অচেনা অতিথি - পর্ব ৪৩ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


তিতিরের এখন নিজেকে এতটা ছোট মনে হচ্ছে যে মাহাদের কাছে যেতেও  লজ্জা করছে। কারন তার এখন মনে হচ্ছে মাহাদ যে পরীক্ষা নিয়েছে সেই পরীক্ষায় সে ফেল পড়েছে।  তার কোন যোগ্যতায় নেই মাহাদের সামনে দাড়ানোর।

তিতিরের এমন নিঃশ্চুপ স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকায় মাহাদ ওর বাবার কথার সাথে এবার তিতিরের মিল শতভাগ খুঁজে পেল। তিতিরের সব থেকে বড় সমস্যা সে নিজেকে সবার থেকে নিচু মনে করে। সে মনে করে যত সমস্যা তার জন্য।

মাহাদ তিতিরকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় দাড়োয়ান ছাতা আর টর্চ নিয়ে এদিকে এল। মাহাদের মুখে টর্চ জ্বালিয়ে মাহাদকে দেখে টর্চ অন্য দিকে করে বলল," মাহাদ, তুমি এখানে?"

" জ্বী চাচা, এই বাসায় যাবো এর ভিতর ও চলে এসেছে।"

" যা বলেছ! তোমার বৌ একখান মানুষই বটে। এক নিমিষেই যে ওতবড় গেট টপকাতে পারে সে আর যাই হোক এই বৃষ্টির মধ্য মানুষ হিসাবে গন্য হবেনা। একে ভূতই বলা যাবে। আমার বারন করা স্বত্তেও গেট টপকে চলে এল?"

" মাহাদ মুচকী হেঁসে বলল," ও একটু ঐ রকম স্বভাবেরই  চাচা।"

না না একদম হেঁসে উড়িয়ে দিওনা। ওকে ১০ জন বডিগার্ড দিয়ে রাখলেও, ও যদি ইচ্ছা করে তাহলে সেখান থেকেও ওর চম্পট দিতে এক সেকেন্ডও লাগবেনা। ওকে একটু কড়া শাসন করো বাবা। এরকম করলেতো বিপদে পড়বে। তাকে মনে রাখতে হবে সে ছেলে মানুষ না। ওকে নিয়ে বাসায় আসো বলে দাড়োয়ান চলে গেল।

মাহাদ এবার গাড়ীর উপর থেকে নেমে তিতিরের কাছে এসে বলল," এই তিনদিনে তোমার কেমন কেটেছে তিতির ? আমারতো খুব কষ্টে কেটেছে। মনে হয়েছে তুমি ছাড়া একদিনও আমার থাকা দায়।"

তিতির কিছু না বলে বাসার পথে রওনা দিল। অনেকটা দৌড়েই রওনা দিল। কোথাও একটু দেরিও করলোনা।

তিতিরের এমন ব্যবহারে মাহাদ প্রচন্ড কষ্ট পেল। তবে মাহাদের ধর্য্য ধারন করার ক্ষমতা সাংঘাতিক। তাই ও কিছু না বলে গাড়ী নিয়ে বাসায় ঢুকল। 

♦♦♦♦

তিতিরের পুরো শরীর ভিজা দেখে আসমা বলল," আপা আপনি কই গিয়েছিলেন!"
আসমা দরজাটা বন্ধ করতেই তিতির বলল," আসমা দরজা বন্ধ করোনা। তোমার ভাইজান আসছে।"

কথা গুলো বলে তিতির ওর রুমে চলে গেল। আর আসমা তিতিরের কথা শুনে গোলাবের দিকে তাকিয়ে বলল," কি গোলাব বাবু, তোমার বাবা আসছে। এবার তুমি খুঁশি তো?"

আসমার কথা শুনে গোলাব ফ্লোরে সুয়ে তিনবার পলট খেয়ে আসমাকে জানিয়ে দিল, হ্যাঁ সে আজ ভিষন খুঁশি।

মাহাদ বাসার ভিতর ঢুকতেই গোলাবের খুঁশি দেখে কে? দৌড়ে মাহাদের কাছে গিয়ে মাহাদের পায়ে ওর দু'পা দিয়ে দাড়িয়ে অদ্ভুদ ভাবে ডাকতে লাগলো।

মাহাদ গোলাবের মাথাটা নাড়িয়ে দিয়ে বলল," বাবা, আজ তো তোর জন্য খাবার নিয়ে আসতে মনে নাই।" এরমধ্য আসমা কাছে এগিয়ে এসে মাহাদকে  সালাম দিল।

মাহাদ সালাম নিয়ে বলল," আসমা কেমন আছো?"
আসমা, কিচেনের দক্ষিন দিকের তাকের উপর একটা বক্স আছে। ওখানে ওর স্পেশাল খাবার আছে। ওটা গোলাবকে দাও ও ঠান্ডা হয়ে যাবে। আসমার কথার জবাব আসার আগেই মাহাদ তিতিরের রুমে চলে গেল।

রুমে আসতেই তিতির মাহাদের গায়ে হাত দিতেই মাহাদ দুরে সরে গেল। তারপর বলল," আমার কাজ আমি নিজে করতে পারি। তোমার সহানুভূতির দরকার নেই আমার।"
মাহাদ ওয়াসরুমে চলে গেল। তিতির ওভাবেই দাড়িয়ে রইল। মাহাদ গোসল করে বের হয়ে এসে দেখে তিতির ওখানেই দাড়িয়ে আছে। মাহাদের চুল বয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তিতির আবার চেষ্টা করল মাহাদের কাছে যেতে কিন্তু তার আগেই মাহাদ সরে গেল।

তিতির একটা টাওয়াল নিয়ে মাহাদের হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বেডে বসিয়ে দিয়ে বলল," আপনি যদি এখান থেকে আর এক পা সরেন তাহলে আমি এখুনি রুম থেকে বের হয়ে যাব।"

মাহাদ আর কিছু বললো না। তিতির ভালো করে চুলগুলো  মুছে দিয়ে শরীরের পানি মুছে দিতেই চমকে উঠলো। আপনার শরীরে তো খুব জ্বর। এত জ্বর নিয়ে আবার কেন গোসল করেছেন?

মাহাদ ছোট বাচ্চাদের মত তিতিরের কোমড়টা জড়িয়ে ধরল। তারপর মাথাটা তিতিরের পেটের সাথে ঠেকিয়ে বলল," তিতির তুমি দিন দিন বড় হচ্ছো আর কঠোর হয়ে যাচ্ছো। আমিতো এমন তিতিরকে চাইনা।"

"গায়ে জ্বর বাঁধলো কিভাবে!"

...........................?

"আপনি জানেন, এই তিনটা দিন আমি তিন ঘন্টাও ঘুমাতে পারিনি। আমার সব সময় মনে হত এই বুঝি আপনি কল দিলেন। একটু পর আপনি আমার কাছে চলে আসবেন। কিন্তু আপনি আসেননি।"

" আমিতো রোজ আসতাম কিন্তু আমাকে দেখার মত তোমার মনের সময় হয়নি। তাই তুমি দেখতে পাওনি আমাকে। আমি তোমাকে এটাই বোঝাতে চাইছিলাম যে, আমরা একে-অপরকে ছাড়া থাকতে পারবোনা। তাই ভুলেও মাথা গরম করে ভূল ডিসিশন যেন না নেই আমরা দু'জনেই।"

হঠাৎ মাহাদের ফোনটা বেজে উঠলো। কিছুটা দুরে থাকার জন্য তিতির গিয়ে ফোনটা নিয়ে এসে মাহাদকে দিল। মাহাদ তিতিরকে এক হাত দিয়ে জোড়েই কাছে টেনে এনে কলটা রিসভ করে তিতিরের পেটের সাথে মাথা হেলান দিয়ে বলল," হ্যাঁ মা বলো।"

" এতরাত হয়ে গেল তুই কোথায় আছিস? সেই জ্বর শরীরে বের হয়ে গেলি। আর কত টেনশন করবো তোর জন্য।"

" আমি ঠিক আছি মা। আমি আজ বাসায় যাবোনা।বাবাকে ফোনটা দাও।"

" বাসায় আসবিনা মানে! তুই এই অবস্থায় বাহিরে থাকবি আর আমি স্থির থাকতে পারবো? জলদি বাসায় আয়। না হয় বল কোথায় আছিস আমি গিয়ে নিয়ে আসছি।"

" মাহাদ অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো বৌয়ের কাছে আছি মা। কাল বাসায় যাবো।"

মাহাদের কথায় লাবিবা চমকে উঠলো। মাহাদের শরীর যে ঠিক নেই সেটা লাবীবা বুঝতে পারলো ওর কথায়। মাহাদ, কি উল্টাপাল্টা বকছিস বাবা। তোর তো মনে হয় জ্বর বেরে গেছে। তুই কোথায় আছিস বল আমায়?

"মা আমি কাল যাবো বলে মাহাদ কলটা কেটে দিল।"

মাহাদ তিতিরকে ছেড়ে দিয়ে উঠে টাউজার পরে ট্রী শার্টটা গায়ে দিয়ে বলল," তিতির আমাকে একটু খাবার দাও তো! মেডিসিন খেতে হবে। শরীরটা ভালো লাগছেনা।"

তিতির আর একমুহুত্ব দেরি না করে রুম থেকে বের হয়ে চটজলদি প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে আসলো। মাহাদ বেশি খেতে পারলোনা। একটু খেয়েই মেডিসিন খেয়ে কম্বোল মুড়ি দিয়ে সুয়ে পড়লো। মাহাদ তিতিরকে কাছে ডাকলো। তিতির গিয়ে কাছে বসতেই মাহাদ একটু হাঁসার চেষ্টা করলো। তিতির, আমি মারা গেলে কি তুমি আবার বিয়ে করবা? বিয়ে যেন তুমি করোনা! তাহলে আমার খুব কষ্ট হবে। তোমার উপর অধিকার শুধু একমাত্র আমারই। আমার চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাংখা, ভালবাসা সব তোমার কাছে আমানত হিসেবে রেখেছি। একটা নিদিষ্ট সময়ে সব কিছু তোমার কাছ থেকে সহিসালামতে ফেরত চাইবো। তাই তুমি আমানতের খেয়ানত যেন করোনা। মাহাদ আরো ভুলভাল বকতে শুরু করলো। জ্বরের প্রকোপে বাতাসির সাথে মনের অজান্তেই ঠাট্টা করে চলছে মাহাদ।

তিতিরের চিন্তা বেড়েই গেল। শরীরে জ্বর হু হু করে বেড়েই চলছে। তিতির সরিষার তেল গরম করে এনে মাহাদের পুরো শরীর মালিশ করে দিল। তারপর জলপট্টি দিতে লাগল। এর মধ্য ঘন্টা দুয়েক কেটে গেল। তবুও জ্বর কমার কথা নেই। তিতির আসমাকে ডেকে বলল, " আসমা, হিনু আপুকে একটু ডেকে নিয়ে আস তো।" 
তিতিরের বুক দুরদুর করছে। মাহাদের এতই জ্বর বেড়ে গেছে যে, তিতির যেখানেই হাত দিচ্ছে ওর হাত পর্যন্ত গরম হয়ে উঠছে। তিতির এই অবস্থায় আর কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। 

মাহাদের নাক জ্যাম হয়ে গেছে। তাই জোড়ে জোড়ে মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে। মাহাদের গরম নিঃশ্বাস গুলো অনুভব করে তিতিরের মনে হল, তার অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

এদিকে খানিকপর হিনু আর ওর মা চলে আসল। থার্মোমিটারে জ্বর মেপে দেখল ১০৫ ড্রিগী গায়ে জ্বর। এত রাতে ওরে নিয়ে কই যাবে। বাসায় ছেলে মানুষ বলে আর কেউ নেই। শুধু এক দাড়োয়ান চাচা ছাড়া।
তিতির ফোনটা হাতে নিয়েই কামরান সাহেবকে কল করল।

তিতিরের কল পেয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে কলটা রিসিভ করতেই তিতিরের অস্থির কন্ঠ ভেঁসে আসলো। " বাবা মাহাদের অবস্থা ভালো না। আপনি জলদি আসেন। আর কিছু বলতে পারলোনা তিতির।"

কথাটা শুনেই কামরান সাহেব রুমে এসে শার্টটা গায়ে দিয়ে বের হতেই লাবীবা বলল," এত রাতে কই যান?"

" লাবীবা, মাহাদের কাছে যাচ্ছি।"

" আমি সেই কখন থেকে বলছি ছেলেটা আমার অসুস্থ। সে কোথায় আছে আমাকে বলছেনা। আপনি একটু বলেন না। কিন্তু আপনার তো সময় নেই ছেলের কথা ভাবার।"

" লাবীবা বাজে বকো না। অহেতুক কথাবার্তা সব সময় ভালো লাগেনা। কান্না কাটি থামাও।"

কামরান সাহেব দ্রুত বের হয়ে গেলেন বাসা থেকে। লাবিবাও যেতে চাইলো কিন্তু কামরান সাহেব নিলেন না সাথে।

ডাইনিংরুমের লাইট জ্বালানো দেখে বাতাসির উঠে এসে দেখল লাবীবা ফোন নিয়ে কাকে যেন কল করছে। ও বৌ, এত রাইতে এমন ভূতের মত হাটাহাটি করো কিয়ের লায়?

" ফুয়াদের বাবা বাহিরে গেছে আম্মা। ওনাকে কল দিচ্ছি কিন্তু উনি কল রিসিভ করছেনা।"

" অ্যার পুতের সাথ আবার ঝগড়া লাগছো? তোমার সাহস তো দেহি দিনকে দিন বাইড়াই চলছে। আর পুতের কিছু হলে কিন্তু তোমারে বাড়ি ছাড়া করুম।"

" আজ লাবীবা বাতাসির এমন কথায় ক্ষেপে গেল। লাবিবা চিৎকার দিয়ে বলল," আজ যদি আমার ছেলের কিছু হয় তাহলে আপনাদের মা ছেলের কি হাল করবো সেটা আপনি নিজেও ভাবতে পারবেন না।আপনার ছেলের প্রতি আপনার দরদ থাকতে পারে আর আমার ছেলের প্রতি আমার দরদ থাকবেনা! আজ যদি মাহাদের কিছু হয় তাহলে এই বাসায় আগুন জ্বালিয়ে দিব।"

" মাহাদের এমন কথা শুনে বাতাসির বুকটা মনে হয় ফেঁটে গেল। মাহাদের কি হইছে লাবীবা!"

" আমি কিছুই জানিনা। আপনার ছেলে আমার ফোন রিসিভ করছেনা।"

" বাতাসি আর কোন কথা না বলে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। আল্লাহ্ মাহাদ যেই হানেই থাউক সেই হানে য্যান সহিসালামতে থাউক।"

♦♦♦♦

তিতির এর মধ্য ফুয়াদকেও কল দিয়েছে। ফুয়াদ একটু আগে এখানে এসেছে। সাথে নিসাও এসেছে নিধিকে নিয়ে। নিধি ঘুমিয়ে পড়েছে তাই আসমার রুমে নিধিকে সুয়ে রেখে মাহাদের কাছে চলে আসল।
ফুয়াদ মাহাদকে কয়েকবার ডাকল কিন্তু মাহাদ রেসপন্স করছেনা। ধীরে ধীরে যেন শান্ত হয়ে যাচ্ছে।

নিসাও কয়েকবার মাহাদকে ডাকলো তবুও মাহাদ সাড়া দিলনা। নিসাতো তিতিরকে মাহাদের কাছে যেতেই দিচ্ছেনা। শেষে ফুয়াদের সামনেই নিসা তিতিরকে একটা থাপ্পড় মেরে বলল," শুনেছি মাকে তুমিই খেয়েছ, বাসায় জায়গা হয়নি। এখন মাহাদকে খাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ? একদম ওর কাছে আসবেনা। এই মুহুত্বে এখান থেকে তুমি দফা হয়ে যাও। সব কিছু তোমার জন্য হয়েছে।"

" নিসা কি শুরু করেছ! ওর গায়ে হাত তুলছো কোন সাহসে?" (ফুয়াদ)

" হাত তুলেছি বেশ করেছি। মন চাইছে তো এখুনি খুন করি ওকে বলেই আবার একটা চড় মারতেই হিনু এসে নিসার হাত ধরে ফেলল। 
আমি আগেই জানতাম তোমার স্বভাবের দোষ আছে কিন্তু আজ সেটা নিজের চোখেই দেখলাম। ওর গায়ে আর একবার হাত তুলে দেখ, ঐ হাত আর হাতের জায়গায় থাকবেনা। ও তোমার থেকেও শতগুন ভালো।"

ফুয়াদ আর কিছু বললনা, কারন ফুয়াদ মাহাদকে নিয়ে ব্যাস্ত। ওর এমন অবস্থা চললে ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। 

তিতির দুরে দাড়িয়ে মাহাদের পানে একধানে চেয়ে রয়েছে। চোখের পানি আর পড়ছেনা। বুকের ভিতর পাথর হয়ে গেছে। নিসা মাহাদকে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে আর ফুয়াদ মাহাদের পায়ে জোড়ে জোড়ে তেল মাসেজ করে দিচ্ছে। কারন মাহাদ অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে।

খানিকক্ষণ পড়ে কামরান সাহেব এসে ফুয়াদকে দেখে দরজার সামনেই থেমে গেল। কতদিন পর ফুয়াদকে সে দেখছে। নিজের আবেগকে বলসর্ট মেরে নিজেকে স্বাভাবিক করল।
তারপর তিতিরের দিকে চেয়ে দেখল ও দুরে দাড়িয়ে মাহাদকে শুধু দেখছে। মাহাদের শরীর কেঁপে যাচ্ছে। কামরান সাহেব ডক্টরকে আবার কল দিয়ে বলল," আপনার আসতে আর কতক্ষণ লাগবে?"

" স্যার, একটু সময় লাগবে বলতেই কামরান সাহেব ক্ষেপে উঠে বলল," আপনার আর আসতে হবেনা। আমার ছেলের অবস্থা খারাপ আর আপনি আমার সাথে ঠাট্টা শুরু করেছেন?"

কামরান সাহেব তিতিরের হাত ধরে মাহাদের কাছে নিয়ে গেল। তারপর বলল," মা, তুমি একটু ওকে ডেকে জাগানোর চেষ্টা করো। বাঁকিটা আমি দেখছি।"

ফুয়াদের সাহস আর হলনা মাহাদের কাছে থাকা। মাহাদের কাছ থেকে সরে আসল। কামরান সাহেব সাথে সাথে বলে উঠলো," ফুয়াদ, তোমার স্ত্রীকে আমার চোখের সামনে থেকে সরাও। আমার চোখে যে ওকে দ্বিতীয়বার না দেখি। যে আশায় ও এখানে আজ এসেছে সেটা কোনদিনও পূর্ন হবেনা। ও আমার পরিবারের যতটা ক্ষতি করেছে তার কোন ক্ষমা নেই আমার কাছে।"

শশুড়ের এমন কথা নিসার বুকে এসে বাঁধল। সাথে সাথে অন্য রুমে চলে গেল। 

তিতির মাহাদকে বারবার ডাকতে লাগলো। চারপাশের অবস্থান  ভুলে গিয়ে সবার সামনেই তিতির চিৎকার করে উঠে বলল," মাহাদ, দেখেন আমি আপনার তিতির। উঠুন, আমার সাথে কথা বলুন। আপনি ছাড়া আমার কে আছে বলেন! আমার সাথে একবার কথা বলুন। কথা বলুন আমার সাথে।"

তিতির মাহাদের শরীর কয়েকবার ঝাঁকালো। গভীর পানির নিচে শ্বাস আটকিয়ে থেকে তারপর অনেক কষ্ট করে পানির উপরে এসে যেমন শব্দ করে শ্বাস নেয় তেমন একটা শব্দ করে শ্বাস নিয়ে মা বলে ডেকে উঠলো মাহাদ।  দু'চোখ দিয়ে অঝড়ে পানি ঝড়ে পড়ল।

(মা এমন একটা মধুর, পবিত্র আর প্রিয় ডাক যে মানুষ কষ্ট পেলে এই  মা বলেই সর্বপ্রথম কান্না করে ওঠে। প্রতিটা মানুষের মন,শরীরের কষ্টের সাথে এই মা ডাকটা ভিষন  উৎপ্রেতভাবে জড়িত।)

বাবা, আমার দ্বারা আর সম্ভব নয়। আপনি এখানে জলদি মাকে ডাকেন। ওর মাকে প্রয়োজন।

পরে ওকে ডাকবো। ফুয়াদ এসে মাহাদকে ধরতো ওকে এক্ষুনি হসপিটালে শিফর্ট করতে হবে। ফুয়াদ এসে একাই মাহাদকে কোলে নিয়ে দু'তলা থেকে নিচে নেমে নিয়ে গেল। তারপর গাড়ীর ভিতর তুলেই হিনু এসে বলল," ভাইয়া আমি ড্রাইভ করছি আপনি নিসাকে নিয়ে অন্য গাড়ীতে আসেন।"

ফুয়াদ কোন কথা না বাড়িয়ে হিনুর কথা শুনে গাড়ী থেকে নেমে গেল। কামরান সাহেবে দ্রুত তিতিরকে নিয়ে নিচে নামল। গোলাব আগেই মাহাদের কাছে গিয়ে ওর শরীর ঝাঁকিয়ে ওকে তোলার চেষ্টা করলো। তিতির মাহাদের পায়ের কাছে গিয়ে বসল আর কামরান সাহেব বসে মাহাদের মাথাটা নিজের কোলের  মধ্য নিল। মাহাদ, মাহাদ একটু জেগে থাক বাবা।  আমরা হসপিটালে চলেই এসেছি।

তিতির মাহাদের পায়ে কিস করে ওর পায়ের পাতা নিজের গালের সাথে ঘষিয়ে বলল," আমি জানতাম আল্লাহ্ আমার সাথে এমনই করবেন। কেউ আমার কাছে আসলেই আল্লাহ্ তাকে আমার বুক ছাড়া করে। আমি আর আপনার কাছে থাকবোনা। তবুও আপনি ভালো হয়ে যান। আল্লাহ্ তুমি শুনতে পাচ্ছো, আমি ওর কাছে আর থাকবোনা। এবার তো ওকে ঠিক করে দাও। আমাকে দুনিয়াতে যখন তুমি একা রাখারই সিদ্ধান্ত নিয়েছ তখন আমি সারা জিবন একাই থাকবো। আমার না হয় কিছু নেই কিন্তু ওরতো পরিবার আছে। তাদের কথা ভেবে হলেও ওকে ঠিক করে দাও।

তিতিরের এমন হাহাকার কথা শুনে সামনে ড্রাইভরত হিনু পর্যন্ত ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলো। তিতির চুপ করনা। মাহাদ ঠিক হয়ে যাবে তো।  

শেষে কামরান সাহেব তার পুত্রবধুকে ধমক দিয়ে বলল," তিতির, কি সব কথা বলছো? শান্ত হও,  নিজেকে ধর্য্য ধরে রাখো।"

আমি যে আর ধর্য্য ধরতে পারছিনা বাবা। কোথা থেকে কি হয়ে গেল। আপনি জানেননা বাবা আমি কতটা অপায়া। দেখছেননা আপনার ছেলে কিভাবে শান্ত হয়ে সুয়ে আছে! আমি তো চাইনা আমার সাথে এমন হোক। কেন আল্লাহ্ বার বার আমারই জিবন নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছেন! আমি বলেছি তো আমি আর ওর লাইফে থাকবোনা। তবুও কেন উনি শুনছেন না!

"দেখ, ও আমার ছেলে। আমার কি কষ্ট হচ্ছেনা! আমি কি ভাগ্যকে দোষারোপ করছি? কারন আমি জানি আমার ছেলে সুস্থ হয়েই আমার বুকে ফিরবে। এত অল্পতে ভেঙ্গে পড়তে নেই বাবা। আল্লাহর কাছে অভিযোগ না করে তার কাছে সাহার্য্য প্রার্থনা করো। সমস্ত কিছু উত্তমরুপে সমাধান করতে তার চেয়ে উত্তম আর কে আছে! তাই তার কাছেই সাহার্য্য প্রার্থনা করো।"

" তিতির ধীরে বলে উঠল," আমিতো তার কাছেই রোজ সাহার্য্য প্রার্থনা করি বাবা! তার কাছেই আমার সমস্ত অভিযোগ, অভিমান, চাওয়া সবকিছু।"
তিতির ওর গালের সাথে মাহাদের দু'পায়ের পাতা জড়িয়ে ধরে আছে আর অঝোড়ে কেঁদে চলছে। সেখানে কয়েকটা কিস করে বলল," আমার নাম ধরে একবার ডাকুন মাহাদ। আমার কিছু ভালো লাগছেনা। গোলাব তোর বাবাকে উঠতে বলনা!"

গোলাব মাহাদের দিকে চেয়ে আছে। তারও চোখের পানিতে লোমগুলো ভিজে গেছে যা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

হসপিটালে এসে গাড়ী থামলে মাহাদকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তাররা সাথে সাথে অক্সিজেনের মার্স্ক পড়ে দেয়। কারন মাহাদ ঠিকমত শ্বাস নিতে পারছেনা। কিছুক্ষন পর ফুয়াদ আর নিসাও চলে আসে।

হিনু আর কামরান সাহেব কোন একটা বিষয়ে আলোচনা করছিল। এমন সময় ফুয়াদ ওর বাবাকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, "বাবা আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দেন। আপনাকে খুব মিস করি আমি।  আমার পরিবারকে প্রতিটা মুহুত্বে মিস করি। ছেলে মানুষ তাই চোখের পানি ফেলতে পারিনা সহজেই। কিন্তু এতটা বছর নিজের হৃদয় পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। আপনাকে আমার সব কিছু আগেই বলা উচিত ছিল। প্রায় চারবছর পর আপনাকে ছুতে পেরেছি তাও মাহাদের কারনেই। এর থেকে বড় কিছু আমার কাছে পাওয়ার আর কি আছে?

"তোমার স্ত্রীকে আমার চোখের সামনে আসতে নিষেধ করেছিনা!  তবুও ওকে কেন নিয়ে এসেছ?"

বাবা, ও মাহাদকে খুব ভালোবাসে। ওকে নিয়ে আসতে চাইনি কিন্তু ও জোড় করেই আসলো। তাছাড়া ও মানুষিকভাবে খুব অসুস্থ। ওর চিকিৎসা চলছে। 

কামরান সাহেব আর কোন কথা বললেন না। কারন তার নিসার দিকে ফিরেও তাকাতে মন চাচ্ছেনা।

♦♦♦♦

তিতির গোলাবকে কোলে নিয়ে বসে আল্লাহকে ডাকছে বারবার। এরমধ্য নিসা এসে তিতিরের পাশে বসেই বলল," বাবাকেও দেখছি মাহাদের মত পটিয়ে ফেলছ।  কি করে পটালে তিতির! যাদুবিদ্যা করে? তুমি কি টুকটাক জানো তিতির? আমি তোমার কত আগে তাদের জিবনে এসেছি কিন্তু দেখ, তারা আমাকে সহ্যই করতে পারেনা। আর তুমি পুরো রাজ্যতেই রাজত্ব করে চলেছ। হাত তালি দিয়ে তোমায় অভিন্দন না জানিয়ে আর পারছিনা।"

তিতির কোন কথা না বলেই চুপ করে আছে। ওর মনে কতটা কষ্ট হচ্ছে, সেটা শুধু ওই উপভোগ করছে।

" এই অসভ্য মেয়ে! বড়রা কিছু বললে তার কথার জবাব দিতে হয় সেটা তুমি জানোনা? বাজা মেয়ে একটা।"

" এবার তিতিরের চোখের পানি আর আটকাতে পারলোনা। চোখের পানি উপচে পড়ে গোলাবের লোমশ শরীরে পড়ে হারিয়ে গেল নিমিষেই। "

তিতিরের চোখের পানি নিসাকে প্রচন্ড তৃপ্তি দিচ্ছে। তাই তার মুখ ছুটলো আরো। আচ্ছা তিতির তোমার মনে হয়না তুমি জোড় করেই মাহাদের জিবনে রয়ে গেছ আর মাহাদকে জোঁকের মত চুষে ওর রক্ত পান করছো! ও একটা মানুষ হয়ে দুইটা পরিবারকে ওর কন্টোল করতে হয়। আর তুমি আরামছে পায়ের উপর পা তুলে খাচ্ছো আর ফুর্তি করছো। তোমার এসব করতে লজ্জা করেনা?

ওর লজ্জা করেনা! না তোমার লজ্জা বলতে সামান্য বোধটুকু আছে? ফুয়াদ ভাইয়া বললো তুমি নাকি অসুস্থ। কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম, তুমি মহিলাটা জাতে মাতাল কিন্তু তালে ঠিকই আছো। সব দিকে ঠিক আছো আবার এখানে ওকে  অপমানের ঝুড়িও খুলে দিয়েছ। তোমার ভোলাভালা স্বামীকে বুঝাতে পারবে যে তুমি অসুস্থ কিন্তু তুমি আমাকে বুঝাতে এসনা তুমি একজন মানুষিক রোগী। নিজের স্বভাবটা ঠিক করো। তিতির হয়ে চুপ করে আছে। কিন্তু ওর জায়গায় আমি থাকলে এতক্ষনে তোমায় পাগলা গারদেই রেখে আসতাম। যার যেখানে থাকার উপযুক্ত তাকে সেখানেই রেখে আসতাম। তিতির চল এখান থেকে। ওকে শাস্তিতো উপরওয়ালা দেওয়ার জন্য বসে আছে বলে হিনু তিতিরকে নিয়ে কামরান সাহেবের কাছে চলে গেল।

♦♦♦♦

রাত পেরিয়ে ভোরের দিকে মাহাদের অবস্থার উন্নতি হল। কামরান সাহেব তিতিরের কাছে এসে বলল," মা তুমি বাসায় চলে যাও। লাবীবা সহ বাসার সবাই কিছুক্ষনের মধ্য চলে আসবে। তোমাকে দেখলে সমস্যা হবে। তাই তোমার চলে যাওয়াই বেটার। মাহাদ সুস্থ হলে অবশ্যই তোমার কাছে যাবে।

তিতির মাহাদের সামনে গিয়ে মাহাদকে একটু সময় নিয়েই দেখলো। মাহাদ ঘুমিয়ে আছে। তিতিরের প্রচন্ড ইচ্ছা করছে মাহাদকে একবার ছুয়ে দেখতে। কিন্তু অনুমতি নেই। এত কাছে সে আছে তবুও মনে হচ্ছে হাজার হাজের মাইল দুরে আছে। 
মাহাদ আপনার রেসপন্স আমার জিবন বাঁচানোর জন্য ইশারা করছে। আমি যেন অতল সুমুদ্রের উপরে নিজেকে বাচানোর জন্য দ্বিতীয় বার সুযোগ পেলাম। আপনার আমার জিবনে আগমন মানে আল্লাহর সুবহানাতালার অশেষ রহমত আমার উপর বর্ষিত হওয়া। ভালো থাকুন সবসময়।

তিতির চোখের পানি মুছে হাসি মুখে সেখান থেকে বের হয়ে এল হিনু আর গোলাবকে নিয়ে। গোলাব আসতে চাইছিলোনা তবুও একপ্রকার জোড় করেই তাকে নিয়ে আসা হল।

"বিবাগী এ মন নিয়ে জন্ম আমার?
যায়না বাধা আমাকে কোন পিছু টানের মায়ায়। 
শেষ হোক এই খেলা এবারের মতন
মিনতি করি, আমাকে হাসি মুখে  বিদায় জানা,,,,,ও
আমায় ডেকোনা, ফেরানো যাবেনা
ফেরারি পাখি,,,রা, কুলায় ফে,,রেনা।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন