০১!!
অনেকগুলো শুকনো বকুল ফুলের মালা বুকে জাপটে ধরে চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছে মায়রা। একটু পরেই এভাবে নিরালায় চোখের জল ফেলার অধিকারটাও হারিয়ে যাবে চিরদিনের মতো। ঠিক যেভাবে কদিন আগে এই বকুলের মালাগুলো খোঁপায় জড়িয়ে দেয়া মানুষটার উপর থেকে সমস্ত অধিকার হারিয়ে গেছে, সেভাবেই। একটু পরেই মায়রাকে সাজাতে পার্লার থেকে মেয়েরা আসবে। আর সাজটা হয়ে গেলেই বিয়েটাও হয়ে যাবে। আজ আরও একবার হাজারটা মেয়ের মতোই ভালোবাসার মানুষটার কাছে স্বার্থপর, লোভী, ধোঁকাবাজ এসব উপাধি পাবে মায়রাও। আজ আরও একবার পরিবারের সম্মানের কাছে পরাজিত হবে ভালোবাসা।
মায়রা ফ্লোরে বসে হাঁটুতে মাথা রেখে কাঁদছে। কান্নার শব্দ যাতে বাইরে না যায় তাই নিজের হাতটা কামড়ে ধরেছে মেয়েটা। চোখের সামনে আয়ানের চলে যাওয়ার দৃশ্যটা ভেসে উঠছে বারবার। এখন একবার খুব আয়ানের কণ্ঠটা শুনতে ইচ্ছে করছে মায়রার। কিন্তু সেটা তো কিছুতেই আর সম্ভব না। ছেলেটা কি করছে কে জানে। হয়তো আয়ানের মন থেকে চিরতরে মুছে গেছে মায়রার নামটা৷ হয়তোবা মুছে যায় নি। যতবার মায়রার নামটা মনে পড়বে ততবার হয়তো আয়ানের সুন্দর মুখটা ঘৃণায় বিকৃত হয়ে যাবে। তার আয়ান তাকে আজ ঘৃণা করে। প্রচন্ড ঘৃণা। কথাটা ভাবতেই এবার হাউমাউ করেই কেঁদে ফেললো মায়রা৷ রুমের বাইরে কান্নার শব্দ পৌঁছাচ্ছে কিনা সেটা ভাবার মতো মনের অবস্থা আর রইলো না মেয়েটার।
দরজায় নকের শব্দে চমকে ফ্লোর ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মায়রা। দরজার বাইরে থেকে মায়রার মা সাহেলা আহমাদ খানের গলা শোনা যাচ্ছে।
-মায়রা? কি হলো? শব্দ হলো কিসের? এই মায়রা?
-আসছি মা---।
-দরজা খুলছিস না কেন? কি করছিস দরজা বন্ধ করে? খোল দরজা??
মায়রা তাড়াতাড়ি করে উঠে আয়ানের দেয়া সেই বকুল ফুলের মালাগুলো একটা বক্সে রেখে বক্সটা আলমারি রেখে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সাহেলা রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে মায়রার দিকে তাকালো।
-মায়রা? আবার কাঁদছিলি তুই? এভাবে কেঁদেকেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে রাখলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে তোর মনে হয়? সীমান্ত এসে তোকে এভাবে দেখলে কি ভাববে বল তো?
-মা---। প্লিজ একবার বাবার সাথে কথা বলো না প্লিজ? আমি পারবো না আয়ানকে ভুলে অন্য কাউকে---।
-তুই কি চাস বল তো মায়রা? তুই কি চাস এবার তোর বাবা আর আমি গলায় দড়ি দিই?
-মা!!
-মা বলবি না তুই আমাকে। তোর বড় বোন তাথৈয়ের জন্য তো সমাজের সবার কাছে মাথা আগেই হেঁট হয়ে গেছে। এবার তোর জন্য তো দেখছি সমাজে মুখ দেখাতেও পারবো না। সীমান্ত ছেলেটা ভালো বলেই এতো কিছুর পরও আমাদের পরিবারের আরেক মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে--। অন্য কেউ হলে----। আর তুইও এখন---। তোদের দু বোনকে জন্ম দেয়াটাই কি আমার অপরাধ ছিল?
-মা--। একবার তো আমার কথাটা শোনো---? আয়ান----।
-খবরদার মায়রা। আগেই বলেছি ওই ছেলেটার নাম যেন আর তোর মুখে না শুনি। কয়েক ঘন্টা পর সীমান্তের সাথে তোর বিয়ে হবে। আর তুই কিনা!? আর এই শোন? এতোই যদি ওকে ভুলতে না পারবি তাহলে তুইও তাথৈয়ের মতো চলে যা না? জানবো আমার দুই মেয়েই মরে গেছে---। মা হিসেবে আমি ব্যর্থ---। সব আমার এই পেটের দোষ, যে পাপ পেটে ধরেছি তোদের--।
-মা!! এভাবে বলো না। প্লিজ।
-আর হ্যাঁ--। যাওয়ার আগে এটাও জেনে নিস---। তাথৈয়ের করা অপমানের পর তোর বাবা মা তবু বেঁচে আছে, কিন্তু তুইও একই কাজ করলে বিষ খেয়ে মরা ছাড়া তোর বাপ মায়ের আর পথ থাকবে না। অমানুষ, কুলটা মেয়েদের বাপ মায়ের পরিচয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। আর ভাবিস না। আমাদের লাশটা দেখারও দরকার হবে না তোর---। সে ব্যবস্থাও করে যাবো----।
-মা---। প্লিজ থামো?? আমি আর নিতে পারছি না এসব---।
-তুইই ঠিক কর এখন কি করবি। বিয়ে করবি নাকি বাপ মায়ের লাশের উপর দিয়ে গিয়ে প্রেমিকের সাথে সংসার করবি।
-আমি যাবো না মা। কোথাও যাবো না। প্লিজ মা। এসব বলো না প্লিজ??
-যা তাহলে--। পার্লার থেকে মেয়েরা এসেছে তোকে সাজাতে। এখনো সেই কাল রাতের গায়ে হলুদের শাড়িটাই পড়ে আছিস? কেমন উসকোখুসকো লাগছে দেখতে--। যা শাওয়ার নিয়ে আয়--।
-হুম মা। যাচ্ছি---।
সাহেলা চলে যেতেই মায়রা আবার দরজা বন্ধ করে একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। মাথার উপরের শাওয়ারটা ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরেই বসে পড়লো মায়রা। শাওয়ারের পানির সাথে মায়রার চোখের জলেরাও সমান গতিতে ঝরছে। চোখের সামনে আয়ানের হাসি মাখা মুখটা ভাসছে মায়রার। কাঠফাটা রোদের মধ্যেও মানুষটা ছুটে আসতো শুধু মায়রাকে এক নজর চোখের দেখাটা দেখার জন্য। এভাবে দু মিনিটের জন্য দেখে কি মজা পেত লোকটা মায়রা কখনো বুঝতেই পারে নি। আজ মায়রাও খুব ইচ্ছে করছে এক নজর আয়ানকে দেখতে। শেষ বারের মতো জাস্ট এক নজর দেখে চোখের আশ মিটাতে পারতো যদি! এই মানুষটার থেকে কি করে দূরে গিয়ে থাকবে মায়রা?
দু আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে রেখেই সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে আয়ান। মায়রা সাগর ভিষণ ভালোবাসতো। তাই সময়ে অসময়ে মায়রা বায়না ধরলেই আয়ান ওকে সীবিচে নিয়ে আসতো। কখনো সকালে, কখনো ভর দুপুরে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে, বা কখনো বিকেলে। তাই আজ মায়রার কথা খুব বেশি মনে পড়তেই আয়ান সাগরের পাড়ে এসে বসে আছে। মায়রার কথা মনে পড়তেই যতটা না ঘৃণা হচ্ছে আয়ানের তার চেয়েও বেশি রাগ লাগছে। গত চারটা বছর ধরে এই ধোঁকাবাজটাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে আয়ান। যখন তখন না দিন না রাত একটা নজর মেয়েটাকে দেখার জন্য পাগলের মতো ছুটে গেছে আয়ান৷ কি করে পারলো মেয়েটা এতো দিনের একটা সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়ে চলে যেতে?
আয়ানের চোখের সামনে সপ্তাহ খানেক আগের ঘটনাটা ভাসছে। ঠিক এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিল মায়রা৷ মায়রার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। তাই মামার বাসায় না থেকে বাড়ি ফিরবে এবার। মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হলে আবার চট্টগ্রামে ব্যাক করবে। এবার বেশ অনেক দিনের জন্য বাড়ি যাবে মায়রা। তাই সন্ধ্যাবেলা দেখা করতে বলায় সমস্ত কাজ ফেলে আয়ান মায়রাকে বিচে নিয়ে এসেছিল। মায়রা দুহাত পাখির মতো করে দুদিকে মেলে সাগরের দিকে মুখ করে চোখ বুজে অনুভব করছিল সাগরের বাতাসের শীতল স্পর্শটা। আর আয়ান মায়রার পাশে দাঁড়িয়ে অবাক মুগ্ধ চোখে দেখছিল ওর প্রশান্তি ছেয়ে থাকা মুখটা। আশেপাশে তেমন লোকজন নেই। আর যারা আছে তারাও নিজেদের মতো ব্যস্ত। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই আয়ান পিছন থেকে মায়রাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর আলতো করে মায়রার ঘাড়ে ছোট্ট করে একটা চুমো খেয়েছিল আয়ান। কতদিন এভাবে জাপটে ধরা হবে না পাগলিটাকে! মায়রাও কেঁপে উঠেছিল আয়ানের এমন ছোঁয়ায়।
-এই? কি করছ? সবাই দেখছে তো?
-কেউ দেখছে না গো। আচ্ছা মায়রা? বলো তো তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? তোমার এই সাগরকে? নাকি আমাকে?
-সাগর তো আমার মুগ্ধতা। আর তুমি তো আমার রক্তের প্রতিটা বিন্দুতে মিশে থাকা নেশা। এবার তুমিই বুঝে নাও কাকে বেশি ভালোবাসি---।
-উহু এভাবে বললে তো হবে না। আর ম্যাডাম বিয়ের পরে কিন্তু এভাবে হুটহাট বায়না ধরলেও সাগরে নিয়ে যেতে পারবো না বলে দিলাম। আর তোমাকে অন্য কারো সাথেও ছাড়বো না। তখন কি করবে?
-তোমার বুকের বিশালতায় আমি নাহয় আমার সাগর খুঁজে নিব---।
-থাকতে পারবে তো? তখন কিন্তু জেদ করলেও শুনবো না--। তখন যেন রেগে গিয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার হুমকি দিও না---।
-ধ্যাত। তোমার জন্য সব ছাড়তে পারি--। সাগর আর এমন কি----? আর তোমাকে রেখে তো এক মিনিটের জন্যও কোথাও যাবো না তখন৷ বাপের বাড়িতেও না--। বুঝলেন জনাব?
-তখন বলতে কখন বউসোনা? হুম?
-যাও। জানি না----।
মায়রা লজ্জায় লাল হয়ে আয়ানের দিকে ঘুরেই আয়ানকে জড়িয়ে ধরেছিল। আর আয়ানও তার পাগলিটাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল। সন্ধ্যার আবছা আলোয় দুজনকে দেখে যে কেউ বলে দিতে পারতো কতোটা সুখী ছিল ওরা একসাথে। কতোটা ভালোবাসতো একে অন্যকে। কথাটা মনে পড়তেই আঙুলের ফাঁকে জ্বলতে থাকা সিগারেটটা হাতের মুঠোয় পিষে ফেললো আয়ান। সিগারেটের ভাঙা কুঁচোগুলোকে আক্রোশে হাত থেকে ঝেড়ে ফেলে চোয়াল শক্ত করলো আয়ান। মায়রার লাজুক মুখটার সাথে সাথে ওর দেয়া ধোঁকার কথাও মনে পড়ে গেছে আয়ানের। একই সাথে হারানোর ব্যথা জেগেছে বুকে, আবার ধোঁকা দেয়ার ঘৃণা।
-কি করে এতো নাটক করতে পারলি মায়রা? পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম তো তোকে--। তার এই প্রতিদান দিলি? তোরা মেয়ে জাতটাই খারাপ। এটা ওটা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে ভালোবাসা দেখাবি। পরে ঠিকই বড়লোক কাউকে পেলে তাকে ধরে তার গলায় ঝুলবি। এতো লোভ! এতো শান্ত, সুন্দর মুখটার পিছনে এতো বিশ্রি একটা ধোঁকাবাজের চেহারা লুকিয়ে রেখেছিলি এতোদিন!! এতো লোভ ছিল আরেকজনের সম্পদের দিকে? কি করে?? একবারও মনে পড়ে না আমার সাথে কাটানো সময়গুলো? একবারও সেই স্মৃতিগুলো পোড়াবে না তোকে? তোর ঠোঁটের কোণের সেই লাজুক হাসিটাও তো আমি ভুলতে পারি না। আর তুই কিনা-----। খুশিই আছিস তাই না? থাকিস---খুশি---।
আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে আয়ান পকেটে হাত দিয়ে একটা তাজা বকুল ফুলের মালা বের করলো। একটা দীর্ঘশ্বাস পেলে আবার সেটা যত্ন করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো।
-তুই আমার কতোটা অভ্যেস হয়ে গেছিস জানিস? এখানে এলে এখনো প্রতিদিন ভুল করে তোর জন্য বকুলের মালা কিনি। জানিস সেটা? হয়তো আজীবন কিনবো। কিন্তু দেয়া হবে না কাউকে কখনো। কারণ তোর জায়গাটা অন্য কাউকে কখনো নিতে দিবো না আমি। কখনো না----। যতই ছলনা করে চলে যাস না কেন তুই, তবু বুকের বা পাশটা শুধু তোর জন্যই বরাদ্দ। সেখানে আর কারো জায়গা হবে না কখনোই---।
চারদিকে বেশ ঘন হয়ে অন্ধকার নামলে আয়ান এসে গাড়িতে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার আগেই রিং হচ্ছে দেখে মোবাইলটা বের করলো। স্ক্রিনে ওর কাজিন সায়নার নাম দেখে কিছুটা বিরক্ত হয়েই কলটা রিসিভ করলো আয়ান।
-হ্যাঁ সায়না বল?
-আয়ান? একটা হেল্প লাগতো।
-বল।
-ওই যে রিয়ান ছেলেটা আছে না? ও খুব জ্বালাচ্ছে। একটু দেখ না?
-রিয়ান?? ও না তোর বয়ফ্রেন্ড? জ্বালচ্ছে কেন? কি করেছিস আবার?
-আরে ধুর। কিসের বালের বয়ফ্রেন্ড? ব্রেকআপ হইসে পরশু। এখন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতেসে কল দিয়ে--। ডিজগাস্টিং---।
-তোরা মাইয়া জাতটাই অমানুষের জাত। ছেলেগুলারে মানুষ মনে হয় না তোদের? কারো ইমোশন নিয়ে খেলতে লজ্জা লাগে না? অবশ্য তোদের লজ্জা, শরম এগুলো তো কিছুই নাই। হারামির দলগুলা! যদি ভালোই না বাসবি তাহলে আরেকজনের জীবন নষ্ট করিস কেন? হ্যাঁ? কারো জীবন নিয়ে খেলে এখন ডিজগাস্টিং মারাস তুই?
-আরে! তুই এতো হাইপার হচ্ছিস কেন আয়ান? তোকে আবার কে ছ্যাঁকা দিলো??
-ওই তুই ফোন রাখ। চিটার, হারামি। জীবনে কোনদিন যদি কল করিস খুন করে ফেলবো তোকে আমি। অমানুষ এক একটা তোরা। রাখ ফোন---। তোর চেয়ে রাস্তার প্রস্টিটিউটাও হাজার গুণে ভালো। টাকা নিয়ে সুখ দেয়। তোর মতো ফেইক না ওরা----।
-আয়ান?? মুখ সামলে কথা বল--।
-রাখ তুই---। নিজের ক্যারেক্টার সামলা। পরে আমারে মুখ সামলাইতে বলিস। আর জীবনেও কল দিবি না আমারে। আর ভুলেও যেন তোরে আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখি---। শালী টাউট---। রাখ ফোন----।
আয়ান রাগের চোটে কলটা কেটেই মোবাইলটাকে একটা আছাড় দিয়ে সিটে ফেলে ফুলস্পিডে গাড়ি চালালো। রাগে, ঘৃণায় মাথাটা ফেটে যাচ্ছে ওর। মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে মরে গেলেও আর কোন আফসোস থাকবে না ওর। তিলে তিলে মরার চেয়ে একবারে মরে গেলেই এই অন্ধকারে ভরা জীবনটা থেকে মুক্তি পেত। এভাবে আর কয়দিন বাঁচতে পারবে ওই ধোঁকাবাজটার স্মৃতি আগলে? চারদিকে হাজার হাজার ধোঁকাবাজের কালো ছায়ার মাঝে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো মনে হচ্ছে আয়ানের।
০২!!
ডং ডং করে ১২ বার ঘন্টা বাজিয়ে সময়ের জানান দিচ্ছে দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটা। রাত বাড়ার সাথে সাথে যেন ঘড়িটার শক্তিও বেড়েছে। গত দুই ঘন্টা চেয়ে এখনকার ঘড়ির শব্দটা যেন একটু বেশিই জোরালো আর তীক্ষ্ম মনে হচ্ছে মায়রার। হয়তো সারদিনের বিয়ের এতো আচার অনুষ্ঠান আর এতো লম্বা জার্নির কারণে টায়ার্ডনেস থেকে এমনটা হচ্ছে। শরীরটা যেন ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসতে চাইছে মায়রার। ইচ্ছে করছে এই অপরিচিত বাড়ির, অপরিচিত রুমটার এক কোণে গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে যেতে৷ টানা কয়েকদিনের কান্নাকাটি, দুশ্চিন্তা,গ্লানি হৃদয়ের গভীর ক্ষতটার উপরে আরো শক্তপোক্ত করে জেঁকে বসে দুর্বল করে দিচ্ছে ওকে প্রতিনিয়ত। তবু জেগে থাকতে হচ্ছে মায়রাকে। কারণ শরীর, মন, আত্মা সব ক্লান্তিতে অচেতন হয়ে গেলেও ঘুম আসবে না মায়রার। ওর জীবনের শান্তির ঘুমের ওষুধটা, প্রশান্তির ঘুমটা আয়ানের সাথে সাথে দূর হয়ে গেছে। মানুষ যেমন বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে খায়, ঘুমায়, কাজ করে-মায়রার অবস্থাও এখন ঠিক তেমন। একটা জীবন্ত লাশ।
সীমান্ত নামের লোকটার জন্য ভয়ে দুরুদুরু বুকে বসে আছে মায়রা। আজকের এই ফুলে সাজানো বাসরে লোকটার আসার অপেক্ষা করছে না মায়রা। শুধু মনে মনে দোয়া করছে কোন অলৌকিক কারণে আজকে যেন লোকটা না আসে এখানে। অদৃশ্য কোন জাদুবলে যেন লোকটা অন্য কোথাও ব্যস্ত হয়ে যায়, বা কোন জরুরি কাজ এসে পড়ুক লোকটার৷ একদমই সীমান্তের সামনে পড়তে মন চাইছে না মায়রার। লোকটা কেমন কে জানে! তাথৈকে দেখতে আসার দিন সীমান্তকে দেখেছিল মায়রা। আর একদিন দেখেছিল তাথৈ বিয়ের দিন বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর। কেমন একটা ইমোশনলেস ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো লোকটা। আর সেই নিউট্রাল আবেগশূন্য দেখতে লোকটাকে বিয়ে করতে হয়েছে মায়রাকে। আয়ানের বদলে সীমান্ত। ভাবতেই কান্না পাচ্ছে মায়রার। তবে চোখে এক ফোঁটা পানিও আসছে না। এ কয়দিন এতো কেঁদেছে যে মনে হয় চোখের সাগরটায়ও ক্ষরা পড়েছে।
আরো আধঘন্টা মতো পরে মায়রার সমস্ত প্রার্থনাকে মিথ্যে করে দিয়ে আর অলৌকিক কিছু না ঘটায় ঠুং করে দরজায় একটা শব্দ তুলে রুমে এসে ঢুকলো সীমান্ত। সীমান্ত একবার বিছানার দিকে তাকিয়ে মায়রাকে দেখে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। দরজা বন্ধের হালকা শব্দটায়ও মায়রা কেঁপে উঠলো। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা মায়রার৷ সীমান্ত মায়রার পাশে বিছানায় গিয়ে বসে মায়রার ঘোমটা তুলে দিয়ে মুখের দিকে তাকালো। মায়রা চোখ বুজে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে শক্ত হয়ে বসে আছে। সারা শরীরটা যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে। লোকটাকে কি করে আটকাবে সেটাই চোখ বুজে ভাবছে মেয়েটা।
মায়রা চোখ বন্ধ করে মুখ নিচু করে বসে আছে দেখে সীমান্ত আলতো করে মায়রার চিবুক ধরে মুখটা তুলে ধরে মায়রার মুখের দিকে তাকালো। বেশ অনেকক্ষণ পর সীমান্ত মায়রার গালে নিজের আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিয়ে একটু শব্দ করেই হাসলো। সীমান্তের স্পর্শে মায়রা কেঁপে উঠলেও চোখ খোলে নি। কিন্তু সীমান্তের হাসির শব্দ শুনে একটু কৌতূহল হলেও চুপ করে বসে রইলো মায়রা। সীমান্ত হেসে মায়রার মুখের সামনে দু আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজালো।
-হ্যালো ম্যাডাম? আপনি কি ঘোড়া বংশীয় মানবিনী নাকি? বসে বসেই ঘুমিয়ে গেছেন? নাকি আমি দেখতে এতোটাই খারাপ যে আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না?
-জি?
মায়রা বেশ অবাক হয়েই চোখ খুলে তাকালো সীমান্তের দিকে। আয়ানের জায়গায় এই মানুষটার স্পর্শ যতই খারাপ লাগুক এই স্পর্শটা এক সময় অভ্যেস করে নিতে হবে মায়রার। কারণ জীবনের বাকি দিনগুলো এই অচেনা অজানা মানুষটার সাথেই কাটাতে হবে মায়রার। লোকটার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না মায়রা। জানার আগ্রহও নেই কোন। হয়তো পাশে থাকতে থাকতে জেনে যাবে কোন একদিন। অথবা স্বামী নামের এই লোকটা মায়রার কাছে আজীবন অজানাই থেকে যাবে।
মায়রার চুপ করে বসে থাকা দেখে সীমান্ত মায়রার দুপাশে বেরিয়ে থাকা চুল আঙুলে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খেলা করছে। এতো আলগোছে চুল টানছে যে মায়রার চোখে ঘুম এসে যাচ্ছে। লোকটা কি করতে চাইছে কিছুই বুঝতে পারছে না মায়রা৷ কিন্তু মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে লোকটা ঘুমিয়ে গেলে মায়রার সবচেয়ে বেশি শান্তি লাগবে। ইভেন সারাদিনের এতো জার্নি, টায়ার্ডনেসের পর নিজের চেয়ে এই মানুষটা ঘুমিয়ে গেলেই বেশি স্বস্তি লাগবে মায়রার। মায়রা এসব ভাবতে ভাবতেই সীমান্ত আবার মায়রার চোখের সামনে তুড়ি বাজালো।
-হ্যালো মিসেস? ঘুমিয়ে গেলেন আবার? এবার চোখ খোলা রেখেই!! বাহ বাহ! কপাল করে একটা বউ পেয়েছি বলতে হয়! যে কিনা বসে চোখ খুলেও ঘুমাতে পারে--। দারুণ তো ব্যাপারটা!
-আমি--- জেগে আছি----।
-বিয়ের পর স্বামী রুমে আসলে প্রথমে তাকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে হয়। জানেন না নাকি ম্যাডাম ব্যাপারটা? কেউ বলে নি কখনো??
-নাহ মানে!! সরি----।
মায়রা খাট থেকে নেমে সীমান্তের পা ছুঁয়ে সালাম করার চেষ্টা করতেই সীমান্ত হাত টেনে ধরে আটকালো মায়রাকে।
-আরে!! কি করছো পাগলী? সালাম করা লাগবে না---। চুপচাপ বসো আমার পাশে। আমি একটু আমার নতুন বউয়ের মিষ্টি মুখটা দেখি--।
সীমান্তের কথাটা শুনে থমকে জায়গায়ই দাঁড়িয়ে রইলো মায়রা। এই কথাটা আয়ান ওকে সবসময় বলতো। পাশে বসে অপলকে মায়রাকে দেখতো আয়ান৷ কখনো দুষ্টুমি করে মায়রার চুলের বাঁধন খুলে দিত। বাতাসে মায়রার বাঁধনহারা চুলগুলো যখন উড়ে এসে দুজনেরই চোখে মুখে খেলা করতো তখন আয়ান আবার নিজেই ঠিক করে দিতো বা কখনো কানের পিছনে গুঁজে দিতো। কানের পিছনে চুলগুলো গুঁজে দিতে গিয়ে সবসময়ই মায়রার গালে, ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে দিতো আয়ান। মায়রা কেঁপে উঠে চোখ বুজে নিতো প্রতিবার। আর আয়ানও মায়রার লাজুক মুখটা দেখতো মন ভরে। কখনো কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে ফিসফিস করে মায়রাকে বলতো, "আমার বউসোনার লাজুক মুখটা দেখতে কি যে মিষ্টি লাগে! এতো মিষ্টি কেন গো তুমি বউ?" আয়ানের এমন কথায় মায়রা লজ্জায় আরো লাল হয়ে যেত।
হঠাৎ হাতে টান খেয়ে মায়রা হুড়মুড় করে বিছানায় বসা সীমান্তের গায়ের উপরে এসে পড়লো। আয়ানের কথা মনে পড়তেই মায়রার খেয়ালই ছিল না যে সামনে এই লোকটা ওকে দেখছে এতোক্ষণ ধরে। মায়রাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গভীরভাবে চেয়ে আছে সীমান্ত। সেটা দেখে একবার শিউরে উঠলো মায়রা। এতোটা শক্ত করে ধরে রেখেছে লোকটা যে মায়রা নিজের চেষ্টায় কিছুতেই তাকে সরাতে পারবে না বা তার বাঁধন থেকে নিজেও ছুটতে পারবে না। সীমান্তের চোখে চোখ পড়তেই মায়রা আরেকবার শিউরে উঠে চোখ বুজে নিলো। সীমান্তের এই ঘোর লাগানো দৃষ্টির দিকে তাকাতেও ভয় হচ্ছে মায়রার। লোকটার চোখদুটো এতো গভীরভাবে কেন তাকিয়ে আছে মায়রার মুখের দিকে। যেন দৃষ্টি দিয়ে একেবারে মায়রার অন্তর আত্মা কাঁপিয়ে দিতে চায় লোকটা।
-মায়রা? এই যে বউ, আবার ঘুমিয়ে গেলে নাকি?
-উহু---।
-ব্যথা পেয়েছ নাকি মায়রা? কোথায় ব্যথা পেয়েছ দেখি? আর এই চোখ খোলো না?
-না না---। ব্যথা-ব্যথা পাই নি-আমি-।
-তাহলে চোখ খুলছো না কেন? আমি কি দেখতে এতোই খারাপ নাকি ম্যাডাম? একবার ভালোভাবে তাকানো যায় না আমার দিকে?
-না মানে ---আসলে----?
-এতো আমতা আমতা করো কেন সবসময়? হুম? আমি কি বাঘ নাকি ভালুক যে তোমাকে খেয়ে ফেলবো??
-----------------------
-আনইজি লাগছে? ধীরে ধীরে অভ্যেস করে নাও---। এভাবে ধুমধাম আক্রমণ হবে--। আজ টায়ার্ড তাই চোখ বন্ধ করে বেঁচে গেছো--। কিন্তু সবসময় তো এভাবে বাঁচবে না ম্যাডাম---। আমি তো এতো সহজে ছাড়বো না আমার বউকে----।
-জি!!??
-বিয়ের সাজে দারুণ লাগছে তোমাকে। ভাবতেই পারি নি সাজলে তোমার এতো সাঙ্ঘাতিক রকমের সুন্দর লাগবে দেখতে--। মাঝে মাঝে এভাবে সাজগোজ করবা বুঝসো? এখন এই ভারী মেকাপটা তুলে আসো তো যাও---। আসল বউটাকে দেখি--। দেখি বিয়ে করে ঠকলাম নাকি জিতলাম---।
-জি!!
-তুমি শাওয়ার নিয়ে আসো--। অনেক ঝক্কি গেল তো আজকে তোমার। শাওয়ার নিলে ফ্রেশ লাগবে। আমি তোমার ড্রেস বের করে দিচ্ছি---।
-হুম---।
সীমান্ত ওয়াশরুম দেখিয়ে একটা টাওয়াল ধরিয়ে দিতেই মায়রাও তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকে পড়লো। মায়রা একটা বড় করে দম নিয়ে ওয়াশরুমের আয়নার দিকে তাকালো। আয়ানের এতো ভারি মেকাপ পছন্দ না বলে মায়রা কখনোই এমন করে ভারি মেকাপে সাজে না। বড় জোর আয়ানের সাথে দেখা করতে গেলে টিপ, কাজল আর ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক। আয়ান তাতেই মায়রার দিকে এতো মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কিছু দেখছে। কথা ছিল মায়রা বিয়ের দিন একদম হালকা করে সাজবে। টুকটুকে লাল বেনারসির সাথে লাল কড়া করে লিপস্টিক, চোখে কালো মোটা করে কাজল আর কপালের মাঝ বরাবর লাল ছোট্ট একটা টিপ। আর রাতে আয়ান নিজ হাতে মায়রার পায়ে আলতা পড়িয়ে দিবে আর মায়রার খোঁপায় গুঁজে দিবে ওদের দুজনের প্রিয় বকুলের মালার গাঁজরা।
মায়রা চিন্তায় মগ্ন হয়ে গা থেকে আস্তে আস্তে গয়নাগুলো খুলছিলো। দরজায় নকের শব্দে চমকে উঠলো মায়রা। সীমান্ত কেন আবার দরজা নক করছে? দরজা খুলবে কিনা চিন্তা করতে করতে একটু করে ওয়াশরুমের দরজাটা ফাঁক করলো মায়রা। সীমান্ত দরজার বাইরে কিছু একটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-এই? তুমি ড্রেসটা না নিয়েই চলে এসেছো তো। জামাটা দিতে এলাম-।
-থ্যাংক ইউ---। দিন----।
-এ কি? এখনো গয়নাও খোলা হয়নি তোমার? ওফফফ! চুলের এতো ক্লিপ ট্লিপ কখন খুলবে? মুখের এতো ভারি মেকাপটা কখন তুলবে? আর কখনই বা শাওয়ার নিবে? তোমাকে নিয়ে যে কি হবে খোদাই ভালো জানে! এই মেয়ে কত রাত হলো খেয়াল আছে সেদিকে? আমি কি না ঘুমিয়ে সারা রাত ধরে ওয়েট করে বসে থাকবো তোমার জন্য? ফাইজলামি পেয়েছ নাকি?
-আপনি যান না? শুয়ে পড়ুন--। আমার আর বেশিক্ষণ লাগবে না----।
-সে তো দেখতেই পাচ্ছি বেশিক্ষণ লাগবে কি না----। দেখি সরো তো--? আমি ভিতরে ঢুকি। জায়গা দাও---।
-আরে? কি করছেন টা কি? আপনি এখানে আসছেন কেন?
-আমি তোমার কাজটা একটু সহজ করে দিচ্ছি মিষ্টি বউ---। সারারাত তোমার শাওয়ার শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য্য অন্তত আমার নেই বাপু--।
সীমান্ত ওয়াশরুমের দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকে মায়রার জন্য আনা ড্রেসটা হেঙ্গারে রেখে দিয়ে মায়রার গয়না খোলায় লেগে পড়লো৷ মায়রাও ভয়ে চোখ বুজে স্ট্যাচুর মতো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ভেবেছিল লোকটা ঘুমিয়ে গেছে টের পেলে তারপর ওয়াশরুম থেকে বের হবে মায়রা। কিন্তু লোকটা তো উল্টো ওর জন্যই জেগে বসে আছে! কি হবে এখন?? কি চায় লোকটা? তবে কি আজকেই এই লোকটার কাছে ধরা দিতে হবে--? ভাবতেই এই ঠান্ডা আবহাওয়ায়ও মায়রা কুল কুল করে ঘামতে শুরু করলো।