হঠাৎ তুমি এলে - পর্ব ০৩ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৫!! 

চোখেমুখে একটা আলোর ছলকানি এসে পড়ায় চোখ মুখ কুঁচকে সেই আলোর হামলা থেকে হালকা হয়ে আসা ঘুমের চাদরটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতেই চোখের সামনে আবার অন্ধকারের শীতলতা ঘনিয়ে এলো। এভাবে মিনিটের মধ্যে এই আলো আঁধারির খেলা চলছে তো চলছেই। থামার কোনো লক্ষণই নেই। এই আলো ছায়ার হাতছানিতে ঘুমটা ভেঙ্গে যেতেই একটা বিরক্তির ভ্রুকুটি রেখা কপালে ফুটে উঠেছে প্রজ্ঞার। বেশ বিরক্ত হয়েই ঘুমুঘুমু চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করলো রাতে জানালা না বন্ধ করেই ঘুমিয়ে গেছে কি না। অবশ্য চোখ মেলে জানালার বদলে বালিশের সাথে হেলান দিয়ে ওর দিকেই খানিকটা ঝুঁকে বসে থাকা গভীর মনোযোগী ধূসরের দুষ্টু হাসিটাই নজরে পড়লো প্রজ্ঞার। ভদ্রলোক ইচ্ছে করেই জানালার পর্দা মেলে দিয়ে এসে চোখের সামনে একবার আলো আর আঁধারির খেলা শুরু করেছে। এভাবে ঘুমের চৌদ্দটা বাজোনোর কোনো মানে হয়? তার উপরে সকালের এই রোদটা ঘুমে বুজে আসা চোখে কি যে কড়া লাগে এই লোকটা কি জানে না? প্রজ্ঞা রাগে চোখ জোড়া ছোটোছোটো করে কিছু একটা বলার জন্য উঠে বসার চেষ্টা করতেই ধূসর প্রজ্ঞার দিকে আরো ঝুঁকে প্রজ্ঞার ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের বাঁধনে আটকে নিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে ধূসর সরে আসতেই প্রজ্ঞা ধড়ফড় উঠে বসে রীতিমতো কাশতে কাশতে হয়রান হয়ে পড়ার জোগাড়। ধূসরও মিটিমিটি হাসতে হাসতে প্রজ্ঞার কাশি থামানোর জন্য পিঠে হালকা হাত ছুঁইয়ে দিতেই প্রজ্ঞা রেগেমেগে ধূসরের দিকে তাকালো। 

-কি সমস্যাটা কি তোমার? এভাবে হুটহাট দম বন্ধ করে মেরে ফেলার প্ল্যান করো নাকি? আর এক সেকেন্ড দেরি হলে তো মরেই যেতাম আজকে। উফ!

-আমার বউটাকে এক মিনিট না দেখলে আমার কেমন ফিল হয় সেটা বুঝাতে চাইলাম আর কি তোমাকে। এই যে হুটহাট গাল ফুলিয়ে আমার সাথে কথা বলো না, অন্ধকারে ডুব মেরে বসে থাকো, বারান্দায় গিয়ে অন্ধকার বিলাস করো, তখন আমারও এমন দম বন্ধ লাগে। এটা গতকাল রাতের শাস্তি। তোমার পার্টি মিস করেছি বলে যে আমার সাথে জেদ দেখিয়ে তর্ক করেছ, সেটার শাস্তি। হিসাব বরাবর হল এবারে বুঝলেন ম্যাডাম?

-তুমি এমন কেন করো বলো তো ধূসর? রাগ হওয়ার মতো কাজ করো সবসময়, আর আমি রাগ করলেই তোমার একেক বার একেক শাস্তি দিতে মন চায় আমাকে তাই না?

-একই শাস্তি বারবার দিয়ে মজা আছে বলো তো? প্রত্যেকবার নতুন নতুন শাস্তি দিলে তবে না এমন আজাইরা রাগ দেখাবে না আর। বাপের বাড়িতে আদরের দুলালি হয়ে ছিলে, যখন ইচ্ছে, যার উপরে ইচ্ছে রাগ ঝেড়েছ। বাট এটা তো চলবে না ম্যাডাম। আমার বউয়ের রাগকে কি করে ট্রাকেল দিতে হয় আমার ভালো করেই জানা আছে। 

-তোমার এসব অদ্ভুত কাজকর্ম তোমার রাগের চেয়েও বেশি ভয়ংকর লাগে আমার কাছে। নিজে দোষ করেছে স্বীকারও করবে না, তাই বলে কি কেউ তোমার উপরে রাগ, অভিমান এসবও দেখাতে পারবে না?

-আর কারো কথা জানি না। বাট আমার বউয়ের আমার উপরে রাগ করে থাকা চলবে না। একদম চলবে না।

-তার মানে তুমি যা ইচ্ছে করতে পারবে আমি কিছু বলতেও পারবো না? তাই তো? ওকে ফাইন। সরি মিস্টার ধূসর আহমাদ। ভুলটা আমারই হয়েছে। শুভ্রা ঠিকই বলেছিল, আপনার মতিগতি বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। 

-দেখো প্রজ্ঞা? আবার রাগ করছ তুমি? ম্যাডামকে সারপ্রাইজ দিবো বলে এতো কিছু করলাম, ম্যাডাম কি একবারও বলেছে যে পার্টিতে না আসার জন্য ওভাবে বকাঝকা করা তার উচিত হয়নি? বলো তো?

-ঘরোয়া পার্টি ছিল না ওটা ধূসর। আমাদের কাছের কিছু ফ্রেন্ড, তোমার বাবা মা, ভাইয়া, ভাবি, এরা এসেছিল।

-যাদের কথায় তুমি নিজেকে আমার কাছ থেকে গুটিয়ে নিতে চাও তাদের সাথে হেসে হেসে আড্ডা দিবো? এতোটা চিপ মেন্টালিটির মনে হয় আমাকে তোমার?

-কি আশ্চর্য! চিৎকার করছ কেন তুমি এভাবে? আর চিপ মেন্টালিটি মানে কি? আমি তোমাকে কি বুঝাতে চাইছি, আর তুমি কি বলছ? 

-আর একটাও কথা বলবে না প্রজ্ঞা। তুমি কি মিন করেছ আমি বেশ ভালো করেই জানি। যাদের কাছে তোমার দু পয়সারও মূল্য নেই তাদের মূল্যও আমার কাছে শূন্য, শূন্যের চেয়েও যদি ভ্যালুলেস আর কিছু থেকে থাকে, তার চেয়েও কম তাদের দাম আমার জীবনে। এই কথাটা বোঝো না তুমি? তবু কেন বারবার চেষ্টা করো তাদেরকে আমার জীবনে ফিরিয়ে আনতে? বলো?

-আমি কি করেছি? বাবা মা ই তো আগের দিন কল করে জানালো আমাদের ম্যারেজ এনিভার্সারি উপলক্ষে একটা ছোটোখাটো গেট টুগেদারের আয়োজন করতে। তুমি তো ওই বাড়িতেও যাও না, তাই ভাবলাম-----।

-কথাগুলো এতো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেছেন তোমার শ্বশুর শাশুড়ি? নাকি এটা বলেছে যে তুমি তাদের ছেলের মাথাটা বিগড়ে দিয়ে তাকে নিয়ে আলাদা সংসার করছ? তাদের কাছে আসতে দাও যাও, ইত্যাদি ইত্যাদি। 

-তোমাকে কে বলেছে এসব? মা বাবা কেউই এমন কিছু বলে নি----।

-মিথ্যে যদি বলতে হয় সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে বলো। সেই সাহস আছে তোমার? আর প্লিজ এই বাবা মা এসব বলা বন্ধ করো। আগেও হাজার বার বলেছি যারা সম্মান পাওয়ার যোগ্য না তাদেরকে অযথা সম্মান দিতে গিয়ে নামগুলো, সম্বন্ধগুলোকে অপমান করো না। 

-এভাবে কথা বলছ কেন তুমি? আমাদের এনিভার্সারির জন্য একটা ঘরোয়া পার্টির আয়োজন করারও কি আমার অধিকার নেই? সেরকম হলে বলে দাও, এর পর থেকে সংসারের কোনো ব্যাপারেই নাক গলাবো না। সরি।

কথাটা বলেই প্রজ্ঞা পড়নের আলুথালু শাড়িটা কোনোমতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েই বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করতেই ধূসর প্রজ্ঞার বাম হাতের বাহুটা ধরে টেনে নিজের কাছে একদম গা ঘেঁষে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। প্রজ্ঞা শাড়িটার একটা কোণা শক্ত করে খামচে ধরে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে চোখ সরানোর চেষ্টা করতেই ধূসর প্রজ্ঞার মুখটা বাম হাত দিয়ে একটু চেপে ধরে জোর করেই প্রজ্ঞার মুখটা আবার নিজের দিকে ফিরিয়ে চোখে চোখ স্থির করলো। 

-কথা প্যাঁচাও কেন এভাবে হ্যাঁ? আমি একবারও, এর আগে লেটারেলি একদিনও তোমাকে বলেছি এটা করো না, ওটা করো না, বলেছি কখনো?

-এখনও তো বলছ। আপনার বাবা মা এসেছে সেটাই আপনার পছন্দ হচ্ছে না। এট মানে আর কি দাঁড়ায় বলুন?

-আপনার শ্বশুর শাশুড়ি নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আপনাকে সম্মানের সাথে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসলে তো আমার রাগ হতো না। এটা আপনিও ভালো করেই জানেন ম্যাডাম। আপনার শ্বশুর শাশুড়ি গেট টুগেদার করতে চায় ভালো কথা, তাদের অমুক বন্ধু, তমুক বান্ধবীকে কেন আমাদের এনিভার্সারির পার্টিতে ইনভাইট করবে? তাও আবার আমাদের বাড়িতে? কেন বলুন?

-আমমমম। পার্টিতে তো কত মানুষই আসে। তাই--।

-আর একবার যদি ওদের সাইড নিয়েছ তাহলে সোজা ওই বাড়িতে তোমার আদরের শ্বশুর শাশুড়ির কাছেই রেখে আসবো বলে দিলাম প্রজ্ঞা। মাইন্ড ইট। ওদের বিশাল রাজপ্রাসাদে কি ঘটে আমি এমনিতেই সব আপডেট পেয়ে যাই। আর তোমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর শাশুড়ি তোমাকে কি বলছে, কি বলে খোঁচা দিচ্ছে, কি শর্তে তোমাকে মেনে নিবে এসব গল্প শোনাচ্ছে সেসব জানতেও আমার তোমার বলার অপেক্ষা করা লাগে না। কথাটা মাথায় রাখবে।।

-আমাকে কেউ কিচ্ছু বলে নি। 

-ওহ রিয়েলি? পার্টিতে ইনভাইটেড যে কোনো একজন গেস্টের নাম বলো যে তোমার শ্বশুর শাশুড়ির বিহেভের পজিটিভ ফিডব্যাক দিবে। কই বলো? এনিওয়ান?

-ছাড়ো তুমি। আমাকে কেউ কিচ্ছুই বলে নি। নিজে তো ছিলেও না সেখানে। আন্দাজে ঢিল মারলেই হয়ে গেল আর কি?

প্রজ্ঞার কথায় এবারে সত্যি সত্যিই প্রজ্ঞাকে ঠেলে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিল। প্রজ্ঞা অবাক হলেও নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যাতে ওর এই মিথ্যে কথাটুকু ধূসরের কাছে ধরা না পড়ে যায়। তাই আর কথা না বাড়িয়ে কাবার্ড থেকে টাওয়াল আর একটা ফতুয়া আর স্কার্ট হাতের কাছে পেয়ে সেগুলো নিয়েই ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।

-তোমার শ্বশুর বা শাশুড়ির করা প্রত্যেকটা প্রশ্নের জবাব দিতে আমি ঠিকই আসতাম। আসি নি কেন জানো? সেখানে আরো একজন উপস্থিত ছিল। শুভ্রা। ও কেন আসবে আমাদের মাঝে বলো? 

-শুভ্রা আপু তোমার কাজিন হয় ধূসর।

-ওই বাড়িতে থাকলে এতোদিনে তোমার শ্বশুর শাশুড়ির মেহেরবানিতে আমার কাজিন তোমার সতিন হয়ে যেত। সেটা তো বললে না? 

-ধূসর? দুনিয়ার যত বাজে কথা সব তোমার কাছে! আশ্চর্য তো! ভুল হয়ে সরি। পরেরবার থেকে ভুলেও, মানে ভুলেও আমার এনিভার্সারি নিয়ে একটা টু শব্দও করবো না। বাসায় সবাই আসলেও সোজা মুখের উপরেই দরজাটা বন্ধ করে দিবো। ওকে?

কথাটা শেষ হতেই প্রজ্ঞা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করতেই ধূসর দরজাটা ঠেলে ধরলো। প্রজ্ঞা দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ধূসরকে ওয়াশরুমে ঢুকতে দিলো না। ধূসরও এবার হেসে দরজার ফাঁক দিয়ে প্রজ্ঞার কাঁধে হাত ছুঁইয়ে দিতেই প্রজ্ঞা ধড়ফড় করে সরে এলো দরজার থেকে। ধূসরও সেই সুযোগে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে প্রজ্ঞার মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে এক পা এগিয়ে গেল প্রজ্ঞার দিকে। প্রজ্ঞাও চমকে উঠে পিছিয়ে আসতে আসতেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় দাঁড়িয়ে গেল। ধূসর ধীর পায়ে এক পা দু পা করে প্রজ্ঞার দিকে এগিয়ে এসে প্রজ্ঞার দু পাশের দেয়ালে হাত দিয়ে মেয়েটার পালানো আটকে সোজা প্রজ্ঞার মুখের দিকে তাকালো।

-এভাবে সে সারাদিন এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছ, ছটফট করছ আমার থেকে পালানোর, এসব করতে গিয়ে ব্যথা পেলে কিন্তু খবর আছে বলে দিলাম মেয়ে।

-ব্যথা পাওয়ার কি হলো? আপনি যে ব্যথাগুলো দিচ্ছেন কথার আঘাতে তার চেয়ে কি এই ব্যথা বেশি মনে হয়?

-উফ! কি ডায়লগ বলো তো প্রজ্ঞা? বাকি কারো কথায় আঘাত লাগে না তোমার, শুধু আমি তোমার কথা ভেবে কথাটা যতবার বলি ততবারই তোমার কষ্ট লাগে, কান্না আসে। অযথ ওরা যে বারবার তোমাকে অসম্মান করে, অপমান করে, সবার সামনে ছোটো করে সেসব কিছুই না? এই যে জিদ্দি বউ হয়ে আমার সাথে তর্ক করে ওদের পক্ষ নিয়ে, কই নিজের বেলায় কেন গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হয়না তোমার?

-আমি হয়ে বলার জন্য তো আপনিই আছেন। আমাকে নিজের সাফাই দিতে হবে কেন অন্য কারো।কাছে? এখন সরুন তো সামনে থেকে। বারবার আমাকে ভয় দেখিয়েই যাচ্ছেন না? যখন থাকবো না তখন বুঝবেন। সুযোগ পেলেই আমাকে জ্বালান তো এভাবে? চলেই যাবো একদিন দেখবেন। তখন হাজার খুঁজেও পাবেন না। হুহ।

-ওহ্হো! বরের রাগটা হজম করতে করতে বউয়ের গোস্সা শুরু হয়েছে দেখছি? তখন না বললে কথার আঘাতে বেশি ব্যথা পেয়েছ, তা কোথায় ব্যথা পেয়েছ দেখি? আদর করে আজকের মতো ব্যথাটা সারিয়ে দিই। কজ আপনি তো হার মানার মেয়ে নন, দুদিন পরে আবার আপনার শ্বশুরবাড়ির সাফাই গাওয়া শুরু হয়ে যাবে। আবার বকা খাবে আমার হাতে। কন্টিনিউয়াস সার্কেল তো এটা তাই না? কি বলো?

-আপনি জানেন আপনার রাগটা আমার কত ভয় লাগে, তবুও আপনি আমার উপরে রাগ দেখান। কখনো ইচ্ছে করে, কখনো নাটক করে। আবার এসেছেন আমার রাগ ভাঙ্গানোর ঢং করতে? সরুন। লাগবে না আপনার আদর, আমি আমার ব্যথা নিয়েই থাকি। আপনি বের হন, বের হন, বের হন। 

প্রজ্ঞা অভিমানী হাতে ধূসরকে সত্যি সত্যিই ঠেলে বের করার চেষ্টা করতেই ধূসর আরো কিছুটা এগিয়ে এসে প্রজ্ঞার সাথে নিবিড় হয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে প্রজ্ঞার ঘাড়ে মুখ ডুবালো। ওদের মান অভিমানের ভেলা কোনদিক থেকে কোনদিকে মোড় নেয় বোঝা মুশকিল। এক্ষুণি দুজন চিল্লাপাল্লা করে ঘর মাথায় তুলছে, তো পরক্ষণেই অন্যজন অভিমান ভাঙাতে আদরের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। কি অপেক্ষা করছে ওদের টোনাটুনির সংসারে কে জানে!

০৬!! 

দুষ্টু মিষ্টি খুনশুটি করতে করতে বেশ অনেকটা সময় কেটে গেছে। শাওয়ার শেষ করে স্কার্ট আর ফতুয়াটা পড়ে চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চোখ পড়লো প্রজ্ঞার। ধূসর শার্টের স্লিভ গুঁটিয়ে নিতে নিতেই থমকে আয়নায় প্রজ্ঞার দিকেই তাকিয়ে আছে। প্রজ্ঞা ভ্রু নাচিয়ে 'কি হয়েছে' ইশারায় জানতে চাইতেই ধূসর এগিয়ে এসে প্রজ্ঞাকে পিছন থেকেই জড়িয়ে ধরে কাঁধে নাক ডুবিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিলো। হুট করে এভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁধে নাক মুখ ডুবিয়ে দেয়ায় ধূসরের উষ্ণ নিঃশ্বাসগুলো আছড়ে পড়ছে প্রজ্ঞার ঘাড়ে আর কাঁধে। আর তাতে কেমন গা শিরশির করা অনুভূতি হচ্ছে প্রজ্ঞার। প্রজ্ঞা আপাতত অনুভূতিটাকে পাত্তা না দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ধূসরের মুখটা দেখার চেষ্টা করলো।

-এভাবে হা করে আমাকে দেখতে হবে না ম্যাডাম। আপনার এই মু্গ্ধ দৃষ্টিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলার জেদ চাপলে কিন্তু তখন পালাতে চাইলেও পারবেন না। 

-মাঝেমাঝে তোমার কথা শুনলে আমি বুঝে উঠতে পারি না, লজ্জা পাবো নাকি হাসবো। তোমার মতো স্মার্ট, হ্যান্ডসাম একজন ভদ্রলোক পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যে কোনো মেয়েই একবার হলেও আড়চোখে তাকাবে। আর সেই হিসেবে আমার মতো একটা মেয়ের হাজবেন্ড তুমি। তোমাকে মুগ্ধ হয়ে দেখবো না তো কি করবো?

-তোমার মতো মেয়ের হাজবেন্ড মানে? আমার বউটাকে নিয়ে টন্ট মেরে কথা বলতে বারণ করেছি না একবার? কেনো কথাই শুনবে না বলে ঠিক করে রেখেছ তাই না প্রজ্ঞা?

-এতো রাগ করো কেন কথায় কথায়? তুমি মানে আর না মানো নিজেকে সুন্দরী বলার মতো গায়ের রঙ আমার নয়। কালো না বললেও অন্তত এই গায়ের রঙের তামাটে ভাবটাকে আর যাই হোক সুন্দর বলা যায় না। শুভ্রাদের মতো অত আগুন সুন্দরীও নই যে তুমি এতো হুট হাট আমাকে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকবে।

-শুভ্রারা আগুন সুন্দরী হলেই বা আমার কি? আর তোমারই বা কি? খালি ফর্সা গালে আরো সাদা গোলাপি লাল হলুদ রঙ মাখলেই কি তাকে সুন্দর বলে? এই যে আমার প্রজ্ঞা রাণী, শাওয়ার নেয়ার পর এতো স্নিগ্ধ লাগছে তাকে, একদম তাজা কুয়াশার চাদরে মোড়া ধানের শিষের মতো। অথবা ভোরের প্রথম শিউলি বৃষ্টিতে ভিজলে যেমনটা দেখায়, তার চেয়েও বেশি দারুণ দেখাচ্ছে তোমাকে।

-হয়েছে হয়েছে। আর বলতে হবে না। কেমন সুন্দর দেখায় সেটা তো কাল তোমার গেস্টরাই বলে দিল। আপনার মতো একজন লম্বা, সুদর্শন পুরুষ এমন বউ নিয়ে এক বছর কি করে সংসার করেছে সেটাই গতকাল পার্টির হট টপিক ছিল।

-তো আমি কি করতে পারি? আর একটা ভুল কথা বললে। আমার গেস্ট নয়, তোমার গেস্ট। আরো স্পেসিফিক করে বলতে গেলে তোমার শ্বশুর শাশুড়ির গেস্ট। ওদের কাছে নজরে যারা সুন্দরী তাদের সাথে বড় জোর দু একটা রাত কাটানো যায়, এক বছর ধরে সংসার করবে! হাস্যকর মনে হবে ভাবতেও।

-ছি! তুমিও আজকাল ওদের মতো বাজে কথা বলা শুরু করেছ ধূসর। সুন্দরী মেয়েরা কি সংসার করে না? এই যে এতো এতো যে বিশ্বসুন্দরী হয়, বিউটি কনটেস্টের বিজয়ী মেয়েগুলো, ওরা কি সংসার করে না? যত্তসব আজেবাজে কথা। সরো তো। মেজাজটাই খারাপ করে দিল লোকটা আমার।

-তুমি আমার কথাটা ধরতে পারো নি। আমি বলেছি তোমাস গেস্টদের দৃষ্টিতে যারা সুন্দরী তাদের কথা। যারা তোমাকে গায়ের রঙ নিয়ে কথা শুনিয়েছে তাদের ঘরের বউগুলো কিন্তু কোনো বিশ্বসুন্দরীর চেয়ে কম নয়। রূপে, গুণে, ঘরকন্যায় অনেকে অল ইন ওয়ান প্যাকেজ বলতে পারো। তবু খবর নিয়ে দেখবে সেই ভদ্রলোক অফিসের কাজের নাম করে বান্ধবীর সাথে হোটেলে গিয়ে উঠছে। কি বা কেন সেসব আশা করি তোমাকে এখন ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না।

-সবাই তো এক না।

ধূসরের কথাগুলো শুনে প্রজ্ঞা মিনমিন করে কথাগুলো বলে নিজেই নিজের মনকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলো। ধূসর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রজ্ঞাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে প্রজ্ঞার মুখটা দু হাতের আঁজলায় তুলে ধরলো।

-সবাই যেমন এক না তেমনি সবার চয়েজও এক না। আমার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সুন্দর মানুষটা হলে তুমি। তোমার স্নিগ্ধ, আনকোরা মুখটা তাই আমাকে অনেক বেশি টানে বুঝলে মেয়ে? আর তুমি সুন্দর নও, হাইটে একটু শর্ট, এসব না মাথা থেকে বের করে দাও বুঝলে? যারা চায় না তুমি আমার পাশে থাকো, তারা এমন বহু খুঁত বের করবে, এটাই স্বাভাবিক। বাট তুমি আমার সাথে থাকতে চাও কি না সেটা হলো জরুরি।

-আমার দুনিয়াটাই তো তুমি। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই কি না এটা কেমন কথা? তবে মাঝেমাঝে তোমাকে দেখলে এতো অবাক হই জানো? মনে হয় আসলেই তো তোমার পাশে শুভ্রার মতোই কাউকে মানায়। অন্তত আমার চেয়ে আরে কয়েক ইঞ্চি লম্বা, আরেকটু ছিমছাম গড়নের, সুন্দরী। এমন কেউ তোমার পাশে দাঁড়ালে একদম পার্ফেক্ট মানাতো। 

প্রজ্ঞার কথাটা শেষ হতেই ধূসর প্রজ্ঞাকে একটু সরিয়ে দিয়ে ভালো করে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা শুরু করলো। ধূসরের এমন কাজে বেচারি এবারে একটু লজ্জাই পেয়ে গেল। 

-কি দেখছে এভাবে?

-দেখছি না, হিসেব করছি। যেদিক থেকেই দেখি না কেন তোমাকে একটা কিউট পুতুলের মতো লাগে বুঝলে? যে পুতুলটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে আগলে রাখতে হয় সবসময়। আর হাইটের কথা বলছ? এই যে তোমাকে জড়িয়ে ধরলে একদম বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে লুকিয়ে পড়ো, সেটাই তো একদম পার্ফেক্ট মনে হয় আমার। আর তোমাকে কে বলেছে শুভ্রা তোমার চেয়ে বেশি লম্বা? কয় ইঞ্চি উঁচু হিল পরে থাকে খেয়াল করেছ কখনো? কখনো দেখা হলে ওকে বলো হিলগুলো খুলে ফ্লোরে তোমার পাশাপাশি দাঁড়াতে তারপর বুঝবে ওসব হাইটের খেলা না, এসব হলো তিন-চার ইঞ্চি উঁচু হিলের জাদু।

-তোমার সব কথাই রেডি থাকে আগে থেকে তাই না? হিলের কথা যে বললে, তার মানে তুমি ওই শুভ্রাকে খুব ভালোভাবেই অবজার্ভ করেছ। নইলে তো এতো কিছু বলতে পারতে না।

-এই প্রজ্ঞা? তোমার চুলগুলো তো আগের চেয়ে বেশ লম্বা হয়েছে! কি তেল ইউজ করছ বলো তো?

-কিহ? তেল, চুল, এসব কোথা থেকে এলো?

-বারবার শুভ্রাই বা আমাদের মাঝে কোথা থেকে আসছে? ওর সাথে নিজেকে কম্পেয়ার করে নিজের লেভেলটাকে এতো নিচে নামিও না বুঝলে? ওকে আমি নিজের বোনের চোখেই দেখে এসেছি আজীবন। তুমি আমার লাইফে না আসলেও অন্তত ওকে বিয়ে করতাম না। এটা তোমার শ্বশুর শাশুড়ি যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই ভালো।

-কিন্তু মা তো মামাকে কথা দিয়েছিল -----।

-তো আমি কি করবো? মায়ের কথা রাখতে কি এখন শুভ্রাকে বিয়ে করতে হবে নাকি? 

-এভাবে বলছ কেন? আমি কি সেটা বললাম নাকি?

-মাঝে মাঝে তুমি এমন এমন সব কথা বলো যে আমার মাথাটাই গরম হয়ে যায়। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছি, গোল একটা লঙ ড্রেস পরা, একদম কিউট পুতুলের মতো লাগছিল। সেদিন থেকেই প্রার্থনা করেছি এই পরীর মতো দেখতে ছোট্টো পুতুলটা আমার হোক। বাকিরা কে কি বললো সেটা আমার শোনার সময় নেই। আমি শুধু একটা কথাই জানি এই পুতুলটাকে আমার সারাজীবনের জন্য পাশে চাই, আর এই অনুভূতিটা আমার মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত থাকবে। সো এসব আজাইরা কথাবার্তা না ভেবে রেডি হয়ে নাও। রেস্টুরেন্টে একসাথে নাস্তা করে তোমাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে অফিসে যাবো আমি।

-রেডিই তো। চলো? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো তোমার?

-রেডি? এভাবে যাবে রেস্টুরেন্টে?

-কেন ভালো লাগছে না? চেইঞ্জ করতে হবে?

-ভালো লাগছে কিনা বুঝতে পারছো না? তোমাকে এভাবে দেখে অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না। বাট আফসোস, একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে।

-তাহলে?

-আমার ফতুয়া আপনার পড়নে ম্যাডাম। শেষে সবাই যখন হা করে তাকিয়ে থাকবে, লজ্জা পেলে তো আপনিই পাবেন। তাই আর কি ভাবলাম হয়তো চেইঞ্জ করে নিবেন।

-উঁহু না। বয়ফ্রেন্ডের ড্রেস তো পড়ি নি, নিজের হাজবেন্ডের ফতুয়া পরেছি। হুহ। আর যার ইচ্ছে দেখুক। আমার কি। 

-ওকে। তোমার প্রবলেম না হলে তো আমারও কোনো প্রবলেম নেই। চলো? ওয়েট, এক মিনিট।

ধূসর কাবার্ড থেকে একটা ওড়না বের করে প্রজ্ঞার গলায় পেঁচিয়ে দিয়ে দু পাশে ঝুলিয়ে দিয়ে প্রজ্ঞাকে আরেকবার দেখে নিলো।

-ওকে, এবার পার্ফেক্ট। চলো?

একটা ফ্যামেলি রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট সেরে প্রজ্ঞাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে সোজা অফিসে চলে গেল ধূসর। দুদিনের অনেক কাজ জমা পড়ে আছে। আজকের মধ্যে কাজগুলো শেষ করার জন্যই একমনে কাজে মন দিল ছেলেটা। ধূসর এতো মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল যে কখন ওর রুমের দরজা খুলে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা টেরই পায়নি। দরজায় দাঁড়ানো মানুষটা অনেকক্ষণ ধূসরের দিকে তাকিয়ে থেকে শেষে হতাশ হয়েই দরজায় নক করলো। আর ব্যস্ত ধূসর হঠাৎ কারো কণ্ঠস্বর শুনে চমকে তাকাতেই দরজায় দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। আর কানে তখনো বাজছে কয়েকটা শব্দ।

-মে আই কাম ইন স্যার?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন