আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে গল্প সম্বন্ধে আপনার মতামত অবশ্যই প্রকাশ করবেন। আপনাদের মতামত আমাদের এই ছোট প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। শীঘ্রই আরও নিত্য নতুন গল্প আপডেট আসছে, সঙ্গে থাকুন। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখক/লেখিকা'র নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত গল্পের ডায়েরি’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখক/লেখিকা'র কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় গল্পের ডায়েরি কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

মায়াবতী (পর্ব ০৮)


১৫!! 

-আপনি প্লিজ চুপ করে থাকবেন না। প্লিজ কিছু তো বলুন? আপনি সেদিন চলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত গত দুদিন ধরে সবাই আমাকে হাজারটা প্রশ্ন করছে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা নেই আমার। দয়া করে আপনি আমাকে বলে দিবেন আমি কি করবো, কি বলবো?

মায়ার কথাগুলো শুনেও চুপ করে মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো রাহাত। আসার সময় পুরো রাস্তা মায়াকে কী কী বলবে, কীভাবে সরি বলবে সব প্ল্যানিং করে এসেছিল রাহাত। কিন্তু এখন মায়ার সামনাসামনি বসে থেকেও একটা শব্দও বের হচ্ছে না রাহাতের গলা দিয়ে। রাহাতের চোখ আটকে গেছে মায়ার মুখের দিকে। এই দুদিনেই মেয়েটার চোখেমুখে বিশাল একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে রাহাত। সম্ভবত অতিরিক্ত কান্নাকাটি করার কারণে চোখ জোড়া লাল হয়ে ফুলে আছে মায়ার। আর সবসময়ের লজ্জারাঙা মুখটা আজকে ফ্যাকাশে। মায়াবতীর এই অবস্থা দেখে রাহাতের নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছে। তাই অপরাধবোধ থেকেই কিছু বলতে পারছে না লোকটা। রাহাত নিজেকে সামলে নিয়ে আবার মায়ার মুখের দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। রাহাত কিছুটা ইতস্তত করে চোখ সরিয়ে নিলেও মায়া রাহাতের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। 

-জানেন স্যার? খুব ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। মা নিজে কষ্ট করে টিউশন আর সেলাইয়ের কাজ করে আমার পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছেন। তবু কখনো কারো সামনে নিজেও হাত পাতে নি, আমাকেও হাত পাততে শেখায় নি। তবু আজ আপনার কাছে হাত জোড় করে ভিক্ষা চাইছি। আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন প্লিজ? আপনাকে আমি কখনোই বলবো না যে আপনি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে বিয়ে করুন। আমি মরে গেলেও সেটা বলবো না। শুধু একটা বার আমাকে বলে দিন আমার দোষটা কি ছিল? আমি তো আপনাকে ছাড়া আর কিছুই চাই নি। নেশার ঘোরেই হোক বা সমস্ত সাহসে ভর করে আপনাকে নিজের মনের কথাটা তো বলেই দিয়েছিলাম। আপনি তো তখনই বলে দিতে পারতেন আমাকে। যে আপনার কেয়ারগুলো দেখে আমিই আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখছি। তখনই না হয় বলে দিতেন আমার জায়গায় অন্য যে কেউ হলেও আপনি এভাবেই প্রতি সেকেন্ডে তাকে আগলে রাখতেন। 

-ব্যাপারটা সেরকম নয় মায়া।

-ব্যাপারটা কিরকম সেটাই তো আপনার কাছে জানতে চাইছি স্যার। সবার কথা নাহয় বাদই দিলাম। কিন্তু আমি কতোটা আশা নিয়ে আপনার আসার অপেক্ষা করছিলাম সেটা কি আপনি জানেন? কিন্তু আপনি যখন সবার সামনে বিয়ে করবেন না বলে উঠে চলে এলেন তখন আমার কি ইচ্ছে করছিল জানেন? নিজেকে এতো ঘৃণা হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল মরে যাই। আপনাদের আসার খবরটা তো সবাই জানতো, হয়তো আপনি না এলেও এতোটা ছোটো মনে হতো না নিজেকে। যতটা না আপনার সবার সামনে এভাবে চলে যাওয়ায় নিজেকে ছোটো মনে হচ্ছে। 

-মায়া প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো? আমি জানতামই না আমরা কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। এমনকি তোমার বাসার সামনে এসে তখন জানতে পেরেছি যে তোমাদের বাসায় এসেছি। 

-বাবা আপনাকে বলে নি আপনারা যে বিয়ের-- বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে আসবেন?

-সকালে বাবা কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমি ঘুমের ঘোরে শুনি নি কি বলেছে---।

-তার মানে আপনি এসবের কিছুই জানতেন না?

-না মায়া। ইভেন আমি ভাবছিলাম তোমার সাথে পার্টির রাতের ঘটনাটা নিয়ে কথা বলবো। সোহান জুলিকে দিয়ে তোমাকে ড্রিংকসটা দিয়েছিল যাতে তুমি নিজের মনের কথাটা আমাকে বলে দাও নেশার ঝোঁকে। আর আমিও সেটা এ্যাকসেপ্ট করে নিবো এটা ওরাও ভেবেছিল। 

-হয়তো উনিও আমারই মতো আপনার কেয়ারটাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছিল। 

-মায়া? আম সরি। আমি ভাবতেই পারি নি এতো কিছু হয়ে যাবে। আমি ভিষণ লজ্জিত মায়া। একচুয়েলি প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল বাবা আর সোহানের উপরে। তাই কিছু না ভেবেই ওভাবে ধুম করে চলে এসেছিলাম সেদিন।

-আপনি সরি বলছেন কেন স্যার? আপনি তো এই গল্পটার অংশ কখনো ছিলেনই না। কিন্তু আমি কি করবো বলে দিবেন প্লিজ? আপনার কাছে উত্তর চাইবো ভেবে এভাবে পাগলের মতো যে ছুটে এলাম? এরপর কি করবো আমি? আপনি কি জানেন আপনার রুম থেকে বের হলেই সবাই আমাকে ঘিরে ধরে জানতে চাইবে কি হয়েছে আপনার আর আমার---বিয়ের--। তাদেরকে আমি কি জবাব দিবো? 

-ওদেরকে এতো জবাবদিহি করার কি হলো? নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিজে নিতে শিখো। কারো কথা শুনে কেন এতোটা ভেঙ্গে পড়ছ? আমার কাছে সাজেশন যদি চাও তাহলে বলবো তুমি কয়েকটা দিন সময় দাও নিজেকে। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তারপর নাহয় ধীরেসুস্থে আবার জয়েন করো। এই অফিসে তোমার জায়গাটা কেউ কখনো নিতে পারবে না মায়াবতী। তুমি তোমার মতো সময় নিয়ে ফিরে এসো কেউ তোমাকে কিছু বলবে না।

-সেটা আর সম্ভব নয় স্যার। হয়তো কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে না, কিছু বলবে না কিন্তু আমি নিজে তো তাদের কারো চোখে চোখ রেখে মাথা উঁচু করে চলতে পারবো না। এমনিতেও আজ আমি অফিশিয়াল রেজিগনেশন দিতেই এসেছি স্যার।

-মায়া? কিসব বলছ? সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে রেজিগনেশন দেয়ার কোনো মানে আছে?

-সামান্য ব্যাপার না স্যার। আপনি না জানলেও অফিসের সব কয়জন স্টাফই ব্যাপারটা খুব ভালো করেই জানে। 

-হোয়াট!

-আমি যতদিন থাকবো ততদিন তারা কিছু না বললেও তাদের কটুদৃষ্টি আমাকে প্রতিটা মূহুর্তে আমাকে হাজারটা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিবে। আপনার হয়তো আমার কাজ করা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না স্যার। কিন্তু আমার? আমার পক্ষে এরপর একটা সেকেন্ডের জন্য আপনার সামনে আসতে নিজেকে----।

-মায়া? প্লিজ রিল্যাক্স? আমার কথাটা তো শোনো? এভাবে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নাও। 

মায়া আর কিছু না বলে নিজের রেজিগনেশন লেটারটা টেবিলের উপরে রেখে উঠে দাঁড়ালো। মায়ার কফির মগটা টেবিলের উপরেই যেরকম দেয়া হয়েছে সেভাবেই পড়ে রয়েছে দেখে রাহাত মুখ তুলে মায়ার দিকে তাকালো। রাহাতের কেন যেন মনে হচ্ছে মায়া আজ অন্য কিছু বলতে এসেছিল। কিন্তু হয়তো রাহাতের উত্তরগুলো শুনে ওর কথাগুলোও ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু রাহাতের তো অনেক কথা বলা বাকি মায়াকে। হয়তো কথাগুলো না জানলে মায়ার বিশেষ কোনো ক্ষতি হবে না। তবু রাহাতের আজ বলতে ইচ্ছে করছে। রাহাতও উঠে দাঁড়িয়েছে এমন সময় মায়া ফিরে যেতে গিয়েও আবার ফিরে তাকালো রাহাতের দিকে। 

-গত ছয়টা মাস আপনাকে অনেক বিরক্ত করেছি স্যার। আমার জন্য হয়তো অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতেও পড়তে হয়েছে। সেজন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি স্যার। পারলে মাফ করে দিবেন। আর আমার জন্য আপনাকে এমন কিছু ফেইস করতে হবে না আশা করি। আসছি স্যার।

-মায়া? শোনো?

-আপনাকে কিছু কথা বলার জন্য এসেছিলাম স্যার। আপনার কাছ থেকে কথাগুলো শোনার পর আর সেটা বলার প্রয়োজন দেখছি না। ভালো থাকবেন স্যার।

-তুমি জানতে চাইছিলে না মায়া আমি তোমাকে কেন বিয়ে করতে চাই নি? তোমার দোষ কোথায়? আসলে দোষটা তোমার নয় মায়া। দোষটা আসলে কারো নয়। দোষটা আমার ভাগ্যের। তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাষাও আমার নেই। কিন্তু কিছু বলার আছে। শুনবে প্লিজ?

-বলুন। শেষবার নাহয় আপনার কথাগুলো শুনি। তাতে অন্তত যদি নিজের ভুলটা জানতে পারি--।

-এসো আমার সাথে----?

-কোথায়?

-প্লিজ কোনো প্রশ্ন করো না।

-আচ্ছা।

রাহাত মায়াকে নিয়ে সবার সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেল অফিস থেকে। সবাই কৌতূহলী চোখে রাহাত আর মায়াকে দেখছে। নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করলেও রাহাত বা মায়া কাউকে গিয়ে প্রশ্ন করার সাহস কারো হলো না। রাহাত ব্যাপারটা খেয়াল করেই মায়ার হাত ধরে টেনে অফিস থেকে বেরিয়ে মায়াকে গাড়িতে বসিয়েই গাড়ি স্টার্ট দিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামতেই মায়া বাড়িটা দেখতে পেল। শহর থেকে বেশ দূরেই বাড়িটা। তার উপরে এলাকাটাও বেশ শান্ত। এমন একটা জায়গায় রাহাত ওকে কি বলতে নিয়ে এসেছে সেটাই মায়া বুঝতে পারলো না। রাহাত মায়াকে নিয়ে সোজা বাড়িটার ভিতরে ঢুকে কোণার একটা রুমে নিয়ে এলো। রুমে ঢুকেই মায়া হা করে তাকিয়ে রইলো। পুরো রুমটা ধবধবে সাদা রঙ করা। মায়ার মনে হচ্ছে কোনো এক বরফের দেশে চলে এসেছে ও। তার চেয়েও বেশি অবাক করা হলো রুমটার একপাশের দেয়ালে কয়েকশো ফটো ফ্রেমে থরে থরে রাহাত আর একজনের ছবি সাজানো আছে। রাহাতের সাথে থাকা মেয়েটির মুখটা দেখে মায়া চমকে উঠলো। রাহাত নিজে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে স্মৃতির আর ওর বড় করে বাঁধানো ছবিটায় হাত ছুঁইয়ে দিল।

-মায়া তুমি যদি আমাকে প্রশ্ন করো আমি কাকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তবে উত্তরটা হবে স্মৃতি।  আবার যদি প্রশ্ন করো কাকে আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি তাহলেও উত্তরটা হবে স্মৃতি। এই হলো আমার স্মৃতি। প্রথম দেখায় ওকে আমি পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এতোটাই ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে যে ওর প্রত্যেকটা কথা আমি চোখ বুজে বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম। ও বারণ করেছিল যেন ওর ব্যাপারে বা কোনো কাজ নিয়ে যেন আমি ওকে প্রশ্ন না করি। করি নি। বলেছিল ভরসা করতে। সেটাও করেছিলাম। ও বলেছিল এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করতে হবে। তাই পুরো ডাবলিন শহর খুঁজে একজন মুসলিম ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে খুঁজে বের করেছিলাম আমি। কিন্তু ও সেদিন কথা রাখে নি মায়া। ও আসেনি সেদিন। আমাকে বলে গিয়েছিল ওর ফ্রেন্ড যার থ্রুতে ও আয়ারল্যান্ডে এসেছে তার ঠিকানা খু্ঁজে বের করেছে। ওর সাথে একসাথেই ম্যারেজ হলে আসবে--। কিন্তু সেটা যে ওর আরেকটা নাটক ছিল আমি বোকা লোকটা সেটা বুঝতেই পারি নি---।

-মানে? উনি আসেন নি কেন?

-কেন আসে নি আমি জানি না। ও যে ঠিকানাটার কথা বলে গিয়েছিল সেখানে কেউ ওকে চিনেও না। তবুও ভাবলাম হয়তো আমিই ভুল করছি। সারা ডাবলিন শহর পাগলের মতো খুঁজেছি ওকে আমি। ডাবলিন পুলিশ পুরো শহর, প্রত্যেকটা হসপিটাল তন্নতন্ন করে খুঁজেও ওকে পায় নি। পাবে কি করে? ও আমার কাছ থেকে পালাতে চাইছিল। 

-মানে?

-স্মৃতির সাথে যেদিন প্রথম বার দেখা হয়েছিল সেদিন ও বলেছিল ও সেদিনের ফ্লাইটেই আয়ারল্যান্ড এসেছিল। হাস্যকর ব্যাপার কি জানো? ওইদিন আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় কোনো ফ্লাইটই আসে নি আয়ারল্যান্ডে। তারপর যে হোটেল থেকে আমি নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম সেটায় খোঁজ নিয়ে কি জানতে পারলাম জানো? জানলাম স্মৃতি ওই হোটেলে তিনমাস ছিল। আর যেদিন ও ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করবে বলে বের হয় সেদিনও স্মৃতি এই হোটেলেই ওঠে। সেখানে ওর 'ফিওয়ন্সে' ওর সাথে দেখা করতে এলে স্মৃতি চেক আউট করে ওর সাথেই বের হয়। 

-হোয়াট?

-আশ্চর্য কি জানো মায়া? কেউ একজন আমাকে কল করে জানিয়েছিল স্মৃতি আমাকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে যাবে। আমি তার কথা বিশ্বাস না করে স্মৃতির উপরেই ভরসা করেছিলাম। ওকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম। আর এখন প্রচন্ড ঘৃণা করি। কিন্তু আমার সবটা জুড়ে শুধু ওর বসবাস। ওর সাথে আমার জীবনে কখনো দেখা হবে কিনা জানি না। কিন্ত ওর জায়গায় আমি কাউকে বসাতে পারবো না মায়া। তোমাকেও না। 

-মৌনি আপু!

রাহাতের কথাগুলোর সাথে নিজের জানা ঘটনাগুলো মেলাতে পারছে না মায়া। এই মানুষটাকে মায়া চিনে। রাহাত নিজের দিক থেকে এক বিন্দুও মিথ্যে বলছে না সেটাও মায়া জানে। কিন্তু অন্য পাশের মানুষটা তো এমনটা করতেই পারে না। নিজের মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে মায়া। বাইরে যে সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনিয়েছে সেদিকেও হুঁশ নেই মেয়েটার। আর রাহাত? সে স্মৃতির ছবিটা ছুঁয়ে দিয়ে নিজের মনে কথা বলছে। কথাগুলো যাকে শোনাচ্ছে সেই মানুষটা যে কখন বেরিয়ে গেছে সেটা রাহাত জানতেও পারলো না।

১৬!! 

-এই মেয়ে? তোমার নূন্যতম কমনসেন্সও নেই নাকি? এভাবে না বলে চলে এলে কেন? খুব বেশি সাহস বেড়েছে না তোমার? এভাবে অচেনা অজানা একটা রাস্তায় অন্ধকারের মধ্যে বেরিয়ে গেছ! আর যাচ্ছই বা কোথায়? আমি তাকে এদিকে পাগলের মতো খুঁজছি। আর সে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছে। ইচ্ছে করছে ধরে----। ওই মেয়ে? কানে শুনতে পাও না? তোমাকে বলছি আমি--। হ্যাভ ইউ লস্ট ইওর মাইন্ড? কি ভেবে বের হলে বাড়ি থেকে বলো আমাকে--। বলো?

মায়া থতমত খেয়ে রাহাতের রাগে টকটকে লাল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মৌনির কথা ভাবতে ভাবতে কখন বাসাটা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে এসেছিল মায়া নিজেও জানে না। যখন খেয়াল হলো তখন মায়া নিজেও কিছুটা ভয় পেল। কিন্তু ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সামনের দিকে পা বাড়ালো মায়া। এই মানুষটার অপেক্ষায় থাকার মতো আর কিছুই বাকি নেই মায়ার জীবনে। জীবনের বাকি পথটা তো এই মানুষটাকে ছাড়াই সামনে এগিয়ে যেতে হবে মায়াকে। তাহলে এই সামান্য অন্ধকার রাস্তাকে ভয় পেয়ে আর কি হবে? এদিকে রাহাত নিজেকে সামলে নিয়ে পিছনে তাকাতেই মায়াকে না দেখতে পেয়ে বাইরের দিকে ছুটে গেল। বাড়ির ত্রি সীমানাতেও কারো ছায়া পর্যন্ত চোখে পড়লো না রাহাতের। রাহাত তড়িঘড়ি করে গাড়ি নিয়ে বের হলো মায়াকে খুঁজতে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেক আগেই। এই অন্ধকারের মধ্যে মেয়েটা কোন দিকে গেছে সেটাও বুঝতে পারছে না রাহাত। কোনোমতে সামনের দিকে গাড়ি চালিয়ে কিছুদূর আসার পর গাড়ির হেডলাইটের আলোয় কাউকে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দেখে ছুটে এলো রাহাত। মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের দিকে তাকিয়েই রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে গেল রাহাতের। মায়া এখনো রাহাতের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে দেখে রাহাত মায়াকে টেনে গাড়িতে বসিয়ে ধুম করে দরজাটা বন্ধ করে নিজে এসে ড্রাইভারের সিটে বসলো। রাহাতের এমন কাজে মায়া ভয় পেয়ে চুপসে গেছে একেবারে। রাহাত এবারে মায়ার দিকে তাকালো।

-কি সমস্যা কি তোমার মায়া? চাইছ টা কি তুমি? এভাবে একা রাস্তায় বের হওয়া কতোটা রিস্কি জানো না তুমি? তার উপরে এমন বেখেয়ালে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছ? পিছন থেকে হঠাৎ কোনো গাড়ি এসে ধাক্কা দিলেও তো টের পেতে না। 

-কি আর হতো স্যার? বড় জোর মরে যেতাম। অন্তত এই জীবনটা থেকে মুক্তি পেয়ে যেতাম। আর আপনিও-----।

মায়া কথাটা শেষ করার আগেই রাহাত মায়ার ডান হাতের বাহুটা চেপে নিজের দিকে টেনে আনলো। 

-তোর খুব মরার শখ হয়েছে না? খুব শখ হয়েছে? কি এমন হয়েছে তোর যে মরে যেতে হবে? আর কখনো এমন আজাইরা কথা বলতে শুনলে কপালে তোমার খুব খারাবি আছে বলে দিলাম মায়া।

-স্যার ছাড়ুন। লাগছে আমার।

-আমি ধরেছি আর ওমনি লাগছে না? আর এভাবে যে হুট করে বেরিয়ে এসেছ কি ঘটতে পারতো সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তোমার? এইরকম ফাঁকা একটা রাস্তায় একা কোন সাহসে বের হলে তুমি? আনসার মি।

-কিছু তো হয়নি স্যার। তাছাড়া এভাবে একা চলার অভ্যেস তো করে নিতে হবে আমাকে। সবসময় তো আর আমাকে বাঁচাতে আসবেন না আপনি। নিজের লড়াইটা আমাকে নিজেকেই করতে হবে। তাই এই সামান্য এইটুকু অন্ধকার রাস্তা দেখে ঘাবড়ে থেমে গেলে চলবে বলুন?

-এটাকে তোমার সামান্য একটু রাস্তা মনে হচ্ছে? শহর থেকে কতোটা দূর আছি ধারণা আছে তোমার? কোনদিকে যেতে হবে? বা এটা কোন এলাকা জানো?

-জানি না। তাতে কি হয়েছে? খুঁজে নিবো। এ আর এমন কি। 

-খুঁজে নিবি না? যা---। এখান থেকে তুই একা একাই বাসায় যা। আমিও দেখি--। নাম?

রাহাত রাগে মায়াকে ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিলো। মায়া সত্যি সত্যি গাড়ির দরজা ঠেলে খোলার চেষ্টা করতেই রাহাত ফুলস্পিডে গাড়ি স্টার্ট দিলো। মায়ার মাথাটা সামনের দিকে গাড়ির সাথে ধাক্কা খাওয়ার আগেই রাহাত মায়াকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে হাত বাড়িয়ে সিটবেল্টটা বেঁধে দিলো। মায়া অবাক চোখে রাহাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আর রাহাত নিজের রাগ সামলাতে ফুল স্পিডে ড্রাইভ করছে গাড়িটা। নিজের রাগের কারণটা রাহাতের কাছেও স্পষ্ট নয়। কিন্তু তবু মায়ার উপরে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে রাহাতের। কিছুতেই রাগটা কন্ট্রোল করতে পারছে না রাহাত।

-স্যার? একটু স্পিডটা কমান প্লিজ? এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে---।

-তো? তুমি তো মরতেই চাইছিলে না? এক্সিডেন্টে তুমি আমি দুজনেই মরে গেলে তো আরো ভালো তাই না? খুব সহজেই এতো ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে। 

-আমি মরলে মরলাম। কিন্তু আপনাকে তো বেঁচে থাকতে হবে। অনেক কিছু জানার যে এখনো বাকি আপনার। 

-কি? কি জানার বাকি? চুপ করে থাকবে না মায়া। বলো? কি জানা বাকি?

-গাড়িটা আস্তে চালান প্লিজ? আমার ভয় করছে স্যার।

-মরতেও চাও। আবার ভয়ও পাও? বাহ!

-প্লিজ স্যার?

-আচ্ছা মায়া আমাকে একটা কথা বলো তো? তোমার মাথায় কি সমস্যা আছে কোনো? তোমার ওই জনমানবহীন শর্টকাট রাস্তা আর আজ এমন অন্ধকারে অচেনা একটা জায়গায় একা বেরিয়ে পড়লে! তোমাকে কি করা উচিত তুমিই বলো?

-কি আর করবেন? তাছাড়া ওই রাস্তা দিয়ে দিনের বেলাতেই তো যেতাম। 

-তোমার কি মনে হয় দিনের বেলায় ওই নির্জন রাস্তায় বিপদে পড়বে না? নাকি দিনে রাস্তাটা রাতের চেয়ে সেইফ?

-আপনি এতো ওভাররিএ্যাক্ট করছেন কেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না আমি। কিছু যখন হয়নি তাহলে এসব আলোচনা করার কোনো কারণ আছে?

-আমি ওভার রিএ্যাক্ট করছি? 

-নয়তো কি? দয়া করে এমন কেয়ার দেখিয়ে আমাকে কনফিউজড করবেন না। আপনি নিজের কাছে কতোটুকু ক্লিয়ার আমি জানি না। কিন্তু আপনার এই অযাচিত কেয়ারগুলো বিষের মতো লাগছে আমার।

-মায়া! 

মায়া বাইরের অন্ধকারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ মোছায় ব্যস্ত। রাহাত কি বলবে বুঝতে পারছে না। ওর প্রতিটা কাজে প্রতিটা কথাতেই এখন মেয়েটা কষ্টই পাচ্ছে। তাই কিছু না বলে চুপ করে গাড়ি চালানোয় মন দিলো রাহাত। মায়া একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে রাহাতের দিকে তাকালো।

-জানেন? আমি আজ এখানে আপনাকে কি বলার জন্য এসেছিলাম? গত দুদিনে কত মানুষ আমাকে কত প্রশ্ন করেছে, কত কথা শুনিয়েছে সেসবে আমি একদম কান দিই নি। ভেবেছি হয়তো আপনি কোনো কারণে আমার উপরে রেগে আছেন। তাই ওইদিন ওভাবে চলে এসেছেন। কিন্তু আজ সকালের একটা ঘটনায় আমি বাধ্য হয়েই আপনার কাছে ছুটে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম একমাত্র আপনিই পারেন আমাকে এই বিপদটা থেকে বাঁচাতে। কিন্তু----।

-কি হয়েছে মায়াবতী? বলো প্লিজ? দেখো আমি জানি না আমি কতোটুকু হেল্প করতে পারবো তোমাকে। কিন্তু এমন কিছু হতে দিবো না যা তোমাকে কষ্ট দেয়---।

-আজ সকালে দ্বীপ স্যার উনার বাবা মাকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছেন। উনার বাবা মা আপনার সাথে আমার ঘটনাটা পুরোটা জানেন। তবু তারা চান----।

-বুঝলাম না। এখানে দ্বীপ এলো কোথা থেকে?! আর ওর বাবা মা তোমাদের বাসায় কি করতে গেছে? কি চায় উনারা? বলো মায়া?

-উনারা চান দ্বীপ স্যারের সাথে আমার বিয়েটা হোক। মায়ের সাথে এটা নিয়ে উনারা আজ কথা বলে গেছে। মা এখনো কিছু বলে নি। কিন্তু উনারা চাইছে এই মাসেই বিয়েটা--।

-হোয়াট?

-আপনি জানেন আমি ভেবেছিলাম এই কথাটা শোনার পর আপনি আর আমার উপরে রেগে থাকবেন না। তাই পাগলের ছুটে এসেছিলাম। কি করবো বলুন? তখন তো আর জানতাম না আপনার জীবনের গল্পে আমার নামটা তো কখনো ছিলই না।

-মায়া? কেঁদো না প্লিজ? 

-কাঁদছি না স্যার। অনেক বকবক করছি আজ আপনার সাথে। হয়তো আজকের পর আর আপনার সাথে আমার দেখা নাও হতে পারে। তাই একটু বেশিই বলে ফেলছি। পারলে মাফ করে দিবেন প্লিজ। 

-মায়া? যতটুকু জানি দ্বীপ ছেলে হিসেবে খারাপ না। এখন পর্যন্ত অফিসে ওর কোনো ব্যাড রেকর্ড নেই। তবু--। তুমি কি চাও বলো? তুমি কি দ্বীপকে বিয়ে করতে চাইছ না? আমি কি আন্টিকে কিছু বলবো?

-আপনি এতো ভাববেন না স্যার। যা হচ্ছে সেটাই নাহয় হোক। আমার ভাগ্যে যা আছে সেটা তো আমি বদলাতে পারবো না। আমি নাহয় ভেবে নেবো যে আমার হৃদয়ের সবটা জুড়ে আপনি থাকলেও আমার ভাগ্যে আপনি নেই। 

কথাগুলো বলে মায়া কিছুক্ষণ রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মায়ার মুখটা দেখে রাহাত বুঝতে পারলো না মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে নাকি অবাক হয়েছে। একটু পরে রাহাতের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মায়া আবার বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকালো। রাহাতও এক নজর মায়ার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালানোয় মন দিলো। মায়াকে কিছু বলে শ্বান্তনা দেয়ার ভাষা নেই রাহাতের। মায়াবতীটাকে এভাবে দেখতে রাহাতেরও ভালো লাগছে না। কিন্তু কি করবে ও? ওর সবটা জুড়ে যে এখনো স্মৃতিরই বসবাস, স্মৃতিরই অধিকার। মনের মধ্যে অন্য কাউকে রেখে মায়াকে কি করে কাছে টানবে রাহাত? তাছাড়া মায়াকে ও কষ্ট ছাড়া আধো কিছু কি দিতে পারবে? এর চেয়ে নাহয় মেয়েটা অন্য কারো সাথেই সুখে থাকুক।
Author, Publisher & Developer

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উফ!
মনে হচ্ছে আপনার ইন্টারনেট সংযোগে কিছু সমস্যা আছে। অনুগ্রহ করে আগে আপনার ইন্টারনেটের সংযোগ ঠিক করুন এবং তারপর আবার ব্রাউজিং শুরু করুন৷
AdBlock সনাক্ত করা হয়েছে!
আমরা শনাক্ত করেছি যে আপনি আপনার ব্রাউজারে অ্যাডব্লকিং প্লাগইন ব্যবহার করছেন৷ আমরা আপনাকে আপনার অ্যাডব্লকিং প্লাগইন বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করছি, কারন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমরা যে রাজস্ব আয় করি তা এই ওয়েবসাইট পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হয়।