৩১!!
আয়ান আরিশার কথাগুলো শুনে রুম থেকে বেরিয়ে এসে করিডোর দিয়ে কয়েকপা সামনে এগিয়ে যেতেই একটা কটেজের বাইরে তাথৈ আর রিহানকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। আয়ান হন্তদন্ত হয়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেল। তাথৈ কান্নাকাটি করে চোখ লাল করে ফেলেছে দেখে আয়ানের একটু ভয়ই হলো।
-তাথৈ? কি হয়েছে?
-আয়ান? দেখো না--মায়রা সেই কখন থেকে দরজাটা বন্ধ করে বসে আছে--। কখন থেকে ডাকছি ওকে। দরজাটা খুলছে না পর্যন্ত---।
-তোমরা ওকে একা রুমে ছাড়লে কেন?
-ও এসেই আমাদেরকে বের করে দিয়েই দরজা বন্ধ করে কাঁদছে--। একটু দেখো না ভাই প্লিজ?
-ভেবো না তাথৈ--। আমি দেখছি। তুমি একটু নিজেকে সামলাও। সামনে লড়াইটা হয়তো আরো বেশি কঠিন হবে--।
-হুম--।
-তুমি যাও। রেস্ট করো। আমি মায়রাকে দেখছি। ওকে? ভাইয়া আপনি তাথৈয়ের খেয়াল রাখুন--।
রিহান মাথা নেড়ে তাথৈকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে নিজেদের রুমের দিকে পা বাড়ালো। আয়ান সেদিকে একবার তাকিয়ে মায়রার রুমের দরজাটায় নক করলো। কটেজের ভিতর থেকে মেয়েটার কান্নাভেজা ফোঁপানোটা আয়ানের কানের ভিতর দিয়ে যেন একেবারে মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। মায়রার কান্নাটা যেন একেবারে আয়ানের বুকের ভিতরটা একেবারে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। আয়ান নিজেকে সামলে নিয়ে আরো জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। এবারে রুমের ভেতর থেকে একটা কান্নাভেজা কণ্ঠ ভেসে এলো।
-আপুই ভাইয়া? তোমার প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও। প্লিজ?
আয়ান মায়রার কথার উত্তর না দিয়ে আবার দরজা নক করতে লাগলো জোরে জোরে। মায়রা অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে বসে থাকলেও এবারে বিরক্ত হয়ে উঠে এসে দরজাটা খুলে দিলো। দরজা খুলেই আয়ানকে দেখে মায়রা পুরো থতমত খেয়ে গেল। আয়ান মায়রার অবাক হওয়ার মুখটা দেখে একটু হাসার চেষ্টা করলো।
-তুমি? তুমি এখানে কি করছো?
-মায়রা? আম সরি--।
-প্লিজ এখন যাও--। আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আর সরি বলতে হবে না। তুমি তো ভুল কিছু বলো নি। যা মনে হয়েছে, যা তুমি দেখেছ তাই বলেছ--। তোমার সরি বলতে হবে না। বায়--।
-মায়রা?
-প্লিজ যাও এখন। আমি ঘুমাবো--।
মায়রা দরজা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করতেই আয়ান দরজা ঠেলে কটেজের ভিতরে ঢুকে পড়লো। আয়ানের এমন হুট করে রুমে ঢুকে পড়ায় মায়রা এক মিনিট স্তম্ভিত হয়ে কিছু বলতেই পারলো না। আর আয়ানের জন্য সেই সময়টুকুই যথেষ্ট ছিল। মায়রাকে আলতো করে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে মায়রার সামনে ফ্লোরে বসে হাতে হাত রাখলো আয়ান। মায়রা আয়ানের হাত থেকে হাত টেনে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।
-কি করছ কি তুমি? রুমে এলে কেন? আর কেউ দেখলে কি ভাববে? যাও প্লিজ আয়ান---।
-মায়রা প্লিজ আমার কথাগুলো শোনো। কথা শেষ হলেই চলে যাবো।
-আমি কিচ্ছু শুনতে চাচ্ছি না।
-মায়রা? রাগ করে থেকো না আমার উপরে--। আমি সরি পরী। আমি ভাবতেই পারি নি তুমি এতোটা কষ্টে আছো--। আর ওই লোকটা এতোটা---।
-তোমার সরি হতে হবে না আয়ান। বাদ দাও--। আমি কষ্টে ছিলামও না। কি বলো তো। একজনকে ভালোবেসে অন্য জনের সাথে কি করে মানিয়ে নিয়ে সংসার করতে হয় তা আমি শিখি নি। লোকটা যেমন একজনকে চেয়েছে তার স্ত্রী হিসেবে তেমন আমি কখনোই হয়ে উঠতে পারি নি। এটা আমারই ব্যর্থতা। তার চাওয়ায় যদি ভুল থাকে তবে আমার তার সাথে মানিয়ে নিয়ে সংসার করতে না পারাটাও ভুল ছিল। তার সাথে অন্য কারো ভালোবাসা কম্পেয়ার করতে যাওয়াটাও ভুল ছিল। সবাই তো আর একভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। আমারও সেটা বোঝা উচিত ছিল।
-মায়রু? আম সরি। আমার ওভাবে কথাগুলো বলা ঠিক হয়নি---।
-তুমি সরি বলছ কেন? এটা তো আমাদের সমাজের একটা অঘোষিত সত্য, তাই না? এই যে মেয়েরা টাকার জন্য বা ক্ষমতার জন্য নিজের ভালোবাসাকে ত্যাগ করে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে। কমন ব্যাপার না? কি আর ভুল বলেছ?
-মায়রা? আসলে তখন মাথা ঠিক ছিল না। কি বলতে কি বলে ফেলেছি--। শোনো না পরীটা?
-তুমি প্লিজ যাও এখন আয়ান। আমার ভালো লাগছে না।
-মায়রা?
-আর এমনিতেও একজনের করা অপমানগুলো হজম হচ্ছে না। কিছু না করেও বারবার চরিত্র নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। আর এখন তোমাকে এই রুমে কেউ দেখলেও সেই আমার চরিত্র নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। আর ভালো লাগছে না এসব।
-মায়রা?
-প্লিজ যাও---। আয়ান। হাত জোড় করছি তোমার কাছে---।
-চলে যাবো--। শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। ওই লোকটা তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছে বলে তুমি আপসেট?
আয়ানের প্রশ্নটা শুনে মায়রা বেশ কিছুক্ষণ আয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর নিজের হাতটা আয়ানের হাত থেকে টেনে নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে নিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। আয়ানের বলা প্রত্যেকটা শব্দ একেবারে তীরের মতো গিয়ে বিঁধছে ওর বুকে। আয়ানও ততক্ষণে কথাটা বলে ফেলে নিজেই আফসোস করলো মনে মনে। কথাটা এভাবে না বললেও হতো। মেয়েটাকে আবার কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ভেবে আয়ানের নিজের উপরেই রাগ হলো।
-মায়রা আসলে আমি এভাবে মিন করতে চাই নি--।
-প্লিজ যাও আয়ান---।
-শোনো না?
আয়ান মায়রার হাত ধরে টেনে নিজের দিকে ফেরানোর জন্য টানতেই মায়রার গলা দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বের হলো। মায়রা নিজেকে সামলে নিলেও ব্যথার কাতর কোঁকানোর শব্দটা আয়ানের কানে ততক্ষণে পৌঁছে গেছে। আয়ান তাড়াতাড়ি মায়রাকে ছেড়ে দিয়ে মায়রার সামনে এসে মুখটা তুলে ধরলো দুহাতে।
-মায়রু? কি হয়েছে? ব্যথা পেলে কি করে? আমাকে বলো প্লিজ?
-কিছু না। কারো সাথে মানিয়ে নিতে না পারার পুরস্কারের চিহ্ন এসব। আমার সহ্য হয়ে গেছে ঠিকই, শুধু শরীরটা হয়তো এসবে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে নি--।
-কি হয়েছে বলবে আমাকে প্লিজ?
-বললাম তো কিছু হয়নি। আর সব চোখের পানি কষ্টের হয় না আয়ান। কিছু কান্না মুক্তির আনন্দের হয়। কিছু কান্না অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কড়া নাড়ার ভয় থেকেও হয়। আর কিছু কান্না জীবনের প্রতি ঘৃণাবোধ থেকেও হয়--।
-খুব কথা বলতে শিখে গেছ না? আমাকেও এখন নিজের কষ্টের কথাগুলো শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে না?
-হুমায়ুন আহমেদ স্যারের একটা কথা আছে জানো? 'জীবনে কিছু কিছু প্রশ্ন থাকে যার উত্তর কখনও মিলেনা, কিছু কিছু ভুল থাকে যা শোধরানো যায়না, আর কিছু কিছু কষ্ট থাকে যা কাউকে বলা যায়না।' এটাও নাহয় তেমনই শেয়ার করতে না পারার মতো কিছু কষ্ট। তুমি কষ্ট পেও না। আমি ভালো আছি। ভালো থাকবো। আজ তো সীমান্ত সাইনটা নিয়ে গেল। কয়েক দিনের মধ্যেই ডিভোর্সটাও অফিশিয়ালি হয়ে যাবে। আর আমার জীবন থেকে হয়তো এই অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায়টারও সমাপ্তি ঘটবে---। তুমি এখন যাও আয়ান। আমার ঘুম পাচ্ছে।
-মায়রা?
-প্লিজ?
আয়ান কিছু না বলে পিছিয়ে গেল। একবারও না থেমে সোজা চলে গেল দরজার কাছে৷ মায়রাও আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ফ্লোরেই বসে হাঁটুতে মাথা রেখে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। জীবন ওকে এমন একটা মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে যেখান থেকে না সামনে পা বাড়ানোর রাস্তা আছে, না পিছনে ফিরে যাওয়ার। সীমান্ত যার কাছে মায়রা ফিরে যেতে চায় না, আর আয়ান, যার কাছে ফিরতে চাইলেও সমাজের হাজারটা প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে হবে আয়ানকেই। তাই মায়রা সেই আশাটাকেও নিজের বুকের মধ্যেই পিষে ফেলতে চেষ্টা করছে। হয়তো আজকের ঘটনাটা আয়ানের সামনে না ঘটলে এই মূহুর্তে এসব নিয়ে ভাবতে হতো না মায়রার।
এসব ভাবতে ভাবতে মায়রা টেরই পায়নি আয়ান আবার ফিরে এসেছে। কান্নার কারণে রুমের দরজাটা বন্ধ করার শব্দটা টের পায়নি মায়রা। হঠাৎ ঘাড়ের কাছে চুলগুলো কেউ সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেই মায়রা চমকে উঠে মুখ তুললো। মুখ তুলে আয়ানকে ওর পাশে ফ্লোরে বসা দেখে মায়রা চমকে উঠলো। আয়ানের চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে উঠছে দেখে আরো কিছুটা আঁতকে উঠলো মায়রা।
-আয়ান? কি করছো তুমি? তোমাকে না যেতে বললাম?
-চুপ করে বসে থাকো মায়রা। আমি জানি আমি কি করছি---।
-কি করছ কি তুমি?
-চুপ বললাম না? আমাকে দেখতে দাও---।
-আয়ান?
আয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়রা এবারে সত্যি বেশ ভয় পেয়ে গেল। আয়ান মায়রার মুখের দিকে না তাকিয়েই মায়রার ঘাড়ের কাছে চুল সরিয়ে কালশিটে পড়ার দাগগুলোয় হাত ছুঁইয়ে দিলো। শাড়ির আঁচলটা পিঠ থেকে একটু সরিয়ে দিতেই পিঠের আর কোমড়েরও কিছু কালচে দাগ আয়ানের চোখে পড়লো। আয়ান ততক্ষণে চোয়াল শক্ত করে উঠে দাঁড়িয়েছে। মায়রা স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলো ভয়ে। আয়ানের রাগী মুখটা দেখে প্রশ্ন করতেই যেন ভুলে গেছে বেচারি।
-সীমান্ত তোমাকো এভাবে মেরেছে? ওকে তো আমি খুন করে ফেলবো। ওর সাহস হয় কি করে----।
আয়ান রাগের চোটে কথাটা শেষ করতে পারলো না। একটু পায়চারি করে আবার ফিরে এসে মায়রার পাশে বসে গালে হাত ছুঁইয়ে দিতেই আয়ানের চোখ বেয়েও দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
-ওর এতো বড় সাহস আমার পরীটার গায়ে হাত তোলে! ওকে তো আমি সত্যিই মেরে ফেলবো--। খুন করে ফেলবো আমি---।
আয়ান কথাটা বলতে বলতে আবার উঠে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই মায়রা আয়ানের হাত টেনে ধরে থামালো। আয়ান নিজেকে সামলাতে না পেরে আবার বসে পড়ে মায়রাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। মায়রা বহুদিন পর আয়ানের বুকে মুখ ডুবিয়ে বাচ্চাদের মতোই কেঁদে চলেছে। আর আয়ানও নিজেকে সামলাতে পারছে না কোনমতেই। ওর মাথায় একটা কথাই ঘুরছে। এই অন্যায়ের শাস্তি তো সীমান্তকে আয়ান যে করেই হোক দিবে। দরকার হলে সীমন্তকে খুন করে জেলে যাবে। তবু ছাড়বে না আয়ান। কিছুতেই না।
৩২!!
বেশ কিছুটা সময় পার হওয়ার পর আয়ান নিজেকে সামলে নিয়ে মায়রার থুঁতনি ধরে মুখটা একটু তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো। মায়রা এতোক্ষণ আয়ানের বুকে মুখ ডুবিয়ে ফোঁপাচ্ছিলো। এবারে আয়ান মুখটা তুলে ধরতেই মায়রা আবার ফোঁপাতে ফোপাঁতে আয়ানের দিকে তাকালো। আয়ান আলতো করে মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।
-মায়রা? আর কেঁদো না লক্ষীটা। দেখি? ওঠো তো?
-হুম---।
মায়রা কোনমতে আয়ানের হাত ধরে উঠার চেষ্টা করলো। পা টা এতো ঝিমঝিম করে উঠলো যে দাঁড়াতে গিয়েই মায়রার মনে হলো পায়ের নিচে মাটির কোন অস্তিত্বই নেই। মায়রা পড়ে যাওয়ার আগেই আয়ান মায়রাকে ধরে ফেলে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো।
-কি হয়েছে মায়রু? পড়ে যাচ্ছিলে তো আরেকটু হলেই?
-পা ঝিমঝিম করছে খুব। উফ। মনে হচ্ছে পায়ে একটুও সেন্স নেই। পা ফিলই করতে পারছি না----।
-দেখি কি হয়েছে?
-আয়ান কি করছ কি তুমি?
-চুপ--। কথা না কোনো। চুপ করে বসে থাকো--। দেখবে দু মিনিটের ম্যাজিক করে ঠিক করে দিবো--।
-আয়ান?
-মায়রা?
মায়রা আয়ানের ধমক খেয়ে চুপ করে গেলে আয়ান মায়রার পায়ের কাছে বসে মায়রার পা মাসাজ করে দিতে লাগলো মায়রা কোনোমতে পা টেনে সরানোর চেষ্টা করেও সফল হলো না আয়ানের রাগী মুখটা দেখে। আয়ানের উষ্ণ হাতের স্পর্শে অল্প সময়ের মধ্যেই মায়রার পায়ের ঝিমঝিমটা সেরে গেল। মায়রা এবারে পা টেনে নিয়ে গুটিসুটি হয়ে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। আয়ান এভাবে পায়ের কাছে বসে আছে ব্যাপারটায় কেমন একটু ইতস্তত বোধ করছে মায়রা। কিন্তু এই লোকটাকে বলে যে কোন লাভ নেই সেটাও মায়রা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। বহুদিনের দমিয়ে রাখা অধিকারটা আজ কেমন হুট করেই যেন আয়ান পেয়ে গেছে। সেই অধিকার ফলানো থেকে মায়রা তাকে বাধা দিতে পারছে না। বাধা দিতে পারছে না? নাকি মন থেকে বাধা দিতে চাইছে না? কোনটা? মায়রা ভাবার চেষ্টা করলো।
মায়রা নিজের মনকে করা প্রশ্নটার উত্তর পাওয়ার আগেই আয়ান মায়রার গালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে নিজের দিকে ফেরালো।
-মায়ু? দুটো মিনিট অপেক্ষা করো। কেমন? আমি এক্ষুণি আসছি--।
-আচ্ছা---।
আয়ান বেরিয়ে গিয়ে ঠিক দু মিনিটের মাথায় হাতে একটা প্লেটে করে খাবার নিয়ে ফিরে এলো। এতো ঝামেলার মাঝে সেই বিকেল থেকেই যে মায়রা না খেয়ে আছে কথাটা মায়রার একদমই মনে ছিল না। এখন প্লেটে খাবার দেখে খিদেটাও যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। মায়রা এসব ভাবতে ভাবতে আয়ান ভাত মাখিয়ে মায়রার মুখের সামনে ধরলো। মায়রা অবাক চোখে আয়ানের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো।
-কি হলো? খাও? সেই কখন কি খেয়েছ কে জানে। অনেক রাত হলো তো বাবা? ঘুমাতে হবে না?
-তোমার খাবার কই? নিজের জন্য আনো নি কেন?
-এতো প্রশ্ন করো কেন বলো তো?
-না বললে খাবো না আমি---।
-মায়রা? জেদ করো কেন সবসময়? হা করো বলছি না?
-না---।
-মায়রা?
-না না না--। তুমি নিজের খাবার নিয়ে আসো--। তারপর একসাথে খাবো---।
-আসলে মায়রা--। এক প্লেটই খাবার বাকি ছিল--। তুমি খেয়ে নাও। আমি নাস্তা করে নিবো নি। হা করো?
-উহু--। হবে না--। একসাথে যখন খাবো বলেছি তখন একসাথেই খাবো--। দাঁড়াও---।
মায়রা চট করে উঠে গিয়ে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসে খাবারের প্লেটের ভাতগুলোকে দুটো অসমান ভাগে ভাগ করে বর্ডার লাইন টানলো। আয়ান হেসে ফেললো পাগলিটার পাগলামি দেখে। মায়রা আঙুল দিয়ে বড় পোর্শনটা দেখিয়ে দিল আয়ানকে।
-এই ভাগটা তোমার--। খাওয়া শুরু করো এখন---।
-বড় ভাগটা আমার কেন?
-আপনি তো আমার সিনিয়র তাই। হি হি--।
-ওরে দুষ্টুটা--। তা ম্যাডাম আমার সাথে এক প্লেটে একসাথে খেতে কি সমস্যা আছে?
-একদম না--।
-তাহলে আর খাবারের মাঝখানে বর্ডারের কি দরকার? হা করো? আমিও খাই, তুমিও খাও--।
-হুম---।
আয়ান প্লেটের ভাতটুকু আবার একসাথে করে মাখিয়ে নিলো ধীর হাতে৷ তারপর ছোট ছোট করে মায়রার মুখে খাবার তুলে দেয়া শুরু করলো।
-তোমার আর আমার মাঝে কোন রকমের কোন দেয়াল আর তৈরি হতেই দিবো না মায়রা৷ সেটা এখন এই খাবারের প্লেটে হোক, বা ভবিষ্যতে আমাদের দুজনের জীবনে হোক--। কখনো দিবো না।
-তুমি---। তুমি খাচ্ছো না কেন? খাও? হা করো? বলো আআআআ?
-আমাকে খাওয়াতে গিয়ে দেখি নিজেই খাওয়ার জন্য হা করে বসে আছো?
-আয়ান?
-হা হা---। আচ্ছা হা করছি৷ খাইয়ে দিবা?
-হুম--। হা করো? বড় করে---।
আয়ান হা করতেই মায়রা বড় করে একটা লোকমা আয়ানের মুখে পুরে দিলো। আর কাজটা করেই মায়রা হাসতে শুরু করেছে৷ আয়ান মুখের ভাতগুলো কোনরকমে গিলে মায়রার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
-এটা কি হলো?
-তুমি নিজে না খেয়ে চিটিং করে আমাকে বারবার খাওয়াচ্ছিলা৷ আমি তাই একেবারে অনেকগুলা খাওয়াই দিসি তোমাকে--। হি হি-।
মায়রার হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে আয়ান নিজেও হেসে ফেললো। তারপর আবার মায়রাকে খাইয়ে দিলো।
-আচ্ছা ম্যাডাম। নো মোর চিটিং।
-গুড। মনে থাকে যেন--।
-হুম--।
খাওয়া শেষ হলে আয়ান মায়রাকে পানি খাইয়ে মুখ হাত মুছিয়ে দিয়ে নিজেও পানি খেয়ে প্লেটটা পাশে রাখলো। তারপর মায়রাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথার কাছে বসে চুলে আলতো করে হাতিয়ে দিতে লাগলো। মায়রা কিছু একটা ভাবছে বুঝতে পেরে আলতো করে ঝুঁকে মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আয়ান। মায়রা একটু ইতস্তত করলো।
-তুমিও যাও। ঘুমাও। অনেক রাত তো হলো?
-হুম। যাবো--। এখন আর কান্নাকাটি করবা না একদম। মনে থাকবে?
-হুম---।
-লক্ষী মেয়ে হয়ে ঘুমিয়ে যাও। ওকে ম্যাডাম?
-আচ্ছা।
-আর শোনো? আম সরি--। কি বলতে কি বলে ফেলেছি নিজেও জানি না--। সরি ওয়ান্স এগেইন।
-বাদ দাও আয়ান--। যা হয়ে গেছে তা তো বদলাতে পারবে না--।
-কিন্তু যা সামনে আছে চাইলেই আমরা সেটাকে সুন্দর করতে পারি মায়রা। কি পারি না?
-------------------------------
-তোমার মন থেকে ওই লোকটার কালো ছায়াটুকুকেও মুছে দিতে আমি তোমার পাশে থাকতে চাই মায়রা৷ সুযোগটা কি দিবে না?
-আয়ান? এখন কি এসব আলোচনা করার সময়?
-হুম--। আলোচনা করলে যখন শুরু করবে তখনই সময়--৷ আর না চাইলে---।
-ঘুমাতে যাও আয়ান--। কেউ দেখলে সত্যি খারাপ ভাববে---। আমি যে কোন মূল্যে ওই লোকটা থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছি--। চাই না মাঝ পথে কোন বাধা আসুক--।
-বাধা আসবে কি আসবে না জানি না মায়রা--৷ তবে ওই সীমান্তকে তো আমি ছাড়বো না৷ তোমাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তি তো আমি ওকে দেবোই৷ তুমি ওকে ক্ষমা করে দিলেও আমি ওকে ক্ষমা করবো না মায়রা। ওই লোকের ক্যারিয়ার, জীবন ধ্বংস করে দিবো আমি। নয়তো মরেও শান্তি পাবো না আমি---।
-আয়ান প্লিজ?
-এতো সহজেই কি করে মাফ করে দিচ্ছ ওই অমানুষটাকে?
-মাফ করার আমি কে আয়ান? লোকটা আমার জীবনে এসে অনেক কিছু চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়ে গেছে আমাকে। এই একবিংশ শতাব্দীতেও একটা মেয়ে কতোটা অসহায়, কতোটা অত্যাচারিত, নির্যাতিত সেটা সীমান্তকে না দেখলে আমি জানতেই পারতাম না৷ ওই লোকটার কারণেই নিজের একটা গোল সেট করতে পেরেছি।
-কিসের গোল?
- আমার মতোই নিশ্চয়ই হাজারটা মেয়ে আছে যাদের পরিবার থেকেও নেই, যারা সমাজের হাজারটা লৌকিক নিয়মের বেড়াজালে আটকা পড়ে প্রতিনিয়ত মরছে ধুঁকে ধুঁকে, সেই মেয়েগুলোকে একটা নতুন জীবন দেয়ার চেষ্টা করবো৷ যাতে ওদের জীবন থেকে সীমান্তদের মতো মানুষদের কালো ছায়াটা দূর করতে পারি সেটা নিয়েই কাজ করবো--।
-আম এলওয়েজ উইথ ইউ ম্যাডাম। কিন্তু তোমার মনে হয় না তোমার স্বপ্নটা সীমান্তকে শাস্তি দেয়া দিয়ে শুরু করা উচিত? লোকটা এতোদিন যা তোমার সাথে করেছে, দুদিন পর সেটা অন্য একটা মেয়ের সাথেও তো করবে---। ভুলগুলো তো শোধরাবে না সে কখনোই---।
-ভুল হলে সেটাকে শুধরে দেয়া যায় আয়ান। কিন্তু লোকটা আমার সাথে যা করেছে তা হলো অন্যায়। অন্যায়ের শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু কি বলো তো? তাকে শাস্তি দিতে হলে আরো কিছু মানুষ জড়িয়ে যাবে। আরো অনেকগুলো ঘটনা না চাইতেও মিলিয়ে মিশিয়ে মুখরোচক করে লোকের সামনে তুলে ধরা হবে। সেটা এই মূহুর্তে সহ্য করার মতো মনের জোর বা ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই--।
-আম--। মায়রা--। এখন এসব আর ভেবো না। যা হয় ভালোর জন্যই নাকি হয়৷ এর মধ্যেও হয়তো ভালো কিছু অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। এসব বাদ দিয়ে আপাতত ঘুমানোর চেষ্টা করো--। আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি মাথায়---।
-লাগবে না আয়ান। আমি ঠিক আছি। তুমিও গিয়ে ঘুমাও--।
-হুম---। আই লাভ ইউ পরীটা।
আয়ান মায়রার কপালে একটা ভালেবাসার স্পর্শ এঁকে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মায়রাও উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে ভাবতে বসলো। জীবন ওকে নিয়ে নতুন কি খেলা খেলতে চাইছে কে জানে।