অচেনা অতিথি - পর্ব ৩৩ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


বাতাসি প্রচন্ড রেগে গিয়ে সাবিনাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিতে লাগলো।
অ্যার সেক্রেটারি হইয়া তুই কুত্তার সাথ লস? আজ থাইকা তোর চাকরি আর নাই। তুই অ্যার চোখের সামনে থাইকা বিদায় 'হ'।

দিনগুলো এভাবেই চলছিল। বাতাসি পিন্টুকে একদমই সহ্য করতে পারেনা। রোজ পিন্টুকে লইয়া তাহার ঝগড়া বাধিবেই।


তিতির মাঝ রাত অবদি পড়াশুনায় ব্যস্ত ছিল। আজ অনেকদিন হল মাহাদের সাথে তার দেখা নেই। আর একটা পরীক্ষা আছে। সেটা শেষ হলেই বর মহাশয়কে কাছে পাবে। সব পড়া রিভাইজ দিয়ে এক পা দু পা করে রুম থেকে বের হল। নিচে ডাইনিংরুমে অন্ধকারের মধ্য কেউ হাটাহাটি করছে।

তিতির কান দুটো খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করছে আসলে সেটা কি ছিল! এর মধ্য মজার একটা কান্ড বেঁধে গেল।

বাতাসি বিবি  কাউকে একটা জড়িয়ে ধরে চোর চোর বলে গায়ের শক্তি দিয়ে চিক্কুর দিল।

কামরান সাহেব তার আম্মাজানের এহেন কান্ড দেখে ভয়ে চমকে উঠলো। পিন্টুকে মারার জন্য একখান বড়ই সুন্দর লাঠি বানিয়েছিল বাতাসি। সেই লাঠি দিয়ে চোরের শরীরে বাতাসি গায়ের শক্তি দিয়ে মারলো এক বারি। তারপর একের পর এক বারি পড়তে লাগলো চোর বাবাজীর শরীরে।

সবাই যে যার রুমে তখনোও ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু আসমা আর সাবিনা ঘুম থেকে উঠে বাহির হয়ে আসলো। অন্ধকারের মধ্যই দাদী দাদী বলে কয়েকবার ডাকলো। কিন্তু বাতাসি এই জিবনে প্রথম চোর ধরেছে। সেটা কি চাট্টিখানী কথা!  এটা একটা গর্বের বিষয় তার জন্য।

কিন্তু বাতাসি অবাক হয়ে যায়। চোরকে যতই মারা হয় চোর সেটা প্রতিহত না করে উল্টো পিঠ নাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এমন তো হওয়ার কথা না! নিঃশ্চয় ভেজাল আছে।

অবশেষে তিতির লাইট জ্বালিয়ে যা দেখলো তাতে "থ" মেরে গেল। মাহাদের বাবাকে বাতাসি লাঠি দিয়ে মারছে আর তিনি তা সহ্য করতে না পেরে শুধু নেড়েই চলছে ম্যাইরের জায়গা গুলো। বেচারা টাওয়াল গায়ে জড়িয়ে পায়াচারী করছিল। পিটুনের ঠেলায় শরীর থেকে টাওয়াল খানাও সরে গেছে।

দাদী থামেন বলে তিতির জোড়ে বাতাসিরে ধমক দিল। ছেলেটাকে কি মেরে ফেলবেন! আপনি আচ্ছা মানুষ তো! তিতির এসে বাতাসির কাছ থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে শশুড়কে ধরে বাতাসির কাছ থেকে নিরাপদে দুরে সরে আনলো।

বাতাসি রেগে গিয়ে আবার তার শখের লাঠি খানা তিতিরের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনলো। এবার বাতাসির টনক নড়লো। তিনি এতক্ষন অন্ধকারের মধ্য চোরকে ধোলায় দিতেছিলেন।  কিন্তু স্পষ্ট আলোয় দেখলো চোরের জায়গায় তার নিজের ছেলেকে ধরে এতক্ষন পিটনের উপর পিটুন দিচ্ছিলেন। কিন্তু ধরা পইড়া উনি বুঝেও না বোঝার ভান করলো।

কামু, বাপ আমার তোরে কে এমন করে মারলো! বাতাসির তেজ এবার দেখে কে। কোন ফকন্নির বাচ্চা আর পুতের গায়ে হাত তুলেছে! কার এতবড় সাহস হইলো আর পুতের গায়ে হাত তোলা!

কামু তোরে লাবীবা মারছে! আজ তো ওর একদিন কি আর একদিন। থাম আই চোর ধরছি, আগে ঐডারে শায়েস্তা করে আসি তারপর তোর বৌয়ের বিচার করুম।

বুড়ীর এহেন কর্মকান্ডে তিতির সহ সবাই বেক্কেল হয়ে গেল। কামরান আধো কান্নার সুরে বলল," আম্মাজান, আর আমার সম্মান হানী করেন না। এই বুড়ো বয়সে মায়ের পিটুন খাওয়া, সেটা নিঃশ্চয় গর্ব করার বিষয় নয়! আপনি চিৎকার চেঁচামেচি করে আর সবাইকে জানান না।"

বাতাসি ওর হাতের লাঠি খানা দুরে ছুড়ে মেরে হা হইয়া দাড়িয়ে রইলো। লাঠিটা এমন করে ছুড়ে মেরেছে যেন মনে হয় সে কিছুই করেনি।


দাদী কইলেন না! কোন ফকন্নি আন্নের পুতরে মারছে! বাতাসি ফকন্নি আমাগো সাহেবরে এই রকম ধোলায় দিছে বলে সাবিনা ফিঁক করে হেঁসে উঠলো। 

ঐ ছুড়ি মুখ সামাল দিয়ে কথা ক। আই ফকন্নি!  তুই ফক্কনি বলে সাবিনার সাথে লেগে পড়লো বাতাসি। তার ছেলে যে কষ্টে মরে যাচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। তার ইজ্জতের উপর হামলা হয়েছে। তাকে ফকিন্নি বলা হয়েছে সে কি সহজে ছাড়বে?

তিতির ওদের দিকে নজর না দিয়ে ফ্রীজ থেকে একটা বাটিতে বরফ নিয়ে এসে বলল," আঙ্কেল কোথায় লেগেছে আমাকে বলেন আমি সেখানে বরফ দিয়ে দিচ্ছি।

কামরান সাহেব অত্যান্ত লজ্জা পেয়ে বললেন, আমি ঠিক আছি বাবা। তোমার না কাল এক্সাম! তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

কালকের জিনিস কাল দেখা যাবে বলে শরীর থেকে টাওযালটা খুলে পিঠে বরফ দিয়ে দিতে লাগলো। এটা মা, না অন্য কিছু! এত বড় ছেলের গায়ে এভাবে হাত তোলে কেউ! এই বুড়ো বয়সে এত শক্তি আসে তার কোথা থেকে!
এদিকে কামরান সাহেব কিছুটা আরাম পেয়ে চোখ বন্ধ করল। 

"আঙ্কেল, এত রাতে আপনি এখানে হাটাহাটি কেন করছিলেন?"

তিতিরের কথা শুনে কামরান চোখ বন্ধ করেই বলল," আসলে কি বলি বলতো! পা টা খুব ব্যাথা করছিল।  ডায়েবেটিকস হয়ত বেড়ে গেছে। তাই ব্যাথাটা আবার বেড়ে গেছে। ঘুম আসছিলো না। রুমে পায়াচারী করলে তোমার আন্টি জেগে যেত তাই নিচে এসে একটু পায়াচারী করছিলাম।

♦♦♦♦

বাতাসি সাবিনাকে সাবান শোটা ছাড়াই ধুয়ে দিচ্ছে সাথে আসমাকেও। কিন্তু সাবিনা তো আর কম জানেনা! 

দাদী, দেহেন অ্যারে আর কথা হুনাইতে আইবেন না। আই আন্নের চাকরি ইস্তাফা দিছি। অ্যার সাথে না লাইগা ঐ দিকে চাইয়া দেহেন, সাহেবের কি কষ্ট হইতাছে। আন্নে কেমন মা হেইডা দেখা হইয়া গেছে। নিজের পোলারে কেউ এই রকম  রাত দুপুরে চোরের মত করে মারে! আন্নে জানেন না! এই বাড়িতে কতগুলো চৌকিদার আছে। তারা থাকতে বাড়িতে চোর ঢুকবে?


বাতাসি আর কোন কথা না বলে কামরানের কাছে এসে বলল," অ্যার বাপ, অ্যার সাত রাজার ধন, তোর কই লাগছে বাপ! আরে ক বলে তিতিরের কাছ থেকে বরফের বাটি কাইড়া লইয়া বাতাসি নিজে বরফ দিতে লাগলো আর কামরানের মাথা নাড়তে লাগলো।


তিতিরও বসে রইলোনা। ওর শশুরের  পায়ের কাছে বসে পা টিপে দিতে লাগলো।

" এই বাবা, কি করছো বলে পা সরিয়ে নিল কামরান।"

" আঙ্কেল দেনতো বলে তিতির জোড় করে পা টিপে দিতে লাগলো।"

বাতাসি কিছু আর বলল না। কিন্তু কামরান তার মাকে বললো," আম্মাজান, আমার যদি তিতিরের মত একটা মেয়ে থাকতো তাহলে সেও এমন করে আমাকে শাসন করে এভাবে সেবা করতো তাই না?"

কামরানের কথা শুনে বাতাসি রেগে আগুন হয়ে গেল। নিকুচি করছি তোরে বরফ দেওয়া বলে বরফগুলো ছুড়ে মারলো ফ্লোরে। তারপর আরও দু'ঘা কামরানের পিঠে মেরে বলল, " এখনো সময় আছে, বউরে পোয়াতি বানা। দোয়া করি তোর বউ যেন একসাথে পাঁচটা মাইয়া জন্ম দেয়।"

কামরান তার আম্মাজানের এমন কথা শুনে তিতিরের সামনে অত্যান্ত লজ্জা পেল। তার আম্মাজান এই টুকু মেয়ের সামনে এত বড় লজ্জার কথা কিভাবে বলতে পারলো। 

তিতির হা করে বাতাসির দিকে চেয়ে রইলো। এ মানুষ না অন্য কিছু! তিতির সেটাই বুঝতে পারছেনা।
 এমন পরিস্থিতির স্বীকার সে কখনো হয়নি। না পারছে উঠে যেতে না পারছে বসে থেকে কাজ করতে।

বাতাসি জোড় গলায় কড়া ভাষায় বললো, আজই মাহাদরে কইবো তোর আরও ছাওয়াল পাওয়ালের দরকার। জলদি ওগরে খুঁশির খবরখানা দিইয়া দে। লাবীবাকে দিয়ে না হলে প্রয়োজনে তোরে আবার একখান বিয়া দিমু। তারপর যত মাইয়া তোর লাগবে তত মাইয়া পয়দা করবি।

তিতির আর থাকতে পারলো না। চট করে উঠেই আধা দৌড় দিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো। ও থাকলে আরও কথা শুনাবে বাবাকে।

তিতিরের চলে যাওয়া দেখে কামরানও উঠে দাড়ালো। এখানে থাকা আর সম্ভব না। তার মা যে সবার সামনে তার নাক কেটে দিবে সেটা তার আর বুঝতে বাঁকি রইলো না। নাক কাটবে কি, একেবারে ছোট ছোট তিনটা হাঁটুর বয়সী মেয়ের সামনে অলরেডি নাকের বলি দেওয়া হয়েছে। কামরান সাহেব আর কোন টু শব্দ না করে উপরে নিজের রুমে চলে গেলেন।

♦♦♦

আজ তিতিরের শেষ পরীক্ষা ছিল। এই কয়েকদিনে তার একটা বান্ধবী হয়েছে। নাম তার রেনু। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। তিতির পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে রেনুর জন্য অপেক্ষা করছিল। রেনু অন্য ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী। রেনু বের হয়ে আসলে তিতির ওর সাথে কথা বলতে বলতে সিড়ি দিয়ে নামছিল।

" তিতির, আর হয়ত তোমার সাথে তেমন যোগাযোগ হবেনা। তোমার নাম্বারটা কি দিবা? মাঝে মধ্য কল দিতাম।"

" তিতির একটু চুপ করে রইল। মাহাদের নিষেধ আছে কাউকে নাম্বার দেওয়া। রেনু,  তোমার নাম্বারটা দাও। আমি সময় করে কল দিব।"

" রেনু খুশি হয়ে ওর নিজের নাম্বারটা দিয়ে বলল, তিতির আমার সাথে এক জায়গায় যাবে! আজ নয় দু'দিন পরে।"

" কই যাবা?"

" একটা জবের ইন্টারভিউ আছে, সেখানে যেতাম আরকি! আমার বড় ভাই নাই তো! তাই বললাম।"

" তোমার পরিবারতো যথেষ্ঠ ভালো তবুও তুমি এখন জব করতে কেন চাচ্ছো! স্ট্যাডি শেষ করো! তাছাড়া পড়ালেখার ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা আছে।"

" এবার রেনু কেঁদে ফেলল। তিতির, আমাদের মানুষ যা দেখে তা কিন্তু সত্য না। হাজারো কষ্ট চাপা দিয়ে মুখে হাঁসি ফুটিয়ে আমাদের থাকতে হয়। মৃত্যুর যন্ত্রনা কতটা কঠিন সেটা হয়ত আমার জানা নাই। কিন্তু নিজের আপনজনের দেওয়া কষ্টগুলো পৃথিবীর সবথেকে ভয়াভয় এবং কঠিনতম কষ্ট।"

" তিতির রেনুর কথায় চুপ করে রইলো। তিতির ভালকরে যানে, বাবা-মায়ের দেওয়া কষ্টগুলো প্রচন্ড শক্তিশালী হয়। যা মানুষের প্রতিটা শিরা- উপশিরায় আঘাত করে। তখন চারদিকে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না। সেই অবস্থায় থেকে কেউ বের হয়ে আসতে পারে কেউ পারেনা। 
আবার কেউ মনে করে মৃত্যুই একমাত্র তার মুক্তির পথ। কিন্তু সেটা জিবনের সবচেয়ে ভুলপথ। আমাদের পৃথিবীতে পরীক্ষা নেওয়া হবে। আমরা যেখানেই থাকিনা কেন আর যে অবস্থায় থাকিনা কেনো, আমাদের জন্য নির্ধারিত কষ্টগুলো আমাদের পিছু পিছু ধাওয়া করবেই। আর সেই কষ্টগুলোকে ধর্য্য সহকারে মোকাবেলা করার নামই জীবন।" 

দু'জনের মধ্য অনেক কথা হল। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে তাই তিতির রেনুকে বিদায় জানিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে বাসার পথে রওনা দিল।

বাসায় এসে যা দেখলো তা ওর কল্পনার বাহিরে। মাহাদ নিধিকে নিয়ে বাসায় ঢুকছে। আল্লাহ্ মাবুদ ভালো জানে মাহাদ আজ কি করতে চলছে।

♦♦♦♦

মাহাদ নিধিকে কোলে করে বাসার ভিতর ঢুকতেই সাবিনা মাহাদের কাছে এসে বলল," ভাইজান, এই ছোড মাইয়াডা কে?"

" আমার মেয়ে বলে মাহাদ নিধিকে নিয়ে ওর রুমে চলে গেল।"

" অহ্ আল্লাহ্ গো ভাইজান বিয়া করছে? তার আবার এতবড় মাইয়া আছে? আসমা বুবু অ্যারে ধরো। অ্যার মাথা ঘুরতাছে।"

আসমা নিজেও অবাক হয়ে গেছে মাহাদের এমন কথাবার্তায়। এর মধ্য তিতিরও বাসায় এসে হাজির হতেই সাবিনা গিয়ে সব কথা খুলে বলল তিতিরকে।

আসমা বার বার চোখ দিয়ে সাবিনাকে নিষেধ করা স্বত্ত্বেও সাবিনা মুখে দিয়ে সব কিছু বলে দিল তিতিরকে।

তিতিরও একটু আগে সব কিছু দেখেছে। তিতিরের এখন চিন্তা হচ্ছে, বাসায় ব্যাপারটা কেমন করে নিবে। টেনশনের আর শেষ নাই।  মনে হয় বর মশাইয়ের মনেই নেই, তার বৌয়ের  আজ শেষ এক্সাম ছিল। কোথায় একটু তাকে নিয়ে সময় কাটাবো তা না!  উনি এমন কাজ করেছেন এখন মনে হচ্ছে এই বুঝি বড় রকমের ঝড় বাসায় এলো বলে।

♦♦

মাহাদ নিধিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে কিছু চকলেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফ্রেস হতে গেল। কিছুক্ষন পরে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো নিধি রুমে নেই। মাহাদ টাওয়ালটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে নিধি বলে কেবল ডাকতে যাবে এমন সময় শুনলো নিধি পিন্টুকে নিয়ে খেলা করছে।

উফ্ বলে একটা হাফ ছেড়ে মাহাদ ব্যালকুনিতে এসে দাড়ালো। নিধি পিন্টুকে নিয়ে মজা করতে ব্যস্ত রয়েছে। মাহাদকে দেখে নিধি বলল," চাচ্চু, এর নামকি! একে আমি কি বলে ডাকবো?

"ওর নাম পিন্টু, ওকে তুমি পিন্টু বলেই ডেকো।"

" চাচ্চু, আমায় ওকে দিবা?"

" না মা, ও অন্যজনের আমানত। আমার কাছে ওকে রাখতে দিয়েছে। মাহাদ নিধির হাত ধরে রুমে নিয়ে আসলো। সাথে সাথে পিন্টুও চলে আসলো।

♦♦

বাসায় তখন সবার কাছে খবর পৌছে গেছে। মাহাদ একটা ছোট্ট মেয়েকে বাসায় এনেছে। ওটা নাকি তার মেয়ে। 
কামরান সাহেব সহ বাসার সবার  চোখ তখন মাহাদের দরজার দিকে। মাহাদ দরজা খুলে নিধিকে নিয়ে বের হতেই সাথে সাথে সবাই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে যে যার কাজে মনযোগ দিল। সবাই এমন ভান করলো যেন মনে হয় তারা কিছুই জানেনা।

এমন সময় তিতির কেবল গোসল সেরে কিছু খাওয়ার উদ্দেশ্য রুম থেকে বের হয়েছে ওমনি নিধি ওকে দেখতে পেয়ে চাচী আম্মু বলে চিক্কুর দিয়ে ডাক দিল।

তিতিরের তো জিবন আসা যাওয়া অবস্থা। চট করে আবার রুমের ভিতর ঢুকে পড়লো। আল্লাহ্ এতো দেখছি মসিবতের শেষ নাই। এই মেয়ে বাসায় থাকিতে যে তিতিরকে রুম থেকে একদম বের হওয়া যাবেনা সেটা তিতির হারে হারে টের পেল।

মাহাদ সাথে সাথে নিধির মুখ চিপে ধরলো। মা কেন ঝাঁপি থেকে সাপ বের করতে যাচ্ছো? এখানে তোমার চাচীআম্মু কই থেকে আসবে! মাহাদ নিধিকে কোলে নিয়ে নিচে নেমে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো। কামরান সাহেব তখন সন্ধার নাস্তা সারছিলেন। বাতাসি বিবিও মাহাদের পাশে এসে ঘোর চোখে নিধির দিকে চেয়ে বলল," ঐ মায়াটা কে রে?"

" তোমার আর আমার সন্তান। এর মধ্য ভুলে গেলে?"

" বাতাসি আর কোন কথা না বলে কেবল কেকে হাত দিবে এমন সময় নিধি ওর বাম হাত দিয়ে কেকটা তুলে নিজের পাতে রেখে বলল," আমি এটা খাবো।"

বাতাসি চোখ বড় বড় করে নিধির দিকে চাইয়া কইলো, " ঐ মাইয়া, আর খাওনে তুই কোন সাহসে হাত দিস! আর খাওন দে কইচি!"

" দাদী ছোট বাচ্চার সামনে ভদ্র ভাষায় কথা বল। ওদের সামনে যা বলা হয় তাই দ্রুত শিখে ফেলে। তাই ভাষাটা মার্জিত করো।"

" কি, আই কতা কইতে জানিনা! তুই কতা কইতে জানোস না, তোর বাপ -মা সগ্গলে কতা কইতে জানেনা। উমহ্ আরে কতা কইতে শিকাইতে আইছে।"

" তোমারে আর কথা আমি কি শিখাবো বল! তুমিতো নেপোলিয়ন মামুর নানী হও। তোমার ভিতর কি শিক্ষার অভাব আছে নাকি। তুমি সর্বসেরা শিক্ষিত।"

" মাহাদ আর বাতাসির মধ্য শিক্ষিত আর অশিক্ষিত নিয়ে চুল চেরা বিশ্লেষণ চলছে আর এদিকে নিধি কামরান সাহেবের প্লেটের দিকে চেয়ে আছে। ডায়াবেটিস রোগী তিনি। নোনতা বিস্কিট আর চা দিয়ে তার নাস্তা কমপ্লিট করছেন। এই নোনতা বিস্কিট গুলো নিধি কখনো দেখেনি তাই কামরান সাহেবের প্লেটের দিকে হাত বাড়াতেই কামরান সাহেব খপ করে হাতটি ধরে ফেলল। অমনি নিধি অন্য হাতে বিস্কিট তুলে নিয়ে নিজের প্লেটে রাখলো।

নিধির এই বয়সে এমন বুদ্ধিমত্তা দেখে কামরান সহ লাবীবা ও রুপালী হতবাক না হয়ে আর পারলো না।

রুপালী তো হাঁসতে হাঁসতে শেষ। হাঁসি থামিয়ে বলল," মাহাদ এই বাচ্চাটা কে রে!
এর স্বভাবতো আম্মাজানের মত। নানীর কাছ থেকে শুনেছি, আম্মাজান ছোট থাকতে নাকি ছোচনার মত অন্যর প্লেট থেকে খাবার চুরি করতো। 

রুপালীর কথা শুনে বাতাসি একদম চুপ মেরে গেল। আর মাহাদ চোখ বড় বড় করে বাতাসির দিকে চেয়ে রইলো।

"ঐ অ্যার মুখের দিকে তাকাইয়া কি দেহস্! আরে কি কোনদিন দেহেসনি?"

মাহাদ গলা ঝেড়ে বলল," তোমার যে এমন গুন ছিল সেটাতো জানা ছিল না! আর কি কি করেছ বলতো?

বাতাসি এবার ক্ষেপে গিয়ে রুপালীর দিকে চেয়ে বলল," শত্রু পয়দা করছি। ঐ বিয়াদপ, অ্যার মা কোন কালে তোরে কইছে আই ছোচনা ছিনু! 
আর একটা উল্টা-পাল্টা কথা কইছোস তো তোর পিঠেই পিন্টুউল্যার লাডি খানা ভাঙ্গমু। কামুরে জিগা আর পিটুনের স্বাদ কি রকম।"

বেচারা কামরান তার বড় আপার দিকে করুন মুখে চাহিয়া ঘাড় নারিয়া না না বলিয়া সাবধান করিয়া দিল। কারন গতরাত্রে তাহার সাথে যা ঘটেছে সেটা পুনরায় তার বড় আপার সাথে যেন না ঘটে।

ছোট ভাই কামরানের ইশারায় রুপালী মুখে কুলুপ এঁটে চুপ করে রইল। তার মা যে মানুষ, এই বয়সে যদি ছেলে আর ছেলের বৌয়ের সামনে পিঠে লাঠির বাড়ি পড়ে তাহলে মানসম্মানের ছিটাফোঁটাও আর থাকবেনা। 

এমন সময় লাবীবা হাসতে হাসতে বলল, " আমার এমন শাশুড়ীকে পেয়ে আমি নিজেকে খুব গর্ববোধ করি। এই বয়সে এসেও তিনি সন্তানদের শাসন করেন। ক'জন এমন মা আছে যে অন্যায়কে প্রশয় দেয়না!

এবার বাতাসি খুঁশিতে ডগমগ হয়ে কহিল," ২৫ খানা মাইয়া দেইখ্যা এমন একখান বৌমা আই জোগাড় করছি। দেখতে হবনা! কার পছন্দ।"

এর মধ্য সাবিনা টুপুস করে কহিল, " আম্মা আন্নে জানেন কিছু! কাল দাদী আমাগো সাহেবরে আর একখান বিয়া দিতে চাইছিলো........."

এবার যা ঘটলো তাতে বাতাসির রাজত্ব ঠাস্ করিয়া ভেঙ্গে পড়লো। বাতাসির এখন মনে হচ্ছে তার সামনে লাবীবা দাড়িয়ে নেই। দাড়িয়ে আছে এক জল-জ্যান্ত বাঘিনী। যাকে দেখিয়া এই প্রথম বাতাসি ডড়াইলো।  লাবীবা কঠোর চোখে বাতাসির দিকে চেয়ে আছে আর মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই গুলি ছুড়ছে। আর বাতাসি নিজের প্লেট খানা দিয়ে চোখমুখ ঢাকিয়া পগাড়  পার হওয়ার চেষ্টা করিতেছে। আহ্ কি দৃশ্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন