০৭!!
সকালে মাইশা হালকা একটু সাজগোজ করে কলেজে গেছে। ২ টা পর্যন্ত ক্লাস হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কি একটা কারণে ১২ টা বাজেই ক্লাস শেষ। মাইশা চিন্তা করছে এখন কি করা যায়! ধ্রুবকে কল দিবে! নাকি ওর জন্য অপেক্ষা করবে! কতোক্ষণই বা একা একা অপেক্ষা করা যাবে! নাকি বলে বাসায় চলে যাবে! চিন্তাটা মনে আসতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো। আজকে ধ্রুবর সাথে কথা বলতেই হবে৷ সে যতোক্ষণই অপেক্ষা করতে হোক বা যাই হোক না কেন। তার তো অফিসে নাকি কাজের চাপ বেশি না। একটু কল করে না হয় দেখা যাক কি করছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই মাইশা কলেজ গেইটের সামনে চলে এসেছিল। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়েছে এমন সময় একটা গাড়ি এসে মাইশার সামনে থামলো। আরেকটু হলেই গাড়ির নিচে চাপা পড়তো বেচারি। যদিও ও এক পাশেই দাঁড়ানো৷ তবুও। খুব বিরক্ত হয়েই গাড়িটার দিকে তাকাতেই মাইশার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। এই গাড়িটা ওর পরিচিত। কালো রঙা একটা গাড়ি। গাড়িটা রাতুলের। ঠিক রাতুলেরও না। ওর বাবার। মস্ত ব্যবসায়ী মানুষ তিনি। এমন দু একটা গাড়ি তার ছেলে মেয়েরা নিয়ে ঘুরতেই পারে! সেটা কোন ব্যাপারই না।
কিন্তু রাতুল এখন এখানে কি করে! রাতুলকে দেখেই মাইশার যেন পায়ের নিচের মাটিটাই সরে গেছে। কি চায় ও আবার! আর কি চায়! অপমান করতে চায়! নাকি কথা শুনাতে! তামাশা করতে! চায় টা কি! মাইশা এসব ভাবতে ভাবতেই রাতুল গাড়ির বাম পাশের দরজাটা খুলে দিলো।
-উঠো এসো মায়শু-? কথা আছে।
-আমি যাব না---। যা বলার বলুন.......।
-রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিনক্রিয়েট না করলে তোমার চলছে না?
-সিনক্রিয়েট করার মতো কিছু নেই।
-আমি জাস্ট ২ টা মিনিট কথা বলেই চলে যাবো---। এমন করো না প্লিজ? চলো?
-সরি--। যা বলার এখানেই বলুন।
-আচ্ছা বেশ। যেও না। অন্তত গাড়িতে এসে বসো?
-না-------।
-তুমি তো কখনোই এতো ঘাড়ত্যাড়া টাইপের মেয়ে ছিলে না মাইশা?
-সময়ে সব কিছু বদলায়। আপনিও বদলেছেন। আমিও বদলেছি---।
-আর একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? পাঁচটা বছরের সম্পর্ক আমাদের মাইশু---। তোমার আমার প্রথম ভালোবাসা--। অন্তত সেটা চিন্তা করে হলেও-----।
-কি চিন্তা করবো? আপনি চিন্তা করেছিলেন? আপনার পরিবার চিন্তা করেছিল? সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত একটা পরিবারের মেয়ে আমি। জানতেন তো সেটা, নাকি? এ্যাক্সেপ্ট করেছিল আপনার পরিবার সেটা? কিসের সুযোগ চান আর?
-এভাবে বলো না মাইশু প্লিজ----।
-খবরদার এই নামে আর একদম ডাকবেন না আমাকে। কোন অধিকার নেই আপনার এই নামটা নেয়ার।
-পাঁচটা বছর পাগলের মতো যাকে ভালোবেসেছো তাকে আজ অধিকার শিখচ্ছো পাগলী? তুমি কি জানো না আমার অধিকার কতোটুুকু তোমার উপর?
-পাঁচ বছর-পাঁচ বছর করবেন না একদম--। এটা জেনে রাখুন মিস্টার রাতুল- লোভ আর অর্থের অহংকারের কাছে যেদিন আমার ভালোবাসাটা হেরে গেছে সেদিনই এই সম্পর্কটাও আমার কাছে চিরজীবনের মতো শেষ হয়ে গেছে।
-উহু--। তোমার কাছে শেষ হলেই তো হবে না। তুমিও খুব ভালো করেই জানো-- আমিও কতোটা ঢিট টাইপের ছেলে--। এই কয়টা দিনে বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছি যে তোমাকে আমার চাই-। যেকোন মূল্যেই চাই মাইশা---।
-আপনার বাবার এতো চাহিদা পূরণ না করে তো তিনি আমাকে আপনার সাথে কখনো স্বীকার করবেন না--।
-তোমাকে তো আগেই বললাম- এটাই সমাজের নিয়ম-। এটাই সমাজের সবাই মেনে চলছে-তবে তুমি কেন--?
-না আমি মানতে পারবো না--। আজ বিয়েতে আমার বাবা পাঁচ লাখ টাকা, ফ্রিজ, সোফা, খাট-এসব দিতে পারছে না বলে বিয়েটা ভেস্তে গেছে--। কাল বিয়ের পরেও যে আপনার পরিবার আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগাবে না তার গ্যারান্টি কি?
-মুখ সামলে কথা বলো মাইশা--।
-আপনার কাছে আপনার পরিবার ঠিক-আপনাদের সমাজের নিয়ম ঠিক-বিয়ের ফর্দে উপহারের নামে যৌতুকও ঠিক হতে পারে-। আমার কাছে নয়--। আপনার যদি মনে হয় একজন সাধারণ মানুষের তার চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর একমাত্র মেয়ের বিয়েতে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে না পারাটা, যৌতুক দিতে না পারাটা অপরাধ, তবে আমি আপনাদের এমন নিয়ম মানতে বাধ্য নই-। পরিবারের শক্তি হয়ে পাশে থাকতে চাই-। তাদের মাথায় আজীবনের ঋণ চাপাতে চাই না আমি---।।মরে গেলেও না।
-মাইশা? এবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা? বাবার সাথে কথা বলে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারবো আমি--। কিন্তু তুমি যে বিপ্লবীর খাতায় নাম লিখাচ্ছো তাতে করে তো সারাজীবন ঘরে বসে থেকেই বাপ মায়ের বোঝা হয়েই থাকবে---।
-পৃথিবীতে অন্তত একটা মানুষের কাছে হলেও এসব উপহারের ফর্দের চেয়ে সম্মান, ভালোবাসা এসব ম্যাটার করবে-।
-সেই আশাতেই থাকো মাইশা--। তবে একটা কথা মনে রেখো--। তুমি আমার ছিলে আমারই থাকবে--। আর আমি থাকতে তোমার সেই একটা মানুষ কেমন করে আসে আমিও দেখবো মাইশু---।
-আপনি এখন আসতে পারেন---।
রাতুল গাড়ির স্পিড তুলে শা করে চলে গেলো। কলেজ ছুটির পর কেউ তেমন ছিল না। তাই কোন ঝামেলা হয় নি। তবে এভাবে কতো দিন! দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই মাইশার আটকে থাকা কান্নারা বাঁধ ভাঙলো চোখের। অতীতটার থেকে যতই দূরে যেতে চাইছে ততই যেন তার চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এর থেকে বাঁচার উপায় কি একদমই নেই? চিৎকার করে কাঁদতে পারলে হয়তো মনের কষ্টটা কিছুটা হলেও কমতো। সেটা পারছে না বলেই হয়তো আরো হু হু করে কান্না এসে চোখ মুখ ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে মাইশার।
০৮!!
কতোক্ষণ এভাবে দেয়ালে হেলান দিয়ে কেঁদেছে মাইশা নিজেও জানে না। ধ্রুবর কথাটা একেবারেই মাথা থেকে ছুটে গেছে। প্রায় দেড়টার দিকে মোবাইলটা হুট করেই ভাইব্রেশন দিয়ে একটা গান বাজা শুরু হলো। গানটা মাইশার খুব পছন্দের।
"শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা---।"
গানটা বেজেই চলেছে বহুক্ষণ ধরে। তখন মাইশার খেয়াল হলো। কল এসেছে। মোবাইলটা হাতে নিতেই ধ্রুবর নামটা দেখে আরো কান্না পেল ওর। কোনমতে সামলে কলটা রিসিভ করলো৷
-হ্যালো মাইশা-। তুমি কি ক্লাসে?
বহুক্ষণ কান্নাকাটি করার কারণে মাইশা চেষ্টা করেও একটা কিছু বলতে পারলো না।
-আচ্ছা। শোনো ক্লাসে হলে কথা বলতে হবে না। ক্লাস শেষ হলে কল দিও---।
কথাটা শোনামাত্রই আবার অস্ফুট শব্দে ফুঁপিয়ে উঠলো মাইশা। তবে এবার নিজেকে সামলে নিতে সময় লাগলো না।
-হ্যালো? হ্যালো মাইশা? কি হয়েছে? এনিথিং রং?
-না না--। কিছু হয় নি--।
-তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন! কাঁদছ কেন? প্লিজ বলো কি হয়েছে! আমার টেনশন হচ্ছে--।
-কিছু হয়নি--। ঠান্ডা লেগেছে একটু----।
-কাল রাতেও তো ঠিক ছিলে-। ঠান্ডা লাগলো কি করে হঠাৎ?
-সকালে লেগেছে----।
-তো কলেজে এলে কেন! এই তোমার ক্লাস শেষ?
-হুম---।
-সেকি! কখন?
-১২ টার দিকে----।
-ওহ শিট! তুমি আমাকে আগে বলো নি কেন! এতোক্ষণ একা একা! তোমাকে নিয়ে যে কি করি! কোথায় এখন তুমি?
-কলেজের গেইটের সামনে--।
-ইশ! সবাই চলে গেছে না! তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে কেন!
------------------------------------------------------
-মাইশা--। তোমার কলেজ থেকে একটু আগে সামনের মোড়টায় একটা কফি শপ আছে--৷ ওখানে গিয়ে পাঁচ মিনিট ওয়েট করো--। আমি আসছি---।
-আচ্ছা----।
কফিশপটাতে এর আগে মাইশা কখনো আসে নি। বেশ পরিপাটি সাজানো গোছানো। দুপুরবেলা বলে প্রায় পুরো শপটাই খালি। এখান দিয়েই বাসায় যাওয়ার জন্য রিকশায় উঠতে হয় মাইশাকে। অথচ অনার্স শেষ হয়ে যাচ্ছে -আজই প্রথম আসছে মাইশা। ভাবতেই হাসি পেল ওর। ওয়াশরুমে গিয়ে ভালো মতো মুখ ধুয়ে আয়নায় নিজে দেখলো মাইশা। কাজলটা ভালো। এতো কান্নাকাটি করার পরও ছড়িয়ে চোখে লেপ্টে যায় নি। তবে ভালো করে ফ্রেশ হয়ে চোখ মুখ মুছে এখন অনেকটাই রিফ্রেশড লাগছে নিজেকে।
আবার গিয়ে একটা সিটে বসে ধ্রুবর জন্য অপেক্ষা করছে মাইশা। অদ্ভুতই লাগছে মাইশার কাছে। একজনকে মাত্র ২ দিন চিনে অথচ সেই মানুষটা তার ফোঁপানো শুনে ব্যস্ত হয়ে উঠছে। আর যাকে পাঁচটা বছর ধরে চিনে! সেই মানুষটা ইচ্ছে করেই কাঁদিয়ে যাচ্ছে! এমন কেন হয়! মানুষ চিনতে এতোটা ভুল! আর ধ্রুব? এই মানুষটাকেই বা কতোটা ভরসা করা যায়! রাতুলও তো এভাবে করেই সবসময় খেয়াল রাখতো ওর। কেয়ার করতো। শাসন করতো। আর এখন! কার কোন রূপটা বিশ্বাস করবে মাইশা!
কলটা কাটার আগে ধ্রুবর তড়িঘড়ি করার শব্দ শুনেছে মাইশা। ভালো লেগেছে কেন জানি! কতোক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হবে কে জানে! একলা বসে বসে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছে মাইশা। ধ্রুবও যদি রাতুলের মতো হুট করে বদলে যায়!
তাছাড়া ধ্রুবকে কতোটা চিনে বা কতোটা জানে! হ্যাঁ, বিয়ের আগে যথেষ্ট সময় আছে ওকে জানার জন্য। তবে পাঁচটা বছর যেখানে একটা মানুষকে জানার জন্য যথেষ্ট হয় নি-সেখানে ছয়মাসে কতটুকু বুঝতে পারবে ও ধ্রুবকে!
ভাবতে ভাবতেই রাতুলের কথাগুলো কানের পাশে যেন ঘুরঘুর করছে।
"তুমি আমার ছিলে আমারই থাকবে--। আমার থাকতে তোমার সেই একটা মানুষ কেমন করে আসে আমিও দেখবো মাইশু---।"
রাতুল যখন ধ্রুবর কথা জানতে পারবে কি করবে ও? ভাবতেই মাইশার চোখ দুটো আবার ভরে এলো। ওর জীবনটা এতোটা কেন এলোমেলো হয়ে গেলো? কেন!
একমনে ভাবতে ভাবতে মাইশা খেয়ালই করে নি কফিশপের দরজায় দাঁড়িয়ে কেউ একজন তাকে অপলক চোখে দেখছে।