১৫!!
রাতে খাবার টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে মায়রা টেরই পায়নি। একটু শক্ত শক্ত লাগছে মাথার নিচে। কারো দুটো হাত জড়িয়ে ধরে আছে ওকে আষ্টেপৃষ্টে। মিষ্টি ঘ্রানটা নাকে এসে লাগছে বারবার। ধড়ফড় করে চোখ জোড়া খোলার চেষ্টা করলো মায়রা।৷ কিন্তু ঘুমের ঘোরে চোখের পাতারা একে অন্যকে আরো জড়িয়ে ধরছে।। যতই চেষ্টা করছে ঘুমটা ততই যেন জেঁকে বসছে চোখে, মস্তিষ্কে।। তবুও শেষ একবার চেষ্টা করে চোখ খুলে তাকাল মায়রা। বহুদিন মানুষটার ঘুমন্ত মুখটা দেখে না।৷ লোকটা কখন আসে আর কখন যে যায়-টেরই পায় না মায়রা। এখন কি গভীর রাত?? নাকি ভোর হতে চলেছে?? মানুষটার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে?? এখনই কি উঠে চলে যাবে মানুষটা??
মায়রা আয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছে। ক্লান্ত-শান্ত মুখ। দুষ্ট হাসিটা ঠোঁটের কোণে নেই।। তবু এই মুখে কিছু একটা আছে।। যেটা মায়রাকে বারবার তার দিকেই টানে।৷ মায়রা আয়ানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আর আয়ান ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। একটু মুখটা তুলে ঘড়িটা দেখবে কিনা ভাবলো মায়রা। মানুষটা ঘুমাচ্ছে শান্তিতে। নড়াচড়া করলেই যদি ঘুমটা ছুটে যায়!! অবশ্য আয়ানের বুকের মৃদু ঢিপঢিপ হৃৎস্পন্দনের শব্দে ঘোর ঘোর লাগছে মায়রার। বারবার ঘুম চলে আসতে চাইছে।
মায়রা বেশ কায়দা করেই মাথাটা আয়ানের বুক থেকে তুলে ঘড়ির দিকে তাকালো।। ৭টা বাজে।। আয়ান এখনো বাসায়!! মায়রা কিছু একটা ভেবে আস্তে আস্তে উঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু একটু সরে আসতেই আবার জাপটে বুকে টেনে নিলো দুটো হাত।। মায়রা আয়ানের মুখের দিকে তাকাল। চোখ খুলে তাকায় নি আয়ান। ভারি পর্দার ফাঁক দিয়ে আধো আলো আঁধারিতে আয়ানের ভ্রু কুঁচকানো মুখটা দেখছে মায়রা। চোখ না খুলেই মায়রাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো আয়ান।।
-এতো নড়ো না তো বাবা--।। ঘুমাতে দাও একটু শান্তিতে---।।
-তুমি ঘুমাও না---?? আমি তোমার জন্য একটু নাস্তা বানাই---।।
আয়ান চোখ না খুলেই মায়রার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল।। মায়রা চোখ বড় বড় করে আয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।।
-কথা কম--।। কোথাও যাচ্ছি না আমি এখন--।। সো চুপ করে বুকে ঘুমাও--। আর আমাকেও ঘুমাতে দাও--।। আর একবার উঠার চেষ্টা করবা তো--।। আশা করি বলা লাগবে না---।।
-হুম-----।।।
সারাদিনটা দুজনের বেশ ভালোই কাটলো। অনেকদিন পর আজ দুজনে একসাথে লাঞ্চ করেছে। আজ সোমবার। ছুটির দিন না। তবুও আয়ান বাসায়!! ভাবতেই ভালো লাগছে মায়রার। অবশ্য আয়ানের বাসায় থাকার কারণও আছে। সন্ধ্যায় অফিসে একটা বিজনেস পার্টি আছে। সেখানে আয়ানের সমস্ত কলিগরা পার্টনার নিয়ে আসবে।৷ ক্লাইন্টরাও আসবে।। তাই আয়ান আর মায়রা দুজনকেই যেতে হবে। আর এই কয়টা দিন যে ডিলটা নিয়ে কাজ করেছে সেটাও সাবমিট হয়ে গেছে। সো আজকে তার ছুটি। সারাদিন দুজনে ইচ্ছে মতো খুনসুটিতে মেতে ছিলো। বহুদিন পরে আয়ান আজ মায়রাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছে। আর একটা দিনেই মায়রার মনের সমস্ত অভিমানের বরফ গলে পানি হয়ে গেছে। প্রিয় মানুষটার আলতো স্পর্শও মনকে খুশিতে ভরিয়ে দিতে পারে--। আর এখানে তো স্বয়ং পুরো মানুষটাই আছে--।
সন্ধ্যায় আয়ান মায়রাকে রেডি হতে বলে নিজে একটু বের হলো। কিছু একটা কাজ আছে। মায়রা কি পড়বে ভাবছে।৷ অন্য সময় কি পড়বে সেটা নিয়ে মায়রাকে একটুও ভাবতে হতো না। আয়ান সবটা আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রাখতো। এখন মানুষটা কাজের চাপে হয়তো ভুলে গেছে। সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে কি পড়া যায় সেটার দিকে মনোযোগ দিলো মায়রা।
হাফ সিল্কের নীল রঙা একটা শাড়ি প্রচন্ড পছন্দ হলো মায়রার। সেটাই পড়ে নিলো। সেটার সাথে ম্যাচিং করে নীল পাথরের গলায় চেইন, কানে দুল পড়লো। হাতে নীল রেশমি চুড়ি। চুলটা সামনে একটু পাফ করে ফুলিয়ে খোঁপা করলো। সব কটা ড্রয়ার খুঁজেও সবুজ কাজলের কৌটোটা পেল না৷ কবে যে কাজলটা শেষ হয়েছে খেয়ালই নেই মায়রার।৷ আর নতুন করে এক কৌটো কাজল কিনে আনবে সে সময়ও পায় নি।। কি আর করা!! চোখে কালো মোটা করে কাজল পড়লো মায়রা। আর ঠোঁটে হালকা কালারের একটা লিপস্টিক।। আয়নায় নিজেকে দেখে মৃদু হাসলো মায়রা। টিপটা না হয় আজকে আয়ানের জন্যই তোলা থাক।।
-মায়রা--। আমরা পিকনিকে যাচ্ছি না--। একটা পার্টিতে যাচ্ছি--।। তাও বিজনেস পার্টি---।।একটু তো ড্রেস আপটা সেটার সাথে ম্যাচ হয় মতো করবে---!!??
আয়ানের কথাটা শুনে মায়রা পিছনে ফিরে তাকাল। আয়ান এমন কিছু বলেছে মায়রার বিশ্বাসই হচ্ছে না৷
আয়ান মায়রার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। আজ আয়ানের চোখ দুটোতে মায়রাকে দেখে না বিস্ময় খেলা করছে না- না চোখদুটো অবাক হয়ে মায়রার চোখে ডুব দিচ্ছে। অবাক বিস্ময়, কৌতূহল আর ছেলেমানুষির পরিবর্তে সেখানে আজ একরাশ বিরক্ত দেখতে পাচ্ছে মায়রা। বিরক্ত হওয়ার মতো কি করেছে ভাবছে মায়রা। খুব একটা সাজগোজ ও কখনো করে না। যা একটু সাজে সেটা কেবল আয়ানের জন্য বা আয়ান ওকে যে রূপটাতে দেখতে চায় তেমন রূপ নেয় মায়রা। আজকে কি মায়রার রূপটা আয়ানের মন মতো হয় নি??!!
নাকি নেহার কথাই ঠিক?!! মায়রার ছেলেমানুষি- সাদাসিধে চলন এখন আর আয়ানের পছন্দ হচ্ছে না? বিরক্ত লাগছে খুব??
-মায়রা?? তোমাকে কি বলছি??! এটা কি পার্টির গেট আপ!!??
-আ-আমি-আমি তো --জানি না পার্টির জন্য কেমন ড্রেস আপ করে যেতে হয়!?
আয়ান নিজের মোবাইলটা মায়রার দিকে ঘুরালো।। মায়রাও তাকাল মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে। স্ক্রিনে আয়ানের কলিগরা আছে। আর সবার সামনে ওদের বস আরিশা।। ছেলেরা কালো সুটেড বুটেড।। আর মেয়েরা কেউ লাল টকটকে গাউন। কেউ লাল জর্জেট শাড়ি। সবার থেকে আলাদা লাগছে আরিশাকে। লাল পাতলা জর্জেটের শাড়ির সাথে পার্টি মেকাপ, হাই হিল সু আর পার্লের হালকা গয়না।। সব মিলিয়ে একদম পারফেক্ট ম্যাচ লাগছে।
-আরিশা ম্যামকে দেখো আর নিজেকে দেখো মায়রা--। দুটোর পার্থক্য নিজেই বুঝতে পারবে তুমি----।।
-আ---আমি তো এমন শাড়ি পড়ি নি কখনো--।।।আর এভাবে যে যেতে হয়-- আমি জানি না--।। সরি----।।
-মায়রা--। তুমি এভাবে ড্রেস আপ করো না জানি আমি--।। কিন্তু কখনো কখনো তো করতে হবে--।। আমরা কি কখনো কোন পার্টিতে যাবো না?? নাকি তুমি যাবে না!!?? আর আরিশা ম্যামকে দেখো--। আমি উনার একজন ইমপ্লোয়ি--। উনি আমাদের বিয়ের সবকটা ফাঙ্গশন এ্যাটেন্ড করেছে--।। হলুদ থেকে বৌ ভাত-সব কটা অনুষ্ঠানে এসেছেন---।। উনার ড্রেস আপ দেখেছো তুমি?? একটু তো ড্রেসিং সেন্স থাকতে হবে তোমারও--।।
-আই এম সরি-----।। আমি আসলে-।
আয়ানের চোখে মুখে বিরক্তি ভাবটা দেখে মায়রা আর কথাটা শেষ করলো না। আর আয়ানও মায়রার নিচু করে রাখা মুখ যে চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে সেটাও দেখতে পেল না। আর দাঁড়িয়ে না থেকে বিরক্ত হয়েই বেরিয়ে গেল আয়ান। দরজাটা ধুম করে ধাক্কা খেয়ে বন্ধ হলো। মায়রাও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না।। পা জোড়া আর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছে না। ড্রেসিং টেবিলের সামনেই ফ্লোরে বসে পড়লো মায়রা। আয়ান এতোটা বিরক্ত হবে মায়রা স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি।।
এসব বিজনেস পার্টি বা ঘরোয়া পার্টি- কোনটাতেই মায়রার কখনো আকর্ষণ ছিল না। কখনো বাসা থেকে চাপ দেয় নি।। মাও যেতেন না-আর বাবাও খুব একটা ফোর্স কখনো করে নি।। পার্টি হোক বা বিজনেস- সবটা সব সময় তাথৈ সামলেছে। না এসবে মায়রা কখনো মাথা ঘামিয়েছে- না গেছে। তার পরিনাম যে এমনটা হবে মায়রা ভাবে নি।৷
মায়রার মুখে যে সরলতা দেখে আয়ান ওকে প্রচন্ড ভালোবেসেছিল- সেই সরলতা-সেই ছেলেমানুষিই কি তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে??!!
আয়ান এখন কোথায় গেছে?! পার্টিতে!! মায়রা সেসবই ভাবতে ভাবতে খাটের সামনে আবার ফ্লোরে বসে পড়লো। খুব করে কান্না আসছে। প্রিয় মানুষগুলোর একটু দূরে সরে যাওয়াও প্রচন্ড কষ্ট দেয়। অভিমানরা গলা চেপে ধরে। কখন যে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে এতোটা দূরে যায় মানুষগুলো যে পাশের মানুষটার শরীরের মিষ্টি গন্ধটাও অচেনা হয়ে যায়!!! তারা দুজনও কি এতোটা দূরে চলে যাচ্ছে?? নাকি আসলেই এতোটা দূরে চলে গেছে মায়রা টেরই পায় নি!!??
ভাবতে ভাবতে দুচোখে অশ্রুর বন্যা বয়ে যাচ্ছে মায়রার।ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে অবহেলাটাও তিলে তিলে মারতে পারে একটা মানুষকে।। আর এতোটা দূরত্ব!! কিভাবে সহ্য করবে মায়রা!!?? এসব ভাবতে ভাবতে মায়রা খাটের সাথে হেলান দিয়েই কাঁদতে লাগলো।। কখন যে চোখ দুটো লেগে এসেছে মায়রা টেরই পায় নি।।
এদিকে আয়ানও বেরিয়ে অফিসে পার্টিতে চলে এসেছিল।। পার্টিতে এ্যাটেন্ড করা আজ জরুরী। মায়রার উপর বিরক্তও লাগছিল- রাগও হচ্ছিল৷ রাগটা কি জন্য আয়ান জানে না। পার্টিতে এতোগুলো মানুষের মধ্যেও নিজেকে একা একা লাগছে আয়ানের।। বেশ রাত করেই আয়ান বাসায় ফিরেছে। ১টা দেড়টা বাজে তখন। আরিশা মায়রার কথা জিজ্ঞেস করায় "মায়রা একটু অসুস্থ" বলে কাটিয়ে গেছে আয়ান। আর সারা পার্টি আয়ান আরিশাকে খেয়াল করেছে।। দুটো মানুষ কতোটা আলাদা ভাবছে আয়ান। ভাবা উচিত নয় জানে সে।। তবু ভাবছে। মানুষের মন তো!! কত কিছুই তো ভাবতে পারে!! তাতে বাধা দেয়ার ক্ষমতা কি তার নিজের আছে!!!
লাল জর্জেটের ফিনফিনে একটা শাড়িতে অসম্ভব রকমের সুন্দর লাগছে আরিশাকে। আরিশাকে দেখেও বিরক্ত লাগছে আয়ানের। এর কারণটাও বুঝতে পারছে না সে।। শেষে এতো বিরক্ত হলো যে পার্টি শেষ না হতেই আয়ান ফিরে এলো বাসায়।। এসেই মায়রাকে খাটের সামনে ফ্লোরে গুটিশুটি মেরে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে দেখে আরো বেশি বিরক্ত হলো।। এভাবে ঘুমালো যে ঠান্ডা লেগে বিশ্রি একটা অবস্থা হবে সেই বুদ্ধিটুকু নেই কি মেয়েটার!! আলতো করে মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে খাটে শুইয়ে দিলো আয়ান।। নিজের কোর্টটা খুলে একপাশে ফেলে শুয়ে পড়লো মায়রার পাশে। ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো।। আর চোখ জুড়ে নামলো রাজ্যের ঘুম।।
১৬!!
সকাল হতেই আয়ানের ছুট শুরু হয়। আর মায়রার একাকিত্ব। দুজনের মধ্যে কথা বলার সময়টুকুও এখন আর হয়ে উঠে না। রোজ রাতে ডাইনিং টেবিলের শক্ত পাটাতনে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায় মায়রা।। সকালে ঘাড়ের কাছের মাংসপেশীতে প্রচন্ড ব্যথাটা জানান দেয় সারারাত সেখানেই ঘুমানোর কথাটা। আজকাল আর কেউ যত্ন করে তুলে খাটে শুইয়ে দিয়ে মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে আর বুকে টেনে নেয় না। শক্ত করে বুকে জড়িয়ে বুকের ভেতরে লুকিয়ে ফেলার প্রয়োজনটাই এখন হয়তো আর নেই।
মায়রা প্রতিদিন ভাবে আজ রাতেই আয়ানের সাথে বসে একসাথে ডিনার করবে। এটা ওটা নিয়ে দুনিয়ার কথা বলবে--। প্রতিদিন এই ভেবে না খেয়েই আয়ানের জন্য রাত ১ টা ২ টো পর্যন্ত জেগে বসে থাকে মেয়েটা।৷ কিন্তু কখন যে চোখ দুটো বুজে আসে-আর কখন যে ঘুমে ঢলে পড়ে তার কিছুই টের পায়না মায়রা। সাধে কি আর আয়ান তাকে 'ঘুমপরী' বলে!? অবশ্য টের পাওয়ার কথাও না।। দুপুরে কখনো সখনো নাম মাত্র খায় মেয়েটা। আর সারাদিনে দানাটুকুও দাঁতে কাটে না।এই দুর্বল শরীর নিয়ে কি আর রাত জাগা যায়!!
আয়ানেরও এখন আর বাসায় ফিরতে ইচ্ছে হয় না। মায়রার কালো বড় বড় চোখ জোড়াতেও আগের মায়া খুঁজে পায় না। যে ঘুমন্ত মুখটা দেখে সারাটা রাত সে নিজে নির্ঘুম কাটিয়ে দিতো-সেই মুখটার দিকে তাকানোর সময় হয় না তার আজকাল। তার এখন অন্য এক জোড়া চোখ পছন্দ।। মোটা করে আইলাইনার - মাশকারা- ডিপ আইস্যাডো আঁকা কালো কালো দুটো চোখ।। চোখের মালকিনও তার দিকে আলতো হেসে তাকায়। সেটাও বেশ লাগে আয়ানের। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে চোখের মালিক অফিসে চেক করে এটা সেটা। আর সেই চোখের নেশায় আয়ানও ব্যস্ত থাকে।। ঘুমু ঘুমু চোখের মায়ার নেশা এখন তার কেটেছে।। এখন তার সৌন্দর্যের নেশা।। এই নেশা দিন দিন যেন চারদিক থেকে আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরছে আয়ানকে। মাদকতাময় চোখের নেশা- সৌন্দর্যের নেশা।৷ যেখানে আয়ানের সকালের আধো ভিজে মুখটা দেখতে ভালো লাগতো-সেখানে আজ তার গোলাপি লাল আভায় মেকাপ করা মুখটা না দেখলে যেন দিনই শুরু হতে চায় না।
আয়ান কখনো কখনো ভাবে।। কি হচ্ছে এসব?? কেন করছে সে..?? কিন্তু পরক্ষণেই লাল গোলাপী মুখটা মৃদু হেসে তার মস্তিষ্কের মধ্যে ঝড় তুলে চলে যায়।। আর মায়রা নামের মেয়েটার অস্তিত্বটা আরো একবার তার চোখের সামনে থেকে আড়াল হয়ে যায়।। কি অদ্ভুত না?? যার ঘুমকাতুরে কন্ঠে একবার 'ভালোবাসি' শুনতে না পেয়ে আয়ানের সারা রাত ঘুমই হয় নি-আজ সেই কণ্ঠস্বরটা শুনার তার সময় ও নেই!!
এভাবে দিন কাটছে। আয়ানেরও মনে নেশাটা আরো জেঁকে বসেছে। প্রতিদিন প্রতিক্ষণে মরণব্যাধির মতো শরীরের সমস্ত রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন ছড়িয়ে পড়ছে নেশাটা। আয়ান মাঝে মাঝে কাজ ফেলে ভাবে কি আছে এই আরিশা মেয়েটার মধ্যে।। আর মেয়েটা কি চায়!!ও কি আয়ানের অভ্যেসগুলোকে আশকারা দিয়ে আয়ানকে কোন ইঙ্গিত দিচ্ছে?!! মিষ্টি করে হেসে আয়ানের চোখে চোখ রেখে কি বোঝাতে চায় মেয়েটা!? মেয়েটা তো বোঝে আয়ান ওকে দেখছে- খেয়াল করছে। তাহলে!!?
তাথৈ আর রিহান এসেছে বাসায়। এই তিনমাসে কেবল একবার বাড়ি গেছে মায়রা আর আয়ান।৷ আয়ানের কাজের চাপ তাই আর কেউ জোর করে নি।৷ কিন্তু এবারে মায়রাকে দেখে তাথৈ পুরো শকড হয়ে গেল।। কি হাল হয়েছে মেয়েটার!! শুকিয়ে কাঠ হয়েছে সেটা আলাদা কথা।। মুখটা পর্যন্ত চেনা যাচ্ছে না মায়রার। এভাবে আর কিছুদিন চললে মেয়েটাকে বাঁচানো যাবে না।। রিহানও মায়রাকে দেখে এতোটা অবাক হলো কি বলবে ভেবে পেল না। মেয়েটা বরবারই একটু শান্তশিষ্ট।৷ এই শান্ত মেয়েটা যে একেবারে চুপ হয়ে যেতে চলেছে সেটা রিহান ভালো করেই বুঝতে পারছে।।
-মায়রু--।। রেডি হ--।। ব্যাগ গোছা।
-আপ্পি---।। ও অফিসে--।। বলে --।।
-বেশি বুঝো না তুমি??? কল করে বরকে বলো তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি আমি--।। আর সে যেন নিজে গিয়ে নিয়ে আসে--।।
মায়রার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো। আয়ান তো এতো ব্যস্ত।। ও মায়রাকে আনতে ও বাড়ি কি আধৌ যাবে! অতি কল্পনার পর্যায়ে পড়ছে না ব্যাপারটা!
ফোনে রিং হতেই মায়রার নাম্বারটা দেখে বিরক্ত হয়ে কলটা রিসিভ করলো।।
-বলো---।।
-হ্যালো-শুন না?? তাথৈ এসেছে। আমাকে বলছে ওদের সাথে ওই বাড়ি যেতে।। তুমি গিয়ে----।।
- তো যেতে চাইলে যাও--।। আমাকে বলার কি আছে!?! আশ্চর্য!!? আমি কাজের সময় তোমার এসব কাহিনী শুনবো!!??
-সরি----।।।
আয়ান কিছু না বলে কলটা কেটে দিতেই মায়রার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। তাথৈরা দেখার আগেই পানিটা মুছে মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটালো।।
-আপি--।৷ ও বলেছে যেতে--।।
-রেডি হ যা---।। আমরা বসছি--। তাড়াতাড়ি কর একটু--।। আমাদেরকে ড্রপ করে দিয়ে রিহান আবার অফিসে যাবে--।। মিটিং আছে।। যা যা----।
-হুম----।
রিহানের খুব কোন জরুরী কাজ নেই। কথাটা মায়রার মুখটা দেখার জন্যই বলেছে তাথৈ। মায়রার চোখের ছলছলানি আর নিরব কান্না কোনটাই চোখ এড়ায় নি তাথৈয়ের।।
-রিহান--।। তুমি আমাদের বাবার ওখানে ড্রপ করে বাড়ি চলে যেও।। আমি আর মায়রা কয় দিন ওই বাড়িতে থাকবো।।
-আমি--- তোমাকে ছাড়া--- কি করে!! মানে বলছিলাম যে?? আমি যাই না--- তোমাদের সাথে----??!
-রিহান---।। মায়রাটার অবস্থা দেখছো তুমি?? কি হয়েছে না হয়েছে এই মেয়েটা তো কিছুই বলবে না।। সো কাজটা আমাদেরই তো করতে হবে- তাইনা???
-আচ্ছা পুতুল বউটা--বুঝেছি।। পিচ্চি বোনটার জন্য আর আমার পুতুলটার জন্য না হয় একটু কষ্ট করলাম---।।
তাথৈ একটু হাসার চেষ্টা করলো। আয়ানের বা মায়রার কার কি হয়েছে ও এখনও জানে না। তবে যাই হয়ে থাক না কেন সবটা সে ঠিক করবেই করবে।। তাথৈ চোয়াল শক্ত করে ভাবছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ও। আয়ান নিজে এসে না বলা পর্যন্ত কিছুতেই মায়রাকে এই বাড়িতে ফিরতে দিবো না তাথৈ।
রাত দুটো বাজে আজও বাসায় ফিরলো আয়ান। অনিচ্ছা সত্বেও চোখ দুটো ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে পড়লো। মায়রাকে প্রতি রাতে ফিরে এখানে দেখে অভ্যস্থ আয়ান। আজকে না দেখে ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো আয়ানের। বিরক্ত হয়ে গেছে রাত জেগে জেগে! ভালোই।। চোখের সামনে মেয়েটাকে এভাবে পড়ে ঘুমুতে দেখলে আয়ানের অস্বস্তি লাগে। অস্বস্তিটা কিসের সে জানে না। তবে লাগে।। আর নিজের ভেতরের নেপথ্য ইঙ্গিতটা বুঝতে পারে না বলেই আরো রাগ লাগে।। মেয়েটার প্রতিদিন এই ন্যাকামিটা কি না করলেই হয় না!! প্রতিদিন এই ভাবটাই মায়রাকে দেখে আয়ানের মনে আসে।। আজ মায়রাকে না দেখে ভিতরের খুশখুশানি আরো বাড়লো আয়ানের। সাথে বিরক্তিও।৷ এতোদিন তাহলে এই নাটকটা করার কি ছিল!?
গলার টাইটা টানতে টানতে আলগা করছে আয়ান। খাবারটাও আজ টেবিলে রাখা নেই। বেশ ভালোই!! এবার থেকে নিজে নিয়েই খাবে-সমস্যা আর কোথায়!! টাই টা একটানে খুলে ছুড়ে ফেললো আয়ান। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার নিতে ফ্রিজের সামনে গিয়েই অবাক হলো। একটা নোট ঝুলছে। ছোট্ট গুটিগুটি ঝকঝকে কাঁপাকাঁপা হাতের লেখা।।
"একটু কষ্ট করে খাবারটা গরম করে খেও। আমি জলদিই চলে আসবো।।"
'জলদিই চলে আসবো'-লেখাটা পড়েই বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো আয়ানের। তড়িঘড়ি করে রুমে এসে ভালো করে খাটের দিকে তাকাল।।রুমটার সবকটা জিনিস সুন্দর করে গোছানো।ধবধবে সাদা বিছানায় তুষার শুভ্র চাদর পাতা, পায়ের পাশটাতে সাদা বরফের মতো চাদর ভাঁজ করা,সাদা কভার দেয়া বালিশগুলোও নিজের জায়গায় আছে। নতুন যোগ হয়েছে একটা কোলবালিশ।। বেড সাইডের টেবিলে একটা ছোট্ট নোট সাঁটানো আছে।
"কোলবালিশটা দিয়ে দিলাম। তোমার তো জড়িয়ে না ধরলে ঘুম হয় না--।৷ এটা লুকানোর জন্য সরি----।"
কোলবালিশটা লুকিয়েছিল মানে!! আয়ানের কিছুই মাথায় ঢুকছে না।। কি হচ্ছে এসব!? আর মেয়েটা গেল কোথায়! উল্টো পাল্টা কিছু করে বসে নি তো!?? বেশ অনেকক্ষণ ভেবেও যখন কুল কিনারা করতে পারছে না তখন মোবাইলটা বের করলো তাথৈকে কল করবে বলে।। মোবাইলে বেশ কয়েকটা মেসেজ জমে আছে দেখে ওপেন করলো আয়ান।। মেসেজগুলো এমনঃ-
"আমি আপুর সাথে বাবার বাসায় যাচ্ছি। এখন বের হলাম।" -বিকেল ৪ টা ৩২
"আমি পৌঁছে গেছি। টেনশন করো না।" সন্ধ্যা ৫ টা ৪৫
"তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে খেয়ে নিও। দু-তিন দিনের জন্য রান্না করে ফ্রিজে রেখে এসেছি।" রাত ৮টা
"তুমি কি ফিরেছো? কল করেছিলাম তো। কোথায় তুমি?? খেয়েছো?? খেয়ে তারপর ঘুমিও। কেমন?? আই লাভ ইউ।" রাত ১২ টা
"তুমি কবে আসবে আমাকে নিতে?! তাথৈ আপ্পি বলছে তুমি না এলে আমাকেও নাকি একলা আসতে দেবে না।। তাড়াতাড়ি এসো না প্লিজ....?" রাত ১ টা ৪৫।
আয়ান মেসেজ পড়তে পড়তে আরেকটা মেসেজ এলো।
"তুমি ব্যস্ত জানি।৷ একটু সময় করে নিয়ে যাও না প্লিজ?? তুমি আসতে না পারলে বাসায় বাবাকে কল করে বলে দিও যেন আমাকে আসতে দেয়। প্লিজ--??"
মায়রার মেসেজগুলো দেখে আয়ানের মনে পড়লো মায়রা দুপুরেই ওকে বলেছিল তাথৈরা নিতে এসেছে। খাবারগুলো ওভেনে গরম করে চেয়ারে এসে বসলো আয়ান। তার ফেভারিট চিকেন বিরিয়ানি রান্না হয়েছে আজ। সুন্দর একটা স্মেল আসছে।। এই তিনমাসে মেয়েটা আয়ানের পছন্দের সব কটা রান্না শিখে ফেলেছে। তবে এতোটা ভালো রান্না শিখেছে কল্পনাও করতে পারে নি আয়ান। নিজেই ধরে ধরে রান্না শিখিয়েছে আয়ান ওকে। রান্নার চেয়ে দুজনে মিলে দুষ্টুমিই করেছে বেশি। তবে আজকের রান্নাটা আয়ানের করা রেসেপিটার চেয়েও বেশি ভালো হয়েছে। আয়ান খাচ্ছে আর ভাবছে এসব।। আর একটু পর পর তাকাচ্ছে সামনাসামনি থাকা চেয়ারটার দিকে। প্রতিদিন খাওয়ার সময় মেয়েটাকে এখানে দেখেও বিরক্ত লাগতো।। আজ সেই জায়গাটা শূন্য।। বুকের ভেতর কিসের একটা হাহাকার উঠছে আয়ানের।
খাটে এসে শুয়ে পড়েছে আয়ান। আজকাল খুব একটা ঘুম হয় না ওর। কি হয়েছে কে জানে!! কিছুদিন আগেও তো ঘুমন্ত মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে আলতো করে খাটে শুইয়ে দিয়ে বুকে টেনে নিতেই শান্তিতে চোখ জুড়িয়ে ঘুম নামতো। আজকাল আর এসব হয় না। বিরক্তি চলে এসেছে। বিরক্তিটা কিসের উপরে!! মায়রার উপরে?? সময়ের উপরে?? নাকি নিজের উপরে?? ভেবেও উত্তর পায় না আয়ান। একসময় ভাবতে ভাবতে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে ওর।। আরেকটা দিন শেষ হলো। আরো একটা ক্লান্তিকর দিনের শুরুর অপেক্ষা।।
এদিকে মায়রাও চোখ বুজে আছে। তাথৈ কতোবার ডেকে গেছে। মেয়েটা 'হু-হা' করে আবার ঘুমুচ্ছে। তাথৈ ছোট্ট বাচ্চার মতো করে আদর করে-বকা দিয়ে-ধমক দিয়ে-বহুভাবে ডেকেও তুলতে না পেরে শেষে ওর খাবারটা বেড সাইড টেবিলে ঢেকে রেখে গেল। জানে খাবে না-তবুও বার বার করে খেয়েও নিতে বললো। তাথৈ চলে গেলেও অনেকক্ষণ একটুও নড়াচড়া না করে মড়ার মতো পড়ে রইলো মায়রা। মনে মনে ঠিক করেছে ফেলেছে মায়রা। আর কারো বোঝা বাড়াবে না সে।
অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদলো মায়রা। তারপর উঠে এসে ওয়ারড্রবটা খুলে কয়েকটা ব্যাগ নিয়ে খাটে এসে বসলো।।তাথৈয়ের গায়ে হলুদের দিনকার সবুজ পাথরের কাজ করা হলুদ লেহেঙ্গাটা বুকে জড়িয়ে কাঁদছে কিছুক্ষণ।। এটা আয়ানের দেয়া প্রথম উপহার। আয়ানের ওর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা- দুষ্টুমি-সবটা মনে পড়ছে মায়রার। হাফ সিল্কের রয়েল ব্লু শাড়ি, লাভ শেইপ লকেট দেয়া চেইন, আংটি-সব মিলিয়ে আয়ানের প্রপোজের ছবিটা মাথায় ঘুরছে মায়রার।। আর এই যে ক্রিম কালারের ফ্লোরটাচ গাউন, আয়ানের মন-ময়ূরী পারপাল-ব্লু গাউন- সব কিছুই বারবার মায়রাকে আয়ানের শূন্যতার জানান দিচ্ছে।।
বিয়ের পরে যখন ১ সপ্তার জন্য এসেছিল আয়ান বড্ড জ্বালিয়েছে মায়রাকে। বাবা অফিসে আর তাথৈ আর রিহান নিজেদের মতো করে ব্যস্ত। বাকি কাজের লোকেরা নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত।। আয়ানের এতে সুবিধেই হয়েছে।। হুট করে যখন তখন মায়রাকে বুকে টেনে নেয়। হুট করে কোমড় পেঁচিয়ে টেনে নিয়ে মুখটা তুলে ধরে দুষ্টু হাসি দিয়ে মায়রার আত্মা কাঁপিয়ে দেয়। আবার রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে ঘুমন্ত মায়রাকে পাঁজাকোলা করে ছাদে নিয়েও গেছে।। ঠান্ডা বাতাসে ঘুম ভাঙতে মায়রা দেখে ছাদের ফ্লোরে চাদর পাতা ফোমের বিছানায় শুয়ে আছে।। আর আয়ান অপলকে তাকেই দেখছে। ঘুম ঘুম চোখে মায়রা আয়ানকে দেখে থতমত খেয়ে আশেপাশে তাকিয়ে হা করে তাকিয়ে রইলো। আয়ানও এগিয়ে এসে মায়রার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিল।। দুজন মিলে পাড়ি জমাল ভালোবাসার সমুদ্রে।। অবশ্য সকালে ঘুম ছুটতেই নিজেকে আবার রুমে দেখে হেসে ফেলে মায়রা। মায়রা আবারও আয়ানের বুকে মুখ ডুবিয়ে নেয় লজ্জায়।। দিনগুলো মনে পড়তেই মায়রার চোখ বেয়ে নামে অভিমানের কান্না।।
পাগলামির সময়গুলো কি আর ফিরে আসবে!! আয়ান এসে মায়রাকে কি নিয়ে যাবে না??!! না এলে মায়রা কি করবে!!?? মরে যাবে তো আয়ানকে ছাড়া!! লোকটা কেন বুঝতে পারছে না সেটা!! আয়ানকে ছেড়ে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে মায়রার।। কেন বুঝে না মানুষটা সেটা!! শপিং ব্যাগগুলো আবার ওয়ারড্রবে রেখে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসবই ভাবছে মায়রা।। আর ভাবতে ভাবতে চোখদুটোও ক্লান্তিতে আর দুর্বলতায় বুজে আসছে ওর।