৭৭!!
মায়রাকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে একটু চোখ লেগে এসেছিল আয়ানের। মায়রা খুব সাবধানে আয়ানের শক্ত বাঁধনটা কিছুটা আলগা করে সরে আসার চেষ্টা করতেই আয়ান একটু কেঁপে উঠে মায়রাকে একেবারে নিজের বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিলো। মায়রা একটু অবাকই হলো এবারে। ছেলেটা দুপুর থেকে কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। মায়রাকে এক সেকেন্ডের জন্যও যেন চোখের আড়াল হতে দিতে চাইছে না। মায়রা এবারে আয়ানের বুকে চিবুক ঠেকিয়ে আয়ানের মুখের দিকে তাকালো। আয়ান আবার চোখ বুজে নেয়ায় একটু বিরক্ত হলো মায়রা। এবারে ইচ্ছে করেই সরে আসার চেষ্টা করলো আয়ানের বুকের উপর থেকে। এবারেও আয়ান মায়রাকে টেনে আরো শক্ত করে নিজের বুকে বেঁধে রাখলো। এবারে এক্সট্রা প্রোটেকশনের জন্যই কি না কে জানে মায়রার কোমড় জড়িয়ে দুহাতে শক্ত করে চোখ বুজে আছে আয়ান। মায়রা ভ্রু কুঁচকে আয়ানের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে।
-এভাবে কি দেখছেন ম্যাডাম? চুপ করে বুকে শুয়ে থাকুন। এভাবে উল্টোপাল্টা পজিশনে শুয়ে পরে আমার আমায়া মামনিকে কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করবা না বলে দিলাম। বাবু ব্যথা পেলে তোমার খবর আছে কিন্তু---।
-আপনি যে এভাবে শক্ত করে ধরে আছেন, তাতে বাবু ব্যথা পাচ্ছে না?
-উঁহু। পাচ্ছে না। তাছাড়া আমার মেয়ে আমাকে বলেছে ওর মামনি যেন এখন বাবাইয়ের বুকে চুপটি করে শুয়ে থাকে। বাবা মা দুজনের ছোঁয়া একসাথে পেতে চাইছে আমার আমায়া মামনিটা।
-ইশ! নিজের ইচ্ছে এখন মেয়ের নামে চালানো হচ্ছে না?
-উঁহু না। ও তো বললো আমাকে। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম---।
-অনেক হয়েছে। এখন ছাড়ো। আর জনাব? মেয়ে আসবে না। আমার ছেলে আসবে আগে।
-না। আমায়া আসবে। জানি আমি।
-না না না। আগে আমান আসবে। আমার লক্ষী মিষ্টি ছেলে--।
-বাহ! ছেলের নামও পছন্দ করে ফেলেছেন? নামটা অবশ্য দারুণ। আমান! কিন্তু ম্যাডাম? আমায়াই আগে আসবে---।
-তোমাকে বলছি না আমি-----?
আয়ানের বুকে মাথা রেখে ফিসফিস করে খুনসুটিতে মেতে ছিল মায়রা। হঠাৎ দরজায় নকের শব্দে আয়ান এমনভাবে চমকে উঠলো যে মায়রা অবাক হয়ে আয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আয়ান অবশ্য মায়রার অবাক চাহনি দেখে নিজেকে সামলে নিলো মূহুর্তের মধ্যেই। মায়রাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েই চুপ করে শুয়ে রইলো। মায়রা কিছু বলার চেষ্টা করতেই আয়ান মায়রার ঠোঁটে আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিয়ে কথা বলতে বারণ করলো। মায়রা আরেকবার অবাক হলো আয়ানের এমন আচরণে। আবার দরজায় নকের শব্দ হলো।
-আয়ান? মায়রা এখন কেমন আছে? একবার আসতে পারবি তোরা?
-কেন মা? ও তো ঘুমিয়ে গেছে---।
-না আসলে তোর খালামনিরা চলে যাচ্ছে তো। সায়নার বিয়ের কার্ডটা তোকে দিয়ে যেত। আর ওর শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথেও পরিচিত হয়ে নিতি আরকি---।
-মা এখন না প্লিজ? মায়রাকে একা রেখে এখন যেতে ইচ্ছে করছে না--।
-আচ্ছা। বিয়ের দিন পরিচিত হওয়া যাবে। আর একটু পরে এসে মায়রার জন্য খাবার নিয়ে আসবি মনে করে। মেয়েটা সেই কখন থেকে না খেয়ে আছে।
-ঠিক আছে মা---।
আয়ান মনোযোগ দিয়ে মায়ের চলে যাওয়ার শব্দ শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো যেন। মায়রা ভ্রু কুঁচকে আয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে খেয়াল হতেই আয়ান আলতো করে মায়রার পেটে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে আবার চোখ বোজার চেষ্টা করলো। মায়রা আয়ানের বুকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে কটমট করে তাকালো।
-এই? তুমি মাকে মিথ্যে কথা বললে কেন? না যাওয়ার জন্য এতো পায়তারা করছো কেন? নতুন মেহমান কি ভাববে বলো তো?
-আরে ধুর। কোথাকার কে। তাদের সাথে বকবক করার সময় কার আছে? বাবা মায়ের এনিভার্সারিতে বহু কষ্টে ছুটি নিয়েছি অফিস থেকে। এই সুন্দর সময়টা তোমার সাথে স্পেন্ড না করে কোথাকার কোন লোকের সাথে পরিচিত হতে যাবো কোন দুঃখে?
-আয়ান? কি লুকাচ্ছ তুমি? সত্যি করে বলো?
-আরে বাবা! কি লুকাবো? আমি আমার সবটা ফোকাস তোমার আর আমাদের বেবিটার দিকে দিতে চাই। বাদ বাকি কার বিয়ে, অমুক রিলেটিভস, তমুক রিলেটিভস এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় নেই আমার।
-আয়ান?
-প্লিজ সোনাপাখি। আমি এখন আমার মামনির সাথে ব্যস্ত আছি। প্লিজ কথা বলো না এখন---।
------------------------------
আয়ান মায়রার পেটে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে চোখ বুজে বিড়বিড় করে কিসব বলে চলেছে। আর মায়রা ভ্রু কুঁচকে আয়ানকে দেখছে। কি এমন হয়েছে যা মানুষটা ওকে বলতে পারছে না? নাকি সবটা মায়রার মনের ভুল? সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে মায়রার। আয়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে চোখ বুজলো মায়রাও। সময় হলে আয়ান নিজেই হয়তো বলবে। তাই আপাতত এসব নিয়ে আর মাথা ঘামালো না।
এদিকে হোটেলের রুমে আসার আগ পর্যন্ত কেউ কারো সাথে একটা কথাও বলে নি। রুমে ঢুকতেই নিজের পার্সটা বিছানার উপর ছুঁয়ে ফেলে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন ভদ্রমহিলা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলার স্বামীর চোখেমুখে কোন রিএ্যাকশনের ছিটেফোঁটাটুকু পর্যন্ত নেই বলেই হয়তো আরো রেগে ফেলেন তিনি। এই দুই অপদার্থ লোক এতো সহজে কি করে সবটা ভুলে যেতে পারে সেটাই উনার মাথায় ঢুকছে না। মিনিট দুয়েকের জন্য মেয়েটাকে দেখেই উনি চিনতে পেরেছেন, এটা আর কেউ নয়, মায়রা। এরা দুজন কি মায়রাকে দেখে নি? নাকি দেখেও না দেখার ভান করছে? এমন হাজারো প্রশ্ন জমে আছে মহিলাটির মনে। কিন্তু তার বোকা ছেলেটা এসব কিছুরই পাত্তা না দিয়ে মোবাইলে কিছু একটা করতে করতে নিজের রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে দেখে আরো বেশি রেগে গেলেন।
-আয়ানের ওয়াইফ মেয়েটা মায়রা ছিল না রে সীমান্ত?
মোবাইলে অফিসের কলিগদেরকে বিয়ের ইনভিটেশন পাঠাতে পাঠাতে বাবা মায়ের রুমটা থেকে বের হচ্ছিল সীমান্ত। দরজার সামনে পৌঁছাতেই মায়ের বলা কথাটা শুনে চমকে দাঁড়িয়ে গেল। আর সীমান্তের এমন চমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া দেখেই ওর মা যা বোঝার সহজেই বুঝে গেলেন।
-তোর লাইফের সবকিছু এই মেয়েটাকে কেন্দ্র করেই কেন ঘটে সীমান্ত? নাকি তুই ইচ্ছে করেই ঘুরেফিরে ওর দ্বারে গিয়েই ভিড়িস? কোনটা?
-ইট’স নট এবাউট মায়রা মম। আমি সায়নাকে বিয়ে করছি। এবারের ব্যাপারটা জাস্ট একটা কোইন্সিডেন্ট ছিল।
-সায়না ফায়না কাউকে বিয়ে করতে হবে না। মায়রার ছায়াও তোর জীবনে আমি পড়তে দিবো না। ওর ননদের সাথে তো মরে গেলেও বিয়ে দিবো না তোর---।
-মা মায়রা ওর কাজিনের ওয়াইফ। এখানে সায়নার দোষটা কোথায়? তাথৈ বিয়ে করতে চায়নি জেনেও তোমরা ওকে আমার সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলে। ও সেটা চায় নি বলে নিজের পছন্দের মানুষটার সাথে চলে গেছে। এখানে তাথৈ বা মায়রার দোষটা কোথায়? মায়রা বিয়ে করতে চায়নি জেনেও জোর করে ওকে আমার সাথে বিয়ে দেয়া হলো। চাপিয়ে দেয়া একটা সম্পর্ক বেশিদিন টিকবে না এটাই স্বাভাবিক। আমাদের বেলাতেও তাই ঘটেছে। এখানে মায়রার দোষ কোথায়, আর সায়নার ই বা দোষ কোথায়?
-ওহ আচ্ছা। সায়নার যে মায়রার সাথে একটা সম্পর্ক আছে সেটা তুই জানতি? তুই আমাদের থেকে এতো বড় একটা ব্যাপার গোপন করে গেলি?
-হ্যাঁ জানতাম। এই ব্যাপারটা তোমাদেরকে জানানোর প্রয়োজন মনে করি নি। বিয়ের পর সায়নাকে নিয়ে আমি ঢাকায় শিফ্ট করবো। মায়রার সাথে যোগাযোগ এমনিতেও ঘটবে না আমাদের। তাহলে অহেতুক এসব নিয়ে মাথা ঘামাবো কেন?
-ও আচ্ছা। এই মেয়েও তোর মাথায় এসব ঢোকাচ্ছে না? মায়রার থেকে ট্রেইন্ড নেওয়া তো। আমি তো ভুলেই গেছি---।
-আমার আর সায়নার বিয়েটা নেক্সট উইকে। প্লিজ এখন কোনো সিনক্রিয়েট করো না।
-কি বললি তুই? আমি সিনক্রিয়েট করছি? আমি সিনক্রিয়েট করছি? বলতে পারলি তুই এই কথা?
-মায়রাকে দেখার আগ পর্যন্ত সায়নাকে তো তোমার দারুণ পছন্দ হয়েছিল। আপাতত তাই মায়রার ব্যাপারটা বাদ দিয়ে সায়নাকে নিয়েই ফোকাস করো প্লিজ?
-ওই মেয়ে আমার বাড়িতে বউ হয়ে আসবে না সীমান্ত। আগের বারও বারণ করেছিলাম তোকে। শুনিস নি। শেষে কি হলো দেখলি তো?
-মায়রার সাথে আমার সম্পর্কটা না টেকার পিছনে তোমারও একটা বিশাল অবদান আছে মা। প্লিজ আমাকে মুখ খুলতে বাধ্য করো না। আমি নেক্সট উইকে সায়নাকে বিয়ে করছি। তোমার থাকতে ইচ্ছে হলে থাকো। নাহলে কালই তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবো। আর ভয় পেও না। সায়নাকে নিয়ে আমি ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটেই চলে যাবো সোজা। তোমার বাড়িতে গিয়ে ঘর দখল করবো না।
-সীমান্ত?
-আসছি মা। আমি সায়নার সাথে একটু দেখা করতে যাবো। আসার পরে তোমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিও। ব্যবস্থা করে দিবো---।
-মায়রা তোকে ছেড়ে চলে গেছে এটায় আমার কি দোষ ছিল? বল তুই আমাকে?
-জানো না তুমি? মায়রা তোমাদের সাথে থাকতে চায় না বলে আমার সাথে ঢাকায় চলে এসেছে। কথাটা কে বলেছিল? কিন্তু মায়রা শেষ পর্যন্ত জানলো আমি নাকি তোমাদেরকে এসব বলে মায়রাকে নিয়ে চলে এসেছি। এমন দুমুখো লোকের সাথে কোন মেয়ে সংসার করতে চাইবে বলো তো? আমার সংসারটা ভাঙ্গার পেছনে তোমার অবদানটা বুঝতে পেরেছ মা? অথচ জানো মা? ও নিজের জন্য একটা শাড়ি কেনার আগে তোমার জন্য শাড়ি আর বাবার জন্য পাঞ্জাবি কিনেছে। ওর নিজের জন্মদিনেও ওকে শপিং করাতে নিয়ে গেছি সেদিনও সেইক কাজটাই করেছে। হাহ। এসব কথা তোমাকে বলাই বেকার।
-ওই মেয়ে তোর পুরোই ব্রেন ওয়াশ করে রেখেছে--। ওকে তো আমি--।
-শোনো মা? আর একটা কথা। মায়রা আমাকে প্রথমে ডিভোর্স করে নি। আমিই ওকে ডিভোর্স দিয়েছিলাম। সংসারটা ও ভাঙে নি। ভেঙেছিলাম আমি। সুতরাং ওকে অহেতুক দোষ দিবে না। আর না সায়নাকে। প্লিজ?
সীমান্ত আর এক মূহুর্তও সেখানে না দাঁড়িয়ে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আর সীমান্তের মা থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন সেখানেই। ছেলের কাছে এভাবে অপমানিত হতে হবে কখনও স্বপ্নেও ভাবেন নি তিনি। আর পাশে সীমান্তের বাবা ভাবলেশহীন হয়ে চুপ করে বিছানায় বসে বসে স্ত্রীকে দেখছেন। উনি স্ত্রীকে হাজার বার বুঝিয়েছেন ওদের পারসোনাল লাইফে নাক না গলাতে। এবার নাহয় কারো পারসোনাল লাইফে নাক গলানোর ফলটা ভোগ করুক। সহজ কথা সহজে না বুঝলে অপমানিত তো হতেই হবে। এটাই স্বাভাবিক।
৭৮!!
দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেছে। আয়ান সেই প্রথম দিন থেকেই মায়রার এমনভাবে খেয়াল রাখছে যেন মায়রা এখনো ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে। এই মূহুর্তের কথা ধরা যাক। সায়নার গায়ে হলুদে যাওয়ার জন্য মায়রা লাল পাড়ের হলুদ একটা জামদানি পড়েছে। চোখে মোটা করে কাজল টেনেছে, সামনের দিকে একটা ছোট্ট সিঁথি কেটে ফুলোফুলো করে একটা খোঁপা করেছে, মুখে হালকা করে মেকাপের ছোঁয়া দিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগানোর জন্য চয়েজ করছে এমন সময় এক বাটি স্যুপ ট্রেতে নিয়ে ভদ্রলোক রুমে আসলেন। একটু পরে ওরা সায়নার গায়ে হলুদের প্রোগ্রামের জন্য বের হবে আর এই সময় আয়ানের এমন ছেলেমানুষি কাজ দেখে মায়রা হাসবে নাকি কি করবে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে আবার নিজের কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করলো। অবশ্য এই ইগনোরেন্স আয়ান কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারলো না। মায়রাকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে এক চামচ স্যুপ মায়রার মুখের সামনে ধরলো। মায়রা ভ্রু কুঁচকে আয়ানের দিকে তাকালো। ছেলেটা রেডি না হয়ে কিসব পাগলামি করছে!
-আরে! আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে বলি নি। আমাকে দেখার বহু সময় পড়ে আছে ম্যাডাম। হা করুন? হা করুন?
-তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ নাকি? আমরা সায়নার গায়ে হলুদে যাচ্ছি। ওখানে কি খেতে দিবে না নাকি? অদ্ভুত!
-আরে! কখন যাবে কখন খাওয়া হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কি আমার বাবুরা না খেয়ে থাকবে নাকি?
-ধুর। খেতে ইচ্ছে করছে না এখন। আর তুমি রেডি না হয়ে আমাকে খাওয়ানোর পিছনে পড়লে কেন? যাও রেডি হও?
-রেডি হয়ে কি হবে?
-কিছু হতে হবে না। রেডি হয়ে এসো তাড়াতাড়ি। নইলে আমি মা বাবার সাথেই চলে যাবো। পরে যেও তুমি একা একা। হুহ।
-হা করুন ম্যাডাম। আর বাবা মার সাথে যাওয়ার কথা ভুলে যান। উনারা আগেই রওনা হয়ে গেছে। এখন আমার যেতে ইচ্ছে না হলে আপনারও যাওয়া হবে না। হা করো?
-এই কি বললা তুমি? আবার বলো তো? সাহস বেশি বেড়েছে না তোমার? আমি কত কষ্ট করে শাড়ি পড়েছি, সাজগোজ করেছি আর এখন বলছ ইচ্ছে না হলে যাবো না? ফাইজলামি পাইছ নাকি?
-আরে বাবা? তুমি শাড়ি পড়েছ, সেজেছ আমি দেখলাম। সারা রাত বসে দেখবো। আমার বউটাকে একদম পরীর মতো লাগছে। এতো রূপের ঢালি মেলে কোথাও যাওয়ার মানে হয় কোনো? উঁহু। তোমার এই চাঁদপরীর রূপটা শুধু আমি দেখবো।
-একদম বেশি বেশি করবা না আয়ান। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি কিন্তু।
-যাব্বাবা! আমি কি করলাম?
-তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে এসো যাও। আমি নিজেই তোমার এই অখাদ্যটি খেয়ে নিতে পারবো। আবার যদি যাবো না বলো তাহলে কিন্তু----।
-হুম ম্যাডাম? তাহলে?
-তাহলে--। তাহলে যেদিকে দু চোখ যায় চলে যাবো দেখো---।
-মায়রা? সামান্য একটা ফাংশনে যাওয়ার জন্য তুমি আমাকে এতো বড় একটা কথা বলতে পারলে?
-হ্যাঁ পারলাম। আমার জানতে হবে এই বিয়ের সাথে আপনার অদ্ভুত বিহেভের কাহিনীটা কি।
-মা-মানে?
-মানে তো যাওয়ার পরে বুঝতে পারবো। তুমি এমন অদ্ভুত অদ্ভুত লজিক কেন দেখাচ্ছ?
-তুমি তো জানো সায়নাকে আমার পছন্দ না। তাই---।
-সায়নাকে পছন্দ না বলে ওর বিয়েতেও যাবে না। আজাইরা লজিক দেখাবা একদম---।
-আরে বাবা! রেগে যাচ্ছ কেন তুমি? তুমি তো সবটা জানো। তবু কেন এতো জেদ করছ?
-কারণ তুমি সায়নার উপরে বিরক্ত বলে ওর বিয়েতে যাবে না কথাটা এক বিন্দুও সত্য না।
আয়ান কিছুক্ষণ থমকে মায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চামচের স্যুপটুকু মায়রাকে খাইয়ে দিয়ে আরেক চামচ স্যুপ নিয়ে মায়রার মুখের দিকে ধরলো।
-আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। তুমি স্যুপটা শেষ করো। আমি আমার বেবিদের সাথে দু মিনিট কথা বলবো। ওরা যেতে চাইলে আমরা যাবো। আর না চাইলে----।
-ফাইজলামি হচ্ছে আয়ান?
-আরে বাবা! এতো কথা বলো না তো। খাও। এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে।
-হুম---।
মায়রাকে এক বাটি স্যুপ পুরোটা খাইয়ে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে আয়ান বাটিটা রান্নাঘরে রেখে এসে মায়রার সামনেই ফ্লোরে বসে পড়লো। পেটের কাছ থেকে শাড়িটা একটু সরিয়ে ছোট্ট করে দুইটা চুমো খেল আয়ান। মায়রা একটু কেঁপে উঠে আয়ানের শার্টটা খামচে ধরলো। আয়ান হেসে মায়রার পেটে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে নিজের মতো করে বকবক শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে।
-কি রে সোনাপাখিগুলো? পেট ভরেছে আমার বাবাই দুজনের? আর কিছু খাবি? উমমম। চকলেট? আচ্ছা বল তো? তোরা কি মাম্মাকে বেশি জ্বালাতন করছিস? বেশি দুষ্টুমি করিস না বাবু। তোদের মামনি এমনিতেই ভিষণ রেগে আছে। আরো বেশি রাগ করলে যে কি হবে? আর এই যে আমান সাহেব। আমার আমায়া মামনির সাথে একটুও ঝগড়া করবা না কিন্তু। তাহলে বাবাই কিন্তু খুব বকবো---।
-আরে? কিসব বলছ? একবার আমায়া আবার আমান!
-হুম। ভাবছি দুজনেই একেবারে এলে মন্দ হয় না। কি বলো? আমায়া এলে আমি খুশি, আমান এলে তুমিও খুশি। আর একবারে দুজনে এলে তোমার কষ্টটাও একটু কম হবে। কি বলো?
-ধ্যাত। দুজন আসবে কে বললো?
-এই যে আমি বলছি। আমার বাবুরা বলেছে। আচ্ছা কি ব্যাপার বলো তো? আমি ওদের নড়াচড়া টের পাই না কেন?
-আরে! এতো তাড়াতাড়ি কি করে? ওরা বড় হবে। ধীরে ধীরে হাত পা বাড়বে। তারপর তো নড়াচড়া টের পাবে। অনেক দেরি এখনো---।
-ধ্যাত এটা কিছু হলো? আমি আরো ভাবলাম---।
-তুমি রেডি হও যাও? কথা ঘুরানোর ওস্তাদ একেবারে--। ১০ মিনিটের মধ্যে বের না হলে দেখবা তো---।
-কি দেখবো গো বউসোনা? আগে থেকে বলে দাও। তারপর দেখছি রেডি হবো কি না--।
-কিছু দেখতে হবে না আপনার। যেতেও হবে না। আমি আর বাবুরাও আপনার সাথে কথাও বলবো না। খাবো না। ঘুমাবো না। রুম থেকে বের হবো না----।
-আরে বাবা! ঠিক আছে ঠিক আছে। বুঝেছি।
-যাচ্ছি আমি।
আয়ান পাঁচ মিনিটের মধ্যে চেইঞ্জ করে নিয়েছে। মায়রা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আয়ানকে দেখে হাসলো। হলুদ পাঞ্জাবিটাতে দারুণ মানিয়েছে লোকটাকে। আয়ানও মায়রার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। মেয়েটা কানে ঝুমকো পড়ছে দেখে আয়ান নিজেই মায়রার কানে ঝুমকো পড়িয়ে দিয়ে ছোট্ট করে একটা চুমো খেল। একে একে গলায় হালকা একটা সীতাহার, মাথায় টিকলি, হাত ভর্তি করে চুড়ি পড়িয়ে দিয়ে মায়রাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো। আয়নায় ওদের প্রতিবিম্বটা যেন ওদের চোখেমুখের খুশিটাকে আরেকটু বেশি করে ফুটিয়ে তুলেছে। আয়ান পাশ থেকে মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে আবার আয়নায় নিজেদেরকে দেখতে লাগলো।
-চলো না? সবাই টেনশন করবে না?
-মায়রু? একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। বুঝতে পারছি না বলাটা ঠিক হবে কিনা।
-বলে ফেলো তাড়াতাড়ি।
-সায়নার সাথে যার বিয়ে হচ্ছে সে আমাদের পরিচিত। বিশেষ করে তোমার পরিচিত সে---।
মায়রা একটু অবাক হয়ে আয়ানের দিকে ঘুরে তাকাতেই আয়ান মায়রার কোমড় জড়িয়ে নিজের সাথে আলতো করে আটকে রাখলো।
-আমার পরিচিত? কে গো? আমার ব্যাচমেট কেউ? উমমম। কে বলো না?
-সী-সীমান্ত---।
-হোয়াট?
মায়রা এতোটা অবাক হয়েছে যে আয়ান ধরে না রাখলে হয়তো চমকে পিছনের দিকে গিয়ে পড়তো। আয়ান মায়রাকে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে নিজের বুকের সাথে প্রায় মিশিয়ে ফেললো। মায়রা কি বলবে বুঝতেও পারছে না। সীমান্ত নামটা ওর জীবনের হয়তো সবচেয়ে কালো অধ্যায়ের একটা। তাই নামটা শুনলেই অজানা ভয়টা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চায় মায়রার ভিতর থেকে। চাইলেও এই নামটা আর ভয়টা কিছুতেই ভুলতে পারে না মেয়েটা।
-তুমি পাগল হয়ে গেছ? সব জেনেও সায়নাকে কেন ওই লোকটার সাথে বিয়ে দিচ্ছ? লোকটা সায়নার কি হাল করবে ধারণা আছে তোমার? তবু কেন বিয়েটা আটকাচ্ছ না তুমি?
-শশশশশ। মায়রা রিল্যাক্স---।
-তুমি আমার কথা বাদ দাও। বিয়েটা আটকাও প্লিজ। ওই লোকটা মানুষ না। সায়নাকে ও হয়তো মেরেই---।
-শশশশশ। মায়ু? দেখেছ? আমি এর জন্য তোমাকে বলতে চাই নি। আগে আমার পুরো কথাটা তো শোনো? এতো হাইপার হয়ো না প্লিজ? শরীর খারাপ করবে আবার---।
-তার মানে আমি সেদিন ঠিকই দেখেছিলাম। ওই লোকটা সত্যিই এসেছিল---।
-হ্যাঁ মায়রা। এসেছিল।
-তুমিও দেখেছিলে ওকে?
-হ্যাঁ----।
-তারমানে তুমি সবটা জানার পরও লুকিয়েছ আমার কাছ থেকে? ইভেন বলো নি পর্যন্ত!
-মায়রা সীমান্ত ছেলেটা ততটাও খারাপ না যতটা তুমি ভাবছ। আসলে ও চায় নি---।
-খারাপ নয়? মানলাম খারাপ নয়। তো আমার সাথে ওর করা ব্যবহারগুলো উচিত ছিল বলছ তুমি? সব দোষ তাহলে আমার তাই তো?
-মায়রা?
আয়ান মায়রার মুখটা তুলে ধরে আলতো করে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। মায়রা একটু ফুঁপিয়ে উঠে সরে আসার চেষ্টা করতেই আয়ান মায়রার মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে চোখে চোখ স্থির করলো।
-আমরা বাইরে থেকে সবাইকে যা ভাবি সে হয়তো বাস্তবে সেরকম নয়। পরিস্থিতির কারণে সবাইই কোনো না কোনো কাজ করতে বাধ্য হয় মায়রা। হয়তো লোকটা ততটাও খারাপ ছিল না।
-তুমি এখন ওই লোকের হয়ে ওকালতি করবে আমার কাছে?
-মায়রা? সবটা জানার আগে আমিও ভাবছিলাম ওই লোককে সামনে পেলে খুন করে ফেলবো। কিন্তু সবটা জানার পর আর কিছু বলতে পারি নি। ইউ নো হোয়াট মায়রু? He loved you enough to let you go. আজ এই লোকটার কারণেই তুমি আমার হয়েছ, এতোটা কাছে আছো। এতো সুন্দর একটা দিন আমাদের জীবনে এসেছে। তুমিই বলো এই লোকটাকে কি করে খারাপ বলতে পারি আমি?
-মা-মানে? কি বলছ এসব?
আয়ান মায়রাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে সীমান্তের বলা প্রতিটা কথা একে একে বলতে শুরু করেছে। আর মায়রা থ হয়ে সবটা শুনছে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যবিন্দুতে এসে যেন আটকে গেছে মায়রা। কোনটা বিশ্বাস করবে? যেটা আয়ান বলছে নাকি যেটা নিজে উপলব্ধি করেছে লোকটার সাথে কাটানো ছয়টা মাসে? আর লোকটার কথাগুলো যদি সত্যিই হয় তাহলেই বা মায়রা কি করবে? লোকটা কি আসলেই সায়নাকে ভালো রাখতে পারবে? নাকি আরেকবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে?