উপহার - পর্ব ০৩ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৫!! 

আজ দুটো দিন পেরিয়েছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো ভাবছে মাইশা। ধ্রুব নামের মানুষটা হুট করে এসে ওকে কোন এক ধাঁধার জালে আটকে দিয়েছে। হুট করে এসেই যেন সে মাইশার জীবনের ধ্রুব সত্য হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কি হচ্ছে, কি করে হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছে না মাইশা। অনেকগুলো বিষয় নিয়ে মানুষটার সাথে কথা বলা দরকার। অনেকগুলো বিষয় ক্লিয়ার করা দরকার লোকটার সাথে। নয়তো সারাজীবন নিজেকে নিজের কাছেই অপরাধী মনে হবে। অথচ লোকটার খবরই নেই। আজব! দুটো দিন হলো তাদের আংটি বদল হয়েছে। দুটো পরিবার অফিশিয়ালি কথা বলে গেছে। আগামী ছ মাস পর ওদের বিয়ের ব্যাপারটা পাকাপাকিভাবে ঠিক হয়েছে। অথচ যার সাথে বিয়ে গত দু দিনে তার কোন পাত্তাই নেই! এ কেমন কথা!

অথচ মিষ্টি মেহেরটার সাথে মাইশার সারাক্ষণই কথা হচ্ছে। মেয়েটা খেতে বসে কল করছে। ঘুমোতে গেলে কল করছে। ঘুম ভাঙলে কল করছে। এমন একটা অবস্থা। আর তার ভাই লাপাত্তা! কাহিনীটা কি?

বসে বসে এসব ভাবতে ভাবতেই বাবা এসে বসলেন মাইশার পাশে। বাবাকে দেখে মাইশাও উঠে বসলো।

-বাবা? কিছু বলবে?

-মা রে--বাবাকে মাফ করে দে--।

-বাবা--! কি বলো এগুলা? 

-এখন মনে হচ্ছে এতোটা তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা ঠিক করা উচিত হয় নি। একটু তো অপেক্ষা করা যেত--।

-না বাবা। ঠিকই আছে। আর তাড়াহুড়োর কিছু হয় নি। এখনই বিয়েটা হচ্ছে না। তাদেরও আমাকে জানার জন্য ছয়টা মাস সময় আছে। এর মধ্যে দেখা যাক----।

-আমি ধ্রুবকে নিয়ে বলছি না মা।

-আর কাউকে নিয়ে কথা বলার বা কারো জন্য অপেক্ষা করার মতো তো কিছু নেই বাবা---।

-ও হয়তো ওর বাবাকে রাজি করাতেও পারে তো মা---।

-রাতুলের কথা বাদ দাও বাবা--। ওর পরিবারের চাহিদা পূরণ করা আমার বা তোমার পক্ষে কতোটা সম্ভব সেটা কি আমি বুঝতে পারছি না বাবা? এতো লোভীও মানুষ হয়! এতোগুলো বছর লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে আমার! 

-কাঁদিস না মা----।

-না বাবা-। কাঁদবো না। কাঁদবো না। পাঁচটা বছরের সম্পর্কের পরও যে বলতে পারে 'বিয়ের উপহারগুলো দিয়ে দিলেই তো বিয়েটা হয়ে যায়- তোমার বাবাকে বলো--।' তার জন্য কাঁদার প্রশ্নই আসে না। একদম না।------।

------------------------------

-তুমি ভেব না বাবা--। আমি একদম ঠিক আছি।-------------। কারো যদি মনে হয় আমাকে ঘাড় থেকে নামানোর জন্য আমার বাবার ঘাড় থেকে লাখ লাখ টাকা গচ্ছা যাবে-সেটা তাদের সমস্যা--। তোমারও না। আমারও না----।

-কিন্তু মা--এটা তো ঠিক ওদের চাহিদাটা পূরণ করার মতো সামর্থ্যটা তোর বাবার ছিল না---।

-বাবা--? ও তো সবটা জানতো। পাঁচটা বছর ধরে আমাকে দেখেছে, বুঝেছে, চিনেছে--। তবুও যখন ওর মনে হলো ওর বাবার ডিমান্ডটা উচিত ছিল তখন তো আর এই ছেলেমানুষি স্বপ্নগুলো আঁকড়ে পড়ে থাকার কারণ নেই বাবা----।

-কিন্তু মা--?

-আর কিছু বলো না। বাবা---। প্লিজ-----?

বাবা আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেলেন। মাইশার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে এই মূহুর্তে। কি ভেবেছিল আর কি হয়ে গেলো! রাতুল! যে মানুষটার স্বপ্নে বিভোর থেকে দিন শুরু হতো ওর, শেষ হতো রাতগুলো, সেই মানুষটার নাম শুনতেও এখন গা ঘিনঘিন করে! কেন এমন হয়! কেন একটা সপ্তাহ আগে গিয়ে সবটা ম্যাজিক করে মুছে দিতে পারে না ও! অবশ্য এক সপ্তাহ আগের ঘটনাটা মুছে দিলেই কি সবটা ঠিক হয়ে যাবে? একটা ভুল মানুষকে ভালোবাসার পরিণাম কি সারাজীবন ধরে ভোগ করতে হবে না ওর! ভুল মানুষই তো----!

পাশে থাকা মোবাইলটা কেঁপে উঠতেই চোখ মুছে মোবাইলটা হাতে তুলে নিল মাইশা। অবাক হওয়ার কিছু নেই। এতো রাতেও মেহেরের কল যে আসবে সেটা মাইশার জানাই ছিল।

-হ্যালো? মেহেরমনি?

-হি হি হি৷ হি হি---। ভাবি! হি হি হি। হি হি। 

-এই যে মেহের মনি--? এতো হাসছো!কাহিনী কি?

-হি হি। জানো ভাবি? আজকে না ভাইয়াকে বাবা বকা দিয়েছে--।

-তাই হাসছো?

-আরে শোনো না? বাবা খেতে বসে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো- তোমার সাথে কথা হয়েছে কিনা--। তা ভাইয়া কাঁচুমাঁচু মুখ করে যেই বলেছে হয় নি---। হি হি---। ওমনি বাবা রেগে গেছে--। হা হা হা।

-কেন?

-আরে কেন আবার! মায়ের দু-দুটো জাঁদরেল ভাই থাকা স্বত্ত্বেও বাবা ঠিকই মায়ের সাথে পত্রপ্রেম করে বিয়েটাও করে ফেলেছে। আর ভাইয়া তোমার জন্য তিনবছর ধরে কষ্ট করছে দেখে বাবা শেষমেশ বিয়েটাও ঠিক করে ফেলেছে-। অথচ সে তবুও নাকি তোমার সাথে এক মিনিট কথাও বলতে পারছে না! আচ্ছা বলো তো..? আমার থেকে চাইলেও তো আমি তোমার নাম্বারটা দিতাম-- না? তাতে আমারও কিছু আয় হতো--। হি হি--।

-তিন বছর মানে?

-সে তুমি ভাইয়ার থেকে জেনে নিও। আমি বলেছি বলো না। ভাইয়ার নাম্বার মেসেজ করছি তোমাকে। একটু কথা বলে নিও। নইলে সে বেচারা লজ্জায় কারো কাছে তোমার নাম্বার চাইতেও পারবে না। হা হা---।

-মেহের তুমি অনেক কিউট---।

-আমার ভাইয়া বুঝসো আরো বেশি কিউট--। তুমি কথা বলে বলবা কিন্তু আমাকে কি কথা হইসে--। হি হি---। রাখি এখন? টা টা ভাবি।

একটু পরেই মেহেরের নাম্বার থেকে মেসেজ এলো। আর মাইশা ভাবতে বসলো। এখন কি করা যায়! এতো রাতে কল করাটা কি ঠিক হবে?

০৬!! 

অনেক ভেবে শেষে মাইশা মেহেরের দেয়া নাম্বারটাতে কল দিলো। কলটা অনেকক্ষণ বাজছে। ধরার নাম গন্ধই নেই। কেটে দিবে এমন সময় রিসিভ হলো। ওপাশে খুব গম্ভীর আর বিরক্ত হওয়া কণ্ঠস্বর। হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছিল মানুষটা। এতো রাতে কল করায় হয়তো রাগ হয়েছে খুব।

-হ্যালো? কি আশ্চর্য কল করে চুপ করে আছেন কেন? কে বলছেন‌?

মোটামুটি পর্যায়ের ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো ধ্রুব৷ এর পরে মাইশা ভয়েই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।

-ধুর--। কথা না বললে রাখেন তো।

-হ্যালো?

------- হ্যালো---? মাইশা বলছেন?

-জি----।

-ওহ। সরি সরি---।

-আপনি বোধ হয় ঘুমাচ্ছিলেন? সরি।আচ্ছা সকালে কথা হবে--।

-এই না না--। আসলে আমিই সরি। ঘুমাচ্ছিলাম না--। আসলে একটা কাজ করার চেষ্টা করছিলাম--। কিছুতেই হচ্ছিল না----।

-ও আচ্ছা--। তাহলে আপনি কাজ করুন। পরে কথা বলবো না হয়----।

-আরে না না৷ কাজ তো নিজে নিজেই হয়ে গেলো!

-জি?

-না না কিছু না। কেমন আছেন?

-আপনি আপনি করে বলবেন না প্লিজ? কেমন জানি ১০-১২ টা পিচ্চির দাদিআম্মা দাদিআম্মা ফিলিংস হয়।

-হা হা---। একেবারে নাতি নাতনীর চিন্তাও করা হয়ে গেছে? নাম ধাম ঠিকঠাক করে ফেলেছেন নাকি!

-না মানে--! সেটা না---। আসলে--!

-আচ্ছা তুমি করেই বলবো না হয়। আপনিও থুড়ি তুমিও চাইলে বলতে পারো----।

- না না--। ঠিক আছে।

-কি করছিলে? এতো রাত হলো ঘুমাও নি?

-মেহেরের সাথে কথা হলো। ঘুম আসে নি -। আপনি ঘুমান নি?

-এই দু রাত টেনশনে একটুও ঘুম হয় নি। আজকে বোধ হয় রাতে ভালো একটা ঘুম হবে---।

-কেন?

-কারো মিষ্টি একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম দুদিন পর--। তাই---।

----------------------------------------------------

-তোমার কালকে ক্লাস নেই?

-আছে। এই কদিন তো যাই নি। কাল যাবো---।

-ক্লাস শেষ কয়টায় তোমার?

-২ টার সময়----।

-কাল একটু ক্লাসের শেষে সময় হবে? না মানে-- তোমার কোন কাজ না থাকলে----।

-নাহ। কাজ নেই কোন। 

-অবশ্য ইচ্ছে না করলে সমস্যা নেই----। অন্য কোন দিন না হয়---।

-নাহ। ঠিক আছে। কাল দেখা করা যাবে। আপনার অফিস নেই?

-আছে। লাঞ্চ টাইমে দেখা করব। আর অফিসে এখন কাজের তেমন চাপও নেই--।

-ওওওও----।

-ক্লাস শেষ হওয়ার আগে করে কল দিও।আমি কলেজের সামনে থেকে তোমাকে পিক করে নিবো---।

-আচ্ছা--।

-এখন ঘুমাও তাহলে? সকালে তো ক্লাস আছে--।

-হুম।

-বায়। গুড নাইট।

-গুড নাইট।

কল কেটে দেয়ার পর মাইশার হুঁশ হলো। উনি তো জানে না মাইশা কোন কলেজে পড়ে! তাহলে! আর এই যাহ! তিন বছরের কাহিনীটা জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছে। ওর নিজের কথাগুলোও তো বলতো ভুলে গেছে! লোকটার কণ্ঠটা ভিষণ সুন্দর। কণ্ঠটা শুনলেই সব তালগোল পাকিয়ে যায় মাইশার। কালকে সবটা বলবে। সবটা জানবে। আচ্ছা? মানুষটা কি ওর সাথে কথা বলার জন্য চেষ্টা করছিলো? দুদিন ধরেই? ব্যাপারটা চিন্তা করতেই মাইশার মুখটা অজান্তেই লাল হয়ে গেলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন