পুরো বাসা আজ মাথায় তুলে রেখেছে বাতাসি। কিছুক্ষন আগে মাহাদ তাকে কল দিয়ে বলছে তার পুরনো বান্ধবী জয়গুন আসছে বাসায়। প্রায় ৫৮ বছর পর তাদের দেখা হতে চলছে। পুরনো সখী আসবে বলে কথা। এটা বানাও ওটা বানাও সেটা বানাও। শুধু বানাও বানাও আর বানাও বলে লাবীবা এবং রুপালীর কান ঝালাপালা করে ছাড়ছে বাতাসী। মৌ কেও কাজে লাগিয়েছে। সাথে সাবিনা সহ কাজের লোকজনতো আছেই। কিন্তু নিসার ধারে কাছে যায়নি। এমনকি তিতিরকেও ডাকেনি।
ছেলের বউ আর মেয়ের কাজ তার পছন্দ হচ্ছেনা তাই লাজ-লজ্জ্বা ফেলে তিতিরের রুমে গিয়ে উকি দিল বাতাসি। তিতির অতিথীকে খাবার খাওয়াচ্ছে আর পাশে গোলাব চোখ বন্ধ করে গুটিশুটি মেরে বসে আছে।
অনেকক্ষন হল বাতাসি দাড়িয়ে আছে। তিতির ওকে দেখতে পায়নি। শেষে যখন তিতিরের কোন রেসপন্স পেলোনা তখন বাতাসি গলা খাকারি দিয়ে বলল-
~" ঘরের মধ্যে যে কখন থাইকা একটা মাইয়া মানুষ দাড়াইয়া আছে হেইডা কি কারো চোক্কে পড়েনা!"
বাতাসির কথা শুনে তিতির চমকে উঠলো। পিছন ফিরে দাদীকে দেখেই মেয়েকে নিয়ে দাড়িয়ে পড়লো। দুঃখিত দাদী, আমি আপনাকে দেখতে পাইনি। আসুন বলেই তিতির এগিয়ে গেল বাতাসির দিকে।
বাতাসি অভিমানী গলায় বলল-
~" থাউক, থাউক অ্যারে আর দরদ দেখনের কাম নাই। বুইড়া হলে মানুষতো সগ্গলের ভারী হইয়া যায়। আইও হইচি। অ্যার খবর কেডাই নিব?"
তিতির কিছু একটা ভাবলো তারপর বাতাসীর হাত ধরে সেখানে একটা চুমা খেয়ে বলল-
~" দাদী, আমি শুনেছিলাম আপনার খুব প্রিয় একটা বান্ধবী ছিল, যে ছোট কালে মারা গিয়েছিল। সে নাকি আপনার কাছে কাছে ছায়ার মত থাকতো এবং আপনার সমস্ত সমস্যা সমাধান করে দিত। আপনি না হয় ভাবেন আমিই সেই মানুষ। এখন ফটাফট হুকুম করেনতো! দেখেন এক নিমিষেই সব কাজ শেষ করে দিব।"
বাতাসি ঝট করে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল-
~" ঢং দেকলে বাঁচিনা। অ্যার সামনে একদম নাটক করবিনা।"
বাতাসির কথা শুনে তিতির খুব কষ্ট পেল। কিন্তু সেটা বাতাসিকে বুঝতে না দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-
~" আপনার সেই বান্ধবীর নাম "শাপলা" ছিলোনা?"
বাতাসির কি হলো বুঝা গেলোনা। কিন্তু ঝট করে তিতিরের হাতটা চেঁপে ধরে ছলছল চোখে বলে উঠলো-
~" শাপলার কতা কসনা বইন। আল্লাহ্ তোরে বাঁইচা রাখুক। সোয়ামী সন্তান লইয়া দুধে-ভাতে দিন কাটা।"
বাতাসির মুখে এমন উত্তম দোয়া শুনে তিতির আর কথা বলতে পারলোনা। বাতাসির সামনেই ফিকরে কেঁদে উঠলো। মেয়েকে এক হাতে নিয়েই বাতাসিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল-
~" আমি সবসময় আল্লাহর কাছে অভিযোগ করতাম, যে দাদি আমার মাহাদকে এত ভালোবাসে সে কিভাবে আমাকে ভালো না বেসে থাকতে পারে! আল্লাহ্ তো আজ আমার অভিযোগের জবাব দিয়েই দিল দাদী।"
বাতাসি বিবি এতো ভালোবাসা পেতে হয়ত অভ্যস্ত নয় তাই তিতিরের কাছ থেকে সরে এসে বলল-
~" কিছু খাওন বানাইয়া দিতে পারবি? জয়গুন আইবো তো তাই! ওরা ঠিকমত বানাইতে পারেনাই। আই বলমো আর তুই বানাবি।"
তিতির চোখ মুছে হাসি মুখে বলল-
~" এটা কোন কথা হল দাদী! আমায় হাজারটা কাজ করতে বলেন, আমি তিতির সবসময় সর্বদা আপনার হুকুমের অপেক্ষায় থাকবো। চলেন.......।"
অতিথীকে গোলাবের কাছে রেখে তিতির বাতাসিকে নিয়ে চলে গেল। বাসার সবাই আজকে চোখ বড় বড় করে তিতির আর বাতাসিকে দেখছে। এটা কিভাবে সম্ভব। এ যেন বাঘ-বকরি এক ঘাটে জল খাওয়ার মত অবস্থা। সাবিনা তো সবার সামনে বলেই ফেলল-
~" দাদী, আই মনে হয় কানা হইয়া গেছি। অ্যার চশমার দরকার মনে হইতাছে। আইকি এটা সত্যি দেখতাছি! সাপে নেউলের বিবাদ মিইটা গেছে?
সূর্য কোন দিকে উঠলো অ্যাঁ????"
সূর্য পুবেই উঠছে। এহানে কাম না থাকলে সর এহান থাইকা বলে সাবিনাকে ধমক দিল বাতাসি। তারপর তিতিরকে যা যা বলল তিতির সেই ভাবেই তা করতে লাগলো। সব কিছু গুছিয়ে নিতেই বাসার দরজার কলিংবেল বেজে উঠলো। বাতাসি বিবি তাড়াহুড়া করে আধা দৌড় দিয়ে আসতে আসতে বলতে লাগলো-
~" ঐ খাড়া তোরা! আই দরজা খুলুম।"
কথাগুলো বলে বাতাসি দরজা খুলে যাকে দেখলো, তাতেই সে আক্কেল গুডুম হয়ে গেল। চোখের সামনে বুদুন দাড়িয়ে আছে। বুদুনকে দেখে মনে পুরনো আগুন যেন জ্বলে উঠলো। বাতাসি বিবি চোখ ঘোড় করে বললো-
~" তুই.....! তুই অ্যার বাড়ীত আইছোস ক্যান?"
বুদুন তার ফোকলা দাঁতের হাসির চমক দেখিয়ে দিয়ে বলল-
~" বউদের সাথে বাজি ধরছিলাম বুবু! তোমার বাড়িত আইয়া তোমার হাতেই শীতের পিঠা-পুলি খামু। বউরা বলে কি! তোমার মত ছোচনা, বজ্জাত, আমুড়া বোন নাকি কিছুই খাওয়াবোনা। অ্যার বুবুরে তারা বলে নাকি ছোচনা! এই বাজিতে তো অ্যার জিততেই হইব।
তাই জয়গুন বুবুর নাম লইয়া মাহাদরে কল দিলুম। ব্যস হয়ে গেল সব। বুদ্ধিটা ক্যামন বুবু?"
বুদুনের কথা শুনে বাতাসি থম ধরে দাড়িয়ে পড়লো। বাসার এত মানুষের সামনে কিছু বলতেও পারছেনা ভাইকে। এতে যে নিজেরই নাক কাটা যাবে। তাই কিছু না বলে তিতিরকে ডেকে বানানো সব খাবারগুলো টেবিলে দিতে বলল।
এতএত খাবার দেখে বুদুনের চোখ তো আকাশ ছুতে গেল। খুশি মনে যতটা পারলো সব গুলো চেটেপুটে পেটে তুলল। তারপর সুখের ঢেকুর তুলে এদিক ওদিক চাইতেই দেখলো বাসার সবাই তার চারদিকে দাড়িয়ে আছে। বুদুনের নিজেকে এখন রাজা রাজা লাগছে। বুবু যে সব কিছু এত জলদি মেনে নিবে সেইটাই আজব।
বাতাসি বিবি উঠে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়েই বলল-
~" পেট ভরছে ভাই! চল ঘরে গিয়ে গপ্পোগুজব করি। কত দিন তোর সাথে সুখ দুঃখের গপ্পো করা হয়নি। চল ভাই ঘরে চল......।
শাশুড়ীর এমন কথা শুনে লাবীবা সহ রুপালীর মুখ শুখে গেল। আজ মামার আর নিস্তার নেই। আল্লাহ্ মালুম আজ কি ঘটতে চলছে।
আম্মা, মামাকে রুমে নিয়ে যাওয়ার কি আছে! এখানেই আমরা সবাই মিলে গল্প করি! কথাটা সবার সামনে বলেই ফেলল লাবীবা।
মৌ তো মুখে হাত দিয়ে বুদুনকে নিজের মাথা নাড়িয়ে বার বার ইশারা করছে, দাদা আপনি বাঁচতে চাইলে জলদি বাসা থেকে বিদায় হোন।
মৌয়ের ইশারা করা দেখে বাতাসি ওর দিকে তাকাইয়া চোখ গরম করে বলল-
~" মৌ তোরে কি অ্যার তেলেসমাতি দেখন লাগবো? যদি দেখবার চাস তো এহোনি কো, শুরু কইরা দিই! আর যদি না দেখবার চাস তাইলে চুই কইরা থাক।"
মৌ আর কথা বলে! মুখে কুলুপ এটে স্ট্যাচুর মত দাড়িয়ে রইলো। তিতির তেমন কিছু বুঝতে পারলোনা। তাই টেবিলের সমস্ত খাবারগুলো কিচেনে নিয়ে গেল। কিন্তু বাসার অন্য সদস্যরা বাতাসিকে হারে হারে চিনে। বাতাসি কি করতে পারে। তাই যে যতটা পারলো বুদুনকে ইশারা করে নিষেধ করতে লাগলো তার সাথে না যাওয়ার জন্য। সাবিনা তো দাঁত কেলাইয়া বলল-
~" দাদা মনে হয় বহুকাল উত্তম মধ্যম খায়নি। তাই খাওনের লায় ছডপট করছে। পিঠে ছালা বান্দে দিব দাদা?"
~" ধ্যুর ছুড়ি কি কস! বুবু তুমি রাজি থাকলে সাবিনারে অ্যার সাথে লইয়া যাইতাম। আমার বউদের লহে তার বেশ জমবে। এ একাই একশ। কিরে সাবিনা অ্যার সাথে যাইবি?"
আগে নিজের পিঠ সামাল দেন। তারপর অ্যার কথা চিন্তা কইরেন বলে সাবিনা মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।
কারো ইশারার তোয়াক্কা না করে বুদুন বাতাসির দিকে চাইলো। অ্যারে কি কও তোমরা! বুবু অ্যার সাথে গপ্পো করবো বলেই বুদুন বাতাসিকে নিয়ে রুমে চলে গেল। যাক্ বাব্বা শিকার নিজেই শিকারীর কাছে নিজেকে তুলে দিল।
বুদুন খাটে বসে আছে। বাতাসি তার ঘরের কোনা থেকে গোলাবের জন্য বানানো লাঠিটা বের করে সুর সুর করে বুদুনের কাছে এসেই পিঠ বরাবর একটা বারি বসিয়ে দিয়েই বলল-
~" হারামজাদা, তোর বউরা অ্যারে ছোচনা কইছে সেই বিচার তুই না কইরা অ্যার বাড়িত পিঠা গিলতে আইছোস! খাড়া আজ তোর পেট থাইকা সব পিঠা বাড় করুম।"
অচমকায় বারি খাইয়া বুদুন কোকড় হইয়া লাফ দিয়ে খাটের উপর দাড়াইয়া বলল-
~" বুবু অ্যারে মারছো ক্যান! অাইতো আন্নের মান-মর্যাদা ঠিক রাখছি।"
হারামজাদা তোর মান-মর্যাদার খ্যাতা পড়ি আই বলেই আবার লাঠি তুলতেই বুদুন এসে বাতাসির লাঠি ধরে ফেলে চিল্লাই বলল-
~" বুবু ভালো অইতেছেনা কিন্তু! অ্যারে সায়শুই দিয়ে ঘরে ডাইকা আইনা মারতাছ? তোমার নামে মামলা করুম। পুরুষ নির্যাতনের মামলা দিমু।"
ছাড় অ্যার লাডি ছাড়......! অহো এইভাবে তো হইবোনা। তোরে অন্য তেলেসমাতি দেখানো লাগবো।
দারা বলেই বাতাসি চিক্কুর দিয়ে গোলাবরে ডাকতে লাগলো। গোলাবও চোখের নিমিষেই এসে হাজির হল বাতাসির ঘরে। রুপালি রুমে ঢুকতেই বাতাসি চিল্লাইয়া আসতে নিষেধ করলো ওদের। এবার বাতাসি বুদুরনে ছেড়ে দিয়েই গোলাবরে কইলো,
~" গোলাব ধর ওরে..... ধর! ওর ইজ্জত মাটিতে মিশাইয়া দে। দুনিয়াতে ওর ইজ্জত থাকার কোন অধিকারই নেই।"
হাত দিয়ে গোলাবকে ইশারা করতেই গোলাব ঝাপিয়ে পড়ে বুদুনের গায়ে। লাবিবা দৌড় দিয়ে তিতিরের কাছে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল-
~" তিতির গোলাবরে থামাও। মামাকে আজ ও মেরেই ফেলবে।"
সব কিছু শুনে তিতির ওখান থেকে দ্রুত বের হয়েই বাতাসির রুমে গিয়ে দেখলো, গোলাব বুদুনের রান কামড়ে ধরে আছে আর বুদুন চিৎকার দিয়ে লাফালাফি করছে। এই কুত্তারে কেউ সরাস না ক্যান। অ্যারে মাইরা ফেলল..........
তিতির চিৎকার দিয়ে গোলাবকে ডাকতেই গোলাব থেমে গেল। কিন্তু ততক্ষনে গোলাবের মুখে বুদুনের পাজামা শোভা পেতে লাগলো। তিতির সাথে সাথে চোখ ঢেকে দ্রুত রুম থেকে বের হতেই গোলাব পাজামা রেখে তিতিরের পিছে পিছে দৌড় দিল। বুদুন পাঞ্জেবী দিয়ে নিজেকে ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বলল-
~" বুবু তুমি অ্যারে এইহারে মান-অপমান করলা! তুমি মানুষ না, তুমি ঘঁষেটি বেগম। বউদের সামনে অ্যার ইজ্জত আর রাখলানা।"
তোর মত নিমোখারামের এইডাই হওন দরকার। তোরে যেন এই মুল্লুকে না দেহি বলেই বাতাসি বিবি রুম থেকে বের হয়ে গেল। বুদুন জলদি পাজামা পড়ে রুম থেকে বের হতেই রুপালী তার গায়ে হাত দিয়ে বলল-
~" বলেছিলাম রুমে যাইয়েননা মামা, কিন্তু কথা শুনলেননা তো! এখন বোঝেন কেন নিষেধ করেছিলাম আমরা। যা হবার হয়েছে, চলেন আপনাকে হসপিটালে নিয়ে যাই।"
ছাড় অ্যারে ছাড়। সাপের বাচ্চা সাপ। তগো অনেক আপ্যায়ন দেকচি। অ্যার ইজ্জত লইয়া টানা হিচড়া কইরা দরদ দেহাস? লাগবোনা.... আর আইমু না তগো বাড়ি। এই পশ্চিম দিকে ঘাটা ধরনু। আর তোর মা! হেরে সাবধানে থাকতে কইস। মাহাদের কাছে বিচার দিমু, দিমুই। কথাগুলো বলে বুদুন হসপিটালে চলে গেল।
এদিকে বাতাসি বিবি এই জিবনের প্রথম গোলাবের গায়ে হাত বুলিয়ে বলল-
~" তোর উপর আজ আই অন্নেক খুঁশি। আয় তোরে লাড্ডু খাওয়ামো।"
এবার বাতাসি সবাইবকে হুংকার দিয়ে বলল-
~" আজকের ঘটনা খান যদি মোর সোয়ামীর কানে কেউ তুলছে! তয় তার একদিন কি অ্যার একদিন। বুদুনের থেকেও তার হাল খারাপ হইবো।
আজ যেন শুধু বাতাসিরই দিন ছিল। সেদিন আর বাতাসির উপর কেউ কোন কথা বলতে পারলোনা।
♥
পরেরদিন বিকালে সবাই রেডী হয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্য রওনা দিল। পরপর তিনটা প্রাইভেট কার বাসা থেকে বের হয়ে গেল। কামরান সাহেব আর মাহাদ কিছু কাজে আটকে গেছে। তারা তাদের কাজ শেষ করে রওনা দিবে। একটা লম্বা সময় নিয়ে তারা সবাই রূপসার বাসায় এসে পৌছে গেল। সবাই গাড়ী থেকে নেমে দেখলো, এ যেন এলাহী কান্ড। বাসার চারদিকে সহ পুরো বাসা লাইটিং করা। দেখেই মনে হচ্ছে একটা জমকালো অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রূপসার বরের পরিবার থেকে তাদের জন্য আপ্যায়নের কোন ক্রুটি করা হলোনা। মন্ত্রী পরিবারের লোকজন বলে কথা। সবাই ক্লান্ত তাই যে যার রুমে অবস্থান নিল।
তিতির এসে ছেলেকে নিয়েই নামাযে দাড়িয়ে পড়েছে কাযা নামাযগুলো আদায় করতে। ছোট্ট অতিথী কেঁদেই চলছে তিতিরের পাশে সুয়ে থেকে। লাবীবা বেগম এসে বার বার দেখে যাচ্ছেন কিন্তু অতিথীকে কোলে নেওয়ার সাহস পাচ্ছেননা। তিতির যখন সালাম ফিরালো তখন লাবীবা বেগম দ্রুত অতিথীকে নিয়ে কান্না থামানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগলো। তিতির জায়নামায গুটিয়ে শাশুড়ীর কাছে এসে বলল-
~" মা ওকে আমায় দিন। ওর খুদা লেগেছে। বরং আপনি সাদকে নিয়ে যান। ওকে একটু খাবার দিন। ছেলেটা একটা লম্বা সময় ধরে কিছু খায়নি।"
লাবীবা বেগম কথা না বাড়িয়ে নাতনীকে তিতিরের কোলে দিয়ে সাদকে নিয়ে গেল। আর তিতির অতিথীকে ফিডিং করাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। মাহাদ এখনো আসেনি। ও এখন কি করছে কে জানে?
.
পরেরদিন দুপুরের দিকে মাহাদ আর ওর বাবা হেলিকাপ্টার যোগে কক্সবাজারে পৌছালো। কাজের চাপে তারা আসতে পারেনি। বাসায় পৌছার সাথে সাথে সাদ কোথায় থেকে যেন দৌড়ে এসে মাহাদকে জড়িয়ে ধরেই সালাম দিল। সাথে গোলাবও এসেছে পিছুপিছু। সালামের জবাব দিয়ে সাদকে কোলে নিতেই গোলাব দু,পা মাহাদের গায়ে তুলে দাড়িয়ে আদুরে গলায় ডাকতে লাগলো। মাহাদ গোলাবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েই তিতিরের কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
দুরে রূপসা দাড়িয়ে মাহাদকে মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলো। এই মহাপুরুষটার জন্য এত এত আয়োজন। শুধু মাত্র তাকে একমুহুত্ত্ব দেখার জন্য রূপসা যেকোন কাজ করতে প্রস্তুত। কতদিন পর তাকে দেখছে। এদিকে অনুষ্ঠান পুরো জমে গেছে।
মাহাদ রুমে এসেই তিতিরকে লম্বা একটা সালাম দিল। ইশ্ আজও তিতির মাহাদকে আগে সালাম দিতে পারলোনা। তবে মাহাদকে দেখে তিতিরের ভিতরের সব দুঃশ্চিন্তা যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। বুকের ভিতর প্রশান্তির বাতাস বইছে। মাহাদ সাদকে নেমে দিয়েই আগে গোসল করতে গেল। গোসল সেরে এসে অতিথী কে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো। পুরো রাত অর্ধনিদ্রায় কাটানোর জন্য এখন যেন দু'চোখ ক্লান্তিতে বন্ধ হয়ে আসছে। তাই মেয়েকে বুকে জড়িয়েই সুয়ে পড়ল।
এমন সময় লাবীবা রুমে এসে তিতিরকে ডেকে নিয়ে গেল। সবাই মাহাদের বউ দেখতে চায়। মাহাদ ঘুমিয়ে আছে, ওকে এই অবস্থায় ছেড়ে যেতে মন চাচ্ছেনা। তবুও যাওয়ার আগে দরজা লক করে চলে গেল তিতির। সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। রূপসা তিতিরকে ব্যস্ত রেখেছে সবার সাথে গল্প করাতে। রূপসার ভাব-সাব তিতিরের খুব একটা ভালো লাগছেনা। মাহাদ ঘুমিয়ে আছে সেই সুযোগটাই না রূপসা নেয়। এত মানুষের মাঝে কিছু বলাও দায়। তবে রূপসা কি আবার তার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। আল্লাহ্ রক্ষা করো। আল্লাহ্ আমার এমন কোন পরীক্ষা নিওনা, যেখানে আমি বেঁচে থেকেও সারাজিবন বার বার মৃত্যুর স্বাধ আলিঙ্গন করি।
তিতিরের ধারনা মিথ্যা ছিলোনা। রূপসা সত্যিই তার খেলায় মেতে উঠছে। রূপসা এসে দরজা খুলতে যখন যাবে তখন দেখলো, ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করা আছে। রূপসা একটা তাচ্ছিল্যর হাসি দিয়ে মনের ভিতর কথার ঢেউ তুলে বলল-
~ " বোকা মেয়ে কোথাকার। আমার বাসা, আর আমার উপরই পোদ্দারি? এভাবে বুঝি স্বামীকে সুরাক্ষায় রাখা যায়? আমার কাছ থেকে নিজের স্বামীকে বাঁচিয়ে দেখা। আজ আমি সব রেডী করেই মাঠে নেমেছি। জয়তো আমারই হাতের মুঠোয়।"
রূপসা চাবি এনে পুশ করে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো। ক্যামেরা সেট করল মাহাদের দিক করে। কাজটা যদি ঠিকমত সফল হয় তাহলে কেল্লাফতে। মাহাদকে হাতের মুঠোয় পাবে সে। যে ভাবে মাহাদকে নাচাবে সেই ভাবেই মাহাদ নাচবে। শুধু একটা চান্স পেলেই হয়।
রূপসা একটা রুমালে ক্লোরোফোম স্প্রে করে মাহাদের পাশে দাড়ালো। কি সুন্দর লাগছে মাহাদকে। মাহাদের পাশে অতিথীও ঘুমিয়ে আছে। দু'জনকেই দারুন লাগছে। আজ যদি মাহাদের সাথে আমার বিয়ে হত তাহলে তোমার মত আমারও একটা বেবী থাকতো বলে অতিথীর গাল ছুয়ে দিল রূপসা।
ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন, সে মাহাদের সাথে ঘর করবে। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই কিছুসময় মাহাদকে একান্ত পেতে চায় রূপসা। রূপসা মাহাদের দিকে ঝুঁকে গিয়ে ওর শরীরের ঘ্রান নিল প্রানভরে। হ্যাঁ মাহাদ, আমি এখনো তোকে চাই। সেটা বৈধ হোক কিংবা অবৈধ। তবুও তোকে আমার চাই। তুইতো তিতির বলতেই পাগল। আমি কিন্তু তোর জিবনে আগে এসেছি। তবুও তুই আমাকে ছেড়ে তিতিরকেই বেছে নিয়েছিস। কত মানুষ কাজিনদের বিয়ে করে আর তুই! আমার সাথে তুই খুব খারাপ ব্যবহার করেছিস মাহাদ। তাই তোকে আজ এমন ফাঁদে ফেলাবো যে তোর মত বাঘও আমার কাছে বিড়াল ছানা হয়ে যাবে।
কিন্তু রূপসা দরজাটা পুরো আটকাতে ভুলে যায়। সব পাপ কাজের একটা ফাঁক থাকে, যেই ফাঁক দিয়ে পূন্য কাজগুলো ঢুকে পাপকে বিনাস করে। সেটা রূপসার বেলায়ও প্রযোজ্য হল। রূপসা মাহাদকে নিয়ে এতোই বিভোর ছিলো যে, রুমে কে ঢুকলো তার কোন খেয়াল রইলোনা। বাতাসি বিবি এসে রূপসার চুলের মুঠি ধরেই একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল। তারপর কোমড়ে শাড়ীর আচল বেঁধে চোখ মুখ শক্ত করে রূপসার দিকে তেড়ে এসেই চিৎকার দিয়ে বলল-
~" তোরে বলিনি, মাহাদ থেকে দুরে দুরে থাকবি! এক কথা তোকে কতবার কইতে হয়! খাড়া তোরে তো আজ পলিথিনের ভ্যানিটিব্যাগ পড়ামু।"
রূপসা তার কাজে আজও ব্যার্থ হল, কিন্তু ও থেমে থাকলোনা। ঝট করে ফ্লোর থেকে উঠেই নানীর মুখ আর গলা চেঁপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল-
~" তোমার জন্য আমার সব পরিকল্পনা ভেঁস্তে যাবে সেটা আমি হতে দিবোনা। তুমি বারবার আমার পরিকল্পনা জলে ডুবে দাও। আজ তোমায় আর ছাড়ছিনা। প্রয়োজনে তোমার লাশের উপর দাড়িয়ে আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবো। তাছাড়া তোমার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার একটা মুক্ষম সুযোগও পেয়েছি। আগে নিজেকে বাঁচিয়ে দেখাও।"
হিংসা আর রাগে যেন রূপসা ওর হিতাহিত বোধটুকুও হারিয়ে ফেলল। শক্ত করে বাতাসির গলা চেপে ধরলো। আজ সে বাতাসিকে শেষ করেই যেন দম নিবে।