নিজ ঘরের বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে এই ঘোর চিন্তাই করছিলেন তিনি। সামনে রাখা দাবার ছকে তার রাজাকে দুপাশ থেকে গিলার প্রচেষ্টা চলছে। তখনই ফুলির মা ছুটে আসে। হাপাতে হাপাতে বলে,
"কত্তা, পুলিশ আইছে। আপনার লগে কথা কইবার চায়। জলদি আইয়েন”
ফুলির মা কথায় নড়েচড়ে বসেন অভিনব সিংহ। প্রতিমাসে পুলিশের ভাগ তার বাড়িতে পৌছে যায়। সুতরাং পুলিশের নামক ব্যাক্তিগুলো এক প্রকার তার পোষা। তাদের উঠতে বললে উঠে, বসতে বললে বসে। বিনা খবরে তারা আসে না। যদি তাদের অভিনব সিংহের সাথে তাদের কোনো কাজ থাকে তবে গুদামের কালো টেলিফোনে ফোন করে। আজ বিনা খবরে কেনো তারা এলো এটাই বুঝতে পারছে না অভিনব সিংহ। গায়ের খদ্দরের চাদরটা পেঁচিয়ে নিলেন তিনি। গম্ভীর গলায় বললেন,
“তুমি যাও, আমি আসছি। আর রুদ্রকে নিচে যেতে বলো।“
“জ্বে আচ্ছা”
চটিখানা পরে উঠে দাঁড়ালেন অভিনব সিংহ। গোঁফে কিছুক্ষন গা ঘুরালেন। মস্তিষ্কটা কাঁজ করছে না। হুট করে ইন্সপেক্টরের আগমন কেনো হলো, কিছুদিন পূর্বে বর্ডার এর ঘটনাটার বেশ নিপুন হস্তে তিনি নিস্পত্তি করেছেন। তবে কেনো? মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ প্রশ্নের ঝড় তুলেছে। অভিনব সিংহ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে নিচে গেলে। নিচে যেতেই তার মাথায় বাজ পড়ে। নিচে একজন সিভিল ড্রেসে পয়ত্রিশোর্ধ্ব যুবক দাঁড়িয়ে আছে। যুবকটিকে এর পূর্বে কখনোই অভিনব সিংহ দেখেন নি। তাকে দেখেই যুবকের ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। এক রহস্যময় হাসি। সে এগিয়ে গেলো অভিনব বাবুর সামনে। হাত বাঁড়িয়ে বললো,
“আদাব, আমি কালিগঞ্জ থানার নতুন ওসি আবদুল্লাহ আল মামুন।“
“আদাব, তা সকাল সকাল আমার বাড়ি কেনো?”
“আমার আগমন বোধহয় আপনার ভালোলাগে নি?”
“ব্যাপারটা ভালো কিংবা মন্দ লাগার নয়। যতই হোক সকাল বেলায় বাসায় পুলিশ আসাটা কারোর ই ভালো লাগে না।“
“চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায় সকাল, বিকাল যখন তখন পুলিশ আসতেই পারে তাই নয় কি?”
“ভনীতা আমার পছন্দ নয়, ঝেড়ে কাশুন”
আবদুল্লাহ আবার তার রহস্যময় হাসিটা ঠোটের কোনায় ফুটিয়ে তুললো, তারপর বললো,
“আপনার আমার সাথে একটু থানায় যেতে হবে। কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।“
আবদুল্লাহ এর কথা শুনে থমকে যান অভিনব সিংহ। থানায় যেতে হবে এটা কি মশকরা। তখন ই বসার ঘরে রুদ্রের এবং উমার আগমন ঘটে। অভিনব সিংহ নিজের ভারসাম্য খুব কম হারান। বেশ মার্জিত আচারণ তার। খুব কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি বিচলিত হন না। তিনি জানেন ক্রোধ তার শত্রু। নিজের সংযম হারালেই তিনি ব্যর্থ। শত্রু থেকে পরাজিত হবার পূর্বেই নিজের কাছে হেরে যাবেন তিনি। তাই আজও তিনি সংযত রইলেন। শুধু শান্ত দৃষ্টিতে আপাদমস্তক আবদুল্লাহ কেই দেখে যাচ্ছিলেন। এদিকে বাবাকে থানায় যেতে হবে শুনে রুদ্র ঝাঝালো কন্ঠে বললো,
“আপনি এসব কি আজেবাজে বকছেন? বাবা থানায় কেনো যাবেন? আপনি জানেন কার সাথে কথা বলছেন? উনি অভিনব সিংহ রায়। এই কলিগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান তিনি। ঠিক কয় শত গ্রামের সমন্বয় এই উপজেলা জানা আছে? আমার বাবা এই এতো উপজেলার চেয়ারম্যান। গ্রামের যে কোনো মানুষকে জিজ্ঞেস করেন, তার সম্মানের একটা ঝলক পেয়ে যাবেন। আপনি তাকে বলছেন থানায় যেতে। এটা কি মশুকরা? বাবা আপনি সদরের ফোন করেন। পুলিশ সুপার আপনার পরিচিত। উনি ই সব করে নিবেন। এই নতুন ওসির জ্ঞান সামান্য”
“শা্ন্ত হও রুদ্র। ধৈর্য্য ধরো। তা আমাকে কিসের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জানতে পারি?”
“আজ্ঞে, অবশ্যই। কমলাপট ব্রীজের কথা মনে আছে? এই তো ক বছর আগেই নির্মান হয়েছিলো। উদ্ভোধনটা আপনি ই করেছিলেন। সেই ব্রীজটা তার উদ্ভোধনের ছয়মাসের মধ্যেই ভেঙ্গে যায়। একটি টেম্পু, একটা ছোট ট্রাক নদীতে পড়ে যায়। নির্মানের যিনি ইঞ্জিনিয়ার ছিলো তিনি সপ্তাহের মধ্যেই উধাও। সেই কেসটা আবার খোলা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়াল শাহাদাত হোসেনের পরিবারের লোকেরাই এই কেসটা অন করেছেন। সেই ব্যাপারেই জিজ্ঞাসাবাদে এসেছি।“
“আমি তো ব্রীজটা বানাই নি। তাহলে আমি কেনো?”
“আপনি বানান নি, যথার্থ। কিন্তু এই টেন্ডর তো আপনি পেয়েছিলেন তাই নয় কি?”
“মানে?”
“এই কন্ট্রাকশনটা ছিলো “ আর এ কন্সট্রাকশন” এর। সেটা তো আপনার একটা ব্যাবসা। শুধু তাই নয়, যে সিমেন্ট, ইট, এবং রড ব্যবহার হয়েছে তার সাপ্লাইয়ার সে দোকানটি ছিলো তা হলো আপনার ছেলে রুদ্র সিংহ রায়ের তাই না? ভুল বলছি?”
অভিনব সিংহ চুপ মেরে গেলেন। আবদুল্লাহ ঠিক বলছে। মেসার্স “আর এ কন্সট্রাকশন” নামক কোম্পানিটি তার। এই কথাটা গ্রামের কেউ জানে না। এই কন্সট্রাকশনটি সদরে উপস্থিত। এই কোম্পানির মূলে অভিনব সিংহ এর একজন বিশ্বস্ত লোক। অভিনব সিংহ এর কথায় ই সব কাজ হয়। এই খবরটা নতুন ওসির জানা সম্ভব নয়। অভিনব সিংহের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে। আবদুল্লাহ হেসে বলে,
“থানায় ভাবার অনেক সময় পাবেন। আর রুদ্র বাবু, আপনার ও আমার সাথে যেতে হবে।“
রুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। উমার বুকে কামড় পড়ে। কাতর চোখে তাকায় রুদ্রের দিকে। এই ত গতরাতেও লোকটার বাহুতে তার স্বপ্নযাপন হয়েছে। লোকটা তার মনমন্দিরের দরজায় কড়া নেড়েছিলো। সব ভুলে তার সাথে নতুন সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলো উমা। ভেবেছিলো রুদ্রের প্রতি অজানা অনুভূতিগুলোকে উপেক্ষা করবে না উমা। তাকে উপজেলার সবথেকে ভালো কলেজে ভর্তি করবে রুদ্র। তাদের নবজীবনটা যেনো শুরু হবার আগেই চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে, কেনো হচ্ছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না উমার। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে, খুব ভয়ানক পাপের সাথে লেপ্টে আছে রুদ্রের নাম। এই সত্যিটা মানতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে উমা। কেনো তার সাথেই এমন হয়। রুদ্র আকুল স্বরে বলে,
“আমার কিছুই হবে না, এই অপবাদ মিথ্যে উমা। আমার জন্য অপেক্ষা করো।“
উমা কোনো কথা বলে না, শুধু নিঃশব্দে অশ্রু ছেড়ে দিলো। বিষাদযন্ত্রণায় জ্বলছে বুকটা। অসহনীয় এই যন্ত্রনা। নিঃশব্দে রুদ্র এবং অভিনব সিংহ। লক্ষী দেবী মন্দির থেকে এসে ফুলির মার কাছ থেকে সব জানতে পেরে ধপ করে বসে পরেন। সামান্য গৃহ বধু তিনি। আইনী মারপ্যাঁচ তার অজানা। এদিকে শাশ্বত টাও বাড়ি নেই। মালিনীর বুকতা ধরফর করছে। এই কান্ডের পেছনে তার হাত নেই তো? ছেলেটা আগুন নিয়ে খেলছে। এই আগুন না তাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।
কালিগঞ্জ থানা। থানাটি খুব একটা বড় নয়। তেমন কোনো ইন্টারোগেশন রুম নেই এই থানায়। একটা বদ্ধ ঘরে বাবা ছেলে কে বসানো হয়েছে, রুমটির কোনো জানালা নেই। আলো ঢোকার স্থান নেই। শুধু মাথায় উপর একটা সোনালী বাল্ব জ্বলছে। কার্তিক মাসের শীতলতায় তরতর করে ঘামছে রুদ্র। ভয়ে নয়, ক্রোধে। কারন তার সামনে বিকৃত হাসি দিয়ে আবদুল্লাহ বসে রয়েছে। লোকটার রহস্যময় হাসি দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো রুদ্র। এদিকে অভিনব সিংহ সাবলীল ভাবে বসে রয়েছেন। তিনি নির্বিকার চিত্ত প্রদর্শন করছেন। দাবা খেলার প্রথম নিয়ম, প্রতিদ্বন্দীর সাথে মানসিক লড়াই। তিনিও আবদুল্লাহ এর সাথে তাই করছেন। আবদুল্লাহ তার প্রশ্ন শুরু করলো,
“সবার মতে ব্রীজের কাঁচামালে সমস্যা ছিলো। ব্রীজটির মোট বাজেট বারো লক্ষ টাকা ছিল। বারো লক্ষ টাকার ব্রীজ ছয় মাসে ধসে যাবার কথা নয়। এবার বলুন ঘাপলাটা কোথায় করেছেন?”
“তার আগে প্রমান দিন এই ব্রীজের টেন্ডর আমার ছিলো। আর আর এ কন্সট্রাকশন আমার? ট্রেড লাইসেন্স? কাগজ কিছু কি আছে?”
“হ্যা আছে, আপনার নামের ট্রেড। আর মেসার্স লক্ষী স্টোর তো আপনার ছেলের? তাই নয় কি? কি রুদ্র বাবু?”
এবার রুদ্র হেসে উঠলো। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“হ্যা, সেটা আমার দোকান। কিন্তু আমি যে সব কিছু সাপ্লাই করেছি প্রমান কি?”
“মানে?”
“দেখুন এই টেন্ডর আমি পেয়েছিলাম। প্রথম দিকের কাঁচামাল আমার দোকানের ই ছিলো। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার শাহাদাতের সাথে আমার ঝামেলা হয়। তারপর থেকে আমি আর কাঁচামাল দেই নি। আমার কাছে প্রমান আছে। আমার দোকানের কোনো মাক ভেজালের না। সেটার প্রমান ও আছে। আমি এই দোকান সাত বছর ধরে চালাই, হ্যা আমি বসি না। কিন্তু দোকানের সকল কাজ আমার কথায় হয়। আপনি চাইলে খোঁজ নিন। আর এই আর এ কন্সট্রাকশন এর কথা বলছেন সেটা বাবা চার বছর পূর্বেই বিক্রি করে দিয়েছেন। একটা কথা বলি? ভাসা কথায় কান দিবেন না। প্রমান ছাড়া কিছুকে বিশ্বাস করা ঠিক নয়।“
আবদুল্লাহ ভ্রু কুচকে আসলো। তার কাছে প্রমান আছে, এই বাপ ছেলে মিথ্যে কথা বলছে। রুদ্র হেসে বললো,
“আপনার হয়তো বিশ্বাস করছেন না, সমস্যা নেই। আমাদের সব প্রমান আমাদের কাছেই আছে।“
আবদুল্লাহ মুখোভাব বদলালো। সে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অভিনব বাবু এবং রুদ্রের দিকে। রুদ্র শার্টের কলার পেছনে টেনে আয়েশ করে বসলো। অভিনব বাবুর মুখে স্মিত হাসি। কিন্তু বুকের কোনে এক সূক্ষ্ণ ভয় উঁকি দিচ্ছে। তার শত্রুটা ঠিক কে?
শাশ্বত ফিরলো সন্ধ্যে নামার পর। ক্লান্ত শরীরে প্রবেশ করলো সে চেয়ারম্যান বাড়িতে। শান্ত চেয়ারম্যান বাড়ি যেনো হজম হলো না তার। কারন বিগত দিন বেশ কষাকষি লেগে আছে এই বাড়িতে। এর মাঝেই সে মুখোমুখি হয় মালিনীর। ছেলেকে দেখেই হাত টেনে নিজের ঘরে নিয়ে যায় সে। মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলে,
“সত্যি করে বল, দাদা আর রুদ্রকে পুলিশে দেবার পেছনে তোর হাত নেই তো?”
মালিনীর প্রশ্নে আকাশ ভেঙ্গে পরে শাশ্বতের মাথায়। কানকে যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার রুদ্র এবং মামামশাই কে পুলিশ ধরে নিয়েছে? কেনো?......
—————
শাশ্বত ফিরলো সন্ধ্যে নামার পর। ক্লান্ত শরীরে প্রবেশ করলো সে চেয়ারম্যান বাড়িতে। শান্ত চেয়ারম্যান বাড়ি যেনো হজম হলো না তার। কারন বিগত দিন বেশ কষাকষি লেগে আছে এই বাড়িতে। এর মাঝেই সে মুখোমুখি হয় মালিনীর। ছেলেকে দেখেই হাত টেনে নিজের ঘরে নিয়ে যায় সে। মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলে,
“সত্যি করে বল, দাদা আর রুদ্রকে পুলিশে দেবার পেছনে তোর হাত নেই তো?”
মালিনীর প্রশ্নে আকাশ ভেঙ্গে পরে শাশ্বতের মাথায়। কানকে যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার রুদ্র এবং মামামশাই কে পুলিশ ধরে নিয়েছে? কেনো? এই খবরটা যেনো তার স্নায়ুকোষগুলোকে ক্রমশ চঞ্চল করে তুললো। হাজারো প্রশ্ন ভিড় জমালো। নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় লাগলো শাশ্বতের। বিছানায় ধপ করে বসে পরে সে। ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে আসে। শাশ্বতকে নীরব থাকতে দেখে মালিনী আরো জোর দেয়,
“কি হলো, কথা বলছিস না কেনো?”
“সত্যি বলছি মা, আমি জানি না এসবের কিছুই। আমি তো আমার কাজে গিয়েছিলাম শহরে। আমি কিছুই জানি না। তোমার দিব্যি। তোমার কেনো মনে হলো আমি মামামশাইকে বিপদে ফেলতে চাইবো। এ কি সম্ভব?”
“দেখ খোকা, আমি তো মা। তোকে আমি ই পেটে ধরেছি। তোর নাড়ীর খবর ও আমি পাই। হতে পারি মুখ্য মেয়েমানুষ, কিন্তু সন্তানের গতি বুঝতে মায়ের বিদ্যের শিক্ষা লাগে না। সে সন্তানের চোখ দেখলেই বুঝতে পারে সব। তুই কদিন ধরে দাদার ঘরের কাছে ঘুরঘুর করছিস। আমি কি সেটা দেখি নি? দেখেছি রে, সবকিছুই দেখেছি। বাবা আগুন নিয়ে খেলিস না। তোর বাবাকেও হাজার বারণ করেছি। সে শুনে নি আমার কথা। অকালেই আমাদের ছেড়ে গত হলেন। এই দাদা না থাকলে তোকে নিয়ে কই যেতাম রে? তাই বলছি, পত্রকার হতে চাও, হও। কিন্তু সিংহের মুখে ঝাপিয়ে নয়।“
মালিনীর চিন্তা অনর্থক নয়। সম্বল বলতে তো একটা ছেলেই। শাশ্বতের পিতা উত্তম বাবু ছিলেন একজন দারোগা, বেশ শিক্ষিত, মার্জিত পুরুষ। অন্যায়কে দমন করার ভুতটা শাশ্বত তার পিতার থেকেই পেয়েছে। কখনো অন্যায় এবং ক্ষমতার কাছে মাথানত করে নি উত্তম। তাই তো সেই মাথাটাই কেটে ফেলা হয়েছে। কে? কিভাবে তা জানা নেই। শুধু রেলওয়ের পটরিতে তার বিচ্ছিন্ন ধর এবং মাথাটা পাওয়া যায়। তাও তিনদিন বাদে, গলা পঁচা লাশটি ঘরে আনা হয়। কোনো ক্রিয়াকর্ম ছাড়াই তাকে পোড়ানো হয়। তখন মালিনী পাঁচ মাসের অন্তসত্ত্বা, শাশ্বত একজন অবুঝ শিশু। স্বামীর এমন পরিনতি ছোট মালিনী মানতে পারলো না। বাচ্চাটি খোয়ালো মানসিক ধাক্কার জন্য। অভিনব সিংহ তখন তাকে এই বাড়ি নিয়ে আসে। মালিনী চায় না তার শেষ সম্বলটুকু হারাতে। তাই তো এতো সাবধানতা। শাশ্বত মালিনীর ঝাপসা কাতর নয়ন দেখে খানিকটা আহত হলো। মা কে জড়িয়ে আশ্বত করলো ধীর কন্ঠে,
“মা, আমি কিছুই করি নি। আমি তো জানিও না মামামশাই এবং রুদ্রকে ধরে নিয়ে গেছে। সত্যি বলছি। তুমি শান্ত হও।“
মালিনী শান্ত হলো না। সে উলটো দিব্যি দিয়ে বললো,
“খোকা আমার মাথা খেয়ে বল, তুই এসবে নাক গলাবি না।“
মালিনীর আকুল নিবেদনকে উপেক্ষা করতে বাধ্য হল শাশ্বত। দৃঢ় স্বরে বললো,
“সাংবাদিক সমাজের দর্পন। সেই দর্পন যদি ভেদাভেদ করে হবে তার সাংবাদিক হবার যোগ্যতা নেই। আমি এটা করতে পারবো না মা। আমি সত্যান্বেষে বেড়িয়েছি, এত সহজে কাপুরুষ বনতে পারব না।“
বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো শাশ্বত। মালিনী আঁচলে মুখ চেপে নোনাজল ছেড়ে দিলো। ভয় হচ্ছে ছেলের অকল্যান যদি হয়, মায়ের মন তো সত্য অসত্য বুঝে না। বুঝে শুধু সন্তানের মঙ্গল________
গভীর রাতে পুলিশের গাড়ি এসে থামলো চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে। গাড়ির শব্দ শুনেই বারান্দায় ছুটে এলো উমা। তৃষ্ণার্ত আখিজোড়া কাতর চোখে তাকালো মূল ফটকের দিকে। অভিনব সিংহ এবং রুদ্র নামলো গাড়ি থেকে। রুদ্রকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সকালে নাস্তা না করেই বেড়িয়েছিলো সে। পুলিশ অফিসার বিনয়ী স্বরে অভিনব সিংহ এর সাথে কথা বলে গাড়ি ঘোরালো। রুদ্র বাবার জন্য অপেক্ষা করলো না। হনহন করে ভেতরে চলে আসলো। লক্ষী দেবী ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁপা স্বরে বলল,
“বাপ ফিরেছিস?”
“তুমি কাঁদছিলে?”
“চিন্তা হয় না?”
“খেয়েছো?“
“এই পরিস্থিতিতে কি গলা দিয়ে অন্ন নামে?”
“চল, একসাথে খাই।“
লক্ষী দেবী হু হু করে কেঁদে উঠলেন। রুদ্র মাকে শান্তনা দিলো। কিন্তু চোখজোড়া উমাকে খুঁজে যাচ্ছে। মেয়েটি নামলো না। তবে কি সে আবারো রুদ্রকে ভুল বুঝবে? ভেবেই মনটা আনচান করতে লাগলো। তাদের সম্পর্কটা স্বামী স্ত্রীর বটে কিন্ত বেশ জটিল। উমার রুঢ়তা, উপেক্ষা সহ্য হয় না রুদ্রের। এই নারী তার জীবনে না আসলে সে কখনই বুঝতে পারতো না সন্তোষ কেবল দৈহিক হয় না। সন্তোষ হয় মনের। উমা রুদ্রের কেবল দেহের খোড়াক নয়, সে তার অন্তরের খোড়াক। উমার শীতল মনে নিজের রাজত্ব জমানোই তার উদ্দেশ্য। ভালোবাসা নামক বিষাক্ত নেশায় লিপ্ত যে সে। রুদ্রের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। উমা ব্যাতীত ই খেতে বসলো সকলে, উমা নামলো না। রুদ্রের চোখ বারবার সিড়ির দিকেই গেলো। কিন্তু হতাশ হলো। উমা আসলো না। ছোট্ট মেয়েটা অভিমান করেছে। এই অভিমান ভাঙ্গানো যে খুব কঠিন___________
খাওয়া শেষে ঘরে আসলো রুদ্র। উমা তখন কাপড় গুছাতে ব্যাস্ত। মন ভালো ছিলো না বিধায় বেঘোরে ঘুমিয়েছে সন্ধ্যায়। অগোছালো শাড়ীগুলো খাটের উপর অবহেলায় পড়ে আছে। তাই এখন সেগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে উমা। রুদ্রকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে আড়চোখে তাকে দেখে নিলো উমা। তারপর আবারো নিজের কাজে মন দিলো। রুদ্র নানা ভঙ্গিমায় তার সাথে কথা বলতে চাইলো। কিন্তু উমা একটু টু শব্দ করলো না। উমার কাছ থেকে গুরুত্ব পাবার আশায় হাতখানা টেনে ধরলো। উমা দেরী না করেই হাত ছাড়িয়ে নিলো। উমার এরুপ আচারণ রুদ্রের সহ্য হলো না। তাই বাহু টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো তাকে। ঝাঝিয়ে উঠে বলল,
“কি সমস্যা? এমন আচারণ করছো কেনো?”
অন্য সময় হলে উমা চুপ করে থাকতো। কিন্তু আজ যেনো ইচ্ছে হল না। আজ দমবে না সে। অভিমান, ক্রোধে আজ মন বিষিয়ে উঠেছে। একজন সন্ত্রাশের সাথে আর যাই হোক সংসার করা যায় না। সে মাতাল, নিষ্ঠুর সব কিছু তো মেনেছিলো উমা। কিন্তু মানুষকে ঠকিয়ে তাদের প্রান নিয়ে নেবার মতো পাষানকে নিজের স্বামী মানতে কষ্ট হচ্ছে তার। ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে চাইলো রুদ্রের দিকে। চোখ জোড়া রক্তিম হয়ে রয়েছে। ধীর কিন্তু শক্ত কন্ঠে বললো,
“ছাড়ুন, আমার কাজ আছে। ভালো লাগছে না এই আদিক্ষেতা?”
“ভালো লাগছে না মানে?”
“বাংলা বুঝতে কি কষ্ট হচ্ছে?”
“হ্যা, হচ্ছে। আমি একটা মানুষ উমা। তোমার এই পায়ে ঠেলা আচারন আমি নিতে পারছি না”
“তাহলে কি করতে হবে আমাকে? একজন খুনীকে ভালোবাসতে হবে?”
রুদ্র থমকে গেল। উমার কন্ঠে আজ কোন আড়ষ্টতা নেই, নেই কোনো জড়তা। অভিমানের প্রবল ঝড় তার ভেতরটাকে চূর্নবিচূর্ন করে দিচ্ছে। এতোকাল রুদ্রের কোনো কিছুই তাকে বেদনা দিত না, তবে আজ দিচ্ছে। হয়তো লোকটাকে কোথাও না কোথাও মনে ঠায় দিয়েছে সে। তাই তো এই অসহনীয় যন্ত্রণা সইতে পারছে না সে। রুদ্রের চোখে চোখ রেখে রুঢ় কন্ঠে বললো,
“আজ বলেই দিন কি চান আপনি? আর কতো যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে আমাকে? সেদিন তো খুব বলেছেন ভালোবাসেন। এই ভালোবাসার নমুনা? আর কতো লুকানো সত্য আছে? আর কতো গোপনীয়তা? আজ আমার উত্তর চাই।“
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো,
“বেশ্, আজ তোমাকে সব খুলে বলবো………