৭৫!!
দেখতে দেখতেই দুটো দিন কেটে গেছে। আজ আয়ানের বাবা মায়ের ত্রিশতম বিবাহ বার্ষিকী। এর আগে কখনো নিজেদের বিবাহ বার্ষিকী পালন করে নি ইমতিয়াজ আর সাহেবা। এবারে আয়ান, মায়রা আর আরিশা, তাওহীদ চারজনে মিলে পুরো ফাংশনটা আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানটা দুপুরেই। সকাল থেকেই সবাই মিলে হৈ চৈ করতে করতে পুরো বাড়িটা সুন্দর করে সাজিয়েছে ওরা। আরিশা সব কিছু তত্ত্বাবধান করছে, সাথে থেকে হেল্প করছে আয়ান আর তাওহীদ। বেচারি মায়রার শুধু গালে হাত দিয়ে বসে বসে দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ ছিল না। একটুখানি অসুস্থ হয়েছে কি হয়নি তারপর থেকে কেউ একটুও কাজ করতে দিচ্ছে না মেয়েটাকে। রীতিমতো বিরক্ত লাগছে মায়রার। অনুষ্ঠানটা শেষ হলে সবাইকে দেখে নিবে কথাটা ভেবে বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে রুমে চলে এলো মায়রা। কাজ করতে না পারলে অন্তত একটু সুন্দর করে সেজেগুজে সময় পার করা যাবে।
মায়রা শাওয়ার নিয়ে এসে দেখলো আয়ান বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইলে কিছু একটা করছিল। মায়রাকে ওয়াশরুম থেকে বের হতে দেখে আয়ান উঠে বসে মায়রার দিকে তাকালো। মায়রা আয়ানকে একটুও পাত্তা না দিয়ে কাবার্ড থেকে শাড়ি বের করায় মন দিলো। শাওয়ার নিয়ে মায়রা একেবারে সোনালী রেশমি সুতোর ভারি কাজ করা একটা লাল ব্লাউজও পড়ে নিয়েছে। কাবার্ড থেকে সোনালী পাড়ের ভারি একটা টকটকে লাল শাড়ি বের করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে পড়ায় মন দিয়েছে মায়রা। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় আয়ানের মুখটা দেখে কেমন একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে। মায়রা ভাবলো এটাও বুঝি আয়ানের নতুন কোনো দুষ্টুমি করার ফন্দি। লোকটাকে তো একটুও বিশ্বাস নেই। তাই আপাতত রাজ্যের কৌতূহল নিজের মনে চেপে রেখেই শাড়ি পড়ায় মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো মায়রা। একটু পরেই আয়ান মায়রার কোমড় জড়িয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিজেই মায়রাকে শাড়ি পড়িয়ে দেয়ায় মন দিলো। মায়রা কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে আয়ানের কাঁধে হাত ঝুলিয়ে আয়ানের দিকে তাকালো।
-এই যে মিস্টার? কি হয়েছে আপনার?
-কোথায় কি হয়েছে?
-কিছু না হলে এমন ভদ্র লক্ষী ছেলে কি করে হয়ে গেলেন?
-হুম? কি?
-এই যে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছেন এতো চুপচাপ হয়ে। কি করে সম্ভব!
-দুষ্টুমি করলে বলো আমি খারাপ। না করলে বলো করছি না কেন। এতো রকম কথা বললে কোনটা করবো গো বউ?
-মাইর লাগাবো কিন্তু একদম। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবা না বলে দিলাম।
-কথা ঘুরাচ্ছি না গো সোনাপাখি। কুঁচিটা ঠিক করে করতে দাও না বাবা!
-বলো না কি হয়েছে। কি ভাবছ এতো?
-আরে বাবা! কিচ্ছু হয়নি বললাম তো।
-বলতে হবে না যাও। আমি নিজেই শাড়িটা পড়ে নিতে পারবো। আপনার হেল্প লাগবে না। ছাড়ুন।
মায়রা রাগ করে সরে আসার চেষ্টা করতেই আয়ান মায়রার কুঁচিগুলো ধরে টেনে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে সুন্দর করে আবার কুঁচি দিয়ে শাড়িটা পড়িয়ে দিলো। তারপর আঁচলটা মায়রার গায়ে জড়িয়ে ফ্লোরে বসে কুঁচিগুলো গুছিয়ে ছোট্ট করে একটা চুমো এঁকে দিলো মায়রার পেটে। মায়রা একটু কেঁপে উঠে সরে আসার চেষ্টা করলে আয়ান উঠে দাঁড়িয়ে মায়রার ভেজা চুল থেকে টাওয়াল নিয়ে চুল মুছে দিতে শুরু করেছে।
-জানো মায়রু? খুব ভয় করছে আমার। অনেক কথা বলার আছে তোমাকে। কিন্তু কি করে শুরু করবো সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না আমি।
-কি হয়েছে বলো না? আর ভয় করবে কেন?
-আজ বাবা মায়ের এ্যনিভার্সারি না হলে তোমাকে এই রুম থেকে বাইরে একটা পা ও ফেলতে দিতাম না। কিন্তু আজ কি করবো ভেবে পাচ্ছি না পরী। খুব খুব খুব টেনশন হচ্ছে আমার---।
-কেন সেটা বলবে তো? আর রুমের বাইরে আসতে দিতে না কেন? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
-আজকে কয়েকজন গেস্ট আসবে বাসায়।
-হুম। তো?
-আমি চাইছি না তুমি কোনোভাবে তাদের সামনে পড়ো। পরে কি হবে আমি জানি না। শুধু আজকের দিনটা যেন তুমি তাদের মুখোমুখি না হও--। কিন্তু কি করবো? কিছুই ঠিক করতে পারছি না। আগে জানলে আজকে ফাংশনটাই এ্যারেঞ্জ করতাম না--। ধ্যাত---।
-কিসব আবোল তাবোল বকছ? এই? আয়ান? তুমি ঠিক আছো?
-ইয়া। আম ফাইন--।
-ঘোড়ার ডিম ঠিক আছো। বসো তো এখানে। তারপর আমাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলো। কি হয়েছে? আর কে আসবে? যাদের সামনে আমার যাওয়া বারণ! আচ্ছা বারণ হলে যাবো না। সিম্পল। কিন্তু কি হয়েছে কারণটা তো বলবে? নাকি?
-মায়ু? আসলে-----। তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।
-হুম। বলো না?
মায়রা আয়ানকে আগেই বিছানার উপরে বসিয়ে দিয়েছিল। আয়ান এবারে মায়রার হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে মায়রার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো। আয়ান কিছু বলবে এমন সময় দরজায় নকের শব্দে চমকে উঠলো। মায়রা কিছুটা অবাক হয়ে আয়ানের এমন চমকে উঠা দেখলো। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আবার নক হলো রুমের দরজায়। আয়ান ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিলো।
-মা? তুমি এখন? আমমম। কিছু বলবে?
-আরে বাবা তাড়াতাড়ি আয় না তোরা? প্রোগ্রাম শুরু হবে তো একটু পরেই। গেস্টরাও একে একে সবাই আসতে শুরু করেছে---।
-কে? কে কে এসেছে মা?
-তোর খালামনিরা সবাই এসেছে। মায়রাকে নিয়ে একটু জলদি আয় না বাবা? একবার দেখা করেই চলে আসিস তোরা নাহয়। মেয়েটার শরীরটাও খারাপ এখনও। আমি বুঝিয়ে বলবো ওদেরকে। আয় আয় তাড়াতাড়ি আয় বাবা--।
সাহেবা ছেলেকে কথাগুলো বলতে বলতে চলে গেলেন। কিন্তু আয়ান দরজার সামনেই থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কি করবে কিছুই মাথায় ঢুকছে না বেচারার। ডাক্তার সেদিন বারবার করে বলে দিয়েছিল মায়রা যেন কোনোমতে কিছু নিয়ে টেনশন না করে। কিন্তু একটু পর মেয়েটা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে তখন মায়রাকে কি করে সামলাবে আয়ান সেটাই ঠিক করতে পারছে না। আয়ান এসব ভাবতে ভাবতেই মায়রা এসে আয়ানের পিঠে আলতো করে একটা কিল বসালো।
-আয়ান? তুমি এখনো রেডি হও নি কেন? মা কি বলে গেল শুনতে পাও নি? তাড়াতাড়ি করো তো?
-মায়ু? কথাটা শোনো তো আগে?
-উফফ। এখন সময় নেই। যাও তুমি রেডি হয়ে নাও এখন--। তোমাকে তো রাতে দেখে নিবো আমি। কি এমন কথা যে ভদ্রলোক আমাকে বলতেই পারছে না। যাও যাও যাও?
-হুম।
আয়ান চেইঞ্জ করে মায়রার সাথে ম্যাচিং করে গোল্ডেন কালারের ভারি সুতোর কাজ করা চকলেট রঙা পাঞ্জাবি আর গোল্ডেন লেইস বসালো পাজামা পড়ে নিলো। পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে আয়নায় মায়রার সাজ দেখছে আয়ান। পাঞ্জাবির স্লিভস দুটো কনুই পর্যন্ত গোটানো হতেই আয়ান এসে মায়রাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো। মায়রা গালে আলতো করে ব্লাশের গোলাপি আভা ফুটিয়ে তুলতে তুলতে আয়নার আয়ানের দিকে তাকালো।
-এই যে জনাব? নিজে রেডি হয়ে এখন আমাকে জ্বালাতন করা হচ্ছে?
-জ্বালাচ্ছি না। দেখছি।
-কি দেখছো?
-আমার বউটাকে। গালে পিংকিশ আভা ছড়িয়েছ কেন এভাবে? তুমি লজ্জায় লাল হয়ে গাল দুটো টুকটুকে লাল হলেই বেশি মানায় তোমাকে। অবশ্য এই গোলাপি গোলাপি গাল দুটো! আহ! ইচ্ছে করছে খেয়ে ফেলি এখনই।
-তুমি! অসভ্য ছেলে। আবার দুষ্টুমি শুরু করেছ? সরো তো? আমার চুলে খোঁপা করা বাকি---।
-তোমাকে নিয়ে আর পারি না বাপু। একবার বলো দুষ্টুমি করছি না কেন। আবার দুষ্টুমি করলেও দোষ। ধ্যাত।
-তুমি একটা--। এভাবে চুলগুলো পাগলের মতো এলোমেলো করে রেখেছ কেন? চুল ঠিক করো।
-আমি পাগল তাই এভাবেই এলোমেলো করেই থাকবো। আরো এলেমেলো----।
-আয়ান?
আয়ান কিছু না বলে হাসলো। মায়রা এগিয়ে এসে আয়ানের চুল ঠিক করে দিয়ে নিজের খোঁপা করায় মন দিলো। সামনের চুলগুলো একটু পাফ করে ফুলিয়ে খোঁপায় গুঁজলো বাকি চুলগুলো। আয়ানও কোথা থেকে একটা একটা বকুল ফুলের মালা মায়রার খোঁপায় পেঁচিয়ে দিয়ে একটু কাজল মায়রার কানের পিছনে ছুঁইয়ে দিলো।
-কারো নজর না লাগুক আমার লাজুক পরীটাকে।
মায়রা হেসে আয়ানের হাত জড়িয়ে ধরে বাইরের দিকে পা বাড়ালো।
-চলো এখন। সবাই অপেক্ষা করছে।
-পরী? শোনো না? আজ যা ই হোক প্লিজ হাইপার হবে না। প্রমিস করো? আমি পরে তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলবো। কেমন? প্লিজ মায়ু?
-হুম? কিসব বলছ? আচ্ছা ঠিক আছে। এখন চলো?
আয়ান মায়রার পাশে পাশে চলছে ঠিকই। কিন্তু ওর মনটা ডাইনিং রুমের সোফায় বসে থাকা কয়েকজন মানুষের দিকেই নিবদ্ধ হয়ে আছে। প্রত্যেকটা পা ফেলতে রীতিমতো নিজের পায়ের সাথে মনের যুদ্ধ করতে হচ্ছে আয়ানকে। সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাতেই আয়ান টের পেল মায়রার হাতটা কিছুটা আলগা হয়ে এসেছে। নিচে একজনকে চমকে উঠে সোফা থেকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখেই পাশে মায়রার দিকে তাকালো আয়ান। মায়রা সামনের দিলে ঢলে পড়ছে দেখে আয়ান মায়রার হাত টেনে নিজের বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আয়ান মায়রাকে ধরতে এক সেকেন্ড দেরি হলে মায়রা সোজা সিঁড়ি দিয়ে ডাইনিং রুমে এসে পড়তো। কথাটা চিন্তা করতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে আয়ানের। মায়রাকে ধরে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আয়ান। কি করবে কিছুই মাথায় ঢুকছে না বেচারার।
৭৬!!
চারপাশে কেমন একটা চাপা গুঞ্জন হচ্ছে মায়রার। শব্দটা কিসের সেটা বুঝে উঠতে না পেরে ধীরে ধীরে চোখ জোড়া খুলে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো মায়রা। একটা তীক্ষ্ম আলোতে কিছুক্ষণ তাকাতে সমস্যা হলেও ধীরে ধীরে চোখে সয়ে গেল মায়রার। রুমে প্রায় ফিসফিস করে একে অন্যের সাথে কথা বলতে থাকা চিন্তিত মুখগুলো মায়রার পরিচিত। শ্বশুর শাশুড়ির সাথে গলা নিচু করে কথা বলা লোকটা হলো ডাক্তার সাইফ মির্জা, তাদের থেকে কিছুটা দূরে আরশির পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে তাওহীদের সাথে কোনো একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলতে থাকা মানুষটা আরিশা, ওদের বা দিকে পাঁচ জনের ছোট্ট একটা দল করে নিজেদের মধ্যে আলোচনা সভা করা মানুষগুলো হলো আভা, সামি, বাঁধন, তাথৈ, আর রিহান। এতো সব পরিচিত মুখের মধ্যে আয়ানটা কোথায় খোঁজার জন্য একটু চেষ্টা করে নিজের ডান দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মায়রা। মায়রার মাথার কাছে ফ্লোরে বসে আছে লোকটা। মায়রা এতোক্ষণে টের পেল মায়রার বা হাতটা এই ভদ্রলোকটি নিজের দুহাতের মুঠোর মধ্যে পুরে রেখেছে। লোকটা এল দৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে কি এতো ভাবছে সেটা জানার ভিষণ কৌতূহল হলো মায়রার। কোনমতে প্রায় অসাড় হাতের আঙ্গুলগুলো নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করতেই আয়ান চমকে মায়রার দিকে তাকালো। মায়রা ঠোঁটের কোণে একটা ক্লান্ত হাসি টানার চেষ্টা করে বোঝানোর চেষ্টা করলো সে ঠিক আছে। আয়ান ততক্ষণে মায়রার চুলে মাথায় প্রায় উন্মাদের মতো হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো।
-মায়রা? মায়রা? তুমি? তুমি ঠিক আছো? কষ্ট হচ্ছে কোনো পরী? আমি আছি তো পাশেই--। কিছু তো বলো প্লিজ? মায়রু? প্লিজ?
-আয়ান এমন পাগলামি করিস না। মায়রা সেন্সে নেই। এখন তুইও যদি এভাবে ভেঙ্গে পড়িস কেমন করে চলবে বল তো? এই নিয়ে কয়বার বোঝালাম তোকে। টেক সাম রেস্ট ম্যান। প্লিজ? এমন চললে তুই নিজেও অসুস্থ হয়ে যাবি---।
কথাগুলো কে বলছে মায়রা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছে না। এই পাগল ছেলেটাই বা এতো টেনশন করছে কেন? ও তো একদমই ঠিক আছে। এতো ভয় পাওয়ার কি হলো বোকা ছেলেটার? ইশ! লোকটা পারেও বটে! সবাই কি ভাববে? মায়রা এসব ভাবতে ভাবতে আয়ানকে ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে পাচ্ছে হাত জোড়ায়। এবারে তাই আয়ানের মুঠোয় থাকা হাতটা একটু আলতো করে আয়ানের আঙুলগুলোকে চেপে ধরতে সক্ষম হলো। আয়ান এতোক্ষণ কেমন একটা ঘোরের মাঝে ছিল। এবারে মায়রার হাতটা ওর আঙ্গুল আঁকড়ে ধরায় আয়ান বুঝতে পারলো এবারে কোনো ভুল হচ্ছে না। মায়রা সত্যিই জেগে উঠছে। এতোক্ষণ ধরে আয়ানের প্রার্থনা আল্লার দরবারে কবুল হয়েছে। আয়ান কোনোমতে ডাক্তার সাইফ মির্জার দিকে মুখ তুলে তাকালো।
-আঙ্কেল মায়রা চোখ মেলছে। প্লিজ একটু দেখুন?
ডাক্তার সাইফ মির্জা এই নিয়ে চতুর্থ বারের মতো আয়ানের কথায় মায়রাকে চেক করার জন্য এগিয়ে এলেন। বাকিরাও কিছুটা এগিয়ে এসেছিলো। সাইফ মির্জা এবারে সত্যি সত্যি মায়রার চোখ আধো খোলা দেখে তাড়াতাড়ি চেকআপ করায় মন দিলেন। আধ ঘন্টার মতো পরে মায়রার ঘোরটা কেটে চারপাশে কি হচ্ছে একটু একটু করে বুঝতে পারছে। এবারে চোখ খুল রাখতে তেমন কষ্ট হচ্ছে না। সাইফ মির্জা মায়রাকে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করে কিছুটা গম্ভীর মুখ করে কয়েক মূহুর্ত বসে রইলেন। তারপর আবার মায়রার দিকে তাকালেন।
-কি হয়েছিল তোমার কি কিছু মনে পড়ছে মা মায়রা?
-জি আঙ্কেল। আমি আয়ানের সাথে নিচে ড্রইংরুমে আসছিলাম। রুম থেকে বের হওয়ার পরেই চোখ মুখের সামনে কেমন আলো আঁধারি খেলা করছিল। সিঁড়ির কাছে আসতেই চারদিকে একেবারেই অন্ধকার হয়ে গেল। কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। পুরো পৃথিবীটা যেন ঘুরছিল ভন ভন করে। উফফ। পড়ে যাওয়ার আগ মূহুর্তে টের শুধু পেয়েছি আয়ান আমাকে ধরে ফেলেছে। আর কিছু মনে নেই আমার।
-যেটা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই--। ইমতিয়াজ, ভাবি? আপনারা সবাই নিজের মনকে শক্ত করুন। আর আয়ান। বাবা তোমাকে এখন শক্ত হতে হবে। এই মূহুর্তে তোমাকেই বৌমার বেশি করে প্রয়োজন। তোমাকেই ওর খেয়াল রাখতে হবে। নয়তো---।
সাইফ মির্জার কথায় পুরো ঘরটায় পিন পতন নিরবতা বিরাজ করছে। কেউ একটা টু শব্দ পর্যন্ত করতে পারছে না। আয়ান তো নিজের জায়গায় যেন পাথর হয়ে জমে গেছে। মায়রার কি হয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করতেও আয়ানের সাহস হলো না। ছোট্ট বাঁধন ছুটে এসে ডাক্তারের কোট ধরে টানলো।
-আমার আপুর কি হয়েছে আঙ্কেল?
সাইফ মির্জা একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাঁধনকে বিছানায় মায়রার পাশে বসিয়ে দিয়ে নিজে উঠে দাঁড়ালো।
-তোমার আপুর কি হয়েছে সেটা আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। শুধু সন্দেহের বশে তোমাদের সবাইকে এতো বড় কথাটা তো বলতে পারি না। টেস্ট করাতে হবে কয়েকটা। আর সম্ভব হলে সেটা কাল সকালেই করাতে হবে। নইলে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে---। তবে আমি জানি আমার সন্দেহ যে ভুল নয়। এর আগে কতো পেশেন্ট দেখেছি এমন--। হাহ্--।
আয়ানের চোখ বেয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। আয়ান এখনো শক্ত করে মায়রার হাত চেপে ধরে বসে আছে। আর মায়রা থতমত খেয়ে একবার একেক জনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। আর ডাক্তার আঙ্কেলের এমন নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা বলা দেখে মায়রার টেনশনের চেয়ে হাসি বেশি পাচ্ছে। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার এমন সেন্সলেস হয়েছে মায়রা। এই সামান্য ব্যাপারটাকে এমন সিরিয়াসলি নেয়ার কি হয়েছে সেটাই মেয়েটা বুঝতে পারছে না। আর সামান্য কয়েকটা প্রশ্ন করেই রোগ ধরতে পারলে তো এতো এতো চেকআপ, এক্সরে মেশিন, আল্ট্রাস্নোগ্রাফি মেশিন, অমুক মেশিন, তমুক মেশিনের দরকার হতো না। মায়রা কিছুটা বিরক্ত হয়েই এবারে সাইফ মির্জার দিকে তাকালো।
-আমার কি হয়েছে আঙ্কেল?
ইমতিয়াজ আহমেদও এবারে এগিয়ে এসে সাইফ মির্জার কাঁধে হাত রাখলো।
-চুপ করে থাকিস না সাইফ। বল আমার বউমার কি হয়েছে? তুই কি সন্দেহ করছিস?
-ইমতিয়াজ? আমি জানি না তোমরা আমাকে কতোটুকু বিশ্বাস করবে। তবুও বলছি। আমার মনে হচ্ছে মায়রা মামনি আমাদেরকে খুব শীঘ্রি গ্রান্ডচাইল্ড উপহার দিবে----।
-নাআআ। এটা কিছুতেই হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি না। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে আঙ্কেল---। ওয়েট? হোয়াট?
আয়ানের রিএ্যাকশন দেখে সাইফ মির্জা ততক্ষণে হা হা করে গলা ফাটিয়ে হাসতে শুরু করছেন। ঘরভর্তি মানুষগুলো হা করে সাইফ মির্জার দিকে তাকিয়ে তার এমন গুরুতর রসিকতা বোঝার চেষ্টা করছে। ইমতিয়াজ সাহেব এসে সাইফ মির্জাকে একটা ঘুষি দিলেন। তারপর একটু পরে আবার জড়িয়েও ধরলেন।
-আরে ইমতিয়াজ? ভাই এসব কি? এতো বড় সারপ্রাইজের এমন ড্রামাটিক নিউজ দিলাম আর তুই কিনা আমাকে সবার সামনে মারছিস? এসব কিন্তু ঠিক না ইয়ার।
-শালা! তুই সেই কলেজ লাইফের মতোই আছিস। ড্রামাবাজ কোথাকার! আমার ছেলেটার মুখটা কতো শুকিয়ে গেছে দেখেছিস? আরেকটু হলে তো ওকেই হসপিটালে নেয়া লাগতো। শালা! মানুষ হবি না তুই কখনো?
-হা হা হা। আম সরি আয়ান। বাই দা ওয়ে কংগ্রাচুলেশনস টু বোথ ওফ ইউ। কাল অবশ্যই গিয়ে একবার চেকআপ করে নিবে। আর এই যে মামনি? এবারে একটু নিজের খেয়ালটাও একটু রাখুন কেমন? এই অবস্থায় এতো প্রেশার ফল করা কিন্তু ঠিক না। আয়ান ধরে না ফেললে কি অবস্থা হতো তখন একবার ভাবো তো? বাই দা ওয়ে? আয়ান? মিষ্টি খাওয়াচ্ছো কখন? হা হা হা। এতো ঘাবড়ালে চলে বোকা ছেলে? সামনে তোমার কত দায়িত্ব! সেগুলো কে সামলাবে এমন ভয় পেলে হ্যাঁ? চল ইমতিয়াজ? আজ জমিয়ে পার্টি করি দুই বন্ধু। তুই দাদা হচ্ছিস রে ব্যাটা। আর আমিও--।
সাইফ মির্জা আর ইমতিয়াজ নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে বাইরের দিকে চলে গেলেন। বাকি সবাই একে একে এগিয়ে এসে মায়রার চুলে হাত বুলিয়ে কংগ্রাচুলেশনস জানিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। বাঁধনটা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। শেষে আরশিকে নিয়ে খেলতে বলায় নাচতে নাচতে আরিশা আর তাওহীদের সাথে বেরিয়ে গেছে। এই মূহুর্তে রুমে আর কেউ নেই। শুধু আয়ান আর মায়রা। আয়ান থতমত খেয়ে বসেছিল তখনো। মায়রা আয়ানের হাতে আলতো করে অন্য হাতটা রাখতেই আয়ান মায়রার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলো।
-ভয় পেয়েছিলে না খুব?
আয়ান উঠে দরজার দিকে পা বাড়াতেই মায়রা তাড়াতাড়ি উঠে বসার চেষ্টা করলো বিছানায়। কিন্তু শরীরটা বেশ দুর্বল বলে উঠতে পারলো না।
-এই আয়ান? কোথায় যাচ্ছ? তুমি খুশি হও নি খবরটা শুনে?
আয়ান রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আবার এসে আগের মতো ফ্লোরে বসে এবারে মায়রার পেটের উপর থেকে শাড়িটা একটু সরিয়ে ছোট্ট করে একটা চুমো খেল।
-আমি যে কতোটা খুশি হয়েছি মায়রা সেটা তোমাকে আমি বলে বোঝাতে পারবো না। আর তখন ভয়ও পেয়েছিলাম ভিষণ। তোমাকে ছাড়া একটা মূহুর্তও বাঁচবো না তো। প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম তাই। জানো তো খুব বেশি ভালোবাসলে হারানোর ভয়টাই আগে মনে আসে। আমিও তাই--।
-আরে! থামো থামো? অনেক কষ্টে আপনাকে পেয়েছি জনাব। এতো সহজে তো আপনার ঘাড় থেকে নামছি না। মরে ভূত হয়ে হলেও ঘাড়ে ঝুলে থাকবো। হি হি---। এখন এখানে এসে শোও তো? আমি তোমার বুকে থাকবো কিছুক্ষণ। ভালো লাগছে না। কেমন কেমন লাগছে---।
-হুম---।
আয়ান বিছানায় উঠে শুয়ে মায়রাকে বুকে জড়িয়ে নিলো আলতো করে। একটা ভয়ের মাঝে এবার আরেকটা নতুন ভয় যোগ হয়েছে আয়ানের। মায়রা ওদেরকে দেখার আগেই তাহলে সেন্সলেস হয়ে গেছিল। কিন্তু ওরা? ওরাও কি মায়রাকে দেখে নি? বাবা মায়ের এ্যানিভার্সারির প্রোগ্রামটা এখনো শেষ হয়নি। বাইরে আর সবার মাঝে উনারাও নিশ্চয়ই বসে আছে এখনো। এবারের মতো তো ব্যাপারটা মিটে গেছে। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ? এক না এক সময় তো মুখোমুখি হবে ওরা সবাই? তখন? তখন আয়ান কি করে পুরো ব্যাপারটা সামলাবে? আর এই অবস্থায় মায়রাই বা কি রিএ্যাক্ট করবে তাহলে? সব কিছু আবার এলোমেলো লাগছে আয়ানের। চারিদিকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। এই অন্ধকার ভেদ করে বের হওয়ার কি আসলেই কোনো রাস্তা খোলা নেই আয়ানের?