অস্পষ্ট প্রেমাবেগ - পর্ব ০৩ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৫!! 

লাঞ্চ শেষ কিশোর ফালেহা চৌধুরীর রুমে এলো। ফালেহা চৌধুরী সবে একটু রেস্ট করার জন্য বিছানায় শুয়েছিলেন। কিশোরকে দেখে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলেন। কিশোর এসে মায়ের পায়ের কাছে এসে বসলো। 

-কি রে কিশোর? আজ হঠাৎ কি মনে করে মায়ের কাছে এলি? 

-মা---। আমি কি তোমার রুমে আসি না? নাকি আসতে পারি না?

-আসিস না তো তাই বললাম আর কি--। তা তুই কি আজই ঢাকায় ফিরে যাবি? 

-আজই চলে যাব--। 

-ওহ! সেটাই বলতে এসেছিস তাহলে! তা যা চলে--। আবার কবে আসবি?

-মা আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে এসেছি। দয়া করে একটু কি শুনবে আমার কথা?

-তোমার কথা শোনার জন্য তো আমি বসেই থাকি কিশোর। কিন্তু মায়ের সাথে কথা বলার কি তোর সময় আছে? আর দীপ্তি? ও তো তোর নিজের মেয়ে--।

-দীপ্তির দিকে তাকালেই আমার ওই ধোঁকাবাজের কথা মনে পড়ে যায় মা। আমি কি করব!!

-সুপ্তি যা করেছে তার জন্য তো দীপ্তির কোন দোষ নেই কিশোর। তুই ওকে কেন তোর থেকে দূরে সরিয়ে রাখবি? ও তো তোর নিজের মেয়ে। ওর ভাগ্যে তো মায়ের ভালোবাসাটা নেই, তাই বলে কি ও বাবার আদর যত্নও পাবে না? এতোই দূর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে মেয়েটা?

-মা!!!

-মা কি হ্যাঁ মা কি? আমি আজ আছি কাল নেই। আমি মরার পর যে তুই ওকে বাবার স্নেহ দিবি সেটা আমার তো বিশ্বাস হয় না।--।

-মা! কিসের মধ্যে কি বলছো!

-আমি ঠিকই বলছি কিশোর। তুই যখন ওকে দেখবিই না। আর নিজের বাবা থাকতে যখন দীপুকে অনাথের মতোই থাকতে হবে, তারচেয়ে ভালো ও অনাথআশ্রমেই থেকে বড় হোক--। তুই তোর মতো করে নিজের ব্যবসা সামলা, নিজের জীবনটা নিজের মতো করে মাতলামি করে উড়িয়ে দে--। আজ থেকে আমাকে নিয়ে আর আমার নাতনীকে নিয়ে তোর কোন চিন্তাই করতে হবে না। আমিও নাহয় কোন বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব----।

-মা? এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ তুমি। আমি কখন বললাম----।

-আমি বাড়াবাড়ি করছি কিশোর? আমি!! আর তুই যে একটা মেয়ের জন্য নিজের মায়ের কাছ থেকে, নিজের সন্তানের কাছ থেকে এতো বছর ধরে দূরে সরে আছিস সেটা বাড়াবাড়ি না? যে গেছে তার জন্য তুই কেন নিজের জীবনটা শেষ করে দিবি? পৃথিবীতে কি আর মেয়ে নেই? নাকি সব মেয়েই খারাপ সুপ্তির মতো?

-সব মেয়ে খারাপ কিনা আমি জানি না মা। তবে এই মেয়ে জাতটাকে আমি বিশ্বাস করি না আর।

-তোর মাও এই মেয়েজাতের একজন, তোর মেয়েও---। বলার সময় অন্তত একবার ভেবে বলিস কিশোর---।

-সে তো রাগই করো আর যাই বলো। আমি আর কাউকে বিশ্বাস করে হাত ধরবো!! অসম্ভব মা---।

 -কিশোর?

-তবে দীপ্তি তো আমারই মেয়ে--। ওকে কোথাও পাঠাতে হবে না। আমি চেষ্টা করব ওকে সময় দেয়ার---। 

-ওর জন্য তোকে চিন্তা করতে হবে না। ওর জন্য তামান্না আছে--। তুই তোর মতো থাক যা---।

-ওহ!! আমি যা বলতে এসেছিলাম সেটাই আর বলা হলো না। 

-কি বলতে এসেছিলি!! তামান্নাকেও তাড়িয়ে দিতে চাস নাকি? সেটা করার কথা ভুলেও মাথায় আনিস না। দীপ্তি সবে মাত্র মেয়েটার সাথে মানিয়ে নিয়েছে--। আর তামান্নাও মেয়েটাকে------।

-মা। আমি এখনই কিছু বলছি না। তুমি শুধু আমাকে এটা বলো যে উনাকে এ্যাপয়েন্ট করেছ--সব খোঁজ খবর নিয়েছ?

-নেয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। 

-ওফ---। মা!! উনি কি করে খবর পেলেন যে এখানে এলে গর্ভনেসের জবটা পাবেন সেটা কি জানতে চেয়েছিলে?

-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। সেটা দেখেই এ্যাপ্লাই করেছে। সেখান থেকেই গতকাল জয়েন করেছে মাত্র--।

-ওহ!! উনি নাকি উনার অনাথাশ্রমের কাজপত্র তোমাকে দিয়েছে--। সেগুলো আমাকে দিও তো মা৷ একটু খোঁজ খবর নিব লোক দিয়ে---।

-সেটার কি দরকার কিশোর! তামান্না মেয়েটা অনেক ভালো। দেখলেই---।

-মা! উনার খোঁজখবরই নিব শুধু। আর কিচ্ছু না---। কোন সমস্যা আছে?

-আম---। না সমস্যা থাকবে কেন! তোর তো এমনিতেও ওকে পছন্দ না। সেটা তো বুঝাই যাচ্ছে--। ওকে না রাখার---।

-মা? তুমি কি উনার সার্টিফিকেটগুলো আমাকে দিবা?

-আলমারিতেই আছে--। নে যা। 

-হুম----।

-তবে একটা কথা খেয়াল রাখিস কিশোর। ও চলে গেলে দীপ্তিকে কি করে সামলাবি সেটা আমি জানি না। 

-সেটা তখন নাহয় দেখা যাবে--। আমি এখনই বের হচ্ছি মা। কিছু কাজ আছে অফিসে---। 

-হুম----। আচ্ছা। 

কিশোর আলমারি খুলে তামান্নার জমা দেয়া সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে বেরিয়ে এলো। ফালেহা চৌধুরী হাসি মুখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। ছেলেকে ইচ্ছে করেই একটা মিথ্যে কথা বলেছেন তিনি। তামান্নার ব্যাপারে সব খোঁজ খবর নিয়ে তবেই দীপ্তির জন্য গর্ভনেস করে এনেছেন ফালেহা চৌধুরী। কিন্তু কথাটা কিশোরকে বলেননি যাতে কিশোর নিজে থেকে মেয়েটার খবর নেয়। আর তামান্নার ব্যাপারে সবটা জানার পর অন্তত কিশোর মেয়েটার কষ্টটা ফিল করতে পারে। সবটাই আপাতত ফালেহা চৌধুরীর প্ল্যান অনুযায়ী এগোচ্ছে। উনি বেশ ভালো করেই জানেই কিশোর আজই তামান্নার অনাথ আশ্রমে খোঁজ নিবে। ঠিক খোঁজ নিবে না। কিশোর নিজেই যাবে তামান্নার ব্যাপারে যাবতীয় খোঁজ খবর নিতে।

কিশোর মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে দীপ্তির রুমের কাছে এলো। এক মিনিট দাঁড়িয়ে চিন্তা করলো কি করবে। কিছু একটা ভেবে দরজায় একবার নক করলো কিশোর। কেউ দরজা খুললো না। এমন কি কারো সাড়াশব্দও পেল না কিশোর। কিশোর আরেকবার নক করতে গিয়েও থেমে গেল। দরজার লকে হাত দিয়ে চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল। কিশোর দরজাটা হালকা ফাঁক করে ভিতরে তাকালো। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই খাটের উপরে তামান্না আর দীপ্তিকে দেখতে পেল কিশোর। দীপ্তি ঘুমাচ্ছে আর তামান্না দীপ্তির মাথার কাছে বসে খাটের সাথে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে গেছে।

 সম্ভবত তামান্না দীপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিলো। দৃশ্যটা কিশোরের বুকের ভিতরে যেন কেউ হাতুড়ি পেটা করছে। তামান্নার পাশে কি সুন্দর নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে দীপ্তি। আর তামান্না! মেয়েটার মুখেও কিসের যেন একটা প্রশান্তির ছায়া ফুটে আছে। কিশোর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। আস্তে করে দরজাটা টেনে দিয়ে এসে সোজা নিজের গাড়িতে এসে বসলো। চোখের সামনে দীপ্তি আর তামান্নার ঘুমন্ত মুখটা ভেসে উঠছে বারবার। কেন হচ্ছে এমন কিশোর বুঝতে পারছে না। 

কিশোর তামান্নার সার্টিফিকেটগুলো দেখে অনাথ আশ্রমের নাম আর ঠিকানাটা জোগাড় করে নিলো। তারপর শহর থেকে দূরে "দীপশিখা অনাথালয়ের" দিকে গাড়ি ছোটালো। তামান্না নামের মেয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে না জেনে দীপ্তির সমস্ত দায়িত্ব ওর হাতে দিতে সাহস হচ্ছে না কিশোরের। যদিও মেয়েটার তেজদীপ্ত কণ্ঠ, মিষ্টি হাস্যোজ্জ্বল চেহারাটা দেখে কেন যেন কিশোরের ইচ্ছে করছে তামান্নাকে ভরসা করতে। কিশোরের মন বলছে মেয়েটাকে বিশ্বাস করতে। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার সুপ্তির কথাটা মনে হতেই নিজেকে সামলে নেয় কিশোর। আগে তামান্নার ব্যাপারে সব খোঁজ খবর নেয়া যাক। তারপর দেখা যাবে কি হয়। 

০৬!! 

এই মুহূর্তে কিশোর বসে আছে 'দীপশিখা অনাথালয়' এর ওয়েটিং রুমে। তামান্নার ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য অন্য কাউকে পাঠানোর ভরসা হয়নি কিশোরের। তাই নিজেই এসেছে। ঢাকা না গিয়ে সোজা দীপশিখা অনাথালয়ে এসেছে কিশোর। আপাতত অনাথালয়ের পরিচালিকা কোন একটা মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন বলে অপেক্ষা করছে কিশোর। আজই মিস তামান্না রহস্যের সমাধান করবে কিশোর। অন্তত উনার সব কাহিনী জেনে তবে আবার বাড়ি ফিরে যাবে। 

কিশোর বসে এসব ভাবতে ভাবতেই পিয়ন এসে জানালো ম্যাডাম কিশোরকে রুমে আসতে বলেছেন। কিশোরও পরিচালিকার রুমে এসে সালাম জানিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।

-আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। বলুন কিভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?

-আমি আসলে একজনের সম্পর্কে খোঁজ নিতে এসেছি। উনি এখানেই মানে আপনাদের অনাথাশ্রমেই বড় হয়েছেন, লেখাপড়া করেছেন--।

-ও আচ্ছা।  কি নাম বলুন? তবে আমাকে একটু সময় দিতে হবে। আমি লিস্ট দেখে তারপর বলতে পারব। বুঝতেই পারছেন এতো ছেলেমেয়ে আছে আশ্রমে। এর চেয়ে বেশি স্টুডেন্ট এখান থেকে পাস করে ভালো ভালো পজিশনে গেছে--। তাই হয়তো নাম বললেই চিনতে পারবো না--৷

-ইয়া। আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড। আমি জাস্ট একটু উনার ব্যাপারে ভেরিফাই করতে এসেছি। আমার মেয়ের গভর্নেস উনি--।

-তাহলে তো ভালোই। উনার কোন সার্টিফিকেট থাকলে আমাকে যদি দিতেন খুব ভালো হতো। তাহলে ব্যাচ হিসেব করে খুঁজে পেতে সুবিধে হতো--।

-হ্যাঁ হ্যাঁ ম্যাডাম। আমি নিয়েই এসেছি-। গাড়িতেই আছে। আমি নিয়ে আসছি---। জাস্ট ২ মিনিট সময় দিন---।

-আচ্ছা ঠিক আছে।

কিশোর গাড়ি থেকে তামান্নার ফাইলটা নিয়ে আবার পরিচালিকার রুমে এসে দেখলো পরিচালিকার মুখোমুখি হয়ে আরেকজন লোক বসে আছে। মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। কিন্তু কেমন গম্ভীর মুখে পরিচালিকার সাথে কথা বলছেন। কিশোরকে দেখেই চুপ করে গেলেন। কিশোরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন ভদ্রলোক। 

-আপনি কে?

-আম--। আমি কিশোর চৌধুরী। আমার মেয়ের গভর্নেসের ব্যাপারে একটু ইনকোয়ারি করতে এসেছি--।

-ওহ আচ্ছা আচ্ছা৷ বসুন। তা কার ব্যাপারে জানতে চান বলুন। 

-আম---। আপনাকে ঠিক--।

-আমি সোলেমান শেখ। দীপশিখা আমার পারিবারিক অনাথাশ্রম। বংশ পরম্পরায় এই অনাথাশ্রমের বাচ্চাকাচ্চাদের দেখাশোনা করি আমি। 

-ওহ--। এই যে উনার সার্টিফিকেট--।

সোলেমান শেখ সার্টিফিকেটটা হাতে নিয়ে দেখেই চমকে উঠলো। কিশোরের ব্যাপারটা চোখ এড়ালো না। অনাথাশ্রমের পরিচালিকার মুখটাও কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল সার্টিফিকেটে তামান্নার নামটা দেখে। কিশোর বুঝতে পারলো না কি হচ্ছে। আর এই দুজন তামান্নার সার্টিফিকেট দেখে এতো অবাক হয়ে গেল কেন?

-তামান্না!

-আপনারা কিছু বলছেন না যে? উনার ব্যাপারে আমার কিছু জানার ছিল---।

-আপনি শিওর এই মেয়েটাই আপনার মেয়ের গভর্নেস? কি নাম বলেছে ও? তামান্নাই বলেছে তো?

-জি--। তামান্নাই আমার মেয়ের গভর্নেস। কেন বলুন তো? কোন প্রবলেম?

-এই মেয়েটা হলো সমস্ত সমস্যার গোডাউন। ও আপনাদের বাড়িতে থাকলে আপনাদের কোন বড় রকমের ক্ষতি করে দিতে পারে--। 

-ঠিক কি হয়েছে বলুন তো? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। উনি কি কিছু করেছে? 

-করেছে মানে? মেয়েটা একটা বড় রকমের চোর। মাস খানেক আগে আমাদের অফিস থেকে পাঁচ লাখ টাকা চুরি করে পালিয়েছে। 

-অনাথ আশ্রমে পাঁচ লাখ টাকা ক্যাশ!

-ওই দিনই ডোনেশন পেয়েছিলাম। আমার অফিস অনাথ আশ্রমেই। তাই টাকাটাও অফিসের লকারেই রাখি। ওই মেয়ে টাকা নিয়ে পালিয়েছে--। পুলিশ কমপ্লেইনও করেছি--। পুলিশ তো খুঁজেই পায় নি---। সেই থেকে খুঁজছি ওকে--। আপনার বাসার ঠিকানাটা দিন। আমি পুলিশ নিয়ে গিয়ে ধরে আনবো ওকে। এতো বড় চুরি-। জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব এই মেয়েকে আমি---।

-তার প্রয়োজন নেই। ওকে আমিই পুলিশের হাতে তুলে দিব---।

-না না। আপনি বুঝতে পারছেন না। আপনার ঠিকানাটা জানলে আর আমি সহ গেলে পুলিশের ওকে চোর প্রমাণ করতে সুবিধা হতো--। মামলায় একটু জোরালো হবে----।

-আম---। সে রকম কোন দরকার হলে আমি নিজে আবার সে আপনাকে নিয়ে যাব--। আসছি এখন--। সোলেমান সাহেব? সার্টিফিকেট টা??

সোলেমান শেখের হাত থেকে তামান্নার সার্টিফিকেটের কাগজগুলো নিয়ে কিশোর বেরিয়ে এসে নিজের গাড়িতে এসে বসলো। কোথাও একটা গন্ডগোল লাগছে। বারবার তামান্নার হাসিমাখা মুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আর আসার সময় দেখে আসা ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটা মনে পড়তেই সোলেমান শেখের কথাগুলো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে কিশোরের। আসলেই কি মেয়েটা ঠকাচ্ছে ওদেরকে? হাসিমাখা মুখটার আড়ালে কি আসলেই কোন ফেরারি অপরাধী লুকিয়ে আছে!

কিশোর কিছুই বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষণ বসে থেকেও কূলকিনারা করতে না পেরে গাড়ি চালানোয় মন দিলো। সত্যিই যদি তামান্না এমন চুরি করে থাকে তাহলে বাড়িতে মা আর দীপ্তিকে তামান্নার ভরসায় কিছুতেই রেখে আসা ঠিক হয়নি। কিশোর মিনিট পাঁচেকের মতো এসব ভাবতে ভাবতেই ড্রাইভ করলো। হঠাৎ গাড়ির মিররে কাউকে হাত নাড়িয়ে ছুটতে দেখে কিশোর একটু অবাক হলো। লোকটা দীপশিখার পিয়ন। পিয়নকে চিনতে পেরে কিশোর গাড়ি একপাশে ব্রেক করলো। পিয়নও ছুটে কিশোরের গাড়ির জানলার সামনে এসে হাঁফাতে লাগলো।

-আরে? আপনি এতো ছুটে এলেন কেন? কিছু কি বলবেন?

-স্যার----। বড় আপা আপনাকে এই কাগজটা দিতে বলেছে---।

-বড় আপা মানে?

-ওই যে আপনি কথা বললেন? উনি আমাদের অনাথাশ্রমের বড় আপা--।

-ওহ আচ্ছা---। আপনি এতো ছুটে এলেন কেন? একটু দম নিন। হাঁপিয়ে গেছেন----।

-স্যার--।। তাামন্না-----।

-মিস তামান্নার ব্যাপারে আরো কিছু বলতে চান?

-শেখসাব যা বলসে কিছুই সত্য না। উনি তামান্নামারে মিছাই বদনাম দিসে---। 

-কেন? উনি উনার আশ্রমের একজন স্টুডেন্টের নামে কোন বদনাম করতে যাবে!

-সেইসব আপনারে বড় আপাই বলবে---।। কাগজে বড় আপার নম্বর লেখা আছে। আপনে একটু কথা বলে নিয়েন। সোলেমান শেখ পুলিশ দপ্তরে গেছে---। তাই বড় আপা আমারে আপনার কাছে পাঠাইসে----।

-জি--। ধন্যবাদ। 

-আমি আসি স্যার। তামান্না মায়ের খেয়াল রাইখেন---। আসি স্যার---।

বয়স্ক পিয়নটি আবার ছুটতে লাগলো। কিশোর অবাক হয়ে গেল। এটা কি হলো! আশ্রমের মালিক বলছে তামান্না পাঁচ লাখ টাকা চুরি করো পালিয়েছে। তাও এক মাসের মতো আগে। আর আশ্রমের পিয়ন এসে বলছে লোকটা মিথ্যে বলেছে। আর সেই আশ্রমেরই পরিচালিকা কিশোরকে অফিসে কিছু না বলে পিয়নের হাত দিয়ে মোবাইল নাম্বার পাঠিয়েছে কথা বলার জন্য? কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না কিশোরের। পিয়নের দেয়া কাগজটা খুলে নাম্বারটায় ডায়াল করলো কিশোর। তামান্না রহস্য ভেদ না হয়ে আরো জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। রহস্যের সমাধান না হয়ে উল্টো কিশোর তাতে আরো বেশিই জড়িয়ে যাচ্ছে। 

কলটা বাজার প্রায় সাথে সাথেই রিসিভ হলো। কেউ যেন কলটা আসার অপেক্ষায় বসে ছিল টেলিফোনের সামনেই।

-হ্যালো? কিশোর সাহেব বলছেন?

-জি ম্যাম। বলুন---।

-শেখ সাহেব যা বলেছে তার কিছুই দয়া করে বিশ্বাস করবেন না। তামান্না এমন মেয়েই নয়। ওকে ছোটবেলা থেকে আমি নিজের হাতে করে মানুষ করেছি--। বাবা থাকার পরও অনাথের পরিচয়ে মানুষ হয়েছে মেয়েটা। পড়ালেখা আর অনাথা আশ্রমের বাচ্চাগুলোই ছিল ওর জীবন। অনার্স শেষ করে তাই বাইরে না গিয়ে অনাথ আশ্রমেই কাজ করছিল মেয়েটা। তাতেই সোলেমান শেখের সব জারিজুরি ধরা পড়ে যায়। কিন্তু---। সোলেমান শেখ মেয়েটাকে দমাতে না পেরে জোর করে বিয়ে করারও চেষ্টা করে---।

-কি বলছেন? আপনারা কোন স্টেপ নেন নি কেন উনার বিরুদ্ধে?

-কি করে নিব বলুন? উনি অনাথ আশ্রমের ওনার। কোন ঝামেলা হলেই উনি অনাথ আশ্রম বন্ধ করে দিবেন। তখন এতোগুলো বাচ্চা কোথায় যাবে। এদের তো নিজের পরিবারেও ঠাঁই হয় নি---।।

-ম্যাম---। তারপর কি হলো?

-শেখ সাহেব তামান্নাকে জোর করে বিয়ে করতে চাইলে ও পালিয়ে আমার কাছে চলে আসে। গত একটা মাস আমি ওকে নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলাম। কয়দিন আগে গভর্নেসের একটা ভেকেন্সি দেখে ওখানে তামান্নার সিভি দিয়ে আমিই এপ্লাই করেছিলাম। ওখান থেকে রিপ্লাই এলে আমিই তামান্নাকে গোপনে পাঠিয়ে দিয়েছি চৌধুরী ম্যানশনে। 

-ওহ! এতো কিছু হয়ে গেছে---।

-আপনি প্লিজ তামান্নাকে ভুল বুঝবেন না। 

-আরে না না ম্যাডাম।

-আর প্লিজ-দয়া করে সোলেমান শেখের আপনার বাড়িতে যাওয়াটা যে করেই হোক আটকান। উনি পুলিশ কমপ্লেন করতে গেছেন। কি করবে সেটা নিয়েই ভয় হচ্ছে। 

-আপনি টেনশন নিবেন না। আমি দেখছি ব্যাপারটা---।

-থ্যাংকস কিশোর সাহেব।

কলটা কেটে যেতেই কিশোর আবার চিন্তা করতে লাগলো। এখন কি করবে। সোলেমান শেখের বিরুদ্ধে কোন আইনি ব্যবস্থা নিবে, নাকি তামান্নার সেইফটির জন্য কোন কিছু করবে! সব মিলিয়ে কিশোরের মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন