১৩!!
তামান্না উঠে বসে দীপ্তির গায়ে ভালো করে চাদরটা টেনে দিয়ে আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। দরজাটা হালকা করে ভেজিয়ে দেয়া আছে৷ বাইরে গিয়ে দেখবে কিনা সেটা ভাবতে ভাবতেই আবার একটা ছায়া দেখতে পেয়ে এক পা এগিয়ে গেল তামান্না।
-কে ওখানে?
-----------------------------
-কে? কথা বলছেন না কেন?
-মিস তামান্না? আমি--। ভয় পাবেন না।
-কিশোর সাহেব?
-একবার ভেতরে আসবো? আসলে কিছু কথা বলার ছিলো আপনার সাথে---।
-জি আসুন---।
কিশোর আস্তে করে দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে তামান্নার থেকে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে একবার চমকে উঠলো। লোকটার ফর্সা মুখটা লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। চোখ দুটোও আগের চেয়ে বেশি তীক্ষ্ম মনে হচ্ছে। রাতের সেই স্নিগ্ধ, শান্ত ভাবটা নেই চোখে মুখে। কেন মানুষটা এতোটা রেগে আছে সেটাই মাথায় ঢুকছে না তামান্নার। তামান্নার দিকে না তাকিয়েই দীপ্তির দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে কিশোর। সেটা দেখে বেশ ভশ পেল তামান্না। লোকটা কি আবার ড্রিংকস করে এসেছে! এই দিন দুপুরে?
-মিস তামান্না? দীপ্তি আপনাকে এতোক্ষণ কার কথা বলছিলো বলুন।
-কার কথা! আমি তো সেটা জানি না স্যার।
-সিরিয়াসলি আপনি জানেন না?
-নাহ---। কার কথা বলেছে দীপ্তি আপনি জানেন?
-আপনি যদি নাই জানেন বা নাই চিনে থাকেন তাহলে দীপ্তিকে কেন বললেন ওর মতো সাজিয়ে দিবেন? না চিনলে কি করে - সাজাবেন ওর মতো করে? আন্সার মি---।
-ও তো বউয়ের মতো সাজার কথা বললো--। তাই বলেছিলাম---। আমি বুঝতে পারছি না---।
-আপনি বুঝতে পারছেন না? বুঝতে পারছেন না আপনি? আপনি এসব কিছুই জানেন না সেটাও এখন আমাকে বিশ্বাস করতে হবে---?
কিশোর রাগের চোটে চিৎকার করেই কথাটা বলে ফেলেছিল। দীপ্তি যে ঘুমাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই তার। দীপ্তিও চিৎকার শুনে ঘুমের ঘোরে কেঁদে উঠলো একবার। তামান্না এক নজর কিশোরের দিকে তাকিয়ে দীপ্তির মাথার কাছে বসে একটু ঝুঁকে দীপ্তির পিঠে আলতো করে চাপড় দিয়ে দিলো। দীপ্তি আবার ঘুমিয়ে গেলে তামান্না আবার উঠে দাঁড়ালো।
-পাগল হয়ে গেছেন আপনি? মেয়েটা সবে একটু ঘুমিয়েছে। বাচ্চাদের কাঁচা ঘুম ভাঙলে শরীর খারাপ হয় জানেন না? আর আপনারই বা কি হয়েছে বলুন তো? এমন কেন করছেন? আমার উপরে এতো রেগে আছেনইবা কেন? আমি কি করেছি?
কিশোর তামান্নার কথাগুলো শুনে আরো রেগে গিয়ে তামান্নাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। কিশোর এমন হুট করে আক্রমণ করায় নড়ার বা বাধা দেয়ারও সময়টা পায় নি তামান্না। কিশোরের মুখটা এতোটা কাছে দেখে বেচারি এবার সত্যিই ঘাবড়ে গেল। লোকটার হঠাৎ আবার কি হলো?
-আমার মেয়েকে নিয়ে আমার চেয়ে তোমার চিন্তা বেশি এটা প্রুভ করতে চাইছো তুমি? কিসের লোভে পড়ে করছো এসব? বলো আমাকে? কত টাকা? কত টাকা দিয়েছে তোমাকে ও? কত টাকা? আমি ওর চেয়েও বেশি পে করবো তোমাকে৷ প্রয়োজনে তোমার আজীবন তোমার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিব---। না না। আমার সব কিছু তোমাকে দিয়ে দিবো--। আমার মেয়েটাকে প্লিজ নিয়ে যেতে দিও না প্লিজ---। হাত জোড় করছি তোমার কাছে--। প্রয়োজনে পায়ে পড়ছি তোমার তামান্না---।
-আরে স্যার? কি করছেন টা কি? আমি কারো থেকে টাকা নিতে যাবো কেন? কিসব বলছেন?
-তাহলে তুমি সত্যি করে আমাকে বলো? দীপ্তি তোমাকে কার কথা বলেছে---।
-স্যার আমি সত্যি জানি না। আমি শুধু ওকে বলেছি উনার কাছ থেকে আর চকলেট না নিতে-----।
-চকলেট? ঠিক কি বলেছে দীপ্তি তোমাকে? বলো প্লিজ---।
-দীপু--। দীপু বলেছে-। আজ ওর স্কুলে একটা মেয়ে এসেছিলো। আপনার কাছে নাকি তার ছবি আছে। বউয়ের সাজে। --। উনি দীপ্তিকে অনেক আদর করেছে, চকলেট দিয়েছে--। আর বলেছে---।
-কি বলেছে!?
-বলেছে দীপ্তি যেন উনাকে মামনি বলে ডাকে-----।
-হোয়াট??
তামান্নার কথাটা শুনেই কিশোর এক ঝটকায় তামান্নার কাছ থেকে সরে এলো। তামান্নাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। লোকটা এমনভাবে হাত চেপে ধরেছিল একেবারে লাল হয়ে ব্যথা করছে তামান্নার হাত। তামান্না কিশোরের হঠাৎ এভাবে ধরার মানেও বুঝে নি, আবার এভাবে ছিটকে সরে যাওয়ার মানেও বুঝে নি। তাই এবার কিশোরের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ দেখে তামান্না পুরো থতমত খেয়ে গেল। কিশোর থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে তামান্না আতঙ্কিত হয়ে কিশোরের দিকে এগিয়ে গিয়ে কিশোরের হাতে হাত রেখে নাড়া দিলো একবার।
-স্যার? কি হয়েছে আপনার?
-আর কি বলেছে আপনাকে দীপ্তি? ও কি আবার আসবে আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে----?
-কে স্যার?
-বুঝতে পারছেন না আপনি ও কে? সুপ্তি। সুপ্তি। এতোগুলো বছর পর আবার কেন ফিরে এসেছে ও? আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নেয়ার জন্য? আমাকে এভাবে তিলে তিলে শেষ করে দেয়ার জন্য? কেন করছে ও এমনটা? কি দোষ করেছি আমি? কেন কেন কেন?
-স্যার? এসব কেন বলছেন??
-সুপ্তিই এসেছে তামান্না। ও আমার মেয়েকে নিতে চায়। প্লিজ প্লিজ প্লিজ কিছু করো। প্লিজ---। আমাদের বিয়ের ছবিগুলো আজো ফেলতে পারি নি আমি। দীপ্তি ওর ছবি দেখেছে এ্যালবামে--। তাই চিনতে পেরেছে--। আজ চকলেটের লোভ দেখাচ্ছে আমার মেয়েকে-। কাল দীপু যদি জানতে পারে ওই দীপুর মা--। তাহলে তো মেয়েটা চলে যাবে---। আমাকে যে প্রচন্ড ঘৃণা করে আমার দীপু---। তারই সুযোগ নিবে ওই কালনাগিনী--। আমার মেয়েকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিবে ও। যে করেই হোক ওকে আটকাতেই হবে--। নয়তো আমার মেয়েটা--।
-স্যার? সামলান নিজেকে---। দীপ্তি যাবে না কোথাও--। আমি আছি তো। ও আমাকে ফেলে কোথাও যাবে না---। একবার বিশ্বাস করুন--।
-জানেন? মেয়েটাকে কখনো বুকে জড়িয়ে ধরে আদর পর্যন্ত করতে পারিনি আমি--। এতোগুলো দিন নিজের থেকে আলাদা করেই রেখেছি--। আমার ছোট্ট মেয়েটা----। বাবার স্নেহ ভালোবাসাটা কখনো পায় নি--। পায় নি বললে ভুল হবে। আমিই ওকে বাবার ভালোবাসাটা দেই নি----। এখনও আমার দীপুটাও আমাকে রেখে যদি চলে যায় তবে কি নিয়ে বাঁচবো আমি বলতে পারেন?
-স্যার??
কিশোর একেবারে ভেঙে পড়েছে। কান্না আটকাতে না পেরে তামান্নার সামনে ফ্লোরেই বসে পড়লো। কিশোরের চোখ থেকে ঝড়ে পড়া প্রত্যেকটা কান্নার বিন্দুগুলো যেন তামান্নার বুকে ঝড় তুলছে। কিছুতেই কিশোরকে সামলাতে পারছে না দেখে তামান্নার নিজেরই অসহায় লাগছে নিজেকে। একটা মানুষ কতোটা অসহায় হলে অচেনা একজন বাইরের মানুষের সামনে নিজের চোখের পানি ফেলে সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছে তামান্না। কিন্তু ও কি করবে এখন? এসব ভাবতে ভাবতেই তামান্নার হুঁশ হলো শাড়ির আঁচলে টান পড়ায়। দীপ্তি কখন উঠে তামান্নার পিছনে লুকিয়ে আঁচল টেনে ধরেছে একদমই টের পায়নি তামান্না।
-মিস? বাবাইয়ের কি হয়েছে? কাঁদছে কেন এভাবে---? বাবাই? ও বাবাই? কি হয়েছে তোমার? তোমাকে কেউ বকেছে? কে বকেছে?
কিশোরের দিকে এক নজর তাকিয়ে তামান্না আলগোছে দীপ্তিকে টেনে নিয়ে কিশোরের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। দীপ্তি ঠোঁট কামড়ে একবার তামান্নাকে দেখছে আর একবার কিশোরকে। তামান্না ইশারায় দীপ্তিকে কিশোরের কাছে যেতে বললে দীপ্তিও এগিয়ে গিয়ে কিশোরের চোখের পানিটুকু মুছে দিলো।
-বাবাই কেঁদো না। কে বকেছে বলো না আমাকে? আমি আর মিস মিলে তাকে বকে দিয়ে আসবো। দিম্মাও বকে দিবে। ও বাবাই?
কিশোর মুখ তুলে দীপ্তিকে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। ছোট্ট দীপ্তিকে একেবারে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো কিশোর। এই ছোট্ট মেয়েটার জন্য এখনো বেঁচে আছে কিশোর। ওকেই যদি হারাতে হয় তাহলে কি নিয়ে বাঁচবে ও? কি করে ওকে সুপ্তির কালো ছায়া থেকে দূরে রাখবে কিশোর? কালই যদি দীপ্তিকে নিয়ে যেতে চায়? কি করে সুপ্তিকে আটকাবে কিশোর? কি করে তার ছোট্ট দীপুকে সে তার বুকের মাঝে আড়াল করে লুকিয়ে রাখবে?
১৪!!
বেশ অনেকক্ষণ আগেই সন্ধ্যা নেমেছে চৌধুরী ম্যানশনে। সেদিকে যেন হুঁশই নেই কিশোরের। সেই বিকেল থেকেই দীপ্তিকে বুকে জাপটে ধরে বসে আছে ছেলেটা। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ছাড়লেই যেন ওর ছোট্ট মেয়েটা হারিয়ে যাবে কোথাও। কিশোরের বুকে মুখ ডুবিয়ে একসময় ঘুমিয়েও গেছে দীপ্তি। তবু ওকে বুকে আগলেই বসে আছে কিশোর। একটা ছোট্ট শিশু যেমন ভয় পেয়ে তার খেলনা পুতুলটা আগলে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা, তেমনই অবোধ শিশুর মতো লাগছে এই মূহুর্তে কিশোরকে।
তামান্না আপাতত সেসব নিয়ে চিন্তা করছে না। কিশোর আর দীপ্তিকে একসাথে রেখে সে আপাতত খাবারের ব্যবস্থা করছে সবার জন্য। কাজের ফাঁকে এসে কিশোর আর দীপ্তিকে দেখে যাচ্ছে একটু পর পরই। আবার ফিরে এসে কাজে মন দিচ্ছে। রান্না করছে আর ভাবার চেষ্টা করছে তামান্না। দুপুরে তামান্না আর দীপ্তির কথাগুলো কিশোর শোনে নি৷ অন্য কেউ শুনেছে আর সেটা কিশোরকে গিয়ে উল্টোপাল্টা করে বলেছে। কারণ কিশোর শুনলে ওভাবে অযথাই তামান্নার উপরে রেগে যেত না। কিন্তু কে ওদের কথাগুলো লুকিয়ে শুনেছিল তাহলে? বাড়িতে তো শুধু এতোজন কাজের লোক, ফালেহা চৌধুরী, কিশোর, তামান্না আর দীপ্তিই থাকে। বাইরে থেকেও কেউ আসার কথা নয়। তাহলে কি কাজের লোকদের মধ্যেই কেউ??
তামান্নার রান্না শেষ হতেই রুমে ফিরে দেখলো দীপ্তির ঘুম ভেঙেছে। কিশোরের বুকে শুয়ে থেকে অবাক অবাক চোখে কিশোরের মুখটা দেখছে মেয়েটা৷ তামান্নাকে দেখেই হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো দীপ্তি। তামান্না এগিয়ে গিয়ে দীপ্তির কাছে গেল৷ দীপ্তি ইশারায় আরো কাছে আসতে বললো। তামান্না এবার একটু ইতস্তত করে কিশোরের মুখের দিকে তাকালো। কিশোর ঘুমের মাঝেও দীপ্তিকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে৷ এখন তামান্না দীপ্তির দিকে ঝুঁকে কথা শুনতে হলে কিশোরের দিকেই ঝুঁকতে হবে। কথাটা চিন্তা করতেই গা শিউরে উঠলো তামান্নার। তামান্না আসছে না দেখে দীপ্তিও ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানি চোখে তাকালো তামান্নার দিকে।
-ও মিস?
-কি-কি হয়েছে দীপুসোনা?
-শোনো না? কথা আছে তো?
-হুম?
-আরেকটু আসো না??
-হুম----।
তামান্না প্রায় দম আটকে দীপ্তির দিকে একটু ঝুঁকলো। দীপ্তি শক্ত করে তামান্নার হাতটা চেপে ধরলো।
-মিস? বাবাই কি সত্যি আমাকে আদর করে বুকে নিয়ে ঘুমাচ্ছে? নাকি আমি স্বপ্নে দেখছি? ওই যে সেদিন রূপকথার গল্পে পড়লাম--।
-তুমি তোমার বাবাইয়ের সাথেই তো আছো দীপুসোনা। স্বপ্ন না।
-সত্যিইই!! কি মজা!!
-হ্যাঁ সোনা। মজা। এখন উঠে পড়ো? নাস্তা খেয়ে হোমওয়ার্ক করতে হবে তো? কালকে না স্কুল আছে দীপুরাণীর? হুম?
-ওপস--। হুম তাইতো।
-ওঠো ওঠো??
-ও মিস? শোনো না??
-হুম??
দীপ্তির ডাকে তামান্না তাকাতেই দীপ্তি টুপ করে তামান্নার গালে একটা চুমো খেল আরেকবার কিশোরের গালে চুমো খেল।
-লাভ ইউ মিস। লাভ ইউ বাবাই।
দীপ্তির কান্ড দেখে তামান্না থতমত খেয়ে সরে আসার চেষ্টা করতেই কিশোরও নড়ে উঠে চোখ খুললো। আর সাথেসাথেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। চোখে চোখ পড়তেই কিশোরও চমকে গেল তামান্নাকে এতোটা কাছে দেখে। আর তামান্নাও তাড়াতাড়ি সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই দীপ্তি তামান্নার আঁচল টেনে ধরলো। তামান্না কিশোরের সামনে থেকে সরেও আসতে পারলো না। কি করবে ভেবে না পেয়ে চোখ বুজে ফেললো। এই লোকের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা তামান্নার অসাধ্য।
-আমি মানি না। মিস আর বাবাই কেউ আমাকে ভালোবাসে না৷ আমি দুজনকেই আদর দিলাম। কেউ আমাকে আদর করলো না। হুহ। কথা নেই কারো সাথে---। এখন মিস আগের মতো আমাকে না বলেই উঠে চলে যাচ্ছে---। হুহ হুহ হুহ। কাট্টি।
কিশোর একবার তামান্নার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। তারপর দীপ্তির হাত থেকে তামান্নার আঁচলটা আলতো করে ছাড়িয়ে নিলো। আঁচলের টান আর লাগছে না দেখে তামান্না তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কিশোর দীপ্তিকে নিয়ে উঠে বসে গালে কপালে চুমো খেল।
-লাভ ইউ টু মামনি। আর মামনি। এমন কেউ করে? তোমার মিস লজ্জা পেল না বাবাইয়ের সামনে? মিস পরে আদর করে দিবে তোমাকে কেমন? এতো আড়ি দিতে আছে?
-কেন আড়ি দিব না? আমার বন্ধুরা যখন স্কুলে আসে ওদের মাম্মি পাপা দুজনেই তো ওদেরকে আদর করে দেয়৷ মিস তাহলে কেন করবে না আমাকে?
দীপ্তির কথা শুনে কিশোর আর তামান্না দুজনেই থমকে গেল। দীপ্তিকে বলার মতো ওদের দুজনের কারো কাছেই কোন কথা নেই। কি করে এই বাচ্চা মেয়েটাকে বোঝাবে দুটো ঘটনার মধ্যে কতোটা তফাত?
পরদিন সকালে তামান্না দীপ্তিকে খাইয়ে রেডি করে দিয়ে নিজেও রেডি হয়ে নিলো। দীপ্তির ব্যাগ, টিফিন আর পানির বোতল গুছিয়ে নিচে গাড়ির সামনে আসতেই একবার চমকালো তামান্না। কিশোর গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দীপ্তি কিশোরকে দেখে ছুটে এলো বাবাই বলে। কিশোরও মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করলো। আর তামান্না গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে কিশোরকে দেখছে অবাক হয়ে। কেমন করে যেন আজ ওদের দুজনেরই ড্রেস ম্যাচ হয়ে গেছে। কিশোর ডিপ নেভি ব্লু কালারের শার্ট পড়েছে। সাথে নেভি ব্লু গাবাডিং। শার্টের স্লিভ কনুই থেকে গোটানো। চুলের কাট, শার্ট-প্যান্ট-সব মিলিয়ে পুরোই হিরো লাগছে দেখতে।
তামান্নাও আজ একটা নীল রঙা শাড়ি পড়েছে। শাড়ি পড়তে দীপ্তি আজকে একটু সাহায্য করেছে। তাই একদম সুন্দর মতো সেট হয়ে আছে শাড়িটা। খোলা চুলে আর কোন প্রসাধন ছাড়াও তামান্নাকে দেখতে অসাধারণ লাগছে। কিশোরও বেশ অবাক হয়েই কিছুক্ষণ তামান্নাকে দেখলো। তারপর দীপ্তিকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো। তামান্নাও আর কি করবে। চুপচাপ পিছনের সিটে গিয়ে বসে পড়লো দীপ্তির ব্যাগ জিনিসপত্র নিয়ে।
কিশোর গাড়ির ফ্রন্ট মিররটা সেট করে গাড়ি স্টার্ট দিলো। দীপ্তি বকবক করছে তামান্নার দিকে মুখ করে। আর তামান্না ওর কথায় মাঝেমাঝেই হেসে ফেলছে। আর কিশোরের চোখ তার অনিচ্ছা স্বত্বেও মিররে তামান্নার হাসি মুখটার দিকে চলে যাচ্ছে। খোলা জানলা দিয়ে আসা বাতাসে তামান্নার চুলের বেপরোয়া উড়োউড়ি আর হাসার সময় গালে পড়া টোলে কিশোরের নজর আটকে যাচ্ছে বারবার। দীপ্তি কি বলছে সেসব কিছুই কানে পৌঁছচ্ছে না কিশোরের। সে নিজের মনে একটা কথাই ভাবছে। দুজন মানুষের মধ্যে এতোটা অদ্ভুত মিল হয় কি করে? কোন সম্বন্ধ ছাড়া এতোটা মিল কি আধোও সম্ভব? নাকি তামান্না সত্যি কিছু লুকুচ্ছে? তামান্নাও কি ওকে ঠকানোর জন্যই এসেছে? নাকি সবটা ওর নিজের মনের ভুল?
একমনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বেশ তাড়াতাড়িই দীপ্তির স্কুলে গেইটের সামনে চলে এসেছে। দীপ্তি কিশোরের গলা জড়িয়ে ধরে একটা চুমো খেয়েই টুপ গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। কিশোর হাত বাড়িয়ে মেয়েকে ধরতে না পেরে নিজের সিটবেল্ট খোলা শুরু করলো। দীপ্তি তামান্না ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমেছে দেখে দীপ্তি কিছুটা গিয়ে আবার তামান্নার কাছে ছুটে এলো। এই বাচ্চা মেয়েটার এতো ছুটোছুটির কারণ তামান্না কিছুই বুঝতে পারছে না৷ তবু দীপ্তি ওর দিকে ছুটে আসায় মিষ্টি করে হাসলো তামান্না।
-মিস মিস?? ব্যাগে চকলেটগুলে আছে না? দাও না? ওই বউটাকে দিয়ে দিব। ওই যে দেখো?? আজও এসেছে----।
দীপ্তির কথাটা শুনে আর দীপ্তির ইশারায় দেখানো ডিরেকশন বরাবর তাকিয়ে কিশোর আর তামান্না দুজনেই থমকে তাকিয়ে রইলো। দুজনেরই চিনতে অসুবিধা হলো না যে দীপ্তি যার কথা বলছে সে আর কেউ নয় সুপ্তি।