বকুল ফুলের মালা - অন্তিম পর্ব ৪০ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৭৯!! 

গাড়িতে বসে পুরো রাস্তাটা আয়ানের বলা কথাগুলো ভেবেছে মায়রা। কিছুতেই ওর হিসেবগুলো মিলছে না। সীমান্ত লোকটা যদি আসলেই ওর ভালোর জন্য, ওর সুখের জন্যই এমন অদ্ভুত আচরণ করবে তাহলে ওর এমন দ্বিমুখী আচরণের মানে কি ছিল? আয়ান পাশে বসে ড্রাইভ করতে করতে মায়রাকে দেখছে একটু পর পর। মেয়েটা পুরো ব্যাপারটা কিভাবে দেখছে আয়ান জানে না। কিন্তু মায়রাকে বিষয়টা না জানিয়ে শান্তিও পাচ্ছিল না বেচারা। একটা লোক শুধু মায়রার সুখের কথা ভেবে নিজের প্রথম ভালোলাগা, ভালোবাসাটাকে স্যাক্রিফাইস করেছে, অথচ তার স্মৃতিগুলো কিনা মায়রার এতোটা আতঙ্কের সাথে মনে করবে? যতবার লোকটার নাম মনে পড়বে ততবারই আঁতকে উঠবে মায়রা ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারছিল না আয়ান। কিন্তু এখন মায়রাকে এতো চিন্তা করতে দেখেও ভালো লাগছে না আয়ানের। মেয়েটার এতো সব হুট করে মানতে কষ্ট হচ্ছে সেটা আয়ানও বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু ওর লাজুক পরীটার ঠোঁটের কোণে লজ্জারাঙা হাসি ছাড়া আর কিছুই দেখতে চায় না আয়ান। আয়ান হাত বাড়িয়ে মায়রাকে হালকা করে নিজের কাছে টেনে নিলো।

-মায়ু? এভাবে মন খারাপ করো না প্লিজ? যা হয়েছে ভুলে যাও। সীমান্ত আর সায়না ওদের নতুন জীবনে খুশি থাকুক। আর তুমি সব ভুলে শুধু আমাদের বেবিদের দিকে ফোকাস করো। 

-কিন্তু আয়ান? ও যদি সায়নাকেও--।

-আরে পাগলি? সীমান্তের চোখে সায়নার জন্য যে ফিলিং দেখেছি সেটা মিথ্যে হতে পারেই না। তাছাড়া সায়না তোমার মতো এতো সহজ সরল মেয়ে না মোটেও। ও নিজের অধিকার ফলাতে জানে। যদি কখনো সীমান্ত ওর সাথে এভাবে দুর্ব্যবহার করে ও ঠিক কোনো না কোনো স্টেপ নিবেই। এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। সো একদমই টেনশন নিবা না।  আশা করি সায়নারও সীমান্তের সাথে সংসার করতে সমস্যা হবে না।

-যে একবার গায়ে হাত তুলতে পারে, সে বারবারই তুলতে পারে আয়ান।

-আর যে মানুষটা একবার ভালোবেসে হেরে যায়, সে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসাটাকে আগলে রাখতে জানে মায়রা। 

-লোকটা যে সত্যি বলছে বুঝলে কি করে? এটা তার কোনো নাটকও তো হতে পারে? হতে পারে সায়নাকে আরো বেশি করে কষ্ট দিয়ে তড়পানোর জন্য প্ল্যানিং করছে?

-হতে পারে। কিন্তু সীমান্তের একটা কথায় কিন্তু লজিক আছে। ও যদি তোমাকে সামনাসামনি বসে খুব সাবলীলভাবে বলতো, তুমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে আমার কাছে চলে এসো। আসতে পারতে? 

মায়রা এবারে একটা কথাও বলতে পারলো না। আসলেই কি আসতে পারতো মায়রা? এভাবে কি আসা যায়? আর আসলেও আয়ানের সামনে কি মুখ নিয়ে দাঁড়াতো?

-ছেলেটা সত্যি বলছে নাকি মিথ্যে আমি সেসব নিয়ে তর্ক করতে চাই না মায়রা। শুধু একটা কথা বলি। ও যদি একদম পারফেক্ট হাসবেন্ড হয়েও তোমার সামনে আসতো তবু তুমি ওর সাথে ততটা কমফোর্টেবল হতে না যতটা আমার সাথে আমাদের রিলেশনের প্রথমদিন থেকে ছিলে। ওর প্রত্যেকটা ব্যবহারের সাথে, প্রতিটা স্পর্শের সাথে তুমি আমাকে জড়িয়ে ফেলেছিলে। ও তোমাকে ডিভোর্স না দিলেও ওর সাথে কখনোই হয়তো সুখী হতে পারতে না। সেটা সীমান্তও খুব ভালো করেই জানতো। তাই তোমাকে মিছেমিছির একটা বন্ধনে আটকে রাখতে চায় নি।

-------------------------------

-তুমি চাইলেও এতো সহজে কোন কারণ ছাড়াই একটা সম্পর্ক এতো সহজে ভেঙে দিতে পারতে না মায়রা। তোমাকে সেই কারণটা সীমান্ত নিজে করে দিয়েছে। ঠিক কি ভুল সেটা বলবো না। কিন্তু ওই পাগল লোকটার কারণেই আজ তোমাকে পেয়েছি। তাই ওর উপরে আমার আসলেই আর কোনো ক্ষোভ নেই।

আয়ানের বলা কথাগুলো মায়রার কানের কাছে ননস্টপ রিপিট হচ্ছে যেন। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ওরা সায়না আর সীমান্তের গায়ে হলুদের ভেন্যুতে পৌঁছে গেছে। চট্টগ্রামে সীমান্তদের পরিচিত খুব বেশি কেউই নেই। তাই দুজনের গায়ে হলুদের প্রোগ্রামটা একই সাথে আয়োজন করা হয়েছে। বিশাল হোটেলের হলরুমের এক পাশে বিশাল করে স্টেইজ করা হয়েছে। সেখানেই সায়না আর সীমান্ত পাশাপাশি বসা। হলুদের সাজে আর সবার হলুদ চন্দনের ছোঁয়ার পরেও ঠোঁটের কোণে একটা তৃপ্তির হাসি লেগে আছে দুজনেরই। সীমান্তের এই হাসিটার পিছনে কোনো ঘৃণ্য বর্বর চেহারা নজরে পড়লো না মায়রার। উল্টো একটা নিষ্পাপ পবিত্রতা ছেড়ে আছে লোকটার চোখে মুখে। মায়রা আর কিছু না ভেবে চুপচাপ আয়ানের হাতে হাত রেখে স্টেইজের দিকে এগিয়ে গেল। মায়রাকে দেখে সায়না অবাক হলো আর সীমান্ত হয়তো কিছুটা চমকে গেল। আয়ান এগিয়ে এসে সীমান্তকে জড়িয়ে ধরলো। 

-কংগ্রাটস ম্যান। হ্যাভ এ নাইস মেরেড লাইফ।

-থ্যাংকস আয়ান। তোমার হেল্প ছাড়া হয়তো এতো সহজে দিনটা আসতো না। আর তোমাদের দুজনকেও কংগ্রাচুলেশনস। আশা করি পরের দিনগুলো আরো সুন্দর কাটবে তোমাদের। আর মায়রা? থ্যাংকস ফর কামিং। এন্ড সরি হোয়াট আই হ্যাভ ডান উইথ ইউ।

মায়রা একটু হাসার চেষ্টা করলো সীমান্তের দিকে তাকিয়ে। তারপর সায়নাক একটু হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে হালকা করে জড়িয়ে ধরলো। 

-আপনারা দুজনেও খুব ভালো থাকুন। এটাই দোয়া করি--।

-চলো মায়রা? খালামনি আর আঙ্কেলের সাথে দেখা করে আসি।

-হুম---। আসছি--।

আয়ান মায়রার হাত ধরে স্টেজ থেকে নামতে সাহায্য করছিল। তাই কেউ একজন হঠাৎ করে মায়রার সামনে এসে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা টের পায়নি। কিন্তু মায়রা মানুষটাকে দেখেই চমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। মানুষটার চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি ফুটে আছে দেখে মায়রা কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। 

-আমার ছেলেটার মাথা একবার বিগড়ে কি শান্তি হয়নি তোমার? আবার চলে এসেছ ওর জীবনে? এতো নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়ে মানুষ আমি জন্মে দেখি নি---।

সীমান্তের মায়ের কথাগুলো শুনেই আয়ান রেগে গেল। কিন্তু মায়রা ওর হাতটা চেপে ধরায় চুপ করে ছিল এতোক্ষণ। কিন্তু এবারে আয়ানের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে এই মহিলা। 

-কোথায় দাঁড়িয়ে কার সম্পর্কে কথা বলছেন জানেন আপনি? শি ইজ মাই ওয়াইফ। ওর সম্পর্কে একটা বাজে কথাও শুনবো না আমি আন্টি। দয়া করে নিজের কাজে মন দিন। 

-হাহ! এই মেয়ে দেখছি তোমার মাথাটাও বিগড়ে দিয়েছে। এখন তোমাকে বলা আর একটা গাধাকে বলা সমান। নিজের ছেলেটাকেই তো দেখেছি। এই মেয়ে এর চেয়ে আর ভালো কি করতে পারবে---।

-এনাফ! যথেষ্ট বলে ফেলেছেন আপনি। এসো তো মায়রা। আমরা আর এক মূহুর্তও এখানে থাকবো না। চলো?

-যাও যাও। নিজের বউকে নিয়ে ঘরে তালাবদ্ধ করেই রেখে এসো। যে মেয়েকে ওর মা বাবাই চায় না। এই পোয়াতি অবস্থায়ও যে মেয়ে মায়ের স্নেহ পায় না তার আবার----।

-জাস্ট শাট আপ আন্টি----।

আয়ান এতোক্ষণ রেগে গেলেও স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কথা বলছিল সীমান্তের মায়ের সাথে। কিন্তু শেষের কথাগুলো বেশ জোরেই বলে ফেলেছিল আয়ান। স্টেজ থেকে সীমান্ত নিচে নেমে আসতে আসতে মায়ের সামনে মায়রা আর আয়ানকে দেখে একটু চমকে তাড়াতাড়ি আয়ানের পিছনে এসে দাঁড়ালো। 

-কি হয়েছে আয়ান?

মায়রা ততক্ষণে আয়ানকে সীমান্তের মায়ের সামনে থেকে টেনে নিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়িয়েছে। আয়ান সীমান্তকে কিছু বলার সুযোগও পেল না। মায়রা কোনোমতে কাঁপা গলায় জবাব দিলো। 

-কিছু না। আমরা আজকে আসছি। চলো আয়ান?

মায়রা কিছু না বললেও সীমান্তের বুঝতে বাকি রইলো না এখানে কি ঘটেছে। সীমান্ত এক নজর মায়ের দিকে তাকালো। 

-তোমাকে এতো করে বলার পরও তুমি সেই আগের মতোই কাজ করলে মা? ছি মা? মেয়েটা তোমার কি এমন ক্ষতি করেছে? কেন এমন করো সবসময়? তোমাকে কিছু বলাই বেকার। ছি!

কথাগুলো বলেই সীমান্ত আবার স্টেজে গিয়ে সায়নার পাশে বসলো। সায়না ইশারায় জানতে চাইলো কি হয়েছে। সীমান্ত কোনমতে মাথা নেড়ে জানালো কিছু হয়নি। আর সীমান্তের মা সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে রাগে ফুঁসছেন। এদিকে আয়ান চুপচাপ মায়রার পাশে বসে ড্রাইভ করেছে। মায়রা বাইরের অন্ধকারের দিকে মুখ করে নিরবে চোখের পানি ফেলছে সেটাও বেশ বুঝতে পারছে আয়ান। আয়ান কোথাও না থেমে সোজা বাসায় চলে এলো। আয়ান গাড়ি পার্ক করে মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে। মায়রাও কিছু না বলে আয়ানের কাঁধে মুখ ডুবিয়ে চোখের পানি ফেলছে। মায়রাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে পাশে বসে আলতো করে বুকে জড়িয়ে ধরলো আয়ান।

-বউটা এতো কাঁদছে কেন গো? মন খারাপ?

-আমি সত্যি খুব খারাপ তাই না আয়ান? তাই তো মা বাবাও আমাকে চায় না----।

আয়ান মায়রার ঠোঁট জোড়া নিজের উষ্ণ ঠোঁটের বাঁধনে আটকে নিলো। আয়ান একটু পরে সরে এসে আবার মায়রার কান্নাভেজা মুখ দেখে মায়রার মুখটা দু হাতে তুলে ধরলো। 

-এই পাগলি বউটা কিসব বলছ? আমার বউটা কত লক্ষী সেটা কাউকে বলে দিতে হবে না। এমন বাজে কথা আর কখনো বলবে না। তাহলে কিন্তু-----।

-আন্টি ঠিকই বলেছে আয়ান। এই সময় তো প্রত্যেকটা মেয়ে তার মাকে পাশে পেতে চায়। অথচ দেখো আমার কি পোড়া কপাল----?

-শশশশশ। আবার এসব বলছ? আর এতো কাঁদছ কেন সোনাপাখি? আমার কথাটা শোনো? এভাবে কেঁদো না প্লিজ? শরীর খারাপ করবে তো?

-সত্যি আমাকে কেউ চায় না আয়ান। কেউ না---।

মায়রা কথাটা শেষ করার সুযোগ পেল না। তার আগেই আয়ান মায়রাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মায়রার উপরে নিজের ভর ছেড়ে দিয়ে ঠোঁটে আলতো করে কামড় বসিয়ে দিয়েছে। মায়রা একটু কেঁপে উঠতেই আয়ান মুখ তুলে মায়রার মুখের দিকে তাকালো। আয়ানের উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে সোজা মায়রার ঠোঁটের উপরে এসে পড়ছে বলে মায়রা থতমত খেয়ে আয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ান কয়েক মিনিট মায়রার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার ছোট্ট করে একটা চুমো খেল। 

-আর কখনো এসব ভেবে একদম মন খারাপ করবে না মায়রা। তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না। আর দেখবে তোমার বাবা মা একদিন ঠিক তোমাকে কাছে টেনে নিবে। প্লিজ? এসব ভেবে আর একদম কাঁদবে না। ওকে?

-হুম। আম সরি।

-কিছুক্ষণ লক্ষী মেয়ে হয়ে রেস্ট নাও। আমি এক্ষুণি তোমার খাওয়ার জন্য কিছু নিচ্ছি---। 

-নাআআ। আমি এখন তোমার বুকে থাকবো। 

-মায়রা?

-উঁহু----। 

আয়ান মায়রাকে বুকে টেনে নিয়ে শুয়ে রইলো চুপচাপ। মেয়েটার মন খারাপের কারণটা আয়ান জানে। কিন্তু কিছুই করার নেই ওর। মায়রার মনটা ভালো করার জন্য কিছু একটা তো করতেই হবে। কথাটা ভাবতে ভাবতে মায়রাকে বুকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বুজলো আয়ান। কি করা যায় সেটাই ভাবার চেষ্টা করলো। অন্তত তাতে যদি মেয়েটার ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসিটা ফিরে আসে। 

৮০!! 

গত এক ঘন্টা ধরে মায়রাকে একেক বার একেকটা শাড়ি পড়িয়ে যাচ্ছে আয়ান। কোনোটাই তার মন মতো হচ্ছে না বিধায় সেটা পাল্টে আবার নতুন একটা শাড়ি পড়ানোয় মন দিচ্ছে। এই মূহুর্তে সোনালী রেশমি সুতোর কাজ করা কালো হাফ সিল্কের একটা শাড়ি পড়নে মায়রার। এই শাড়িটা আয়ানের কতটুকু পছন্দ হয়েছে সেটা মায়রা বুঝতে পারছে না। কিন্তু আয়ানকে এই শাড়ির ট্রায়াল দিতে দিতে বেচারি কাহিল হয়ে বিছানায় বসে পড়লো। আয়ান মায়রার পাশে বসে হাতে চুড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে এক মনে। মায়রাও মানুষটাকে দেখছে এক দৃষ্টিতে। লোকটা আজ হঠাৎ এমন পাগলামি করছে কেন? আজ সকাল পর্যন্ত জেদ ধরে ছিল সায়না আর সীমান্তের বিয়েতে ওরা কিছুতেই যাবে না। সীমান্তের মা থাকলে তো নয়ই। অথচ এখন সে নিজেই মায়রাকে আগ্রহ নিয়ে রেডি করিয়ে দিচ্ছে বিয়েতে যাওয়ার জন্য। আর কিসব পাগলামি করছে! কোনো সাজই যেন লোকটার আজ পছন্দ হচ্ছেই না। এমন করছে কেন লোকটা কে জানে?

-এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন ম্যাডাম? নতুন দেখছেন নাকি?

-তোমাকে এতোটা উত্তেজিত তো প্রথমবার দেখছি। কি হয়েছে বলো তো?

-আজ তোমার সাজটা কিছুতেই আমার মন মতো হচ্ছে না গো লাজুক পরী। কিছুতেই যেমন চাচ্ছি সেভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারছি না। 

-কেন? ভালোই তো লাগছে। তাছাড়া আজ সায়নার বিয়ে। ওকে দেখতেই যাবো আমরা। নতুন বউয়ের চেয়ে আমি বেশি সেজেগুজে গেলে কেমন দেখাবে না ব্যাপারটা?

-কিচ্ছু কেমন দেখাবে না। তোমাকে আজকে বিয়ের আসরের সবার চেয়ে বেশি সুন্দর দেখতে লাগতে হবে। যেন কেউ চোখ ফিরিয়ে না নিতে পারে আমার চাঁদপরীটা থেকে--।

-আমার দিকে কেউ তাকালেই নাকি তোমার রাগ হয়। তা আজ তাহলে সবাইকে দেখাতে চাইছ কেন?

-আজ আমি সারা পৃথিবীকে দেখাতে চাই আমার বউটাকে। দেখাতে চাই আমার লাজুক পরীটা--।

-হুম? কি?

-কিছু না। এই শাড়িটা ঠিক লাগছে? নাকি এই যে লাল সিল্কের শাড়িটা পড়বা?

-আর না প্লিজ? আমি টায়ার্ড হয়ে গেছি চেইঞ্জ করতে করতে--।

-সে কি? তোমাকে তো আমি চেইঞ্জ করিয়ে দিচ্ছি---।

-আয়ান? প্লিজ? আর না---।

-আচ্ছা বাবা। ঠিক আছে। এখন সাজটা কমপ্লিট করিয়ে দিই। এসো?

-হুম---।

 
সাজটা কমপ্লিট হওয়ার পর মায়রাকে আসলেই কোনো পরীর থেকে কম লাগছে না। মায়রার চোখে কাজল পড়াতেও ভোলে নি আয়ান। আর সাথে আছে মায়রার এক গুচ্ছ বকুল ফুলের মালার গাজরা। বিয়ের ভেন্যুতে পৌঁছানোর পরও সবাই প্রায় হা করে দেখছে মায়রাকে। সোনালী কালো কম্বিনেশনের শাড়িটায় মায়রার সৌন্দর্য যতটা না ফুটিয়ে তুলেছে ততটাই সবার নজর কাড়ছে মায়রার লাজুক রাঙা হাসিটা। আর এই দৃশ্যটা ফিরে পেয়েই আয়ানের সব চেষ্টা যেন এক নিমিষে সফল হয়ে গেছে। অন্তত আয়ানের চোখে মুখে ফুটে থাকা আনন্দের ঝিলিকটা তো সেটাই বলছে। 

-মায়রা? কেমন আছিস মা?

আয়ানের পাশে বসে আশেপাশের লোকজনের আনাগোনা খেয়াল করতে করতে পাশ থেকে একটা কণ্ঠ শুনে মায়রা চমকে উঠে তাকালো। ওর পাশে যে মানুষ দুজন দাঁড়িয়ে আছে সেটাই মায়রার কাছে স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। তবু কোনমতে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুজনের একজনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো মায়রা। এই মানুষ দুজনকে এখানে দেখতে পাবে সত্যিই ভাবে নি মায়রা। 

-কাঁদিস না মা। কাঁদিস না। 

-মা বাবা? তোমরা? তোমরা এখানে কখন এলে? কি করে---?

-সীমান্ত তোর বাবাকে আসতে বলেছিল কাল। আমরা একটু আগেই এসে পৌঁছলাম---।

-সীমান্ত?

-আমরা যতটা না ওর কাছে অপরাধী ততটা তোর কাছেও অপরাধী রে মা। মা বাবাকে মাফ করে দিস? নিজেদের সম্মানের কথা ভেবে জেদের বশে একবারও তোর সুখের কথাটা ভাবি নি। একবারও চিন্তা করি নি জোর করে একটা সম্পর্কে বেঁধে দিলেই সেটাকে সংসার বলে না। মাফ করে দে রে মা।

-বাবা? কি বলছ? আর কাঁদবে না তো এভাবে। আমি একটুও রাগ করে নেই তোমাদের উপরে। সত্যি বিশ্বাস করো?

-বলতে দে মা। আজ বলতে দে। কতোটা পাষাণ বাপ আমি? তা না হলে নিজেরই সন্তানদেরকে এভাবে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিই?

-বাবা? প্লিজ থামো তো? ও মা? তুমিও এমন কেঁদো না প্লিজ?

-তোকে আর আয়ানকে, তাথৈকে আর রিহানকে একসাথে দেখে বুঝতে পারছি সেদিন আমরা কতোটা ভুল ছিলাম। সেদিন তোদের ভালোবাসাটা মেনে নিলে হয়তো আমার দুটো মেয়েকেই এতো কষ্ট সহ্য করতে হতো না। তোর এই সময়টায় তোর পাশে থাকতে পারতাম। কিছুই হলো না---।

-বাবা?

আয়ান এতোক্ষণ বাবা মায়ের সাথে মায়রার সব মিটমাট হওয়ার অপেক্ষা করছিল। কিন্তু উনারা তিনজনেই আগের কথা মনে করে কান্নাকাটি করছে দেখে এবারে আয়ান নিজেই উদ্যোগী হয়ে উঠে মায়রার পাশে এসে দাঁড়ালো। 

-বাবা? মা? যা হওয়ার হয়ে গেছে। যে সময়টা চলে গেছে সেটা আমরা আর ফিরত পাবো না। কিন্তু আসছে সময়টাকে আমরা সবাই মিলে সুন্দর করে সেলিব্রেট তো করতে পারি? তাই কান্নাকাটি বন্ধ করে আমাদের আর আপনাদের ভবিষ্যৎ নাতি নাতনির জন্য দোয়া করুন। 

বিয়ের যাবতীয় অনুষ্ঠান শেষ করে দুদিন পর সায়নাকে নিয়ে ঢাকায় ব্যাক করেছে সীমান্ত। এতোটা রাস্তা জার্নি করে দুজনেই ভিষণ টায়ার্ড। সীমান্ত সায়নাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চুলে আলতো করে বিলি কেটে দিচ্ছে। আর সায়না চুপ করে শুয়ে থেকে সীমান্তের পাঞ্জাবির বোতাম নাড়াচাড়া করছে। সীমান্ত একটু হেসে সায়নার কোমড় জড়িয়ে আরেকটু কাছে টেনে নিলে সায়নার ঘাড়ে মুখ ডুবালো।

-কি ভাবছ বউ?

-আমরা তোমাদের বাড়িতে যাবো না? বাবা মা ও তো এখানে এলো না। মা এতো রাগ করেছে কেন? কি হয়েছে একটু বলবে আমাকে প্লিজ?

-আরে কিছু না। মা এমনি। মায়রাকে দেখে আবার রেগে আছে। ওসব কিছু না। বাদ দাও।

-তাহলে আমি শ্বশুরবাড়ি যাবো না? বাড়িতে না গিয়ে এখানে কেন এলাম আমরা? তোমার না আরো পাঁচদিন ছুটি আছে?

সীমান্ত সায়নার মুখটা তুলে ধরে ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।

-তুমি এখানে তোমার সংসারে আর আমার জীবনে রাজত্ব করবে সায়না। আর মা যেদিন নিজের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে তোমাকে সত্যি মন থেকে মেনে নিবে সেদিন আমরা ওই বাড়িতে যাবো। তার আগে না। আর পাঁচদিন সময় হাতে আছে। চুটিয়ে প্রেম করবো এই কয়টা দিন। তাছাড়া ম্যাডাম তো হুটহাট ঘুরতে পছন্দ করেন। অফিসের কাজের প্রেশার বাড়লে তখন তো একদমই সময় দেয়া হবে না---।

-প্রেম করতে বিয়ে করেছেন বুঝি জনাব?

-সেরকমই বলতে পারো। দেখা যাবে বহু কষ্টে বছরের পর বছর প্রেম করলাম আমি আর এদিকে অন্য কেউ এসে আমার প্রেমিকাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে। না বাবা। এই রিস্ক আমি নিতে পারবো না একদমই। তাছাড়া প্রেম করলে তো তোমায় এভাবে হুটহাট আদর করে ছুঁয়ে দিতে পারবো না। বা ইচ্ছে করলেই বুকে জড়িয়ে ধরে তোমার চুলে মুখ ডুবাতে পারবো না--। তাই না বলো?

-ধ্যাত। আচ্ছা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? রাগ করবে না বলো?

-হুম বলো?

-আচ্ছা তুমি শাড়ি দুটো তো মায়রাকে দেয়ার জন্যই কিনেছিলে। তাহলে দিলে না কেন?

-কমলা রঙের শাড়িটা ওকে সরি বলার জন্য কিনেছিলাম। প্রথমবার যখন রাগের বশে ওর গায়ে হাত তুলেছিলাম। ও তো পরেরদিন না বলেই বাড়ি চলে গেছে। আর হলুদ শাড়িটা ওর বার্থডের পরের দিন ওকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য কিনেছিলাম। আমি তো জানতাম না আগেরদিন ওর বার্থডে ছিল। তাই অনলাইনে অর্ডার করেছিলাম। শাড়িটা হাতে এসে পৌঁছানোর আগেই আমার দুনিয়াটাই তছনছ হয়ে গেছে। আর যার জীবনে আমারই কোনো অস্তিত্ব ছিল না, তাকে শাড়িগুলো দিয়ে তার জীবনে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে কি হতো বলো?

-আমমম। আচ্ছা বাদ দাও এসব। 

-হুম। এখন একটু ঘুমিয়ে নাও। কাল সকালে অনেক কাজ আছে।

-কি কাজ?

-সকালে উঠে প্রথম কাজ হলো একটা মেইড সার্ভেন্ট ঠিক করা। দেখি আশেপাশের বাসায় কাজ করে কাউকে পাই কিনা---।

-না। কোনো দরকার নেই----।

-আরে? দরকার আছে বলেই তো বলছি পাগলিটা। তুমি না বললে এসব রান্নাবান্না হাবিজাবি কাজগুলো কখনো করো নি? তাহলে কাজগুলো করবে কে শুনি? আমি তো আর সবসময় তোমাকে শিখিয়ে দিতে পারবো না জান। 

-না পারলে নেই। তবু কাজের মেয়ে রাখা যাবে না। আমি একটু একটু করে শিখে নিবো। তবু বাইরের কাউকে রাখা যাবে না--।

-কেন গো? তোমার কাজের মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কি আমি বিয়ে করে নিবো নাকি?

-সীমান্ত? যা ইচ্ছে বলো। কিন্তু কাজের মেয়ে রাখা হবে না মানে হবে না।

-তো তুমি কবে কাজ শিখবে! ততদিন কি হবে আমার? হায় আল্লাহ!

-হুহ। নিজে শিখিয়ে দিবা। নইলে বাইরে থেকে অর্ডার করে খাবার আনাবা। আর নইলে উপোস থাকবা। তবু----।

-উপোস কেন করবো ম্যাডাম? আপনি আছেন না? আপনাকে দিয়েই না হয় খিদে মিটাবো। এখন থেকে একটু প্রাকটিস করা যাক। কি বলো?

-ধ্যাত--। কিসব বলো?

সায়না চোখ নামিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাসছে দেখে সীমান্তও যেন প্রশ্রয় পেয়ে সায়নাকে টেনে নিয়ে ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিতে শুরু করেছে। 

ক্যালেন্ডারের পাতার ঘুরে গেছে তিনটা বছর। এই তিন বছরে সবার জীবনেই কিছু না কিছু পরিবর্তন এসেছে। আরিশা আর তাওহীদের ছোট্ট আরশি আজকাল অনেক বেশিই দুষ্টু হয়েছে। আর সম্ভবত মায়ের সবটা জেদ মেয়েটা একাই পেয়েছে। তার বায়না না পূরণ হলে রীতিমতো দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে বসে। আর সেটা নিয়ে আরিশা নিজেই কাহিল। আরশির বর্তমান আবদার তার একটা ছোট্ট গলুমলু ভাই পুতুল চাই। মেয়ের আবদারে তাওহীদ মিটিমিটি হাসলেও আরিশা বেচারির বিষম খাওয়ার জোগাড়। এদিকে, তাথৈ আর রিহানের সংসারে এতোদিনে নতুন অতিথি আসছে। তাথৈয়ের মা বাবা খুশি মনেই মেয়ে আর জামাইকে নিয়ে মেতে আছেন। আভা আর সামির সাথে বাঁধনও বেশ খুশিতেই আছে। সপ্তাহে একটা দিন বাঁধন তার আরশিলতার সাথে খেলতে আসবেই আসবে। অবশ্য এই পিচ্চি মেয়ের জেদের কাছে বাঁধনের মতো দুষ্টু ছেলেও কাহিল। সায়না আর সীমান্তের ভালোবাসাটাও ধীরে ধীরে ডাল পালা মেলতে শুরু করেছে। সীমান্ত যত ব্যস্তই থাকুক না কেন সায়নার জন্য ঠিকই সময় ম্যানেজ করে নেয়। আজকাল মেয়েটার একটু বেশি খেয়াল রাখতে হচ্ছে যদিও। নতুন কেউ আসার অপেক্ষা ওদের জীবনে। কিন্তু সায়না এখনও জেদ ধরেই বসে আছে কাজের লোক রাখা চলবে না বাসায়।

এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বদলে গেছে আয়ান মায়রার জীবন। মায়রার জীবনের সবটুকু অপূর্ণতা সেদিন এক নিমিষেই কেটে গিয়েছিল। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টায় সব হারিয়ে যাওয়া আনন্দগুলো ফিরে পেয়েছিল মেয়েটা। মা বাবার ভালোবাসা, শ্বশুর শাশুড়ীর স্নেহ, প্রিয় মানুষটর যত্ন-সব কিছুই পেয়েছে মায়রা। আয়ানের কাছে হুটহাট রাত বিরেতের আবদারগুলো মনে পড়তেই এখন ভিষণ হাসি পায় মায়রার। কত পরম স্নেহে মায়রাকে আগলে রেখেছিল মানুষটা। এমনকি এখনো এতোগুলো দিন পরেও লোকটা কোনদিন মায়রার কোন একটা আবদার অপূর্ণ রেখেছে বলে মনে পড়ে না মায়রার। এই যে এই মূহুর্তে মায়রার কোলে আমায়া আর আয়ানের কোলে আমান লক্ষী বাচ্চা হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আর ওরা দুজনে সাগরের পানিতে পায়ের পাতা ডুবিয়ে যত দূরে চোখ যায় সাগরের বিশালতা দেখছে। অবশ্য একটু পর পরই দুজনের চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। আর চোখাচোখি হতেই দুজনে হেসে ফেলছে। 

-মায়ু? একটা কাজ করলে কেমন হয় বলো তো? এই সাগরের পাড়ে একটা বাড়ি বানাবো। বেশি কিছু না। ছোট্ট একটা কুঁড়ে। পাশেই একটা বকুল গাছ থাকবে। তুমি সারাদিনের ক্লান্তি ভুলাবে এভাবে পায়ের পাতা ডুবিয়ে সাগরের গর্জন শুনতে শুনতে। আর আমি সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে তোমার জন্য বকুল ফুলের মালা গাঁথবো। নিজের হাতে গাঁথা মালাটা তোমার খোঁপায় গুঁজে নতুন করে বকুল ফুলের বাসর সাজাবো প্রতিবার। কেমন হবে বলো তো?

-এসব ছাড়া ভদ্রলোকের মাথায় আর কিছু আসে না তাই না?

-আসে তো। এই ধরো আমাদের ছোট্টো কুঁড়েটাকে ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিবো। শত শত তারার মতো ফুলগুলোর মাঝে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকবে তোমার শাড়ি, চুড়ি। তোমার সমস্ত শরীর জুড়ে থাকবো আমি, আমার আদর আর শুভ্র বকুল ফুলের ঘ্রাণ। আইডিয়াটা কেমন?

-অসভ্য লোক একটা---। চুপ করো তো। বাবুরা ঘুমাচ্ছে। 

-আহা! লাজুক পরী। আমায়া আর আমান দুজনেই তো বড় হয়েছে। এবারে আরেকজনের আসা উচিত না বলো? ওদেরও তো একটা ছোট বোনের ইচ্ছে থাকতেই পারে বলো?

-তুমি একটা খুব খারাপ--। 

-খারাপ না? হোটেলে চলো। তারপর দেখাচ্ছি তোমাকে----।

-ধ্যাত। কি সুন্দর সূর্যাস্ত হচ্ছে। সেটা দেখো। 

আয়ান আর কিছু না বলে মায়রার একটা হাত ধরে সামনের দিকে তাকালো। সূর্যের লালিমা পুরো পানিটাতেই অন্যরকম একটা আভা ফুটিয়ে তুলেছে। আর এই স্নিগ্ধ পরিবেশে নিজেকে আজ সম্পূর্ণ মনে হচ্ছে মায়রা আয়ান দুজনেরই। পিছন থেকে ছ'সাত বয়সী একটা ছেলের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে আয়ান মায়রা দুজনেই আবার হেসে ফেললো। আয়ান মায়রাকে ইশারায় বসতে বলে ছেলেটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ধীর পায়ে। আর ছেলেটা তখনো এক মনে আওড়ে যাচ্ছে কয়েকটা লাইন।

-মালা লাগবে গো মালা? আছে বকুল ফুলের মালা। ফুল শুকিয়ে যাবে কিন্তু ঘ্রাণটা রয়ে যাবে তরতাজা। মালা নিবেন নি গো মালা? আছে বকুল ফুলের মালা।



                                 ***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন