অলকানন্দা - পর্ব ১৩ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!৩৭!!

"আপনি চিন্তা করবেন না মিঃ রেজওয়ান। মিস মাহা সুস্থ হয়ে যাবেন।"

চেহারায় যথাসম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে কথাটা বললো সার্থক। এই মুহূর্তে নিজের রাগ সে প্রদর্শন করতে চাচ্ছেনা। রেজওয়ান আস্বস্ত হলো কিনা তার চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই। রেজওয়ান এগিয়ে গেলো মাহার কাছে। পাশে রাখা চেয়ারে বসে বললো,

"মাহা, আমি একটু আসছি। কিছুক্ষণের ভিতরই ফিরে আসবো। প্লিজ তুমি শান্ত হয়ে থেকো। তুমি না ব্রেইভ্ গার্ল?"

মাহা মাথা নিচু করে রেখেছে। আস্তে করে মাথাটা ডানদিকে দুলালো একবার। অতঃপর স্থান ত্যাগ করলো রেজওয়ান। সম্পূর্ণ সময় ধরে মাহা এবং রেজওয়ানকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। রেজওয়ান বেরিয়ে যেতেই মাহার পাশে এসে বসলো সে। হাতটা টেনে নিলো আলতো করে নিজের কাছে। রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে কিছুটা। কেঁপে উঠলো মাহা। হাতের রক্ত পরিষ্কার করতে করতে সার্থক বললো,
"আপনি কি সবসময় এমন পাগলামি করেন মাহা?"

মাহা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মুখ দিয়ে কোনো কথাই আসছেনা তার। হাত কাঁপছে রীতিমতো। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। সার্থক আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। 

"আমার সাথে একদম জেদ দেখাবেন না মাহা। আমি অফিসার রেজওয়ান নই। এখানকার কর্তব্যরত একজন ডাক্তার আমি। আশা রাখছি একজন ডাক্তারের সাথে কিরকম ব্যবহার করতে হয় সেই শিক্ষা আপনার পরিবার আপনাকে দিয়েছে?"

বুকটায় হঠাৎ একটা পিঁপড়ের কামড় অনুভব করলো মাহা। বিষ পিঁপড়া। দলে দলে কামড়ে চলেছে তার বুকে। হাত পরিষ্কার শেষে উঠে দাঁড়ালো সার্থক। গটগট করে বেরিয়ে গেলো সে। একবার পিছু ফিরে তাকায়নি! তাকালে হয়তো দেখতে পেতো তার অলকানন্দার ছলছল দুটি নেত্র।

কিছুক্ষণ বাদে একজন নার্স এলেন। হাতে স্যুপের বাটি। মাহাকে নিজ হাতেই খাইয়ে দিলেন তিনি। মাহা অবাক হলো অনেকটা। নার্সের এতো ভালো ব্যবহারের পিছনে কার হাত রয়েছে বুঝতে অসুবিধা হলোনা তার। নার্স ওর হাতে ইনজেকশন পুশ করার কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমেরা এসে জড়ো হলো তার চোখে। ঘুমের দুনিয়ায় পাড়ি জমালো মাহা। মাহা কি জানে এতটা সময় তার পাশে বসে ছিলেন ডক্টর ফায়রাজ সার্থক? এই যেমন এখনো বসে আছেন। দ্বিতীয়বারের মতো মাহার কপালে চুমু এঁকে দিলো সার্থক। মেয়েটাকে কি সে ভালোবেসে ফেললো তবে? এই যে কালো সালোয়ার কামিজ পরনে হলদেটে ফর্সা মেয়েটা। কোঁকড়া চুলের হৃদয় দুলানো মেয়েটার কি প্রেমে পরে গেলো সার্থক। অবাধ্য জীবনে কি শান্তির পরশ হবে মেয়েটা? মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে সার্থক বললো,

"তুমি আমার পবিত্রা, অলকানন্দা।"

দূর থেকে তাদের লক্ষ্য করছে নেকড়ের চেয়েও ধারালো দু'খানা চোখ। একেবারে পর্দার আড়াল থেকে। দুজনের মধ্যে একজন ব্যাক্তির প্রতি তার ভিষণ রাগ। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। 
"কে বাইরে?"

সার্থকের গলার আওয়াজ পেয়ে সরে গেলো সে। নারী! এই পৃথিবীতে একমাত্র নারীই পুরুষকে ধ্বংস করতে পারে। আবার এই নারীই কোনো ধ্বংসের তান্ডবে মাতোয়ারা পুরুষ কে নিজের ছোঁয়ায় পবিত্র করতে পারে। ভালোবাসা এ এক গভীর কুহক। এই কুহকে ডুবে নিজের সত্তাও ভুলে যায় অনেকে। কিন্তু অতীত! অতীত তাকে ফেলে দেয় দোটানায়। এক গভীর দোটানায়। 

!!৩৮!!

এসপি প্রলয় চ্যাটার্জীর জরুরি তল্লবে হাসপাতাল থেকে চলে এসেছে রেজওয়ান। এখানে উপস্থিত আছেন আরো দুই চৌকস পুলিশ অফিসার। এএসপি শাওন ও মোবারক। প্রলয় চ্যাটার্জী ভেতরে প্রবেশ করতেই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলো তিনজন। মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের চেহারায় কাঠখাট্টা ভাব। চুলগুলো ছোট করে কাঁটা। এই বয়সেও যথেষ্ট ফিট তিনি। ইউনিফর্মে তাকে দেখলে অনেক নব্য পুলিশ অফিসারেরই ঘাম ছুটে যায়। বিশাল কাঁচের টেবিলের বামপাশের চেয়ারে বসলেন তিনি। রেজওয়ান সহ বাকিদের বসতে বললেন তার বিপরীতে রাখা তিনটা চেয়ারে। সকলে চেয়ারে বসতেই রেজওয়ানের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন প্রলয়। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

"মেয়েটা কি শনাক্ত করতে পেরেছে?"
"জ্বি, স্যার। কিন্তু বাকি জিনিসগুলো দেখানোর আগেই ওর অবস্থা খারাপ হয়ে যায় ফলে দেখানোর আগেই অজ্ঞান হয়।"
"মাহা হোসেন তো আপনার পূর্ব পরিচিত?"
"জ্বি।"

ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কপালের একপাশ ঘষলেন প্রলয়। এটা তার মুদ্রাদোষ। 

"অফিসার্স। এই শরীরের অংশ প্রাপ্তির ঘটনাকে কোনো ভাবেই হেলায় ফেলায় নেওয়া যাবেনা। ২০১২ সালে এমনই এক ঘটনার স্বাক্ষী হয়েছিলো সারা বাংলাদেশ। পিবিআই, সিআইডি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ একযোগে কাজ করেছিলো তখন। প্রয়াত স্যার আজিজ এই ঘটনার মূল তদন্তে ছিলেন। স্যারের নেতৃত্বে অবশেষে অপরাধী কে ধরতে সক্ষম হই আমরা। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কেস এগুচ্ছে না। কোর্টের শুনানির আগের দিন আজিজ স্যারের বাসায় আগুন ধরে। পুড়ে ছাই হয়ে যায় সব। প্রাণ হারান স্যার আজিজ সহ তার পরিবার।"

মোবারক প্রশ্ন ছুঁড়েন,
"স্যার সব প্রমাণ কি আজিজ স্যারের কাছে ছিল? কিভাবে মারা যান তিনি?"
"সে সম্পর্কে আজও আমরা জানিনা। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ফলে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সন্দেহভাজন কোনো কিছুই ছিলোনা। তাই এই ঘটনাকে এক্সিডেন্ট হিসেবে ধরে নিয়েছে আদালত।"

শাওন মাঝে প্রশ্ন করলো,
"স্যার এমনও তো হতে পারে। এটা পরিকল্পিত?"
"হতেও পারে অফিসার শাওন। কিন্তু এরপর থেকে খুনের ঘটনা আর ঘটেনি।"

রেজওয়ান চুপচাপ সব শুনছিলো। সে প্রশ্ন করলো,
"স্যার এখন আমাদের প্রথম পদক্ষেপ কি?"
"দেখুন মিঃ রেজওয়ান। মাহা হোসেন আপনার পূর্ব পরিচিত। তাছাড়া সর্বপ্রথম মিসিং কেসে আপনার সাথেই তিনি যোগাযোগ করেন। অর্থাৎ কেসটায় সর্বপ্রথম ইনভলভ আমরা হয়েছি। আপাতত সিআইডি কিংবা অন্য কোনো ব্রাঞ্চ কে আমি এর সাথে যুক্ত করতে চাচ্ছিনা। মিঃরেজওয়ান আপনি, শাওন এবং মোবারক আপনাদের তিনজন কে নিয়ে একটি বিশেষ দল গঠন করা হবে। আপনাদের আন্ডারে থাকবেন ১০০ জন পুলিশ সদস্য। আমি আশা রাখছি এই ঘটনার মূল অপরাধীদের আমরা শনাক্ত করবোই।"
"সিলেট পুলিশের সহযোগীতাও প্রয়োজন পড়বে স্যার।"
"অবশ্যই। আমি যোগাযোগ করেছি। তারা সাহায্য করবেন আপনাদের।"
"স্যার লাশটা আতিয়া জামান চৈতির কিনা তা আগে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে।"
"ভিক্টিমের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করুন।"
"করেছি স্যার। চৈতির বাবা এবং ফুফু আর কিছুক্ষণের মাঝেই হাসপাতালে পৌঁছে যাবেন।"
"ভেরি গুড রেজওয়ান। তাহলে আপনারা কাজে লেগে যান। এই ঘটনা উদ্ঘাটন করতে পারলে অনেক বড় শিকলের সন্ধান মিলবে বলে আমার ধারণা।"

শাওন, মোবারক কেবিন ত্যাগ করলো। রেজওয়ান বের হওয়ার আগেই তাকে ডাকলেন প্রলয়। 
"মিঃ রেজওয়ান?"
"জ্বি, স্যার।"
"আপনাকে নিয়ে আমি আশাবাদী মিঃ রেজওয়ান। এই ঘটনা বড় কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস। কিংবা ঝড়টা হচ্ছে আমাদের অজান্তে। আমরা টের পাচ্ছিনা। বহু মানুষের জীবন এর মাঝে জড়িয়ে আছে। মাত্র কিছুক্ষণের মাঝেই মিডিয়াতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে এই ঘটনা। আমাদের যা করার শীঘ্রই করতে হবে।"
"আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো স্যার।"

বলেই বেরিয়ে গেলো রেজওয়ান। 

!!৩৯!!

মর্গের রাস্তা কোনদিকে মনে করতে পারলোনা মাহা। সে কোন তলায় আছে তাও তার ধারণার বাইরে। শুধু মনে আছে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো চৈতি তাকে ডাকছে। চৈতির কাছে যাওয়া প্রয়োজন। তাই আবার স্যালাইন ছিঁড়ে মর্গের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে সে। চৈতির সাথে তার কথা বলা খুব প্রয়োজন। হাত থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে মেঝেতে। সেই খেয়াল তার নেই। মানুষ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সেদিকে খেয়াল নেই। এটা কয় তালা? দুতালা নাকি তিন। কোথায় মর্গ! উফ! মাথাটা চেপে ধরে সিঁড়ি দিয়ে পাগলের মতো নামছে মাহা। 

"নার্স, এই কেবিনের পেশেন্ট কোথায়?"

রক্ত লাল চোখে প্রশ্ন করলো সার্থক। একটু আগে মাত্র বাইরে বেরিয়ে ছিলো সে। আর এসে দেখে মাহা নেই! 
"কি হলো বলুন? আপনাদের কাজের প্রতি এত অনীহা কেন আমাকে বলতে পারবেন? মেয়েটা মানসিক ভাবে সুস্থ না। আপনাকে দায়িত্বে রেখে গেলাম। মেয়েটা কোথায় চলে গেলো তা আপনি জানেনও না!"

নার্স নাজমা যারপরনাই অবাক হচ্ছেন। এতটা বছরে কখনো হাসিমুখ ছাড়া সার্থক কারো সাথে কথা বলেনি। সবসময় সুন্দর ভাবে কথা বলেছে। বড় বড় ভুল হলেও বুঝিয়ে দিয়েছে। আজ একটা মেয়ের জন্য এতটা অস্থির তিনি কেন হচ্ছেন? মেয়েটা কি অনেক স্পেশাল কেউ? মুখ খুলে কিছু বলবে তার আগেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো সার্থক। ফ্লোরে রক্তের ফোঁটা তার চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। রক্তের ফোঁটার সূত্র ধরেই সামনে এগুচ্ছে সে। কপালে ভাঁজ। তার ব্রাশ করে রাখা ঝাঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো। অদ্ভুত কালো চোখের মণি দুটো লালবর্ণ। 

সরু রাস্তা ধরে এগুচ্ছে মাহা। একটা সরু কন্ঠে চৈতি ডাকছে তাকে। চৈতির সরু ডাক ভেসে আসছে। মাহাকে কি যেন বলতে চায়। খুব জরুরি কথা। মাহাও এগিয়ে যাচ্ছে। শুনতে যে তাকে হবেই! এই তো মর্গের দরজা। উপরে সাদা বোর্ডে লাল কালিতে বড় বড় করে লেখা,"মর্গ"।

"আমি আসছি চৈতি।"

বলে মর্গে প্রবেশ করার আগেই তাকে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক। পাগলামি শুরু করলো মাহা। তাকে যে ভিতরে যেতেই হবে। চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু হলো তার। 
"প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দেন। আমাকে ভিতরে যেতে দেন।"
"চৈতি ডাকছে আমায়।"
"এই চৈতি। আমি আসছি।"

সার্থক আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। 
"মাহা, শান্ত হন।"

শক্ত, সামর্থ্যবান সার্থকও যেন পেরে উঠছেনা মাহার সাথে। কোনো দৈব শক্তিতে তাকে ভর করেছে যেন। সার্থকের হাত হালকা আলগা হতেই......
.
.
.
চলবে.....…....................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন