উপহার - অন্তিম পর্ব ১২ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


২৩!! 

দরজায় আলতো টোকার শব্দে মাইশা আর ধ্রুবর হুঁশ হল। মেহের দরজায় আলতো করে টোকা দিচ্ছে। 

-ভাবি?

এতোক্ষণে মাইশার খেয়াল হলো ওরা বারান্দায় বসা। ধ্রুব চেয়ারে ওকে কোলের উপরে নিয়ে বসে আছে। ব্যাপারটা খেয়াল করা মাত্রই মাইশা পড়িমরি  করে উঠার জন্য লাফালাফি শুরু করলো।

-কি হয়েছে এমন কেন করছে মেঘপরীটা?

-না--না মানে--। মানে মেহের--। মেহের ডা-ডাক-ডাকছে----।

-আরে বাবা ধীরে---। এতো নাচানাচি করছো কেন? ব্যথা পাবা--।

-না --না--মানে----!

ধ্রুব মাইশার একটা হাত টেনে ধরে আবার নিজের কাছে আনলো। মাইশার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল একটু। তারপর আলতো করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে হাতটা ছেড়ে দিল। মাইশা কি করবে ভেবে না পেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

-কি হলো ম্যাডাম? এবার আপনার ননদিনী ডাকছে না?

মাইশা লজ্জা পেয়ে ছুটে এসে দরজা খুলে দিল। মেহের মাইশাকে দেখে চোখ টিপে হাসল।

-কি গো ভাবি? এতো প্রেম করলে হবে? সময়টা দেখবা না একটু?

-মেহের?

-হি হি---। সেই কখন এসেছো রুমে---। আব্বু আম্মু হাঁটতে গেছে। এসে যদি দেখে এখনো এই রুমে আছো---। হি হি---। পরে তো আর লজ্জায় সামনেও যেতে পারবা না---।

-তোমার ভাইয়াই তো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল--। আমি কি করবো?

-ওই ফাজিল পোলাটারে কান মলা দিসো?

-কাকে কান মলা দিবে রে মেহের?

-এই ভাবি? চলো তো? আমার রুমে যাবা--। আমি আর কারো সাথে জীবনেও কথা বলবো না---। 

-আরে--মেহের?

মেহের মাইশার হাত ধরে টেনেই নিজের রুমে নিয়ে গেল। ধ্রুব পিছন থেকে এতো ডাকছে। কিন্তু কে শুনে! ওদের দু ভাই বোনের অবস্থা দেখে মাইশা হাসি থামছেই না।

পরদিন বিকেলবেলা।

মাইশা এই পর্যন্ত ওর চারটা ফ্রেন্ডকে কল করেছে। রবিন, তানিম, আয়াজ আর দিহান। রাতুলের নাম শুনেই আর কেউ ব্যাপারটায় মাথা ঘামাতে রাজিই হলো না।সবাইকে বিশাল উপদেশ দিয়ে কল রাগ করে কেটে দিল মাইশা। শেষে মাইশা ওর বেস্টফ্রেন্ডকেই কল দিলো।

-হাসিব? হ্যালো?

-কি রে দোস্ত?  কি অবস্থা?

-একটা কাজ করতে হবে---।

-বল?

পুরো প্ল্যানটা শোনার পর দুমিনিট নিরব হয়ে রইলো হাসিব।

-শুনছিস? পারবি না?

-আমারে কি পাগলা কুকুরে কামড়াইসে? তোর এক্সের বাসায় গিয়া ওর বোনরে-----।

-উফ---। এতো চিল্লাস কেন? পারবি কি না বল। না পারলেও--একটা ব্যবস্থা করে দে না ভাই----। প্লিইইইইজ দোস্ত?

-তোরে পাবনা দিয়ে আসমু নি-। মাগার ওই বাড়িত! নো ওয়ে---।

-ধুরো--। অকর্মার ঢেঁকি এক একটা--। 

-নিজের জামাইরেই কও না---? আমার শহীদ হওয়ার সখ লাগে নাই--। এখনো বিয়াই করতে পারলাম না--।

-থ্যাংকস দোস্ত। এত্তো ভালো একটা আইডিয়া দেয়ার জন্য--।

-ওই মাইশানি? পাগল হইসোস তুই---?

-আর শোন--। এর পর যাই হোক একটাও মুখ খুলবি না ভুলেও---।

মাইশা কল কেটে নতুন প্ল্যানিং করে রিধিকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল। তারপর ধ্রুবকে কল দিলো। 

-হ্যালো?

-হুম--। পরীটা এসময় কল দিলো! কি হয়েছে?

-তুমি কি ব্যস্ত এখন?

-উহু-। দেখা করবা? বাসার নিচে আসি?

-একটু পরে--। তার আগে একটা কাজ করতে হবে---।

-হুম--। বলো--।

-তোমাকে একটু রাতুলদের বাসায় যেতে হবে--।

-ওমা! কেন?

-প্লিজ প্লিজ? আমি রিধিকে বলে রেখেছি---।

-----কি করবো গিয়ে?

-আসলে না কেউ রাজি হচ্ছে না যেতে----।

-বিয়ের দাওয়াত দিয়ে আসতে হবে ওদের? ওরা কেউ কি আসবে?

------------------------------

-আচ্ছা- বাবা সরি--। বলো শুনছি--।

পুরো ব্যাপারটা ধ্রুবকে বুঝিয়ে বললো মাইশা। আর শুনে তো ধ্রুবর চক্ষু চড়কগাছ!

-কি বলো এসব মাইশা?

-প্লিজ রাগ করো না---।

-রাগ করছি না--। বাট ওখানে? এসব! কেমনে হবে?

-তোমাকে তো চিনবে না--। আর খুঁজতে তোমার বাসায়ও কেউ আসবে না---। 

-অগত্যা---।

-শুনো তোমাদের গাড়ি নিয়ে যাবা না---। অন্য কারো বা ফ্রেন্ড কারো গাড়ি নিয়ে যাবা--। আর একটু সাবধানে---।

-আচ্ছা পরী----।

-আর তুমি হচ্ছো মিথিলার বড় ভাই--। মনে থাকবে?

-জি ম্যাডাম---।

-যাও--। সাবধানে যেও--।

ঘন্টাখানেক পরে।

মাইশা ধ্রুবদের বাসায় ড্রইংরুমে বসা। পাশে ধ্রুবর বাবা, মা আর মেহের। সবাই ধ্রুবর ফেরার অপেক্ষা করছে। ছেলেটা এখনো আসছে না কেন কে জানে! মাইশার ভয় ভয় হচ্ছে এখন। মানুষটা ধরা পড়ে গেল না তো? তাহলে কি যে হবে! এর মধ্যেই কলিংবেল বাজতেই মেহের ছুটে দরজা খুলে দিল। ধ্রুব দরজায় দাঁড়িয়ে। সবাই দরজার সামনে এসে কৌতূহলী মুখে তাকিয়ে আছে ধ্রুবর মুখের দিকে।

-কি রে? কাজ হলো?

------------------------------

-চুপ করে আছিস যে? কি হলো বল? মেয়েটা এতো কষ্ট করে প্ল্যানিং করলো--। আর তুই কিনা!

-আরে বাবা--। ভাইয়াকে বলতে দাও না----? এই ভাইয়া?

ধ্রুব সবার অবস্থা দেখে শেষে হেসে একপাশে সরে দাঁড়ালো। সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে সাথে সাথে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

২৪!! 

রিধিকে দেখেই সবাই অনেক খুশি হলো। আর রিধি হা করে সবাইকে দেখছে৷ এরা মানুষ নাকি অন্য কিছু! মেহের আর মাইশা এসে হাত ধরে রিধিকে ঘরে ঢুকালো। 

-ভাবি? সবাই জানতো আমি আসবো?

-হুম-রিধি আপু---। ভাবি আমাকে বলেছে--। আমি আব্বু আম্মুকে। সেই কখন থেকে তোমাদের জন্য বসে আছি। তোমাদের এতো দেরি হলো কেন? 

-না মানে-। ধ্রুব ভাইয়ার সাথে আব্বু কথা বলছিল--। 

ধ্রুব গাড়ি পার্ক করে এসে মাইশার পাশে এসে দাঁড়ালো। মেহের আর মাইশার মাঝখানে সোফায় বসা রিধি৷ তাওহীদ আর সাহেবা সামনাসামনি সোফাতে বসা। 

-ভাবি তো আগেই আমাকে বলে রেখেছিল- বাসায় যাতে বলে দিই মিথিলা মানে আমার ফ্রেন্ডের বিয়ে। ওর ভাইয়া নিতে আসবে। এটা বাসায় বলে রাখতে। ধ্রুব ভাইয়া যখন এসেছে বাসায় ভাইয়া ছিল না। আব্বু অনেকক্ষণ কথা বলেছে কিসব নিয়ে----।

সবাই ধ্রুবর দিকে তাকালো।

-কি রে? শেষমেশ একটা মেয়েকে বাড়ির সবার সামনে দিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে এলি? এই জন্য তোকে এতো পড়ালেখা করিয়ে মানুষ করলাম! হা হা হা----।

-বাবা! 

ধ্রুব তাকিয়ে দেখলো সবাই হাসছে।

-হাসো হাসো! এদিকে আমার ভয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল--।

-কেন?

-মাইশা তুমি কি করে জানলে রিধির বাবা আমাকে ফ্যামেলি ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে প্রশ্ন করবে?

-না মানে?

-আরে ভাইয়া বুঝিস না কেন! তুই তো দেখতে মাশাল্লাহ! রিধি আপুর বাবা রিধির আপুর জন্য তোর মতো সুইট বিজনেসম্যান খুঁজতেসে---। হি হি--। ভাবি আগেই বুঝতে পেরেছে সেটা--।

সাহেবা উঠে এসে রিধির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

-আজ থেকে তুমি আমাদের আরেকটা মেয়ে--। কিছুক্ষণের মধ্যেই তন্ময়ের বাবা মা এসে পড়বে--। তুমি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও মা---।

-জি আন্টি----।

মাইশা, রিধি আর মেহের তিনজনে মিলে মেহেরের রুমের দিকে যাচ্ছে। আর দুষ্টুমি করছে।

-এই ভাবি? আব্বু আম্মু যদি আমার বিয়েতে রাজি না থাকে তাহলে তুমি আমাকেও এভাবে ভাগিয়ে দিবা? হি হি---।

-সেই সম্ভাবনা নেই রে ফাজিল মেয়ে--। যার গলায় ইচ্ছা ঝুলে পড়িস--। কেউ কিছু বলবে না। তবে ছেলের বাবা-মা মানবে কিনা ---। নাকি তোর জন্য পাত্রকে কিডন্যাপ করে আনতে হয় দেখ---।

-ভাইয়া----? তোমাকে আমি---। 

মেহের ধ্রুবকে তাড়া করে এলোপাথাড়ি কিল ঘুষি দিচ্ছে। আর ধ্রুব হাসছে। মাইশা আর রিধি ধ্রুব আর মেহেরের কান্ড দেখে হাসতে হাসতে শেষ। মেহের রাগ করে ঘ্যানঘ্যান করতে করতে রিধিকে টেনে নিয়ে চলে গেল।

-এই ফাজিল ছেলেরে জীবনেও আমি যদি আর হেল্প করি---। হুহ--। খালি আমার পিছনে লাগে----।

ধ্রুব আর মাইশা ওদের চলে যাওয়া দেখে হাসছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। মেহের আর রিধি চলে যেতেই ধ্রুব আলতো করে মাইশাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো৷ মাইশা একটু কেঁপে উঠলো।

-ম্যাডাম--। এতো রিস্ক নিয়ে কাজটা করলাম। তো কি গিফ্ট পাচ্ছি আমি? হুম?

-কি করছো? 

-কিছুই করছি না। কেউ গিফ্ট না দিয়ে যেন পালাতে না পারে সে ব্যবস্থা করলাম--। এখন বলুন বলুন--।

-কি গিফ্ট চাই আপনার?

-আমার লাইফের সবচেয়ে সেরা উপহারটা চাই---।

-কি?

-তোমাকে গো মেঘপরী। তুমিই তো আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর- সবচেয়ে দামি উপহার---।

------------------------------

-তা কবে পাচ্ছি আমার উপহার?

-শীঘ্রিই পাবেন---। 

-বাসায় কি বলবো বিয়ের আয়োজন শুরু করার জন্য?

মাইশা লজ্জা পেয়ে ঘুরে ধ্রুবর বুকে মুখ লুকালো।

-জানি না-----।

-ওয়াও-----। হুরররররেএএএ। দুটো বিয়ের অনুষ্ঠান--। কি মজা!

-মেহের?

-আমাকে যে জ্বালাও! আমিও ছাড়ব কেন?

এক সপ্তাহ পর।

আজ ২৪ শে ডিসেম্বর।

মাইশা আর রিধিকে সাজাচ্ছে পার্লার থেকে আসা মেয়েগুলো। এই কয়দিনে রাতুলেরা সবাই মাইশা আর তন্ময়দের বাসায় চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে গেছে। তবুও রিধিকে পায় নি। পাবে কি করে! রিধি ছিল ধ্রুবদের বাসায়। সাজানো হয়ে গেলে রিধি আর মাইশাকে নিয়ে যাওয়া হবে ক্লাবে। সেখানেই বিয়ে হবে। দুটো বিয়েরই সব এ্যারেঞ্জমেন্ট করা হয়েছে। 

মাইশা আর রিধিকে সাজানো শেষ হলে মেয়েগুলো চলে যেতেই মেহের এসে দুজনকে জড়িয়ে ধরলো।

-ইশ! কি সুন্দর লাগছে তোমাদের দুজনকেই! লাল টুকটুকে শাড়ি- মেকাপ-গয়না-কাজল! উফফ--। একেবারে পারফেক্ট বউ! আমি কবে এমন সেজে বিয়ে করবো গো ভাবি?

রিধি মেহেরের কান টেনে দিল। আর ওদের কান্ড দেখে মাইশা হাসছে মিটি মিটি।

-খুব শখ না? দাঁড়াও না এইচএসসি টা দাও--। হৃদয় ভাইয়াকে বলবো এসে নিয়ে যেতে----।

-আহ---। রিধি আপু-- লাগছে তো? এই ভাবি তুমি হাসো কেন! খুব মজা না? সবাই এতো এতো খারাপ--। আমাকে জ্বালায় খালি! আমি আর থাকবই না--। ধুর।

-ওলে বাবুটা--। রাগ করেছে মেহেরমনি? 

-হুম--। তন্ময় ভাইয়ারে বলবো রিধি আপুরে মাইর দিতে--। আর ভাবি তোমারে তো পরে দেখব নি আমি--। এখন চলো?  আজকে বিয়ে--। পরে দেখা যাবে সবাই এসে গেছে- বউরাই লেইট--। হা হা---।

বিয়ের ক্লাবে পৌঁছে মাইশা আর রিধিকে বসানো হয়েছে একটা রুমে। মাইশা মোবাইল হাতে বসে ভাবছে। কলটা করবে কি করবে না। শেষে কলটা করলো।

-হ্যালো?

-কি চাই তোমার আর? আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবা না? কল কেন করেছ! বেঁচে আছি কিনা দেখতে!

-সরি রাতুল--। তোমাকে দুটো খুশির খবর দিতে কল দিলাম--।

-মানে?

-একটা খবর তো তুমি জানো? আজ আমার আর ধ্রুবর বিয়ে। 

-এটা তোমার খুশির খবর?

-হ্যাঁ--। আরো একটা খবর হলো- আজ রিধি আর তন্ময়ের বিয়ে--।

-মানে? রিধিকে তো খুঁজেই পাওয়া-----।। ও তার মানে তোমরাই ওর মাথাটা খেয়ে বাড়ি থেকে পালাতে---।

-অর্থ বিত্ত এসবের মোহে কতোটা অন্ধ হয়ে গেছ বুঝতে পারছো? নিজের বোনের সুখটার চাইতেও আজ তোমার কাছে ছেলের ব্যাংক ব্যালেন্স বেশি হয়ে গেল কি করে রাতুল? একটা সমাজে মাথা উঁচু করে সম্মান নিয়ে বাঁচতে হলে কেবল ধনী হলে হয় না। যোগ্য মানুষ হতে হয়। এটা তুমি ভুলেই গেছ। থাক সেসব কথা। তন্ময় আর ওর পরিবার অনেক ভালো। ওদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে তারপর বিয়েটা হচ্ছে রাতুল। ভাইয়ের এই দায়িত্বটা তোমার ছিল। রিধির অন্য এক ভাই তোমার হয়ে কাজটা করে দিয়েছে। তবু তুমি তো ওর ভাই।  তোমার তো জানার অধিকার আছে যে আজ তোমার বোনের বিয়ে----। পারলে মন থেকে ওদের জন্য দোয়া করো। রাখি। ভালো থেকো।

মাইশা আর রিধি দুজন হাত ধরে বসে আছে৷ দুজনের চোখই হয়তো স্বপ্নগুলো সত্য হওয়ার প্রহর গুনছে আনমনে। 

২৫!! 

কোন ঝামেলা ছাড়াই দুটো বিয়েই শেষ হল। বিয়ে, খাওয়া দাওয়া, আত্মীয় বিদায় পর্ব শেষ হতে হতে দশটা বাজল। তারপর দুটো গাড়ি দুদিকে রওনা হলো। রিধি আর তন্ময়ের গাড়ি তন্ময়ের বাড়ির দিকে আর মাইশা-ধ্রুবর গাড়ি ধ্রুবদের বাড়ির দিকে। রিধি যাওয়ার আগে সবাইকে জড়িয়েই কেঁদেছে। মাত্র সাতটা দিনে এই মানুষগুলো ওর জন্য যা করেছে তার ছিটেফোঁটাও ওর পরিবারও করে নি। হয়তো করতে চায় নি বলে। নিজের পরিবারের সাথে সম্পর্ক থাক না থাক এদের সাথে রিধির সাথে সম্পর্কটা আজীবনই থেকে যাবে। বিশেষ করে ধ্রুবর সাথে। উপরওয়ালার বিশেষ উপহার হয়েই যেন এই মানুষটা রিধির জীবনে বড় ভাই হয়ে এসেছে।

মাইশাদের গাড়িটা ধ্রুবর বাড়িতে পৌঁছাতে একটু সময় লাগলো। পুরোটা সময় ধ্রুব আলতো করে মাইশার হাতটা ধরে বসেছিল। আর একটু পর পর মাইশাকে দেখছিল। মেয়েটা চুপ করে বসে আছে। ওর মুখ দেখে ধ্রুব বুঝতে পারছে না কি চলছে মাইশার মনে। তাই আর ঘাটায় নি ওকে। নিজের পরিবার ছেড়ে যাচ্ছে, মন খারাপ হওয়া তো স্বাভাবিক। 

রাত ১২ টা।

ধ্রুব রুমে এসে দেখলো রুমটা বেলি ফুল আর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। রুমটার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দেয়ার জন্যই যেন মাইশা টকটকে লাল বেনারসি পড়ে বসে আছে খাটের মাঝখানে৷ ধ্রুব একটু এগিয়ে আসতেই যেন মাইশা একটু কেঁপে উঠলো। ধ্রুব সেটা দেখতেও পেল বুঝতেও পারলো। ধ্রুব খাটের কাছে এগিয়ে আসতেই মাইশা নেমে ধ্রুবকে পা ছুঁয়ে সালাম করলো৷ ধ্রুব আলতো হাতে মাইশাকে টেনে তুলে খাটে বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসলো। মাইশাকে অসম্ভব রকমের সুন্দর লাগছে ধ্রুবর কাছে। মনে হচ্ছে একটা লালপরী এসে ধ্রুবর পাশে বসেছে। ভারি মেকাপ, মুখে চন্দন টিপের ফোঁটা, চোখে মোটা কাজল, আইলাইনার, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, গলায়-কানে-হাতে গয়না- সব মিলিয়ে একদম সম্পূর্ণা লাগছে মাইশাকে। 

বেশ অনেকক্ষণ ধরে মাইশাকে দেখে আলতো করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো ধ্রুব৷ 

-এই যে মেঘপরী? লাল পরী হয়ে তোমাকে ভিষণ সুন্দর লাগছে। এখন যাও। শাওয়ার নাও। ফ্রেশ লাগবে নিজেকে৷ আর এতো ভারি শাড়ি পড়ে থাকতে হবে না৷ এটা নাও। পছন্দ হলে পড়ো---। যাও---।

 মাইশার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ধ্রুব মাইশার লাগেজটা খুলতে হেল্প করল। মাইশাও মুগ্ধ চোখে ধ্রুবকে দেখছে। বিয়ের সাজে মেয়েদেরকে যেমন অসম্ভব সুন্দর লাগে ঠিক তেমনি সুন্দর দেখতে লাগছে ধ্রুবকে। কালো খয়েরি রঙের শেরওয়ানিতে সাদা পার্লের আর রেশমি সুতোর কাজ করা। দেখতে রূপকথার গল্পের রাজকুমারের মতো লাগছে৷ ধ্রুবর সাথে চোখাচোখি হতেই মাইশা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল। কোনমতে টাওয়াল আর কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। 

শাওয়ার নিয়ে দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো ধ্রুব রুমে নেই৷ দরজা ভেতর থেকেই লক করা। তাই মাইশার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ধ্রুব কোথায়। বেশ অনেকক্ষণ লেগেছে ভারি মেকাপ তুলতে। রুমে এসে ধ্রুবর দেয়া প্যাকেটটা খুলে মাইশা হা হয়ে গেল। কালো পাড় দেয়া নীল রঙের হাফ সিল্কের একটা শাড়ি, লাল রেশমি চুড়ির দুটো বড় সেট, পাথরের অর্নামেন্ট, লাল টিপ। সাথে ছোট্ট একটা নোট।

'আজ নাহয় চুলগুলো মুক্ত বাতাসে উড়ুক মেঘপরীটার।'

মাইশা কাঁপা কাঁপা হাতে প্রত্যেকটা জিনিস ছুঁয়ে দেখলো৷ তারপর তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিল। ধীর পায়ে বারান্দার দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো।  আর সাথে সাথে ধ্রুবকে দেখলো সোফায় অন্ধকারের দিকে মুখ করে বসে আছে৷ মাইশার উপস্থিতি টের পেতেই একটা হাত টেনে মাইশাকে নিজের কোলে বসিয়ে অপলকে দেখছে ধ্রুব। মাইশাও ধ্রুবকে দেখছে অবাক চোখে৷ মানুষটা চেইঞ্জ করে নীল রঙা টিশার্ট আর গাবাডিং পড়েছে। দারুণ লাগছে দেখতে। ধ্রুব মাইশার কপালে চুমো খেয়ে মাইশার বুকে আলতো করে মাথা ঠেকালো। মাইশা ধীর হাতে ধ্রুবর চুলে হাত বুলাচ্ছে।

-পরী? একটা গল্প শুনবে?

-হুম----। শোনাও---।

-তোমাকে প্রথমবার দেখেছি তোমার কলেজের সামনে। সেও আজ থেকে তিন বছর আগে। তোমাকে দেখেই যেন সময়গুলো থমকে গিয়েছিল। প্রত্যেকটা দিন তোমাকে দেখার আশায় চাকরি পর্যন্ত চেইঞ্জ করেছি জানো? তুমি তিনটা বছরে জানতেও পারো নি--। তোমাকে রাতুলের সাথে দেখে কি ফিল হতো আমি সেটা তোমাকে----। বাদ দাও--। তোমাকে নিজের করে পেয়ে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে আজকে। মনে হচ্ছে নিজের জীবনের সবচেয়ে দামি উপহারটা আজ পেয়েছি----। নিজের করে পেয়েছি----।

মাইশা কিছু বলতে পারলো না। শক্ত করে শুধু মানুষটাকে জড়িয়ে রাখলো নিজের সাথে।

দুই বছর পর।

ধ্রুব রাগ করে শুয়ে আছে। আর ঘড়ি দেখছে। ১১ টা বাজে। এই মেয়ের খবরই নেই। আর মাত্র ১ টা ঘন্টা বাকি। কিন্তু এই মেয়েটা ১২ টা বাজার আগে রুমে আসবে কিনা কে জানে। কয়বার ডেকেছে! তবু কে কার কথা পাত্তা দেয়! ধুর। মোবাইলটা মাথার কাছে রেখে ধ্রুব বামপাশে কাত হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে গেল।

মাইশা রুমের দরজা বন্ধ করে পা টিপে টিপে রুমে এলো৷ ধ্রুব যেভাবে রেগে আছে কপালে কি আছে কে জানে? মেহের আর হৃদয় এসেছে আজকে সন্ধ্যায় বেড়াতে। হ্যাঁ ওদের বিয়েটাও হয়েছে। গল্প করতে করতেই এতো দেরি হয়ে গেছে। মাইশা শাড়িটা বদলে একটু হালকা করে কাজল পড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। জানে একটু পরেই ধ্রুব আসবে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে। শত রাগ করে থাকলেও এই কাজটা তার কখনো মিস হয় না। 

১২ টার দিকে মোবাইলের ভাইব্রেশনে ঘুমটা ছুটতেই ধ্রুব পাশে মাইশাকে না পেয়ে উঠে বসলো। মেয়েটা প্রতিরাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কি আনন্দ পায় বুঝে না ধ্রুব। জোর করে কোলে তুলে আনার সময়ও কতো না নাচানাচি করে। কথাটা চিন্তা করেই হেসে বারান্দার দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো ধ্রুব। নীল রঙা শাড়ি পড়েছে মাইশা আজ। খোলা চুলগুলো উড়ছে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে। ধ্রুবও এগিয়ে এসে মাইশাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ ডুবালো।

-হ্যাপি সেকেন্ড ম্যারেজ এ্যানিভার্সারি মেঘপরী।

মাইশা ধ্রুবর দিকে ঘুরে নিজের জিভ কাটলো।

-সরি সরি--। আমার একটুও মনে ছিল না--।

ধ্রুব আবারও মাইশাকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিল।

-সেটা মনে থাকবে কেন? ননদিনীকে পেয়ে আমাকে তো ভুলেই গেসিলেন---।

-সরি তো? হ্যাপি এ্যানিভার্সারি--।

-উহু--। আই ওয়ান্ট মাই গিফ্ট। মনে আছে তো? হয় তোমার চাইতেও দামি কিছু উপহার দিবা-নয়তো আমার উপহারটা আমি নিজেই নিয়ে নিব--!

ধ্রুব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে দেখে মাইশা লজ্জা পেয়ে ধ্রুবর একটা হাত ধরে ফেললো। 

-একটা কথা ছিল---।

-কোন বাহানা শুনছি না ম্যাডাম--। 

-না মানে-তোমার জন্য স্পেশাল একটা উপহার ছিল। কিভাবে দিবো বুঝতে পারছিলাম না--।

-ওহ! আচ্ছা দাও গিফ্ট--। কি আর করা----!

ধ্রুব রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করতেই মাইশা ধ্রুবর হাতটা ধরে আলতো করে নিজের পেটে রাখলো। ধ্রুব বুঝতে না পেরে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। মাইশা মুখ নিচু করে পেটের উপর থেকে শাড়িটা একটু সরিয়ে ধ্রুবর হাতটা রাখলো সেখানে। লজ্জায় ধ্রুবর দিকে তাকাতেও পারছে না বেচারি। ধ্রুব হা করে মাইশাকে আর নিজের হাত দেখছে।

-সত্যি! থ্যাংকু থ্যাংকু থ্যাংকু মাইশা। আমার লাইফের আরেকটা শ্রেষ্ঠ উপহার এনে দেয়ার জন্য--। তোমাকে অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি মেঘপরী--। আর আমাদের ছোট্ট পুঁচকিটাকেও--।

ধ্রুব মাইশার মুখ অসংখ্য চুমোয় ভরিয়ে দিল। 

-এই? আচ্ছা পুঁচকি আসলে তো আমি গোলুমলু হয়ে যাব। তখনো এমন ভালোবাসবে আমাকে?

-আমার জীবনের সবচেয়ে বড়-সবচেয়ে দামি উপহার তুমি মাইশু। তোমার প্রতিটা অঙ্গ-প্রতিটা অংশ আমার জন্য উপহার। আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার-------। তাই তুমি যতই গোলুমুলু হও না কেন তবুও তোমাকে ভালোবাসব৷ অনেক অনেক বেশি ভালোবাসব--।

মাইশা লজ্জা পেয়ে ধ্রুবর বুকে মুখ ডুবালো। প্রিয় মানুষের কাছে এমন কথা শোনাও পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কোন উপহারের চেয়ে কম কিছু নয়।



                                   ***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন