বন্ধন - পর্ব ০৩ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৫!! 

মায়রা শোয়া থেকে উঠে বসে র‍্যাপিং খুলে মোবাইলটা বের করে হাতে নিল। বেশ দামি একটা টাচ মোবাইল। মায়রা এর আগে এতো দামি মোবাইল দেখে নি। অবশ্য দামি মোবাইল নয় এর আগে মায়রার নিজের কোন মোবাইলই ছিল না। মায়ের বা বাবার বা ভাইয়ার কারো মোবাইল প্রয়োজন ছাড়া ধরার কখনো সাহস পর্যন্ত হয় নি মায়রার৷ আর তার এখন নিজের একটা মোবাইল হয়েছে! তাও এতো সুন্দর! কালো মোবাইল সেটের উপরে রূপালি চিকচিকে রঙে নামটা ফুটে আছে। ধবধবে সাদা চার্জার আর হেডফোন। সাদা কালোর কম্বিনেশনটা দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে মায়রার কাছে। 

মোবাইলের হোম কি প্রেস করতেই মায়রা দেখতে পেল সোয়াইপ অপশন উঠে আছে। কোন লক নেই, একটা সিম কানেকশনও শো করছে৷ মায়রা এক এক করে সব কটা এ্যাপ দেখলো। মোবাইলটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো কোথায় কি আছে, ক্যামেরা কেমন এসব। নিজের ছেলেমানুষিতে নিজেই হেসে ফেললো এক সময়। বেশ অনেকক্ষণ কেটে গেল মোবাইল নিয়েই। দেখতে দেখতে রাতও নেমে এলো। অথচ একটা কলও এলো না। মায়রার বড্ড অভিমান হতে লাগলো। মোবাইল পেয়ে লাভটা কি হলো যদি কথাই না হয় কারো সাথে! ওর অবশ্য কথা বলার মতো কেউ নেইও৷ বাসায় ফিরতে একটু দেরি হলেই বাসায় মোটামুটি লঙ্কা কান্ড হয়ে যায় মায়রার। তাই কারো সাথে দু মিনিট কথা বলতেই ভয় করে মায়রার। বন্ধুত্ব! সে তো বহু দূরের কথা। 

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে শাড়ি পাল্টে মায়রা বিছানায় শুয়েছে এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। মায়রা তড়িঘড়ি করে মোবাইলটা হাতে নিলো। হাত পা অকারণেই কাঁপছে কেন জানি। তবু একটু পর সাহস করে কলটা রিসিভ করলো। রিসিভ করতেই খিলখিলিয়ে কেউ একটা হেসে উঠলো মোবাইলের অপর পাশ থেকে।

-ওহো! এতোক্ষণ কি নতুন বউ মোবাইল হাতে বসে ছিলা বরের কলের অপেক্ষায়!

-তিথি আপু?

-আবার আপু? যাও কথা বলবো না ভাবি---।

-না না--। মানে তিথি?

-জি ভাবি! আপনার একটা মাত্র কলিজার টুকরা ননদিনী তিথিইইই।

-হিহি।

-সুইট ভাবিটা? কি করো?

-এই তো খেয়ে এসেছি---। তুমি?

-শুধু আমার কথা জিজ্ঞেস করলে? নাকি অন্য কারো কথাও বলবো?

-না মানে! তোমার কথাই তো জিজ্ঞেস করলাম-।

-আমিও খেয়ে এসেছি--। তোর পচা বর আমার সাথে পল্টি খাচ্ছে--। তাই নাম্বার দিই নি--। রাগ করো না ভাইয়ার সাথে। কেমন?

-না আপু---। 

-এই শোনো------।

ফোনের ওপাশ থেকে আয়ানের শব্দ শুনে থমকে গেল মায়রা। মানুষটার কন্ঠটা সামনে থেকে যেন মায়াভরা, তেমনি মোবাইলেও অনেক সুন্দর লাগছে শুনতে।

-তিথিনি? আমার মোবাইল দিয়ে কি করিস ফাজিল মেয়ে? একটা দিবো ধরে----।

-হুহ---। ধর? কে জানি কল করেছে--। আমি তো ভাবলাম বিয়ের আগে কার সাথে প্রেম করছিস। হুদাই আমার আপুটা কষ্ট পাবে---।

-আজাইরা কথা কম বল--। যা এখান থেকে-। ভাগ---।

-এখনো সময় আছে ভাইয়ু--। গিভ রেসপেক্ট টেক-----। হি হি।

-যাবি তুই?

-হুহ---। পরে ৫০০ বার ডাকলেও শুনবো না আমি---।

-এই এই? তিথি? মায়রার নাম্বারটা দিয়ে যা---।

-আমি কিছু শুনছি না---। 

তিথি দরজাটা ধুম করে বন্ধ করে দিয়ে আয়ানের রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। আয়ান বিরক্ত হয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলো কলটা কাটে নি। সেকেন্ড চলছে। মেজাজটা আরো বিগড়ে গেল। কমন সেন্স নাই? কারো পারসোনাল কথা শুনতে হয়? ইউজলেস পাবলিক এক একটা!

-হ্যালো?

-----আম---। আসসালামু আলাইকুম।

--------ওয়ালাইকুম আসসালাম। মায়রা?

-হুমম--। জি। 

-তুমি কল করেছো! আমার নাম্বার পেলে কি করে?

-আমি কল করি নি তো--। তিথি আপু কল করেছে----।

-ওহহহ আচ্ছা৷ বুঝসি। এই মেয়েটা---। উফফ--। সরি-। কি করছো?

-উম---।  এইতো খেয়ে আসলাম--। আপনি খেয়েছেন?

-হুম খেয়েছি--। গলা দিয়ে নেমেছে যে কয়টা-।

-মানে!

-কিছু না ম্যাডাম---। কি করবেন?

-এই তো----। ঘুমাবো--।

-কালকে ক্লাস আছে? ক্লাসের পরে সময় হবে ম্যাডাম আপনার?

-তত ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস নেই কালকে--।

-যাবা না কলেজে?

- না না---। যাবো তো---।

-ও আচ্ছা৷ ক্লাস না করলেও চলবে। এই তো?

-না মানে--। আসলে---।

-ইটস ওকে লাজুক পরী। সকালে তিথি যাবে তোমাদের বাসায়। রেডি হয়ে থেকো। ওকে?

-জি আচ্ছা---।

-এখন ম্যাডাম--। একটু ঘুমান কেমন? সারাদিন অনেক ধকল গেলো না?

------------------------------

-ও আচ্ছা? আরেকটা কথা বলার ছিল না আপনার?

-কি?

-দুপুরে মন খারাপ ছিল কেন? মনে হচ্ছিল  আরেকটু পরেই চোখের আকাশে ঝড় হয়ে বৃষ্টি নামবে। কেন বলো তো? বরটা দেখতে পচা? পছন্দ হয়নি?

-না না--। তেমন- তেমন কিছু না।

-তাহলে কেমন?

-------------------------------

-বলবে না?

-আসলে----?

-বর পছন্দ হয় নি--। এই তো? আমি কালই নাহয় বাসায় বলে দিবো--।

-না না--। পছন্দ হয়েছে তো। খুব পছন্দ----।

-তাই?

----------- আমি রাখছি। 

- হা হা---। লাজুক পরীটা--। পালিয়ে যাচ্ছো? আচ্ছা যাও--। ঘুমাও--। কালকে দেখা হবে। ওকে?

-জি আচ্ছা।  

আয়ান কলটা কেটে দেওয়ার পরে মায়রা মোবাইলটাকে দুই মিনিট বুকে জাপটে ধরে রাখলো। এতো কেন ভালো লাগছে ওর! কে জানে! এই অনুভূতিটা একেবারে নতুন মায়রার জন্য। আগে কখনো কারো জন্য এমন ফিল হয় নি৷ কারো জন্য এভাবে অপেক্ষা করে থাকেনি ও কখনো। কারো ছোট্ট একটা শব্দ এভাবে বুকে এসে লাগতে পারে এটা স্বপ্নেও ভাবে নি মায়রা। তবে কি ও এই মানুষটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে? এই তীক্ষ্ণ, তীব্র অনুভূতিটাই কি তবে ভালোবাসা? কি জানি! তবে যাই হোক না কেন। অনুভূতিটা অসাধারণ। কেমন যেন নেশা ধরানো। এসব ভেবে মোবাইলটা পাশে রেখে ডায়েরি নিয়ে বসলো মায়রা। একটা পৃষ্ঠায় আঁকিবুঁকি করে লিখতে বসলো মনের কিছু কথা। ছোট্ট একটা চিঠি।

"আয়ান,

আপনাকে ঠিক কি বলে সম্বোধন করবো বুঝতে পারছি নি। দুটো পরিবারের সম্মতিতে আর একটা মাস পরেই আমাদের বিয়ে। অথচ আপনাকে কি বলে সম্বোধন করব জানি না এখনো। আজব না ব্যাপারটা?

জানেন? ছোটবেলা থেকেই সবসময় বাড়ির বাকিদের মতামতে আমার জীবনটা চলেছে৷ আঁকতে ভিষণ ভালোবাসতাম জানেন? বাবার পছন্দ না বলে আঁকাআঁকিটা ছুটে গেল আমার। গানের গলাটাও নেহাত মন্দ ছিল না। তবে মা ঠিক করে দিলেনঃ- বনিয়াদি মুসলিম পরিবারের মেয়ের গান! প্রশ্নই ওঠে না। হ্যাঁ স্কুল, কলেজ আর এখন ভার্সিটি-কোথাও কিছুতে কমতি রাখে নি বাবা, মা বা ভাইয়া। তবে ভাইয়ার মতো স্টাডি ট্যুরগুলোতে যাওয়ার পারমিশন কখনো মিলে নি। অথচ জানেন? পাহাড়গুলো, নদী, সাগর দু হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকে। আমি কিন্তু পারমিশন পাই না একবারও। এগুলোকে হারানো বলে কিনা জানি না। তবে আমার প্রাপ্তির খাতায় এদের নাম কখনো ওঠে নি। 

জানেন? আপনার সম্বন্ধটা যখন এলো বাড়িতে আমি সারাটা দিন কেঁদেছি। কেউ একবারের জন্যও এসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে নি আমি কি চাই। মা এসে মায়ের নীল রঙা জামদানিটা ধরিয়ে দিয়ে বললো রেডি হয়ে সাজগোজ করে নিতে। জাস্ট এইটুকুই। মায়ের শাড়িটা পড়ে আপনার সামনে যখন গেলাম আর আপনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন তখন এতো ভালো লাগছিল বলে বোঝাতে পারব না। এই প্রথমবার কারো চোখে নিজের জন্য এতোটা মুগ্ধতা দেখেছি আমি। উহু, কারো চোখে নয়। এমন একজনের চোখে যার সাথে আমার নামটা আজীবনের জন্য বন্ধনে বেঁধে যাবে। ভাবতে অন্যরকম একটা খুশি লাগছে আমার। 

আর জানেন? ছোটবেলা একা একা যখন পুতুল দিয়ে ঘর ঘর খেলতাম, তখন থেকেই ছোট্ট একটা স্বপ্ন দেখে আসছি আমি৷ আমার পুতুলের মতো আমারও একটা সংসার হবে। প্রিয় মানুষটার কাঁধে মাথা রেখে কোলের পুঁচকিটাকে আদর করতে করতে বিকেলের সময়টা কাটবে। আর বড় দুটো দুষ্টু পিচ্চি নিজেরাই নিজেদের মতো করে ছুটোছুটি খেলবে কখনো। বা কখনো 'বাবা' বলে চেঁচামেচি করতে করতে প্রিয় মানুষটার হাত ধরে পিচ্চি দুটিতে টানাটানি করবে। আর আমি? আমি কোলের পুঁচকিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তাদের তিনজনের খুনসুটি দেখব অবাক চোখে। ইদানিং মনে হয় স্বপ্নটা একটু বদলেছে। কারণ মুখ তুলতেই প্রিয় মানুষটার আবছা অবয়বের জায়গায় আপনার চেহারাটা দেখতে পাই। অদ্ভুত না?

আচ্ছা? বিয়ের পরও আমাকে এভাবে শাড়ি পড়া দেখলে আমার চোখে সেদিনের মতো অবাক মুগ্ধতা খেলা করবে? আজীবন? আমার না ভিষণ জানতে ইচ্ছে করে জানেন? এই প্রথমবার আমি অধীর আগ্রহে এই একটা মাস শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছি। একটা নতুন বন্ধনে বাঁধার অপেক্ষায় প্রত্যেকটা দিন গুনছি। 

অনেক বকবক করলাম। আশা করি জবাবে বলে দিবেন সম্বোধনের জায়গাটায় কি লিখবো। 

ইতি,
মায়রা।"

ডায়েরিটা কোনমতে বালিশের পাশে রাখতেই ঘুমে চোখ বুজে এলো মায়রার। রাজ্যের ঘুম ভর করেছে চোখে। সকালে কোন ড্রেসটা পড়বে, কি করবে সেসব ভাবতে ভাবতেই মায়রা হারিয়ে গেল গভীর ঘুমের রাজ্যে। আর ঠোঁটের কোণে ঝুলে রইলো মিষ্টি এক টুকরো হাসি।

০৬!! 

সকালে ঘুম ভাঙতেই মায়রা শাওয়ার নিয়ে কমলা রঙা একটা জামা পড়লো। চুল শুকাতে শুকাতে হালকা সাজগোজ কমপ্লিট করলো। কপালে ছোট্ট কমলা কালারের টিপ, চোখের নিচে চিকন করে কালো কাজলের টান, কানে একটা ঝুল কানের দুল। অনামিকায় আংটিটা দেখে একটু লাজুক হাসলো মায়রা৷ চুলগুলোকে উপর দিকে একটু পাফ করে ফুলিয়ে বেনী করে নিলো। তারপর ডান হাতে পছন্দের চেইন ঘড়িটা পড়ে বাম হাত ভর্তি করে কাচের চুড়ি পড়লো। ওড়নাটা গায়ের উপর দিয়ে দুদিকে ঠিক করে ঝুলিয়ে দিয়ে কলেজে যাওয়ার জন্য ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। 

মায়রা ব্যাগ গোছাতে গোছাতে রুমের দরজার নক শুনে চমকে উঠলো। ওর রুমে সচরাচর কেউ আসে না। না ভাইয়া বা মা, বাবার আসার তো প্রশ্নই উঠে না। তাদের কাছে মায়রা হলো একটা বোঝা। আর বোঝাকে দয়া করে বাড়িতে জায়গা দেয়া যায়। তার এতো খোঁজ খবর নেয়া লাগে না। তবে এখন কে এলো! তিথি? মায়রা তাড়াহুড়ো করে দরজাটা খুলে তিয়াশকে দেখে চমকে গেল।

-ভা-ভাই-ভাইয়া? কিছু লাগবে?

-না রে--। কলেজ যাচ্ছিস?

-জি ভাইয়া---।

-তিথি নিচে গাড়িতে ওয়েট করছে। বাসায় আসতে বললাম--। বললো নাকি তাড়া আছে। তাড়াতাড়ি যা-।

-জি ভাইয়া---। আমি রেডি হয়ে গেছি---।

-শোন?

-জি ভাইয়া?

-আয়ান ভাইয়া আসবে নাকি?

-উমমম---। হুম--। বলেছে তো আসবে---।

-তো এমন হয়ে যাচ্ছিস কেন? একটু সাজগোজ করে যা---। এতো সাদামাটা হলে হয়!

-আমার সাজতে ভালো লাগে না।

-জানি---। তবু একটু সাজতেই পারিস--। সাজলে মেয়েদেরকে সুন্দরই লাগে--। আর আয়ানেরও তো পছন্দ হতে হবে--। এভাবে একেবারো সাদা কাগজ হয়ে থাকলে পরে উনি বিয়ে করতে না চাইলে কি করবি তখন?

-মানে?

-একটু সাজিস---। অন্তত কাজল পড়িস আরেকটু গাঢ় করে, ঠোঁটে লাল বা ডিপ কালারের লিপস্টিক দিস--। আমি আজ আসার সময় কিছু কসমেটিক নিয়ে আসবো নি তোর জন্য----।

----------আচ্ছা। 

-এসব বলছি বলে রাগ করিস না। কোন কারণে বিয়েটা না হলে তুই ভাবতেও পারছিস না কি হবে তোর সাথে---। 

-জি ভাইয়া---। 

-যা এখন--। কালকের লিপস্টিকটা দিয়ে তাড়াতাড়ি যা--।

-আচ্ছা।

-আমিও গেলাম---। যা তুই। আর তাড়াতাড়ি ফিরিস--। 

-হুম---।

তিয়াশ চলে যেতেই মায়রা কোনমতে নিজের ঠোঁট কামড়ে কান্না ঠেকালো। সে কি দেখতে খারাপ! নইলে এসব মেকাপ, লিপস্টিক, গাঢ় কাজল দিয়ে কেন আয়ানের মন ভুলিয়ে রাখতে হবে! উনিও কি আর সবার মতো বাইরের এই সাজসজ্জাটাই দেখবেন! সত্যিই কি এই সাদামাটা মুখটা আসলেই পছন্দ হবে না মানুষটার! সত্যিই কি বিয়েটা ভেঙে দিবে! ভাবতেই মায়রার বুকের ভেতরে ধ্বক করে উঠলো। কোনমতে স্বাভাবিক হয়ে ঠোঁট জোড়া হালকা করে ক্রিম কালারের লিপস্টিকে রাঙালো। নিজের কাছেই নিজেকে বিদঘুটে লাগছে মায়রার। তবু সামলে নিলো নিজেকে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে মাকে একবার বলেই বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। 

নিচে এসেই তিথির গাড়িটা দেখতে পেল। তিথি গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। এই মেয়েটাকে ছোট খাটো পরী বলা যায়। গোলাপি-সাদা কম্বিনেশনের একটা জামা পড়নে। আর সাথে চোখে মোটা করে আইলাইনারের টান, গাঢ় গোলাপি লিপস্টিক আর গালে গোলাপি আভা। আর মায়রার জীবনে মেয়েটা তো আসলে পরী বা এ্যাঞ্জেল থেকে কম কিছু না। হুট করে মায়রার জীবনটা কেমন করে বদলে দিতে চলেছে তিথি নামের এই মেয়েটা। ভাবতেই অবাক লাগছে মায়রার। মাঝে মাঝে সবটাই স্বপ্ন মনে হয় মায়রার কাছে। মায়রা এসব ভাবতে ভাবতেই তিথি এসে মায়রাকে জড়িয়ে ধরলো।

-ওহহহ! তোমাকে এত্তোগুলো কিউট লাগছে ভাবি---। ভাইয়া তো চোখই ফেরাতে পারবে না। হি হি--।

-তোমাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে গো আপু।

-হি হি--। জানি জানি। তাই তো আজ পর্যন্ত কেউ প্রপোজও করতে আসে না--। হুহ---। কি আমার চেহারা- নাম আবার পেয়ারা!

-কি?

-হি হি---। চলো চলো? তোমরা প্রেম করবা--আমার তো ক্লাস আছে নাকি?

-সরি সরি আপু---।

-আরেহহহহ--। ব্যাপার না---।

মায়রা আর তিথি কলেজের সামনে পোঁছতে দেখলো আয়ান আরেকটা নেভি ব্লু কালারের গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়রা অবাক হয়ে তিথির দিকে তাকালো। ওরা তখনও গাড়ি থেকে নামে নি।

-উনি এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

-হি হি---। ভাইয়া সেই কখন এসেছে জানো? ওটা ওর নিজের কেনা গাড়ি বুঝসো---। ওই গাড়িতে আমাকে সে উঠতেই দেয় না। হুহ। তোমার কি কপাল দেখো! তোমার জন্য সব রুলস চেঞ্জ হয়ে গেছে---।

-------------------------------

-ওরে আমার ভাবিটা--। যাও আর লজ্জা পেও না। আমিও গেলাম। বায়--।

মায়রা ধীর পায়ে আয়ানের সামনে এসে দাঁড়াতেই আয়ানের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। 

-সরি---। লেইট হয়ে গেল--।

-ইটস ওকে লাজুক পরী--। এসো? 

আয়ান ড্রাইভারের অপর পাশের দরজাটা খুলে ধরে মায়রার দিকে তাকালো। মায়রা গাড়িতে উঠে বসতেই আয়ান এসে ড্রাইভিং সিটে বসলো।

-ম্যাডাম নাস্তা করেছেন?

-উমমম --হু----।

-আমিও করি নি--। চলুন আগে নাস্তা করে নিই--। পরে কোথাও যাওয়া যাবে। ওকে?

-জি----। আচ্ছা।

মায়রাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসলো আয়ান। মায়রা আয়ানের মুখোমুখি বসে এক মনে কিছু ভাবছে দেখে আয়ানও এক মনে মায়রাকে দেখছে। মেয়েটাকে দেখে কমলা পরী লাগছে একদম। জামার গাঢ় রঙটা বেশ মানিয়েছে মায়রাকে৷ তবু মনে হচ্ছে চুলগুলো ছাড়া থাকলেই মেয়েটাকে আরো বেশি মানাতো। ভাবতে ভাবতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। মায়রা লাজুক হাসলো আয়ানের দিকে তাকিয়ে।

-কি খাবে? 

-আমি ঠিক---৷ 

-আচ্ছা ওয়েট--। আজকে নাহয় আমার পছন্দ মত খাও?

-আচ্ছা----। 

আয়ান দুজনের জন্য রুটি, স্পাইসি চিকেন, স্যালাড আর ফ্রুট জুস অর্ডার করলো। ঘরের বাইরে কোন রেস্টুরেন্টে খাওয়া এটাই মায়রার প্রথম অভিজ্ঞতা। আর রান্নাটাও বেশ মজা হয়েছে। মায়রা কিছুটা চিকেন আর স্যালাদটা দিয়ে একটা রুটি শেষ করে জুসের গ্লাসে চুমুক দিলো। জুসটাও একেবারে ফ্রেস। ভিষণ মজা লাগছে খেতে। আয়ানও খেয়াল করলো মায়রা খাচ্ছে না।

-মায়রা? খাও না? মাত্র একটা রুটি খেলে হবে? লাঞ্চের আগে আবার কখন কি খাবে কে জানে! 

-আর না প্লিজ---।

-ওমা! কি আর না? হা করো হা করো?

আয়ান চেয়ার টেনে মায়রার পাশে এসে বসে এক টুকরো রুটি মায়রার মুখের দিকে এগিয়ে ধরলো।

-হা করো?

মায়রা আর একটা কথা বলতে পারলো না। হা করতেই আয়ান নিজে না খেয়ে মায়রাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। মায়রা কি খাচ্ছে নিজেও জানে না। শুধু অপলকে আয়ানকে দেখে যাচ্ছে। এর আগে ওকে কেউ কখনো এতো স্নেহ করে খাইয়ে দিয়েছে কিনা সেটা মায়রার মনে পর্যন্ত নেই। এই মানুষটা হুট করে কোথা থেকে এসে এতোটা স্নেহ, এতোটা ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখছে! এতোটা সুখ সত্যিই কি মায়রার কপালে লেখা ছিল! একটু পরে মায়রার খেয়াল হলো মানুষটা নিজে না খেয়ে ওকেই খাইয়ে যাচ্ছে। 

-উমমম---। আমি আর খাবো না। আপনি খান না?

-জি৷ আমি তো খাবোই। রুটিগুলো অনেক সফট না? অনেক মজাও খেতে তাই না?

-হুম। আসলেই।

-আরেকটু খাও তাহলে?

-হুম? এই না না--। আমার পেট ভরে গেছে--।

-আমি তো এবার টেনশনে পড়ে যাচ্ছি----।

-কেন? কি হয়েছে?

-তুমি তো নিজেই খাও না ঠিক করে-। আমাদের বাচ্চা কাচ্চাগুলোকে কি খাওয়াবে! আর বাচ্চা কাচ্চার জন্যও তো একটু খেয়ে দেয়ে তর তাজা হওয়া লাগবে ম্যাডাম---।

কথাটা শুনেই মায়রা লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে নিলো। এই লোকটা কি সব বলে হুটহাট করে! এভাবে ওকে লজ্জায় ফেলে দিয়ে কি মজা পায় এতো লোকটা! খাওয়া শেষ হলে আয়ান মায়রাকে নিয়ে নদীর পাড়ে ঘুরতে গেল। শহরের ব্যস্ততা থেকে এই জায়গাটা একটু আলাদা। নদীর পাড়ে ঘাসের উপরে আয়ানের পাশে বসে আছে মায়রা। আয়ান এটা ওটা নিয়ে কথা বলছে। আর মায়রা শুনছে। কখনো হেসে ফেলছে, কখনো এটা ওটা জবাব দিচ্ছে। ছোট্ট একটা আইসক্রিমের ভ্যান দেখে আয়ান মায়রাকে আইসক্রিমও কিনে খাওয়ালো। 

দুজনেই গল্প করতে খেয়ালই করলো না কখন বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মায়রার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। দুটো বাজে। আজকে বাসায় যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আর বাসায় যাওয়ার পর কপালে কি আছে সে কেবল আল্লাহই ভালো জানেন৷ ভেবেই একটা ঢোক গিললো মায়রা। আজকে কপালে কোন শনি নাচছে কে জানে! ভেবেই মায়রার হাত পা একেবারে ঠান্ডা হয়ে আসছে। বেচারি কথাটা আয়ানকে বলবেই বা কোন মুখে! আর কিই বা বলবে! ওর বলার কি আধো কিছু আছে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন