৪৫!!
আয়ান বেশ কিছুক্ষণ থমকে মায়রার ভেজা মুখ আর চুল বেয়ে টপটপ করে পানিগুলো ঝড়ে পড়ার দৃশ্যটা দেখলো। মায়রার লজ্জামাখা গাল বেয়ে পানির স্রোতটা নেমে এসে মায়রার পড়নের শাড়িটাও ভিজিয়ে দিয়েছে একদম। ভেজা শাড়িটা মায়রার গায়ে এমনভাবে লেপ্টে গেছে যে আয়ান চেয়েও নিজের চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না। আর এই যে মায়রার ভেজা ঠোঁট জোড়ার আলতো কাঁপন, সেটাও যেন আয়ানকে মায়রার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে বারবার। এই ডাকে সাড়া না দেয়ার সাধ্য কি আয়ানের আধৌ আছে? আয়ান আরেকটু এগিয়ে এসে মায়রার দুপাশের দেয়ালে হাত দিয়ে মায়রার মুখের দিকে একটু ঝুঁকে এলো। মায়রাকে স্পর্শ করলো না ঠিকই। কিন্তু আয়ানের উষ্ণ ঘন নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে মায়রার মুখের উপরে৷ মায়রা এতোক্ষণ চোখ বুজে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে চোখে মুখে আয়ানের নিঃশ্বাস এসে পড়ায় ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো আয়ানের দিকে। আয়ানকে নিজের এতোটা কাছে দেখে মায়রা নিজেও খেঁই হারিয়ে ফেললো যেন। ওর হাত দুটো যেন কোন এক দৈব মায়ায় আয়ানের ঘাড়ে ঝুলে গলা জড়িয়ে ধরলো৷ সোজা আয়ানের চোখে চোখ রেখে একবার লাজুক হাসলো মায়রা।
-এভাবে কি দেখো সারাদিন?
-আমার বউটাকে।
-এতো দেখেও বুঝি দেখা শেষ হয় না জনাব?
-তোমাকে সারাটা জীবন ভর দেখলেও যে আমার দেখার আশ মিটবে না গো লাজুক পরী৷
-কচু। বললেই হলো নাকি?
মায়রা এমনভাবে ঠোঁট বাঁকিয়ে কথাটা বললো যে আয়ান হেসে ফেললো। মায়রার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে আলতো করে কানের লতিতে কামড় বসালো আয়ান। মায়রা কেঁপে উঠতেই মায়রাকে নিজের সাথে শক্ত করে বেঁধে আবার কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আয়ান।
-"তুমি আমার এমনই একজন
যারে এক জনমে ভালোবেসে
ভরবে না এ মন
এক জনমের ভালোবাসা
এক জনমের কাছে আসা
এক জনমের ভালোবাসা
এক জনমের কাছে আসা
একটু চোখের পলক পড়তে
লাগে যতক্ষণ
তুমি আমার এমনই একজন
যারে এক জনমে ভালোবেসে
ভরবে না এ মন।"
আয়ানের ঠোঁটের ছোঁয়া আর কানের উপরে এসে পড়া আয়ানের উষ্ণ নিঃশ্বাস মাখা আবেগী গান শুনে অন্যরকম একটা ঘোরের মাঝে ছিল মায়রা। আয়ান ধীর হাতে মায়রার কাঁধের উপর থেকে ভেজা আঁচলটা সরিয়ে নিয়ে কাঁধের টকটকে লাল রঙা তিলটায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে মায়রার ভেজা চুলে মুখ গুঁজে দিলো। মায়রা কেঁপে উঠে আয়ানকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। একটু পরেই আয়ানের সরে আসা টের পেয়ে লজ্জায় চোখ বুজে রইলো মায়রা। বেশ কয়েকটা মিনিট কেটে যাওয়ার পরেও আয়ানের স্পর্শ না পেয়ে মায়রা চোখ খুলবে কিনা ভাবলো৷ কোনমতে পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখলো আয়ান একদম সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মায়রা কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই আয়ান মায়রার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। মায়রা চোখ বড় বড় করে আয়ানের দিকে তাকাতেই আয়ান সরে এসে চোখ টিপলো মায়রার দিকে তাকিয়ে। তারপর ধবধবে সাদা একটা টাওয়াল জড়িয়ে দিলো মায়রার গায়ে। এতোক্ষণে মায়রার খেয়াল হলো আয়ান নিজেও একটা টাওয়াল গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। আয়ান মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে ওয়াশরুমের দরজার দিকে পা বাড়ালো।
-এসব কিন্তু ঠিক না মায়রা। আমি নাহয় একটু কন্ট্রোল হারিয়েছিলাম৷ তাই বলে তুমিও বাধা দিবে না? এটা কোনো কথা?
মায়রা থতমত খেয়ে আয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো লোকটা কি বলতে চাইছে৷ আয়ান পিছন ফিরে মুখ টিপে একবার হেসে আবার একটু গম্ভীর মুখে মায়রার দিকে ফিরলো৷
-একটু পরেই বৌভাতের ফাংশানটা শুরু হবে। সেসব ভুলে এভাবে রোমান্সে ডুবে থাকলে চলবে কি করে বলো তো? ছি ছি ছি মায়রা! এটা কিন্তু তোমার ভারি অন্যায় হয়েছে--। তোমার কাছে আমি মোটেও এমন কিছু আশা করি নি।
-আমি কি করলাম?
-কিছুই তো করো নি প্রিয়। সেটাই তো বলছি। এখন তাড়াতাড়ি এসে রেডি হয়ে নাও তো? সবাই কতো হাসাহাসি করবে আজকে আমাকে নিয়ে! ছি ছি! বলবে কেমন বউ পাগলা ছেলে হয়েছে? তারা কি আর জানে যে আমার বউ আমাকে ওয়াশরুমে আটকে রেখেছে এতোক্ষণ? আসতেই দিতে চাইছে না? মান সম্মান আমার আজ সব গেল রে!
আয়ান এবারে আর এক মূহুর্তও দেরি না করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গেল। মায়রা ভ্রু কুঁচকে আয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। বেচারি এটাই বুঝতে পারলো না আয়ান ওকে কি বলে গেল। ও আবার আয়ানকে আটকে রাখলো কখন? লোকটা নিজে ওকে আটকে রেখেছে এতোক্ষণ। আর এখন বলে কিনা ও নাকি তাকে আসতে দিতে চাইছিল না? এটাকে কি বলে? এ তো এক কথায় পল্টি খাওয়া! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মায়রা আস্তে আস্তে ভিজে শাড়িটা বদলে নিয়ে শুকনো টাওয়ালটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। আয়ানের এমন উল্টোপাল্টা কথা মায়রাকে ভিষণভাবে ভাবতে বাধ্য করাচ্ছে। কোথা থেকে কি হচ্ছে আর কি ভাবছে তার কিছুরই মাথামুন্ডু মায়রা নিজেই বুঝতে পারছে না। এমন সময় হঠাৎ দরজায় নক হওয়ায় চমকে উঠলো মায়রা।
-কে?
-মায়রা? আজকে কি চেইঞ্জ করবে না? নাকি বাথরুমেই ঘুমিয়ে পড়লে জান?
-আসছি তো--।
ওয়াশরুম থেকে বের হতে পা বাড়িয়েই মায়রা থেমে গেল৷ পড়নের টাওয়ালটার দিকে চোখ পড়তেই হাত দুটো আপনাআপনিই টাওয়ালটাকে চেপে ধরলো। মায়রা দরজার পিছনে মুখ লুকিয়ে নিলো। আবারও আয়ান দরজায় টোকা দিতে শুরু করায় মায়রা অল্প করে দরজাটা খুলে উঁকি দিলো।
-আয়ান? এই? শোনো না?
-বউ বউটা। শুনছি তো। ওমা? এভাবে লুকিয়ে আছো কেন দরজার আড়ালে? রুমে এসো? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো?
-না মানে আসলে? আমি তো শাড়ি--। না মানে শাড়ি নিয়ে আসি নি। একটা শাড়ি দাও না প্লিজ?
-তোমার শাড়ি তুমি নিজে এসে নাও। আমি কেন দিবো?
-এই শোনো না প্লিজ? টাওয়াল পড়ে বের হতে পারবো না। দাও না একটা শাড়ি?
-শুধু শাড়ি দিলে তো চলবে না। তারপর বলবে ব্লাউজ দাও। পেটিকোট দাও। অমুক দাও। তমুক দাও। না বাবা। আমি পারবো না। তোমার জিনিস তুমি নিয়ে নাও।
-এমন কেন করছ? দাও না?
-জি নাহ। পারবো না। নিজে এসে নাও। আমি তোমার বিয়ে করা বর। চাকর না। হুহ।
-ভালো হবে না বলে দিচ্ছি আয়ান।
-সেটা পরে দেখা যাবে।
-তোমার রেডি হওয়া শেষ? বের হও রুম থেকে।
-বাহ! কি শখ? এই শোনো? এই রুমটা আমার বুঝলে? আমার অনেক কাজ বাকি এখনো। আমি এখন রুম ছেড়ে এক পা ও কোথাও নড়বো না।
-আয়ান?
-বলো বউটা?
-এমন করছ কোন?
-আমি কিচ্ছু করছি না বউ। আমি আমার কাজ করছি, তুমি তোমার কাজ করো। সিম্পল।
মায়রা কয়েক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে একটু বোঝালো। আয়ানই তো রুমে। আর তো কেউ না। ওর নিজেরই বর। ও নিজের কাজ করুক। মায়রা নাহয় শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে আসবে। কয়েক মিনিটেরই তো ব্যাপার। ভাবা শেষ হলে মায়রা টাওয়ালটা গায়ে ভালো করে পেঁচিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। আয়ান ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গায়ে বডি স্প্রে দিচ্ছিলো। মায়রাকে দেখে আয়ানের ঠোঁটের কোণে বাঁকা একটা হাসি ফুটে উঠলো। টাওয়ালটা মায়রার হাঁটু থেকে কিছুটা নিচ পর্যন্ত ছুঁয়ে আছে৷ মায়রার ধবধবে সাদা পায়ের উপরে কয়েক ফোঁটা পানি চিকচিক পায়ের সৌন্দর্যটা যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মায়রা একবারের জন্যও আয়ানের দিকে না তাকিয়ে লাগেজ থেকে লাল রঙা একটা বড় শাড়ি আর আনুষাঙ্গিক জিনিস নিয়ে তড়িঘড়ি করে পালানোর চেষ্টা করলো। আয়ান মায়রাকে সেই সুযোগটা দিলো না৷ মায়রার ওয়াশরুমে যাওয়ার রাস্তা আগলে একদম দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে আয়ান। মায়রা আয়ানকে দেখে শাড়ি আর অন্য জিনিসগুলো নিজের গায়ে চেপে ধরলো।
-সরো না? আমি চেইঞ্জ করবো।
-তা ম্যাডাম চেইঞ্জ করতে যাচ্ছেন? নাকি আবার ভিজতে? হুম? কোনটা?
-ভিজবো কেন?
-মনে তো হচ্ছে ভিজবেন। এই শাড়ি আপনি ওয়াশরুমে গিয়ে কি আধো পড়তে পারবেন? এর চেয়ে রুমে পড়ে নিলে ভালো হয় না?
-আমি তো পড়তে চাইলাই। তুমিই তো---।
-আমি কি করলাম? আমি তো নিজের কাজ করছি। দেখছো না? আমি রেডিও হয়ে গেছি--। তুমি নিজে তো রেডি হচ্ছোই না আবার---।
---------------------------
-আর কষ্ট করতে হবে না বউটা। দাও আমি পড়িয়ে দিচ্ছি শাড়ি----।
-না না না।
-যাহ বাবা! এ তো দেখছি ভালোর জামানাই নেই। আমি ভালোর জন্য তাকে শাড়িটা পড়িয়ে দিতে চাইছি--।
-যাও না প্লিজ? দেরি হচ্ছে তো?
-কি আর করা! মিষ্টি খাওয়া তো হলো। আমি এখন তাহলে নাস্তা করে আসি। তুমি ততক্ষণে রেডি হয়ে নাও। তবে আমি আসার আগে রেডি না হতে পারলে কিন্তু আমি এসে----।
-না না। আমি-আমি রেডি হয়ে হচ্ছি। তুমি যাও এখন।
-হুহ। তাড়াতে পারলেই যেন বাঁচে সে। এই মায়রা? একটা কথা শোনো না?
-কি?
-এই সাদা টাওয়ালে তোমাকে একদম স্নো হোয়াইটের মতো সুন্দর লাগছে। একটা কাজ করবে? তুমি প্রতিদিন এক মিনিটের জন্য হলেও---।
-তুমি যাবা প্লিজ?
-আচ্ছা বাবা যাচ্ছি। কথাটা মাথায় রেখো কিন্তু। বায়। পনেরো মিনিট সময় ম্যাডাম। আবার আসছি কিন্তু।
আয়ান ঠোঁটের কোণে আবার তার বিখ্যাত দুষ্টু হাসিটা ফুটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে ভিতর থেকে দরজাটা লক করে যেতেও ভুললো না। আর মায়রা নিজেকে একবার আয়নায় দেখে হেসে শাড়ি পড়ায় মন দিলো। এই পাগল লোকটা আর কি পাগলামি করবে কে জানে? অবশ্য তার এই পাগলামি ভালোবাসাগুলোর নেশায় পড়ে যাচ্ছে মায়রা নিজেও। কিন্তু মায়রার মনের কোণে একটা ভয় ঠিকই একটু পর পর খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে। মা বাবা যখন সবটা জানবেন তখন কি হবে? তখনও কি এভাবে ভালোবেসে কাছে টেনে নিবেন? নাকি দূর করে দিবেন তাদের জীবন থেকে?
৪৬!!
মায়রার আজকে যে শাড়িটা পড়ছে সেটা টকটকে লাল রঙা ভারি কাতান শাড়ি। সোনালী সূতোয় ফুলের ডিজাইন করা আঁচলে। মায়রা নিজে অনেক যত্ন করে শাড়িটা পড়ে নিলো। বিয়ের হালকা কিছু গয়না পড়ে চুলটায় একটা সিঁথি করে খোঁপায় জড়িয়ে নিলো। তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা টুলটায় বসে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিয়ে হালকা করে সাজটা কমপ্লিট করলো। বেশি কিছু না। মুখে হালকা করে ক্রিম-পাউডার এসব মেখে নিয়ে চোখে কালো করে আইলাইনারের রেখা টানলো মায়রা৷ সাথে যত্ন করে লিপস্টিকে রক্তলাল করে রাঙিয়ে নিলো ঠোঁট জোড়া। সাজটা শেষ হলে মায়রা নিজেকে আবার একবার আয়নায় দেখে নিলো। আয়ান এসে ওকে এই রূপে দেখে না জানি কি করবে! ভাবতেই লজ্জার আভা খেলা করে গেল মায়রার চোখে মুখে।
আয়ানের কথা খেয়াল হতেই ঘড়িতে একবার সময়টা দেখে নিলো মায়রা। লোকটা পনেরো মিনিটের কথা বলে গেছে৷ এখন চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিটের মতো হয়ে গেল। অথচ তার আসার নামই নেই! গেল কোথায়? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দরজার নকের শব্দে মায়রার ঠোঁটের কোণে আগের সেই লাজুক হাসিটা ফুটে উঠলো। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই আয়ানও চট করে রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। মায়রার দিকে তাকিয়েই একেবারে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। মায়রা আয়ানের হাত ছোট্ট করে একটা কিল বসালো।
-এই? তুমি এতোক্ষণ কোথায় ছিলে?
আয়ান ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে মায়রার কোমড় পেঁচিয়ে নিজের একটু কাছে টেনে নিলো।
-কেন গো? মিস করছিলে বুঝি?
-বয়েই গেছে আমার মিস করতে।
-তাই? তাহলে আবার চলে যাই? আর কিন্তু আসবো না তাহলে বলে দিলাম---।
-একবার যাওয়ার চেষ্টা করেই দেখো না। একদম----।
-হুম? একদম?
-একদম পা কেটে হাতে ধরিয়ে দিবো। বলো কোথায় ছিলা?
-একটা জিনিস আনার কথা খেয়াল ছিল না। সেটাই আনতে গেছিলাম।
-ওহ। ছাড়ো? সবার আসার সময় হয়ে গেছে৷ আমি মায়ের কাছে যাই।
-উঁহু। আরেকটু পরে যাবা। এখন কাজ আছে---।
-আমার কোন কাজ নেই আর এখানে। হুহ। তুমি থাকো তোমার কি ইম্পর্ট্যান্ট জিনিস নিয়ে। আমি মায়ের কাছে গেলাম--।
-ওরে পাগলিটা? রাগ করছো কেন? আগে দেখো কি জিনিসের জন্য বের হয়েছি---।
-না না না। আমার এতো শত দেখার দরকার নেই--।
-সাধেই কি তাকে আমি বাচ্চা বলি? এখনো ছেলেমানুষের মতো অভিমান করছে। না দেখেই এতো অভিমান?
-ছাড়ো?
-আগে তো তোমার জিনিসগুলো তোমায় পড়িয়ে সাজিয়ে দিই।
-কি!
-শশশ। একদম চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। নড়বা না কিন্তু।
-হুম----।
আয়ান মায়রার সামনে বসে মায়রার কোমড়ে একটা বিছাহার পড়িয়ে দিলো। সোনালী ফুলের নকশা করা ইমিটিশনের বিছা হারটা মায়রার শাড়ির সাথে একদম মানিয়ে গেছে দেখে আয়ান হেসে একবার মুখ তুলে মায়রার মুখের দিকে তাকালো। তারপর আলতো করে মায়রার পেটের কাছের আঁচল সরিয়ে আবেশমাখা একটা চুমো খেল। মায়রা কেঁপে উঠে আয়ানের কাঁধ চেপে ধরতেই আয়ান মায়রার শাড়ির কুঁচিগুলো একটু টেনে গুছিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মায়রা আয়ানের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করতেই আয়ান মাথা নেড়ে ধীর পায়ে মায়রার পিছনে এসে দাঁড়ালো। হাঁটতে হাঁটতেই আয়ান পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করেছিল। প্যাকেটটা থেকে ছোট কয়েকটা বকুল ফুলের মালার গাজরা বের করে মায়রার খোঁপায় জড়িয়ে দিয়ে মায়রার ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আয়ান। মায়রা আয়ানের দিকে ঘুরে তাকাতেই আয়ান হেসে মায়রার কপালে চুমো খেল আলতো করে।
-অভিমান অভিযোগ সব আশা করি মিটেছে ম্যাডামের? নাকি কিছু বাকি আছে?
-তুমি বাইরে যাচ্ছো বলে যাবা না?
-ইশ রে! সরি পরী। ভুল হয়ে গেছে। তোমার চুলে বকুলের মালা জড়াবো কথাটা ভেবেই আর কিছুর হুঁশ ছিল না। সরি কেমন?
-হুম।
-আরেকটা জিনিস আছে৷ তবে সেটা এখন না রাতের জন্য।
-কি?
-বললাম না রাতে? এখন চলো? সবাই এসে পড়েছে এতোক্ষণে---।
-হুম----।
-এই যে ম্যাডাম? আপনি কি জানেন আপনাকে কতোটা সুন্দর লাগছে? আমার ইচ্ছেই করছে না সবার সামনে আমার বউটাকে নিয়ে যেতে। সবাই তোমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে সেটা আমার একদমই পছন্দ হবে না। ধ্যাত। কে যে এই বৌভাতের ফাংশন বের করেছে। ধুর----।
-বেশি কথা না বলে চলো তো? খালি কিসব অদ্ভুত কথা সবসময়?
-হুম! অদ্ভুত না? কেউ তোমার দিকে একবারও নজর দিলে তোমার খবর আছে দেখবা তো।
-কারো যেন খেয়ে দেয়ে কাজ নেই আরেকজনের বিয়ে করা বৌকে দেখব! চলো না?
-হুম হুম। আসো? তাকাক না তারপর বুঝাবো না তোমাকে? এমন করে সেজেছ কেন।
-তাহলে চেইঞ্জ করে নিই?
-আরে! এতো সময় নেই এখন আর। চলো চলো?
আয়ান মায়রার হাত ধরে টেনে দরজার দিকে পা বাড়াতেই নজর পড়লো মায়রার মেহেদি রাঙা হাতের দিকে। সাথে সাথেই আয়ান দাঁড়িয়ে গিয়ে জীভ কাটলো।
-ওহ শিট! এটা কিছু হলো বলো তো?
-কি হয়েছে?
-কথা ছিল না কাল তোমার মেহেদীতে নিজের নাম খুঁজবো? ধ্যাত? আমার মনেই ছিল না একদম। আর তুমিও কি? একটু মনে করিয়েও দাও নি। ধ্যাত। দেখি আমি এখন খুঁজবো।
-এই না না না। একদম না----।
মায়রা তাড়াতাড়ি নিজের হাত টেনে পিছনে লুকিয়ে নিলো।
-কি হলো মায়রা? দেখবো তো?
-উহুঁ। একদম না। বাসর শেষ। আর দেখা যাবে না মেহেদী। তুমি হেরে গেছো।
আয়ান মায়রার কোমড় পেঁচিয়ে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে চোখে চোখ রাখলো।
-তুমি চাইলে এখন থেকে প্রতিটা রাত হবে আমাদের বাসর। আর প্রতিটা দিন হবে আমাদের----।
-ইশ! কিছু আটকায় না নাকি তোমার মুখে?
-আটকাতে যাবে কেন? আর তোমার মেহেদী রহস্য আজ রাতে উদঘাটন করা হবে। ওয়েট এন্ড ওয়াচ। আমিই জিতবো।
-হুহ। দেখবো কেমন জিতো তুমি।
-এখন চলুন ম্যাডাম।
আয়ান আবার মায়রার হাত ধরে বেরিয়ে এলো নিজেদের রুম থেকে। বাইরে আয়ানদের গার্ডেনে বৌভাতের প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। প্যান্ডেলের একটা অংশে বড় করে আয়ান আর মায়রার জন্য স্টেজ আর ঠিক তার সামনেই মেহমানদের জন্য সারি করে চেয়ার টেবিল সাজানো হয়েছে। পুরো প্যান্ডেলটাই নানা রকম ফুল আর বাহারি পর্দা দিয়ে সাজানো হয়েছে। মায়রা অবাক হয়ে পুরো প্যান্ডেলের সাজটা দেখলো। আয়ান মায়রাকে নিয়ে মা আর আরিশার কাছে এসে দাঁড়ালো।
-মায়রা? আজকের ফাংশনের কোন কিছুতে খুঁত পেলেই আরুকে ধরবা। আমাদের ওয়েডিং প্ল্যানার ও। কিছু তেড়িবেড়ি করলে কপাকপ টাকা কেটে নিবো।
-বেয়াদ্দপ ছেলে! এতো কিপটা কেন তুই? নিজের বিয়ের সবগুলো ফাংশনের হাবিজাবি আমাকে দিয়ে ডিজাইন করাচ্ছিস! কামলাও খাটাইতেসিস আমাকেই! তবুও বলিস পেমেন্ট কম দিবি? হারামি তুই আমারে ডাবল পেমেন্ট না করলে যাওয়ার সময় তোর বউরে আমি নিয়ে যাবো। দাঁড়া না তুই?
-আরে না রে আরু প্লিজ? আমার একটা মাত্র বউ! প্লিজ? আরু? আমার এমন সর্বনাশ করিস না? প্লিজ?
-আয়ান? নাটকবাজ? বাপরে বাপ! এই আন্টি? তোমার ছেলেরে কি খাওয়াইসো গো তুমি ছোটবেলায়? উফ!
আরিশার কথায় সবাই হেসে ফেললো। মায়রা আরিশার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। এতোকিছু আরিশা করেছে ভাবতেই অবাক লাগছে ওর। তার উপরে একটা ছোট বাচ্চা নিয়ে এতো ধকল সহ্য করে কাজ করা আধো কি সম্ভব?
-আপু? আপুর ভিষণ পছন্দ হইসে। স্টেজ, ফুল অনেক সুন্দর হয়েছে।
-থ্যাংক ইউ মায়রা। তোমার পছন্দ হলেই আমার আজকের কাজটা সার্থক।
-আমম--। আপু? আরশি কোথায়? ওকে তো দেখছি না?
-আরশি কাঁদছিলো তো। তাই তাওহীদ ওকে একটু বাইরের দিকে নিয়ে গেছে। ওই যে আসছে?
মায়রা অবাক চোখে একবার আরিশার দিকে তাকিয়ে ওর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটা দেখলো। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে তাওহীদের আরশিকে কোলে নিয়ে হাসি মুখে এগিয়ে আসা দেখলো। এই মানুষটার ঠোঁটেও একটা তৃপ্তির হাসি লেগে আছে৷ আসছে অবধি এই দুটো মানুষের খুনসুটি যেমন দেখেছে মায়রা, তেমনি দেখেছে দুজনের আন্ডারস্ট্যান্ডিংটাও। একে অন্যকে পেয়ে যেন এই দুটো মানুষ সত্যিকার অর্থে পূর্ণতা পেয়েছে। আরিশা আর তাওহীদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মায়রা চোখ ঘুরিয়ে আয়ানকে একবার দেখলো। লোকটা মায়রার মামা, মামি, তাথৈ, রিহান, বাঁধন সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলতে বলতে মায়রার দিকো এগিয়ে আসছে। মায়রার পৃথিবীটা একটদ মূহুর্তের জন্য যেন থেমে গেল। শুধু আয়ানই যেন ধীর পায়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। আর সারা পৃথিবীতে যেন আর একটা মানুষও নেই। আয়ানের দিকে অপলকে তাকিয়ে একটা কথাই মাথায় ঘুরছে মায়রার। এই মানুষটাকে পেয়ে মায়রার জীবনটাও সত্যিকার অর্থেই পূর্ণতা পেয়েছে। আয়ানের মতো একটা মানুষকেই বলা যায় সত্যিকারের জীবন সঙ্গী।