বকুল ফুলের মালা - পর্ব ২৬ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৫১!! 

মায়রাকে বুকে শক্ত করে আগলে বেশ অনেকটা সময় সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো আয়ান। একটু পরেই নিজেকে সামলে নিয়ে মায়রাকে বারান্দার দেয়ালে চেপে ধরলো। মায়রা থতমত খেয়ে আয়ানের রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখছে। মানুষটার এভাবে হুট করে এসে বুকে জাপটে ধরার কারণটাও মায়রা বুঝতে পারে নি৷ এবারে তাই আয়ানের এমন রেগে যাওয়ার কাহিনীটাও মায়রার মাথার উপর দিয়ে গেল। কিন্তু আয়ানের এমন শক্ত করে চেপে ধরায় কিছুটা ব্যথা পেলেও সেই শক্ত বাঁধনটা থেকে ছোটার বিন্দুমাত্রও চেষ্টা করলো না মায়রা। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মানুষটার চোখেমুখে কিছুটা আতঙ্ক, হারানোর ভয়, আর অনেকখানি চিন্তা খেলা করছে। মানুষটার গভীর চোখ জোড়ায় রাগের বদলে ফুটে আছে শত হাজার না বলা ভালোবাসার কথা। 

-তোমার খুব সাহস বেড়েছে না মায়রা? খুব সাহস বেড়েছে? আমাকে টেনশনে ফেলতে মজা পাচ্ছ তুমি? 

-আমি? আমি টেনশনে ফেলবো কেন তোমাকে? আর কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন?

-পাগল হয়ে গেছি আমি। পাগল। তুমি এভাবে একা এখানে বারান্দায় কেন দাঁড়িয়ে থাকবে? ঘরে কি জায়গার অভাব পড়েছে তোমার জন্য? আমি----।

-আয়ান? শান্ত হও প্লিজ? আর এমন করছ কেন? তুমি তো মায়ের সাথে কথা বলছিলে--। তাই আমি একটু বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি--। 

-আমি কতোটা ভয় পেয়েছিলাম তার ধারণা আছে তোমার? তুমি কেন বুঝতে পারছ না মায়রা--। আমি--।

-কেন? কি ভেবেছিলে? আমি তোমাকে এবারও না বলে কোথাও--।

-মায়রা?

আয়ান মায়রাকে দেয়ালে আরো শক্ত করে চেপে ধরে মায়রার ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের ভাঁজে আটকে নিলো। মায়রা আয়ানের রাগী ঠোঁট জোড়ার স্পর্শ অনুভব করলো নিজের কোমল ঠোঁটে। আয়ান এক হাতে মায়রার মুখটা মুখে ধরে রেখেছে, অন্য হাতটা মায়রার কোমড়ের কাছে খামচে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে রেখেছে। একটু পরে আয়ান মুখ তুলে মায়রার মুখের দিকে তাকালো। মায়রার চোখ বুজে রাখা লজ্জারাঙা মুখটা দেখে আয়ানের রাগটা নিমিষেই পানি হয়ে গেল। পাগলিটার ঠোঁট জোড়া তখনো আলতো কাঁপছে দেখে আয়ান মায়রাকে দেয়ালের সাথে হালকা করে চেপে ধরলো এবারে। তারপর আলতো করে কামড় বসাতে শুরু করলো মায়রার নিচের ঠোঁটটায়। আয়ান ঠোঁট ছেড়ে মায়রার কাঁধের লাল তিলটায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই মায়রার ঘোর কাটলো। আয়ানের হাতের উপরে মায়রা হাত রাখতেই আয়ান আবার তুলে মায়রার মুখের দিকে তাকালো। 

-আমাকে এভাবে তিলে তিলে কেন মারতে চাইছ তুমি বলোতো?

-কি বলছ আয়ান?

-তুমি জানো না তোমাকে কতোটা ভালোবাসি? তবু কেন এমন করো আমার সাথে? আবার চলে যাওয়ার কথা বলে কেন ভয় পাইয়ে দিচ্ছো তুমি আমাকে? কেন বলো?

-আরে! আমি তো দুষ্টুমি করে বলেছি--। তুমি এতো রাগ করবে জানলে সত্যি বলতাম না--। আর তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাবো বলো? আর কোথাও যাওয়ার আমার জায়গা আছে নাকি?

-তুমি কোথাও যাবে না। কক্খনো না। যাওয়ার কথা ভাবলেও তোমাকে খুন করে ফেলবো বলে দিলাম--৷ আর এভাবে ধুমধাম বারান্দায়ও যাবা না---। আমাকে না বলে কোথাও যাওয়া চলবে না একদম। 

-আচ্ছা----।

-তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসি পরী। তোমাকে হারাতে পারবো না৷ সত্যি মরে যাবো তাহলে---।

-জি জনাব। হয়েছে তো? এবার ছাড়ুন? আমি যাচ্ছি না কোথাও--।

-তোমাকে ছাড়তেই তো ইচ্ছে হয় না আমার। একটু কাছে পেলে আরো কাছে পেতে মন চায়। তোমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলে মন চায় তোমার মাঝে ডুবে যাই---। ইচ্ছে করে সবসময় তোমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখি---। এই যে এখন? তোমার টুকটুকে লাল হয়ে যাওয়া ঠোঁটটায় আরো আদর করতে ইচ্ছে করছে---। ইচ্ছে করছে তোমার নিচের ঠোঁটটা নিজের মুখে পুরে নিয়ে মনের আনন্দে চুষে খেয়ে ফেলি--। তোমার ঠোঁটের স্বাদটা কিন্তু অসম্ভব মিষ্টি---। জানো তুমি?

-আয়ান?

আয়ানের চোখে ঘোর লেগে গেছে মায়রাকে দেখতে দেখতে। আয়ান ঘোরের মাঝেই মায়রার একদম কাছে চলে এসেছে। ওর উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে পড়ছে মায়রার মুখে। মায়রার নিজেরও কেমন একটা ঘোর ঘোর লাগতে শুরু করেছে। আয়ান আর মায়রার ঠোঁট জোড়া ছুঁই ছুঁই করছে ঠিক সেই মূহুর্তে আয়ানের মোবাইলটা শব্দ করে বাজতে শুরু করলো। আয়ান আর মায়রা দুজনেই চমকে উঠলো। কিন্তু আয়ান মায়রার কাছ থেকে সরে না এসেই মোবাইলটা কানে লাগালো। আর একদম মায়রার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো। এখনও আয়ানের নিঃশ্বাসগুলো মায়রার বুকের ভিতরে ধুকপুকানি বাড়িয়েই চলেছে। এ কেমন অনুভূতি সেটাই মায়রা বুঝতে পারছে না। আয়ান ফোনের অন্য প্রান্তের কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। 

-ঠিক আছে। আমি আসছি। 

কথাটা বলে কলটা কেটে দিয়ে আয়ান এগিয়ে এসে মায়রার ঠোঁটে ঠোঁট করে একটা চুমো এঁকে দিলো। মায়রা থতমত খেয়ে আয়ানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। 

-মনের ইচ্ছে মনে চেপে রাখতে নেই ম্যাডাম৷ সেটা পূরণ করতে হয়। অন্তত মানুষটা যখন সামনেই আছে তখন নিজেকে এতো কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে কষ্ট দেয়ার কি দরকার?

-কি?

-এই যে এতোক্ষণ ধরে আমার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে ছিলে হা করে? চুমো খাওয়ার ইচ্ছে যখন মনে জেগেছে একটা চুমো দিতেই পারতে নিজে থেকে। সবসময় আমি কেন আগে আদর দিবো?

-কি সব বলছো?

-এই? আমি ঠিকই বলছি। মিথ্যে বললে এবার এমন কামড় বসাবো তোমার ঠোঁটে যে কারো সামনেই আসতে পারবে না পুরো এক সপ্তাহ। বলে দিচ্ছি কিন্তু---।

-ধ্যাত--। সরো তো? ব্যথা পাচ্ছি--।

-হা হা--। আমি সামনে এলেই আপনি খালি ব্যথা পান--। ভালোই ভালোই--। আমি চলেই যাচ্ছি--।

-কোথায় যাবে এখন? 

-কোথাও আর যাবো পাখি? অফিস থেকে কল করেছে। আর্জেন্ট অফিসে যেতে হবে---। সরি বউটা। 

-আচ্ছা। সাবধানে যাও---।

-কোথায় ভাবলাম আজ সারাদিন ছুটি আছে। বউকে জড়িয়ে ধরে সারাদিন আদরে আদরে পাগল করে দিবো---। ধ্যাত---। শালার এই অফিসের জ্বালায়---।

-তুমি যাও তো?

-আহারে! আমার লজ্জাবতীটা! একেবারে লাল হয়ে গেছে---। 

-তুমি অফিস যাবা?

-হ্যাঁ রে বাবা! যাচ্ছি---। মা রাগ করে কিছু বললে মনে কষ্ট পেও না পরীটা। কেমন? মার রাগ পড়ে গেলে আবার আগের মতো তোমাকে ভালোবাসবে দেখো---?

-হুম---।

-এখন আমি আসছি--। তুমি সাবধানে থাকবা। খেয়ে নিবা। আর এখন আদর দিবা---।

-আয়ান? তোমাকে মাইর দিবো--। যাও এখন।

-ওহ! কি কপাল! 

-যেতে বললাম না তোমাকে?

মায়রা এক প্রকার জোর করেই আয়ানকে পাঠালো। আয়ানও হেসে চেইঞ্জ করে অফিসে চলে গেল। অফিসে জরুরি একটা কাজে আটকা পড়ে গেল আয়ান। তাই বাসায় কল করা হয়ে ওঠে নি সারাদিন। সন্ধ্যের দিকে কাজ শেষ হলে তখন খেয়াল হলো আয়ানের। সারাদিন একবারও কথা হয়নি কারো সাথে। মেয়েটা কি করছে কে জানে! আয়ান নিজের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বাসার ল্যান্ডলাইনে কল করলো। কয়েক বার রিং হওয়ার পর কলটা রিসিভ হলো। 

-হ্যালো?

-হ্যাঁ আয়ান।

-মা? কি করছো? 

-কিছু করছি না। কি বলবি বল?

-না আসলে--। আমার ফিরতে রাত হবে একটু--। 

-ওহ!

-আম! মা নাস্তা করেছ? 

-আমার কথা জিজ্ঞেস করতে কল করেছিস? নাকি তোর বউয়ের কথা?

-মা! প্লিজ? 

-নাস্তা করি নি। লাঞ্চও করি নি। তোর বউও লাঞ্চ, নাস্তা কিছুই করে নি।

-সে কি! কেন! না খেয়ে আছো কেন সবাই?

-সবাই না খেয়ে আছে কে বললো তোকে? বাকিরা খেয়েছে। আমার খিদে পায় নি তাই খাই নি। আর তোমার বউকে রুমে নিয়ে খাইয়ে দেয়ার মতো কেউ বাড়িতে নেই।

-মানে! মা মায়রা কি এতোটাই অস্পৃশ্য যে ওর সাথে এক টেবিলে বসে খাওয়াও যাবে না?

-তুই কি আর কিছু বলবি? আমার কাজ আছে। রান্না করতে হবে---। 

-কেন মায়রা কোথায়----?

-তোমার বউ অনেকক্ষণ ধরে ঘুরঘুর করেছে রান্নাঘরে আসার জন্য। আমি ওকে বারণ করে দিয়েছি যেন আমার রান্নাঘরে না ঢোকে---। 

-মা? কেন এমন করছ?

-তোর যা ভালো মনে হয়েছে সেটা তুই করেছিস। এবার আমার যা ভালো মনে হবে আমি তা করবো। রাখ এখন। কাজ করছি---।

-মা?

আয়ান কিছু বলার আগে মা কলটা কেটে দিলো। আয়ান নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে রইলো। এতো মানসিক যন্ত্রণা মেয়েটা সহ্য করবে কি করে সেটাই বুঝতে পারছে না আয়ান। অথচ আয়ান যতই ব্যাপারটা ঠিক করার চেষ্টা করছে ততই যেন আরো বেশি করে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে পুরে ব্যাপারটা৷ আয়ান বুঝতে পারছে না এবার কি করলে এসব টানাপোড়েনের শেষ হবে! আধো মা কখনো মায়রাকে মন থেকে মেনে নিবে কি?

৫২!! 

অনেকক্ষণ ধরে মায়রার মোবাইলে রিং হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে যেন একদমই খেয়াল নেই মেয়েটার৷ বিছানার কাছে ফ্লোরে থ হয়ে বসে আছে ও। আর কানে বাজছে সায়নার বলা কয়েকটা কথা। একটু আগে ড্রইংরুমের ফোন বাজছে শুনে নিচে নেমে এসেছিল মায়রা। এসেই দেখলো মা ফোনে কথা বলছে। কথা শুনেই বুঝতে পারলো মা আয়ানের সাথে কথা বলছে। কথাগুলো শুনতে মায়রার মনে হচ্ছিলো কেউ যেন ওর কলিজাটা টেনে ছিঁড়ে আনছে। কোনমতে কান্না চেপে রুমের দিকে চলে আসার চেষ্টা করলো মায়রা৷ কিন্তু পিছন থেকে ফোনটা নামিয়ে শাশুড়ির ফোঁপানোর শব্দ শুনে মায়রা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আবার পিছনে ফিরতেই আয়ানের মায়ের পাশে সায়নাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো মায়রা৷ মেয়েটা মায়ের কাঁধে হাত দিয়ে হালকা করে জড়িয়ে ধরে আছে দেখে মায়রার ইচ্ছে করলো ছুটে এসে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে। এই মেয়েটাকে এই মূহুর্তে অসহ্য লাগছে মায়রার কাছে। কিন্তু সিঁড়ি থেকে এক পা ও নিচে বাড়াতে পারলো না মায়রা। মাকে কাঁদতে দেখে মায়রার দুনিয়াটাই কেমন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। 

-খালামনি? তুমি আবার কেন কাঁদছ এভাবে? 

-ছেলেটার ফিরতে দেরি হবে সেটাও ফোন করে বলতে ভুলে না আজও। অথচ এই একটা মেয়ের জন্য সকালেই আমাকে কতো কথা শুনালো! আমি নাকি-----।

-আরে! এতো কান্না করো না তো খালামনি--। ছেলেদের এই এক সমস্যা। মায়রাদের মতো মেয়েগুলোর লোক দেখানো প্রেমের ফাঁদে পড়ে যায়। আর এই দিয়ে মেয়েগুলো বশ করে গাধাগুলোকে। ওর এই প্রেমের ঘোর কাটলে ঠিকই বুঝতে পারবে যে এসব মেয়ের সাথে আর যাই হোক সুখী হতে পারবে না। তখন দেখবে ঠিকই নিজের পথ বেছে নিবে আয়ান। আচ্ছা করে একটা শিক্ষা হবে তখন গাধাটার---।

-এসব কি বলছিস সায়না? আমার ছেলেটার জীবন এভাবে ভেসে যাবে আর আমি মা হয়ে সেটা চেয়ে চেয়ে দেখবো?

-দেখা ছাড়া আর কি করবে খালামনি? কিছু বলতে গেলে তো নিজের ছেলের কাছেই খারাপ হবে। দেখো নি সকালে কতো কথা বললো তোমাকে আয়ান?

-তাই বলে আমার সামনে আমার ছেলের জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে?

-এটা হলো শাস্তি বুঝলে খালামনি। বাবা মায়ের মনে কষ্ট দিলে আল্লাহ তো শাস্তি দিবেই। নইলে আয়ানের তো বুঝা উচিত ছিল যে মেয়ে আগে একজনের সাথে সংসার করতে পারো নি, সে ওর সাথে সংসার করবে কি করে! তুমি এতো টেনশন করো না তো খালামনি। দেখবে এই মেয়ে যখন আমাদের আয়ানকে হাত করতে পারবে না তখন ওকেও ডিভোর্স দিয়ে চলে যাবে--। অন্য কারো খোঁজে----।

-চুপ কর তো সায়না---। কিসব বলছিস! হতে পারে মেয়েটার উপরে রাগ হচ্ছে আমারও। তাই বলে ওর নামে এসব বলবি?

-আরে খালামনি! তুমিও ওর মিষ্টি চেহারায় ভুলে গেছ নাকি! এসব মেয়েদের এটাই হলো আসল অস্ত্র। এমন ভোলাভালা চেহারা যে তুমি বিশ্বাসও করতে পারবে না এরা কতোটা নিচে নামতো পারে---। ধীরে ধীরে এদের আসল রং বের হবে৷ তখন মিলিয়ে নিও আমার কথা। 

কথাগুলো শুনতে শুনতে মায়রার মনে হচ্ছিলো ওর বুঝি পায়ের নিচ থেকো মাটিই সরে গেছে৷ কোনমতে ছুটে রুমে এসে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে মায়রা। কেন বারবার নিজের অতীতটা এসে সামনে দাঁড়িয়ে ওর বর্তমানটা নষ্ট করে দিচ্ছে। ও তো সুখে থাকতেই চেয়েছিলো। আয়ান, মা, বাবা সবার সাথে মিলে একটা ছোট খুশির সংসার গড়তে চেয়েছিল মায়রা। তবে কেন ওর ভাগ্য সেটাতেও বাধ সাধছে? কেন! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মোবাইলের রিংটোনটা কানে গেল মায়রার। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে মোবাইলটা হাতে তুলে নিতেই আয়ানের নামটা দেখতে পেয়ে আবার ভিষণ কান্না পেল মায়রার৷ কোনমতে কান্নাটা চেপে কলটা রিসিভ করে কানে মোবাইল ধরলো মায়রা। 

-হ্যালো? হ্যালো মায়রা? তুমি-তুমি ঠিক আছো?

-হ্যাঁ-আমি তো ঠিক আছে। তুমি এতো অস্থির হয়ে কথা বলছো কেন? কি হয়েছে?

-অস্থির হবো না? তুমি কল ধরছিলে না কেন? আমি কখন থেকে কল করছি? কোথায় ছিলে?

-আম--। কল শুনতে পাই নি। ওয়াশরুমে ছিলাম---।

-ওহ! আর এই? তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন পরী? কাঁদছ কেন?

---আরে! না না। কাঁদবো কেন? আসলে---ফোনের নেটওয়ার্কের কারণে এমন শোনাচ্ছে হয়তো---।

-মায়রা? কি হয়েছে? সত্যি করে বলো তো আমাকে--।

-আরে বাবা! কি হবে? কিচ্ছু হয়নি। 

-খাও নি কেন? সকাল থেকে না খেয়ে আছো সেই খেয়াল আছে তোমার? তুমি যে কি করো বাবা! আমি বুঝি না--।

-খিদে পায় নি--।

-মন খারাপ মনি?

-উঁহু--। না---।

-আচ্ছা বাদ দাও। মায়রা হোয়াটসঅ্যাপে আসো তো একটু।

-কেন!

-আরে! আসো না বাবা? কাজ আছে তো৷ তাড়াতাড়ি আসো--।

-হুম। আচ্ছা--।

মায়রা কলটা কেটে দিয়ে মোবাইলের ডাটা অন করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টুং করে একটা মেসেজ এলো হোয়াটঅ্যাপে। আয়ানের মেসেজটা চেক করতেই একটা ফটো দেখে সেটায় কি আছে দেখলো মায়রা। ফটোটা ওপেন করতেই মায়রা দেখলো কোন রেস্টুরেন্টের মেন্যুর পিক। আবার একটা মেসেজ এলো আয়ানের আইডি থেকে।

"কি আনবো বলো তো জান?"

আয়ানের মেসেজটা দেখে আরেকবার খাবারের মেন্যুটা দেখলো মায়রা। মেন্যুতে বিরিয়ানি, কাচ্চি, সাদা ভাত, মাছ, মুরগি, ভর্তা, কাবাব, মিষ্টি, কেক, নুডুলস, স্যুপ, আইসক্রিম, দই-সব ধরনের খাবারই আছে। মায়রা বুঝতে পারলো না কি আনার কথা জিজ্ঞেস করছে আয়ান। আর রেস্টুরেন্ট থেকে আনারইবা কি হলো সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না বেচারি। মায়রা ভ্রু কুঁচকে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আরেকবার মেসেজ এলো টুং করে।

"কি খাবে তাড়াতাড়ি বলো তো পরী। আমি আসার সময় নিয়ে আসবো।"

আয়ানের মেসেজটা দেখে মায়রা ভ্রু কুঁচকে টাইপ করলো।

"কিছু লাগবে না।"

"বেশি কথা বলবা না। যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বলো। কি খাবে?"

"কিছু লাগবে না তো। বাসায় তো সবই আছে।"

"বিরিয়ানি নিয়ে আসবো? নাকি কাবাব আর পরটা? নাকি অন্যকিছু?"

"উফ। এসব খাবো না।"

"ওদের সর্ষে ইলিশটা দারুণ হয়। আনি?"

"নাআআআ।"

"তাহলে কি আনবো?"

"উফ! তুমি এমন শুরু করলে কেন বলো তো? কিছু লাগবে না বললাম না?"

"লাগবে বললাম না আমিও? সারাদিন না খেয়ে থেকে অসুখ বাঁধাতে চাও? সেটা হবে না। তোমার জন্য আমি আমার বাবুটাকে নিয়ে কোন রিস্ক নিতে পারবো না। ইম্পসিবল।"

"কি বলো আবোলতাবোল! বাবু পেলে কোথায় তুমি?"

"ইশ! পেলাম আর কোথায়? তবে একসময় বাবুটা তো আসবে নাকি? এখন তোমার নিজেরই ঠিকঠাক নিউট্রেশন না থাকলে আমার বাচ্চাটার কি হবে! তোমার জন্য আমার বেবি পুষ্টিহীনতায় ভুগবে!সেটা আমি মানবো না। একদমই না।"

"এই তোমার কাজ নেই? কাজ করো তো যাও। যত সব উদ্ভট কথাবার্তা।"

"একদম বেশি বেশি করবা না মায়রা। কি খাবা তাড়তাড়ি বলো। নইলে আমি আনলে তখন তোমার ইচ্ছে না করলেও জোর করে খাওয়াবো বলে দিলাম।"

"ধ্যাত।"

"ফুসকা খাবা? তুমি তো ভালোবাসো ফুসকা খেতে।"

"উফ! আয়ান!"

"কি গো বউটা?"

"তোমার যা ইচ্ছে হয় নিয়ে এসো। আমি জানি না।"

"উমমমম। আচ্ছা। কি আর করা!"

"হুম।"

"এই মায়রা? পেস্ট্রি আনবো?"

"আয়ান?"

"কি গো পরীটা?"

"বায়। কাজ করো তো যাও।"

"উমম। ওকে। বায় পরী। আমার ফিরতে একটু লেইট হবে। টেনশন করবা না কিন্তু। কেমন? লাভ ইউ৷"

"ওকে। লাভ ইউ টু।"

মায়রা ডাটা অফ করে মোবাইলটা রেখে হাসলো। এই লোকটা এতোটা পাগল কেন কে জানে! ফ্লোর থেকে উঠে বিছানায় বসে হেলান দিয়ে মায়রা আয়ানের সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো মনে করে নিজের মনেই হাসতে লাগলো। যে কয়জন মানুষ কোন স্বার্থ ছাড়াই মায়রাকে ভালোবেসেছে তাদের একজন হলো আয়ান। কারণে অকারণে ওকে প্রত্যেকটা বিপদ থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করে মানুষটা। এমন একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী রূপে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে মায়রার। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষগুলোর একজন মনে হচ্ছে মায়রার এই মূহুর্তে। কিন্তু সেই মানুষটা ওকে পেয়ে সুখী তো? নাকি যে মানুষটা মায়রার জীবনে পৃথিবীর সমস্ত সুখ এনে দিয়েছে সেই মানুষটার জীবন থেকে সবটুকু সুখ মায়রা নিজেই কেড়ে নিচ্ছে! আসলেই কি আয়ানের জীবনে এসে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছে মায়রা?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন