বকুল ফুলের মালা - পর্ব ১৪ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


২৭!! 

সূর্যাস্তের মিনিট পনেরো আগে মায়রা, তাথৈ আর রিহান তিনজনেই বীচে গেল। মায়রা তাথৈ আর রিহানের কাছ থেকে একটু দূরে এসে দাঁড়ালো। সূর্যাস্ত দেখার জন্য অনেক মানুষ এসে ভিড় জমিয়েছে বীচে৷ ভিড় কখনোই মায়রার পছন্দ নয়। তবু সবার থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে কমলা রঙের সূর্যটার সাগরের জলে ডুব দেয়া দেখায় মন দিলো মায়রা৷ সূর্যাস্তের কমলা আভায় চারদিকে ধীরে ধীরে অন্যরকম একটা মায়া ফুটে উঠছে। তবু এতো ভিড়, এতো কোলাহলের মাঝে মায়রার কানে নিজেরই বলা একটা লাইন যেন টেপরেকর্ডার দিয়ে কেউ বারবার বাজিয়ে চলেছে। যেন সুদূর অতীত থেকে ও নিজেরই স্মৃতিচারণ করছে এই মোহনীয় সন্ধ্যায়। কানের কাছে বাজা সেই লাইনটার সাথে অন্য একজনের স্মিত হাসিও যেন শুনতে পাচ্ছে মায়রা। এই হাসির ধ্বনি শোনার জন্য না জানি কতোদিন মায়রার কান দুটো অধীর হয়ে ছিল। আজ হয়তো সেই হৃদয়ের সেই লুকানো আকুতিটা তাই ভ্রম হয়েই কানে এসে বাজছে। সেই হাসি আর একটা ছোট্ট কথা৷ 

"তোমার বুকের বিশালতায় আমি নাহয় আমার সাগর খুঁজে নিবো।"

কথাটা মনে পড়তেই মায়রার গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। মায়রা তাড়াতাড়ি দু হাতে মুখটা মুছে নিলো কেউ দেখার আগেই। যদিও সাগরের এই মোহনীয় সূর্যাস্তের সামনে ওর কান্নাভেজা মুখ দেখার সময় নিশ্চয়ই কারো হবে না। তবুও নিজের কান্নাটা ভুল করেও দেখতে দিতে চায় না মায়রা। বেশ অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে লালিমামাখা সূর্য আর ঢেউ দেখলো। একটু পরেই হঠাৎ করেই মায়রার বুকের ভিতর ধুকপুক করতে লাগলো। মায়রা কয়েক সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে থেকে আশেপাশে কিছু একটা খুঁজতে শুরু করলো। মায়রার মনে হচ্ছে খুব কাছাকাছি ওর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা আছে। কি করে আছে বা কোথায় আছে সেসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে হন্যে হয়ে মানুষটাকে খুঁজতে লাগলো। এই আশায় যদি দূর থেকে হলেও একটা বারের জন্য তার মুখটা দেখতে পারে ও। আরো কিছুটা সামনে যেতেই মায়রার কানে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো। আর গানের কথাগুলো শুনে মায়রা সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। 

"তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর।"

এদিকে আরিশা আর তাওহীদকে একসাথে নিজেদের মতো করে ছেড়ে দিয়ে আয়ান একদম সাগরের পানিতে পায়ের পাতা ডুবিয়ে দাঁড়ালো। ঢেউগুলো একটু পর পর আয়ানের পায়ে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। আয়ান নিজেকে সামলে নিয়ে সাগরের দিকে মুগ্ধতা নিয়েই তাকিয়ে আছে। সাগরের প্রতি মেয়েটার একটা অন্যরকমের দুর্বলতা ছিল। কয়েকদিন বাসা থেকে বের হতে না পারলেই কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে যেত নাকি ওর। অবশ্য তাতে আয়ানের সুবিধা বই অসুবিধা কিছুই হতো না। বীচে যাওয়ার বাহানায় ওদের নিয়মিত দেখা হয়ে যেত। আর সাগরের কাছে আসতেই মেয়েটা যেন একেবারে বাচ্চা হয়ে যেত। দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে পাখির মতো উড়ে যেতে চাইতো যেন। কতোটা পাগলি হলে কাজটা করা যায়! এখনও কি এই পাগলামিগুলো করে মেয়েটা? এখনও ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে বলে বীচে ছুটে আসে কেউ? এখনও  কি কেউ ওর মুগ্ধ মুখটা দুহাতে তুলে ধরে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে? অথবা পাগলামি করে ওকে আলতো করে ছুঁয়ে দেয়? বা সবার অগোচরে শক্ত করে জড়িয়ে নেয় বুকের মাঝখানে?

সাগরের বুকে সন্ধ্যার অন্ধকার নামার পরও আয়ান একমনে এসব হিসেবই কষছিলো আনমনে। নিজের করা সমস্ত হিসেবই যেন ওর গলা চেপে ধরে খুন করার চেষ্টায় লেগে পড়েছে ততক্ষণে। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেও যেন খুব কষ্ট হলো আয়ানের। তবু নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে চোখের পানিগুলোকে আটকে রাখলো আয়ান। সন্ধ্যার সূর্যাস্ত শেষ হওয়ার পর পরই জায়গাটা বেশ অনেকটাই খালি হয়ে গেছে দেখে নিজের মনেই গান ধরলো আয়ান। কাউকে গান শোনানোর মতো করেই সাগরের কাছে নিজের মনের দীর্ঘশ্বাসটা প্রকাশ করায় মন দিলো ও। 

-"তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়

তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়

তোমার কথার শব্দ দূষণ
তোমার গলার স্বর
আমার দরজায় খিল দিয়েছি
আমার দারুণ জ্বর

তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর

তোমার নৌকোর মুখোমুখি আমার সৈন্যদল
বাঁচার লড়াই
আমার মন্ত্রী খোয়া গেছে একটা চালের ভুল
কোথায় দাঁড়াই

কথার ওপর কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চায়
নিজের মুখের আয়না আদল লাগছে অসহায়

তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান

বুকের ভেতর ফুটছে যেন

মাছের কানকোর লাল এত নরম

শাড়ির সুতো বুনছে যেন
সেই লালের কঙ্কাল বিপদ বড়
কথার ওপর কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চায়
নিজের মুখের আয়না আদল লাগছে অসহায়

তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান

তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়
তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো

তার জীবনে ঝড়
তোমার কথার শব্দ দূষণ
তোমার গলার স্বর
আমার দরজায় খিল দিয়েছি
আমার দারুণ জ্বর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর।"

গানটা শেষ হতে হতে আয়ানের টপটপ করে ঝরা চোখের পানিগুলো পায়ের কাছের সাগরের লোনা পানির সাথে মিশেছে। একটা তীক্ষ্ম অস্থিরতা ওর বুকের মধ্যে বারবার উঁকি দিচ্ছে। আয়ান ধরতে পারছে না আজ এতোগুলো দিন পর হঠাৎ এমন হচ্ছে কেন। মায়রার পছন্দের একটা জায়গায় ঘুরতে এসেছে বলে? নাকি মেয়েটাকে একটা মূহুর্তের জন্যও কখনো ভুলতে পারে নি বলে! নিজের অনুভূতিগুলো আজ আয়ানের কাছেই অস্পষ্ট। আরো কিছুক্ষণ নিজের এই অস্থিরতার সাথে লড়াই করে আরিশা আর তাওহীদের দিকে পা বাড়ালো আয়ান। সাগরের বিশালতা হয়তো ওর জখমটাকে আরো বেশি করে উসকে দিচ্ছে। তাই এখান থেকে পালালেই যেন স্বস্তি হবে ওর। 

মায়রা দূর থেকেই আয়ানকে অপলকে অনেকক্ষণ দেখেছে। মুখটা ভালো করে দেখতে পায় নি। তবু মায়রা জানে এটাই আয়ান। এই মানুষটাকে হাজার মানুষের ভিড়েও ঠিক চিনতে পারে মায়রা। এ অন্য কেউ হতেই পারে না। গান শেষ হওয়ার পরে আয়ানের দিকে একপা এগিয়ে যেতে গিয়েই আবার থমকে গেল মায়রা। এই মানুষটার মুখোমুখি হওয়ার মতো মুখ কি ওর আছে? মানুষটা ওকে ছেড়ে কেমন আছে সেটা মায়রা বেশ ভালো করেই জানে। এতোগুলো দিন পর হয়তো সে তার নিজের মনকে, এমনকি হয়তো নিজেকেও গুছিয়ে নিয়েছে। আজ হঠাৎ তার সামনে গিয়ে সবকিছু ওলট-পালট করে দিবে মায়রা কোন অধিকারে? কথাটা মনে হতেই অজান্তেই একপা দু পা করে পিছিয়ে গেল মায়রা। ধীর কদমে তাথৈ আর রিহানের কাছে ফিরে গেল। তাথৈ আর রিহান একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল মায়রাকে বেশ অনেকক্ষণ না দেখে। তাই মায়রাকে দেখেই দুজনে এগিয়ে এলো।

-কি রে? কোথায় গিয়েছিলি? খুঁজছিলাম তোকে--। আর এই মায়রু? কি হয়েছে রে? এমন লাগছে কোন তোকে?

-একটু হেঁটে আসলাম আপু--। আপু রুমে যাবো--। ভালো লাগছে না--।

-কি রে? শরীর খারাপ করছে? কাছেউ একটা ক্লিনিক আছে--।

-আপু? এমনি টায়ার্ড লাগছে--। চলো না যাই?

-হুম--। আচ্ছা। চল চল? 

-হুম---।

কটেজে ফিরে মায়রা নিজের রুমে চলে গেছে রেস্ট নেয়ার কথা বলে। তাথৈ আর রিহান অনেকবার বলেছে কিছু খেয়ে নিতে। মায়রা কিছুতেই কিছু খাবে না। শেষে তাথৈ আর রিহান খাবার মায়রার রুমেই রেখে গেছে। ওদের কটেজের পাশেই একটা ছোট বাজারের মতো আছে সেখানে গেছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসবে বলে গেল মায়রাকে। তাথৈ আর রিহান চলে যাওয়ার পর মায়রা বেশ কিছুক্ষণ নিজের কটেজেই পায়চারি করলো। একবার ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে আয়ানের সামনে দাঁড়াতে। পরক্ষণেই ব্যাপারটাকে নিছক পাগলামি ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না ওর নিজের কাছেই। কি এক অদ্ভুত দ্বিধায় পড়ে গেছে ও। নিজের মনের সাথে এই দ্বিধা দ্বন্দ্বের যুদ্ধ করতে করতে যেন ওর দমটাই বন্ধ হয়ে আসছে। একটু স্বাভাবিক হওয়ার জন্যই করিডোরের খোলা বাতাসে এসে দাঁড়ালো মায়রা। উদ্দাম বাতাসে ওর শাড়ির আঁচল চর খোলা চুলের সাথে সাথে মনটাও বেশ উড়োউড়ি করতে শুরু করেছে। 

আরিশা আরো কিছুক্ষণ বীচে থাকবে বায়না করায় আয়ান একাই কটেজে ব্যাক করছে। একটা গ্রাম্য ভাব আনার জন্যই কিনা কে জানে কটেজটাকে একটু মান্ধাতা আমলের মতো করে সাজানো হয়েছে। করিডোরের বাইরে চকচকে সাদা ইলেকট্রিকের আলোর বাতির বদলে জ্বলছে মিটিমিটি কেরোসিনের কুপি। সেই মৃদু আলোয় একদম স্পষ্ট দেখা না গেলেও আয়ানের রুম থেকে তিন-চারটা রুম দূরে কটেজটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছায়ামূর্তির মতো মানুষকে দেখা গেল। ছায়ামূর্তিটার বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়া চুল আর শাড়ির আঁচল আর আধো আলোয় মুখটা দেখে আয়ানের একটা হার্টবিট যেন মিস হয়ে গেল। আয়ান আগেপিছে কিছু না ভেবেই সোজা গিয়ে তার হাতটা টেনে ধরে নিজের দিকে ফিরালো। আর সেই আধো কেরোসিনের কুপির আলোয় একে অন্যের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করলো এটা বাস্তব নাকি কল্পনা। 

২৮!! 

এভাবে হুট করে আয়ানের সামনে পড়তে হবে সেটা মায়রা কল্পনাও করে নি৷ কক্সবাজারে এতো হোটেল আর রিসোর্ট থাকতে শেষে কিনা ওরা দুজনেই যে কাকতালীয়ভাবে এই আধপুরোনো কটেজটাতেই উঠবে সেটাও মায়রা আশা করে নি। আসলেই জীবন হুটহাট করে এমন সারপ্রাইজ দিয়ে দেয় যা কেউ কখনোই আশা করে না। হয়তো এমন অদ্ভুত সারপ্রাইজ দিয়ে বিধাতা হাসেন অগোচরেই। কি যে চলে তার মনে সেটা আসলেই বোঝা মুশকিল তাঁর এই সামান্য সৃষ্টির পক্ষে। মায়রা এসব ভেবে আয়ানের মুখের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো।

আর আয়ান? আবছা আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকা নারীমূর্তিটা দেখে বুকের ধুকপুকানিরা আয়ানকে বারবার জানান দিচ্ছিলো যে এটাই মায়রা৷ এটা অন্য কেউ হওয়া সম্ভবই না। তবু সেটা বিশ্বাস হয়নি আয়ানের। মায়রা কি করে এখানে আসবে? তবু ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মানুষটার মুখ দেখে নিজের মনটাকে একটু শান্তনা দিবে ভাবলো আয়ান। কিন্তু সত্যি যখন এই আধো কুপির আলোয় মায়রার মুখটাই আয়ানের চোখে ভেসে এলো তখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটা আলোড়ন বয়ে গেল আয়ানের বুকের ভিতর। অজান্তেই হাত বাড়িয়ে মায়রার গাল ছুঁইয়ে দিয়ে মুখটা তুলে ধরলো। গত ছয়টা মাসের কথা যেন বেমালুম ভুলে গেছে আয়ান। যেন ভুলে গেছে কয়টা দিন আগেও এই মেয়েটাকে ভুলতে না পেরে নিজেকে শেষ করে দেবার কথাটাও মাথায় এসেছিল ওর। এতোগুলো দিন পর মায়রার আধো আলো আঁধারি মুখটা দেখে কোন এক ঘোরের জগতে হারিয়ে যাচ্ছে আয়ান। তবু কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলো আয়ান। শব্দগুলোও যেন চোখের নিমিষে গিয়ে মায়রার কানে গিয়ে বাজলো।

-মায়রু? তুমি সত্যি এসেছ? এটা স্বপ্ন? নাকি কল্পনা? নাকি বাস্তব? বলো না প্লিজ?

আয়ানের কথাটা শুনে মায়রার চোখ থেকে টুপ করে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে গিয়ে আয়ানের হাত বেড়ে পড়লো। মায়রার এই উষ্ণ কান্নার বিন্দুগুলোই আয়ানের প্রশ্নের উত্তরটাও যেন দিয়ে গেল। আর সেই উষ্ণ কান্নার জল আয়ানকে ছয়মাস আগের মায়রার নেয়া সিদ্ধান্তটার কথাও মনে করিয়ে দিয়ে গেল। এতোক্ষণে আয়ানের ঘোর কাটতে শুরু করেছে। আয়ান এক আকাশ সমান অভিমান নিয়ে মায়রার গাল থেকে হাতটা নামিয়ে নিয়ে একটু দূরে সরে এসে দাঁড়ালো। মায়রা জায়গা থেকে এক বিন্দুও নড়তে পারলো না। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে আবার আয়ানের মুখটা দেখার চেষ্টা করলো। 

-কেমন আছো আয়ান?

মায়রার মুখে 'কেমন আছো' কথাটা শোনার সাথে সাথেই কেউ যেন আয়ানের মাথার মধ্যে উত্তপ্ত লোহার চাবুক দিয়ে আঘাত করেছে। আয়ানের এতোটাই রাগ হলো যে সে স্থান কাল না ভেবেই মায়রার হাতটা শক্ত করে ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো মায়রাকে। মায়রা প্রচন্ড ব্যথা পেলেও একটা শব্দও করলো না। শুধু নিজের ঠোঁট কামড়ে ব্যথাটা হজম করে নিলো। এই মানুষটার রাগের মাঝেও যে মায়রার হাজারো অবহেলিত ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। তাই আয়ানের অজান্তে দেয়া এমন হাজারো আঘাত হাজারবার কবুল মায়রার।

-কেমন আছি? কেমন আছি জানতে এসেছ না এখানে? কি? কি করতে এসেছ? হ্যাঁ? কি করতে এসেছ? দেখতে এসেছ মরেছি কিনা? 

-আয়ান?

-কি? কি আয়ান? দেখো মরি নি। মরি নি আমি--। মরবো কেন? কেন মরবো? তোমার মতো ধোঁকাবাজের জন্য? হাহ--। 

-আয়ান?

-এই? একটা কথাও বলবা না তুমি। বরের সাথেই এসেছ না? বেশ ভালোই আছো দেখছি--। হুমম। থাকবেই তো--। আমি আয়ান তোমাকে কি আর দিয়েছি? ভালোই থাকো---। 

-------------------------------

-তা কই তোমার হাসবেন্ড? আমাদের সাথেও একটু পরিচয় করিয়ে দাও? আমিও একটু দেখে ধন্য হই এমন ভাগ্যবানকে--৷ যার জন্য আমার এতোদিনের ভালোবাসাটা ভুলতে তোমার একটা সপ্তাহও সময় লাগে নি--। বিজি মানুষ নিশ্চয়ই। তবু তোমার জন্য সময় বের করে কক্সবাজার বেড়াতে এসেছে--। আসলেই--। হি লাভস ইউ সো মাচ--। 

-------------------------------

-আমার সামনে দাঁড়িয়ে এই কান্নার নাটকটা একদম করবে না মায়রা। নেহায়েতই সামনে পড়ে গেছি বলে কথা বলতে এসেছ জানি--। ভয় নেই তোমার হাসবেন্ড কখনো জানবে না তোমার আর আমার সম্পর্কটার কথা--। তুমিও বলো নি তাকে নিশ্চয়ই। আর আমিও বলবো না। নো টেনশন--। এবার তো পরিচয় করাতে সমস্যা নেই? কি বলো?

-আ-আয়ান?

-হুম? এনি প্রবলেম? বিশ্বাস করতে পারছ না আমাকে? নাকি হাসবেন্ডের সাথে কি বলে পরিচয় করাবে ভেবে পরিচয় করাতে চাচ্ছো না? কোনটা? তুমি কথা বলছো না কোন বলো তো? 

-আমি---।

-আচ্ছা বাদ দাও--। না চাইলে পরিচয়ই নাই করাতে পারো। কোন তো জোর নেই তাই না?

-------------------------------

মায়রার চুপ করে থাকা দেখে আয়ান বিরক্ত হয়ে মায়রার হাতটা ছেড়ে দিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে মায়রার মুখটা দুহাতে তুলে ধরে চোখে চোখ স্থির করলো আয়ান। মায়রা মাথা নিচু করে ফোঁপাচ্ছিল। আয়ানের আবার হুট করে এসে মুখটা ধরায় মায়রা চমকে উঠে আয়ানের মুখের দিকে তাকালো। আয়ানের চোখে কেমন একটা উদ্ভ্রান্তের দৃষ্টি। মায়রা সেটা দেখে একটু ভয় পেল।

-এই মায়রা? বলো তো? ওই লোকটা সত্যি তোমাকে ভালোবাসে? খুব সুখে রেখেছে না ও তোমাকে? আমার মতোই আদর করে তোমাকে? তোমার কাঁধের এই লাল তিলটায়ও সে অধিকার করে নিয়েছে? সেও কি ওটায় রোজ ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়?

আয়ান কথাগুলো বলতে বলতেই পাগলের মতো মায়রার কাঁধের উপরে থাকা চুলগুলো ব্যস্ত হাতে সরিয়ে দিয়ে কাঁধের তিলটা দেখার চেষ্টা করলো। মায়রা চমকে গেছে আয়ানের এমন ব্যবহারে। কোনমতে আয়ানের হাতটা ধর আটকানোর চেষ্টা করতে গিয়েও ব্যথার চোটে পারলো না। আয়ান মায়রার চুল সরিয়ে দিয়ে ততক্ষণে কাঁধের লাল তীলে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে সেটার দিয়ে তাকিয়ে রইলো। আবছা আঁধারেও দাঁতের কামড়ে কালচে হয়ে যাওয়াটা আয়ানের চোখ এড়ালো না। আয়ান মায়রার কাঁধের কালচে জায়গাটায় আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিতেই মায়রার বুক ভেঙ্গে কান্না পেল। নীরবে চোখের পানিগুলো এতোক্ষণও ঝরছিলো। এবারে তাদের গতিটা আরো বেড়ে গেল। আয়ান এবারে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।

-বাহ! এটাতেও ভালোবাসার ছবি এঁকে দিয়েছে? বাহ! অসাধারণ। তবে বেশ পুরোনো মনে হচ্ছে? 

-আয়ান-। প্লিজ থামো---।

-আরে? মায়রা এখানে লজ্জা পাওয়ার কি হলো? সে তোমার স্বামী। সে তোমাকে যেমন ইচ্ছে ভালোবাসতেই পারে--। ওহ-। আমাকে লজ্জা পাচ্ছো? আরে ব্যাপার না--। আমাকে যখন জীবনেই জায়গা দিলে না তখন লজ্জা দেখিয়ে আর কি করবে বলো?

------------------------------

-তা ভদ্রলোক কি বাইরে গেছেন কোথাও? এখনই চলে আসবে নাকি? তাহলে তো সম্ভবত একটু নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়। হাজার হোক তোমাকে আজও ভালোবাসি। তোমার সংসারটা ভাঙুক সেটা কখনোই চাইবো না---।

শেষের দিকের কথাগুলো বলতে বলতে আয়ান মায়রার থেকে কয়েক পা সরে এসেছিলো। মায়রা এবারে একবার মুখ তুলে আয়ানের দিকে তাকালো। আয়ানের বলা প্রত্যেকটা কথা একেবারে তীরের মতো বুকে গিয়ে লাগছে মায়রার। শেষ কথাটা আর সহ্য করতে পারলো না মায়রা। 

-যে সংসারটাই নেই সেটার ভাঙা নিয়ে চিন্তা করারও কিছু নেই আয়ান। কিছু নেই----।

কথাগুলো বলেই একছুটে করিডোর থেকে চলে গেল মায়রা। ঠিক কোন দিকে গেছে সেটা অন্ধকারে আয়ান খেয়াল করতে পারলো না। ওর কানে তখন একটা কথাই বাজছে। 'যে সংসারটা নেই'। কেন নেই, কি হয়েছে তার কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারলো না আয়ান। তার আগেই মায়রা সেখান থেকে কোথাও চলে গেছে। আয়ান মায়রার নাম ধরে জোরে ডাকলো কয়েকবার। কেউ কোন সাড়াশব্দ দিলো না। কটেজের বেশিরভাগ লোকজনই এখন বীচে। আর বাকি যারা বীচে যায় নি তারা হয় পাশের বাজারটায় গেছে বা বাইরের মাঠের মতো জায়গাটায় ক্যাম্প ফায়ারের মতো করে আড্ডা দিচ্ছে। এর মধ্যে মায়রাকে ঠিক কোথায় খুঁজবে সেটাই মাথায় ঢুকছে না আয়ানের। মেয়েটার শেষের কথাটার মানেটা যে ওকে জানতেই হবে। যে করেই হোক জানতে হবে। আর কিছু ভেবে না পেয়ে আয়ান আবার জোর গলায় ডাকার চেষ্টা করলো। 

-মায়রা??

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন