঘুরিয়ে বলল, " দেখা হয়ে গেছে! এখন যেভাবে এসেছো ঠিক সেভাবেই সোজা তোমার রুমে চলে যাবা। দেন ঘুমিয়ে পড়বা।"

" উহ্,,,,,, উপর থাইকা নাইমা আসেন সোয়ামী♥ "

" কোন ডাইলগে কাজ হচ্ছেনা। তুমি চলে যাও।"

" গোলাবরে অন্তত নিয়ে যান?"

ওকে তো আর নিবই না। যেমন দরদ দেখাতে গিয়েছিল ঠিক তেমন তাকেও আজ তোমার মত এই রুমে জায়গা দেওয়া হবেনা বলে মাহাদ নিজের রুমে চলে গিয়ে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।"

তিতির আহত গলায় গোলাবের দিকে চেয়ে বলল," দেখছিস, তোর মালিক কেমন কঠিন হৃদয়ের মানুষ? এত কষ্ট করলাম তার জন্য আর সে কিনা মুখ ফিরিয়ে চলে গেল? চিন্তা করিসনা গোলাব, আমরাতো আজ ঐ রুমের ভিতর ঢুকবো এবং ওর সঙ্গে এক সাথে ঘুমাবো। শুধু দেখে যা এই তিতির কি কি করে। 

তিতির ওর ওড়নাটা খুলে বাঁকি তিনটার সাথে গিঁট দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেললো। তারপর সেটার সাহার্য্য  গোলাবকে নিয়ে মাহাদের ব্যালকুনিতে উঠে পড়লো। এবার দরজাতে আস্তে আস্তে করে ধাক্কা দিতে লাগল।

মাহাদ তখন ওর কাটা জায়গা থেকে ব্লাড মুছে ফেলছিল। কারন কাটা অংশ দিয়ে আবার ব্লিডিং হচ্ছিল। তাড়াহুড়ো করে ব্যালকুনিতে যেতে দরজার সাথে ধাক্কা লেগেছিল তাই ব্লিডিং হচ্ছে।

" মাহাদ, একটু দরজা খুলে দেন রে.....!"

" স্যরি জান, আমি খুলতে পারবোনা। আজ আমি তোমার কোন আবদারই রাখতে পারবোনা। আমি ঘুমাবো।"

" তিতির কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আবার বলল," আমাকে কিন্তু মশা কামড় দিচ্ছে। বেচারা গোলাব অসহায় হয়ে দরজার দিকে চেয়ে রয়েছে।"

" মশাদের বলে দাও আমি ওদের অনুমতি দিলাম। তারা যেন তোমাকে আর গোলাবরে আষ্টে-পৃষ্ঠে ধরে কিস করে।"

 তিতির এবার অভিমানে বলে উঠলো, আমি কি সত্যি চলে যাবো! আর কিন্তু কোনদিনও আপনার কাছে আসবোনা। দাদী আজ বলেছে বাসায় চলে যেতে। আমি কিন্তু সত্যিই চলে যাবো।

এবার মাহাদ গায়ে আবার টাওয়ালটা জড়িয়ে দরজাটা খুলে দিতেই তিতির আর গোলাব দুজনেই হুমড়ি খেয়ে ফ্লোরে পড়ে গেল।"

মাহাদ কপাল জড়িয়ে বলল," তুমি আমার রুমে আড়ি পেতে এতক্ষন দাড়িয়ে ছিলে? কি আজব কর্মকান্ড। চোর কোথাকার........"

" তিতির ফ্লোর থেকে উঠেই রুমের ভিতর জলদি চলে গেল তারপর গোলাবকে দ্রুত ইশারা করলো। অমনি গোলাব এক লাফে খাটের উপর গিয়ে বসে পড়ল। মনে হয়, এতক্ষন ধরে এতকিছু ঘটল কিন্তু তার সাথে বেচারার কোন লেনাদেনা নাই। একদম বাবুর মত বসে আছে। তিতির শেষে বলে উঠলো,
"আমাকে আর কত তোর তেলেসমাতি দেখাবিরে গোলাব!"

মাহাদ দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে দেখল তিতির বসে আছে। মাহাদ কপাল জোড়া উপরে তুলে বলল," তিতির, তোমার কামিজের ভিতর কি ওটা! পেটের জায়গায় এত উচু দেখাচ্ছে কেন!"

মাহাদের কথা শুনে তিতির চোখ ঘুড়িয়ে একটা মুচকি হাঁসি দিয়ে বলল," এমা, মাহাদ আপনি জানেন না আমি প্রেগন্যান্ট! আপনিও না, নিজেই প্রেগন্যান্ট বানিয়ে এখন বলছেন কিছুই জানি না!"

তুমি প্রেগন্যান্ট বলেই মাহাদ তিতিরের জামাতে হাত দিয়ে কাপড় ধরে টান দিতেই এক এক করে ওড়না বের হয়ে আসতে লাগল। চারটা পরপর ওড়না বের করে বলল," এগুলো কি?"

আহ্ এমন করে কেউ টান দেয়! সুড়সুড়ি লাগে তো! তিতির খপ করে মাহাদের হাত থেকে ওড়না গুলো কেড়ে নিয়ে আবার জামার ভিতর রেখে মাহাদকে হেঁটে দেখালো। তারপর বলল," মাহাদ, আমি প্রেগন্যান্ট হলে এভাবে চলাফিরা করবো তাই না! কবে যে সেই দিন আসবে!"

তিতিরের প্রশ্নের কোন জবাব নাই মাহাদের কাছে। গলাটা ধরে এলো মাহাদের। মাহাদ বেডে গিয়ে বসে তিতিরকে কাছে ডাকল। তিতির ওর সামনে দাড়াতেই মাহাদ ওর পেট থেকে ওড়নাগুলো সরিয়ে বলল," খুব ইচ্ছে তোমার প্রেগন্যান্ট হওয়া!"

" তিতির চোখ দুটি বন্ধ করে মুচকি হাসি দিয়ে মাথা ঝাকালো। খুব ইচ্ছে এখানে আপনার বাবু থাকবে বলে ওর  পেট বের করে সেখানে হাত বুলিয়ে দেখালো। দেখেন, আমি আমার সন্তানকে এমন ভাবে মানুষ করবো যে আপনি তাকে দেখে খুঁশি হয়ে যাবেন।"

" মাহাদ তিতিরের পেটে কিস করে বলল," আল্লাহ্ যেন তোমার মনের এই পবিত্র ইচ্ছাগুলো পুরুন করেন। আমিন।"

" আমিন♥"

" কিন্তু তিতির আমার তো কোন বাচ্চা চাইনা। আমার খুব ইচ্ছা আছে, আমরা দু'টি বাচ্চা দত্তক নিব। নিজের সন্তান নিয়ে দেশের জনসংখ্যা বাড়িয়ে কি লাভ বল! তার থেকে অসহায় দু'টি বাচ্চাকে লালন পালন করা হবে খুব সুন্দর করে। এতে তাদের কষ্টও লাঘব হবে।"

" না না আমিতো আপনার টাই চাই চাই।"

মাহাদ পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল। মাহাদের যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে আজই ওর ইচ্ছা পুরুনের পথে পা দিত। কিন্তু অলৌকিক কিছু না ঘটলে সেটা জিবনেও সম্ভব না। তারপরও মাহাদ গলা ঝাড়ি দিয়ে বলল," তিতির তাহলে তোমার আদরী মায়ের থেকে তুমি কোন অংশে কম হলে! সে পরের মেয়ে পছন্দ করেনা আর তুমিও পরের বাচ্চা পছন্দ করছোনা। কিন্তু এটা আমার একটা সখ ছিল। তুমি কি আমার কোন ইচ্ছায় পুরুন করতে চাওনা!"

 তিতির চুপ করে রইলো। তিতিরতো আর জানেনা তার সন্তান ধারন করার ক্ষমতা আর নেই। তিতির চট করে কথার প্রসংঙ্গ পাল্টে বলল," আপনি কি মেয়ে মানুষের মত গায়ে সেই তখন থেকে টাওয়াল জড়িয়ে আছেন! খোলেন এটা বলেই একটা হ্যাঁচকা টান মেরে টাওয়ালটা খুলে ফেললো।

সাথে সাথে দাঁত-মুখ শক্ত করে মাহাদ চোখ বন্ধ করলো। কারন টাওয়ালের ঘেঁষনা ঐ কাটা স্থানে লেগে আবার ব্লিডিং হতে লাগলো।

তিতির মাহাদকে ছেড়ে দিয়ে দুই হাত দুরে গেল। কাটা স্থানের রক্ত তিতির একদম সহ্য করতে পারেনা। শেষ মায়ের শরীরে এমন অনেক জায়গা দেখেছিল তিতির। যেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। তারপর থেকে এই জিনিসটা সহ্য করতে পারেনা সে। চোখ বন্ধ করে কাঁপা স্বরে হাত উচু করে  বলল," আপনার হাতে কি হয়েছে?"

মাহাদ চোখ খুলে মেডিসিনের বক্স নিয়ে এসে তুলা দিয়ে ব্লাডগুলো মুছে নিজেই ড্রেসিং করতে লাগলো। তিতির চোখ বন্ধ করে কেঁপেই চলছে।

"তিতির এখানে আসতো!"

" না, আমি পারবোনা যেতে আপনার কাছে। আমি সহ্য করতে পারিনা এগুলো। চোখ বন্ধ করা অবস্থায় কথাগুলো বলল তিতির।"

"মনে করো, আমাকে তোমার সামনেই কেউ ছুড়ি দিয়ে আমার বুকটা এফোড় ওফোড় করে দিল। তবুও তুমি এভাবেই আমার কাছ থেকে দুরে সরে থাকবে!"

তিতির চট করে চোখ খুলতেই মাহাদ বলল," আমি এক হাতে এটা বাঁধতে পারছিনা। একটু বেঁধে দিবা?"

" তিতির ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে গজটা সুন্দর করে বেধে দিয়ে মাহাদের মাথাটা নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে বলল," আপনি আমাকে কথা দেন, আপনি আর কখনো সন্ধ্যার পর বাহিরে থাকবেন না। আপনার কিছু হলে আমি শেষ হয়ে যাবো। আল্লাহ্ আর আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই এই পৃথিবীতে। "

" তুমি কিভাবে বুঝলা, আমাকে কেউ আঘাত করেছে?"

" আপনার কথার মাধ্যমে বুঝতে পারলাম। আপনি ছুড়ির কথা বলতেই বুঝতে পেরেছি।"

মাহাদ নিজেকে তিতিরের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটা ব্যাথার মেডিসিন খেয়ে বলল," তুমি এখানে থাকবা, না তোমার রুমে চলে যাবা?"

তিতির অপরাধীর মত মাথা নিচু করে বলল," একটু থাকিনা এখানে!"

এভাবে অপরাধীর মত করে কথা বলছো কেন তিতির! তোমার বর, তোমার ঘর। আমার উপর একমাত্র শুধু তোমারই অধিকার আছে। আমি চাই তুমি সেই অধিকার সম্পূর্ন আমার উপর প্রয়োগ করো। মাহাদ বিছানার উপর দুটো আস্তে আস্তে থাবা দিতেই গোলাব মাহাদের দিকে চাইলো। মাহাদ হাত দিয়ে ইশারা করতেই গোলাব উঠে গিয়ে সোফায় বসে গুটিসুটি মেরে চোখ বন্ধ করলো। 

" ওকে বিছানা থেকে তাড়িয়ে দিলেন কেন!"

" মাহাদ বিছানায় সুয়ে বলল," আজ ওর মা বাবার সাথে থাকবে তাই ও নিজেই চলে গেল।"

" আমি ওর মা!"

" হুম, মনে কর ওটাই আমাদের প্রথম ছেলে সন্তান। পরে আরও দু'টো তোমায় এনে দিব। কিন্তু ওগুলো আমাদের মত মানুষ।"

" মাহাদ, আমরা কি সত্যিই বাচ্চা নিব না!"

" নাহ্, আমি চাইনা বাচ্চা নিয়ে তোমার এই সুন্দর ফিগারটা নষ্ট হয়ে যাক। আমি চাই তুমি এমন শরীরেই আমার কাছে সব সময় অবস্থান করো। আমার এমন তিতিরকেই চাই। যাকে দেখলে সবসময় আমার নেশা ধরে যায়।"

তিতিরের বুকটা হুহু করতে লাগলো। তাহলে মাহাদ এতো দিন ভালোবাসার বদলে তার এই শরীরকেই ভালো বাসত? নাহ্ এটাতো হবার কথা ছিলনা। আর শরীরকে ভালবাসলে তো এতদিনে মাহাদ তাকে এভাবে কখনোই ছাড়তো না। কোনটা সঠিক আর কোনটা মিথ্যা! কোনটাই মাথায় আসছেনা তিতিরের।

তিতির মাহাদের পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,"  আমি আপনাকে ঘুমের ছড়া শুনায় আর আপনি ঘুমান।"

মাহাদ আর কোন কথা না বলে  চোখ বন্ধ করলো।

আই নিন্দো বায় নিন্দো
কালা বাদুরের ছাও
ল্যাজ কাটা শিয়াল এল
চুপ করে থাও.......

মাহাদ ধড়পড় করে উঠে বসে বলল," আমি কি ছোট বাচ্চা যে এভাবে ছড়া কেটা ভয় দেখিয়ে আমায় ঘুমিয়ে দিচ্ছো! এমন করলে তো আমার ঘুমের বারোটা বাজবে। আমার শরীর খারাপ লাগছে আমায় ঘুমাতে দাও।"

তিতির অভিমান করে চুপ করে বসে রইলো। মাহাদ আবার সুয়ে পড়লো তারপর তিতিরকেও হাত দিয়ে ইশারা করলো ওর পাশে সুয়ে পড়তে।

এবার তিতির খুশি হয়ে মাহাদের পাশে শুতেই মাহাদ ওকে বুকের মধ্য নিয়ে বলল," একদম নড়াচড়া করবা না।"

এ কেমন নির্যাতন! নড়াচড়া করা যাবেনা! তিতিরের ঘুম আসছেনা। শেষে তিতির ওর মুখ দিয়ে মাহাদের বুকের লোম একবার আলতো করে টান দেয় আর ছেড়ে দেয়।

উমহ্ তিতির! এগুলো কি ছোট বাচ্চাদের মত শুরু করছো! লোম মুখে নিচ্ছো কেন! পেটের অসুখ করবে তো! অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো বলে মাহাদ এসির টেম্পারেচার বাড়িয়ে দিল। আর গায়ের উপর কম্বল দিয়ে নিল।

এবার তিতিরের বেশ ঠান্ডা লাগলো। মাহাদকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর মাহাদের ঘুমের সমস্যা হতে পারে তাই চুপ করে রইলো। একসময় ঘুমিয়ে পড়লো গভীর ঘোরে। তিতির ঘুমাতেই মাহাদ ওকে পরীক্ষা করলো সে আসলেই ঘুমাইছে কি না? নাহ্ তিতির সম্পূর্ন  ঘুমে বিভোর হয়ে পড়েছে তাই মাহাদ ওর কপালে কিস করল। মাহাদের চোখটা ছলছল করছে। তিতির, তোমার ওজন যদি তিনশত কিলোও হয় তবুও আমার ভালোবাসা তোমার প্রতি কমবেনা। আমিতো তোমাকে ছেড়ে থাকতেই পারবোনা তিতির! আল্লাহ্ চাইলে ইনশাল্লাহ্ আমাদের সন্তান হবে বলে  চোখ বন্ধ করলো মাহাদ। প্রিয় মানুষকে নিজের বুকের মধ্য নিয়ে ঘুমানোর মত সুখ পৃথিবীতে আর কিছু নেই।

♦♦♦

কামরান সাহেবের নির্বাচন কাছে চলে এল। কামরান সাহেব আর রেজওয়ান পুরোপুরি নির্বাচনে মনযোগ দিল। পুরো বিজনেস সামলানোর দায়িত্ব মাহাদের কাঁধে এসে পড়লো। রাত করে বাসায় ফেরা, আবার খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে অফিসের জন্য রেডী হওয়া, নানান ব্যস্ততায় তিতিরকে আর সময় দিতে পারেনা মাহাদ। এভাবে দুই মাস কেটে গেল। তিতিরের এখন বড্ড অভিমান মাহাদের উপর। কুড়ে ঘরে স্বামীকে নিয়ে থাকা ভালো তবুও এই রাজপ্রাসাধে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকা ভালো নয়। তিতির রাগ করে, অভিমানে কান্না কাটি করে তবুও মাহাদকে একবারের জন্যও কল দেয়না। মাহাদ ওকে যতক্ষন না পর্যন্ত কল দিচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত তাদের মধ্য কথা হয়না। এক বাসায় থেকেও মনে হয়ে হাজার মাইল দুরে তাদের অবস্থান। এক সাথে থাকলে অন্তত রাতে তাকে কাছে পাইতো। সেটাও সম্ভব না।

তিতিরেরও পড়াশুনার চাপ বেড়ে গেছে। এর মধ্যই বিদেশী এক বিজনেসের বার্ষিক  সম্মোলনে যোগদান করার ইনভাইট আসে কম্পানিতে। কামরান সাহেব আর রেজওয়ান দু'জনেই ব্যস্ত তাদের নির্বাচনী প্রচারনায়। তাই সেখানে যোগদান করার জন্য মাহাদ কে যেতে হবে। ভিসা টিকিট সব কিছু রেডী করা হয়েছে। 

মাহাদের প্লান ছিল এই সুযোগে তিতিরকেও ওর সাথে নিয়ে যেতে। বাসায় বলত ও বাবার কাছে চলে গিয়েছে। তাহলে কোন সমস্যা হত না। কিন্তু প্রায় ১৩ দিনের মত সেখানে অবস্থান করতে হবে। এতে তিতিরের পড়ারও বেশ ক্ষতি হয়ে যাবে। এমন সুযোগ জিবনে হাজার বার আসবে কিন্তু ওর স্ট্যাডির ক্ষতি হলে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া হয়ত সামনের সপ্তাহের দিকে  ওর রেজাল্ট দিবে।

রাত ন'টায় খাবার টেবিলে বার্সেলোনা তে যাওয়ার কথা সবাইকে জানিয়ে দিল মাহাদ। আগে স্পেনে যাবে তারপর সেখানে ৪ দিন অবস্থান করে বার্সেলোনায় যাবে।কামরান সাহেব খুব খুশি হলেন। এতবড় একটা প্লাটফর্ম থেকে কম্পানিতে ইনভাইট আসবে সেটা তার কল্পনাতীত ছিল। রেজওয়ান ও আড়চোখে মাহাদের দিকে বিশ্ময় সহকারে তাকালো। এই ছেলের হাতে কি জাদু আছে সেই জানে। যেখানে যায় সেখানেই তার ভাগ্যর সাফল্য যেন উপচে পড়ে। আমি আর মামা যেটা এতদিন ধরে চেষ্টা করেও পারিনি আর সে প্রথম চেষ্টাতেই সাফল্য পেয়ে গেল!

তিতির মুখে কিছু বলছেনা। শুধু ভাত নাড়া-চাড়া করছে। তিতিরের এমন ব্যবহার মাহাদের চোখ এড়ালো না। মাহাদ নিঃশব্দে খাবার খেয়ে উঠে গেল। একটু পর সবার খাওয়া শেষ হলে তারাও উঠে গেল।বাতাসি বিবি তিতিরকে ধমক দিয়ে বলল," কি রে শোক পালন করোস? সোয়ামী♥ চলে যাবে বলে!"

তিতির বাতাসির মুখের পানে চেয়ে একটা শুকনো হাঁসির দেওয়ার চেষ্টা করলো। দাদী অন্তত আজ আপনি স্বীকার করলেন তো মাহাদ আমার স্বামী হয়! তিতির বাতাসিকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে পড়লো।

♦♦♦♦

লাবীবা ছেলের সব কাপড় চোপড় গুছিয়ে দিচ্ছে ল্যাগেজে। কামরান সাহেব পাশে বসে একটা ফাইল নিয়ে সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে মাহাদকে।  আর বাতাসি সোফায় বসে গোলাবের দিকে চেয়ে মিটমিট করে হাসছে। গোলাবউল্যা তোর জায়গা দখল করে বসছি আজ। এবার কি করবি! 
বেচারা গোলাব ফ্লোরে বসেই বাতাসির দিকে চেয়ে আছে।

এমন কান্ড দেখে মাহাদ চেঁচিয়ে উঠে বলল," বাবা, আপনার মাকে নিষেধ করবেন, আমার গোলাবের পিছে যেন না লাগে। এসে যদি গোলাবের কাছ থেকে বিন্দু পরিমানে রির্পোট শুনছি তাহলে কিন্তু বাতাসির খবর আছে!"

"ঐ আই কি কইছি?"

" কি করেছ মানে! ওর জায়গা দখল করে বসছো কেন!"

লাবীবা কিছু না বলে কামরান সাহেব কে নিয়ে গেলেন  আর বলে গেলন দ্রুত ঘুমাতে। ওরা চলে গেলেও বাতাসির যাওয়ার কোন নাম নেই। কি ব্যাপার বাতাসি, রাত ১১টা বাজতে চলছে কিন্তু তুমি যাচ্ছোনা কেন? আমি ঘুমাবো তুমি যাও।

" আই যাইতাম "ন"। আই যামু আর তুই ঐ মাইয়ার ঘরে গিয়ে ডুক্কি মারবি? আই সেটা হইতে দিমু না।"

" তুমি থাকলেই কি আর না থাকলেই কি। আমি তো যাবোই। প্রয়োজন হলে তোমায় ইঁদুর মারা বিষ খাওয়ায় তারপর ওর কাছে যাবো। তুমি দেখবা আমি কি করতে পারি!"

" বাতাসি আর কোন কথা না বলে সুড়সুড় করে রুম থেকে বের হয়ে গেল। জানের মায়া বলেও তো কিছু আছে নাকি!"

" মাহাদ হাঁসতেই গোলাব রুম থেকে বের হয়ে গেল। মাহাদ ও দরজা বন্ধ করে দিয়ে গোলাবের পিছু পিছু চলে গেল।"

 তিতিরের রুম খোলায় ছিল। গোলাবের জায়গা হলেও মাহাদের জায়গা আর তিতিরের রুমে হলনা। তার আগেই তিতির চট করে দরজা বন্ধ করে দিল।

কিন্তু গোলাবের উৎপাত বেড়ে গেল। সে দৌড়ে গিয়ে মুখ দিয়ে অনায়াসেই দরজা খুলে ফেললো। তিতিরের চোখ তো স্থির হয়ে গেল। এটা কি ছিল।

মাহাদ রুমের ভিতর এসে দরজা বন্ধ করে দিতেই তিতির বলে উঠলো," গোলাব তোর আব্বাজানরে বলে দে, তার সাথে আমার কোন কথা নেই।"

"কি আব্বাজান আব্বাজান লাগাইছো? ওকে কিছু না বলে সরাসরি আমার সাথে কথা বলো।"

" বলবোনা কথা, এতদিন পর খোঁজ নিতে এসেছে। আমার দরকার নেই কেউ আমার খোঁজ নেক।"

" চলে যাবো!"

" যান, কে নিষেধ করছে?"

গোলাব আয় বাবা, তোর মা আমাদের উপর খুব রাগ করেছে। সে বোঝেয় না তোর বাবার সমস্যাগুলো। তোর মাকে বলে দে, যদি আর কোনদিন ফিরে না আসি তাহলে যেন এই রাতের কথা মনে রাখে। আর কান্না-কাটিও যেন করেনা।

এবার তিতির সত্যই কেঁদে ফেলল। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো। মাহাদের কাছে গিয়ে সোজা ওর বুকে কামড় বসিয়ে দিল। সাথে সাথে তিতিরের হাতটা মুচড়িয়ে পিছন দিকে নিয়ে গেল মাহাদ। 
বলিনি, একদম বুকে কামড় দিবিনা।  কামড় দেওয়ার অনেক জায়গা আছে সেখানে কামড় দে কিন্তু একদম বুকে না। এখানে শুধু তোর জন্য ভালোবাসা তুলে রাখা আছে। তাই এখানে কামড় দিয়ে অপমান করবিনা। কথা কি কানে যায়না?

তিতির মাহাদকে ছেড়ে দিতেই মাহাদ তিতিরের হাত ছেড়ে দিল।  তিতিরে কান্না আর অভিমান থামাতেই পুরো রাত কেটে গেল। বেচারার বউকে নিয়ে ঘুমানোর আর ভাগ্য হল না।

পরের দিন মাহাদ স্পেনের উদ্দেশে রওনা দিল। মাহাদ চলে যাওয়ার পর থেকে গোলাব তিতিরের কাছ ছাড়া নড়েনা। সব সময় তিতিরের হয় পিছু পিছু থাকবে না হয় তিতিরের রুমে সুয়ে থাকবে। তিতিরের হাতে ছাড়া খাবারও খাবেনা।

যেটা লাবীবার চোখে সন্দেহ হয়ে ধরা পড়লো। সন্ধ্যার কিছুক্ষন আগে লাবীবা তিতিরের রুমে ঢুকেই সরাসরি প্রশ্ন করলো, মাহাদের সাথে তোমার কি সম্পর্ক আছে।"

তিতির ওর শাশুড়ীর কথা শুনে ভড়কে গেল। সাবিনাকে দিয়ে মৌ কে ডেকে পাঠালো সাথে বাতাসি কেও। 
ওরা রুমে এসে দেখল লাবীবা চিৎকার দিয়ে তিতিরকে শাসন করেই চলছে। মৌ রুমে আসতেই লাবীবা মৌকে খুব খুব খুব বকলো। এত বকলো যে মৌ সবার সামনে কেঁদে উঠলো।

বাতাসিও সুযোগ পেয়ে লাবীবাকে আরো কিছু বললো এতে লাবীবার রাগ বৃদ্ধিই পেল।
এই মৌ, এখুনি তোমার মাকে কল দাও। এক মেয়েকে এই বাসায় পাঠিয়ে তার শান্তি হয়নি। অন্য জনকেও আমার ছেলের পিছে লাগিয়েছে?

"খালাম্মা ফুফুকে কিছু বলেন না প্লিজ। যা বলার আমাকে বলেন।"

এই চুপপপপ!  এখন বুঝছি মা তোমাকে কেন সহ্য করতে পারেনা। তুমি যার খাও তারই সর্বনাশ করতে চাও! এক্ষুনি এক কাপড়ে এই মুহুত্বে বাসা থেকে বের হয়ে যাও। তোমার মুখও আমি দেখতে চাইনা।

মৌ কাঁদতে কাঁদতে বলল,"  ও মেয়ে মানুষ মামী, এই সন্ধ্যায় ও কই যাবে। কাল না হয় চলে যাবে!"

তুমি চুপ করবা! না তোমাকেও ঘাড় ধরে বাসা থেকে বের করে দিতে হবে! দুই জনে কি শুরু করছো? আমার ছেলের মাথা নষ্ট করার প্লান করছো? তোমার আর তোমার মায়ের ব্যবস্থা তো আমি পরে নিব। আগে এরে সোজা করি। 
এই এখনো তুমি দাড়িয়ে রইছো! ফার্দার যেন তোমায় না দেখি মাহাদের সাথে যোগাযোগ করার বলে আরও অনেক কিছু বলল লাবীবা তিতিরকে।

তিতির চোখের পানি মুছে রুম থেকে বের হয়ে নিচে আসতেই আসমার সাথে দেখা। তিতির শুধু আসমাকে একটাই কথা বলল," আসমা আমি এখান থেকে একেবারে চলে যাচ্ছি। কথাটা তোমার ভাইজানকে একদম জানাবেনা। উনি নানা চিন্তায় ওখানে গেছেন তাই তাকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলে দিওনা।"

মাহাদ স্পেনের মাটিতে পা দেওয়ার আগেই তিতিরকে বাসা হতে চলে যেতে হল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন