বকুল ফুলের মালা - পর্ব ১৯ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৩৭!! 

মায়রা আরশিকে কোলে নিয়ে বিছানার উপরে বসে ফ্যালফ্যাল করে একবার আয়ানকে দেখছে আর একবার আরশিকে। এই পিচ্চিটা মায়রার কোলে শুয়ে থেকে এখনো মিটিমিটি হাসছে যে মায়রার বিশ্বাসই হচ্ছে  না। আয়ানও মায়রার সামনে ফ্লোরে হাঁটু গেঁড়ে বসে মায়রার এমন অবাক হওয়া মুখটা দেখে হাসছে। কয়েক মিনিট এমন নিরবতায় কেটে যাওয়ার পর আয়ান একটু এগিয়ে এসে একহাতে মায়রার মুখটা মুখে ধরলো। মায়রা আয়ানের দিকে তাকাতেই আয়ান আলতো করে মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।

-তোমাকে একদম সম্পূর্ণা লাগছে জানো? একদম আমার সেদিনের স্বপ্নটার মতো--। ইশ! আর কতদিন যে এতো অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে হবে দিনটার জন্য---।

-হুম? কোন দিন? কিসের স্বপ্ন? কিসের কথা বলছ তুমি?

-ওহো! তোমাকে তো বলাই হয়নি। তুমি জানবে কি করে? আমিও পাগল হয়ে গেছি খুশির ঠেলায়।

-কিসব বলছ? 

-থ্যাংক ইউ সো মাচ পরীটা। জানি না জোর করাটা ঠিক হয়েছে কিনা। কিন্তু তোমাকে ছাড়া আর থাকতে পারবো না---। তোমার ঠোঁটের কোণে আগের সেই লজ্জারাঙা হাসিটার জন্য হলেও পাশে থাকতে চাই। তুমি যা করতে চাও আমি বাধা দিবো না। কিন্তু যা করার আমার বুকে থেকে করবা। এক মূহুর্তের জন্যও আড়াল হতে দিবো না এবার। 

-আয়ান? আমার খুব ভয় করছে যে? বাবা মা বিয়েটা না মানলে? আর তোমার বাবা মা যদি জানতে পারে?

-শশশ। এসব ভেবো না। বহু ভেবে চিন্তে প্ল্যান করেছি। আশা করি কোন ঝামেলা হবে না। আর বাবা মা আমার পছন্দের উপরে কিছু বলবে না। আর পরে কি হবে সেসব নিয়ে এখনই এতো টেনশন করো না। কোন সমস্যা হলে দুজনে মিলে নাহয় সেটা ফেইস করবো। যত বড় ঝড়ই আসুক না কেন তুমি পাশে থাকলে আমি হাসি মুখে তার মুখোমুখি হতে পারবো। 

-হুম---৷ 

-এই শোনো না?

-হুম?

মায়রা মুখ নিচু করে একবার আরশির দিকে তাকিয়েছিল। আয়ানের ডাকে মুখ তুলতেই আয়ান মায়রাকে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে মায়রার ঠোঁটের এক কোণে চুমো খেল। মায়রা এবারে লজ্জায় লাল হয়ে মুখটা নামিয়ে নিলো। আয়ান হেসে আবার মায়রার মুখটা দুহাতে তুলে ধরলো। 

-এরপর তোমার জীবনে কষ্ট আসবে কিনা সেটার নিশ্চয়তা হয়তো আমি দিতে পারবো না মায়রা৷ কিন্তু তোমরা শরীর থেকে বেদনার বিষের শেষ বিন্দুটাও আমি শুষে নিবো কথা দিলাম৷ তোমার চোখ বেয়ে ঝরা প্রত্যেকটা আনন্দের বা কান্নার জল আমি ঠোঁটে তুলে নিবো কথা দিলাম। সারাদিনের ব্যস্ততায় তুমি যখন বিরক্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিবে তখন তোমাকে আরো বিরক্ত করার জন্য হলেও নিজের মাঝে লুকিয়ে নিবো, কথা দিলাম। যখন ইচ্ছে তুমি রাগ করবে আমার সাথে। আর আমি সেই রাগ ভাঙিয়ে তোমায় মাতাল করে তুলবো আমার ভালোবাসার স্পর্শ বুলিয়ে। তুমি অভিমান করলে আমার ঠোঁটের আদরে সেই অভিমান ভাঙাবো। রাত বিরেতে তোমার ঘুম ভাঙাবো এক চাদরে জড়িয়ে চাঁদ দেখার জন্য। তুমি মুগ্ধ বিস্ময়ে চাঁদ দেখবে। আর আমি? আমি তোমার নরম দেহটায় আদরে ভাসিয়ে তোমাকে নিজের কাছে টানবো। তখনো হয়তো বিরক্ত হয়ে চোখ লাল করে তুমি তাকাবে। আর আমি তোমার সেই লাল হয়ে যাওয়া তেজদীপ্ত মুখটা আদরের সাগর ভরাবো। তুমি চাও বা না চাও তোমাকে মাতিয়ে রাখবো নিজের মধ্যে। জোর করবো না ধরা দিতে কখনো। কিন্তু তোমাকে কাছ ছাড়াও হতে দিবো না এক মূহুর্তের জন্য৷ অধিকার খাটাবো না স্বামীত্বের৷ কিন্তু ভালোবাসায় বেঁধে রাখবো তোমাকে নিজের সাথে। ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যে অধিকার নিয়ে তোমাকে জ্বালাবো। মনে থাকে যেন। 

-কিসব বলছো?

-আর গত দশটা মাসের প্রত্যেকটা সেকেন্ডের উশুল তুলবো। বুঝলা?

-ভয় লাগানোর চেষ্টা করছ?

-ভয় লাগানোর কেন চেষ্টা করবো বউসোনা? যা করবো তাই বলে রাখছি। পরে যেন বলতে না পারো কথা রাখি নি----।

-এই যাও তো তুমি---। সবাই অপেক্ষা করছে বাইরে। কি মনে করবে---।

-কে কি মনে করলো সেটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এতোদিন পরে তোমাকে এতোক্ষণ যে প্রাণ ভরে দেখছি সেটাই অনেক। যখন আমার কাছে চলে আসবে তখনও তো এভাবে দেখা হবে না। তাই দেখতে দাও মন ভরে--।

-কেন? বিয়ের পর কি আগ্রহ শেষ হয়ে যাবে দেখার যে দেখা হবে না বলছো?

মায়রা একটু গাল ফুলিয়ে মুখটা নামারোর চেষ্টা করতেই আয়ান মায়রার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে আলতো করে কামড়ে দিলো। আয়ান সরে এসে মায়রার পাশে বসে লজ্জারাঙা গালে হাত ছুঁইয়ে দিলো।

-হায়রে অভিমানীটা! তখন দেখার সময় পাবো কি? আরো কতো কাজ থাকবে বললাম না? এতোটা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখবো যে ভোরের আগে তুমিও চোখ বোজার সময় পর্যন্ত পাবে না। আমাদের মাতাল করা প্রত্যকটা রাতের সঙ্গী হবে তোমার জন্য আনা সেই শুকনো বকুল ফুলের মালাগুলো। যারা আমার রাতজাগার সঙ্গী ছিল এতোগুলো দিন। এবার ওরা তোমাকে বিভোর করে রাখবে নিজের গন্ধে। 

-আমার বকুল ফুলের মালা? তোমার মনে আছে?

আয়ান আরেকবার মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ কপালে কপাল ঠেকিয়ে চুপ করে বসে রইলো। একটু পরে সরে এসে মায়রাকে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো আয়ান। মায়রা একটু লাজুক হেসে আরশিকে কোলে ঠিক করে নিয়ে নিজেও উঠে দাঁড়ালো। 

-তোমার পছন্দের কথা আমি এক মিনিটের জন্যও ভুলি নি ম্যাডাম। কারণ ভুলে গেলেও মনে করিয়ে দেয়ার জন্য তুমি পাশে ছিলে না। তবে ভবিষ্যতে ভুলবো কিনা সেটার গ্যারান্টি দিতে পারছি না।

কথাটা শুনে মায়রা হা করে আয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই ছেলে এমন করে কেন কথা বলে? মায়রার চাহনি দেখে আয়ান মিষ্টি করে একটু হাসলো।

-তোমার জন্মদিনটা ভুলে গিয়ে উইশ করিনি ভাবছ? দিনটা কি করে কেটেছে সেটা আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না মায়রা। হাহ। বাদ দাও। যা হয়ে গেছে তা তো বদলানো যাবে না। কিন্তু আজকের পর থেকে তোমার সাথে কাটানো প্রত্যেকটা দিনকে স্পেশাল করে রাখতে চাই। যেন বিয়ের কয়েক যুগ পরও নাতি নাতনীদেরকে আমাদের বিয়ের, ভালোবাসার গল্প শোনানোর সময় তুমি এখনকার মতো লজ্জায় লাল হয়ে যাও। যাতে তখনও তোমার লাজুক মুখটা দেখে এখনকার মতো আমার বুকের মধ্যে ধুকপুকানি বাড়াবে। কি বলো? আমি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার ঠিক আগ মূহুর্ত পর্যন্ত তোমাকে আগলে রাখবো প্রমিস। হবে আমার লজ্জারাঙা লাজুক পরী? জীবনের প্রতিটা চড়াই উৎরাইয়ে আমার সঙ্গী হবে মায়রা? আমার স্ত্রী, বউ, অর্ধাঙ্গিনী, বন্ধু- হবে? তোমাকে নিয়ে দেখা ছোট্ট স্বপ্নটা পূরণ করায় আমার সঙ্গী হবে প্লিজ?

মায়রা কান্না সামলে নিয়ে কোনমতে মাথা ঝাঁকিয়ে 'হ্যাঁ' জানালো। আয়ান মায়রার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে কিছু একটা ভেবে কয়েক পা পিছিয়ে এসে দাঁড়ালো। মায়রা একটু অবাক হয়ে আয়ানের দিকে তাকালো।

-কি হয়েছে আয়ান?

-এভাবে দাঁড়াও। একটা ছবি তুলি। 

-কেন?

-আরশিকে কোলে নিয়ে তোমাকে কতোটা সুন্দর লাগছে বলে বোঝানো অসম্ভব মায়রা। একদম পারফেক্ট বউ। বিয়ের হওয়ার আগ পর্যন্ত বাকি কয়টা দিন নাহয় ছবিটা দেখেই কাটিয়ে দিবো--। এখন একটু হাসো তো? স্মাইল প্লিজ?

মায়রার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে আর ঠোঁটের কোণে এক টুকরো তীপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। আয়ান এই সুন্দর মূহুর্তটাকে ফোনের ক্যামেরায় বন্দী করতে এক মূহুর্তও দেরি করলো না। ছবিটা তোলা শেষ হতেই আয়ান মায়রা পাশে এসে দাঁড়িয়ে আরশির ছোট্ট আঙুলগুলো নেড়েচেড়ে দুষ্টুমি করলো।

-দেখেছ মায়রা? আমাদের আরশি কতো লক্ষী বাবু? একটুও কাঁদছে না তোমার কোলে এসে। মনেই হচ্ছে না ও আরিশা বিচ্ছুটার মেয়ে--। উল্টো তোমার কোলে এমন শান্ত হয়ে আছে যে কেউ দেখলে ভাববে তোমার--।

-আয়ান? চলো তো সবাই অপেক্ষা করছে--। চলো--। 

-আহারে! লজ্জাবতী---। লাল টুকটুকে মুখটা! আহা! আমি তো শেষ!

মায়রা লজ্জা পেয়ে আয়ানের হাতে একটা মাইর লাগালো। আয়ান হেসে ফেললো মায়রার এমন কাজে। এমন সময় দরজার নকের শব্দে আয়ান মায়রা দুজনেই চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালো। দরজায় দাঁড়িয়ে আরিশা আর তাথৈ দুজনেই হাসছে দেখে মায়রা লজ্জা পেয়ে আয়ানের পিছনে লুকালো। 

-আয়ান? কথা বলার তো বহু সময় পাবি রে দোস্ত। আপাতত আমার মেয়েটাকে রেহাই দে। নিজের পিচ্চিকে কোলে নিয়ে এমন প্রেমের কথা বলিস কেমন? এখন আপাতত আমরা নাহয় বিয়ের ডেইট ফিক্সড করি। তারপর বিয়ের পর তোরা তাড়াতাড়ি বেবির প্ল্যান করিস। চল চল? আর এই যে ম্যাডাম লজ্জাবতী। আপনি এভাবে না লুকিয়ে থেকে আমার মেয়েটাকে আমাকে ফিরত দিন। তাড়াতাড়ি। আমার একটা মাত্র মেয়ে। তোমাদের দিবো না। উঁহু---। নো ওয়ে। 

আয়ান মায়রার কোল থেকে আরশিকে নিয়ে আরিশার কোলে ধরিয়ে দিলো।

-তোর মেয়ে তুই রাখ বাপু। আর বিয়ের পর আমরা কি কি প্ল্যানিং করবো সেটা তখনই নাহয় দেখিস। তখন দেখবি আর লুচির মতো ফুলবি। আর ভাববি আহারে! কেন যে আয়ানটারে বিয়ে করলাম না। বিয়ে করলে হয়তো তাওহীদের মতো একটা আনরোমান্টিক লোকের পাল্লায় পড়তে হতো না--। আহা! আহা!

-আয়াইন্যা? তোকে তো আমি----?

আরিশা কটকট করে আয়ানকে মারার জন্য এগিয়ে আসছে দেখে আয়ান ছুটে রুম থেকে পালালো। আর পিছন থেকে মায়রা আর তাথৈ দুজনেই হাসছে ওদের দুই বন্ধুর পাগলামি দেখে।

৩৮!! 

-মায়রার বাবা মাকে তো দেখছি না? উনারা থাকলে আজই নাহয় ওদের বিয়ের তারিখটা পাকা করে যেতাম? মেয়ে আমাদের মাশাল্লাহ খুব পছন্দ হয়েছে। 

আয়ানের বাবার বলা কথাটা শুনে মায়রার শরীর বেয়ে যেন একটা বিদ্যুতের হলকা বেয়ে গেল। তাথৈ আর আরিশার সাথে ড্রইংরুমের দরজা পর্যন্ত সবে এসেছে মায়রা। কথাটা শুনেই যেন ওর পা থেমে গেছে। সামন আর একটা কদমও বাড়াতে পারলো না। এই মূহুর্তটা যে আসবে মায়রা সেটা তো জানতো। তবু কেন সবটা ভুলে স্বপ্ন দেখতে সাহস করেছিল? কয়েক সেকেন্ডের জন্য মায়রার মনে হলো কেউ পায়ে কয়েক শ টনের দুটো পাথর ওর পায়ে বেঁধে দিয়েছে। এতো ভারি লাগছে যে মনে হচ্ছে পায়ের তলা থেকে মাটিটা সরে গিয়ে সত্যি বুঝি ও তলিয়ে যাবে অতল গহ্বরে। চোখের সামনে না চাইতেও বেশ অনেকগুলো ঘটনা একসাথে ভাসছে মায়রার। ইচ্ছের বিরুদ্ধে সীমান্তকে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়া, সেদিন রাতে সীমান্তের সাথে পাথরের মতো হয়ে ঢাকায় ফিরে যাওয়া, আর সীমান্তের প্রত্যেকটা আঘাতের স্মৃতি। আর কানের কাছে মায়ের বলা কথাগুলো। মায়রা মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেনি সীমান্তের সাথে। ওর গাফলতির জন্যই সংসারটা ভেঙেছে। আর সীমান্তের সাথে সাথে মা বাবা নামের এই দুটো মানুষের সাথে ওর সম্পর্কটাও আজীবনের জন্য শেষ হয়ে গেছে। 

আর কেউ খেয়াল না করলেও আয়ান ঠিকই মায়রার দরজার বাইরে থমকে দাঁড়িয়ে যাওয়াটা খেয়াল করেছে। আভা আর সামির দিকে এক নজর দেখে নিয়ে আয়ান ঠোঁটের কোণে মিষ্টি করে একটা হাসি ঝুলিয়ে বাবা মায়ের দিকে তাকালো।

-মা? বাবা? মামা আর মামনিই এখন গার্জেন। উনারাই ওকে আর তাথৈ আপুকে মানুষ করেছে৷ বাকি ফর্মালিটিগুলোও উনাদের সাথেই ডিসকাস করে নাও---।

-কিন্তু----? মায়রার বাবা মা---?

-মা? আমি পরে তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলবো---। 

-আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে। তা বেয়াই মশাই? আপনারা দুজনে বেয়াই বেয়াইন হওয়ার জন্য বয়সে একটু বেশিই ছোট না? সবাই তো হিংসে করবে দেখলে--। 

-কি করবো বলুন? আমাদের মেয়েটাও তো ছোট। পরে না বাল্যবিবাহ ভেবে পুলিশ এসে আপনাদেরকেও ধরে নিয়ে যায়। হা হা হা। 

এক সপ্তাহ পর। আজ আয়ান মায়রার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। 
মায়রা হলুদের সাজে কানে মোবাইলটা ধরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। আর আয়ান রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে অপলকে দেখছে মায়রাকে। রাস্তার হলুদ রঙা আলোতে মায়রাকে হলুদ পরীর মতো লাগছে আয়ানের কাছে। হলুদ লেহেঙ্গা আর ফুলের সাজে মায়রাকে দেখে আয়ানের যেন ঘোর লেগে গেছে। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কথা বলতেই যেন ভুলে গেছে ছেলেটা। মায়রাও ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে আয়ানকে দেখছে। হলুদ রঙের পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা আর লাল ওড়না পড়নে আয়ানের। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মানুষটাকে রাজকুমার বলে মনে হচ্ছে মায়রার কাছে। লোকটার অবাক চাহনিটাও চোখ এড়ায় নি মায়রার। চাহনিটা সত্যি সত্যি মায়রাকে লজ্জায় ফেলছে। লোকটা কেন যে এতো লজ্জায় ফেলে কে জানে! মায়রা উল্টো ঘুরে রুমের দিকে পা বাড়াতেই আয়ানের হুঁশ ফিরলো। 

-আরে মায়রা? কোথায় চললে? আরে?

-তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? বাসায় সবাই অপেক্ষা করছে না বুঝি?

-করছে তো। কিন্তু গায়ে যার নামে হলুদ পড়বো তার মুখটা না দেখে গেলে কি চলে বলুন ম্যাডাম?

-কি বলো এসব?

-আরেকটু তোমাকে দেখি না দাঁড়াও প্লিজ? আর শোনো না? কি বলছি?

-হুম? বলো---।

-হাতে মেহেদি পড়বা তো? 

-হুম---।

-আচ্ছা। কাল দেখবো। আর শোনো না? মেহেদিতে আমার নাম খুঁজে পেলে কিন্তু যা বলবো তাই করতে হবে। বুঝলে?

-ইশ! খুঁজে পেলে তবে না?

-ওকে ম্যাডাম। চ্যালেঞ্জ রইলো। খুঁজে পেলে তখন যেন শর্তের কথা মনে থাকে। অবশ্য তুমি ভুলে গেলেও নিজের অধিকার আদায় করিয়ে নিতে আমিও একদমই ভুলবো না। আহ! আমার তো এখনই এক্সাইটেড লাগছে। শুধু কালকের অপেক্ষা। আহা!

-আগে আগেই এতো খুশি হবেন না জনাব। দিল্লি আভি দূর হেয়--। 

-দিল্লি দূরে কি কাছে সেটা কালই ভালো টের পাবেন। অপেক্ষা করুন। 

-এখন বাসায় যাও। মা বাবা চিন্তা করবে তো?

-হুম---। শোনো। আজ কিন্তু তোমাকে জয় করে নিয়ে যেতে আসবো। একেবারে ঢাক ঢোল পিটিয়ে, ব্যান্ড বাজিয়ে, ফুলে সাজানো গাড়ি করে তোমায় নিজের করে নিতে আসবো। 

-আমি অপেক্ষায় থাকবো তোমার আসার। 

-হাহ--। আর আজকের রাতটা কাটার অপেক্ষা। এক একটা সেকেন্ডকে আজ বড্ড বেশিই দীর্ঘ লাগছে গো বউ। ইশ! কবে যে বউটাকে বিয়ে করে নিয়ে যাবো। আই কান্ট ওয়েট---।

-এই? তুমি যাও তো? 

-হ্যাঁ হ্যাঁ। এখন তো তাড়াবাই। হুম হুম। তাড়াও সমস্যা নেই। সব শোধ একসাথে তুলবো৷ গত দশটা মাসের প্রতিটা সেকেন্ডের হিসেব সুদে আসলে তুলবো দাঁড়াও না? একবার শুধু বউ হয়ে আসো। তারপর বুঝবে কত ধানে কত চাল।

--------------------------

-আহাগো! ভয় পেলে নাকি গো পাখি? শোনো এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর শোনো? কাল তোমার টুকটুকে লাল বউয়ের সাজের ছবি দিবা কিন্তু। 

-হুম----।

-এখন আসি বউ সোনা?

-হুম। সাবধানে যাবা। 

-জি ম্যাডাম। বাসায় পৌঁছে কল দিবো। নো টেনশন। 

-আচ্ছা।

-এই মায়রা? আরেকটা কথা ছিল।

-হুম। বলো?

-আই লাভ ইউ পরী।

-তোমাকে ভালোবাসি।

-বায় বায় বউটা। উম্মাহ। যাও যাও। মেহেদি হলুদের সাজে আমার রঙে রাঙাও নিজেকে। আমিও চললাম। বায়য়।

আয়ানের গাড়িটা যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ মায়রা সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর হেসে রুমে আসতেই দেখলো তাথৈ, আভা আর বাঁধন ওর রুমে বসে আছে। মায়রাকে দেখে আভা আর তাথৈ দুজনেই মিটিমিটি হাসছে। বাঁধন এসবের কিছুই বুঝতে না পেরে বিছানা থেকে এক লাফে নেমে মায়রার সামনে এসে দাঁড়ালো। 

-এই এই? মায়রাপু? তুমি এতোক্ষণ ধরে বারান্দায় কি করছিলে? দেখো আমি সেই কখন থেকে হলুদ পাজামা পাঞ্জাবি পড়ে বসে আছি তোমাকে হলুদ লাগাবো বলে। আর তুমিও আসছো না, মা আর এই হিটলার আমাকে তোমার কাছে যেতেও দিচ্ছে না। কি বাজে এরা! আর তুমিও--?

মায়রা কিছু বলার আগেই তাথৈ বাঁধনকে নিজের কাছে টেনে নিলো।

-ওরে বাবা! থাম বাঁধন থাম। তোর মায়রাপুর কি আর এখন এতো কিছু ভাবার সময় আছে? সে তো এখন ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে কারো সাথে কথা বলে কাটিয়ে দিতে পারে। আর কেউ একজনও তাকে দেখার জন্য চুপিচুপি এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এখন কি আর তোর মায়রাপুর আমার কথা ভাববার সময় আছে রে বাঁধন?

-আপু? 

-তা হ্যাঁ রে বাঁধন? তোর আপু তো কাল চলে যাবে। তখন কি করবি?

বাঁধন এক লাফে আবার এসে মায়রাকে জড়িয়ে ধরলো।

-মায়রাপুর জন্য মন কেমন করলেই আমি আপুকে দেখতে চলে যাবো। আয়ান ভাইয়া বলেছে আমাকে--।

-বাহ! এতো চুক্তি হয়ে গেছে এর মধ্যেই? কিন্তু সেই তো তোর আয়ান ভাই তোর বউটাকে নিয়েই যাবে। আর তখন যদি দেখাও করতে না দেয় তখন কি করবি?

-ওই ওই? ফাজিল মেয়ে--। তুমি ভয় দেখাইলেই কি আমি ভয় পাবো? খামচি দিবো একদম। না না। কামড়ে দিবো তোমাকে---। দাঁড়াও---।

-ওরে মায়রা। তোর বাঁধনটা থামা প্লিজ? ও সত্যি সত্যি দেখছি----।

-তুমি আমার আয়ান ভাইয়ার নামে এসব বলবা কেন? আমি রিহান ভাইয়াকে বলে তোমাকে মাইর খাওয়াবো দাঁড়াও না। আর এখন পালাও কেন? কামড়াই দিবো। তুমি বেশি পচা কথা বলো সবসময়--। 

-ওর ভাই। থাম। থাম। ও মামি। তোমার রাক্ষস ছেলেকে থামাও। ওরে মায়রা--? ধর না?

আভা আর মায়রা দুজনেই বাঁধনকে থামানোর চেষ্টা করলেও বাঁধন সেসব কানে না তুলে তাথৈকে সারা রুমে দৌঁড় করাচ্ছে। আজ বাঁধন তাথৈকে ধরতে পারলে নির্ঘাত তাথৈয়ের কপালে খারাবি আছে। অবশ্য শেষমেশ তাথৈ বেঁচে গেল। মায়রা আর তাথৈয়ের দেরি দেখে রিহান ওদেরকে খুঁজতে এসে এমন ছুটোছুটি দেখেই বুঝতে পেরেছে কি ঘটেছে৷ এই বাসায় আসছে হতেই সে দেখছে। বাঁধন আর তাথৈয়ের মধ্যে এমন হুটোপুটি লেগেই থাকে৷ তাই এবারেও এগিয়ে এসে ওদের ঝগড়ার আর ছুটোছুটির পর্বটা নিজেই থামালো রিহান। তাথৈও রিহানকে দেখে থেমে গিয়ে আভার পিছনে লুকালো।

-তোমাদের দুজনের টম এন্ড জেরির ফাইটটা কবে শেষ হবে বলো তো তাথৈ? বাঁধন নাহয় বাচ্চা। তুমিও কি ওর সাথে বাচ্চা হয়ে গেলে?

-আমি কি করলাম? আমি তো---।

-থাক ম্যাডাম। আপনি কি করতে পারেন না পারেন আমি সেটা ভালোই জানি। তা আজ কি শালিকার হলুদ আর মেহেন্দির অনুষ্ঠানটা হবে না? নাকি রাত জেগে আপনারা দুই টম আর জেরি দৌড়াদৌড়ি চালিয়ে যাবেন?

-ওপস৷ সরি সরি--। সব দোষ এই বাঁধনের--। বজ্জাত ছেলে! তোর জন্য এখন আমি বকা খাচ্ছি---। 

তাথৈয়ের কথায় এবারে সবাই হেসে উঠলো। বেচারি এবারে সত্যি সত্যিই লজ্জায় লাল হয়ে মায়রাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ঘরোয়া ছোট্টখাটো একটা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়েছে মায়রার। আভা আর তাথৈ মিলে সেখানেই নিয়ে গেল মায়রাকে। গা ভর্তি হলুদ আর হাত ভর্তি করে মেহেদি লাগানো হলো মায়রাকে। হাসি ঠাট্টার মাঝে হলুদের সব নিয়ম শেষ হতে বেশ অনেকটাই রাত হলো। সব গুছিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সবার চোখ ভেঙে নামলো ক্লান্তির ঘুম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন