সবুজ কাজলের কৌটো - পর্ব ০৪ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৭!! 

একদম কাছে এসে আলতো করে মায়রার মুখটা দু হাতে তুলে ধরলো আয়ান। মায়রা মিষ্টি করে হেসে আয়ানের দিকে তাকাল। অনেকক্ষণ পরে মানুষটাকে দেখে এখন শান্তি শান্তি লাগছে ওর। বুকের ভেতরের ঝড়টা এতোক্ষণে থেমেছে। আর সাথে রাগটাও পড়ে গেছে। অসম্ভব রকমের সুন্দর লাগছে আয়ানকে আজকে। সন্ধ্যায় গোল্ডেন কালারের পাঞ্জাবি পড়েছিল। আর এখন রয়েল ব্লু কালারের ডিজাইন করা নেভি ব্লু কালারের পাঞ্জাবি পরনে।। কালারটা অসম্ভব মানিয়েছে আয়ানকে। আয়ানের ফর্সা গালের উপর লাল আভা ছড়িয়েছে। ঠোঁটের কোণে হাসিটার কারণে গালের এক পাশে আলতো করে টোল পড়েছে।। মিষ্টি লাগছে দেখতে। আর ওর চুল??! চুলের স্টাইলটার জন্য আরো বেশি কিউট লাগছে আয়ানকে।। মায়রা তো ড্যাবড্যাব করেই আয়ানকে দেখছে।।

আর আয়ান!!?? সে বেচারা তার নীল পরীর সৌন্দর্য বর্ণনা করার মতোও ভাষা পাচ্ছে না। তার পরীটাকে সাজলে যে এতোটা ভালো লাগবে সেটা বোধ হয় তার কল্পনারও বাইরে ছিল।। অবশ্য কিছুক্ষণ পরে সামলেও নিল নিজেকে। তার আজ বহু কাজ।। আয়ান আলতো করে মায়রার কপালে ভালোবাসার পরশ দিল। তারপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা গোল্ড চেইন বের করলো। লাভ শেইপের একটা লকেট দেয়া চেইনের সাথে।। চেইনটা মায়রার গলায় পড়িয়ে দিল।। মায়রাকে ইশারায় দেখালো লকেটটা দেখতে। মায়রা লকেটটা নাড়িয়ে চাড়িয়ে-ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। ডিজাইনটা সুন্দর।। ছোট ছোট বেশ কয়েকটা পাথর বসানো লকেটে। মায়রার দেখার স্টাইল দেখে মুখ টিপে হাসল আয়ান। মেয়েটা সারাজীবন এভাবে বাচ্চাই থেকে যাবে!!??

-সুন্দর হয়েছে খুব-----।।

-তাই?? আচ্ছা বলো তো---?? এই লকেটটার মধ্যে স্পেশাল কিছু একটা আছে-সেটা কি!!??

মায়রা ভ্রু কুঁচকে আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লকেটটা দেখতে লাগলো। স্পেশাল কিছু একটা আছে!!? কি হতে পারে!!? লাভ শেইপটা স্পেশাল হতে পারে!! আর কি!!? মায়রা ভাবছে আর আয়ান সেটা দেখে এবার শব্দ করেই হেসে ফেলল।। মায়রা ভ্রু কুঁচকে আয়ানের দিকে তাকাল।।

-হাসির কি হলো!!??

-হায়রে পাগলীটা!!! দাঁড়াও দেখাই---।।

আয়ান হালকা করে লকেটটাতে প্রেস করতেই লকেটটা দুটো পার্টে আলাদা হয়ে গেলো।। সেখানে একপাশে মায়রার হলুদের রাতের হাসিমাখা ছবি আর অন্যপাশে আয়ানের একটা ছবি।। মায়রা অবাক চোখে একবার আয়ানকে আর একবার লকেটটাকে দেখছে। আয়ান মায়রার মুখের ভঙ্গি দেখে আবার শব্দ করে হেসে ফেলল। আয়ানের এতো কাছে এসে পড়েছে মায়রা সেটা এতোক্ষণ খেয়ালই করে নি। একটু সরে এসে লকেটটার দুটো পার্টকে চাপ দিতেই আবার লাভ শেইপে ফিরে এলো।। আয়ান তখনো আয়ান হেসেই যাচ্ছে তো যাচ্ছে।।
এবারে একটু বিরক্ত হলো মায়রা।। ওকে নিয়ে এতো হাসির কি হলো!! একটা মানুষ একটা জিনিস না ই জানতে পারে!! স্বাভাবিক না ব্যাপারটা!! তাই বলে এতো হাসতে হবে!?

-এতো হাসির কি আছে!!?

-হয়নি বউটা--।। ঠিক করে বলো---। 

-কি ঠিক করে বলবো!!??

-বলো যে,ওগো তুমি এতো হাসছো কেন!

-খারাপ একটা!!!!

মায়রা লজ্জা পেয়ে উল্টো দিকে ঘুরতেই আয়ান একটু শক্ত করেই ওর হাতটা টেনে ধরলো।। তারপর আঙুলে একটা আংটি পড়াল। আংটি পড়াচ্ছে বুঝতে পেরে মায়রা আয়ানের দিকে তাকাতেই অবাক হলো।। আয়ান হাঁটু গেড়ে বসে মায়রার একটা হাত ধরে আছে।। 

-মায়রা?? আজকে কতো তারিখ জানো?

-হুম?? ১৬ই সেপ্টেম্বর--।।

-আজকে কি মনে আছে!??

লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়ল মায়রা। গতবছর আজকের দিনে আয়ান মায়রাকে "ভালোবাসি" কথাটা বলেছিল। মনে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো মায়রা।।

-মায়রা?? তুমি কি আমার সত্যিকারের পিচ্চি বউ হবে?? সকাল সকাল আমার দুষ্টুমিতে তোমার ঘুমটা ভাঙানোর অনুমতি দিবে?? অথবা কাজের শেষে বাসায় ফিরলে ছুটে এসে বুকে মুখ লুকাবে?? অথবা আসতে দেরি হয়ে গেলে- বকা দিবে বা তাথৈয়ের মতো দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে কানে ধরে ওঠবস করাবে --।। ছুটির দিনগুলোতে দুজনে ছাদে শুয়ে শুয়ে রাত জেগে তারা গুনবো আমরা।। কখনো সন্ধ্যায় দুজনে বারান্দায় বসে এক মগে করে কফি খাবো।। বা দুপুরে তুমি রান্না করবে-আর আমি তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখবো।। অথবা কখনো সকাল সকাল বলবো-চলো আজ কোন কাজ নয়-ছুটি। সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে রাত করে বাসায় ফিরে ক্লান্ত আমি তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়বো--।। কি গো?? সারাজীবনের জন্য আমার ছোট্ট নীল পরী বউটা হবে???!!

মায়রা অবাক চোখে আয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে এখনো।। কি বলবে ভাষা পাচ্ছে না। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে কান্নাটা সামলানোর চেষ্টা করছে প্রচন্ডভাবে।। তবুও কান্না এসে চোখ মুখ ঝাপসা করে দিলো।। আয়ান উঠে এসে মায়রার চোখ মুছে দিল। আর মায়রা আয়ানের বুকে মুখ ডুবিয়ে ছোট্ট করে -"হুম" বললো।। 
আয়ান আবার মায়রার মুখটা তুলে ধরলো। 

-কাঁদাতে চাই নি লক্ষীটা। সরি?? অনেক অনেক ভালোবাসি---।। 

-কংগ্রাচুলেশনস ব্রো----।।৷

আশপাশ থেকে অনেকগুলো হাততালির শব্দ হতেই মায়রা একটু সরে এলো।। আয়ান হেসে মায়রাকে একটু নিজের কাছে টেনে নিয়ে হাসল।।

-থ্যাংক ইউ গাইজ---।

রিহানের সবগুলো কাজিন মায়রা আর আয়ানকে ঘিরে আছে। 

-ভাইয়া তোমার প্রপোজটা একদম জোস ছিল--।। আমরা কবে এমন করে প্রপোজ করতে পারবো!!?? 

-আগে তো বড় হ ফাজিল ছেলে----।।

-মায়রা আপু কিন্তু আরো কিউটি---।।

- না না--।। মায়রা আপু--।৷ আমরা সবাই কতো কষ্ট করে ডেকোরেট করলাম. তুমি একটু থ্যাংকস ও দিলা না---।।

-ভাইয়া--।। আপু তো রাজি হয়ে গেছে-। এবার বিয়েটা করে ফেলো---।।

-ভাইয়া কালকে বড় করে ট্রিট দিবা আমাদের সবাইকে---।। 

সবাই সব দিক থেকে কথা বলছে আর আয়ান মুচকি মুচকি হাসছে। আর এদিকে মায়রার পাগল হয়ে যাওয়ার দশা। আয়ানের সাথে এরা সবাই এতো ফ্রি!!?? একটু অতিরিক্তই ফ্রি না?? ভাইয়ের বন্ধুর সাথে??!!

সবার চাপাচাপিতে আয়ান শেষে রাজি হলো সময় করে বড়সড় একটা পার্টি দিতে। আর বাকিরাও ওদেরকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে যে যার মতো চলে গেলো।। মায়রা একটা চেয়ারে এসে বসেছে। মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরছে ওর। আয়ান হঠাৎ এখানে কি করে! রিহান ভাইয়ার সব কাজিনরা আয়ানের সাথে এতো ফ্রেন্ডলি!! কাহিনীটা কি!! আয়ানের জন্য রুম ডেকোরেট করে দিলো সবাই মিলে!! আজীব না?? আর এতো প্রপোজ করে ফেললো অথচ ওর ফ্যামেলির কাউকেই মায়রা দেখলোই না!!

আয়ান মায়রার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে ওর চিন্তিত মুখটা দেখছে। চিন্তা করলে মায়রার মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়।। ভ্রু কুঁচকে থাকে। কখনো দাঁতে নখ কাটে- বা কখনো নখ খুঁটাখুঁটি করছে মাথা নিচু করে।। আর কখনো এক হাত দিয়ে অন্য হাত শক্ত করে ধরে আছে। 

-পরী--।সারপ্রাইজ কেমন লাগলো??

-হুম??!!

-সারপ্রাইজ কেমন লাগলো আমার পরীটার??

-কারো সারপ্রাইজের চক্করে আমি তো হার্ট এ্যাটাক করে নইলে গাড়িতে এক্সিডেন্ট করেই মরে যেতাম---।।।

-এক্সিডেন্টের কথা-মরে যাওয়ার কথা--। এসব ছাড়া কথা নাই তোমার কোন?? মনে চাচ্ছে কষিয়ে দুইটা থাপ্পড় দিতে এখন-----।।।

-আমি তো-----।।।

মায়রা আয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা আর শেষ করতে পারলো না। রাগে চোখ লাল হয়ে গেছে আয়ানের। তাই আপাতত চুপ থাকাই ঠিক মনে হলো মায়রার। বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো দুইজন।। মায়রা ঢোক গিলল। কি জন্য আয়ান এতো রেগে গেছে কিছুই মাথায় আসছে না। বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছে নাকি সে!!?? মরে যাওয়ার কথাটা তো এমনি দুষ্টুমি করে বলেছিল।। এতো রাগার মতো কি ছিল সেটা মায়রার মাথায় ঢুকলো না।। তার উপরে খারাপ লোকটা দুইটা থাপ্পড় দিবে বলেছে। ভিষণ মন খারাপ হচ্ছে মায়রার। চোখ ছলছল করে উঠছে। কিন্তু আয়ানের সামনে কান্নাকাটি করলে ওর মন খারাপ হবে না??!! 

-সরি মায়রামনি----।।

আয়ানের সরি বলা শুনে মায়রা এবার ফুঁপিয়ে উঠলো একটু। আয়ান চেয়ার ছেড়ে উঠে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে এক হাতে মায়রার মুখটা তুলে ধরে অন্য হাতে নিজের এক কান ধরলো।। মুখটা একটু করুণ করুণ ভাব করে সরি বললো। আর মায়রা আয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।।  তারপর কি মনে হতে তাড়াতাড়ি আয়ানকে টেনে তোলার চেষ্টা করলো।। 

-উঠুন না?? 

-সরি তো বউটা???

-হুম--।। বুঝছি তো৷  ইট’স ওকে।। উঠুন??

-ওকে ওকে হলে উঠুন উঠুন করছো কেন??

-ওওপপসস।। উঠো না???

আয়ান উঠে দাঁড়ালো।। মায়রার মুখটা একটু তু্লে দিয়ে চোখে চোখে রাখল।।

-সরি--।। কিন্তু আর এমন কথা কক্ষনো বলো না প্লিজ---।। 

মায়রা মনে মনে চিন্তা করলোঃ- মরে যেতাম বলেছি-। মরি নি তো?! এভাবে বকার কি ছিল!! হুদাই--!!

-মায়রা?? একটা জায়গায় যাবে আমার সাথে??

-এ-এক-এখন!!!??

মায়রা দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করছে। এখন বাজে এগারোটা। যদিও আয়ানকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভরসা করে। কিন্তু এতো রাতে আয়ানের সাথে যাবে কিনা!! আর সেটাও কাউকে ন বলে!! ব্যাপারটা কি ঠিক হবে!!???

আয়ান মায়রার কপালের উপরে এসে পড়া এক গুচ্ছ চুল কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে আলতো করে ঝুঁকে কপালে চুমো খেল।। 

-আচ্ছা ঠিক আছে পরীটা--।। তুমি অনেক টায়ার্ড--।। রুমে যাও--।। গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো কেমন???

-হুম??

-সকালে দেখা হবে পিচ্চিটা।। যাও???

মায়রা কি করবে ভাবতে ভাবতে হাঁটতে লাগলো। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। তারপর যে রুমে থাকবে সেটার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। পিছনে ঘুরতেই দেখলো আয়ান বেরিয়ে যাচ্ছে।। আয়ানকে ডাকল কয়েকবার। আয়ান দাঁড়ালো না।। হয়তো শুনতে পায়নি। কি ভেবে মায়রা পড়িমরি করে ছুট লাগাল। সোজা বাইরে এসে আয়ানকে খুঁজতে লাগলো মায়রা। দেখলো আয়ান গাড়িতে বসা।। ছুটে এসে গাড়িতে বসলো মায়রা।। আয়ান ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে।। মায়রা একটু মাথা নাড়িয়ে দম নিয়ে নিলো।।

-এতো ছুটে আসলে কেন??!!

-কোথায় যাচ্ছি আমরা???

-হুম??!!

-কোথায় যাচ্ছি.??!!

-তোমার শ্বশুরবাড়ি --।।। যাবে???

-হুম----।।।

-বাবা-মা আর তিথিকে পিচ্চি বউটা দেখাতে হবে না???

প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া ব্যাপারটায় অনেক এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে মায়রার মধ্যে।। তবে এতো রাতে গেলে কি ভাববেন উনারা সবাই!!? তবুও আয়ানের সাথে পৃথিবীর যেকোন জায়গায় যেতে রাজি আছে মায়রা। চোখ বুজে আয়ানের সাথে পথ চলতেও রেডি মায়রা।।

০৮!! 

আয়ান ড্রাইভিং করছে আর মায়রা পাশে চুপ করে বসে আছে। একটু যে ভয় লাগছে না সেটাও না। তবে ফিলিংসটা অন্যরকম। রাত এগারোটার কিছুটা বেশি। এমনিতেই ১০ টার পরে রাস্তা প্রায় ফাঁকাই থাকে। এইসময় রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। দু-একটা গাড়ি ক্রস করছে পাশ দিয়ে শা শা করে। সেটাও বেশ লাগছে মায়রার। এতো রাতে খুব একটা বের হওয়া হয় না। তাই আরো বেশি মজা লাগছে। কখনো গাড়ির জানালার বাইরে হাত দিয়ে বাতাসের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে এমন একটা ভাব করছে। কখনো চোখ মুখ বন্ধ করে বাতাসের গন্ধ শুঁকছে। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে।। কখনো দুষ্টুমি বাদ দিয়ে আড় চোখে আয়ানকে দেখছে। 

আয়ানটা গুম মেরে বসে আছে দেখে মায়রারও চুপ করে রইলো।। ভাবলো মায়রার ছেলেমানুষিতে বিরক্ত হচ্ছে বা রাগ করছে। কিন্তু মুখটা দেখে মনে হচ্ছে না রাগ করেছে বা বিরক্ত হয়েছে। মুখটা থমথমে হয়ে আছে ওর। কিছু একটা বলবে মনে হচ্ছে। মায়রার দিকে ফিরছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বলছে না। মায়রার একটু একটু চিন্তাও হচ্ছে আয়ানের গম্ভীর মুখটা দেখে।। আয়ানের হাতের উপর আলতো করে হাত রাখলো মায়রা। আয়ানের চোখে মুখে এক ধরনের বিষন্নতা খেলা করছে।। অন্যরকম একটা ব্যথা চোখের চাহনিতে।৷ তাকাচ্ছে একবার। আবার পরক্ষণেই চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

-কি হয়েছে তোমার?এমন করছো কেন??

-কিছু হয়নি মায়রা---।।

-বলো না???

-সত্যি কিছু হয় নি পাগলীটা--।।

 আয়ান আলতো করে মায়রার কপালে চুমো দিয়ে আবার গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিল। আয়ানের মাথার মধ্যে কিছু একটা চলছে। কিন্তু সেটা মায়রা কিছুতেই ধরতে পারছে না।। আয়ানের থমথমে মুখ দেখে মায়রার প্রচন্ড রকমের খারাপ লাগছে। দেখতে দেখতে একটা বিশাল বাংলো টাইপের বাড়ির গেইট দিয়ে গাড়িটা ভিতরে ঢুকালো আয়ান। মায়রা অবাক চোখে বাড়িটা দেখছে। বেশ সুন্দর দেখতে বাড়িটা।। এতো রাতেও চাঁদের আলোর মতো জ্বলজ্বল করছে।। কিন্তু কোথায় জানি একটা শূন্যতা রয়ে গেছে বাড়িটাতে। বাড়িটাকে দেখলে এক দিকে ভালো লাগছে-অন্যদিকে বুকের ভেতরটা কেমন এক অজানা ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে মায়রার। ততক্ষণে আয়ান এসে গাড়ির দরজাটা খুলে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মুখে জোর করেই যেন একটা হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।।

-এসো পরীবউ???

-হুম---।।

আয়ান মায়রার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে বাড়ির ভেতরে না হেঁটে বাড়ির পিছনে বাগানের দিকে হাঁটা শুরু করলো। 

-কোথায় যাচ্ছি???

আয়ান কিছু বললো না। একসময় থেমে গেল। মায়রার হাতটা ছেড়ে আরো একটু সামনের দিকে এগিয়ে এলো। মায়রা পিছনে দাঁড়িয়ে জায়গাটা দেখার চেষ্টা করছে। বাগানের এক পাশের কোণার অংশ এটা। বেশ অনেকগুলো জবা আর রজনীগন্ধার গাছ। তারই একটু সামনে তিনটা ঢিবি মতো জায়গা।। দুটো একটু বড়।। আর একটা তুলনায় ছোট। আয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঢিবিগুলোর সামনেই বসে পড়লো। 

-তিথি?? ঘুমিয়ে গেছিস বনু?? তোর ভাবিকে দেখবি না?? তোর মতোই পিচ্চি একটা পুতুল ভাবি এনেছি তোর জন্য--। 

আয়ানের গলাটা কাঁপছে। মায়রা এসে আয়ানের পাশেই বসে পড়লো। আয়ানের একটা বাহু এক হাতে জড়িয়ে ধরলো।। আয়ান আলতো করে অন্য হাতে মায়রার চোখ মুছে দিল।।

-কাঁদছো কেন পাগলি?? দেখো এটা আমার বাবা-এটা মা--। আর এই যে মাঝের পিচ্চিটা তিথি--।। আমি পিচ্চি তিথিটা----।। জানো তোমাকে তিথির খুব পছন্দ হয়েছে--?? তাই না রে তিথি?

-আয়ান??? এটা কি করে---??

-সরি মায়রা---। আমি তোমাকে দুম করেই এখানে নিয়ে এলাম। অনেকক্ষণ ধরে বলার চেষ্টা করছি---।।।

আয়ানের চোখের পানি মুছে দিয়ে আয়ানের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে কবরগুলো দেখছে মায়রা। আয়ানের পরিবার এখন মায়রার সামনে৷ কতো কিছু ভাবছিল মায়রা। মা-বাবা-বোন। কে কি ভাববে? কি বলবে?? কিভাবে মায়রা সবার মনে একটু ঠাঁই করে নিবে!!?!?

-জানো মায়রা?? ছোট বেলায় তিথি আর আমার সম্পর্কটা ছিল একেবারে সাপেনেউলে যাকে বলে। বাবা মা আমাকে একটু বেশি আদর করলে ও খেপে যেত- আর ওকে বেশি আদর করলে আমি--। 

-কি হয়েছিল সবার???

-একটা এক্সিডেন্ট--।। আর সব শেষ। তিথির ওইদিন ফার্স্ট স্কুল ছিল--।। কয় বছর হবে তখন ওর?? চার-সাড়ে চার?! এইরকম।। ও কিছুতেই আমাকে সাথে নিবে না।। আর বাবা মা দুজনেই যেতে হবে--।। ওইদিন এতো রাগ হয়েছিল আমার!! বলেছিলাম-জীবনেও আর কথা বলবো না কারো সাথে--।। দেখো?? সবাই তাই রাগ করে একবারেই আমাকে ছেড় চলে গেলো----।। 

----------------------

-আমাকে রিহানের বাসায় রেখে গিয়েছিল বাবা মা।। রিহানের আব্বু আর বাবা বিজনেস পার্টনার ছিল। সাথে খুব ভালো বন্ধুও।।------একটা রড ভর্তি ট্রাক রং সাইড থেকে এসে গাড়িটাকে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়--।। আর সব শেষ----।। রিহানরা সবাই মিলে সামলেছে আমাকে। আমার প্রতিটা প্রয়োজন পূরণ করেছে জানো?? রিহান থেকেও আমাকে বেশি ভালোবেসেছে আঙ্কেল আন্টি---।।

-আয়ান???

-তিথিটা এখন আর রাগ করে থাকে না জানো?? আমার সাথে কথা বলে।। এখানে পড়ে থাকতাম বলেই আঙ্কেল আন্টি আমাকে দেশের বাইরেও পাঠিয়ে দিয়েছে। এতোগুলো বছর পরে ফিরেও এখনো প্রায়ই এখানে চলে আসা হয়----।।।

-কেঁদ না প্লিজ???

-কাঁদছি না রে পাগলি---।। মা-বাবা যেখানেই আছো ভালো থেকো তোমরা।।  খুব ভালো থেকো---।। 

মায়রা আয়ানের হাতটা ধরে চুপ করে বসে রইলো। এভাবে কতোক্ষণ কাটলো কে জানে!! বেশ অনেকক্ষণ পরে আয়ান একটু স্তম্ভিত ফিরে পেল। আলতো করে মায়রা হাতটা চেপে ধরলো।। আলতো করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল।। 

-সরি গো--।৷ পরীটার মন খারাপ করিয়ে দিলাম না?? সরি??

-উহু---।।

-মায়রা চলো এবার উঠি---।। অনেক রাত হলো।। আর ঠান্ডাও পড়ছে--।।

মায়রা আয়ানের মুখের দিকে তাকাল। এখন অনেকটাই নরমাল হয়ে এসেছে আয়ান। মুখের গম্ভীর ভাবটা এখন আর নেই। তবে কৃত্রিম একটা হাসি ঝুলে আছে ঠোঁটের কোণে।। আয়ান উঠে দাঁড়িয়ে মায়রাকে টেনে উঠালো।। 

-চলো না?? দেরি হয়ে যাচ্ছে--। ফিরতে হবে তো পিচ্চি???

আয়ান একটু এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরে দেখলো মায়রা জায়গা থেকে এক পা ও নড়ে নি।। আয়ান আবার এসে মায়রার মুখটা তুলে ধরলো।।

-কি গো?? কি ভাবো???

-আমি শ্বশুরবাড়িটা দেখবো না???

-হুম????

মায়রা ইশারায় বাড়িটা দেখালো। এবার আয়ানের ঠোঁটের কোণের মিষ্টি একটা হাসি ফুটে উঠলো।।

আয়ান মায়রাকে বাড়ির দরজায় দাঁড় করিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। কিছু একটা নিয়ে আবার ছুটে এলো তাড়াহুড়ো করে। মায়রা চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে।। সেটার জবাব না দিয়ে আয়ান পাঁজাকোলা করে মায়রাকে তুলে নিলো। মায়রাও আয়ানের ঘাড়ে হাত ঝুলিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে এদিক ওদিক দেখতে শুরু করেছে। বাড়িটাতে কেউ থাকে না অথচ সব সুন্দর করে সাজানো গোছানো। এর কারণটা মায়রা বুঝতে পারলো না। তার উপর ড্রইং রুমটা বেশ সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো। জবা আর গোলাপ দিয়ে ঘর ভরা।। আর রজনীগন্ধার স্টিক দেখা যাচ্ছে ফুলদানিতে। ফুলের গন্ধে ঘর মো মো করছে।। এতো এতো ফুল!! কেন!!?

আয়ান আলতো করে মায়রাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজে ফ্লোরেই বসে পড়লো।। মায়রার কোলে মাথা রেখে চুপ করে রইলো অনেকক্ষণ।। মায়রা কি করবে ভেবে না পেয়ে আস্তে আস্তে আয়ানের চুলে হাত বুলাচ্ছে। মানুষটার কি এখনো মন খারাপ!!? বেশ অনেকক্ষণ পর আয়ান মাথা তুলে মায়রার দিকে তাকালো। আস্তে করে মায়রার হাতে একটা চাবির গোছা ধরিয়ে দিলো।। মায়রা একবার চাবির গোছাটা দেখছে আর একবার আয়ানকে। কি হলো ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। কি জিজ্ঞেস করবে সেটাও মাথায় আসছে না। তাই চুপ করে বসে চাবিরতোড়াটা নাড়িয়ে টুংটাং করে আওয়াজ তুলতে লাগলো।  আয়ান হেসে মায়রার পাশে সোফায় বসে মুখটা দু হাতে তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো।

-আজ থেকে এই বাড়ি- এই বাড়িটার আপাতত শেষ সদস্য সবার দায়িত্ব তোমার। চাবিটা তোমার কাছেই রাখো-। চাইলে মানুষটাকেও সাথে রাখতে পারো---।।

আয়ান কথাটা বলেই হাসল।। মায়রা লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিতে চাইলো।। কিন্তু আয়ান দুহাতে ধরে রাখা মুখটা নামাতে দিলো না।

-জানো পরী?? আমি জানতাম তুমি আসবে।। তাই ওই বাড়িতে সবাইকে ডেকোরেশনের কাজে লাগিয়ে এখানে নিজ হাতে ডেকোরেট করেছি৷  ফুল তো বাগানেই ছিল।। তাই ঝামেলা হয় নি--।

মায়রা আয়ানের দিকে অবাক চোখেই তাকিয়ে রইলো। কি বলবে এবারও বুঝতে পারলো না। তাই চুপ করেই রইলো। আয়ান আবার একটু হাসলো।

-কেমন লেগেছে শ্বশুরবাড়ি পরী বউটার?

-ভিষণ ভালো লেগেছে--।।

-চলো পরী--।। বাড়ি যাবে না??

-আমি বাড়িটা ঘুরে দেখবো না??

-মাথা গেছে??? কয়টা বাজে???

-না না--।। আর একটু দেরি হোক--।।

-আচ্ছা বাবা-চলো---।।

মায়রা উঠে আগে আগে হাঁটছে আর পিছনে আয়ান। দোতলায় উঠার সিঁড়ির কাছে আসতেই আয়ান আবার মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।৷ মায়রা হেসে আবার আয়ানের গলা জড়িয়ে ধরলো।। সারা বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালো। তারপর সোজা বাড়ির দরজায় নিয়ে নামালো মায়রাকে।। মায়রা আর আয়ান দুজনেই গাড়িতে উঠে বসলো। আয়ানের মুখটাতে আবার গম্ভীর ভাবটা আসছে।। মায়রার দিকে ফিরে হাসার চেষ্টা করলো জোর করে।।।

-মায়রা--।। কখনো মরে যাওয়ার কথা বলবে না আর।। সবাইকে হারিয়েছি আমি। মা-বাবা-বোন-সবাইকে।। এবার তোমাকে হারালে আমি মরেই যাবো--।।

-এসব বলবে না একদম বলে দিলাম--।

আয়ান আর কিছু না বলে মুখ নামিয়ে সিট বেল্ট বাঁধছে।। মায়রা কি ভেবে আয়ানের একদম কাছে চলে এলো। 

-আয়ান???

-হুম???

ডাক শুনে মুখ তুলতেই যা ঘটলো তার জন্য আয়ান মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। মায়রা আলতো করে আয়ানের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়েছে।। কি হলো বুঝতে আয়ানের কিছুক্ষণ লাগলো।। মায়রা সরে আসার চেষ্টা করতেই আয়ান মায়রাকে একটু টেনে ধরে ঠোঁটে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিয়ে ছাড়ল।। তারপর ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ফুটিয়ে আয়ান মায়রাকে দেখতে লাগলো।। মায়রা কাজটা কেন করলো নিজেও জানে না।। এখন লজ্জায় লাল হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।। আয়ান হেসে গাড়ি স্টার্ট করলো।। 

-মায়রা?? ভাবছিলাম প্রথমবার শ্বশুড়বাড়ি এসেছো--। খালি মুখে ফিরে যাবে--।। ব্যাপারটা কেমন দেখায়---। তবে নিজেই ব্যবস্থা করে ফেললে---।।

মায়রা আয়ানের বুকে আলতো কিল দিল।

-খারাপ একটা!!!

-কেউ কিছু করলেও খারাপ না-আর আমি বেচারা বললেই খারাপ---।। কি কপাল আমার!!!!

মায়রা লজ্জায় শেষ। তাই চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। আয়ানও আর ওকে ঘাটালো না। অনেক ধকল গেছে সারাদিন মেয়েটার ওপর দিয়ে---।। রিহানদের বাসায় এসে দেখলো মায়রা চুপ করে আছে।। হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। আয়ান আলতো করে কোলে করে নিয়ে রুমে শুইয়ে দিলো মায়রাকে। দরজাটা খোলা থাকবে চিন্তা করতেই আয়ানের ঠোঁটের কোণে বাঁকা একটা হাসি ফুটে উঠলো। রুমের দরজাটা একটু টেনে নিজের রুমে চলে এলো।। 

আর এদিকে আয়ান রুম থেকে বের হয়ে যেতেই মায়রা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।৷ জেগে আছে বুঝলেই আবার জ্বালাতন শুরু করতো মানুষটা--। কি যে করে!! টুং করে একটা মেসেজের সাউন্ড শুনে মোবাইলটা হাতে নিয়েই দেখলো আয়ানের মেসেজ। 

"পিচ্চি-দরজা লক করে ঘুমাও।। হুট করে কে চলে আসে মিষ্টি খেতে বলা যায় না তো।। আর কোলে চড়ার ইচ্ছে হলে সোজা বললেই তো পারতে। ঘুমের নাটকটা করার কি ছিল??আচ্ছা কালকে আবার কোলে করবো পাগলিটা।। এখন ঘুমাও।।"

মেসেজটা পড়েই জিভ কাটলো মায়রা। ধরা পড়ে গেছে।।ছুটে গিয়েই দরজাটা আটকে দিলো মায়রা।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন