চারদিকে অন্ধকার আর নিরবতা।মাঝে মাঝে এক দুটো গাড়ি ছুটে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যে। গাড়ির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে এক মায়াবী কন্যা। বাতাস এসে ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে তার উজ্জ্বল শ্যামলা মুখশ্রীতে।বাতাসের দাপটে সে একটু পরপর চোখ বন্ধ করছে। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা গুলো।
হঠাৎ মাথা উঠিয়ে সামনে থাকা ড্রাইভার কে কাপা কাপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল- আর কতক্ষণ লাগবে চাচা?
- আরো একঘন্টা লাগবে মামণি। তোমার শরীর কি খারাপ লাগছে?যদি কিছু মনে না করো একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
- আপনি বিনা দ্বিধায় জিজ্ঞেস করুন চাচা।
- তোমার কি বেশি কষ্ট হচ্ছে মামণি?
মেয়েটা কাপা কাপা কন্ঠে জবাব দিল-- না চা চা ঠিককক আছি আমি।
কথাটা বলার সাথে সাথেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল মেয়েটা। আসলেই কি সে ঠিক আছে? যদি ঠিকই থাকে কেনো এত কাঁদতে হচ্ছে এই মায়াবী কন্যাটার? কেনো সে এতো ভেঙে পড়ছে?
ড্রাইভার মেয়েটার দিকে ফিরে তাকে শান্তনা দেয়ার জন্য কিছু বলতে যাবে তখনি ঘটে গেল অঘটন। একটা ট্রাকের সামনে থেকে ধাক্কার প্রভাবে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গিয়ে একটি বড় গাছের সাথে ধাক্কা খেলো। গাড়ির সামনের অংশের কাচ ভেঙে গিয়ে আঘাত হানল গাড়ির ভিতরে দুজন মানুষের উপর। নিস্তেজ হয়ে রইল গাড়ির ভেতরে থাকা দুজন মানুষ। জোরে ধাক্কায় গাড়ির দরজা খুলে নিচে পড়ে রইল মেয়েটার রক্তমাখা কাঁচ বিদ্ধ সুন্দর হাতটা। আবারও চারদিকে নিস্তব্ধতা।
প্রায় তিনটা গাড়ি ছুটে চলছে তাদের গন্তব্যে। হঠাৎই গাড়ি তিনটি থেমে যায়।
একজন অতি সুন্দর ছেলে মোবাইল থেকে নজর সরিয়ে তার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এর উদ্দেশ্য গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল -- কি হলো নিশাদ গাড়ি কেনো থামালে?এনি প্রবলেম?
নিশাদ একদম শান্তস্বরে জবাব দিল--ক্ষমা করবেন স্যার। কিন্তু সামনে দেখুন একটা গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। গাড়িটি দেখেই বুঝা যাচ্ছে যেকোনো সময় ব্লাস্ট হতে পারে।বাহির থেকে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।হয়তো ভিতরে মানুষ আছে।আমরা কি হেল্প করবো স্যার নাকি গার্ডদের আর ড্রাইভার কে বলবো গাড়ি স্টার্ট দিতে?
আয়াজ কিছু জবাব না দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো।সাথে সাথেই বাকি দুই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো গার্ডস এবং নিশাদ। কাউকে তোয়াক্কা না করে আয়াজ এগিয়ে গেলো গাড়িটির দিকে।কিছুদূর যাওয়ার পরেই তার চোখে পড়ল রক্তমাখা হাতটির দিকে। হাতটা দেখেই বুঝতে পারল এইটা একটা মেয়ের হাত।দ্রুত পা এগিয়ে সে গাড়িটির কাছে গেলো।নিশাদ ও গাড়ির দরজা খুলে দ্রুত ড্রাইভারকে গার্ডদের সাহায্য নিয়ে বের করে নিজেদের একটা গাড়িতে উঠিয়ে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করল।
মেয়েটা কপাল কেটে রক্ত গড়গড়িয়ে পড়ছে।মাথা অন্যদিকে হেলে আছে। আয়াজ এর কেমন যেনো লাগল মেয়েটাকে এইভাবে রক্তমাখা হয়ে পড়ে থাকতে দেখে। সে মেয়েদের কখনও স্পর্শ করে না। অপরিচিত একটা মেয়েকে স্পর্শ করতে তার কেমন যেনো লাগছে।কিন্তু তার মন বার বার চাইছে মেয়েটার চেহারাটা দেখতে। তাই সে নিশাদ এর অপেক্ষা করছে।নিশাদ আসলেই বলবে মেয়েটা কে গাড়িতে উঠাতে। হাত বাড়িয়ে নিজের ঘড়িতে সময় দেখে নিলো সে।
রাত দুটো বাজে।সময় দেখে ভ্রু কুচকে এলো তার।এতো রাতে একটা মেয়ে কোথায় যাচ্ছিল? তাও একা একা।
তার ভাবনার মাঝে নিশাদ এসে পাশে দাঁড়াতেই আয়াজ তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে তাদের গাড়িতে তুলে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে বলল।
নিশাদ ভালো করে জানে আয়াজ কখনও একটা অপরিচিত মেয়েকে কুলে তুলবে না ।এই মানুষটাকে যতই দেখে ততই মুগ্ধ হয়।মাঝে মাঝে ভাবে এই মানুষটার পারসোনালিটি আর মানুষটা এতো মুগ্ধতায় ভরপুর কেনো...
নিশাদ গাড়ির দরজার কাছে গিয়ে একটু ঝুঁকে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিল। এতো বেশি সিরিয়াস ইনজারড হয় নি।হাতে কাচ বিঁধেছে আর সামনের দিকে বারি খাওয়ায় কপাল কেটে রক্ত বের হচ্ছে।
পাশেই দাড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল আয়াজ।নিশাদ মেয়েটাকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে তখনি আয়াজের চোখ আটকালো মেয়েটার উজ্জ্বল শ্যামলা মুখে।বুকে ভিতর ধুক করে উঠল তার। মুখ দিয়ে কাপাস্বরে বেরিয়ে এলো---"" প্রিয়তা""...
—————
আস্তে আস্তে চোখের পলক দুটো ঝাপটিয়ে চোখ মেলল আরশি।মাথা ব্যাথার যন্ত্রণায় চোখ দুটো খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে তার। নিজের ডান হাত নাড়াতে গিয়ে অনুভব করল হাত টাও কেমন বারি লাগছে আর ব্যাথা করছে।তাই সে পাশ ফিরে দেখতে পেল তার হাতে ব্যান্ডেজ। তার আর বুঝতে বাকি রইল না সে এখন হসপিটালে অবস্থান করছে।সে মনে মনে বলতে লাগল---" আমায় আবার হসপিটালে আনল কে?কার এতো দরদ হলো আমার প্রতি? কেউ ধাক্কা দিয়ে ছুড়ে মারে আবার কেউ জীবন ও বাঁচায়""
মনে মনে কথাটা বলেই সামনের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধন করল আরশি। সামনে সোফায় হাতের ওপর ভর দিয়ে মাথা নিচু করে একজন অতি সুদর্শন ছেলে কে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে এলো তার।আরশির এই একটা স্বভাব যখনি সে কোনো কিছুতে আগ্রহ প্রকাশ করে তখনি তার ভ্রু দুটো কুঁচকে আসে।এই মুহূর্তে ও তার আগ্রহ জন্মাছে সামনে বসে থাকা সুদর্শন যুবকের চেহারাটা দেখার।তার আর বুঝতে বাকি নেই এই মানুষ টাই তাকে হসপিটালে এনেছে। তার এখন ছেলেটা কে বলতে ইচ্ছে করছে--"এই যে সুদর্শন যুবক মাথা তুলে সামনে তাকান আর দেখুন আমি তো জেগে গেছি। আপনি কি আমাকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য নিয়ে এসেছেন নাকি ওমন করে মাথা নিচু করে বসে থাকার জন্য হসপিটালে এসেছেন।"
আরশির ওমন অদ্ভুত ভাবনার মাঝেই মাথা উপরের দিকে উঠিয়ে আরশির দিকে তাকাল আয়াজ।
ছেলেটা আরশির দিকে তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া। এ সে কাকে দেখছে।তিনি তো বিখ্যাত অভিনেতা আয়াজ বিন সাদ। যার পারসোনালিটি অভিনয় সুদর্শন লুক প্রত্যেক টা মানুষের নজর কাড়ে।তেমনি আরশির ও এই মানুষটার পারসোনালিটি খুব ভালো লাগে।তার ভাবতেই অবাক লাগছে আয়াজ বিন সাদ তাকে বাচিয়েছে এবং তার জন্য এইভাবে বসে অপেক্ষা ও করছে।এই মানুষটা তার জন্য ব্যতীত কখনও অন্য কারো জন্য অপেক্ষা করেছে কিনা জানা নেই আরশির।তবে ভালোই লাগছে তার আয়াজ কে সরাসরি দেখতে পেয়ে। আগে তো টিভি তে দেখতো আর তখন ইফাজ..
আরশি কে এইভাবে নিজের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আয়াজ বসা থেকে উঠে সামনে এগিয়ে গেল। আরশির সামনে এগিয়ে এসে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-"এখন কেমন লাগছে মিস?মাথা ব্যাথা করছে?খারাপ লাগছে?
আয়াজ আারশি কে এতো প্রশ্ন করে নিজেই নিজের প্রতি অবাক। সে কখনও কাউকে একসাথে এতো প্রশ্ন করেছে কিনা সন্দেহ আছে।আর তাকে ও কেউ বেশি প্রশ্ন করলে তার পছন্দ হয় না।আয়াজ যতটা মুগ্ধকর তার চেয়ে ও দ্বিগুণ রাগী।তার রাগ সম্পর্কে সবাই অবগত।তাই যেচে নিজের ঘাড়ে শনি কেউ ডেকে আনে না।
আরশি এখনও থম মেরে বসে আছে।মনে হলো যেনো সে আয়াজের কথা শুনতেই পাচ্ছে না।তার এমন থম মেরে বসে থাকা দেখে এবার মাথায় চরচর করে রাগ উঠে যাচ্ছে আয়াজের।সে গম্ভীর আর রাগী কন্ঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজার ওপাশ থেকে নিশাদ বলে উঠল -" আসবো স্যার? "
- ইয়েস কাম ইন নিশাদ।
কথাটা বলেই আয়াজ পাশ থেকে টুল টেনে বসে পড়ল।নিশাদ ভিতরে ঢুকেই আরশির দিকে তাকালো।দেখল আরশি কেমন অবাক হয়ে বসে আছে।নিশাদ একবার আয়াজের দিকে তাকালো।আয়াজের শান্ত চেহারা টা দেখে নিয়ে ঢুক গিলে আরশির দিকে প্রশ্ন ছুড়ল-" কেমন আছেন ম্যাম?"
ম্যাম ডাকটা শুনেই আরশি চকিতেই নিশাদের দিকে তাকালো।মাথা ব্যাথায় জোরে কথা বলতে পারছে না তাই আস্তে করেই জবাব দিল-"ম্যাম কাকে বলছেন ভাইয়া? আমার নাম রিয়ানা জাহান আরশি। আপনি আরশি বলেই ডাকুন।আমি তো আপনার ছোট ম্যাম বলে ডাকবেন না।ম্যাম বললে নিজেকে কেমন বড় বড় লাগে। আর এখানে যা হচ্ছে তা কি সত্যি? সত্যিই কি আমার সামনে অভিনেতা আয়াজ বিন সাদ আছে?আপনি তো ওনার পিএ তাইনা?তার মানে সব সত্যি। আপনিও সত্যি আর ওনিও সত্যি।
আরশির এমন এলোমেলো আর অদ্ভুত কথা শুনে মনে মনে অনেক হাসি পেল আয়াজের আর ঠোঁটের কোণায় ভেসে উঠল মুচকি হাসি।হাসিটা তার সৌন্দর্য যেনো আরো দ্বিগুণ করে দিলো।মনে মনে আওড়াতে লাগলো-"মেয়েটা মাথায় আঘাত পেয়ে পাগল হয়ে গেলো নাতো?"
অপরদিকে নিশাদের তো নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।তার প্রথম কারণ গত রাতে নিশাদ আরশি কে নিয়ে যখনি এগোবে হঠাৎ আয়াজ নিশাদ থেকে আরশিকে কুলে তুলে নিয়ে দপ দপ করে পা ফেলে গাড়িতে উঠে গেল।যেই ছেলে মেয়েদের স্পর্শ করে না তার এমন করে একটা অপরিচিত মেয়েকে কুলে তুলে নেওয়া তে মনে হচ্ছিল সে ঐখানেই নিজের জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।দ্বিতীয় বার অবাক হলো যখন আয়াজ ডক্টর কে বলল -" আমার প্রিয়তার যদি কিছু হয় তবে আপনাদের শান্তিতে থাকতে দিবো না।"
তখন ও সে অবাক হয়েছে আর সারারাত ধরে ভেবেছে প্রিয়তা আবার কে?কিন্তু তার অলস মস্তিষ্কে কিছুই ধরা পড়ে নি।আওয়াজের মুচকি হাসি টাও তার চোখ এড়ায় নি।তিন বছরে এই লোক কে সে এমন করে হাসতে দেখে নি।দেখেছে শুধু মুভিতে হাসতে যা শুধু ছিল অভিনয়ের ক্ষেত্রে মিথ্যা হাসি। নিশাদ ভাবতেই থাকল মনে হচ্ছে এই বুঝি সে জ্ঞান হারাবে,,,
ডাক্তার এসে আরশি কে চেকআক করল এবং জানাল সে এখন পুরোপুরি সুস্থ আর কয়েকদিন রেষ্ট নিলেই ব্যাথা সেরে যাবে।আরশি ড্রাইভার এর কথা জিজ্ঞেস করাতে তিনি জানালেন ড্রাইভার কিছুটা সুস্থ আর সামনে থাকায় ওনার মাথার আঘাত টা একটু গুরুত্বর।
ডাক্তার চেকআপ করে বের হতেই আয়াজ আরশির একটু কাছে ঝুঁকে আসল।এমন করে আয়াজের কাছে আসাতে আরশির মনে হচ্ছে ওর হৃদপিণ্ড তড়িৎ গতিতে জোরে জোরে লাভ ডাব শব্দ করছে।মুগ্ধ চোখে সে আয়াজের মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইল।মুখ খুলে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু তার গলাটাও কেমন আটকে গেছে।
আয়াজ আরশির চোখের দিকে তাকিয়ে তার কোমর আকড়ে ধরে নিজের আরো কাছে টেনে নিল।কিন্তু কি অদ্ভুত আরশির মুখ দিয়ে কিছুই বের হচ্ছে না।আয়াজ আরশিকে কোলে তুলে নিল।আরশির ছোট্ট হৃদয়টা সাথে সাথেই ধুক করে উঠল।সে খামচি দিয়ে আকড়ে ধরল আয়াজের বুকের কাছের টি শার্ট এর অংশ। আর মুখ দিয়ে উচ্চারিত করল--"মিষ্টার নায়ক"
এমন দৃশ্য দেখে আর সইতে পারল না বেচারা নিশাদ।জ্ঞান হারিয়ে সে লুটিয়ে পড়ল ফ্লোরে।