আমার একটাই যে তুই - পর্ব ১৫ - সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি - ধারাবাহিক গল্প


ইউসুফ ভাইয়ার সাথে ছাদে বসে আছি। আমার কান্না না থামছে না দেখে তিনি হুট করেই কোলে নিয়ে এলেন ছাদে। ঠিক সেই জায়গায় যেখানে উনি বসে গান শুনিয়েছেন আমাকে। ইন্টারেস্টিং বিষয় আজকেও পূর্ণ রূপালী থালা আমাদের সঙ্গ দিতে আসচ্ছে। সাথে আছে চিক চিক করা হাজারো তারা। আমি এসব লক্ষ করছি তখনি কানে ভেসে আসলো গিটারের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে চমকে তাকাতেই দেখতে পেলাম আমার নেতা সাহেবকে। গিটার কোলে জড়িয়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি। স্ব স্ব বাতাসে এলো মলো ভাবে এদিক ওদিক ছুটছে তার অবাধ্য চুল গুলো। চাঁদের রূপালী আলোয় দেখতে আরো যেন মায়াবী লাগচ্ছে তাকে। আজ কতদিন পর তার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুঁটেছে তা দেখেই খুশিতে চোখের জল গড়িয়ে পড়লো আমার। ইউসুফ ভাই গিটারে সুর তুলল। আমি মাথা নত করে চুপটি করে উপলব্ধি করছি তার গান।

 --"  তুমি রোদেলা অরণ্যে, যেন এক মায়া হরিণ
      তুমি তীব্র খরার পরেই, যেন হৃদয় বৃষ্টি দিন,
   যাদুকরী এক ছোঁয়ায়, তুমি বদলে দেবে আমায়,
    আমি চোখ বুজে দেখি, তুমি এলে পায়ে পায়।
      ভাবিনি এত সহসায় পূর্ণ হব ভালবাসায়।"

তার গানের মাঝে "ভালবাসা " কথাটি শুনে পূর্ণ দৃষ্টি মেলা তাকালাম। তিনি এক পলকে চেয়ে আছেন আমার দিক।তা দেখে লাজুক হাসতেই তিনি  পরের লাইনি গাইলেন। 

 --"  তুমি খুব চাওয়ার পরেই যেন হাসলে এক ঝলক,
আমি চাইনা কিছুই তো আর, শুধু চেয়ে থাকি অপলক অবাক এক প্রভায়, কাছে টেনেছ আমায়
আমি রই যে ভাষাহীন সেই অদ্ভুত মমতায়,"

আমি লজ্জায় এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। তা দেখে তিনি দুষ্ট-মিষ্টি হাসচ্ছেন। যা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে তাই লজ্জা ভুলেই নির্লজ্জ ভাবে চেয়ে রইলাম তার দিক। তার সুন্দর বিড়াল চোখ গুলোর দিক। তার আঁকা-বাঁকা দাঁত আর টোল পড়া গলা আর সেই থুতনির খাঁজের দিক।

--"তুমি সাত সাগর দূরে, যেন চমকে দেওয়া কাহিনী।
আমি ক্ষুদ্র প্রজা যে দেশের, তুমি সেই দেশের রানী।
মিষ্টি সুখের আশায়, খুজে নেবে এই আমায়,
আমি প্রাণপনে ভাবি, তুমি আমার সীমানায়।"

গান শেষ হতেই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো শিশির কণার মতো টপ টপ করে। ইউসুফ ভাই গিটার সাইডে রেখে কাছে টেনে নিলেন আমায়। এতটা কাছে যে তার নিশ্বাস আর আমার নিশ্বাস মিলে এক হয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলো উনি অপলক আমার দিক তার সেই মহনীয় দৃষ্টি মেলে ধরেছেন। যেখানে আছে আজ হাজারো ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা,  আকুতি, মিনতি, অবৈধ অনেক আবদার। নিজের মাঝে হাজার যুদ্ধ করে এই অনুভূতি গুলো দাবিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা করছেন তিনি।ইউসুফ ভাই তার সেই চোখ দুটি বন্ধ করে ফেললেন। আমার কঁপালে তার ভেজা ঠোঁটের নরম স্পর্শ। যাতে আমিও আবেশে বন্ধ করে নেই আমার চোখ গুলোও। ইউসুফ ভাই চুমু খেয়ে কঁপালে কঁপাল ঠেকিয়ে মৃদু সুরে বললেন,,

--"বাবুইপাখি খুব শীঘ্রই এক হবো আমরা। একে ওপরে হাতে হাত রেখে তোমার আমার দেখা হাজারো স্বপ্ন পূরণ করবো! নিজেদের ছোট একটি নীড় বানাবো! যেখানে থাকবে না কোনো চোখের পানি! থাকবে না কোনো বিষাদের চিন্হ। আর এটাই হবে তবমার ভাল রেজাল্টের উপহার।"

বলে মৃদু হাসলেন। চকিতে চোখ মেলে তাকালাম আমি তিনি হাসচ্ছেন। আর আমার ঠোটের কোনেও হাসি। আর চোখের কোন বেয়ে চলছে অজস্রধারা। ইউসুফ ভাই আমার চোখ মুছে দিলেন। গলা থেকে কানের পিছনে হাত রেখে ফিসফিস করে বললেন,,

--" আই লাভ ইউ বাবুইপাখি! "

আমি তার দিক কেঁদে কেঁদেই বললাম,,

--" আই হেট ইউ! আই হেট ইউ! হেট ইউ লট! 

বলে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলাম। আর ইউসুফ ভাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হেসে যাচ্ছেন। এ যে শান্তির হাসি!

—————

আমি কি করছি? 
কেনো পড়ে আছি আমি এ বাড়িতে? 
কিসের আসায় পড়ে আছি?
এতসব অত্যাচার কেন সহ্য করছি?
এখানেতো আমার আপন কেউ নেই! 
তাহলে? কিসের আসায় পড়ে আছি?
শুধু ভালবাসার টানে? নাকি এই মানুষ টাকে কাছে পাওয়ার আশায়! তাকে বিয়ে করে সারা জীবন আপন করে নিজের সব দুঃখ ভুলে এক বুক ভালবাসা উজার করে তাকে আপন করে নেওয়ার লোভে? কি চাই আমি?

আমার জন্য দিন দিন মামি পাগলের মতো আচরণ করছে। রাত-দিন অভিশাপ করছেন! গালা গাল দিচ্ছেন! এই তো আজ দুপুরের ঘটনা। সেই ঘটনার পর থেকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছি আমি! আর মনের মাঝে হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ইউসুফ ভাই আমাকে রেটিনা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দেন মেডিকেলে পড়ার জন্য কিছুদিন হলো। আজ ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরি। নিজের ঘরে যাওয়ার সময় বড় মামির ঘর থেকে কিছু ভাঙ্গার আওয়াজ পাই। বাসায় তখন কেউ ছিল না। আমি তাঁর রুমে গেলাম। মামি পানি নিয়ার চেষ্টা করছেন হয়তো তৃষ্ণার্ত সে! গ্লাসটি নিচে পরে ভেঙ্গে গেছে। মামা মারা যাওয়ার পর থেকে মামি বিছানা নিয়ে ফেলেছেন। আমি তার কাছে যেয়ে ক্ষীণ স্বরে বললাম,,

--"মামি কিছু লাগবে?"

মামি কিছু বললেন না তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন।

আমি কাছে গিয়ে তাকে পানি দিলাম। তিনি খেলেন না
 মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে চেয়ে রইলাম। আমি নিরবে ছোট শ্বাস ফেলে পানি রেখে চলে যেতে নিতেই তিনি শক্ত কন্ঠে বললেন,,

--"তুই কিভাবে ভাবলী তোর হাতের পানি আমি খাবো?  তুই লোভী,  তোর মতো লোভী মানুষ আর একটা আমি দেখিনি। এতো লোভ তোর আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাষ! নিজের রূপ দেখিয়ে আমার ছেলেকে বস করেছিস।  এত রূপ দেখানের শখ তোর পতিতালয় যা।  রাত দিন রূপ দেখিয়ে ইনকাম করতে পাড়বি।  না তুই তাদের থেকে নিকৃষ্ট। তার নিজের শরীর বেঁচে তো খায়। কিন্তু তুই? অন্যের ঘাড়ে বসে খেয়ে যাচ্ছিস।  তাকেও বস করেছিস। আমার সন্তানকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছিস।আমাদের জীবন জাহান্নাম বানিয়ে ছেড়েছিস তুই।আমি তোকে অভিশাপ করি তোর জায়গা নরকেও না হয়।"

একটানে কথা বলে মামি হাপিয়ে উঠলেন। তার সামনে আমি দাঁড়িয়ে কান্না করতে লাগলাম। এতটাই খারাপ আমি! মামির চোখে বিষে পরিণত হয়ে গেছি আমি? দৌড়ে ঘরে চলে আসলাম। এ বাসায় আর  থাকতে পারবো না আমি! যেভাবেই হোক বের হতে হবে আমাকে। এসব ভাবচ্ছি।

মধ্যরাত ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফেলেছি। চলে যাবো। আর সহ্য হয় না। কেন এমন হচ্ছে? একটি হাসি খুশি পরিবার এভাবে ভেঙ্গে যাচ্ছে! শুধু আমার জন্য? এইতো রাতের খাবারের টেবিলে খাবারে জন্য মাত্র বসেছিলাম আমরা। আমি বড় মামা মারা যাবার পর থেকে আলাদা রুমে খেতাম। আজ ইউসুফ ভাইয়ার জেদের কারণে নিজে যেতে হয় খেতে। তখনি শুরু নানুমা, মিশুপির কটু কথা।

--" এ মেয়ে এখানে কি করছে?"

--" আমাদের সাথে খাবে আজ থেকে!"

--" ইউসুফ দিন দিন তুমি বাড়াবাড়ি বেশি করছো না ওকে নিয়ে?"

--" বাড়াবাড়ির কি আছে? সবাই এখানে খাচ্ছে তো ও কেন একা খাবে!"

--"ও এখানে খেলে আমি খাবো না ভাইয়া!" খাবার টেবিল ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল মিশুপি। 

নানুমাও রেগে আগুন। এক কথা দু কথায় ঝগড়া শুরু হলো। ইউসুফ রেগে মেগে বেড়িয়ে গেলেন। আর নানু মা আর মিশুপুর কথার বর্ষণ শুরু যা একে বাড়ে গিথে গেল।এবারের কথা গুলো ছিল পুরোটা আমার মাকে নিয়ে।  যা মানতে আর পাড়লাম না। সটান হয়ে দাড়িয়ে সেখানেই ধাতস্থ করে ফেললাম। এখানে আর না।
____________________________________________

বাসার সবাই ঘুম। এখন বাসা থেকে বের হওয়া উচিত এভেবে পা বাড়াতেই ইউসুফ ভাই ঢুকলো আমার রুমে ঢুলতে ঢুলতে। তাকে দেখে বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। তিনি আমার সামনে দাঁড়ালেন। তার রক্তবর্ণ চোখ, মুখ দেখে হু হু করে উঠলো আমার বুক। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। আর বার বার বলতে লাগলেন,,

--" বাবুইপাখি!  আমি খুনি! আমার বাবার খুনি! আমার জন্য আজ বাবা নেই! আমি দোষী। তোমার,  মার, মিশুর, বাবার! না আমি যেতাম না এ হতো! আমি যে খুব খারাপ ছেলে! খুব খারাপ!" 

আর্তনাদ করতে লাগলেন ইউসুফ ভাই। তার কান্না আমার কলিজা ফেঁটে যাচ্ছে।কারণ মামা মারা যাওয়ার পর থেকে এ ব্যক্তিটির চোখে এক ফুঁটা পানি পড়তে আমি দেখিনি। আর আজ ৬ মাস ব্যক্তিটিকে কান্না করতে দেখিনি।  আর আজ তার চোখে পানি।  ধীরে ধীরে ভর ছেড়ে দিলেন আমার উপর। কথা জড়িয়ে আসতে লাগলো তার। তাকে আমার বিছানায় শুয়ে দিলাম।ইউসুফ ভাই আমার হাত তার বুকের সাথে জড়িয়ে নিলেন। আর  ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলেন। বিড়বিড় করতে লাগলেন,,

--'" আমি খুনি! আমি বাবাকে মেরেছি! আমার জন্য সব কিছু। আমি খুনি। বাবুইপাখি আমি খুনি!"

বলতে বলতে তিনি চোখ বুঝে নিলেন। আমি আজ তাকে ছেড়ে যাচ্ছি এ কথা জানার পর হয়তো আর ক্ষমা করবেন না আমায়। কিন্তু আমাকে যে যেতেই হবে। উনার ভালোর জন্য।  সবার ভালোর জন্য। এসব ভাবতে ভাবতে তার হাত থেকে আমার হাত ছাঁড়িয়ে উঠে পড়লাম। সামনের দিক পা বাড়াতেই আমার ওড়নায় টান পড়ে। ভয় পেয়ে যাই আমি! ইউসুফ ভাই উঠে গেল না তো? ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকাতেই দেখি ইউসুফ ভাই শক্ত করে মুঠ করে আছে ওড়নার কোনা। আমি হালকা ঝুকে ওড়না ছাড়াতেই শুনতে পেলাম তার বিড় বিড় করে বলে কথা,,

--" বাবুইপাখি  আমাকে ছেড়ে যেও না। কখনো না। মরে যাবো আমি! বাবার মতো তুমিও হারিও না।"

আমি কাঁদতে লাগলাম। মুখে কাপড় গুঁজে। আরেকটু ঝুকেঁ চুমু খেলাম ইউসুফ ভাইয়ার কঁপালে।কান্না জড়িত কন্ঠে বললাম,,

--" ভাল থাকবেন ইউসুফ! জানি না কিভাবে থাকবো। কিন্তু সবার ভালোর জন্য এটা করতেই হলো। তাই বলে ভাববেন না আমি আপনাকে ভালবাসি না। আমি অনেক অনেক ভালবাসি। আসি..!"

 কথা গুলো বলতেই কান্নার বেগ বাড়তে লাগলো। শেষ বারের মতো জড়িয়ে ধরে তার হাতে আমার আঁকড়ে রাখা ওড়না তার হাতে রেখে দিলাম। অন্য হাতে একটি কাগজ রাখলাম। শেষবার সেই মুখ খানা দেখে বেড়িয়ে চলে এলাম স্বার্থপরের মতো বাসা থেকে। বার বার চোখ ভিজে উঠেছে। বাড়ির বাহিরে এসে বৃষ্টি বিলাস বাড়িটি আমার দেখে নিলাম ছল ছল চোখে। পা বাড়ালান অজানা-অচেনা কোনো গন্তব্যে।

—————

তীব্র কড়া রোদ এসে চোখ পড়তেই ঘুম ছুটে যায় ইউসুফের। পিটপিট করে চোখ খুলতে খুলতে উঠে বসে কই আছে বুঝতে চেষ্টা করে।  কিন্তু ব্যর্থ হয় মাথায় অনেক ব্যথা। দু হাতে মাথায় চেপে "আহ্" করে ছোট আর্তনাদ করে সে! ধীরে ধীরে আবার চোখ মেলতে ট্রাই করে। নিজেকে কুহুর রুমে পেয়ে কিছুটা ভ্রুকুটি কুঁচকে ফেলে। গায়ে থেকে চাদর সরিয়ে নিচে নামতে নিবে তখন খেয়াল করে কুহুর ওড়না ইউসুফের হাতে গোল করে বাঁধা। ইউসুফ তাজ্জব বনে যায়!ওড়না তার হাতে কি করে এলো? মাথায় প্রেশার দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে কি হয়েছিল কাল রাতে! কখন আসল কুহুর রুমে? আর কুহুই বা কই?এদিক-ওদিক তাকালো ইউসুফ কুহু রুমে নেই। ধক করে উঠলো তার বুক। খালি খালি লাগচ্ছে কেন যেন? সে বুকে হাত  ঢলতে লাগলো। হুট করে এমন কেন লাগচ্ছে তার? কুহু  নিশ্চয় আশেপাশে আছে! কিন্তু এমন কেন মনে হচ্ছে? আপন কেউ ফেলে গেছে তাকে? মাথা ব্যথা বাড়ছে।  আর ভাবতে পাড়ছে না সে। বেড থেকে উঠতেই টুপ করে একটি কাগজের টুকরো নিজে পড়ে গেল। কাগজটি কুড়িয়ে নিয়ে মেলতেই আকাশ যেন ভেঙ্গে পড়লো ইউসুফের মাথায়। ধুপ করে খাটে বসে পড়ে সে!গগনবিদারী এক চিৎকারে সামনে থাকা টেবিল ল্যাম্পটি তুলে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ছুড়ে মারে।  ঝন ঝন শব্দ করে কয়েকটুরো হয়ে যায় কাঁচ গুলো। তাও যেন রাগ কমছে না তার। চিৎকার করে বলেই যাচ্ছে,,

--" কুহু আমি তোকে ছাড়বো না। এর শাস্তি তোকে পেতে হবে! ভয়নাক শাস্তি! তুই বড্ড ভুল করে ফেললিরে! এত দিন আমার ভালবাসার চাদরে মুড়ে রেখেছিলাম তোকে!  এখন থেকে তুই আমার রাগ আর জেদটাই দেখবি!"

এদিকে কুহুর রুম থেকে চেঁচামেচি শুনে বাড়ির সবাই এসে হাজির। এসব দেখে তিথি নিরবে কাঁদচ্ছে। বাকি সবাই নির্বিকার।  ইউসুফের দাদু এসে ইউসুফের পাশে বসে মাথা হাত বুলিয়ে বলে,

--"যা হয় ভালোর জন্য হয় দাদু ভাই! ওরে ভুলে যা। নতুন জীবন শুরু কর!"

দাদুর এমন কথায় ইউসুফ তাঁর দিকে তাকায়। যা দেখে আতকে উঠে তিনি। ইউসুফের চোখ-মুখ ভয়ানক লাল হয়ে আছে! দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্ত সে পুড়ো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে!সে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,,

--" কুহু নিজ ইচ্ছেয় তো যায় নি! তোমাদের জন্য ঘর ছেড়েছে! এর আগেও চেষ্টা করেছে বহুবার! শুধু তোমাদের জন্য। দাদু এমনটা যেন না হয় দোয়া করো ওকে না পেলে  ওর সাথে সাথে আমিও হারিয়ে যাই!" 

বলে উঠে চলে গেল নিজের ঘরে! এদিকে ইউসুফের কথায় ছেত করে উঠে তার বুক। সত্যি কি তারা ভুল কিছু করে বসেছে?
____________________________________________

 ইউসুফ নিজের ঘর বন্ধ করে খাটের সাথে ঠেসে বসে আছে! কুহুর সেই কাগজের টুকরোটি তার হাতের মুঠোয়। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,,

--"" ইউসুফ ভাই! 

যখন চিঠিটি পাবেন তখন আমি আপনার থেকে বহু দূর থাকবো! জানি আপনি আমাকে এর জন্য কখনো ক্ষমা করবেন না। কিন্তু আমার করার কিছু ছিল না। তাই বলে এই নয় যে আমি আপনাকে ভালবাসি না। খুব ভালবাসি তাই দূরে যেতে পাড়ছি। আপনার  স্মৃতি গুলো সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি! আমাকে আর খোঁজার ট্রাই করিয়েন না। কোনো দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেয়েন। নিজের খেয়াল রেখেন। লাল টুকটুকে একটি বউ নিয়ে আসবেন বিয়ে করে।  সুখ-শান্তিতে সংসার করবেন। আমার উপর রেগে থাকবেন না প্লীজ।  আমরা একে অপরের জন্য না।

কুহু!"

ইউসুফ এবার কাগজটি ছুড়ে মারলো! নিজের মাথার চুল গুলো দু হাত দিয়ে টেনে ধরলো আর বলল,,

--"তোর জায়গা কেউ পাবে না বাবুইপাখি! কেউ না!"

বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে কাউকে ফোন করলো,,

--" আমি ছবি পাঠাচ্ছি! সব জায়গায় খোজ লাগা। আর  টিভিতে এড দে টাকার এমাউন্টও এড করিস। ওকে আমি চাই ২প ঘন্টার মধ্যে। নয়তো সব ধংস করে দিবো আমি!"

ফোন কেঁটে দূরে ছুড়ে মারে।তখনি কিছু একটা মনে পড়তেই।  ইউসুফ উঠে কুহুর রুমে চলে যায়। কুহুর বিছানার নিচে এক কোনায়  নিচে একটি সুন্দর হাতে কাজ করা ডায়রি পায়! কাঁপা কাঁপা হাত ডায়রিটি তুলে সে! একদিন রুমে বসে কুহু লিখচ্ছিল এঁটাতে।  ইউসুফকে দেখে সে লুকিয়ে ফেলে। যা ইউসুফের চোখে এড়ায় নি। সেদিন অন্য খেয়ালে ছিল বলে দেখা হয়নি তার। ডায়রিটি খুললো ইউসুফ! প্রথম পেইজেটি তে খুব সুন্দর করে লিখা,, 
                     " আমার_একটাই_যে_তুই❤️"

লিখাটিতে হাত বুলালো ইউসুফ! ইউসুফের দেশে আশা থেকে কাল রাত পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা এটাতে লিখা! ইউসুফের সাথে কাঁটানো মুহূর্ত গুলো। সব লিখা। ইউসুফ ডায়রিটি বন্ধ করে দিল। চোখ দুটি ছলছল করছে তার। বাবুইপাখি তাকে ভালবেসে যতটা সুখ না পেয়েছে! তার থেকে দুঃখ পেয়েই গেছে। যা বুঝতেই দেয় নি সে! ডায়রিতে একটি মেমোরি ফেয়েছে ইউসুফ। নিজের ঘরে এসে লেফটপে মেমোরি ঢুকলো। মেমোরি ওপশনে যেতেই ইউসুফ স্তব্ধ।  হাজার ইউসুফের ছবি। সব তার অগোচরে তুলা। কিছু ভিডিও পেল। তা দেখে থম মেরে গেল সে,

একটি ইউসুফ ভাইয়ার রান্না করার ভিডিও। একটি ছাদের মাঝে গান গাইছে সে তার ভিডিও। সাজেকের কিছু ভিডিও। সব ইউসুফ কে নিয়ে। এক এক করে সব দেখতে লাগলো ইউসুফ তার বাবুইপাখি যে তাকে এতটা চাইতো তা আজ বুঝতে পারছে সে! 
____________________________________________

আজ ইউসুফের মা অনেক খুশি! সে বিছানা ছেড়ে নিজের ছেলের জন্য রান্না করতে গেছেন। রান্না শেষে খাবার বেড়ে ইউসুফের ঘরে পা বাড়ালেন। ইউসুফ তার রুম অন্ধকার করে বসে আছে
 বাহির থেকে আসা আলোয় তাকে দেখা যাচ্ছে! তিনি ডাকলেন,,

--"ইউসুফ"
 
ইউসুফ সাড়া দিল না। তিনি কাছে বসে মাথায় হাত রেখে বললেন,,

--" ইউসুফ!দেখ আজ আমি নিজ হাতে তোর জন্য রান্না করে এনেছি! চল খাইয়ে দি!"

ইউসুফ তার মার দিকে তাকালো।  খুশিতে গদ গদ করছেন তিনি! তাকে দেখে বিরক্তি লাগচ্ছে তার। কিন্তু প্রকাশ করতে চাইছে না। ইউসুফের সামনে এক লোকমা ভাত তুলে দিল। ইউসুফ খেল। আবার দিল আবার খেলে। খাওয়া শেষে তিনি বললেন,,

--"বললি না খাবার কেমন হয়েছে?"

--"ভাল!"

--"তোর কি এখনো মন খারাপ ইউসুফ!"

--"নাহ্!"

--"তুই রেগে আছিস আমার উপর তাই না!"

ইউসুফ এবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তার মার দিক তাকালো। বলল,,

--" নাহ্! বাবা-মা যা করে ভালোর জন্যই করে! কিন্তু মাঝে মাঝে এত ভালই তারা করে! যে ছেলে-মেয়েরা ভিতর থেকে মরে যায়!"

হাসলো ইউসুফ বেদনাদায়ক হাসি! এমন কথা শুনে বুকে গিয়ে লাগলো ইউসুফের মার। ধরা গলায় বলল,,

--" আমি যা করেছি তোর ভালোর জন্য!"

ইউসুফ হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে ,,

--" হে তাই তো বললাম! এতে তোমার ছেলে খুশি নাকি ভিতরেটা পুড়েছে বা মরছে তা দেখলে না একবার? তার ভালবাসার মানুষটিকে দূরে ঠেলে দিয়ে,  ভালো থাকার কারণ নিয়ে গিয়ে বলছো তোর ভালোর জন্য করেছি?"

ইউসুফের মা কাঁদচ্ছে। ইউসুফ বলল,,

--" আম্মু ঘর থেকে যাও তোমায় বিরক্ত লাগচ্ছে। তোমার কান্না সহ্য হচ্ছে না।"

ইউসুফের মা বিলাপ শুরু করে বললেন,,

--"ওই মেয়ের জন্য আমাকে তোর বিরক্ত লাগচ্ছে? আমি কি ওই মেয়েকে তাড়িয়ে দিয়েছি নাকি?সে নিজেই গেছে! তোর জন্য মুখ বুজে ওকে মেনেই নিলাম।"

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো ইউসুফ বলল,,

--" দিন রাত যাকে পতিতালয়ের সাথে তুলনা করেছো! অভিশাপ করেছো! তাকে কবে মানলে  আম্মু!"

চমকে তাকালো ইউসুফের মা।  তোতলাতে তোতলাতে বলল,,

--"আ..মি ক..খ..ন বললা..ম!"

ইউসুফ ছোট শ্বাস ফেললো বলল,,

--" আমি সব জানি! যা জানা কথা যা অজানা কথা!"

ইউসুফের মা ভয় পেয়ে গেল। বলল,,

--" কি জানিস!"

--"অনেক কিছু!"

ইউসুফের মা চুপসে গেল। মিন মিন করে বলল,,

--"কি!"

ইউসুফ তার মার দিকে ঘুরে বসলো। তার মুখ পানে তাকালো। মুখে চিন্তার ছাপ। ইউসুফ হাসলো। তার বোকা সোকা মায়ের মাঝে এত কুটিলতা দেখে নিজেই বিস্মিত। ইউসুফ বলল,,

--" আম্মু তুমি কুহুকে নাজায়েজ বলেছো! কেন? ওকে তো ওর বাবা তার নাম দিয়েই ছিল! তাহলে? কেন অতটুকু মেয়ে এসব বলে তার কোমল মনটা নষ্ট করলে? তুমি না তাকে মেয়ে মানো? ও তো সহজ সরল ছিল। সবার কাছে একটু আদর ভালবাসা চাইতো! যাকে নিজের হাতে তুলে খাইয়ে দিতে তাকে কি করে এসব বললে আম্মু? তুমিও তো মা এক মা আরেক মার সন্তানকে কিভাবে খারাপ বলতে পারে? ওই সোজা সরল মেয়েটির বাচ্চামোতে ওকে ভালবাসি আম্মু চরিত্রহীনের ট্যাগ ওরে না লাগিয়ে তোমার ছেলেকে লাগতে! তোমার ছেলের যে অনেক বড় হাত এ সবে?"

ইউসুফে মা কেঁদে যাচ্ছে।  নিজের করা ভুল গুলো তার ছেলে এভাবে তুলে ধরবে ভাবতেই লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। সে নীরব রইল। ইউসুফ দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বলল,,

--"দোয়া কর আম্মু কুহুকে যেন ফিরে পাই। নয়তো তোমার এই ভাল ছেলেটা আর ভাল থাকবে না। দিলটা হয়তো মরে যাবে তার।"

বলে বাহিরে চলে গেল ইউসুফ। আর ডুকরে কাঁদতে লাগল ইউসুফের মা। সত্যি কি সে তার ছেলেকে চিরতরে হারিয়ে ফেলল??

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন