৬৭!!
চোখ খোলার চেষ্টা করতেই এক গুচ্ছ আলো এসে প্রায় চোখ জোড়া ধাঁধিয়ে দিলো সায়নার। তবু হুঁশ হওয়ার সাথে সাথেই প্রায় লাফিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো মেয়েটা। কোথায় আছে বুঝতেই বেশ কিছুটা সময় লাগলো। তবে এটা বুঝতে পারলো সেই ট্যাক্সিটাতে নেই ও এখন। বেশ গোছানো একটা বিছানায় শুয়ে ছিল এতোক্ষণ। নিজের দিকে তাকাতেই গায়ের থ্রি-পিস জামাটার বেহাল দশা দেখে গায়ের উপরে টানা চাদরটা আরো ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। এই বাসায় কি করে পৌঁছালো সেটাই বুঝতে পারছে না মেয়েটা। যতটুকু মনে পড়ছে তাতে ট্যাক্সি ড্রাইভারটার গাড়ি থেকে নামার কথাটাই মনে পড়ছে সায়নার। তারপর কি হলো! এমন শয়তান একটা লোক নিশ্চয়ই এই আলিসান বাসার থাকে না। তাহলে! নাকি অন্য কারো খপ্পরে পড়েছে? কথাটা চিন্তা করতেই প্রচন্ড কান্না পেল সায়নার। চোখ থেকে এক ফোঁটা কান্নার জল গড়িয়ে পড়ার আগেই টের পেল দরজা ঠেলে কেউ রুমে ঢুকছে। লোকটাকে আসতে দেখেই সায়না গায়ে চাদরটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে পেঁচিয়ে ধরে বসে রইলো। রীতিমতো হাত পা কাঁপছে মেয়েটার। লোকটার হাতে কিছু একটা থাকায় সায়নার দিকে খেয়াল করে নি। এবারে মানুষটা মুখ তুলে তাকাতেই সায়নার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। আর তাকে দেখে সায়না পুরো থ হয়ে তাকিয়ে রইলো। আরে! এই তো গাড়ির লোকটা! যাকে এতো চেনা লাগছিল সায়নার! এই লোকটা কোথা থেকে এলো!
-আরে ম্যাডাম? আপনার জ্ঞান ফিরেছে? থ্যাংক গড! আমি তো টেনশনে পড়ে গেছিলাম।
-আপনি! আমি! আমি এখানে কি করে এলাম! এটা কোন জায়গা? আমাকে কেন এনেছন এখানে?
-আরে! রিল্যাক্স! ঘাবড়াবেন না। আমার কথাটা তো শুনুন----।
-খবরদার কাছে আসবেন না বলে দিচ্ছি---।
-আরে! কি মুশকিল! চিৎকার করবেন না প্লিজ। সোসাইটির সবাই শুনলে কি না কি ভাববে! অদ্ভুত! এ দেখি আরেক বিপদ!
-আপনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন? কি করেছেন আমার সাথে? বলুন? খবরদার সামনে-- সামনে এগোবেন না বলে দিচ্ছি---।
সায়না চিৎকার করেই কথা বলে চলেছে। লোকটা হাতে থাকা ট্রেটা রেখে সায়নার মুখ চেপে ধরলো। সায়না ভয়ে আরো বেশি ধস্তাধস্তি করে ছোটার চেষ্টা করলো। লোকটা এবারে এক হাতে সায়নার মুখ চেপে ধরে অন্য হাতে সায়নাকে নিজের একদম কাছে টেনে নিয়ে চোখে চোখ রাখলো। সায়না এবারে ভয়ে একেবারে চুপসে গেল।
-কি আশ্চর্য মেয়ে রে বাবা! কখন থেকে চুপ করতে বলছি! কথা শুনছেন না কেন? আপনাকে বাঁচিয়ে কি এবার বাড়ি ছাড়া হতে হবে নাকি! অদ্ভুত! এই জন্যই কারো উপকার করা উচিত না। ঘুরে ফিরে সব দোষ এসে পড়বে নিজের ঘাড়ে! ধুস শালার!
-------------------------------
-এতোক্ষণ তো খুব লাফাচ্ছিলেন! এবার চুপ করে গেলেন কেন? কিছু বলুন? ওই বদমাইশ লোকটার থেকে আপনাকে উদ্ধার করে কি ভুল করেছি যে এখন নিজে বাঁশ খাবো? কথা বলুন?
-উম?
রাগের চোটে সায়নার মুখ থেকে হাত না সরিয়েই প্রায় ধমক দিয়ে কথাগুলো বলছিলো লোকটা। এবারে খেয়াল হতে হাতটা সরিয়ে নিয়ে নিজেই মাথা চুলকালো।
-সরি? আসলে খেয়াল করি নি--।
-আমি এখানে কি করে এলাম প্লিজ বলবেন?
-আমম। বলছি। আপনি চেইঞ্জ করে নিন। কাবার্ডে পড়ার মতো কিছু পেয়ে যাবেন। আর গরম গরম স্যুপটাও খেয়ে নিবেন। দুর্বলতা কেটে যাবে---।
-কিন্তু-----?
-আপনাকে এভাবে অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখতে আমার নিজের কাছেই অকওয়ার্ড লাগছে। প্লিজ চেইঞ্জ করে খেয়ে নিন। আমি ড্রইংরুমে আছি--।
-হুম----।
-আর প্লিজ দয়া করে ভয় পাবেন না। আমি আছি---।
-জি---।
লোকটা রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই সায়না প্রায় ছুটে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। লোকটার আচরণে তেমন খারাপ কিছু মনে হচ্ছে না যদিও। তবু সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন লোককে এতো সহজেই কি করে বিশ্বাস করবে? এসব চিন্তা করতে করতে ঘড়ির ডং ডং শব্দে রীতিমতো চমকে উঠলো সায়না। আরেকটু হলেই গলা দিয়ে আর্তচিৎকার বেরিয়ে পড়েছিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আরেকবার চমকালো সায়না। কাটায় কাটায় বারোটা বাজছে এই মূহুর্তে। সায়নার যতটুকু মনে পড়ছে ট্যাক্সিতে লাস্ট সময় দেখেছিল তখন সাতটা বাজে। এতোটা সময় কিভাবে কেটে গেছে কে জানে! আর কি কি ঘটেছে সেটাও জানে না মেয়েটা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাবার্ডটা খুলতেই সুন্দর করে গোছানো জামা কাপড়গুলো চোখে পড়লো সায়নার। বেশ অবাক হয়েই সায়না খেয়াল করলো দুটো শাড়ি আর আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র খুব সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা আছে কাবার্ডে। তার মানে এই বাড়িতে কোন মহিলাও আছে! কথাটা ভাবতেই ভ্রু জোড়া কিছুটা কুঁচকে গেল সায়নার। সেরকম হলে সায়নার জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে মহিলাটির এখানে উপস্থিত থাকা উচিত ছিল না? এতোটা সময় পার হয়ে গেল একবারের জন্যও তো তার উপস্থিতি টের পায় নি সায়না! আধো এই বাড়িতে ওরা দুজন ছাড়া আরো কেউ আছে তো! নাকি!? কথাটা চিন্তা করে আবার ঢোক গিললো সায়না। কোনমতে এখান থেকে পালাতে হবে চিন্তা করেই কমলা রঙের শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। কোনমতে শাওয়ার নিয়ে শাড়িটা ঠিক করে পড়ে নিলো সায়না। তারপর কয়েক চুমুক স্যুপ কোনোমতে পেটে চালান করে বাইরের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
সোফায় মানুষটাকে হেলান দিয়ে চোখ বুজে থাকতে দেখে সায়নার পা জোড়া না চাইতেও যেন আটকে গেল। ক্লান্ত মুখটায় অন্যরকম একটা মায়া ফুটে আছে। আরো কিছু একটা আছে সেই মুখটায় যা সায়না এই মূহুর্তে ধরতে পারছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে এই মানুষটা কোনো অন্যায় করতেই পারে না। তাকে বিশ্বাস করা যায়। বিশ্বাস করে সারাটা জীবন তার এই ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটা দেখে কাটিয়ে দেয়া যায়। কথাটা ভাবা শেষ হতেই সায়না চমকে উঠলো। কি সব ভাবছে ও! মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি ওর! লোকটা জেগে ওঠার আগেই পালিয়ে যাওয়া উচিত কথাটাও প্রায় সাথে সাথেই সায়নার মাথায় খেলা করে গেল। কিন্তু সেটা করার আগেই চোখের সামনে আবার অন্ধকার হয়ে এসে পড়ে যেতে লাগলো সায়না। পাশের দেয়াল হাতড়ে সেটা ধরে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করতেই কিছু একটা সায়নার হাতের ধাক্কায় পড়ে গিয়ে ধাতব শব্দ করে উঠলো। তাতেই লোকটার চোখটা ছুটে গেল। আর মুখ তুলে সায়নাকে দেখেই প্রায় ছুটে এসে সায়নাকে ধরেও ফেললো। মেয়েটা আরেকটু হলেই বুকশেলফের কোণার উপরে পড়তো। সায়নাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে পাশে বসলো লোকটা। সায়না ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে।
-আপনাকে না বললাম স্যুপটুকু খেয়ে নিতে? উফফ! কি যে করেন! অদ্ভুত!
লোকটা বিরক্ত হয়ে উঠে গিয়ে দু মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলো। সায়নাকে অবাক করে দিয়ে এক চামচ স্যুপ সায়নার মুখের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। সায়না চোখ বড় বড় করে লোকটার দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করলো। কিছু মিশিয়ে টিশিয়ে আনে নি তো! সায়না ভয় পেয়ে ঢোক গিলে মানুষটার মুখের দিকে তাকাতেই বিরক্ত হওয়া মুখটা দেখলো।
-দেখুন? প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে আমার। আর দয়া করে এমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবেন না। বিরক্ত লাগছে আমার। দয়া করে খেয়ে নিন প্লিজ?
-হুম----।
সায়না ভয়ে ভয়েই এক চুমুকে চামচের স্যুপটুকু খেয়ে নিলো। লোকটা আবার চামচ ভর্তি করে সায়নার মুখের দিকে বাড়িয়ে ধরলো। এবারে তার মুখের কঠোর ভাবটা কেটে আবার আগের কোমলতা ফুটে উঠেছে। দেখতে বেশ লাগছে সায়নার।
-আপনি সেন্সে ছিলেন না বলে আমি একজন ডক্টরকে খবর দিয়েছিলাম। উনি বললো আপনি বেশি প্যানিক করার কারণে সেন্সলেস হয়ে গেছেন। মাথায়ও কিছুটা আঘাত পেয়েছেন সম্ভবত। একটা ইনজেকশন পুশ করেছে ডক্টর। যাতে আপনার সেন্সটা তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। তাই এতো দুর্বল লাগছে। এর বেশি কিছুই না। স্যুপটা খেয়ে নিন আর ঘুমানোর আগে এক গ্লাস গরম দুধ। দেখবেন সকালে একদম ঠিক হয়ে যাবেন।
-কিন্তু আমি এখানে! এখানে এলাম কি করে? সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
-একচুয়েলি ট্যাক্সির জানলা দিয়ে আপনাকে দেখে অবাকই হয়েছিলাম কিছুটা। বেশ রাত না হলেও এই সময়টায় একটা মেয়েকে একলা ট্যাক্সিতে করে যেতে দেখা অবাক হওয়ার মতোই বিষয়। চোখের পলকে ট্যাক্সিটা সামনে এগিয়ে যেতে আমিও কি মনে করে ট্যাক্সির পিছু নিলাম। কাজটা কেন করেছি নিজেও বুঝতে পারি নি। তবে মনে হচ্ছিল অদ্ভুত মুগ্ধতার ছায়া যে মুখে তার সেই মুগ্ধতাটা যেন কোন কালো থাবায় মুছে না যায়। ট্যাক্সিটাকে ক্রস করার সময় আপনি যখন হেল্প বললেন সেটাও যেন এই শহরের হাজার কোলাহলের মধ্যেও আমার কানে এসে বাজলো। একটু এগিয়ে গিয়ে সামনেই পুলিশ চেকপোস্ট আছে জানাই ছিল। স্পিড বাড়িয়ে সেখানে খবর দিয়ে কয়েক মিনিট পরেও যখন ট্যাক্সিটা এলো না তখন বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পুলিশের জিপটাও এসেছিল আশপাশটা চেক করতে। তাই সহজেই লোকটার কিছু করে বা বুঝে ওঠার আগেই আপনাকে সহীহ সালামতে উদ্ধার করতে পেরেছি। এন্ড ইউ নো। আপনার তো সেন্সই ছিল না। প্যানিক এ্যাটাক হওয়ার ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। আপনার ঠিকানাও জানি না। তাই নিজের বাসায়ই নিয়ে এলাম। সরি ফর দ্যাট।
-আরে না না! কি বলছেন! আপনি না এলে এতোক্ষণে হয়তো আমার লাশটা আশেপাশের কোন ডাস্টবিনের শোভা বাড়াতো। ভাগ্যিস আপনার কৌতূহলী চোখ জোড়া আমার চোখের মুগ্ধতাটা দেখেছিল। হি হি।
সায়নার কথা শুনে লোকটাও হালকা গলায় হাসলো। আর তার মিষ্টি বাঁকা হাসিটা একেবারে হৃদয়ে গেঁথে গেল সায়নার। লোকটাকে কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারছে না বেচারি। এই হলো সমস্যা। আর তেমন কথা হলো না দুজনের। লোকটা চুপচাপ সায়নার দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে স্যুপটুকু সায়নাকে খাইয়ে দিলো। সায়নাও চুপচাপ লক্ষী মেয়ের মতো খেয়েও নিলো। লোকটা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে স্যুপের বাটিটা নিয়ে সবে উঠে দাঁড়িয়েছে রুমটা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। ঠিক সেই মূহুর্তে দেয়ালে টাঙানো একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল। আর অসাবধানতায় গলা দিয়ে প্রায় চিৎকার বেরিয়ে এলো সায়নার।
-সীমান্ত! আপনি সীমান্ত তাই না?
৬৮!!
সেই কবে থেকে আরিশা আর তাওহীদ আয়ান মায়রাকে বাসায় আসার জন্য বলছে। কিন্তু না আয়ান সময় পাচ্ছে অফিসের কাজের চাপে, আর মায়রার কথা তো বাদই দিলাম। মেয়েটা নিজের সংসার, পড়ালেখা আর এনজিও এর কাজ নিয়ে এতো ব্যস্ত যে নিজের জন্য আলাদা করে বের করার সময়টুকু পর্যন্ত নেই। ওদের দুজনের এতো কাজের প্রেশার দেখে এবারে আরিশা প্রায় রণমূর্তি ধারণ করলো। এভাবে এতো প্রেশার নেয়ার কোনো মানে আছে! কোথায় হুট করে কয়েক দিনের জন্য এই কর্মব্যস্ত জীবনটা থেকে ছুটি নিয়ে সবাই মিলে হৈ হুল্লোড় করে কাটাবে! তা না! তারা নিজেদের সেই এক গদবাধা জীবন নিয়েই ব্যস্ত। আরিশা কাল বিকেলেই এসে ওয়ার্নিং দিয়ে গেছে। আজকের দিনটা যদি ওরা আরিশাদের ওখানে না যায় তাহলে রীতিমতো দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে বসবে। আয়ানের বাবা মা ও তাতে সায় দিলেন। বলতে গেলে উনারা এক প্রকার জোর করেই আয়ান আর মায়রাকে একটা দিনের জন্য মিনি হলিডেতে পাঠালেন। এভাবে রোবটের মতো ডেইলি রুটিনড লাইফ থেকে বেরিয়ে অন্তত নিজেদেরকে সময় দেয়া তো প্রয়োজন। তাই আজকের সারাটা দিন দুই জুটিতে মিলে জমিয়ে আড্ডায় মাতলো। ছোট্ট আরশিটা যদিও নিজের দুষ্টুমি দিয়ে সবাইকে মাতিয়েও রাখার চেষ্টা করছে। সব মিলিয়ে ওদের দিনটা অসম্ভব রকমের সুন্দর কাটলো।
সারাদিন সবাই মিলে বেশ হৈ হুল্লোড় করেই কাটিয়ে, চারজনে মিলে লাফালাফি করে রান্না করেছে। আর সবশেষে সবাই মিলে একসাথে ডিনার শেষ করে আরো বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে যখন ঘুমাতে গেছে তখন ঘড়িতে প্রায় বারোটা বাজে। মায়রা আয়ানের একটু আগেই রুমে এসেছিল। আয়ান রুমে এসে মায়রাকে না দেখে এক সেকেন্ড থমকে কিছু ভাবলো। তারপর দরজা বন্ধ করে হেসে উঠে বারান্দায় দিকে পা বাড়ালো। বারান্দার দরজার কাছে এসে আয়ান কিছুক্ষণ মায়রার শাড়ির আঁচলটাকে বাঁধনহারার মতো উড়তে দেখলো। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মায়রাকে পিছন থেকেই জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজলো। মায়রা কিছু না বলে নিঃশব্দে হাসলো।
-তা জনাব? এইটাই আপনার সারপ্রাইজ ছিল তাই না?
-হুম। আরু নিজের হাতে ডেকোরেট করেছে। স্পেশালি তোমার আর আমার জন্য। আমাকে প্রথম যেদিন দেখিয়েছে আমি তো পুরোই অবাক হয়ে গেছিলাম। তখনই ঠিক করেছিলাম বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে এখানে কয়েকটা দিন বেড়াবো। তোমার তো সময়ই হয় না---।
-ইশ! তাই না? কি পচা বউ আপনার। একদম সময়ই দিতে পারে না। আফসোস!
-টিজ করা হচ্ছে আমাকে? তুমি যে আমাকে একদমই সময় দাও না তার প্রমাণ চাও?
মায়রা আয়ানের দিকে ঘুরে বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সোজা আয়ানের চোখে চোখ রাখলো। আয়ানও মায়রার দুপাশের দেয়াল হাত দিয়ে মায়রাকে বন্দী করে মায়রার গলায় গভীরভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে লাগলো। মায়রা একবার কেঁপে উঠে আয়ানের টিশার্টের পিঠের কাছটা খামচে ধরলো।
-কিসের কি? সে নাকি কিসের প্রমাণ দিচ্ছে? এখন কি হচ্ছে?
আয়ান মায়রার গলা থেকে সরে এসে কানের লতিতে আলতো করে কামড় বসালো। মায়রা এবারে আবার কেঁপে উঠে চোখ বুজে নিলো।
-কাল সকালে আমরা বাসায় ফিরবো না। সারাটা রাত লাজুক পরীটাকে উষ্ণতার চাদরে বেঁধে রাখবো। তারপর সারাটা দিন তাকে বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখবো। জ্বালাতন করবো, আদর করবো, বিরক্ত করবো সারাদিন। সন্ধ্যের আগে বীচে যাবো। বীচে সূর্যাস্ত দেখে পরীটাকে নিয়ে শহরটা ঘুরবো। তারপর গভীর রাতে বাসায় ফিরবো---। মাঝের সময়টায় গাড়িতে অনেকটা সময় পাওয়া যাবো রোমান্স করার----।
-পাগল হয়ে গেছ? কি বলছো এসব? বাবা মা কতো চিন্তা করবে জানো?
-দেখলে তো? আমি ঠিক বলেছি কি না? তুমি আবার না করছো--। তুমি আসলেই আমাকে সময়ই দাও না--।
-------------------------------
-বিয়ের আগে ভেবেছিলাম আমিই কাজের ব্যস্ততায় তোমাকে নিয়ে সাগরে যেতে পারবো না। এখন দেখি বিয়ের পরে তুমিই বের হতেই চাও না। আমি নিতে চাইলেও তোমার এটা ওটা বায়না রেডিই থাকে----।
মায়রা আয়ানের কথাটা শুনে কিছুটা চমকে গেল। মানুষটা কি অভিমান করেছে ওর উপরে? আসলেই তো সারাদিনের কাজের চাপে কোথাও যাওয়ার কথা মায়রার মাথাতেই আসে না। আগে তো প্রতি সপ্তাহে দু তিনবার করে মানুষটার সাথে ঘুরতে বের হতো মায়রা। আসলেই কি মায়রা বদলে যাচ্ছে? মানুষটাকেও সময় দেয়া হয় না তেমন। লোকটা অফিস থেকে কতো টায়ার্ড হয়ে আসে। তবু মায়রার জন্য জেগে বসে থাকে। কখন মায়রা সব কাজ গুছিয়ে রুমে আসবে। সারাদিন মায়রা কি কি করেছে এসব শুনতে শুনতে মায়রাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে মায়রা সেটা টেরও পায় না। কোথায় যেন একটা খারাপ লাগা বাসা বাঁধতে শুরু করেছে মায়রার মনে। তবে সেটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। আয়ানের ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ এবার মায়রার গলা ছাড়িয়ে কাঁধে গিয়ে পৌঁছেছে। মায়রা একটু চমকে আয়ানের হাতে হাত রাখলো।
-আরে পাগলি? আমি দুষ্টুমি করছি। এভাবে গাল ফুলিয়ে এতো ভাবতে হবে না গো সোনাপাখি।
-কিন্তু সত্যিই তো তোমাকে একদমই সময় দেয়া হচ্ছে না আয়ান। আম সরি----।
-দেখেছ? এখনও আদর করছি আর তুমি সেখানেও বাগড়া দিচ্ছ! এসব কিন্তু মানবো না হ্যাঁ মায়রু? ঠিক না ঠিক না এসব একদমই----।
-আয়ান? কি করছ?
-এতো কষ্ট করে সারপ্রাইজ দিলাম সেটার প্রাইজ পাবো না? তা কি হয় বলো?
-দুষ্টুমি করবা না একদম। বেড়াতে এসেছি সে খেয়াল আছে জনাবের?
-হুম তো? বেড়াতে এলে বউকে আদর করা যাবে না এটা কোথায় লেখা আছে গো মিসেস স্নো হোয়াইট? আদর তো আমি করবই---। তুমি মানা করলে শুনছে কে?
-আয়ান?
আয়ান নিজের মতো করে দুষ্টুমিতে মাতিয়ে তুলছে মায়রাকে। বেচারি এবারে আয়ানের দুষ্টুমিতে হিমশিম খেয়ে গেল। তবু কোনোমতে আয়ানের কাঁধে হাত ঝুলিয়ে আয়ানকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো।
-আয়ান? একটা কথা শোনো না?
-হুম? বলো না? আদর করছি কিন্তু কান খাড়া আছে। বলে ফেলো সোনাপাখি---।
-আগামী সপ্তাহে বাবা মায়ের বিবাহ বার্ষিকী বলেছিলে না?
-হুম---। তো?
-চলো না বাবা মা র জন্য কিছু সারপ্রাইজ প্ল্যান করি?
-সারপ্রাইজ! উমমমম। ওকে।
-আরে?
আয়ান দু সেকেন্ড কিছু একটা ভেবে নিয়ে মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো আলতো করে। বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে খাটের স্ট্যান্ডে ঝোলানো পর্দাগুলো খুলে দিয়ে মায়রার দিকে এগিয়ে গেল আয়ান। মায়রা থতমত খেয়ে আয়ানের কাজ দেখছিলো। এবারে আয়ান মায়রাকে টেনে নিয়ে মায়রার উপরে ঝুঁকে মুখটা চুমোয় ভরিয়ে দিতেই মায়রা কেঁপে উঠে চোখ বুজে নিলো লজ্জা পেয়ে। আয়ান মুখ তুলে কিছুক্ষণ মায়রার লাজুক লজ্জা রাঙা মুখটা দেখে মায়রার কানের কাছে মুখ নিলো।
-বাবা মায়ের সাথে খেলার জন্য একজন নতুন অতিথি আসার খবরটা সারপ্রাইজে দিলে কেমন হয় মায়ু? দাদু হওয়ার খবরটা বাবা মায়ের জন্য নিশ্চয়ই ভিষণ বড় একটা নিউজ হবে? কি বলো?
-যাহ! কি বলো?
-আজ থেকেই চেষ্টা করলে আগামী সপ্তাহে নিশ্চয়ই সুখবরটা দিয়ে দিতে পারবো। কি বলো? ভালো হবে না?
-যাহ! অসভ্য একটা----। মুখে একদম কিচ্ছু আটকায় না তার--।
-আটকানোর কিছু নেই বউ। আসো। লেটস স্টার্ট----।
মায়রা লজ্জায় পেয়ে দু হাতে মুখ ঢাকতেই আয়ান হেসে মায়রার হাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো। আলতো করে মায়রার কপালে, নাকে, গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে দিতে একসময় মায়রার ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের উষ্ণ বাঁধনে আটকে নিলো আয়ান। মায়রাও আয়ানের এই উষ্ণ ভালোবাসায় গা এলিয়ে দিয়ে অন্য এক দুনিয়ায় হারিয়ে গেল। রাত বাড়ার সাথে সাথে দুটো মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে নিজেদের ভালোবাসার স্বর্গ রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো আরো একবার।
আয়ানদের পাশের কোনো একটা রুমে ঘুমন্ত আরশিকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে তাওহীদ আরিশাকে নিয়ে রাতের নিস্তব্ধতা অনুভব করছে। আরিশা তাওহীদের কাঁধে মাথা রেখে দূরের টাওয়ারের বাতির আলোয় নিস্তব্ধ ঘুমন্ত শহরটাকে দেখছে। তাওহীদের একটা হাত আরিশার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে আছে। অন্য হাতটা একটু পর পর মেয়েটার গাল ছুঁয়ে নিজের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টায় মেতে আছে। কিছু একটা বলতে চেয়েও উসখুস করছে দুজনেই। মন বলছে সামনের মানুষটা নাহয় বুঝে নিক আজকের আবদারটা। কিন্তু মস্তিষ্ক এতো ফর্মালিটিতে যেতে চাইছে না। দুজনের ভারি নিঃশ্বাসগুলো তাই হয়তো নিজেদের মনের গোপন কথাগুলো বলে যাচ্ছে চুপি চুপি। তাওহীদ এবারে আর চুপ করে থাকতে পারলো না। চোখ বুজে আরিশার ঘাড়ের কাছের কয়েক গোছা চুল সরিয়ে নক ঘষলো। আরিশাও তাওহীদের বুকের কাছে খানিকটা সরে এসে মুখ লুকিয়ে নিলো।
-আজকে একটু বেশি করে ভালোবাসবে আমায় তাওহীদ?
কথাটা শেষ করতে আরিশার যতটুকু সময় লাগলো তার থেকেও কম সময় লাগলো তাওহীদের আরিশাকে কোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াতে। এই দুষ্টু রাগী পরীটাকে ভালোবাসায় মাতাল করার সুযোগ তাওহীদ কি আর ছাড়তে পারে?
এদিকে, সায়নার মুখে নিজের নামটা শুনে সীমান্ত বেশ চমকে গেল। এখনো পরিচয় বিনিময় হয়নি দুজনের। মেয়েটাকে আজকের আগে কোথাও দেখেছে বলেও মনে পড়ছে না সীমান্তের। তবু কি করে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সীমান্ত রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিল। এতো প্রশ্ন একসাথে মাথায় ঘুরছে যে প্রশ্নগুলো যে সায়নাকে করবে সেটাই সীমান্তের মাথায় এলো না। রান্নাঘরে স্যুপের বাটিটা রেখে এসে সায়নাকে প্রশ্নটা আর করা হলো না সীমান্তের। মেয়েটা এই একটু খানি সময়েই একেবারে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা মানুষ কি করে ঘুমিয়ে যায় সেটা ভেবেই সীমান্ত হেসে ফেললো। একটু দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েটার ঘুমন্ত মায়াবী মুখটা দেখতে লাগলো অপলকে। একটা মানুষ এতো সুন্দর কি করে হতে পারে! এতো মায়া, এতো বিস্ময়, এতো কৌতূহল কি করে একসাথে থাকতে পারে একটা মুখে? সায়নার ঘুমন্ত মুখটা দেখে এই একটা প্রশ্নই নিজেকে নিজে করে যাচ্ছে সীমান্ত। জবাবটা পর জানা নেই। এই মূহুর্তে জানার ইচ্ছেও নেই হয়তো।