তিতিরের পুরো শরীর ব্যাথা হয়ে গেছে। সেটা যাওয়ারই কথা। ৫ফুট ৯ইঞ্চি ৭৫ কেজির একটা মানুষ তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য পুরো রাত কম্বোল দিয়ে চেপে ধরে ছিল। ফজরের আযান হচ্ছে কিন্তু মাহাদ অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তিতির আস্তে আস্তে মাহাদকে সরিয়ে দিয়ে উঠে অযু করে এসে রুমে লাইট জ্বালিয়ে এসি বন্ধ করে দিয়ে মাহাদের পাশে বসে রইল।
রুমটা ঠান্ডায় আছে কিন্তু মাহাদের এইটুকু ঠান্ডা দিয়ে কিছু হয়না। মাহাদ দরদর করে ঘামতে শুরু করলো। আর তিতির সেটা চুপ করে দেখছে।
গরমে মাহাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। মাহাদ কিছুক্ষনের মধ্য চোখ মেলে তাকালো। নাহ্ বিদ্যুৎ আছে তাহলে এসি চলছেনা কেন? তিতির এসি বন্ধ করেছ কেন? ওটা ছেড়ে দাও।
তিতির বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা টাউজার আর ট্রী শার্ট বের করে মাহাদের মুখের উপর ছুড়ে মেরে বলল," পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি, ফ্রেস হয়ে এসে নামাযে দাড়ান।"
টাউজার আর ট্রী শার্ট মাহাদের মুখের উপর পড়তেই মাহাদ ধড়পর করে উঠে বিছানায় বসল। তারপর আস্তে আস্তে তার সব কিছু মনে পড়লো। সে রাতে টাওয়াল পড়েই ঘুমিয়েছে। মাহাদ তিতিরের দিকে চেয়ে দেখল, তিতির প্রচন্ড রেগে আছে। মাহাদ সেটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল," বৌ, আসো তোমাকে একটু আদর করি। কাল করা হয়নি।"
তিতির কঠিন চোখে ওর আঙ্গুল উঁচু করে মাহাদের দিকে তুলে বলল," আমি যেন পাঁচ মিনিটের মধ্য আমার পাশের জায়নামাযে আপনাকে দেখি। সালাত শেষ করে গিয়ে নাস্তা বানাবেন। সাড়ে সাতটার মধ্য নাস্তা রেডী চাই। কারন নাস্তা সেরে আটটায় আমি ভার্সিটিতে চলে যাব। আর পারলে দুপুরের লাঞ্চও রেডী করে রাখবেন।"
এই তিতির তুমি আমাকে থ্রেড দিচ্ছো? আমি পারবোনা। আমি এগুলো করতে পারিনা।
তিতির মাহাদের একদম কাছে গিয়ে বলল," কেমন করে পারবেন সেটা আমার জানা নেই। কিন্তু আপনাকে পারতেই হবে। আর যদি মনে করেন আমি আপনাকে থ্রেড দিচ্ছি তাহলে সেটাই মনে করেন, হ্যাঁ আমি আপনাকে থ্রেডই দিচ্ছি। তাই কোন কথা না বলে ঝটপট বিছানা ত্যাগ করুন। আপনার বিছানায় থাকা আর পারমিশন নেই।"
তিতির এটা কিন্তু অতিরিক্ত টর্চার হয়ে যাচ্ছে। এমন ব্যবহার করছো কেন?
কাল রাতে আপনি যা করছেন আমার সাথে তার থেকে এটা অনেক ছোট টর্চার। কথা না বাড়িয়ে উঠে পরুন। সালাতের সময় কমে যাচ্ছে। Go.........
পুরো রাত ঠিকমত না ঘুমানোর কারনে মাহাদের প্রচন্ড ঘুম আসছে। কিন্তু স্ত্রীর শাসনে তার কিছুটা ঘুম পালিয়ে গেছে। মাহাদ উঠে ওয়াসরুমে চলে গেল। খানিক পড়ে এসে তিতিরের সাথে সালাতে দাড়িয়ে গেল।
দুজনে একসাথে সালাত আদায় করে তিতির বিছানায় গিয়ে সুয়ে পড়লো। তারপর এ্যার্লাম দিয়ে মাহাদের দিকে তাকিয়ে বলল," সাড়ে সাতটার আগে আপনার কাজ শেষ হওয়া চাই।"
তিতির, এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছেনা? এমন করছো কেন?
আপনার সম্পর্কে আপনি অনেক ফলস্ কথা আমাকে বলেছেন। আপনি আগে কি ছিলেন সেটা আমার ভালো করে জানা আছে। তাই যে কোন কাজ করাটা আপনার পক্ষে অনেক ইজি। তিতির দরজার দিকে আঙ্গুল তুলে বলল," দরজা খোলায় আছে। গিয়ে কাজে লেগে যান। আমি ঘুমাবো। কোন শব্দ যেন না শুনি। সাড়ে সাতটার আগে যদি কোন শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গেছে তাহলে আরো শাস্তি আপনার জন্য অপেক্ষায় আছে।"
তিতির বিছানায় সুয়ে পড়তেই ঘুমে বিভোর হয়ে গেল। আর মাহাদ দাড়িয়ে চুপচাপ তিতিরকে বাক্কেলের মত দেখতে লাগলো। শেষে মাহাদ বাধ্য ছেলের মত কিচেনে চলে গেল। মাহাদ কাজে লেগে পড়লো। মাহাদ যদি জানতো তাকে সকালে উঠেই এগুলো করতে হবে তাহলে বাঘিনীকে সে কখনোই ক্ষেপিয়ে তুলতো না। এমন সময় গোলাব এসে মাহাদের পিছে দাড়িয়েই দু'বার ভুগ, ভুগ করল। মাহাদ পিছন ফিরে মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলল,'" উসসসসসস চুপ, মা ঘুমাচ্ছে দেখতে পাচ্ছিসনা? যা তুইও ওর পাশে গিয়ে ঘুমা।"
মাহাদ কাজে মনযোগ দিতেই গোলাব মাহাদের পায়ের কাছে বসে ওর পায়ের সাথে গালটা ঘেঁষিয়েই উল্টাবাজির মত একটা পলট খেল মনে খুঁশিতে। কারন সে আজ মাহাদকে পেয়েছে।
মাহাদ গোলাবকে ফ্লোর থেকে কোলে তুলে নিয়ে ডাইনিং রুমে এসে ওর খাবার দিয়ে বলল," তুই জন্তু হয়ে বেঁচে গেছিস গোলাব। তাছাড়া তুই মানুষ হলে আমার মত বিয়ে করতে হত আর এভাবে টর্চার সইতে হত। তুই বড্ড বেঁচে গেছিস গোলাব।"
গোলাব কি বুঝল না বুঝল বুঝা গেলনা। কিন্তু এটা বুঝা গেল সে তার মালিকের কষ্ট বুঝতে পেরেছে। তাই খাবার না খেয়ে লাফ দিয়ে নিচে নেমে তিতিরের রুমে চলে গেল।
মাহাদ এসে কাজে মনযোগ দিল। মাহাদ কাজ করছে আর চিন্তা করছে, আমার সম্পর্কে তো তিতিরকে কিছুই বলিনি তাহলে ও জাললো কিভাবে? মাহাদ আর সেদিকে চিন্তা না করে ঝটপট করে দ্রুত হাত চালাতে লাগলো।
সকাল সাড়ে সাতটা বাজতেই এ্যার্লাম বেজে গেল। তিতির উঠে এ্যার্লাম বন্ধ করে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে মাহাদ ওর কাজ সঠিক সময়ের মধ্যই সমাপ্ত করেছে। সব খাবার প্লেটে সাজিয়ে রুমে এসে দেখলো গোলাব একদম তিতিরের গা ঘেঁষে সুয়ে আছে তিতিরের ওড়নাটা খানিকটা বিছিয়ে।
তিতির পাশ ফিরতেই মাহাদ এসে তিতিরকে ধরে ফেলল। তিতির সাথে সাথে তাকাল মাহাদের দিকে। ঘুমের রেস এখনো কাটেনি। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো, " কি সমস্যা।"
"আর একটু হলে গোলাব তোমার নিচে পড়ে যেত। গোলাব তোমার পাশেই সুয়ে আছে।"
"তিতির হাই তুলে আবার ঘুমিয়ে পড়লো।"
তিতির, তোমার তো দেরী হয়ে যাচ্ছে। আবার কেন ঘুমাচ্ছো। ওঠো বলেই মাহাদ তিতিরের পাশে বেডে বসলো। কিন্তু নাহ্ তিতিরের ওঠার নাম নাই। শেষে মাহাদ তিতিরকে ঝাকুনি দিতেই তিতির উঠে বসল। তার পর মাহাদকে অবাক করে দিয়ে তিতির চট করে মাহাদের কোলে বসে মাহাদকে জড়িয়ে ধরে বলল," আজ ক্লাসে যাবোনা।"
এই মেয়ে কখন কোন মোডে থাকে বুঝা যায়না। তিতির, ক্লাস মিস করা চলবেনা। তাছাড়া আমার অফিস আছে। সাড়ে আটটার মধ্য আমাকে বের হতে হবে। আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে।
তিতির সব কিছু ভুলে গিয়ে মাহাদের বুক থেকে মাথাটা তুলে মাহাদের মুখের দিকে অদ্ভুদ ভাবে চেয়ে রইলো।
" কোন সমস্যা তিতির!"
" অনেক সমস্যা বলে তিতির ওর ঠোট মাহাদের গালে ছুয়িয়েই বলল," কাল এত কষ্ট আমাকে কেন দিলেন? আমি খুব কষ্ট পেয়েছি মাহাদ।"
"স্যরি তিতির, আমি বুঝতে পারিনি তুমি এতে এতটা আঘাত পাবে।"
আপনি সব বোঝেন। আর বুঝেই ইচ্ছা করে এমন করেছেন গতকাল রাতে। তিতির চুপ করে রইলো কিছুক্ষন। তারপর মাহাদের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, " আপনার সামনের মানুষটি আপনাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ, তাকে কি নিজের মত করে সম্পূর্ন করবেন?
মাহাদ কিছু বলতে চাইলো তার আগেই তিতির ওর ঠোট জোড়া দিয়ে মাহাদের ঠোট জোড়া দখল করে ফেলল। খানিক পর মাহাদকে ছেড়ে দিয়ে গালে কিস করে বলল, "এর জন্য আপনাকে আমি কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিব।"
" মাহাদ ভ্রু কুচকে বলল," যেমন?"
তিতির মাহাদের কপালে কিস করে বলল, " আপনি আমাকে মাঝে মাঝে অনেক কষ্ট দেন। তারপর ঘাড়ে কিস করে বলল, " আমি আপনাকে এতবড় শাস্তি দিব যা দেখে আপনার বুক কেঁপে উঠবে। তারপর বুকে কিস করে বলল, " আপনাকে পুরো দুনিয়াটাই ভুলে দিব। "
মাহাদ তিতিরের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তিতিরকে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দিল। তারপর তিতিরের একদম কাছে গিয়ে তিতিরকে আলিঙ্গন করতে লাগল। তারপর তার মিষ্টি স্বরে বলল," তিতির, আমি যদি প্রতিটা সকাল এরকম পাই তাহলে খোদার কসম, আমি এরকম একটা সকালও মিস করতামনা। তোমার একটা আলিঙ্গন আমার সমস্ত ক্লান্তকে দুর করে দেয়। তোমার প্রতিটা ছোয়া আমাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। তোমার প্রতিটা অনুভুতি আমার বুক বরাবর এসে আঘাত করে। নিজের কাছ থেকে তোমাকে দুরে সরিয়ে রাখা যে কতটা কষ্টকর সে একমাত্র ঐ আল্লাহ্ সুবহানাতালাই ভালো জানেন। তোমার প্রতিটা নিঃশব্দ শ্বাস আমাকে আমার কঠিন আবরন কে ভেঙ্গে চুরে বার বার তোমার কাছে আনতে বাধ্য করে। এখন মনে হয় ভালবাসার থেকে কোন সুখ পৃথিবীতে আর নেই। মাহাদ তিতিরের মাঝে ডুবে গেল। আজ যা হয় হোক কিন্তু মাহাদ তিতিরকে ছাড়ছেনা। সমস্ত বাঁধা ভেঙ্গে মাহাদ সম্পূর্ন তিতিরের মাঝে ডুবে যেতেই কলিংবেল বেজে উঠলো। মাহাদ সেদিকে কান না দিয়ে তিতিরকে আরো কাছে টানতেই আবার কলিংবেল বাজল পরপর দুই বার। তারপর আবার পরপর তিনবার বাজল। মাহাদ প্রচন্ড রেগে গেল। বেড থেকে উঠে দরজা খুলতে চলে গেল। হয়ত বিধাতা এখন চায়না তাদের মিল হোক।
তিতির উঠে ফোনটা হাতে নিতেই দেখল," আটটা পার হয়ে গেছে।"
অহ্ আল্লাহ্ রোমান্সে দেখছি আমার মস্তিষ্ক সবকিছু ভুলে গেছে। লাফ দিয়ে উঠে ওয়াসরুমে চলে গেল তিতির।
মাহাদ রেগে গিয়ে দরজা খুলতেই হিনুর মা এসে বলল," রাতে নাকি তোমরা ফিরে এসেছ! না মানে দাড়োয়ান বলল। আমাদের ফ্লাটের কলের পানি বন্ধ হয়ে গেছে। একটু দেখতো, তোমাদের ঠিক আছে কিনা? কলের মিস্ত্রি এসেছে।"
জ্বী আন্টি বলে মাহাদ সব কিছু চেক করে এসে বলল," আন্টি আমাদেরটা সব কিছু ঠিক আছে।"
ওকে বাবা বলে হিনুর মা যেতেই মাহাদ বলল," আন্টি একটু আসমাকে পাঠিয়ে দেন।"
♦♦♦♦
তিতির ঝটপট করে রেডী হয়ে ব্যাগটা কাধে নিয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হতেই মাহাদ বলল," এই কই যাও।"
আপনার আমার উপর করা রংবাজির ফলে আমি ক্লাসের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার হাতে একদম সময় নেই। প্লিজ মাহাদ, এখন আর খেতে অন্তত বলবেন না!
খেতে বলবোনা কিন্তু ৫ মিনিট ওয়েট করো আমি আসছি বলে মাহাদ চলে গেল। ঠিক চার মিনিটের মাথায় রুম থেকে বের হয়ে এসে বলল," চল, আমিও অফিসে যাবো। "
" কিহ্, আপনি এই অবস্থায় অফিসে যাবেন? আপনার সম্মান থাকবে? দেখেন, আপনার সম্মান মানে আমার সম্মান। মানুষ আপনাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে আর আমি মেনে নিব?"
রাস্তার মধ্য ঠিক করে নিব বাঁকিটা বলে মাহাদ দরজার কাছে আসতেই আসমাকে পেয়ে গেল।
আসমা, দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে দাও। আমরা বের হচ্ছি বলেই ওরা দু'জনেই বের হয়ে গেল বাসা থেকে।
তারপর মাহাদ তিতিরকে ওর ভার্সিটিতে রেখে ওর অফিসে চলে গেল। মাহাদ ড্রাইভ করতে করতেই নিজেকে বেশ সুন্দর করে পরিপাটি করে ফেললো।
♦♦♦♦
তিতিরের ক্লাস শেষ। বাহিরে আসতেই আজ রেনুর সাথে দেখা হয়ে গেল।
"এই তিতির, দাড়াও।"
রেনুর কথা শুনে তিতির দাড়িয়ে পড়ল। তারপর দু'জনে নানা কথা বলে একসাথে বাসার পথে রওনা দিল। আজ দুপুরে মাহাদ আসবেনা। রাতে আসতে চাইছে তাই তাড়াহুড়ো করে বাসায় যেত হবেনা। রাস্তায় চলতে চলতে রেনু বাই বলে অন্য রাস্তা দিয়ে বাসার পথে রওনা দিল এদিকে তিতির মহাবিপদে পড়ল। যা রোদ পড়েছেনা! রোদে মনে হয় চোখ-মুখ পুড়ে যাচ্ছে। সামনের দোকান থেকে কয়েকটা আইসক্রিম, রোবো আর কোক নিল তিতির। এখনো খানিকটা পথ আছে। কেন যে আজ পায়ে হেটে বাসায় যাওয়ার ভূত চাপল তিতিরের মাথায়, সেটা তিতিরই জানে।
মাহাদ গাড়ী নিয়ে কোন একটা কাজে যাওয়ার জন্য যাচ্ছিল। সাথে পার্রসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট মো. নজরুল ইসলাম রয়েছে। নজরুল সাহেব একটু বেশিই কথা বলেন।
স্যার দেখেন, একটা বোরখা পড়া নানী রাস্তায় হাটছে আর হিজাবের মধ্য দিয়ে আইসক্রিম খেয়ে চলছে। অ হহহহ নানীর আবার পিঠে কলেজ ব্যাগ। আজবতো? নজরুল সাহেব জানালার কাঁচটা খুলেই মেয়েটাকে দেখে বললো," নানী, ভালো করে আইসক্রিম খান।"
নজরুল সাহেব খিক খিক করে হেসে উঠলো।
মাহাদ চট করে ডান দিকে মিরোরে তাকিয়ে দেখলো, তিতির ছিল ওটা। গাড়ী তিতিরের থেকে কিছুটা দুরে থামাল মাহাদ। তারপর রাগীচোখে নজরুল সাহেবের দিকে তাকায়ে বলল," আপনি ওনাকে কি ইফটিজিং করলেন?
স্যার কি যে বলেন, নানীরে কেউ ইফটিজিং করে! এই গুলো কথা বলে আপনি আমাকে লজ্জা দেন কেন?"
লজ্জা দেই এই কারনে যে উনি আমার ম্যাডাম। বের হোন গাড়ী থেকে। রাস্তায় হেটে কর্মস্থলে পৌছান। এসি গাড়ী এখন আপনার জন্য নয়।
" স্যার, সত্যি নামবো?
ইয়েস, মি. নজরুল সাহেব। আপনি এখুনি গাড়ী হতে নেমে যান।
নজরুল সাহেব মুখটা ভার করে সত্যই নেমে গেল। কেন যে শয়তানগিরি করতে গিয়েছিল, নজরুল সাহেব এখন সেটাই ভাবছেন। এমন রোদে বের হতেই গরম হাওয়া চোখে মুখে এসে ধাক্কা দিল।
এদিকে তিতির কাছে আসতেই মাহাদ ডোরটা খুলে তিতিরকে ডেকে কাছে নিয়ে আসলো। তিতির মাহাদকে দেখে অবাক হয়ে গেল।
"আপনি?"
" এই রোদের ভিতর রিক্সা না নিয়ে কেন হেঁটে যাও তুমি? গাড়ীতে ওঠ! আমার সুন্দর বৌ যদি ক্যাইলা হয়ে যায় তাহলে কিন্তু তোমার খবর আছে?"
তিতির গাড়ীতে উঠে বলল," রোবো খাইবেন?"
" ওটা কি জিনিস?"
তিতির ব্যাগের চেন খুলে পলিব্যাগের মধ্য থেকে একটা লিচি ফেভারের রোবো বের করে মাহাদের সামনে ধরলো। খেয়ে দেখেন, গাড়িতে আর এসি চালাতে হবেনা। এমনি ঠান্ডা হয়ে যাবেন।
এটা তোমার রোবো! আল্লাহ্ এর সুবুদ্ধি কবে দিবা? এই পলিব্যাগের ভিতর আর কি আছে বের করো!
" নাহ্, আমি জানি আপনি ফেলে দিবেন। ওগুলো আসমা আর গোলাবের নামে নিয়েছি। আপনাকে এগুলো দিবনা।"
কিহ্ তুমি গোলাবকেও এসব খাওয়াও? তুমি জানোনা, এগুলো খাওয়ালে ওর দাঁতের সমস্যা হতে পারে!
ফার্দার যেন আমি না শুনছি ওকে এগুলো খাওয়াইছো! নিজে এগুলো খেয়ে শরীর খারাপ তো করাবেই তার উপর বাসায় অবলা দুইজনেরও সাথে একই কাজ করবে। একটু দায়িত্ববান হতে শিখ। ঐ দুজন তোমার দায়িত্বে আছে। তাদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব শুধু তোমার। কোথায় তাদের দেখাশুনা করবে তুমি তা না করে তাদের অসুস্থর দিকে ঠেলে দিচ্ছো। দাও ওগুলো বলে তিতিরের কাছ থেকে ওগুলো কেড়ে নিল মাহাদ।
" তিতির অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো," আমার আইসক্রিম, কোক, রোবো।"
মাহাদ গাড়ীর কাঁচ নামিয়ে নজরুল সাহেবকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। সাথে সাথে নজরুল সাহেব কাছে চলে এলেন।
" স্যার, আপনার আমার প্রতি তাহলে এতক্ষনে সুমতি হইলো। এই গরমে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।"
নজরুল সাহেব তিতিরের দিকে তাকাতেই তিতির চোখ গরম করে ওনার দিকে তাকালো। তিতির মনে মনে একবস্তা গালি দিল নজরুল সাহেবকে।
" দুঃখিত নজরুল সাহেব, আমার ম্যাডাম আপনাকে এগুলো দিতে বলল। আপনি গরমে কষ্ট পাচ্ছেন তাই তার দয়া হল। নিন এগুলো বলে সবগুলো নজরুল সাহেবকে দিয়ে দিল মাহাদ।"
" উপহার পেয়ে নজরুল সাহেব খুব খুঁশি হলেন। আপনার মন অনেক ভালো নানী, অহ্ স্যরি। স্যারের ম্যাডাম মানে আমারও ম্যাডাম।
আপনাকে ধন্যবাদ ম্যাডাম, এই গরমে ঠান্ডা জিনিসগুলো উপহার দেওয়ার জন্য।"
নজরুল সাহেব চলে যেতেই তিতির হাফ ফুলে ছোট বাচ্চাদের মত বলল," আপনি আমার সব জিনিস ঐ বজ্জাদ লোককে দিয়ে দিলেন! জানেন, উনি আমায় একটু আগে টিজ করেছেন?"
" তার জন্যই ওনার জায়গা গাড়ীর মধ্য না হয়ে বাহিরের রাস্তায় হয়েছে।"
মাহাদের কথা শেষ না হতেই নজরুল সাহেব আবার এসে গাড়ীর জানালায় কড়া নাড়ল।
মাহাদ বিরক্ত হয়ে আবার গাড়ীর কাচ নামাতেই নজরুল সাহেব তার ৩২ পাটির দাঁত কেলিয়ে বলল," ম্যাডাম, আপনি বড়ই দয়ালু। আপনার অনুমতি যদি হয় তাহলে আপনার পা ছুয়ে সালাম করতাম। আহা, আপনাকে আমি টিজ করলাম আর আপনি আমায় এতকিছু দিলেন? এই জন্যই কথায় আছে গুরুজনকে কদর করতে হয়। তারাই একমাত্র বিপদে সহায় হয়। ধন্যবাদ ম্যাডাম, আমাকে আমার শৈশব মনে করে দেওয়ার জন্য। শেষে একটা কথা বলি, আপনার এতবয়স কিন্তু আপনি কলেজ পরুয়া মেয়েদের মত কাঁধে ব্যাগ নিয়েছেন কেন? এটা একদম বেমানান ম্যাডাম।
এবার তিতিরকে পায় কে! ওনার কথা শুনে রেগে মনে হয় বাষ্ট হয়ে যাবে। ব্যাট্যা আমি তোর নানীর বয়সী, বোরখা খুললে তুই আমার নানা হয়ে যাবি আর আমারে নানী বলিস? তোরে দেখাচ্ছি মজা বলেই নুজরুল সাহেবের হাত থেকে ওগুলো কেড়ে নেওয়ার জন্য এগুতেই মাহাদ সব কিছু বুঝে যায়। মাহাদ খপ করে তিতিরকে ধরে বলল," নজরুল সাহেব আর একটা কথা বললে ওগুলোও হারাবেন। তাই হারাতে যদি না চান তাহলে এখুনি এখান থেকে চলে যান। শেষে ম্যাডামের আক্রোশ থেকে আমিও আপনাকে বাঁচাতে পারবোনা।
মাহাদ দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। আর তিতির ক্ষেপে গিয়ে মাহাদকে ইচ্ছামত ঝাড়ি দিতে লাগলো। যেমন গুরু তেমন তার শিষ্য। আর এক মিনিট দেরি করলে ওনার খরব করে ছাড়তাম। আমারে নানী বলা!
রাগ করো কেন বৌ! দেখেছ, তুমি কতটা পারফেক্ট পর্দা করেছ যার জন্য তোমার বয়স পর্যন্ত অনুমান করা যাচ্ছেনা। আল্লাহ্ সুবহানাতালা তোমার প্রতি কতটা খুঁশি হবেন। তাছাড়া নজরুল সাহেব খুব সহজ সরল সাদা মনের একজন মানুষ।
মাহাদের কথা শুনে তিতির চুপ করে রইলো। শুধু আল্লাহ্ সুবহানাতালার কথা বলল বলে এদের গুরুশিষ্য কে ছেড়ে দিল। উমহ্ নজরুল সাহেব সাদা মনের মানুষ। যে রাস্তায় টিজ করতে পারে সে কিভাবে সাদা মনের মানুষ হতে পারে?
বাসার কাছে এসে মাহাদ তিতিরকে নামিয়ে দিল আর বললো সন্ধ্যায় আসবে সে।
তিতির বাসার ভিতর চলে গেল। তারপর ব্যালকুনিতে এসে দাড়াতেই মাহাদ ওকে দেখে গাড়ী স্টার্ট দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।
এদিকে নজরুল সাহেব একটা ট্রাক্সিতে উঠে মনের সুখে আইসক্রিম খেতে লাগলো। তার ছোটবেলার কথা মনে পড়লো। এগুলো খাওয়ার জন্য কত মায়ের কাছে ম্যার খেয়েছে। আজ যদি স্যার গাড়ী থেকে বের করে না দিত তাহলে এই সুন্দর সময়টা সে কখনো উপভোগ করতে পারত না। নজরুল সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। মাকে তার খুব মনে পড়ছে কিন্তু মা যে তার বহু বছর আগে পরকালে পাড়ি জমিয়েছে।
♦♦♦♦
রাত আটটা বাজে, মাহাদ আজ কোন কাজে আটকে গেছে তাই আর আসতে পারেনি। ওখান হতেই হয়ত বাসায় চলে যাবে। সন্ধ্যা থেকে মুষুল ধারে বৃষ্টি ঝড়ছে। পুরো ব্যালকুনি বৃষ্টির পানিতে ভেঁসে গেছে। তবুও তিতির ব্যালকুনিতে কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইলো। কিছুই তার ভালো লাগছেনা। রুমের ভিতর এসে মোবাইলটা নিয়ে ওর বাবা এরশাদের নাম্বার ডায়েল করলো। তিতিরের বুক ধড়পড় করছে। একটু পর কলটা রিসিভ হল। ফোনের ওপাশ থেকে হ্যালো শব্দটা ভেঁসে আসতেই তিতিরের চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু পড়ে গেল।
" আসসালামু আলাইকুম, বাবা কেমন আছো?"
তিতিরের বাবা এরশাদ মীর কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল," কল কেন দিয়েছিস?"
" তোমার সাথে একটু কথা বলতে কল দিয়েছি।"
শোন, তোর মা আমার মান-সম্মান কিছু রাখেনি। তুইও একই কাজ করেছিস। আমেনা আপা সবকিছু আমাকে বলেছে। বিশ্বাস কর এখন আমার মনে হচ্ছে তোকে জন্ম দিয়েই সব থেকে বড় পাপ করেছি আমি। তুইও তোর রং দেখিয়েই ছাড়লি?
কথাগুলো শুনে তিতিরের গলা ধরে এল। তিতির নিজেকে সামলিয়ে নিল।
বাবা, আমি শুনেছি বড়আম্মু হাত ছিল মাকে ঐ কাজ করানোর। উনি যদি মাকে ঐ লোকের সাথে পরিচয় না করিয়ে দিত তাহলে এতকিছু হত না। আগে বুঝতামনা, কিন্তু এখন বুঝি জা কখনো আপন হয়না। জানিনা কোন শত্রুতামির জন্য বড়আম্মু এত বড় অন্যায় কাজ করেছিল।
সেটা নাহয় বাদ দিলাম, কিন্তু তুমি! তাকে অত্ত্বহত্যা করার জন্য বাধ্য করেছ। শুধু তুমি দায়ী না তোমরা সবাই দায়ী। আমার খুব ভালো ভাবে মনে আছে। সবাই যখন মাকে নির্যাতন করেছিল তখনো মা আহত অবস্থায় তিতির তিতির বলে চিৎকার করে ডেকেছিল আমায়। কিন্তু তাকে সেদিন ছোট্ট তিতিরটাকে শেষ দেখাও দেখতে দেয়া হয়নি। আমার পরকিয়া মা হয়ে যদি আমাকে না পাওয়ার জন্য পাগলে মত সবার হাত পা ধরে কান্না কাটি করে তাহলে তোমাকে কে বাধা দিল আমার দিক হতে মুখ ফিরাতে!
আদরী মা আমার সৎ মা তাই তার থেকে ভালো ব্যবহার আশা করাটা আমার জন্য বেমানান। কিন্তু তুমিতো সৎ বাবা নও, তাহলে তোমার কাছ থেকে সারাজিবন এমন ব্যবহার কেন পেলাম? তিতির গলা ফাঠিয়ে চিৎকার করে বলল," কিয়ামত অবশ্যই হওয়া দরকার, কারন এত পাপের সঠিক বিচার আমরা আল্লাহর কাছে ছাড়া আর কার কাছ থেকে চাইবো! প্রতিটা কর্মের বিচার হবে। কোন মাফ নাই। তুমি বাবা বেঁচে থাকতে কেন আমাকে অন্যার আশ্রয়ে থাকতে হয়!"
তিতির ফোনটা সাথে সাথে কেটে দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। জিবনটা অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে সব কিছু ধংস করে ফেলতে। এ এক বুকে চাপানো অসহ্য যন্ত্রনা। না কাউকে দেখানো যায় না কাউকে বলা যায়। শুধু অসহ্য যন্ত্রনা একাকী ভোগ করতে হয়।
♦♦♦♦
রাত ১২ টা পার হয়ে গেছে। সবাই যে যার মত ঘুমাচ্ছে। কিন্তু কামরান সাহেব রুমের লাইট জ্বালিয়ে তার ফতুয়াটা খুঁজছেন। এখানেই তো রাখছিলাম কই গেল। এদিকে লাবীবার ঘুম ভেঙ্গে গেল রুমের লাইট জ্বালানোর জন্য।
" তুমি কি খুজছো?
কামরান সাহেব শেষে না পেয়ে গায়ে টাওয়াল জরিয়ে গাড়ীর চাবিটা নিয়ে রুম থেকে বের হতেই লাবিবা বলল," এই অবস্থায় তুমি কই যাও চাবি নিয়ে?"
কারন কামরান সাহেব শুধু লুঙ্গি আর টাওয়াল জড়িয়েই বাহিরে যাচ্ছেন।
কামরান সাহেব লাবীবার কথার কোন জবাব দেয়না। রুম থেকে বের হয়ে যায়।
লাবিবা দ্রুত বিছানা থেকে উঠে রুমের বাহিরে এসে চিৎকার দিয়ে বাতাসিরে ডেকে বলল," আম্মা, দেখেন আপনার ছেলে এই রাতে কই যেন চলে যাচ্ছে।"
ছেলের বৌয়ের চিৎকার শুনে বাতাসি রুম থেকে বের হয়ে দেখল, কামরান সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। কামু, এত রাইতে কই যাস?
কামরান সাহেব থেমে গেল। তারপর ফিরে এসে মায়ের সামনে দাড়িয়ে বলল," আম্মাজান, আমার জরুরি কাজ আছে। আপনি আমাকে বাঁধা দিবেন না। আর দিলেও আজ শুনছিনা।"
" কই যাস আগে হেইডা ক!"
"আমার আম্মাজানের কাছে যাই।"
বাতাসি চোখ উল্টাইয়া কইল," আই তোর চোখের সামনে খাড়া হইয়া আছি আর তুই কস আম্মাজানের কাছে যাবি? অ্যারে চোখে দেখবার পাইছোসনা তুই। চোখে কি কানা হইছোস? তাইলে কাইল একখান টিনের চশমা কিনে চোখে লাগাবি।"
"আম্মাজান আমার বাহিরে কান্নাকাটি করছে আর আমি এখানো দাড়িয়ে আছি কেনো বলে কামরান সাহেব দ্রুত বের হয়ে গেলেন ঐ অবস্থায়।
বাতাসি চিক্কুর দিয়ে বলল," লাবীবা তোমার সোয়ামিরে তো ভুতে ধরেছে। ও সাবিনা, ও রুপালী তোরা কই আছিস। অ্যার পুতরে ভূতে ধরেছে। ঐ তোরা ওকে ধর বলে বাতাসি কামরানের পিছে দৌড় দিল। কিন্তু ততক্ষনে কামরান সাহেব বের হয়ে গেছে। "
লাবীবা কোন হুস না পেয়ে মাহাদের রুমের কাছে এসে জোড়ে জোড়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। মাহাদ, মাহাদ দরজা খোল বাবা।"
মাহাদ দরজাটা খুলে দিতেই লাবীবা কেঁদে ফেললো। তারপর সবকিছু খুলে বলল।
মাহাদ সব শুনে বলল," এতরাতে বাবা কাউকে না জানিয়ে কই গেল।"