আমার একটাই যে তুই - পর্ব ১৬ - সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি - ধারাবাহিক গল্প


৫ বছর পর...!

ইউসুফ তার ব্যালকনিতে বসে ড্রিংক্স করছে। চারিদিকে ভোরে আভা ফুঁটে উঠছে। তা দেখে হেসে ফেললো সে। জড়িয়ে আসা কন্ঠে বলল,,

--"আরোও একটি রাত ঘুমহীন কেঁটে গেল আমার! এসবি চাইছিলে তাই না বাবুইপাখি!  বলে ছিলে না ভালো থাকতে? দেখে আমি ভাল আছি! তোমাকে ছাড়া খুব খুব ভাল আছি। একদম ফিট এন্ড ফাইন্ড।"

এসব বুলি আওড়াতে আওড়াতে ঢুলুঢুলু শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। নেশাটা আজ বেশি করে ফেলেছে।  পা দুটো এদিক ওদিক চলছে। এ বুঝি পড়েই যাবে। দু এক বার পড়েও যেতে নেয়। তাও সামলে হেসে দেয়। বলে,

--"দেখ বাবুইপাখি!  আমি নিজেকে সামলে নিতে শিখেছি।খুব শিখেছি। তোমার আর দরকার নেই।  নেই দরকার।"

বলতে বলতে নিজের শরীর বেডের উপর ছেড়ে দিল। চোখ বুঝে উল্টো হয়ে শুয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর চোখ দিয়ে তার শিশির কণার মতো বিন্দু বিন্দু মুক্ত দানা পড়তে লাগলো তার চোখ দিয়ে! বিড়বিড় করে শুধু বলল,,

--" আমার সামনে কখনো এসো না বাবুইপাখি!  আমি তোমাকে জানে মেরে দিবো! তারপর নিজে মরে যাবে। এসে না আর সামনে। কখনো না!"

এসব কিছু দরজার আড়াল থেকে দেখে ডুকরে উঠছে ইউসুফের মা। সত্যি বড় ভুল সে করেছে। কুহুকে দূর করে নিজের ছেলের অধঃপতন স্বচক্ষে দেখছে।এ ৬ বছরে কতই না খুঁজেছে কুহুকে।  কিন্তু কুহু যেন গায়েবই হয়ে গেছে। কেউ কোনো খোঁজ আর দিতে পারেনি!কুহুকে শুধু আর একটি বার ফিরে পেত? তার ধরতো ফিরে আসার জন্য। তাতেও না মানলে পা ধরবে তারপরও না আসলে তুলে আনবে। তাও কুহুকে আসতেই হবে তার ইউসুফের জন্য। কিন্তু কথা হচ্ছে? কুহু কই? এতটা বছরে কুহুর কোনো খবর কেনই বা তারা পাচ্ছে না????
____________________________________________

--"খালা কায়া কোথায়? ওর ডিউটি কিছুক্ষন পর!"

--" জে জয়ীতা আফা! আমি দেখতেছি।"

--" মেয়েটাকে নিয়ে আর পারিনা!" 

--" আমিও তো তোমাকে নিয়ে পারিনা!" ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো বলল প্রিজম!

জয়ীতা প্রিজমকে দেখে ভ্রু কুচকালো। রাগি কন্ঠে বললো,,

--" ডাঃ প্রিজম? হোয়াট আর ইউ ডুইং হেয়ার? কাজ নেই আপনার? গো?"

প্রিজম হেসে দিল। তা দেখে গা জ্বলে উঠলো জয়ীতার।  দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

--"হাসচ্ছেন কেন? হাসার মতো কিছু বলেছি? খবরদার আর হাসবেনা না।"

প্রিজম বুঝলো জয়ীতা সত্যি রেগে আছে। অসহায় ফেস করে বলল,,

--"আম সরি না! আমি সত্যি কিছু করি নাই! আমি পুরোই নির্দোষ! বি..."

কথার মাঝেই থামিয়ে দিলো জয়ীতা হাত দেখিয়ে।  চোখ মুখ শক্ত করে বলল,,

--"আমি কারো কাছে কোন সাফাই চাইনি!  সো ইউ কেন লিভ নাও।"

মুখটা ছোট হয়ে গেল ডাঃ প্রিজমের।তা দেখে বুক ফেঁটে যাচ্ছে জয়ীতার। এমনটি তো সে চায় নি! তাহলে!চোখ টলমল করছে তার। ছোট শ্বাস ফেলে বেড়িয়ে যেতেই প্রিজম। হু হু করে কেঁদে দিলো সে!

তখনি রুমে ঢুকে কায়া। জয়ীতাকে দেখে বিচলিত হয়ে জিগ্যেস করে,,

--" জয়ী মেম আপনি কাঁদচ্ছেন কেন? আর ইউ ওকে?ডাঃ প্রিজমকেও দেখলাম মুখ ভাড় করে আছেন? কিছু হয়েছে?"

জয়ীতা এবার হাউ মাউ  করে কেঁদে দেয়ে। কায়া কি করবে বুঝতে পারছে না। শান্তনা দিয়ে যাচ্ছে শুধু।কায়ারো খারাপ লাগচ্ছে।হসপিটালের লাভ বার্ড নামে দুজনের পরিচিতি আর তাড়াই দিন রাত লড়েই যাচ্ছে! 

--" জয়ী মেম প্লীজ সে সামথিং? "

জয়ীতা তাকালো কায়ার দিক বললো,,

--" হি চিট মি!"

বলে আবার কেঁদে দিলো। কায়া অবাক হয়ে বললো,,

--" কি বলছেন এসব! ডাঃ প্রিজম মোটেও এমন না। হয়তো আপনার কোথাও ভুল হয়েছে!"

--" না হয় নি! আমি ওকে সেদিন বেসমেন্টে দেখেছি! কারো হাত ধরে কথা বলতে!"

--" মেম হয়তো দেখেছেন! কিন্তু এমনটিও হতে পারে যা দেখেছেন ভুল! অনেক সময় আমরা চোখে যা দেখি তা সত্য নাও হতে পারে!"

জয়ীতা মাথা নত করে রইলো। কায়া আবার বলল,,

--" মেম আপনাদের বিয়ে হতে চলেছে! এখনই মনে সন্দেহ ঢুকে গেলে পুরো লাইফটা হেল হয়ে যাবে। প্লীজ মেম লেম লেম বিষয় না ধরে ভাইয়ার সাথে বসে সর্ট আউট করে নিন। নয়তো আপনি আর ডাঃ প্রিজম দুজনি জ্বলবে সারাজীবন। "

জয়ীতা চকিতে তাকালো। কায়া মাথা নাড়িয়ে আসত্ত   করল।  জয়ীতা এবার হেসে জড়িয়ে ধরলো কায়াকে। বলল,,

--"সত্যি কায়নাত তুমি আমার চোখ খুলে দিলে! আমি এখনি ওর সাথে কথা বলছি!"

--" গো!"

কায়া হেসে বলল! জয়ীতা দৌড়ে গেল।প্রিজমকে সরি বললো। রাগ ভাঙ্গাতে চেষ্টা করলো। দূর থেকে কায়া তাদের খুনসুটি  দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো! এক সময় তার লাইফেও ভালবাসা ছিল। এমন ভাবেই খুনসুটি চলতো! আজ মানুষটি নেই তার কাছে! কেমন আছে জানা নেই তার।আর এ দুটো ব্যাক্তির মাঝে তাদের ভালবাসা খুঁজে পায় কায়া। মানুষটির কথা ভাবতেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো তার। চোখে জল মুছে পা বাড়ালো বাচ্চাদের ওয়ার্ডে। তার ডিউটি শুরু।
____________________________________________

প্রতিদিনের মতো আজ ঘুম থেকে উঠায় অদ্রি ইউসুফকে! ছোট ছোট পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ইউসুফের ঘরে এসে পিঠের উপর বসে পড়ে গালে চুমু খেয়ে বলতে থাকে তার আধ ভাঙ্গা বুলিতে,,

--" বলো পাপা উলো! সকল হইছে। উলো। "

অদ্রির  ছোঁয়া পেতেই ঘুম ছুটে গেছিল তার। অদ্রিকে দেখে হেসে দেয় বলল,,

--" গুড মর্ণিং আমার আম্মুটা!"

--"গুল মনিঙ! চলো লেডি হও। তোমাল নাকি মিনিন আছে! তামান্না আন্টি আসচ্ছে!"

ইউসুফ হেসে ওকে আদর করে উঠে পরে বলে,,

--"থ্যাংক ইউ আম্মু! "

বলে ফ্রেশ হতে চলে যায়। রেডি হয়ে অদ্রিকে নিয়ে নিচে আসতেই ইউসুফের আম্মু এসে বলল,,

--"বাবা নাস্তা করে যা! তোর পছন্দের নাস্তা বানিয়েছি!"

ইউসুফ কাঠ কাঠ গলায় বলে,,

--"খাবো না! তামান্না চলো!"

বলে চলে গেল। ইউসুফের মা কেঁদে দিল। আর কতদিন চলবে এসব। তামান্না কাঁদে হাত রেখে বলে,,

--"মেম ডোন্ট ক্রাই সব ঠিক হয়ে যাবে!"
____________________________________________

কায়া ডিউটি শেষে রুমে আসতেই ডাঃ আশিক তাকে খবর পাঠায় যেতে। সারা রাত ডিউটি করে শরীর অনেক ক্লান্ত।  যেতেই ইচ্ছে করছে না। ধুপ করে বেডে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু যেতে তো হবেই। কাপর পাল্টে ডাঃ আশিকের কেবিনে গেল। যেখানে তার ক্লাসের অনেকেই উপস্থিত!  ডাঃ জয়ীতা আর প্রিজম ও।  সে যেতেই ডাঃ আশিক বলতে শুরু করলো,,

--" গাইস! ময়মনসিংহ মেডিকেলে একটা ক্যাম্পিং হবে রাজশাহী সহ সকল বিভাগের স্টুডেন্টদের সেখানে পাঠানো হবে। আমাদের এখান থেকে আপনাদের পাঠানো হচ্ছে! আজ রাতেই রওনা করবো আমরা ঠিক ১৫ দিনের জন্য।  সো ব্যাগ প্যাগ রেডি করে ফেলুন। রাত ৮ টায় বাসে উঠবো আমরা। আর...!"

এমন আরো কথা ডাঃ আশিক বলতে লাগলো। যা কান পর্যন্ত পৌঁছালো না কায়ার! হাত পা কাঁপচ্ছে। চোখ দুটি টলমল করছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হচ্ছে তার মাথায়। কাঁপা কাঁপা ঠোঁট দুটি নাড়িয়ে শুধু বলল,,

--"ম..য়...ম...ন..সিং..হ! "

—————

শূন্য দৃষ্টিতে টলমল করে সামনের দিক তাকিয়ে আছে কায়া। এই বুঝি টপটপ করে পড়তে শুরু করবে চোখের পানি! যাদের কাছ থেকে এত দূর চলে এসেছিল, প্রিয় শহর ছেড়ে দিয়েছিল, সে শহরে আবার কিভাবে যাবে সে? এত বছর বুকে পাথর বেঁধে যাদের থেকে দূরে ছিল, এতে কাছে গিয়ে কি পারবে সে তাদের চোখের দেখা না দেখে থাকতে?এসব ভেবেই সুপ্ত ভাবে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। ব্যাগপত্র গোছানো শেষ। তখনি ডাকতে এলো খালা।

--" কায়া আফা সবাইরে নিচে গাড়ির কাছে যাইতে কইছে! "

কায়া হেসে বলল,

--" আসচ্ছি খালা।"
_____________________________

গাড়ি ভিতরে মোটামুটি সবাই ঘুমিয়ে আছে, ঘুম নেই শুধু কায়ার চোখ জোড়ায়। কেমন অস্থির লাগচ্ছে। শরীর কেমন রিম ঝিম করছে! মাঝে মাঝে অজানা ভয় কাঁটা দিচ্ছে গা খানায়। শীতের রাতে কুল কুল করে ঘেমে একাকার।তার এই অস্থিরতা দেখে পাশে বসে থাকা ডাঃ জয়ীতা বললেন,,

--" আর ইউ ওকে কায়া?  পানি খাবে? এভাবে ঘামচ্ছো কেন? খারাপ লাগচ্ছে কি!"

কায়া মাথার ঘাম মুছে হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,,

--" না না মেম! আম ওকে! গরম লাগচ্ছে তো তাই আ..র কি!"

ডাঃ জয়ীতা হেসে বললেন,,

--" লাগার কথা কায়া! তুমি যেভাবে নিজেকে ঢেকে রেখেছো তাতে আমার নিজেরি গরম লাগছে! ডাকাত লাগচ্ছে পুড়োই হা হা হা!"

কায়া চাপা হাসলো। ময়মনসিংহ গিয়ে পরিচিত মানুষের ক্ষপরে পড়তে চায় না তার জন্যই এ ব্যবস্থা করা। গাড়ি জালানা খুলে দিলো কায়া। বাহির থেকে আসা স্ব স্ব বাতাস যেন কায়ার শরীর,  মন ঠান্ডা করে দিচ্ছে! কিছুক্ষণ অনুভব করলো চোখ বুঝে মিষ্টি বাতাস। ঠিক তখনি ভেসে উঠলো সাজেকে বুড়ো বুড়ির ঘরে কাঁটানো সেই রাতটির কথা। কতটা কাছেই না ছিল তারা!  আর আজ কত দূরে।এ ভেবেই চোখ জল এসে গেল তার। গন্তব্য যত কাছে আসচ্ছে স্মৃতি গুলো যেন আরো বেশী আঁকড়ে ধরছে তাকে! 
__________________________________

ভোর---৫ঃ০০!

গাড়ি এসে থেমেছে ময়মনসিং মেডিকেল কলেজে। ময়মনসিংহের মাটিতে পা দিতে শিউরে উঠলো তার শরীর। ভয় ভয় লাগচ্ছে খুব। এখানের হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের।একে একে সবাই নেমে নিজেদের নির্ধারিত রুমে চলে গেল। রয়ে গেল কায়া। হাসপাতালে গেটে দাঁড়িয়ে দেখচ্ছে চারপাশটা। তখনি মনে কড়া নাড়লো ছোট একটি অতীত। এ হাসপাতালের আই সি ইউর সামনে ওয়েটিং রুমে সকল প্রকার সুখ বিসর্জন দিয়েছিল সে! সেদিন মামি তাকে কতটানা মার মেরেই ছিল! যার দাগ এখনো শরীর রয়ে গেছে! কিছু মুছেও গেছে! কিন্তু মনের মাঝে যে ঘা লেগেছিল তাকি এতো সহজে মিটে যায়??

--" কায়া এখনে কি করছো? ভিতরে চল!  অপরিচিত জায়গা বাহিরে একা থাকা ঠিক না।"

পিছন থেকে ডাঃ আশিকের কথায় ধেন ভাঙ্গে! হেসে বললো,,

--" জায়গাটা সুন্দর তাই দেখচ্ছি!"

ডাঃ আশিক নাক ছিটকে বললো,,

--" হাসপাতাল আর সুন্দর!"

কায়া হেসে দিল। মনে মনে বলল,,

--" নিজের মাতৃভূমি সবার কাছেই প্রিয়  ডাঃ আশিক! তা আপনি বুঝবেন না!"
______________________________

সকাল সকাল রেডি হয়ে বের হচ্ছে ইউসুফ! পাশেই তামান্না আজকের কাজের সিডিউল পড়ে শুনচ্ছে,,

--" স্যার আপনার ১টায় মিটিং রয়েছে অফিসে! তারপর পার্টি অফিসে যেতে হবে আর ঠিক তিনটায় মেডিকেল কলেজ যেতে হবে!  ক্যাম্পিংয়ের জন্য ডাক্তাররা চলে এসেছেন। তাদের সাথে মিট করতে!"

এভাবে আরো অনেক কিছু বলছে তামান্না। সেদিকে যেন একটু খেল নেই ইউসুফের। সে চেয়ে আছে জানালার বাহিরে গন্তব্য হীন কোনো গন্তব্যে! আজ তার মনটা বড়ই আনচান আনচান করছে। কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছে না।কেন পাচ্ছে না? বুঝতে পাড়ছে  না সে। শুধু বুকে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।
_____________________

বেলা ---২ঃ৩০!

মেডিকেল কলেজের অডিটোরিয়াম রুমে সকল ডাক্তারকে বসতে দেয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝে এমপি সাহেব আসবে তাই। 

কায়া তখন বিরক্তি নিয়ে ফিসফিস করে ডাঃ জয়ীতাকে বলল,,

--" নির্ঘাত বোরিং স্পিচ দিবে!  আমার এখনি মাথা ধরে যাচ্ছে!"

জয়ীতা বলল,,

--" আমার মনে হচ্ছে না। কারণ ভিতরে ঢোকার সময় কিছু মেয়ের কথা শুনলাম। সবাই বলছে তাদের ক্রাশ আসচ্ছে!!"

কায়া ভ্রু কুচকে বলল,,

--" ক্রাশ!"

জয়ীতা মাথা উপর নিচ করে বলল,,

--হে!ময়মনসিংহের ক্রাশ নাকি সে! তাকে এক পলক দেখার জন্য মেয়েরা নাকি হুমড়ি খেয়ে পড়ে। দেখোই না তারা কি সাজটাই না দিয়েছে! পার্লার যেন সাথে করে নিয়ে এসেছে!"

কায়া চিন্তায় পড়ে গেল।আশেপাশে তাকালো ভাল করে। তাইতো! সবাই কেমন মান্জা মেরে এসেছে। ডাক্তার এরা? ভাবতেই অবাক লাগচ্ছে!কিন্তু ক্রাশ টা কে? ইউসুফ ভাইয়া না তো? এ ভেবেই শুকনো ঢুক গেললো সে!

সবার অপেক্ষার অবসানা ঘটিয়ে হাজির হলেন ময়মনসিংহের ক্রাশ এমপি সাহেব! যাকে দেখে কায়া স্তব্ধ হয়ে গেল। চোখের জল নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়তে লাগলো।সময়টা যেন কায়ার সেখানেই থেমে গেল। মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগচ্ছে তার। বিচলিত হয়ে উঠছে খুব। মানুষটিকে এভাবে দেখবে ভেবেই পায়নি সে। এখানে আর বসে থাকতে পাড়লো না কায়া। মুখের মাস্ক পড়ে ছুটে বেড়িয়ে গেল সেখান থেকে। করিডোরে এসে দেয়াল ঘেষে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। এভাবে কাছের মানুষটির দেখা পাবে ভাবতে পারে নি সে!

এদিকে ইউসুফ ভিতরে ঢুকতেই চিরচেনা মানুষের গায়ের ঘ্রাণ  যেন নাকে আছড়ে পড়ে। তখন থেকেই চোখ  দুটো আশেপাশে ঘোরপাক খাচ্ছে তার। কিন্তু কেন? সে ব্যক্তিটি কি আদ তার আশেপাশে আছে? এ ৫ বছরে এমনটিতো কখনো হয় নি। সেই ব্যক্তিটি আশেপাশে  থাকলেই তার শরীরের ঘ্রাণ পায় সে। তাহলে আজ কেন? তাহলে কি সে ফিরেছে? এ সব ভাবতেই এক ঝাঁক অস্থিরতা ঝেঁকে বসে তাকে। ফোন কলের ছুতোয় বাহিরে চলে আসে সে। কিছুটা শ্বাস নিয়ে কাউকে কল করে। 

এদিকে ইউসুফের কন্ঠ শুনে কুহু উঠে দাঁঁড়ায়।  দেয়ালের পাশ থেকে উঁকি দিয়ে সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে মুখ চেপে কেঁদে দেয় সে। মন যেন চাইছে এক প্রকার ছুটে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে,,

--"ইউসুফ ভাই আপনার কুহু ফিরে এসেছে। দেখেন?"

কিন্তু পারচ্ছে না। মনের মাঝে অজানা ভয় আঁকড়ে ধরেছে তাকে। ইউসুফ কি এখনো তাকে ভালবাসে? নাকি বাসে না? তার জীবনে কি কেউ চলে আসে নিতো? আচ্ছা উনি বিয়ে করেন নিতো? সাথে সাথে মোচড় দিয়ে উঠে তার বুক! 

ইউসুফ ফোন কথা শেষ করতেই আবার নাকে আসে সেই চিরচেনা ঘ্রাণ!  বিচলিত হয়ে এদিক ওদিক কিছু খুঁজতে শুরু করে সে! তা দেখে কুহু সরে যায়। তার বুঝতে বাকি নেই মানুষটি বুঝতে পেরেছে তার বাবুইপাখি  আশেপাশেই আছে। 
____________________________________

বিছনায় শুয়ে এপিঠ ওপিঠ করছে কুহু! কোনো রকম শান্তি পাচ্ছে না। ইউসুফকে দেখার পর থেকে চোখ জোড়া ভিজে উঠছে বার বার। মনে হচ্ছে এক প্রকার ছুটে তার কাছে চলে যেতে। কোনো ভাবেই শান্তি পাচ্ছে না সে! কি করবে ভাবচ্ছে কুহু। কি ভেবে ফোনটি হাতে তুলে নিল। আর কাউকে কল দিল। রিং হচ্ছে ওপর প্রান্তে। এদিকে কুহুর কেমন ভয় ভয় করছে!

ওপর পাশ থেকে ফোনটি তুলে বলল,,

--" হ্যালো!"

--" হ্যা..লো!  তিথি! কান্না জড়িত কন্ঠে বলল কুহু।

তিথিও শকড! কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,,

--" তুই! এত দিন পর? ভুলেই গেছিস! সেই যে লাষ্ট কথা হলো আর তো ফোন কল কিচ্ছু দিলি নাম এতো বেইমান হয়ে গেছিস তুই!" 

--" তিথি রিলাক্স! কাঁদিস না। আম সরি! তোকে কিছু বলার ছিল!"

--" কি!" উৎসাহের সাথে জানতে চায় তিথি।

--" আমি ময়মনসিংহ! " কিছুটা থেমে থেমে বলল কুহু!

তিথি খুশিতে গদ গদ করে বলল,,

--" আমিও ময়মনসিংহে!  কই আছিস তুই? কোথায় উঠেছিস?"

--" মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে উঠেছি। এখানে ক্যাম্পিং এর কাজ আছে। কদিন পর চলে যাবো।"

তিথির ঠোঁটের হাসি চওড়া হলো বলল, 

--" কুহু মাই জান!  আমিও হাসপাতেই আছি!"

--" হাসপাতালে কেন?" কার কি হলো? ইউসুফ ভাই,  ইউসুফ ভাই ঠিক আছে তো? কি হলো বল?"

তিথি হেসে ফেললো। বললো,,

--" কারো কিছু হয়নি বাবা! তবে তুই আন্টি হয়েছিস!"খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলল তিথি।

--" কিহ্?  আবাক হয়ে বলল কুহু!

তিথি হেসে বলল,,

--"হে! ৪০৪ এ আছি।  দেখে যা!"

--"কিন্তু!"

--" যাদের চিন্তা করছিস তারা আসবেনা। তারা দেখে চলে গেছে। কাল সকালে আমিও চলে যাবে! এখন আসতে পাড়িস। তোর জিজুও আছে!  আয়!"

কুহু হেসে বলল,,

--"আসচ্ছি!"
_________________________________

কুহুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে তিথি। দুজনে কান্না কাটি করে একা কার। এদের কান্না দেখে ছোট শিশু দিহান ও কাঁদচ্ছে। দিহানের কান্না থামানো ট্রাই করছে  মেসদাক। না পেরে ধমকে উঠলো সে,,

--" এই তোমরা থামবে? তোমারা কাঁদ ভাল কথা আরো কাঁদ কেঁদে শহীদ হও। কেন আমার বেচারা পুচকে টাকে কাঁদাচ্ছো!  দেখো কিভাবে কাঁদচ্ছে আমার আব্বা। উফ চুপ করো এবার?বাবা আমার কাঁদে না।"

মেসদাকের ধমকে দুজন চুপ তো করলোই। সাথে ছোট্ট দিহানো চুপ। তা দেখে হেসে দেয় সবাই। কুহু বলল,,

--" শিলি কেঁটেছে?  "

তিথি মাথা নেড়ে বলল,,  

--"হে"

মেসদাক বলল,,

--" তো শালী সাহেবা! পড়াশোনা কি হাল?"

কুহু হেসে বলল,,

--" জিজু খুব খুব ভাল হাল। আজ আপনাদের জন্য এত দূর পৌছাতে পেরেছি! নয়তো আমার জীবন সেখানেই থমকে যেত! হয়তো মরেই যেতাম।"

--" কুহু সব সময় বাজে কথা কেন বলিস? আমরা কিছু করি নি সব তুই নিজে করেছিস! আমরা শুধু তোর সাথে ছিলাম। কিন্তু. এর মাঝে ইউসুফ ভাইকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমরা খুব! জানিস না ভাইয়া ১ মাস ঘর থেকেই বের হয়নি। কেমন পাগল পাগল ছিল..! আর..!

তিথির কথা মাঝেই কুহুর ফোন বেঁজে উঠলো। জয়ীতা কল করেছে। কুহু এক মিনিট বলে ফোন রিসিভ করলো। কিন্তু ওপর পাশ থেকে কথা কেটে কেঁটে যাচ্ছিল। তাই কুহু বাহিরে চলে আসে। তখনি ইউসুফ আসে অদ্রিকে নিয়ে!অদ্রি ইউসুফের হাত ছেড়ে দৌঁড় দেয়ে। তখনি ইউসুফ উচ্চস্বরে বলল,,

--" আম্মু পড়ে যাবে তো?"

অদ্রি তার ফোঁকলা দাঁতে হেসে বলল,,

--বলো পাপা আমি পড়বো না। আমি সটঙ গাল।"

ইউসুফ হেসে দিল।অদ্রিকে কোলে নিয়ে চুমু খেল বলো,

--"সত্যি আম্মু তুমি স্ট্রং গার্ল।"

 দূর থেকে কুহু এমন একটি দৃশ্য দেখে থমকে গেল!চোখ টলমল করছে। মাথায় শুধু ভন ভন করে ঘুড়চ্ছে "পাপা" ডাকটা। তাহলে কি সত্যি ইউসুফ বিয়ে করে ফেললো?? তার জীবন থেকে কুহু,  তার বাবুইপাখি সত্যি হারিয়ে গেল???

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন