২৩!!
আভা আর সামি মায়রাকে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পর পর দুবার কলিংবেল বাজিয়ে সরে গেছে। মায়রা একটু হাসলো মামা মামির এমন কাজে। উনাদের এমন কাজ করার পেছনের কারণটা মায়রা জানে। তারা বাঁধনকে সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছেন। মায়রা তাই কিছু না বলেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাঁধনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় ভিতর থেকে ধুপধাপ পা ফেলে কারো ছুটে আসার শব্দ পেল মায়রা৷ আর একটু পরেই দরজাটা খুলে গেল৷ দরজা খুলেই ৯-১০ বছরের ছোট্ট একটা ছেলে হা করে তাকিয়ে রইলো। মায়রা হেসে তার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। আর প্রায় সাথে সাথেই বাচ্চাটা এক ছুটে এসে মায়রাকে জড়িয়ে ধরলো।
-মায়রাপু। তুমি এসেছো? এতোদিন কোথায় ছিলা? আমি কতো কেঁদেছি জানো তুমি? তুমি এতো পচা! আমাকে তো যাওয়ার সময় নাও নি। আবার এতোদিন আসোও নি আমার কাছে---।
-ওরে বাবা থাম থাম--। বাঁধন। আল্লাহ! এতো অভিযোগ একসাথে!
-কি অভিযোগ! এতো শক্ত কথা বললা তুমি আমাকে? কথাই নাই যাও। আম্মুকে বলবো তোমাকে আর আদর না করতে---।
-ইশ! বললেই হলো? মামনি আমাকে তোর চেয়েও বেশি ভালোবাসে। হুহ।
-এহ---। কচু বাসে---। ছেলের থেকে কি ছেলের বউকে বেশি ভালোবাসা যায়? উহু--।
-ওরে বাবা! কি বলিস! পাজি ছেলে!
-মায়রাবু--। আর চলে যাবা না বলো। তুমি যখন ছিলে না আমি কতো কেঁদেছি-। আম্মুকে জিজ্ঞেস করো--।
-ওলে বাবা। কাঁদে না বাবুটা। মায়রাপু এখন চলে এসেছি না?
-জানো আব্বু আম্মু বাসায় নেই। চলো আমরা গেমস খেলি মোবাইলে আগের মতো---। একবার তুমি খেলবা আর একবার আমি----।
বাঁধন আভা আর সামিকে খেয়াল করে নি। আর বেচারা মায়রাকে পেয়ে খুশির চোটে হড়বড় করে বলছিলো কথা৷ কিন্তু গেমসের কথাটা বলার পর মায়রা জিভ কাটতেই এক সেকেন্ডের মাথায় যখন কেউ তার কান টেনে ধরলো তখন বেচারা বাঁধন বুঝতে পারলো কি ফাঁসাটাই না ফেঁসেছে সে। অবশ্য বাঁধন একটুও না থমকে একগাল হাসি দিলো আভা আর সামির দিকে তাকিয়ে। আভা ছেলের কান টেনে দিলো আবার।
-যেই দেখেছ আমরা বাসায় নেই ওমনি গেমস খেলার কথাই মাথায় এলো তোমার তাই না?
-আম্মু? লাগছে তো? আমার বউয়ের সামনে প্রেস্টিজ পানচার করছো কেন? ও আম্মু? ছাড়ো না?
-বেয়াদব ছেলে মায়রাপু তোমার বড় আপু হয় না? এসব কি ধরনের কথা?
-ইশ! এতো সুন্দর মেয়েটাকে আপু কে ডাকতে যাবে? ও আমার বউ হয়। তোমরা মানলে মানো-৷ নইলে আমি আজই আমার বউকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো---।
-ও মায়রা? বাঁধন এসব কি বলছে রে! বজ্জাত ছেলে! মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না আজকে তোর দাঁড়া---।
-এহ--। মায়রাপু চলে এসেছে আমাকে আর কে মারতে পারবে? মারো দেখি? মারো তো?
বাঁধন আভার হাত থেকে কোনরকমে ছুটেই মায়রার পিছনে লুকিয়ে গেল। এতোদিন পরে মায়রা আবার প্রাণভরে হাসছে বাঁধনের পাগলামিতে। আর বাঁধন মায়রার চারদিকে ঘুরে ঘুরে আভার সাথে দুষ্টুমি করছে৷ এসব দেখে সামি, আভা আর মায়রা তিনজনেই হেসে ফেলছে। এতোদিন পর ঘরটা যেন আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আবার যেন হাসি আনন্দে কানায় কানায় ভরে উঠতে শুরু করেছে ঘরটা৷
দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ কেটে গেল। মায়রাকে আজ সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে সাজিয়ে দিয়েছে আভা। অফ হোয়াইট কালারের জমিনের উপরে কালো জরি সুতোর কাজ করা জর্জেটের এই শাড়িটা মায়রার জন্য আগেই কিনে রেখেছিল আভা৷ শাড়িটায় মেয়েটাকে একেবারে পরীর মতো লাগছে। শাড়িটার সাথে ম্যাচিং করে ছোট পাথর বসানো কানের দুল আর নেকলেস পড়িয়ে দিয়েছে আভা। মায়রার চোখ দুটো চিকন করে আইলাইনার আর কাজল দিয়ে সাজানোয় আরো বেশি মায়াময়ী লাগছে৷ মুখে হালকা মেকাপের টাচ অন্য আলাদা একটা সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে মায়রার মুখে৷ সাজটা শেষ করে আভা মায়রাকে দেখে একটু করে কাজলের কালি লাগিয়ে দিলো কানের পিছনে।
-মাশাল্লাহ মায়ু-তোকে তো পরীর মতো লাগছে--।
মায়রা কিছু না বলে হাসলো। আভার কথায় আয়নায় একবার নিজেকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো।
-মামনি? মনে হচ্ছে বিয়ে খেতে যাচ্ছি--।
-একদম এসব বলবি না তো--। কতোদিন পর পুরনো বন্ধু বান্ধবদের সাথে দেখা হবে--। একদম মরা মরা হয়ে গেলে চলে?
-তাও? এতো সাজের কি দরকার ছিল?
-বেশি কথা বলবি না তো--। তুই তো একদমই সাজিস না৷ আজ আমার শখ হয়েছে আমার মেয়েটাকে সাজিয়ে দিয়েছি--। কোন কথা শুনতে চাই না আর। এভাবেই যেতে হবে--।
-আচ্ছা মামনি-। পরে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করলে কিন্তু আমি কিছু জানি না--।
-আচ্ছা--। তুই প্রোগ্রাম থেকে ফিরেই নাহয় বলিস--৷ কেউ হাসাহাসি করলো নাকি তোকে দেখে ক্রাশ খেলো---।
-মামনি! কি বলো এসব?
-আহারে! মেয়েটা লজ্জা পেয়েছে গো--।
-ধ্যাত--। আমি গেলাম---।
মায়রা একটু লজ্জা পেয়ে রুম থেকে বের হতেই দেখলো বাঁধন একেবারে স্যুট ব্যুট পড়ে রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজে নিজে কখন যে পিচ্চিটা রেডি হয়ে গেছে সেটা আভা বা মায়রা কেউই টের পায়নি। আভা বাঁধনের মুখ দেখেই বুঝতে পারলো এই ছেলে এখন মায়রার সাথে যাওয়ার জন্য তাল করবে। তাই একটা কষিয়ে ধমক দেয়ার জন্য চোখ গরম করে তাকালো। কিন্তু আভা কিছু বলার আগেই মায়রা বাঁধনের চুল নেড়ে দিয়ে হাসলো।
-এই যে বান্দর? কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
-বউকে পাহারা দিতে--।
-কি?
-আজকে আমার বউকে এতো সুন্দর লাগছে--। কেউ যদি টুপ করে আমার বউটাকে নিয়ে পালিয়ে যায়? তাই আমিও বউয়ের সাথে যাবো।
-আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে তো বাচ্চাপার্টি এ্যালাউড না রে পিচ্চি।
-পিচ্চি পিচ্চি করবা না মায়রাবু৷ আমি বড় হয়েছি না?
-ওলে বাবা লে--। বুইড়া হয়ে গেছো তুমি---।
-চলো চলো? দেরি হয়ে যাবে তো আমাদের--।
আভা এবারে বাঁধনকে টেনে ধরলো।
-মার লাগাবো বাঁধন--। আপু ওর বান্ধবীদের সাথে যাচ্ছে-৷ তুই গিয়ে ওকে জ্বালাবি--। মেয়েটা---।
-ওহ! মা--। এমন করো কেন? আমি মায়রাপুকে একটুও বিরক্ত করবো না--। আপুকেই জিজ্ঞেস করো আমি বিরক্ত করি ওকে? এই মায়রাপু বলো তুমি? বিরক্ত করি?
মায়রা হেসে বাঁধনকে কাছে টেনে নিয়ে চুলগুলো আঙুল চালিয়ে ঠিক করে দিলো।
-মামনি-এই বান্দরটা আমার সাথেই যাক--। কিছু হবে না। একদম দুষ্টুমি করবে না আমাদের বাঁধন। কি বাঁধন? তাই তো?
-হ্যাঁ মায়রাপু---৷ আমি একদম দুষ্টুমি করবো না। পাক্কা---।
-চিন্তা করো না মামনি--। ফিরতে তো একটু দেরি হবে-। ও থাকলে আমারও ভালো লাগবে--।
-আচ্ছা। সাবধানে যাবি কিন্তু--।
-হ্যাঁ মামনি--। চল বাঁধন---।
মায়রা বাঁধনকে নিয়েই ওদের ব্যাচের রিইউনিয়নের পার্টিতে গেল। সেখানে ব্যাচের সবার সাথে কথা বলতে আর আড্ডা দিতে দিতে কখন যে সময়টা পার হয়ে গেছে সেটা টেরই পায় নি মায়রা। বাঁধনও পার্টিতে নিজের সমবয়সী কয়েকজনকে পেয়ে তাদের সাথেই খেলায় কাটিয়ে দিলো পুরো সময়টা। সব মিলিয়ে সুন্দর একটা দিন যেন চোখের পলকেই কেটে গেছে। সবাই আফসোস করছে এতো তাড়াতাড়ি কেন সময়টা কেটে গেলো। কিন্তু সময় তো নিজের নিয়মে চলবেই। আর এক সময় ফুরিয়েও যাবে। তাই সেটা নিয়ে আফসোস না করে জীবনের মূল্যবান সময়টাকে আরো সুন্দর করে তোলাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ হবে৷ এসব ভেবে পার্টি শেষে সবাই যে যার গন্তব্যের দিকে রওনা হলো। মায়রাও বাঁধনকে নিয়ে বাসায় ফেরার জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করলো। কথায় কথায় খেয়ালই ছিল না যে এতোটা রাত হয়ে যাবে। কয়টা বাজে সেটা দেখার জন্য মোবাইলটা বের করতেই দেখলো মোবাইলটা বন্ধ হয়ে গেছে কখন যেন। মায়রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাতের শহর দেখায় মন দিলো। আর ভাবতে লাগলো বাসায় মামা মামি হয়তো খুব টেনশন করছে। এদিকে বাঁধন মায়রার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেছে দেখে হাসিও পেল মায়রার। আসলেই ছোটবেলাটা কতোই না নিষ্পাপ শান্তির!
২৪!!
এক হাতে ঘুমন্ত বাঁধনকে কোলে তুলে বুকে চেপে ধরে অন্য হাত কয়েকটা শপিংব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো মায়রা৷ কোনমতে হাতের শপিংব্যাগগুলো সামলে দরজায় কলিংবেল বাজালো। ঘুমন্ত বাঁধনকে নিয়ে আর ভারি ব্যাগগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে মায়রাকে। এতোকিছুর মাঝেও মায়রার ভয় করছে এতো দেরি করে ফিরায় মামা মামি কি বলবে সেটা ভেবে। যদিও মামা মামি কখনো বকে নি ওকে। তবু কেমন একটা ইতস্তত লাগছে মায়রার। তার উপরে মোবাইলটা কখন বন্ধ হয়ে গেছে সেটাও একদম টের পায়নি ও। এর মধ্যে যদি সীমান্ত কল দিয়ে না পায় তাহলে কি হবে সেটা ভেবে মায়রার হাত পা একেবারে অবশ হয়ে আসছে।
মায়রা কলিংবেল বাজিয়ে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকার পরও কেউ দরজা খুলছে না দেখে আবার কলিং বেল বাজানোর জন্য হাত তোলার চেষ্টা করতেই দরজা খোলার শব্দে মায়রা তাকালো দরজার দিকে। দরজার সামনে আভা আর সামিকে দেখে মায়রা একটু লাজুক চোখে তাকালো।
-সরি সরি মামনি--। সরি মামা। দেরি হয়ে গেছে ফিরতে--। সরি-।
সামি আর আভার মুখের ভঙ্গি দেখে মায়রা একটু থতমত খেয়ে গেল। আভা একটু ত্রস্ত হাতে মায়রার কোল থেকে বাঁধনকে নিজের কোলে তুলে নিলো।
-আয় মায়রা? ভিতরে আয়---।
আভা আর সামির মুখ দুটো এমন উসকোখুসকো লাগছে কেন ভাবতে ভাবতে মায়রা বাসায় ঢুকলো। আভা চোখের ইশারায় মায়রাকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে সেটা মায়রা বুঝতে পারলো না। কিন্তু বাসায় ঢুকেই কেন জানি সোফার দিকেই চোখ চলে গেল মায়রার। আর যা দেখলো তার জন্য মায়রা একদমই প্রস্তুত ছিল না। সোফায় সীমান্ত বসে আছে। কিন্তু সত্যি লোকটা বসা নাকি ভয় আর চিন্তা সব মিলিয়ে লোকটাকে স্বপ্নে দেখছে সেটাই মায়রা বুঝতে পারছে না। একটু পরেই মায়রার ঘোরটা কাটলো যখন সীমান্ত এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে মায়রার হাত ধরে টেনে রুমের দিকে নিয়ে গেল। মায়রা কেমন ঘোরের মাঝেও পিছন থেকে সামি আর আভার সীমান্তের নাম ধরে ডাক শুনে পুরোপুরি নিশ্চিত হলো যে এটা স্বপ্ন না। বাস্তব। এবং সামনে এই বাস্তবটা আরো ভয়ংকর হতে চলেছে সেটা বুঝতে খুব একটা সময় লাগলো না মায়রার।
মায়রার ঘোর কাটতে কাটতেই সীমান্ত ওকে রুমে এনে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। মায়রা পড়ে যেতে যেতেও নিজেকে সামলে নিয়ে সীমান্তের দিকে ফিরলো।
-তুমি কখন এলে------?
মায়রা সীমান্তের দিকে তাকিয়ে কথাটা শেষও করতে পারলো না। বিদ্যুৎ বেগে সীমান্তের হাতটা ঠাটিয়ে চড় বসিয়ে দিলো মায়রার গালে। চড়টা এতোটাই জোরে ছিল যে মায়রা এবারে আর ব্যালেন্স রাখতে না পেরে ছিটকে পড়লো খাটের এক কোণায়। কপালের বেশ খানিকটা কেটে রক্ত পড়া শুরু হলো মায়রার। সীমান্ত এগিয়ে এসে মায়রার হাত চেপে ধরতেই মায়রা সীমান্তের রক্ত লাল চোখ মুখ দেখে বেশ ভয় পেল। সীমান্ত মায়রাকে এতো শক্ত করে ধরেছে যে মায়রার মনে হলো হাতটা ভেঙ্গে যাবে।
-আহ! সীমান্ত? কি করছো? ব্যথা পাচ্ছি আমি----।
-এতো রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি তুই? হ্যাঁ? একেবারে মোবাইল অফ করে দিয়ে--! বাহ! গেট টুগেদারের নাম করে কার কাছে গিয়েছিলি? ভেবেছিস আমি জানতে পারবো না কিছু? আমি আজ হুট করে না এলে যে তুই নিজের রঙ তামাশা চালিয়ে যাচ্ছিস জানতেই পারতাম না--।
-চুপ করো সীমান্ত। বাজে কথা বলবে না একদম---।
-এই? কি বাজে কথা রে? কি বাজে কথা? আমি চাই নি তুই আসিস--। এটা জানতি না? তবু তোর মামা মামি যাতে মনে কষ্ট না পায় তাই কিছু বলি নি--। আর তুই কিনা এখানে এসে--রাত অব্দি আড্ডা মারছিস। আর কি কি করছিস আল্লাহ ই ভালো জানে---।
-মুখ সামলে কথা বলো সীমান্ত।
মায়রার কথাটা শুনে সীমান্ত এবারে আরো জোরে থাপ্পড় বসালো মায়রার গালে। আবার টেনে নিয়ে মায়রার গাল টিপে ধরে চোখে চোখ স্থির করলো লোকটা।
-আমি মুখ সামলাবো? আর তুই? যা ইচ্ছে করে বেড়াবি? আজ রাত করে ফিরছিস কাল হয়তো কার সাথে রাত কাটাবি---।
-সীমান্ত?
-গলা উঁচিয়ে একদম কথা বলবি না তুই। এতো গলার জোর দেখাচ্ছিস কি করে তুই? লজ্জা করে না তোর এতো রাত করে ফিরে আবার আবার চোখে চোখ রেখে গলাবাজি করছিস?
-আমি মানছি ফিরতে রাত হয়ে গেছে--। কিন্তু তার মানে এটা না যে আমি---।
-এর কি মানে সেটা তোর ব্যাখ্যা না করলেও আমি বুঝতে পারছি--। এই জন্যই মামার বাসায় আসার এতো তাড়া এতো জেদ ধরে ছিলি না তুই? এখানে কেউ কিছু বলবে না--। উল্টো একেবারে মাথায় তুলে রাখবে--। বাহ! এদের লাই পেয়ে পেয়েই এমন হয়েছিস---।
-জাস্ট শাট আপ---।
-গায়ে খুব লাগছে না? খুব লাগছে? একে তো দোষ করেছিস তার উপরে আমাকেই মিথ্যেবাদী প্রমাণ করার চেষ্টা করছিস? গলা উঁচিয়ে কথা বললেই কি তোর কুকীর্তি সব ঢাকা পড়ে যাবে---।
-মোবাইলে চার্জ ছিল না তাই মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে সীমান্ত। আর অনেকদিন পর ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা। তাই গল্প করতে করতে সময়েরও খেয়াল ছিল না--।
-বাহ! দারুণ যু্ক্তি!
-আর এমন না আমি একাই ছিলাম সেখানে--। আমাদের ব্যাচের প্রায় সবাই ছিল সেখানে--। বিশ্বাস না হলে বাঁধনকে----।
- ও আচ্ছা। তা এখন এই ছোট বাচ্চাটাকে দিয়েও মিথ্যে বলাবি তুই? এতোটা নিচে নামতেও বাঁধলো না তোর? ছি!
-শোনো সীমান্ত--। তুমি যাই ভাবো না কেন সত্যটা বদলে যাবে না--। আর অবশ্য তোমার মুখে এমন কথা শুনে অন্তত আমার অবাক হওয়াটা হবে রীতিমতো গাধামি---৷ এর চেয়ে ভালো কিছু যে তুমি ভাবতেও পারবে না সেটাও আমার বুঝা উচিত ছিল---।
-কি বললি তুই?
- যা শুনলে তাই বললাম---। তোমার যদি মনে হয় আমি কয়দিনের জন্য মামা মামির বাসায় এসেছি বলে তুমি সেটা নিয়েও এসব আজেবাজে কাহিনী করে তাদের কাছে আমাকে ছোট করবে তাহলে তো আমার আর কিছুই বলার নেই তাই না?
-খুব কথা শিখেছিস না? এখানে এসে সাপের পাঁচ পা দেখেছিস? তোর এই মামা মামিই এসবের মদদ জোগাচ্ছে না? আজ তোকে আমি লাত্থি মেরে ফেলে চলে গেলে এরাও কাল তোকে মুলাবে না বুঝলি? সো বেশি বাড়াবাড়ি করবি না একদম মায়রা--। এটাই লাস্টবার বললাম।
-কার কাছে আমার জায়গা কোথায় সেটা খুব ভালো করেই দেখা হয়ে গেছে আমার সীমান্ত---। মামা মামি আমাকে দু পয়সার মূল্য দিক না দিক তাদের ঘরের এক কোণে পড়ে থাকলেও নিজের সম্মান নিয়েই বাঁচতে পারবো আজীবন----।
-বাহ! মাত্র সাত দিনেই তো দেখছি একেবারে আকাশ ছোঁয়া উন্নতি হয়ে গেছে---। তা পরের সিদ্ধান্তটাও বলে দে--। আমি বাড়িতে নাহয় সবাইকে জানিয়ে দিবো---।
-কিসের সিদ্ধান্ত?
-এই যে তুই ক্রান্তিকারি প্রতিবাদী নারীমুক্তিতে নাম লিখাচ্ছিস! এসব করলে তো আর আমার সংসারে তোর ঠাঁই হবে না বাবা--।
-ঠাঁই না হলে তো আর জোর করে থাকতে পারবো না--। কি আর করা?
-যা বলছিস ভেবে বলছিস তো?
-ভেবে ভেবে তো জীবনে অনেক কাজই করলাম--। এবার নাহয় না ভেবেই করি--।
-খুব বাড় বেড়েছে না তোর? খুব বাড় বেড়েছ? তোর এসব ডানা ছাটাই করা আমার দু মিনিটের ব্যাপার---।
সীমান্তের আরেকটা চড়ের দাপট সামলাতে না পেরে মায়রা আবার বিছানায় মুখ থুবড়ে পড়লো। এবারে মায়রারও জেদ চেপে গেল। সেও মুখ তুলে সোজা সীমান্তের মুখের দিকে তাকালো। সীমান্ত এতে আরো রেগে গিয়ে মায়রার চুলের মুঠি ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেললো। মায়রা সেখানেই শক্ত হয়ে বসে রইলো। নড়লোও না। একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না।
-বেশি ভালোবাসা দেখানোয় গায়ে চর্বি জমেছে তোর তাই না? এই এখন তুই আমার সাথে ঢাকায় ফিরবি--।
-আমি কোথাও যাবো না--। আর গায়ে একদম হাত দিবা না-। ছাড়ো-।
-গায়ে হাত দিবো না তাই না তাই না? ঠিক আছে দিলাম না--।
সীমান্ত মায়রাকে ধাক্কা দিতেই মায়রা আবার ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো। সীমান্ত মায়রার পড়ে গিয়ে উঠতে চেষ্টা করা দেখে একটু শব্দ করেই হাসলো। হাসতে হাসতেই কোমড়ের চামড়ার বেল্টটা খুলে হাতে পেঁচিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে এসে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে মায়রার পিঠে আঘাত করলো।
-গায়ে হাত দিবো না--। কেমন? এবার বল? যাবি এখন আমার সাথে?
-না---।
-কি বললি? শুনতে পাই নি--। আবার বল---।
-যাবো না আমি--। আহ---।
মায়রার প্রত্যেকবার 'না' বলা শব্দটার সাথে সাথে সীমান্তের চামড়ার বেল্টের হানা আঘাতটা যেন আরো বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু তবু মায়রা রাজি হলো না সীমান্তের কথায়। শেষে সীমান্ত নিজেই ক্লান্ত হয়ে থামলো।
-আজকে আমি একা গেলে কি হতে পারে সেটা তুই ভাবতেও পারছিস না।
-আর ভাবতে চাইও না--। একটা কথা মনে রেখো সীমান্ত। একটা মানুষটা এতোটাও ভয় দেখানো উচিত না যাতে তার ভয়টাই মরে যায়। আর যেখানে হারানোর ভয় থাকে না সেখানে বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মাঝে কোন পার্থক্যও থাকে না---।
-এক সপ্তাহ পর তোর এতো কনফিডেন্স কোথায় থাকে সেটাও আমি দেখবো--। ফিরে যাওয়ার জন্য যদি আমার পায়ে এসেও পড়িস তবুও সেদিন তোর দিকে মুখ ফিরিয়েও তাকাবো না। কথাটা মনে রাখিস---।
-প্রার্থনা করি যেন সে দিনটা আসার আগে আমার মৃত্যু হয়।
সীমান্ত বেল্টটা ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আর মায়রা সারা গায়ে ব্যথা নিয়ে ফ্লোরেই ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে চোখের সামনে সব কিছুই আবছা হয়ে আসছে ওর। আর মনে হচ্ছে এখন মরে গেলেও খুব বেশি ক্ষতি হবে না। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই হাজার গুণে বেশি ভালো আর সম্মানের।