"আশহাদু আল্লাহ্ ইলাহা ইল্লাহু"- বলে যখন চারদিকে ফজরের আযানে মুখরিত ছিল এলাকাটা। ঠিক এমন সুন্দরতম সময়ে মিসেস. তিতির সে তার কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। একটা ফুটফুটে কন্যা মাহাদের ঘর আলোকিত করে মাহাদের জান্নাত হয়ে আগমন করেছে।
ডিএম মো.মাহাদ আহনাফ তার শিশুকন্যার কান্নার শব্দে আরও যেন উত্তেজিত হয়ে উঠলো। ডাইনিং রুমে অধৈর্য সহকারে পায়াচারী যেন তার বেড়েই চলল। সময় যেন তার জন্য থমকে দাড়িয়েছে। অস্থিরতা আর ভালোলাগা দুটোই এসে মাহাদের কাধে জেকে বসেছে।
একটু সময় নিয়ে ড. ফাহমিদা আলীম মাহাদের সমস্ত উত্তেজনার সমাপ্ত ঘটিয়ে মাহাদের কোলে তুলে দেয় তার সুখকন্যাকে। মাহাদ কন্যাকে পেয়ে ডাক্তারের সামনেই কেঁদে ফেলল। তার শিশুকন্যাকে সর্বোপ্রথম বুকের সাথে আলতো করে চেপে ধরলো। তারপর একটু উচু করে আবেগময় কণ্ঠে কন্যার কানে আযানের বাক্যগুলো স্পষ্ট ভাবে পাঠ করতে লাগলো। সাদের বেলায় সে কাছে ছিলোনা তাই মেয়ের বেলায় মনের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটাতে কোন কমতি রাখবেনা। আযানের পবিত্র বাক্য শেষ করেই হাস্যউজ্জ্বল চেহারায় বলে উঠল-
" মা, আজ থেকে তোমার নাম- মাহরীন আহনাফ অতিথী।"
কথাগুলো বলেই মেয়েকে নিয়ে নামাযের কক্ষের দিকে ছুটে গেল। আগে থেকেই সে সব কিছু প্রস্তুত করে রেখেছিল। তিনটা জায়নামায বিছানো। মাহাদের প্রায় ৪ বছরের ছেলে সন্তান "সাদ" তার বাবার কোলে মিষ্টি ছোট্ট বোনটিকে দেখেই খুঁশিতে সুবহানাল্লাহ বলেই দৌড়ে এল বাবার কাছে।
মাহাদ সাদের একহাত ধরে জায়নামাযে গিয়ে দাড়াতেই সাদ বাবার আঙ্গুল ছেড়ে দিয়ে অন্য জায়নামাযে দাড়ালো। মাহাদ ওর মেয়েকে জায়নামাযে রেখেই আল্লাহ্ সুবহানাতালার দরবারে সেজদায় লুটিয়ে পড়লো আল্লাহু আকবার বলে। শুকরিয়ার ২রাকাত নামায আদায় করলো ছেলে এবং মেয়েকে নিয়ে। ছোট্ট মেয়ের কান্নার মধ্যই মাহাদ দু'হাত তুলে আল্লাহর প্রসংসায় মশগুল হয়ে গেল।
"হে দুনিয়া ও সুখময় জান্নাতের পরম করুনাময় আল্লাহ্। আপনি আমাদের পথ প্রদর্শক, আপনি ক্ষমতাশীল। অামরা অসহায় বান্দা আপনার কাছেই আশ্রয় খুঁজি। আপনার সাহার্য্য চাই এবং আমরা সকলেই আপনার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি। আপনার দয়ার কোন তুলনা হয়না। আপনাকে অগুনিত শুকরিয়া জানাই এই মনের প্রানকেন্দ্র থেকে। আপনি আমাকে যে সুখের সাগরে ভাসিয়েছেন তার শুকরিয়া আদায় করার ক্ষমতা আমার নেই।"
মাহাদের দু'চোখ দিয়ে সুখের বৃষ্টি বর্ষন হচ্ছিল। এই সুখময় অশ্রু যে তার প্রভূ কতৃক উপহার।
♥
ডি.এম মো. মাহাদ আহনাফ একজন দেশের সফল তরুন উদ্দ্যেক্তা, আন্তজার্তিক মানের খ্যাতিসম্পন্ন ব্যবসায়ী এবং মন্ত্রী দে.মো. কামরান আহনাফের ২য় পুত্র।
সাদ তার ছোট্ট বোনটিকে আদর করতে ব্যস্ত। পাশে তার নানু আপি ড.ফাহমিদা আলীম বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বসে আছেন।
এদিকে মাহাদ সর্বোপ্রথম তার বাবাকে কল দিয়ে খুশির সংবাদটা জানালো। তারপর শিশুকন্যার দিকে অপলকভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। এরপর মেয়েকে কোলে নিয়ে সাদের হাত ধরে তিতিরের রুমে গিয়ে দেখলো, তিতির অপেক্ষায় চেয়ে আছে দরজার দিকে।
মাহাদকে দেখা মাত্রই তিতির অতিকষ্টে উঠার জন্য চেষ্টা করতেই মাহাদ ওকে ইশারা করলো না উঠার জন্য। মাহাদ দ্রুত তিতিরের কাছে এসে মেয়েকে তিতিরের সামনে ধরেই ওর কপালে একটা কিস করেই উচ্ছসিত কন্ঠে বলে উঠলো-
~" তিতির আজ আমি অনেক খুশি। আল্লাহর দয়ায় আবার একবার আমাকে সুখকন্যা উপহার দেওয়ার জন্য।"
যে মেয়ে কোনদিন মা হতে পারবেনা অথচ আল্লাহর অশেষ রহমতে আজ সে ২সন্তানের মা হয়েছে। এটা আল্লাহর মহিমা ছাড়া আর কি হতে পারে! তিতির মাহাদের দিকে চেয়ে কাপা কন্ঠে বলে উঠলো-
~" আপনি খুশি হয়েছেন?"
~" খুব খুব খুব খুঁশি হয়েছি।"
মাহাদের কথা শোনার সাথে সাথে তিতির কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। তারপর মেয়েকে আরও কাছে টেনে এনে পাগলের মত কয়েকটা কিস করেই সাদকে বলল-
~" বাবা তুমি খুশি হয়েছ! তোমার বোন তো তোমার কাছে চলেই এল।"
সাদ ওর বোনের গালে হাত ছুয়ে খুশি হয়ে বলল-
~" মা এই পুতুলের নাম কি! আমি ওকে কি নামে ডাকবো?"
~" মাহরীন আহনাফ অতিথী। ও আমার অচেনা অতিথী। ওকে অতিথী বলেই ডেক বাবা?"
♥
সকাল ১০টার মধ্য মাহাদের বাসায় ওর পরিবারের সকলে তাদের নতুন অতিথীকে দেখার জন্য চলে আসলো। কামরান সাহেব অবশ্যই আগেই চলে এসেছেন। এখন তার কোলে ছোট্ট "অতিথী" ঘুমিয়ে আছে। এমন সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা তিনি খুব কমই দেখেছেন। মনে হচ্ছে বেহেস্ত থেকে ছোট্ট বুলবুলিটি মাহাদের ঘর আলো করতে চলে এসেছে।
মাহাদের দাদি বাতাসি বেগম তার চেনা স্বভাবে তিতিরের দিকে ঘোর চোখে চেয়ে আছেন। তিনি কতটা খুশি এব্যাপারে কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। তিতির ভয়ে মাথা নিচু করে মুখ কাচুমাচু করে আছে। এই বৃদ্ধা মহিলা খুব একটা সুবিধার নন। তিনি তিতিরকে দু'চোখে সহ্য করতে পারেননা। বাতাসী বিবি হঠাৎ তার মুখখানা গম্ভীর করে বলে উঠলেন-
~" তাহলে তুই তোর বাজা নামটা একেবারে ঘুচিয়েই ফেললি। তা তোর বাপ-মাকে খবর দিয়েছিস তো? তারা তোর মুখ দেখতে আসবে না মুখে ঝামা ঘষে না করে দিবে!"
মাহাদের মা লাবীবা বেগম শাশুড়ীর এমন কথা শুনে আর চুপ করে থাকতে না পেরে কাছে এসে অনুরোধের সুরে বললেন-
~" আম্মা, আজ অন্তত এসব কথা বলবেন না। আমরা সবাই আজ খুব খুশি।"
লাবিবার কথা শুনে বাতাসি বেগম একটা চিক্কুর দিয়ে তার মন্ত্রী ছেলেকে কামু বলে একটা হাঁক ছাড়লেন। শাশুড়ীর এমন কান্ড দেখে লাবীবা গিয়ে বাতাসী বিবির মুখ চেপে ধরে বলল-
" দোহাই লাগে আম্মা, আজকের দিন আর সবার সামনে ওনার সম্মান নিয়ে টানাটানি করবেন না। দয়া করে চুপ থাকুন।"
লাবীবা বাতাসি বিবির মুখ ছেড়ে দিতেই তিনি আরো রেগে গিয়ে জোড়ে চিক্কুর দিতে দিতে বাহির হয়ে দেখলেন তার ছেলে দরজার পিছনেই দাড়িয়ে আছেন মুখটা কাচুমাচু করে। কারন তিনি জানেন, তার মায়ের চটে যাওয়া মানে নিজের মান-সম্মান সকলের কাছে নষ্ট হওয়া। মনের ভিতর ভয় উকি দিচ্ছে কামরান সাহেবের।
ছেলেকে দেখে বাতাসি বিবি গলার জোড় আরো একটু বাড়িয়ে দিয়ে বললেন-
~" আই এহানে আইতে চাইনি। তোর বউ জোড় করে অ্যারে আনছে। তোর বউয়ের কত্তবড় সাহস, অ্যার চোপা চাইপা ধরে। আজ যদি বউরে শাসন না করছোস তাইলে ভাবুম, অ্যাই সত্যই একখান বলদারে পেটে ধরচি।"
কামরান সাহেব মাকে অত্যান্ত সম্মান করেন। মায়ের কথার উপর একটা কথাও বলতে তিনি নারাজ। তার মাতা যাহা বলিবেন তাহাই ঠিক। মা যদি বলেন, বিশ্ব সুন্দরী ঐশ্বরিয়া কালো। তাহলে কামরান সাহেবও সেই কথাকে সার্পোট দিয়ে বলবেন, হ্যাঁ সে কালোয়। তিনি যে এতবড় একটা পদে কর্মরত আছেন তবুও তার মায়ের কাছে তিনি একজন বাচ্চা ছেলে ছাড়া কিছুই নন। এই বৃদ্ধ বয়সে চোর ভেবে মায়ের হাতে কেলানি খাওয়ারও রেকর্ড আছে তার। কামরান সাহেব তার মায়ের কাছে গিয়ে নিচু গলায় বললেন-
~"আম্মাজান, বাসায় গিয়ে সব কথা বলি! তখন যা বলবেন তাই শুনবো। এখন সিনক্রিয়েট করেননা আম্মাজান! আপনার ছেলের আর আপনার একটা সম্মান আছেনা?"
বাতাসি বিবি কিছু একটা ভেবে বলল-
~" হ ঠিক কইছোস। আমাগো একটা মান সুলেমার তো আছে! বাড়ীত যাইয়া তোর বউয়ের বিচার করুম। যাহ্ এহন তোর কাম তুই কর।"
বাতাসি বিবি কামরান সাহেবকে কথাগুলো বলেই ১৭ বছর বয়সি কাজের মেয়ে সাবিনাকে হাকতে হাকতে অন্য দিকে চলে গেলেন।
মা চলে যাওয়াতে কামরান সাহেব যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কামরান সাহেবের পাশে তার বড় আপা রুপালী বেগম এতক্ষন দাড়িয়ে থেকে তাদের মা-ছেলের কান্ড গুলো দেখছিল। রুপলী বেগম ভ্রুজোড়া জড়িয়ে তুলে চোখদুটি বাঁকা করে তার আম্মাজানকে একবার দেখেই বলল-
~" আম্মাজানের এত অত্যাচার তুই সহ্য করিস কিভাবে! তোর জায়গায় আমি বা অন্য কেউ হলে, মনে হয়না তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতাম। তুই পারিসও বটে।"
কামরান সাহেব মুচকি হেঁসে বললেন-
~" আম্মাজানের এমন ব্যবহার যেদিন থেকে বন্ধ হয়ে যাবে সেদিন থেকে হয়ত আমি আমাকে হারিয়ে ফেলব। যাক সে কথা, আপা রেজওয়ান আসলো না যে! ওর কি কাজ বেড়ে গেছে?"
~" রাতিশাকে নিয়ে ডক্তারের কাছে গিয়েছে। মেয়েটা কয়েকটা দিন ধরে অসুস্থ, তাই মৌ আর রাতিশাকে নিয়ে গেছে ও।"
অহ্ বলে কামরান সাহেব চলে যেতেই রুপালী বেগম পিছন থেকে তাকে ডেকে বলল-
" কামরান, এবার মাহাদকে বাড়ী নিয়ে চলনা! আমাদের থেকে আর কতদিন এভাবে আলাদা থাকবে? মাঝে মধ্য ওকে দেশের বাহিরে যেতে হয় তখন তিতির ওর ছেলেমেয়েদের নিয়ে কিভাবে এতবড় বাসাতে একা থাকবে? আর যা দিনকাল পড়েছে, শত্রুর কি আর অভাব আছে আমাদের?"
~" আমিও সে কথায় ভাবছি আপা! আজই ওর সাথে এ বিষয়ে কথা বলব।"
হুম বলে রুপালী বেগম চলে গেলেন অন্যদিকে। আজ এ বাসায় এলাহী কান্ড চলছে। মাহাদের সন্তানের আগমনে মাহাদ ওর অফিসের সব স্টার্ফদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সে আজ বড়ই ব্যস্ত। তাকে পাওয়া খুব কঠিন। তবুও কামরান সাহেব ছেলেকে ডেকে এক কোনে নিয়ে গিয়ে বললেন-
~" তোর সাথে আমার কিছু কথা ছিল।"
মাহাদ মুখে হাঁসি ফুটিয়ে চোখের পলক ফেলে বলল-
" হ্যাঁ বাবা বলেন!"
মাহাদের এমন চমৎকার ময় হাঁসি কামরান সাহেব অনেকদিন পর দেখলেন। নানান চড়াই-উৎরাই এর পর আজ সে সুখের নাগাল পেয়েছে। এমন হাসি তার সন্তানের মুখে সবসময় থাকুক এটাই তিনি চান। কামরান সাহেব কিছুটা ইস্ততবোধ করে চট করে মাহাদের হাত দু'টি চেঁপে ধরে বললেন-
~" বাবা, একটা অনুরোধ করছি। আমার তিতির মাকে নিয়ে এবার আমাদের সাথে বাসায় ফিরে চল। আমি কথা দিচ্ছি, এবার আমি নিজে ওর খেয়াল রাখবো। সবাই আছে কিন্তু তুই আমার কাছে থাকিসনা। আমার খুব কষ্ট হয় মাহাদ। আমার এই অনুরোধটা রাখ বাবা!"
বাবার কথা শুনে মাহাদ কিছু একটা ভেবে একটু সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-
~" বাবা, ওখানে আমরা গেলে সমস্যা শুধু বেড়েই চলবে। আপনি জানেন, তারা তিতিরকে ভালো চোখে দেখেনা। আমার পরিবারের জন্য আমি তিতিরকে ৬ বছরের মত জিবন থেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। এবার যদি এমন কিছু ঘটে তাহলে আমি মরে যাব বাবা! আমি একদম শেষ হয়ে যাব।"
~" দেখ বাবা দেখ, আগে সবকিছু না শুনে এমন সিদ্ধান্ত নেসনা। আগে আমার কথাটা শোন! তুই মাঝে মাঝে দেশের বাহিরে যাস দীর্ঘ সময়ের জন্য। তখন তিতিরের সেভটি বলেও তো কিছু আছে নাকি! আমাদের শত্রুর কি অভাব, বল! তাছাড়া ও আমাদের কাছে থাকলে সেই সেফটিটাও সে পাবে। এই বৃদ্ধ বয়েসে আমাকে আর কষ্ট দেসনা বাবা।"
~" আগে আপনার আম্মাজানকে ঠিক করেন। যত সমস্যা তাকে নিয়ে। তিতির তার কোন সময়ের দুশমন ছিল যে সে তাকে দু'চোখে সহ্য করতে পারেনা! আপনিতো আবার আপনার আম্মাজান ছাড়া কিছুই বোঝেননা। সে যা বলবে সেটাই ঠিক। তার সামনে থাকলে আপনার হাটু কাঁপে। আর আপনি বলছেন সেই জল্লাদটার থেকে তিতিরকে বাঁচাবেন!
আপনি গোড়া শক্ত না করে বিলডিং উঠালে কি সেই বাসা থাকবে নাকি!"
মাহাদ কথাগুলো বলে বাবাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। আর করুন চোখে চেয়ে রইলো কামরান সাহেব তার ছেলে চলে যাওয়ার পথের দিকে।
♥
মাহাদের বান্ধবী রুপী বড় ভাইয়ের স্ত্রী নিসাও তার মেয়ে দু'টোকে নিয়ে মাহাদের নীড়ে এসেছে। এই মহিলাটাও তিতিরকে পছন্দ করেনা। তার একটাই অভিযোগ, মাহাদকে সবার কাছ থেকে তিতির কেড়ে নিয়েছে। মাহাদ বদলে গেছে, তার জন্য তিতিরে কোন ক্ষমা নেই নিসার কাছে। সামাজিক সখ্যতা রক্ষা করতেই এখানে তার আসা। নিসা তিতিরের দিকে একটু ঝুকে গিয়ে দাঁত কটমট করে বলল-
" মাহাদকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে দেখছি খুব সুখেই আছো! নিজের বাবার বাসায় জায়গা না হলে কি হবে, মাহাদকেও সেই পথে আনতে পেরেছ তা আবার কম কিসে?"
তিতির কোন কথার জবাব না দিয়ে ছলছল চোখে নিচের দিকে চেয়ে রইল। অতিরিক্ত চোখের জল-ক্ষরনে টপটপ করে তার শিশুকন্যার গালের উপর জল পড়লো। তিতির সাথে সাথে নাক টেনে ওর মেয়ের গাল ওড়না দিয়ে মুছে দিতেই শিশুটি তিতিরের হাতের শাহাদত আঙ্গুল নিজের হাতের ভিতর মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল।
এমন দৃশ্য দেখে নিসা তাচ্ছিল্য সহকারে বলল-
~" বাহ্, মেয়ের দেখছি মায়ের প্রতি দরদ উছলে উঠেছে। জন্ম নিতে না নিতেই মায়ের তরফদারি করছে। যেমন মা তেমন তার মেয়ে। যাকে বলে মধুমুখী, মুখে মধু কিন্তু অন্তরে বিষ। দেখি তুমি কতদিন মাহাদকে আটকে রাখতে পারো।"
এমন সময় শাশুড়ী এলে নিসা চুপ হয়ে গেল। লাবীবা বেগম নিসাকে নিচে খেতে যেতে বললেন। শাশুড়ীর আগমনে নিসা একটু ক্ষুদ্ধ হয়েছে। আর একটু পরে এলে কি হত! কেবল তিতিরকে শায়েস্তা করতে লাগলো আর এমন সময় ওনার আগমন। রাগকে মনের ভিতর দমে রেখে বলল-
~" মা ফুয়াদ কি এসেছে?"
~" হ্যা এসেছে, তুমি যাও।"
নিসা রুম থেকে বের হয়ে গেলে সাদ তাদের পোষা কুকুর গোলাবকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে বলল-
~" দাদীজান, আসসালামু আলাইকুম।"
লাবীবা পিছন ফিরে সাদকে দেখে খুবই খুঁশি হলেন। সাদ বলতে তিনি অজ্ঞান। সাদকে কোলে নিয়েই সালামের জবাব দিয়ে কয়েকটা চুমা খেয়ে বললেন-
~" আমার ভাইজান এতক্ষন কোথায় ছিল! আমিতো তাকে পাগলের মত এতক্ষন ধরে খুজেছিলাম।"
সাদ ওর দাদীজানকে জড়িয়ে ধরল। আমি বাবার কাছেই ছিলাম দাদীজান। কথাগুলো শেষ না হতেই লাবীবা তিতিরের পায়ে হাত দিল। মা, আমার অতীত পাপগুলো ক্ষমা করে দাও। আমি মাহাদকে ছাড়া থাকতে পারছিনা। আমি রাতে ঘুমাতে পারিনা। তুমি একটু মাহাদকে বুঝিয়ে বললেই ও শুনবে। ওকে একটু বুঝিয়ে বলোনা মা! আমি বলছি, তোমাকে কেউ কিছু বলবেনা। আমি আমার পরিবার পূর্ন করতে চাই।
কথাগুলো বলার মাঝে ড. ফাহমিদা আলীম ও ড. আলীম এসে তিতিরের সামনে বসলো। মা আসমার সাথে কথা বলতো! ও অনেক্ষন থেকে বলছে তোমার সাথে কথা বলবে। ড. আলীম তিতিরের হাতে ফোন দিতেই আসমা সালাম দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আপা আপনাকে ছাড়া আমি এখানে থাকতে পারছিনা। আপনাকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হয়। ওয়াহিদও বিশেষ ট্রেনিং এ কানাডায় গিয়েছে। আমি অনেকটা একা হয়ে গেছি আপা!
তিতির ৩টা বছর পর মাহাদের কাছে আসার দিন আসমা আর তার স্বামী ড. ওয়াহিদ ইব্রাহীম পাকিস্তানে পাড়ি জমায়। তিতিরের বিপদে-আপদে এই আসমা আর গোলাব সবসময় ছায়ার মত থেকেছে। তিতির নিজেকে শক্ত করে বলল-
~" আসমা, তুমিতো অনেক শুখিয়ে গেছ বোন! তোমার শরীর খারাপ হলে কিন্তু প্রথমে আমার মেয়ের কাছে জবাব দিহিতা করতে হবে।"
কথাগুলো বলে "অতিথী" কে দেখালো তিতির। আসমা শিশুটিকে দেখে ফ্লাই কিস করে বলল-
~" আপা ওতো একদম আপনার কার্বন কপি। ওর নাম কি রেখেছেন!"
~" মাহরীন আহনাফ অতিথী।"
~" অতিথী! আপনার অচেনা অতিথী? সত্যিই আপনার জিবনে মাহাদ ভাইজান "অচেনা অতিথী" হয়েই প্রবেশ করেছিল। আর আপনি আমার দেওয়া মাহরীন নামই রেখেছেন?"
তুমি রেখেছ সেটা আমি অগ্রার্য করি কিভাবে! তিতির অতিথীর গালে আঙ্গুল ছুয়ে দিল। মা, দেখ তোমার আন্টি তোমায় ডাকছে দুর দেশ পাকিস্তান হতে। মিসেস. ফাহমিদা অতিথীকে কোলে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলেন, যাতে তিতির ভালোভাবে আসমার সঙ্গে কথা বলতে পারে। তিতির আসমার সাথে আরও কিছুক্ষন কথা বলে সাদকে ফোনটা দিল। সাদ ফোন নিয়ে দাদীর কোল থেকে নেমে কথা বলতে লাগল।
এমন সময় আলীম সাহেব বললেন-
~" মা দু'দিন পর আমরা নিউজিল্যান্ডে ফিরে যাচ্ছি। বেশ লম্বা সময় ধরে এখানে আছি আমরা। এবার আমাদের ফিরতে হবে। ওখানেই আসমাকে নিয়ে গিয়ে কিছুদিন কাটাবো। তোমার মাইকেল আঙ্কেলের জন্য কোন মাসেজ থাকলে আমায় বলে দিও। আমি তাকে বলবো। সে তোমাকে খুব মিস করে।"
মি. আলীমের কথা শুনে তিতিরের চোখে এবার পানি চলে আসলো। তিনটা বছর তিনি আগলে রেখেছিলেন তিতিরকে। নিজের বাবা খোঁজ না নিলেও এই মানুষটা বাবার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। তিতির যখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল তখন এই দু'টো মানুষ তাদের সমস্ত চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন মৃত্যু নামক ঐ ভয়াভয় আতঙ্কের থাবা থেকে তিতিরকে বাঁচানোর জন্য। তিনটা বছর নিউজিল্যান্ডে কাটিয়েছে শুধুমাত্র তাদের আশ্রয়ে। আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া এমন বাবা-মাকে তিতিরের সাহার্য্যর জন্য পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। তিতির কথাগুলো ভাবতেই ফুয়াদ এসে সবাইকে ডেকে নিয়ে গেল খাবারের জন্য। এমন সময় সাবিনা রুমে ঢুকে আপা বলে একখান চিক্কুর দিয়ে তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলল-
~" আপা আপনি কেমন আছেন কন তো! আই ঐ বাড়ীত থাইকা এহানে আইতে চাই কিন্তু বজ্জাত দাদী আইতে দেয়না। বুড়ির এক পাও কব্বরে গেছে তাও বজ্জাতি করার খান্ত দিলোনা।"
~"ছিহ্ বোন, এভাবে কাউকে কিছু বলতে নেই। পরিনিন্দা করা ও শোনা দু'টিই গিবতের শামীল।"
আপা আন্নেরে কোন মাটি দিয়া গড়াইছে আল্লাহ্ কনতো! আই আন্নের মত না। কেউ কিছু কইবো আর আই ফাও ফাও শুনবো! কক্ষনও না। কথাগুলো বলে সাবিনা একটু থামল। তারপর আবার বলল-
~" আপা এত ভালো হওন ভালা না! সবাই আন্নেরে কষ্ট দিতেই থাকবো। একজন শেষ করবো তো আরেকজন শুরু করবো। ছাওয়াল-পাওয়াল হইছে একন অন্তত নিজেকে শক্ত করেন। আন্নে কি করবেন আই জানতাম নো, তয় আই যা ভালো মনে করচি হেইডাই আন্নেরে কইলাম।"
সাবিনার কথা শুনে তিতির শুধু হাঁসল কিন্তু কিছু বললোনা। ইতিমধ্য গোলাব বেডে উঠে তিতিরের ওড়নার নিচে আশ্রয় নিয়েছে। তিতিরের শরীরের সাথে নিজের শরীর ঘষিয়েই একটা পলট খেল। তিতির ওর শরীরে হাত বুলাতেই গোলাব তিতিরের হাতে জ্বীভ দিয়ে দুইবার ছুয়ে দিল।
একটা পশু আর মানবীর এমন প্রেম দেখে সাবিনা অবাক হয়ে বলল-
~" আপা হেই সত্যই আন্নের সন্তান। এত বছর ধরে আন্নেদের কাছে আছে তয় কোন অভিযোগ নাই। কয়ডা এমন কুত্তা মানষের থায়ে।"
কুত্তা বলেই সাবিনা জ্বীভে কামড় দিয়ে আবার তিতিরের দিকে চেয়ে বলল-
~" দুঃখিত আপা, হেই তো আমাগো গোলাব।"
এভাবেই পুরো দিনটা কেটে গেল। আনন্দ অশ্রুর মত সময়টা কাটলো তিতিরের। কেউ ভালোবাসায় ভরিয়ে দিল কেউবা কথার তীক্ষ্ণ ধারে খুঁচিয়ে দিয়ে চলে গেল। সবাই যাওয়ার আগে মাহাদকে বার বার করে বাসায় ফিরে যাওয়ার কথাটা ভাবতে বলল। কামরান সাহেবতো সাদকে বুকে নিয়ে কেঁদেই ফেললেন।