৪৯!!
আয়ান মায়রার ডায়েরিটা কোলের উপর নিয়ে থমকে বসে আছে ফ্লোরেই। দরজায় অনেকক্ষণ ধরে থেমে থেমে টোকা পড়ার শব্দটাও যেন আয়ানের কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। আয়ান দরজা খুলছে না দেখেই কেউ একজন এবার আরেকটু জোরে ধাক্কালো। একটু জোরে শব্দ হতেই আয়ানের যেন হুঁশ ফিরলো। তাড়াতাড়ি করে উঠে দরজাটা খুলে দিলো। দরজার সামনে বাবাকে দাঁড়ানো দেখে আয়ান বেশ অবাক হলো। আয়ানের বাবা একটু ভ্রু কুঁচকে আয়ানের দিকে তাকিয়ে রুমে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
-কি করছিলি এতোক্ষণ? দরজা খুলছিলি না কেন আয়ান?
-কিছু না বাবা। মায়রাকে কোথায় খুঁজবো ভাবছিলাম---।
-শুধু ভাবলে তো হবে না। বউমাকে তো খুঁজে বাসায় ফিরিয়ে আনতে হবে রে বাবা। মেয়েটা কি খাচ্ছে? কোথায় আছে? এ সময় তো মেয়েটার একটু খেয়াল রাখতে হবে---।
-এ সময় মানে বাবা?
-আমম। আসলে কালই আমরা জানতে পারলাম। তুই বাপ হবি রে ব্যাটা----।
-মানে? তোমরা সবাই জানতে? আমি ভাবলাম মায়রা আমাকে জানায় নি--। তোমরাও আমাকে একবারও বললে না বাবা?
-মায়রা তোর পোগ্রামটা শেষ হলে আজই কথাটা জানাবে বলেছিল--। ও তোকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল--।
-ইয়াপ। আই এ্যাম সারপ্রাইজড।
-আয়ান? রাগ করে থাকিস না বাবা। মায়রাকে নিয়ে আয়---।
-কোথা থেকে বাবা? কোথা থেকে আনবো? আমি তো বুঝতেই পারছি না ও কোথায় গেছে। কার সাথে গেছে---।
-সেটা সম্ভবত আমি বলতে পারি--।
-তুমি? কি করে বাবা?
-আমার মনে হচ্ছে এর মধ্যে তোর মায়ের হাত আছে৷ মায়রা রাগ করেছে, আর তোর মা ও উনার স্পেশাল গায়েব হওয়ার প্ল্যানিং ঢুকিয়ে দিয়েছে মেয়েটার মাথায়--।
-কি! কি সব বলো? মা কেন এসব করবে?
-তোর মায়ের কাজই এইটা। আমার সাথে কোন কারণে রেগে গেলে বাগান বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতো একা একা। সে রাগ দেখাবে না। প্রথমবার কি একটা নিয়ে রাগ করে চলে গেছে। আমি পুরো এক সপ্তাহ পাগলের মতো খুঁজে তারপর পেয়েছি। উফফফ!
-মায়রা রাগ করেছে বলে ওকেও লুকিয়ে থাকতে বুদ্ধি দিয়েছে? হায় আল্লাহ! কিন্তু ও যদি বাগান বাড়িতে না থাকে? ও তো চিনবেও না। সেই কবে গেছি আমরা---।
-আরে বাবা? এতো টেনশন নিস না। আমাদের ড্রাইভার আছে সাথে। ড্রাইভারই কল করে বলেছে আমাকে যে ওরা গিয়ে পৌঁছেছে---।
-এটা কেমন কথা! মায়ের কথায় ড্রাইভার ওকে নিয়ে গেলে তোমাকে আবার কেন কল করে বলবে?
-আরে তোর মায়ের তো বিশ্বাস নেই। কখন রাগ করে কোথায় গিয়ে ঘাপটি মারে--। তাই আমি ড্রাইভারকে এক্সট্রা কিছু পেমেন্ট করি--। হা হা হা। আমার খবরির কাজ করে সে--।
-তোমরা দুজনেই এপিক। মাঝখান থেকে আমার সহজ সরল বউটা ফেঁসে গেল।
-হা হা হা। যা এখন। অলরেডি ১২ টা বাজে--। যেতে দু আড়াই ঘন্টা তো লেগে যাবে। মেয়েটা সেই দুপুর থেকে না খেয়ে আছে।
-থ্যাংক ইউ বাবা---।
-হুম। মেয়েটাকে বকিস না। বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনিস। আর কোন ভুল বোঝাবুঝি হলে মিটিয়ে নিস। এসময়ে মেয়েরা একটু হাইপার হয়ে ভুল করে ফেলে--। ব্যাপার না।
-হুম বাবা---।
আয়ান কাউকে কিছু না বলেই গাড়ি ছুটিয়ে বাগান বাড়ির দিকে রওনা হলো। পাগলিটা মন খারাপ করে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে, সাথে আয়ানকেও কষ্ট দিচ্ছে। আয়ান হেসে ফুলস্পিডেই গাড়ি ছোটালো। আজকের দিনে এতো বড় একটা সারপ্রাইজ পাবে ভাবেই নি।
সকাল বেলা চোখে সূর্যের আলো এসে পড়তেই মায়রার ঘুমটা ভেঙে গেল। মায়রা শুয়ে থেকেই আড়মোড় ভেঙে পাশে হাত রাখতেই মনে হলো কেউ একজন একটু আগেই মায়রার পাশ থেকে উঠে গেছে। আশেপাশে তাকিয়ে মায়রা তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। রাতে বাগান বাড়িতে এসেছে কথাটা মনে পড়তেই টেনশনে পড়লো বেচারি। বাড়িতে তো ও একাই ছিল! তাহলে পাশে কে ছিল? মায়রা একটু ঘাবড়ে গিয়েও পরে নিজেকে সামলে নিলো। ভাবলো হয়তো ও নিজেই গড়িয়ে ওপাশে গিয়ে শুয়েছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়রা উঠে হাত মুখ ধুয়ে এসে খাটে বসে পেটে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো।
-কষ্ট হচ্ছে বাবু? মাম্মা রাগ করে চলে এসে তোকে কষ্ট দিচ্ছি না রে ভিষণ? সরি বেবি--।
মায়রা একটু মাথা নিচু করে কাঁদছিলো। তাই কেউ মুখের সামনে খাবার ধরে আছে সেটা খেয়াল করে নি। মানুষটা আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে মায়রাকে দেখলো এক মনে। তারপর বাম হাতের প্লেটটা খাটের উপরে রেখে মায়রার চোখের পানি মুছে দিয়ে খাবারটা মায়রার মুখে সামনে ধরলো।
-হা করো মায়রু? একটু খেয়ে নাও?
-তুমি!
চোখের পানিটা কেউ মুছে দিতেই মায়রা মুখ তুলে আয়ানকে দেখে থতমত খেয়ে গেল। এই মানুষটা এখন এখানে কি করছে সেটাই বুঝতে পারছে না মেয়েটা।
-হ্যাঁ আমি। এখন হা করো। সেই কখন থেকে না খেয়ে আছো সে খেয়াল আছে?
-তু-তু-তুমি! তুমি সত্যি এসেছ?
-নাহ আমার ভূত তোমাকে খাইয়ে দিতে এসেছে। এমনিতেই আমি তোমার উপরে অনেক রেগে আছি মায়রা৷ চুপচাপ খেয়ে নাও--।
-হুম?
-খাও---?
আয়ানের ধমক খেয়ে আর কিছু বলার সাহস হলো না মায়রার। চুপচাপ খেয়ে নিলো। মায়রাকে খাইয়ে দিয়ে আয়ান নিজের আর মায়রার হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে মুছিয়ে দিলো। তারপর মায়রাকে খাটে বসিয়ে দিয়ে পাশে বসে চুপ করে রইলো।
-আয়ান?
আয়ান মায়রার দিকে না তাকিয়েই ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে মায়রার পেটের উপর থেকে শাড়ির আঁচলটা একটু সরিয়ে দিয়ে হাত রাখলো। মায়রার দিকে না তাকিয়েই আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে আলতো করে হাত বুলালো। তারপর নিজের মতো করেই কথা বলা শুরু করলো।
-জানিস বাবু তুই আসবি শুনে বাবাই কত্তো খুশি হয়েছি? তুই তো জানিস বাবাই তোকে কত্তো ভালোবাসে? কিন্তু তোর মাম্মাম এতো পচা। এভাবে রাগ করে চলে আসে কেউ? কিছু হয়ে গেলে আমি তো মরেই যেতাম----। সেই কথাটা একবারও ভাবার প্রয়োজন মনে করলো না বল তো?
-আয়ান?
-শোন বাবাই। আমি কাউকে আগেই বলেছিলাম আরিশা আমার খুব ভালো ফ্রেন্ড। এতোগুলো বছর ও আর আমি সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কটায় একসাথে বাঁধা ছিলাম। ও আমার আপদে বিপদে পাশে থেকেছে। আর ওর যে কোন বিপদে আমিই পাশে থেকেছি--। আচ্ছা বল তো? আজ আরিশার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও কি তোর মাম্মাম সেইম কাজটাই করতো? ধর তাওহীদ যদি আমার ফ্রেন্ড হতো? করতো না নিশ্চয়ই? সমস্যাটা হলো তোর মাম্মাম তোর বাবাই কে বিশ্বাসই করে না। করলে অন্তত আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধনটা নিয়ে এসব ভাবতে পারতো না।
-আয়ান? আম সরি---।
-জানিস বাবু? সেদিন আমি কোন মিথ্যেই বলি নি তোর মাম্মামকে। মিটিং শেষ করে ফেরার সময় আরুর কল পেয়ে ওর সাথে দেখা করতে গেছি। তাওহীদ ভাইয়া ওকে কতটা ভালোবাসে জানিস? আর সেই পাগলীটা নিজের ভয়ের কারণে সেই মানুষটাকে একটা সুযোগ পর্যন্ত দিচ্ছিলো না। ওকে বোঝালাম মানুষটাকে অন্তত একটা সুযোগ দেয়ার জন্য-। কিন্তু তোর মাম্মাম কি ধরে নিলো? সে ভেবে নিলো আমি তাকে মিথ্যে বলে আরিশার সাথে-----। বাহ! ভালো না বল তো বাবা?
-আয়ান? প্লিজ? মাফ করে দাও না? আর হবে না। সরি----।
আয়ান মায়রার সামনে থেকে সরে এসে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করায় মন দিলো। মায়রাও উঠে এসে আয়ানের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে কানে ধরলো।
-সরি তো? মাফ করে দাও প্লিজ?
-আমি কাউকে আগেই বলেছিলাম সে যেন নিজের মতো করে ভেবে না নেয়। তেমন কিছু মনে হলে সরাসরি যেন আমাকে প্রশ্ন করে। সে কি জানে না তার কান্নাটা যে আমার সহ্য হয় না? জানে না যে অভিমানটা ভাঙানো যায়, কিন্তু অবিশ্বাসটা না? জানে না সন্দেহ, ভুল বোঝাবুঝি একটা সুন্দর বন্ধনকে কি করে নষ্ট করে দিতে পারে? অবশ্য আমাকে বলার তো তার কিছু নেই। তার কষ্টগুলো আমার সাথে শেয়ার করবে, তেমন মানুষ হয়তো আমি আজও হয়ে উঠতে পারি নি। আরু ঠিকই বলেছে--। আমারই ব্যর্থতা---।
-আয়ান? আম সরি। আসলে ঠিকই বলে জানো? হুট করে যোগ্যতার চেয়ে বেশি কিছু পেয়ে গেলে অতটা খুশি হওয়ার কিছু নেই। আমার মতো অপয়ার ভাগ্যে হুট করে যতটা খুশি এসে ধরা দিয়েছে---।
মায়রা কথাটা শেষ করার আগেই আয়ান মায়রার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে টেনে শক্ত করে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। মায়রা চমকে উঠে আয়ানের হাত ধরে ফেললো। বেশ অনেকক্ষণ পর আয়ান সরে এসে মায়রার মুখটা তুলে ধরলো দু হাতে। মায়রার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানি পড়ার আগেই সেটা আয়ান ঠোঁট দিয়ে মুছে দিয়ে মায়রার ঠোঁটে আলতো করে কামড় দিলো একটা।
-খবরদার কান্নাকাটি করবা না একদম। আর তোমার এতো সাহস আমার বউকে আজেবাজে কথা বলো? বউ রাগ করেই আসুক বা ভুল বুঝে সে তো আমারই বউ। আমার সামনে আমার বউয়ের নামে এসব বললে কিন্তু খুব খারাপ হবে মায়রা--।
-আম সরি----।
মায়রা আয়ানের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। আয়ানও মায়রাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
-আরে পাগলীটা? এমন কাঁদে না প্লিজ? শরীর খারাপ হবে তো বাবা?
-মাফ করে দাও না প্লিজ?
-হ্যাঁ গো পরী-। এবার মাফ করে দিয়েছি। কিন্তু আর কখনো যেন এমন ভুল না হয় বলে দিলাম। তোমার কোন কিছু খারাপ লাগলে সেটা আমাকে সরাসরি বলবা প্লিজ?
-হুমম--। আসলে---।
-ইটস ওকে লাজুক পরী। আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড। ছোটবেলা থেকে যা ঘটেছে, যা কিছু সহ্য করেছ, তার জন্য হয়তো ইনসিকিউরিটি থেকে ভুলটা হয়ে গেছে--। তাই এবারের মতো মাফ--। ওকে?
-হুম-----।
-কখনো যদি এমন কিছু মাথায় আসে প্লিজ একটু মনে করো যে তোমার আয়ান তোমাকে কতোটা ভালোবাসে--। তোমাকে খুব খুব ভালোবাসি লাজুক পরী--। খুব-।
-আমিও তোমাকে ভিষণ ভালোবাসি----।
-হুম। গুড--। এখন একটু কান্নাটা থামাও প্লিজ? আমি একটু আসছি?
-হুম---।
আয়ান বাইরে গাড়ি থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে এসে মায়রাকে ধরিয়ে দিলো। মায়রা প্যাকেটটা খুলে একটা লাল টুকটুকে শাড়ি দেখে আয়ানের দিকে তাকালো। আয়ান হেসে মায়রার পড়নের ভারি লাল কাতান শাড়িটার কুঁচি একটানে খুলে ফেলে শাড়িটা মায়রার গা থেকে খুলে নিলো। মায়রা আয়ানের হাত ধরে ফেললো।
-এই কি করছো?
-তুমি কাল রাগ করে চলে এসে কার কি কি প্ল্যানিংয়ের চৌদ্দটা বাজিয়েছ জানো?
-মানে?
-মানে? মানে হলো এক বছর আগে গতকালের এই দিনটায় এই লাজুক পরীটা আমার জীবনে এসেছিল। তাকে প্রথম বার দেখেছিলাম। মনে আছে?
-হুম-----।
-আমি কাল কতো শখ করে বউয়ের জন্য এই নতুন শাড়িটা কিনলাম। বউকে আদরে আদরে মাতাল করে তুলবো বলে--। কিন্তু তিনি তো রাগ করে----।
-সরি----।
-এখনই সরি বলো না। আরো আছে---।
-কি! কি আছে?
-কাল আরো কিছুক্ষণ ফাংশনে থাকলে তোমার এমনিতেই ভুলটা ভেঙে যেত পাগলী। কাল তাওহীদ ভাইয়া আরিশাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করার সব এ্যারেঞ্জমেন্ট করে রেখেছিল--। কিন্তু আমরা সবাই তোমাকে নিয়ে এতো টেনশনে ছিলাম যে উনি আর প্রপোজ করে নি---।
-সরি----।
-আরেকটা আছে তো? গতকাল তিথি আর তিয়াশ সবাইকে ওদের রিলেশনের ব্যাপারে বাসায় জানিয়ে দেয়ার প্ল্যান করেছিলো---।
-সরি সরি সরি----।
-আরে পাগলি? কেঁদো না। দেখলে তো তোমার একটা ভুল সিদ্ধান্ত এতোগুলো মানুষের জীবনের কতোগুলো প্ল্যান বদলে দিলো? একটা ভুল এর চেয়ে আরো বেশি কিছু কেড়ে নিতে পারে--। তাই--।
-সরি---।
-মায়রা? তবে তোমার রাগের একটা পজেটিভ দিক হলো তুমি যে কষ্টগুলো চেপে রেখেছিলে এতোদিন ধরে, সেগুলো আমি জানতে পেরেছি। যেসব বাজে অভিজ্ঞতা তোমার হয়েছে সেসবের ছায়া কখনোই তোমার জীবনে আর পড়বে না, এইটুকু তোমাকে কথা দিতে পারি---।
আয়ান মায়রাকে নতুন আনা শাড়িটা পড়িয়ে দিয়ে কুঁচিগুলো গুঁজে দিয়ে বসে মায়রার পেটের তিলটায় গভীর আবেশে একটা চুমো খেল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে মায়রার কপালে ছোট্ট করে একটা চুমো খেয়ে পেটে হাত ছোঁয়ালো।
-লাভ ইউ লাজুক পরী। আর লাভ ইউ বাবাই--।
মায়রা হেসে ফেললো আয়ানের কথা শুনে। আয়ান আলতো করে মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়ালো।
-এবার ম্যাডাম? আপনি কি আমার আর আমাদের লক্ষী বাবুটার সাথে বাসায় ফিরতে চান? নাকি এখানেই রেখে যাবো?
-হি হি--। যাবো তো। নিবে না?
-হুম। নেয়ার জন্য তো রেডি হয়ে আছি---।
আয়ানের কাঁধে মাথা রেখে বাড়ি ফিরছে মায়রা। মনের সমস্ত রাগ, অভিমান, অভিযোগ ওর দূর হয়ে গেছে। এই কয়েকটা ঘন্টার দূরত্ব মায়রাকে যতটা না কষ্ট দিয়েছে তার চেয়ে বেশি একটা শিক্ষা দিয়ে গেছে। শিক্ষাটা হলো ভালোবাসলে ভরসা করতে হয়। সাহস করে নিজের জীবনের সবচেয়ে মধুর বন্ধনের উপরে, নিজের ভালোবাসার হাতে সবটা সঁপে দিয়ে ভরসা করতে হয়। কোন ভুল বোঝাবুঝি হলে সেটা ভাঙন ধরানোর আগেই মিটিয়ে নিতে হয়। নয়তো এতোটা দেরি হয়ে যায় যে সেই ভাঙন আটকানোর সাধ্যও আর কারো থাকে না, সাথে ইচ্ছেটাও থাকে না।
৫০!!
দেখতে দেখতে পাঁচটা মাস পেরিয়ে গেছে। আয়ান আর মায়রার দিনগুলো কাটছে খুনসুটিতে। কখনো আয়ান দেরি করে ফিরেছে বলে অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে মায়রা৷ আর আয়ান ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে মায়রার রাগ ভাঙায়। তাওহীদ আর আরিশাও মাঝে মাঝে অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে যায়। এখন আবার আরিশা মায়রার বেস্টফ্রেন্ডের চেয়েও সম্ভবত বেশি কিছু হয়ে গেছে৷ ওরা দুজনে মিলে আয়ানের চৌদ্দটা বাজিয়ে দিচ্ছে। বেচারা আয়ান অফিসে কাজ নিয়ে আরিশাকে বকা দিতে পারে না, আর বাসায় মায়রাকে কিছু বললে তো হয়েই গেল। দু রমণী একসাথে আয়ানের উপরে চড়াও হয়। এসব ভেবেই আয়ান হেসে একটু নিচু হয়ে বসে মায়রার শাড়িঁর কুঁচিগুলো গুছিয়ে দিচ্ছে। আর মায়রা গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। আয়ান আলতো করে মায়রার পেটে চুমো খেল।
-কি রে বাবাই? মাম্মাম এমন গাল পেঁচার মতো ফুলিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে আছে কেন? তুই কি কিছু করেছিস? নাকি আমি কিছু করেছি রে বাবা?
-এই কি বললা তুমি?
-তোমাকে কই কি বললাম? আমি তো আমার বাবাইয়ের সাথে কথা বলছি--। তুমি শুনছ কেন?
-তুমি কথা বলতেই থাকো। আমি থাকবই না। ধুর----।
-ওই? কই যাবা?
-আমি আরুর কাছে চলে যাবো--।
-মায়রা--? তোমরা দুটো মিলে এসব প্ল্যান করো না?
-হি হি। হুম করি তো। তাতে কি হয়েছে?
-তাতে কি না?
আয়ান আলতো করে মায়রার পেটে নাক নিয়ে ঘষা দিলো। তারপর আলতো করে চুমো খেল আরেকবার।
-বাবুই আজকে কিন্তু রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাবি কেমন? তোর লাজুক পরী মাম্মাম নাহয় তোকেও লজ্জা পাবে--।
-এই কি বলো এসব?
-কই কিছু না তো। বাবুকে বলছি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতে---।
-ওমা কেন? বাবুর সাথে কথা বলবো না আমরা?
আয়ান উঠে দাঁড়িয়ে মায়রাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ ডুবালো।
-কি করছ তুমি?
-আজকে বাবুর সাথে কথা বলতে হবে না। আজকে তুমি আমার আদর খাবা লাজুক পরী---।
-যাহ। কি সব বলো?
-কিছুই বলি না। আদর করবো সেটা বলছি--।
-তিথির বিয়ে সেদিকে হুঁশ নেই জনাবের? দেরি হচ্ছে না?
-ইশ রে! রোমান্সের চৌদ্দটা বাজাতেই হবে সবসময় তোমাকে?
-------------------------------
-আহারে! পরীটা। আমার লাজুক পরীটা গোস্সা করেছে?
-হুম---।
-কেন গো?
-আমার লজ্জা করছে এভাবে বাইরে যেতে--। পেটটা কতোটা বড় হয়েছে---।
-হা হা। পাগলিটা! এসময় পেট বড় হবে সেটা তো স্বাভাবিক রে পাগলী। এতে লজ্জা পাওয়ার কি হলো?
-তবু আমার লজ্জা পায়---।
-তাই তো তুমি আমার লাজুক পরী-।
আয়ান মায়রার গালে একটা চুমো খেয়ে শাড়িটা ঠিক করে মায়রার গায়ে টেনে দিলো যাতে পেট দেখা না যায়। তারপর মায়রাকে নিয়ে স্টেজে গেল। মায়রা স্টেজে গিয়ে তিথিকে জড়িয়ে ধরলো। তিথি মিটিমিটি হাসছে মায়রাকে জড়িয়ে ধরে।
-এই পিচ্চি পরীটা আমার ভাবি হয়ে গেল আজকে--। তা এখন তোমাকে কি বলে ডাকবো গো তিথিমনি? তিথু? নাকি তিথিভাবি?
-ভাবি কি সব বলো? আমি তো তিথি। পিচ্চি তিথি---। হি হি।
তিথির কথা শুনে তিথির পাশে থেকে তিয়াশ, আয়ান, মায়রা, আরিশা, তাওহীদ সবাই হেসে ফেললো। মেয়েটা আজো সেই বাচ্চাদের মতোই ছেলেমানুষটাই রয়ে গেছে। তিয়াশ হেসে তিথির খিলখিল হাসিটা দেখছে। এই দুষ্টু মেয়েটা কি করে যেন তার জীবনের অনেকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। আজ এই পিচ্চিটা সত্যি সত্যি ওর পিচ্চি বউ হয়ে আসছে। আজ ওদের ভালোবাসার বন্ধনটা অফিশিয়াল ভাবে বিয়েতে পূর্ণতা পেয়েছে। আজীবন এই পিচ্চিটাকে পাগলামি ভরা ভালোবাসায় মাতাল করে রাখবে তিয়াশ। অন্তত আজকের দিনে এটাই মনে মনে অঙ্গীকার করলো তিয়াশ।
ছয় বছর পর।
মায়রা পুঁচকে একটা বাবুকে কোলে করে আয়ানের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। আর দুটি ছেলে মেয়ে উঠোনে ছুটোছুটি করছে। একটু পর পর আয়ানের কোলে এসে বসছে একজন। আর সাথে সাথেই আরেকজন টানাটানি করে উঠিয়ে দিয়ে নিজে বসে পড়ছে। আয়ান মায়রা দুজনেই হেসে ফেলছে ওদের কান্ড দেখে। বড় মেয়েটা আবার টুপ করে আয়ানের কোলে বসে পড়লো।
-আমায়া? মামনি? এতো ছুটোছুটি করে না বাবা। ব্যথা পাবা তো?
আমায়া উত্তর দেয়ার আগেই চার বছর বয়সী ছোট্ট ছেলেটা আমায়ার হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিলো।
-আমু আপু। সর সর--। আম্মি বসবো বাবার কোলে---।
-নাহ। আমি বসেছি এখন৷ তুই পরে বসিস---। বাবা? আমানকে মানা করো না? ও মা?
-আমান? বাবা আপু বসেছে? না?
আমান মায়ের পাশে বসে চোখ ডলে কান্না করা শুরু করে দিলো।
-আআআআআআ৷ মা আয়রাকে কোলে করে বসে আছে-। বাবা আমু আপুকে-। আআআআ। আমাকে কেউ আদর করে না। কোলেও নেয় না। আআআআ।
আয়ান কিছু বলার আগেই আমায়া লাফ দিয়ে আয়ানের কোল থেকে নেমে আমানের কাছে গিয়ে চোখ মুছে দিলো।
-আমান? তুই আপুর কোলে আয়? আর আপুকে বাবাই কোলে নিবে। তাহলে তুই কোলে চড়তে পারবি আমিও পারবো। কেমন?
-ইয়েএএএএ। আচ্ছা। আমিও কোলে চড়বো--।
চোখের পলকে আবার আমায়া আয়ানের কোলে গিয়ে বসলো। আর আমান উঠে গেল আমায়ার কোলে। আয়ান হেসে দুজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলো। আর পাশে বসে মায়রা ওদের পাগলামিগুলো দেখে হাসছে। মায়রা আয়রাকে বুকের উপরে ধরে রেখে ঘুম পাড়ানোর জন্য দোলাচ্ছিল এতোক্ষণ। এখন কোলের উপরে নিতেই দেখলো মেয়েটা ঘুমিয়ে কাদা একেবারে। আয়ান সেটা খেয়াল করেই মায়রার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো। আয়ানের হাসিটা দেখেই মায়রা চোখ বড়বড় করে তাকালো আয়ানের দিকে। ইশারায় আলতো করে মাথা নাড়লো। আয়ান ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ঝুলিয়ে মায়রার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আমায়া আর আমানের দিকে ফিরলো।
-মায়রা--? আয়রাকে শুইয়ে দাও যাও। ঘুমিয়ে গেছে--।
-হুম-----।
মায়রা আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে আয়রাকে নিয়ে গিয়ে দোলনায় শুইয়ে দিলো। আমায়ার জেদের কারণে বাগান বাড়িতে এসেছে ওরা। কিছুদিন সবাই মিলে এখানে মজা করবে। মায়রা খাটে পা ঝুলিয়ে দিয়ে ওর নীল মলাটের ডায়েরিটা থেকে চিঠিটা বের করলো। কতো সুন্দর করে ওর এতোদিনের লালন করা স্বপ্নগুলো পূরণ হচ্ছে ভাবতেই মায়রার চোখে পানি এসে গেল। মায়রার চোখ থেকে পানিটা গড়িয়ে পড়ার আগেই আয়ান মুখটা তুলে ধরে কান্নার বিন্দুটুকু শুষে নিলো।
-কারণ অকারণ, কান্না করা বারণ।
-তুমি?
-হুম আমি--। আর কে এসে এভাবে তোমার চোখ থেকে ঝড়া মুক্তাবিন্দুগুলো ঠোঁটে তুলে নিবে?
-হুম---। কিন্তু বাবুরা কই? আমায়া আমান? ওরা উঠোনে একলা আছে? বাইরে চলে গেলে?
আয়ান পিছন থেকে মায়রাকে জড়িয়ে ধরে কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।
-ম্যাডাম--। বাইরে মা, বাবা, তিয়াশ ভাইয়া, তিথি, ওদের পুঁচকে মেয়ে তনয়া সবাই আছে--। ভয় নেই--।
-তুমি এভাবে এলে কেন? সবাই কি ভাববে?
-কি ভাববে? আমি আমার বউয়ের কাছে এসেছি--।
-একদম লজ্জা নেই তোমার--। ছাড়ো--। কেউ হুট করে চলে এলে?
-হুম---। ভালো কথা বলেছো--। দাঁড়াও আগে দরজাটা বন্ধ করে নিই--।
-এই এই এই----?
-শশশশশশ। আয়রা ঘুমাচ্ছে--।
-ওপসসস। সরি সরি----।
আয়ান দরজাটা বন্ধ করে এসে মায়রার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে এক হাতে কানের নিচে হাত দিয়ে মুখটা তুলে ধরলো।
-মায়রা? এখন সম্বোধনে কি ডাকবে সেটা ঠিক করতে পেরেছ?
মায়রা লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিতেই আয়ান আবার মায়রার মুখটা তুলে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে গভীর আবেশে চুমো খেল। তারপর মুখটা তুলে ধরে মুখের দিকে তাকালো।
-আহা! আমার লাজুক পরীটা! এই লজ্জা রাঙা মুখটা দেখলেই তো---।
আয়ানের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই মায়রা লজ্জায় লাল হয়ে দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকলো। আয়ানও সুযোগ পেয়ে মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বিছানায় ফেললো। তারপর দুজনে মিলে হারিয়ে গেল ভালোবাসার অন্য এক দুনিয়ায়। যে দুনিয়ায় খানিক অভিমান থাকবে, খানিকটা পাগলামি থাকবে, অনেকখানি ছেলেমানুষিভরা ভালোবাসা থাকবে। আর সবটুকু জুড়ে থাকবে নিজেদের এই পবিত্র বন্ধনটার উপরে অগাধ বিশ্বাস। যে বিশ্বাস এই বন্ধনটা আরো মজবুত করে আঁকড়ে রাখবে দিনের পর দিন।।
***(সমাপ্ত)***