মায়াবতী (পর্ব ০২)


০৩!! 

নিজের রিস্টওয়াচে সময়টা দেখে নিলো রাহাত। প্রায় এগারোটা বাজতে চলেছে। এই মূহুর্তে বি.এস.এম কোম্পানির বিশাল ওয়েটিং রুমে বসে আছে রাহাত আর মায়া। বড্ড বেশিই বিরক্ত লাগছে রাহাতের। সাড়ে দশটার সময় মিটিংটা হওয়ার কথা ছিল। প্রজেক্টটা নিয়ে ডিসকাস করতেই যদি তাদের হাতে সময় না থাকে তাহলে এদের সাথে কাজ করবে কি করে রাহাত? সময়ের প্রতি এতোটা উদাসীন একটা কোম্পানির সাথে কাজ করতে হবে চিন্তা করতেই রাহাতের রাগ হচ্ছে। কেন যে গাধার মতো কোনো খোঁজ খবর না নিয়েই এদেরকে নিজের প্রজেক্ট প্রপোজালটা পাঠাতে গেছে কে জানে! এখন নিজের গাধামির শাস্তিও টের পাচ্ছে। রাহাত আরেকবার বিরক্ত হয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো। কাটায় কাটায় এগারোটা বাজে দেখে চোখ মুখ লাল হয়ে গেল রাহাতের। ওদের সময়েরই দাম আছে, আর কারো সময়ের দাম নেই নাকি? কথাটা ভেবেই রাহাত মায়ার দিকে রাগী চোখে তাকালো।

-আর কতোক্ষণ এভাবে গাধার মতো বসে থাকবো আমরা মায়া? চলো? অনেক হয়েছে। এভাবে মিটিংয়ের নামে ডেকে এনে ইনসাল্ট না করলেও পারতো--।

-স্যার? হয়তো উনাদের কোনো প্রবলেম হয়েছে।

-জাস্ট শাট আপ মিস মায়া। একটা কথাও বলবা না আর। আর এদের হয়ে সাফাই তুমি দিতে এসেছ কেন? তুমি ওদের পি. এ নাকি আমার? কি হলো চুপ করে আছো কেন? বলো?

-আপ-আপ-আপনার পি.এ স্যার। 

-তাহলে আমার অর্ডার ফলো করো। ভেবেছিলাম এই প্রজেক্টটা ভালোভাবে কমপ্লিট করতে পারলে এই কোম্পানির সাথেই আমার ড্রিম প্রজেক্টটা নিয়ে কাজের প্রপোজাল দিবো। এখন তো দেখছি আকাশ কুসুম ভেবে বসে আছি আমি। এই মূহুর্তেই আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি--। গট ইট?

-ইয়েস-ইয়েস স্যার---।

- নাকি তোমার ইচ্ছে আছে আরো কিছুক্ষণ থাকার? কাজ টাজ তো করতে হচ্ছে না কিছু। এখানে বসে বসে বেশ টাইমপাস হয়ে যাচ্ছে তোমার--।

-না স্যার---। চলুন--। এক সেকেন্ড স্যার? আমম আমি রিসেপশনে বলে আসছি---।

-মায়া? কি হয়েছে তোমার?

-জি স্যার? কই কিছু হয়নি তো?

রাহাত এতোক্ষণে খেয়াল করলো মায়ার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। চোখ জোড়ায়ও কিসের একটা ক্লান্তির ছাপ দেখা দিয়েছে। কিন্তু রাহাত বুঝতে পারছে না মেয়েটার হুট করে কি হলো!

-মায়া? তুমি ঠিক আছো? তোমাকে এতো টায়ার্ড দেখাচ্ছে কেন?

-আমমম। না স্যার। তেমন কিছু না। আমি রিসেপশনে কথা বলে আসছি। এক মিনিট বসুন আপনি?

-তোমার যেতে হবে না। তুমি বসো। আমিই বলে দিচ্ছি। এক কাজ করো। তুমি গাড়িতে গিয়ে বসো ততক্ষণ--।

-না স্যার। আমি একদমই ঠিক আছি। আমার ডিউটিটা আমাকেই করতে দিন প্লিজ? আপনি বসুন না স্যার? আমি দু মিনিটের মধ্যেই চলে আসবো---। 

রাহাতকে আর কিছু বলতে না দিয়ে মায়া রিসেপশনের দিকে পা বাড়িয়েছিল। রাহাতও কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে নিজেও মায়ার পিছু নিলো। মেয়েটার শুকনো মুখটা দেখে রাহাতের একদমই ভালো লাগছে না। কি হয়েছে মেয়েটা বলছেও না কিছু। তাতে রাহাতের প্রচন্ড রকমের রাগ হচ্ছে মায়ার উপরে। রাহাত রিসেপশনে এসে মায়ার ঠিক পিছনে এসে দাঁড়াতেই দেখতে পেল রিসেপশনিস্ট মেয়েটা কিছুটা চমকে উঠে দাঁড়িয়ে মায়ার ডেস্কে রাখা হাতটা ধরে ফেলেছে। রাহাত কিছু বুঝে ওঠার আগেই মায়া কিছুটা এলিয়ে পড়লো রাহাতের বুকের উপরে। রাহাতও দেরি না কর মায়াকে ধরে ফেলেছিল বলে মায়া পড়ে যায় নি। রাহাত এবারে মায়ার গালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে ডাকলো কয়েকবার নাম ধরে। মায়া কিছু শুনতে পাচ্ছে বলেও রাহাতের মনে হচ্ছে না। মেয়েটার এভাবে হুট করে কি হলো সেটাই রাহাতের মাথায় ঢুকছে না।

-মায়া? এই মায়াবতী? কি হয়েছে তোমার? কিছু তো বলো প্লিজ? শরীর খারাপ লাগছে? একটা বার অন্তত কথা বলো প্লিজ? কেমন খারাপ লাগছে? 

-স্যার---। ম্যাডামের মনে হয় প্রেশার ফল করছে। উনাকে ওরাল স্যালাইন বা জুস কিছু দিতে হবে। আমি এক্ষুণি ব্যবস্থা করছি।

-ওর কি হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আই থিংক ওকে ডাক্তারের কাছে নেয়াটাই বেটার হবে। আপনি প্লিজ আজকের মিটিংটা ক্যান্সেল করে দিন।

-ওকে স্যার। স্যার আপনার নামটা--?

-রাহাত মাহবুব চৌধুরী। 

-ওকে স্যার। স্যার আপনি চাইলে আমাদের কোম্পানির ডক্টর ম্যামের ট্রিটমেন্ট করতে পারে। উনাকে বেশ ক্লান্ত আর অসুস্থ দেখাচ্ছে---। আমি কি ডক্টরকে খবর দিব?

-ওকে। প্লিজ তাড়াতাড়ি করুন।

-আমাকে দুটো মিনিট সময় দিন স্যার। আমি এক্ষুণি ব্যবস্থা করছি।

রিসেপশনিস্ট মেয়েটা ফোনে কাউকে কল করতে করতে কথাগুলো বলছিলো রাহাতকে। রাহাত মায়াকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজে পাশে বসে মায়ার গাল হাত ছুঁইয়ে দিচ্ছে কখনো, কখনো মায়াকে একটু পানি খাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে, কখনো রাহাত নিজের মিটিংয়ের জন্য আনা ফাইলটা দিয়ে মায়াকে বাতাস করার চেষ্টা করছে। মেয়েটা এমন দপদপ করে ঘামছে যে রাহাত একটু পর পর নিজের রুমাল দিয়ে মায়ার কপালের মুখের ঘামের বিন্দুগুলো মুছে দিচ্ছে। এক একটা মিনিট রাহাতের এক এক বছরের সমান লম্বা মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে। মায়াকে এভাবে একা রেখে রিসেপশনের মেয়েটাকে গিয়ে যে কিছু জিজ্ঞেস করবে সেই উপায়ও নেই রাহাতের। এদিকে মায়ার কোনো হুঁশই নেই। রাহাতের উত্তেজিত চোখ মুখ দেখেও কিছু জিজ্ঞেস করার শক্তি পাচ্ছে না। শুধু কিছুক্ষণ পর পর রাহাতের উদ্বেগী স্পর্শগুলোর মাঝের চিন্তাটুকু টের পাচ্ছে মায়া। রাহাত আরেকবার মায়ার কপাল থেকে ঘাম মুছে দিতেই দুজন লোক এসে রাহাতের সামনে দাঁড়িয়েছে। রাহাত চেয়ার ছেড়ে এসে জায়গা করে দিতেই একজন সেখানে বসে মায়ার হার্টবিট, ব্লাডপ্রেশার এসব চেক করতে শুরু করেছে। রাহাত ভীত চোখে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। এর মধ্যেই রাহাতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা রাহাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।

-সরি মিস্টার রাহাত। উই আর এক্সট্রিমলি সরি। সকাল থেকেই আমাদের এম.ডি স্যারের শরীরটা খারাপ যাচ্ছিলো। একটু আগেই স্যারের এস্থেমার এ্যাটাক হয়েছে। সকাল থেকেই আমরা সবাই তাই স্যারকে নিয়েই ব্যস্ত। আপনার সাথে মিটিংটার কথা একদমই মাথায় ছিল না আমার। সরি ফর দ্যাট। হোপ ইউ ক্যান আন্ডারস্যান্ড।

-ইয়া। মিস্টার খান কেমন আছেন এখন? ইজ এভরিথিং অল রাইট?

-স্যার আগের চেয়ে কিছুটা স্টেবল এখন। রিসেপশন থেকে আপনার মিটিং ক্যান্সেলের কথা বলায় আমার মনে পড়লো আপনাকে জানানো হয় নি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো স্যার আপনাকে। সরি ওয়ান্স এগেইন স্যার। 

-নো নো। ইটস ওকে। মিটিংটা পরে সময় করে করা যাবে। নো প্রবলেম। 

-ইয়া। আই হোপ আপনি আমাদেরকে সেই সুযোগটা দিবেন। স্যার নিজে হয়তো আপনার সাথে কন্টাক করবে। এই ব্যাপারটা জানার পর স্যার নিজেই আসতে চাইছিলেন আপনার সাথে কথা বলার জন্য। বাট ডক্টর পারমিশন দিলেন না। ডক্টর তো আপাতত তিন চারদিন স্ট্রিক্টলি বেড রেস্টে থাকতে বলেছেন স্যারকে। 

-নো প্রবলেম। তাহলে কয়েকদিন পরেই মিটিং হবে না হয়--। ডক্টর? মায়ার কি হয়েছে? কেমন বুঝছেন?

রাহাত মিস্টার খানের সেক্রেটারির সাথে কথা বলতে বলতে বারবার মায়ার দিকে তাকাচ্ছিল। এবারে ডাক্তার মায়াকে একটা ইনজেকশন পুশ করতেই রাহাত কিছুটা চমকে উঠেই ডাক্তারকে প্রশ্নটা করলো। ডাক্তারও একটা প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে রাহাতের দিকে তাকালো।

-মিস্টার রাহাত উনি কি হয় আপনার?

-সি ইজ মাই এ্যাসিটেন্ট। কেন? কি হয়েছে মায়ার?

-দেখুন ঘাবড়াবার মতো কিছু হয়নি। তবে বেশ অনেকদিন ধরেই হয়তো ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করছেন না উনি। হয়তো কোনো কারণে স্ট্রেসের মধ্যে আছে। যার কারণে ব্লাডে সুগার লেভেল মারাত্মকভাবে ফল করেছে। দেখুন ব্লাডসুগার বাড়ানোর জন্য ওষুধ দেয়ার তো কিছু নেই সাধারণত। কিন্তু উনার প্রেশার এতো ফল করেছে যে এই কয়টা ওষুধ নিতেই হবে। আর বেশি বেশি করে খাওয়া দাওয়া করতে হবে। খাওয়া দিয়ে রিকভারি করতে পারলে স্যালাইন পুশ করতে হবে না আশা করি। তবুও যদি এভাবে প্রেশার লো থাকে তাহলে একটা স্যালাইন দিতে হতে পারে। আমি সেটাও প্রেসক্রাইভ করে দিচ্ছি---।

-থ্যাংকস ডক্টর। কতোক্ষণে সেন্সে আসতে পারে ও?

-আমম। শরীরটা বেশি দুর্বল হয়ে আছে উনার। খুব বেশি হলে তিন-চার ঘন্টা লাগবে। তবে ঘুমটা যেন নিজে থেকেই ভাঙ্গে সেটা একটু এসিউর করবেন। 

-ওকে ডক। থ্যাংকস। 

রাহাত মিস্টার খানের সেক্রেটারির সাথে আরেকবার হ্যান্ডশেইক করে মায়াকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে বেরিয়ে এলো অফিস থেকে। ড্রাইভার রাহাত আর মায়াকে এভাবে আসতে দেখেই তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিল। রাহাতও মায়াকে সিটে হেলান দিয়ে শুইয়ে দিয়ে নিজে পাশে বসলো। ড্রাইভারকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলে রাহাত মায়ার মুখের দিকে তাকালো। নিজের উপরেই প্রচন্ড রাগ হচ্ছে এবারে রাহাতের। মেয়েটাকে এই কয়টা দিনে কি পরিমাণ মেন্টাল প্রেশারের উপরে রেখেছে সেটা এখন টের পাচ্ছে রাহাত। আজ সকালেও তো অফিসের আসার পর থেকেই মেয়েটাকে প্রায় দৌঁড়ের উপরেই রেখেছে। মেয়েটা আধো কিছু খেয়েছে কিনা সেটাও একবারের জন্য মাথায় আসে নি ওর। মেয়েটার যদি ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে নিজেকে ক্ষমা করবে কি করে রাহাত? রাহাত এবারে মায়ার একটা হাত আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে মায়ার ঘুমন্ত মায়াবী মুখটার দিকে তাকালো। এবারে একটা কথাই আওড়ালো রাহাত নিজের মনে। 

"প্লিজ মায়াবতী। সুস্থ হয়ে যাও তাড়াতাড়ি। আর কখনো তোমাকে কিছু নিয়ে টেনশন দিবো না প্রমিস। শুধু একবার আবার আগের মতো মিষ্টি হাসিটা ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রেখে চোখ মেলে তাকাও। আর কিছু লাগবে না।"

০৪!! 

মায়া চোখ মেলে রাহাতকে সামনের একটা চেয়ারে বসা দেখে ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করলো। কোথায় আছে কিছুই বুঝতে পারছে না বেচারি। অবশ্য সেটা নিয়ে চিন্তা করারও সময় পেল না মায়া। রাহাতের থমথমে মুখটার দিকে তাকিয়ে আর কিছু চিন্তা করতেই যেন ভুলে গেছে মেয়েটা। রাহাত একনজর মায়ার দিকে তাকিয়ে ল্যান্ডলাইন থেকে কাউকে কল দিয়ে কিছু একটা বলে মায়ার দিকে চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে এলো। দুর্বলতার কারণে উঠে বসতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে শুয়ে ছিল মায়া। তাই এবারে রাহাতকে এগিয়ে আসতে দেখেই মায়া ভয় পেয়ে চোখ বুজে নিল। চোখ বোজা অবস্থাতেই মায়া টের পেল রাহাত আলতো হাতে মায়াকে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। মায়া চোখ বুজে থেকেই টের পেল রাহাত আলতো করে মায়ার মুখের উপরে আসা কয়েকগাছি চুল সরিয়ে দিয়ে কানের পিছনে গুঁজে দিচ্ছে। রাহাতের এমন স্পর্শে মায়ার শরীর বেয়ে যেন একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গ খেলা করে গেল। চোখ মেলে যে রাহাতের মুখের দিকে তাকাবে সেই শক্তিটুকু পর্যন্ত পেল না মেয়েটা।  

-মায়াবতী? তাকাও আমার দিকে?

-হুম?

-হু হা করতে বলি নি তো তোমাকে। তাকাতে বলেছি। চোখ বুজে রেখে তো আর খেতে পারবে না। তাড়াতাড়ি চোখ খোলো। আর হা করো। 

মায়া কোনমতে চোখ মেলে সামনের দিকে তাকাতেই রাহাতের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। রাহাত মায়ার মুখের কাছে এক লোকমা ভাত তুলে ধরে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। মায়া খাবে কি! ভয়েই বেচারির আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড়। এবারে রাহাত মায়াকে ধমক দিয়ে উঠতেই মায়া তাড়াতাড়ি হা করলো। রাহাত মায়ার মুখে ভাতগুলো প্রায় পুরে দিয়ে আরেক লোকমা মাখাতে শুরু করেছে। রাহাতের এমন কাজে মায়া পুরো থতমত খেয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো।

-স্যার আমি নিজেই খেতে পারবো।

-অতিরিক্ত কথা বললে ঠাস করে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিবো মায়া। আমি খাইয়ে দিচ্ছি চুপচাপ খাও। একটাও কথা বলবে না তুমি।

-জি-জি-জি স্যার। 

-না খেয়ে থেকে কি প্রমাণ করতে চাইছিলে তুমি? হ্যাঁ? আমি তোমাকে দু দন্ড শান্তি দিচ্ছি না সেটা? 

-না স্যার। আসলে এতো সকালে আমি খেতে পারি না তো তাই---।

-হ্যাঁ তাই। তাই কি? পরে তো খেয়ে নেয়া যায় নাকি? নাকি বলবে জিরো ফিগার মেইনটেইন করতে খাওয়া দাওয়া শিকেয় তুলেছ? সেটার কি কোনো দরকার আছে? তোমার ফিগার তো মাশাল্লাহ ভালোই---।

-স্যার?

-তো কি? না খেয়ে মরার শখ হয়েছে? যেন বলতে পারো বসের অত্যাচার আর কাজের চাপ সামলাতে না পেরে মরে গেছ?

-না না স্যার---। আসলে---।

-আসলে নকলে কিছু বুঝি না আমি। এর পরে কখনো যদি না খেয়ে এমন অসুস্থ হয়েছ তাহলে তোমার একদিন কি আমার একদিন মায়া। শরীরে এক বিন্দু শক্তি নেই, সে আবার এসেছে আমার সেক্রেটারির জব করতে। হাহ! জোকস অব দা ইয়ার!

-সরি স্যার।

-আপনার সরি আপনার নিজের ঝুলিতেই রাখুন মিস মায়াবতী। চুপ করে খেয়ে নিন এখন। কাল থেকে আপনার খাওয়ার ব্যবস্থা আমি নিজেই করবো। সেটা নিয়ে টেনশন নিতে হবে না।

-কি-কিসের ব্যবস্থা স্যার?

-চুপচাপ খাও মায়া। যেটা তোমার জানার প্রয়োজন নেই সেটা নিয়ে অহেতুক প্রশ্ন করে টাইম নষ্ট করবা না। তোমার ধারণা আছে তোমার জন্য কত সময় নষ্ট হয়েছে আজ আমার? কয় ঘন্টা পর তোমার সেন্স এসেছে জানো তুমি?

-সরি স্যার। আমি আসলে ইচ্ছে করে--।

-তুমি এই কাজটা ইচ্ছে করেই করেছ মেয়ে--। এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। আমার চার-পাঁচ ঘন্টা সময়ের কি কোনো দাম নেই নাকি?

-কি! কি শা-শাস্তি স্যার?

রাহাত আবার চোখ গরম করে তাকাতেই মায়া ভয়ে চুপসে গিয়ে একটা টু শব্দও না করে খাওয়ায় মন দিলো। এই ভদ্রলোকটিকে রাগানোর বিন্দুমাত্র সাহস মায়ার নেই। তাকে রাগানোর ফল যে কি পরিমাণ ভয়ানক হতে পারে সেই কথা ভেবেই মায়ার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। আর  রাহাতও চুপচাপ মায়াকে খাইয়ে দেয়া শেষ হলে প্লেট হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে কিছু একটা ভেবে পিছন ফিরে একবার মায়ার দিকে তাকালো রাহাত।

-বেড সাইড টেবিলের উপরে ওষুধ রাখা আছে। দু পাতা থেকে দুটো ওষুধ খাও। আর একটা গ্লাসে পানি, আর অন্যটায় ওরস্যালাইন আছে। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে খেয়ে এসে যেন গ্লাস দুটো খালি দেখি আর ওষুধ দুটো খাওয়া হয়েছে দেখি। গট ইট?

-ইয়েস স্যার। বাট? স্যার আপ-আপনি খান নি এখনো?

-গুড। একজন মরার মতো পড়ে আছে আর আমি বসে বসে খাবার গিলবো? অমানুষ মনে হয় আমাকে তোমার?

-সরি স্যার। না মানে আসলে----।

-তুমি আর তোমার সরি! গড! তাড়াতাড়ি মেডিসিন নাও। আমি এক্ষুণি আসছি।

-জি-জি-জি স্যার।

রাহাত একবার হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে রুমটা থেকে বেরিয়ে গেল। নিচে ডাইনিং রুমে আসতেই জুলি আর সোহানকে দেখতে পেল রাহাত। ওদের দুজনকে দেখেই রাহাতের ভ্রু জোড়া কিছুটা কুঁচকে গেল। তার কারণ হচ্ছে সোহান রাহাতের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে আর জুলি কিছু না বলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে রাহাতের মুখের দিকে। রাহাত কিছু না বলে খেতে বসে গেল চেয়ার টেনে। এতো খিদে পেয়েছে যে অন্য কোনো দিকে তাকানোর বা কিছু নিয়ে ভাবার মতো অবস্থাই নেই এই মূহুর্তে রাহাতের। জুলিও সেটা বুঝতে পেরে রাহাতকে খাবার সার্ভ করে দিয়ে রাহাতের পাশের চেয়ারটায় বসলো। সোহানও সুযোগ বুঝে ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে জুলির পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লো।

-কি রে দোস্ত! পি. এ কে একেবারে সোজা বাসায় নিয়ে এলি? তাও একেবারে নিজের বিছানায়--?

-সোহান? মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ। 

-আরে আমি খারাপ কিছু মিন করেছি নাকি? আজব তো! আমি তো জাস্ট একটু কিউরিয়াস। যে মেয়েকে নাকি মিস্টার রাহাত মাহবুব চৌধুরী নিজের পি.এ ই করতে চাচ্ছিল না, সেই মেয়ে অসুস্থ হওয়ায় নাকি রাহাত সাহেব এখন এমন পাগলের মতো ছুটোছুটি করছে? টানা চার-পাঁচ ঘন্টা তার সামনে থেকে এক সেকেন্ডের জন্য নড়ে নি পর্যন্ত। এমনটা তো সচরাচর দেখা যায় না ভাই। তাই জিজ্ঞেস করছি আর কি। না মানে জল কদ্দূর গড়িয়েছে রে ভাই?

-সোহান?

-এই জুলি? তুমি বলো তো? কখনো দেখেছ রাহাতকে এভাবে কারো জন্য টেনশন করতে? এর আগে রাহাতকে কাউকে খাইয়ে দিতে দেখেছ তুমি? আমি তো প্রায় বারো-তেরো বছরের ফ্রেন্ডশিপে একটা দিনও দেখলাম না এমন। তুমি দেখেছ জুলি? আচ্ছা? আমাকে তো আজ পর্যন্ত এক গ্লাস পানিও নিয়ে দেয় নি। তোমাকে কি কখনো এমন যত্ন করে খাইয়ে দিয়েছে নাকি জুলি?

-সোহান? এনাফ ইজ এনাফ--। অনেক হয়েছে চুপ থাক এখন। খাচ্ছি কিন্তু আমি। নইলে এতোক্ষণে এসব বাজে বকার জন্য  তোর নাক নকশা বদলে দিতাম---।

-সেটাই তো দেখছি ইয়ার। মেয়েটাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে তারপর নিজে এসে খাচ্ছিস। একটু অদ্ভুত ঠেকছে না ব্যাপারটা? কি বলো জুলি?

-কিছুই অদ্ভুত না এখানে হারামি। অহেতুক ড্রামা করবি না একদম। শি ইজ মাই রেসপন্সিবিলিটি। আর আমার কারণেই মেয়েটার এই হাল হয়েছে আজ। কাজের এতো প্রেশার ক্রিয়েট করে রেখেছিলাম যে মেয়েটা এতো লোড নিতেই পারে নি। এই অবস্থায় আমার যা করা উচিত মনে হয়েছে সেটাই করেছি। তোর এতো সমস্যা কোথায় হচ্ছে সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না।

-আমার সমস্যা হচ্ছে কি ঘটছে, কেন ঘটছে, কেন করছিস এটা এখানে দুজন মানুষ বুঝতে পারছে না। তাদেরকে আমি হাজার বোঝালেও তারা নিজেদের মতো করে হাজারটা যুক্তি রেডি করে ফেলবে আমার কথার কাউন্টার দিতে। অথচ নিজেরা বুঝবেও না কেমন গাধার মতো লজিক দেখাচ্ছে। আর এমন গাধাগুলোকে তাদের মনের কথা বুঝানোর চেষ্টা করে করে আমার নিজেকে আজকাল বিশাল সাইজের একটা বলদ মনে হচ্ছে---। এটাই হলো সমস্যা। বুঝলি কিছু?

-কিসব হাউল ফাউল বকছিস বল তো? আজাইরা তিলকে তাল করার বদ অভ্যেসটা তোর গেল না এখনো সোহান? আর এই জুলি? তুই ওকে থামতে বলবি প্লিজ? নইলে এই ছেলে কিন্তু আমার হাতে ধোলাই খাবে আজকে। আর তোরা থাক। আমি মায়াকে বাসায় ড্রপ করে দিতে যাবো। তারপর এসে তোদের সাথে-----।

রাহাতের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সোহান এবারে হা হা করে হাসতে শুরু করেছে। রাহাত কটমট করে ওর দিকে একবার তাকিয়ে উঠে হাত ধুতে চলে গেল। আজকাল এই পাগলটার কোন কথার বা কাজের কিছুই মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না রাহাত। তাই অহেতুক ওর কথায় কান না দিয়ে মায়ার দিকেই ফোকাস করার সিদ্ধান্ত নিলো রাহাত। মায়াকে নিয়ে বাসায় ফেরার সময় রাহাত চিন্তা করতে লাগলো। মেয়েটাকে আর এতো টেনশন দিবে না ভুলেও। মেয়েটা তো বেশ ভালোই কাজ করতে জানে। তাই আপাতত মায়াকে তাড়ানোর প্ল্যানটা ক্যান্সেল করে দিলো রাহাত। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মায়ার দিকে চোখ আটকে গেল রাহাতের। খোলা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে মুখ করে আছে মায়া। বাতাসের কারণে মায়ার ওড়না আর চুলগুলো একটু পর পর এসে রাহাতকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। আর সাথে সাথেই একটা মিষ্টি ঘ্রাণ যেন রাহাতের নাকে এসে লাগছে। রাহাত বুঝতে পারছে না এই মিষ্টি ঘ্রাণ, মায়ার চুল আর ওড়নার আধো স্পর্শ এসব ওর ভালো লাগছে নাকি খারাপ লাগছে। শুধু এই সময়টা চোখ বুজে উপভোগ করছে রাহাত। এটা ভালো লাগা নাকি আসক্তি সেটা নিয়েও রাহাতের ভাবার সময় নেই। ও শুধু চাইছে সময়টা আজ নাহয় এখানেই থমকে যাক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন