বকুল ফুলের মালা - পর্ব ৩০ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৫৯!! 

শাশুড়ির মাথার কাছে বসে এক মনে ভাবতে ভাবতে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিলো মায়রা৷ হঠাৎ গালে কারো হাতের ছোঁয়ায় চমকে মুখ তুলে তাকাতেই আয়ানকে দেখতে পেল। আয়ান একটু হাসার চেষ্টা করে মায়রার সামনেই ফ্লোরে বসে মায়রার হাত দুটো ধরলো। 

-এতো মনোযোগ দিয়ে কি ভাবছো? আমি যে রুমে এলাম টেরই পাও নি একদম। কোথায় হারালে ম্যাডাম?

-নাহ৷ কিছু না। তুমি এখানে কি করছ? যাও ফ্রেশ হয়ে চেইঞ্জ করে নাও? অফিস থেকে এসে চেইঞ্জ না করে এখনো বসে আছো কেন?

-আরে বাবা! যাবো তো? এমন করো কেন?

-না না না। কোনো কথা শুনবো না আমি। এখনি যাবা তুমি। ফ্রেশ হয়ে চেইঞ্জ করে ডিনার করে নিবা। আমি ডাইনিংরুমে----।

-একা একা খাবো?

-কাউকে কি ডেকে আনবো এখন তোমাকে ডিনার করতে কম্পানি দেয়ার জন্য?

-ধুর বাবা! কাউকে ডাকতে হবে কেন? তুমি খাবে না? চলো একসাথে----?

-এই তোমাকে যেতে বললাম না? এতো কথা বলো কেন? তুমি খেয়ে এলে মাকেও একটু খাইয়ে দিয়ে ওষুধ খাওয়াতে হবে। তাড়াতাড়ি যাও---।

-ওকে ম্যাডাম---। আমি দশ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবো---। 

-হুম৷ যাও।

আয়ান রুম থেকে চলে গেলে মায়রাও বাটির পানিটা বদলে শাশুড়ির গা, হাত, পা একটু মুছে দিলো। তারপর আবার জলপট্টি দিতে লাগলো। পনেরো মিনিটের মতো পরে আয়ান ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে রুমে আসলে মায়রা আয়ানকে মায়ের কাছে বসিয়ে রেখে ডাইনিং রুমে এলো। একটা ট্রেতে শাশুড়ির জন্য হালকা করে খাবার আর পানি নিয়ে রুমে এলো মায়রা। খাবারগুলো বেড সাইড টেবিলের উপরে রেখে মায়রা শাশুড়ির চুলে আলতো করে বিলি কেটে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করলো। বেশ কিছুক্ষণ পর আয়ানের মা পিট পিট করে চোখ খুলে তাকালেন মায়রার দিকে। সামান্য ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে মায়রা আর আয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বলতে চেয়েও পারলেন না। মায়রা বুঝতে পারলো শাশুড়ি উঠে বসতে চাইছেন৷ তাই মায়রা শাশুড়িকে উঠে বসতে সাহায্য করলো। আয়ান মায়ের বালিশটা বিছানার সাথে হেলান দিয়ে দিলে উনি হেলান দিয়ে বসে আবার ওদের দুজনের দিকে তাকালেন। হাতের স্যালাইন লাগানো হাতটা সাবধানে একবার দেখলো মায়রা। রক্ত উঠে গেছে কিনা নলে সেটা চেক করে নিশ্চিত হয়ে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকালো।

-মা আপনার ওষুধ খেতে হবে। একটু খানি কিছু খেয়ে ওষুধটা খেয়ে নিন কেমন?

-উঁহু। কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না আমার। ওষুধ দাও৷ খেয়ে ঘুমাই। চোখ মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে খুব----।

-না খেয়ে ওষুধ খাওয়া যাবে না মা। একটু করে খাবেন। অনেক পাওয়ারী ওষুধ মা। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। আপনার কষ্ট হবে না। বেশিক্ষণও লাগবে না। খেয়ে ওষুধটা খেয়েই শুয়ে পড়বেন----।

-উফফফ। আমার কিছু হয়নি। তোমরা অযথাই প্যানিক করছো--।

-জি মা। জানি তো কিছু হয়নি। এখন হা করুন তো। খেয়ে নিন। 

শাশুড়ির সাথে কথা বলতে বলতেই মায়রা হাত ধুয়ে প্লেটে ভাত মাখাতে শুরু করেছিল। এবারে শাশুড়ি আর তর্ক না করে হা করতেই মায়রাও মনের আনন্দে শাশুড়িকে ছোট বাচ্চার মতো যত্ন করে প্লেটের সবটুকু ভাতই খাইয়ে দিল। শাশুড়ি মাঝখানে একবার খাবে না বলে সরে আসতে চাইছিল বটে। কিন্তু মায়রাও সহজ পাত্রী না।  প্লেটের সবটুকু ভাত খাইয়ে সুন্দর করে মুখ মুছিয়ে দিয়ে নিজের হাতটা ধুয়ে এসে ডাক্তারের দেখিয়ে দেয়া ওষুধ খাইয়ে আবার যত্ন করে শাশুড়িকে শুইয়ে দিলো। শাশুড়িও এবারে শান্ত হয়ে চোখ বুজলেন। 

আয়ান এতোক্ষণ দেয়ালে হেলান দিয়ে মায়রার কাজগুলো দেখছিলো। এবারে মায়রা আয়ানকে ইশারায় শাশুড়ির পাশে বসতে বললে আয়ানও চুপচাপ গিয়ে বসে পড়লো। যাওয়ার দু-তিন মিনিটের মাথায় যখন মায়রা প্লেট আর ট্রে রেখে একটা ওয়াটার পট হাতে করে রুমে ঢুকলো তখন আয়ান ভ্রু কুঁচকে মায়রার দিকে তাকালো। মায়রা ওয়াটার পটটা বেড সাইড টেবিলের উপরে রেখে শাশুড়ির পায়ের কাছে বসে হালকা করে পায়ের আঙ্গুলগুলো টেনে দিতে লাগলো। 

-মায়রা? তুমি না খেয়ে চলে এলে কেন?

-উফফ। আস্তে! মা জেগে যাবে তো? আর খিদে লাগে নি এখনো। লাগলে খেয়ে নিবো---।

-রাতের কয়টা বাজে? খিদে লাগে নি মানেটা কি?

-উফফফ! এই লোকটাকে নিয়ে যে কি করি আমি? তোমার কাল অফিস আছে না? যাও গিয়ে ঘুমাও---। এতো রাত হলো তুমি এখনো জেগে বসে আছো কেন?

-আমি কি বলি আর তুমি কি বলো?

-কিছু বলতে হবে না জনাব। আপনি ঘুমান--। যান?

-জি ম্যাডাম যাচ্ছি---।

আয়ান রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মায়রাও আবার শাশুড়ির মাথার কাছে বসে কপালে হাত দিয়ে জ্বরটা চেক করলো। জ্বর এখনো কমে নি দেখে আবার জলপট্টি দেয়া শুরু করলো মায়রা। স্যালাইন পুরোটা এখনো শেষ হয়েছে কিনা সেটাও একবার চেক করতে ভুললো না। কিছুক্ষণ পরে আয়ানকে চেয়ার টেনে পাশে বসতে থেকে মায়রা খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। এতোক্ষণ ধরে মুখ নিচু শাশুড়ির মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিলো বলে আয়ানের আসাটা খেয়ালই করেনি মায়রা৷ আয়ানের হাতে খাবার ভর্তি প্লেটটা দেখে আরো কয়েক গুণ অবাক হলো মায়রা। আয়ান মিষ্টি করে একটু হেসে মায়রার মুখের সামনে এক লোকমা খাবার তুলে ধরলো। 

-আমি তোমার মতো সুন্দর করে খাইয়ে দিতে পারি না। তবে মনে হয় তোমার আমার হাতে খেতে তেমন অসুবিধা হবে না। আর খাবো না বলে বায়না করবা না। জানো তো তুমি না বললেও আমি শুনবো না। সো? এখন লক্ষী মেয়ের মতো হা করো তো মায়ু?

আয়ানের কথাগুলো শুনে মায়রা হেসে ফেললো। কোনো তর্ক করেনি বলে আয়ান কোনো ঝামেলা ছাড়াই মায়রাকে খাইয়ে দিচ্ছে। আর মায়রা নিজের কাজ করছে। মায়রাকে খাইয়ে দেয়া শেষ হলে আয়ান মায়রার মুখ মুছিয়ে দিয়ে আলতো করে মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে প্লেট রাখতে নিচে চলে গেল। আবার এসে মায়রার পাশে চেয়ারে অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে আয়ানের হালকা ঝিমুনি আসতে শুরু হয়েছে। মায়রা সেটা খেয়াল করে আয়ানের কাঁধে হাত রাখলো। আয়ানও চমকে মায়রার দিকে তাকালো।

-কিছু লাগবে মায়রা? 

-না গো। তুমি অনেক টায়ার্ড। প্লিজ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো না?

-আরে নাহ! আমি একদমই টায়ার্ড না। আর ঘুমও পায় নি এখনো। ঘুম পেলে----। 

-সারাদিন তো অফিসে কাজ করেছ। টায়ার্ড না হলেও ঘুমাও যাও? কালও অফিস আছে তো তোমার। এভাবে রাত জাগা ঠিক না।

-কাল অফিসে না গেলে কিছু হবে না। আমি স্যারকে বলে ছুটি নিয়ে নিবো। আর একদিন রাত জাগলে কিছু হয়না।

-আমি থাকতে তুমি রাত জাগবা কেন? যাও চুপচাপ ঘুমাও?

-উহুঁ না। সারাদিন তো আমি একা কাজ করি নি। তুমিও করেছ। রাত জাগলে তো তোমারও শরীর খারাপ হতে পারে। তাই না? তারচেয়ে বরং তুমি ঘুমাও। আমার ঘুম পেলে আমি তোমাকে ডেকে দিবো। কেমন?

-মেয়েদের রাত জাগলে শরীর খারাপ হয় না। 

-আজাইরা থিউরি দিবা না তো মায়রা। আর তাছাড়া আমার মায়ের সেবা আমার করা উচিত। তাই আমি রাত জেগে এখন মায়ের সেবা করবো। তুমি ঘুমাও যাও---।

-তুমি না বলেছিলে যা তোমার তা ই আমার? সুতরাং আপনার সাথে বিয়ের সাথে সাথে আপনার মা আমার মা হয়ে গেছে। তাহলে এখন দেখা যাচ্ছে আমি আমার মায়ের সেবা করতে চাইছি। আর মাঝখান থেকে আমাকে বিরক্ত করছেন। এসব কিন্তু ঠিক না জনাব।

-বেশি পাকা কথা শিখেছ না? বলছি না ঘুমাও তুমি? আমার ঘুম পেলে তোমাকে ডেকে দিবো তো বাবা?

-আমারও এখন ঘুম পায়নি। হুহ। আমার ঘুম পেলে তখন দেখবো নি। তুমি যাও তো এখন?

-তোমাকে ছাড়া যে আমারও ঘুম আসে না গো পরী৷ তুমি বুকে থাকলে শান্তিতে ঘুম এসে যায়।

-খারাপ একটা! রুমে না গেলে তুমি এখন গিয়ে চুপচাপ ওই সোফাটায় শুয়ে থাকো। এখানে চেয়ারে বেশিক্ষণ বসে থাকলে কোমড়ে ব্যথা করবে৷ যাও?

-জো হুকুম মহারাণী। 

আয়ান মায়রার কপালে আলতো করে একটা চুমো এঁকে দিয়ে গিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। আর দেখতে দেখতে ক্লান্তিতে একসময় ঘুমিয়েও গেল। মায়রাও একমনে নিজের কাজ করতে লাগলো। আরো কিছুক্ষণ পর স্যালাইনটা শেষ হয়ে গেছে দেখে মায়রা শাশুড়ির হাত থেকে স্যালাইনের সুঁই খুলে সেখানে ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো। মাথায় আরো কিছুক্ষণ জলপট্টি দেয়ার পর শাশুড়ির জ্বরটা কমেছে বুঝতে পেরে মায়রা শাশুড়ির মুখটা একবার ভেজা রুমাল দিয়ে মুছে দিতে গিয়ে দেখলো শাশুড়ির চোখের কোণাটা খানিকটা ভিজে আছে। মায়রা পরম স্নেহে শাশুড়ির চোখ মুখ ভিজে রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে শুকনো টাওয়াল দিয়ে মুছে দিয়ে শাশুড়ির মাথার কাছে হেলান দিয়ে বসে থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। শাশুড়ির চোখের কোণের পানির রহস্যটুকু মায়রা জানতেও পারলো না।

৬০!! 

আয়ান ঘুমের ঘোরে হাত বাড়িয়ে মায়রাকে ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু হাতটা বাড়িয়েই আয়ান বুঝতে পারলো পাশে কেউ নেই। আর ব্যাপারটা টের পেতেই আয়ানের ঘুমটা ছুটে গেল। চোখ খুলতেই মায়রাকে মায়ের বিছানায় হেলান দিয়ে থাকতে দেখে গতকাল রাতের পুরো ব্যাপারটা মনে পড়লো আয়ানের। আর মনে পড়তেই আয়ান তাড়াহুড়ো করে সোফা ছেড়ে মায়রার সামনে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটা মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই খাটে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে গেছে। আয়ানের নিজের উপরই প্রচন্ড রাগ লাগছে। ও নিজে আয়েশ করে ঘুমিয়েছে আর মেয়েটা সারা রাত এভাবেই বসে কাটিয়ে দিয়েছে। আয়ান হাত বাড়িয়ে মায়রার গালে হাত ছুঁইয়ে দিতে গিয়ে থেমে গেল। পাগলীটার ঘুম ভাঙ্গলেই তো আবার ছুটতে শুরু করবে। কথাটা ভাবতেই আয়ানের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। একটু সাবধানে এগিয়ে গিয়ে মায়ের কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বরটা এখন নেই একদম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে সাতটা বাজে। আয়ান কিছু একটা ভেবে মায়রাকে আর না ডেকেই নিজেদের রুমে চলে এলো। 

দশ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো আয়ান। অবশ্য আসার আগে মায়ের রুমে উঁকি দিয়ে একবার দেখে নিতেও ভুললো না আয়ান। মেয়েটাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আয়ানের ভালোও লাগছে না। কিন্তু এই পাগলিটাকে এখন ডাকলেই ও এখন নাস্তা বানাতে ছুটবে। তাই মায়রাকে না ডেকেই নাস্তায় কি বানানো যায় সেটাই ভাবছে আয়ান। কিন্তু কি বানাবে সেটাই বুঝতে পারলো না বেচারা। রান্নাঘরটা খুঁজে ডিম, পাউরুটি, ফল পেয়ে গেল। তাই আপাতত এগুলো নিয়েই কাজে লেগে গেল আয়ান। একেবারে কিছু না বানানোর চেয়ে কিছু একটা বানিয়ে যদি মেয়েটার কাজ কিছুটা কমাতে পারে আর কি। এসব ভেবে আয়ান কয়েক পিস পাউরুটিকে টোস্ট করে নিলো। আর দুটো ডিম পোচ করে প্লেটে তুলে রাখলো। তারপর একটা বাটিতে কয়েকটা আপেল ছোট ছোট টুকরো করে কেটে রাখলো। কয়েকটা কমলা দু টুকরো করে কেটে নিয়ে সেটা দিয়ে ফ্রেশ অরেঞ্জ জুসও বানিয়ে গ্লাসে ঢেলে নিলো। আপাতত নাস্তা রেডি। ট্রে তে করে নাস্তার প্লেট, বাটি, গ্লাস নিয়ে ডাইনিং রুমে রেখে উপরে আসতেই মায়রার সাথে দেখা হয়ে গেল আয়ানের। মেয়েটার ভেজা মুখটা দেখে মনেই হচ্ছে না রাত জেগেছে। দিনের স্নিগ্ধ আলোয় অন্যরকম একটা পবিত্রতা যেন ফুটে উঠেছে মায়রার চোখে মুখে। 

-আরে? এভাবে পথ আটকে দাঁড়িয়ে হা করে তাকিয়ে কি দেখো? সরো? মায়ের জ্বরটা এখন নেই। তাই শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। তুমি গিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসো একটু। আমি নাস্তা বানিয়ে ফেলি ততক্ষণে------।

-মায়ের এখনই ঘুম ভাঙ্গবে না। তুমি এসো আমার সাথে----।

-আরে! কোথায় যাবো? মা রুমে একা আছে আয়ান----।

-শশশশ। দুইটা মিনিট চুপ করে থাকো না বাবা। এসো আমার সাথে?

মায়রা আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ আয়ানের সাথে ডাইনিং রুমে এলো। আর ডাইনিং টেবিলের সামনে এসেই মায়রার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ট্রে তে খাবারগুলো দেখে মায়রা একবার খাবারগুলোর দিকে তাকাচ্ছে আর একবার আয়ানের দিকে। মেয়েটা এতোটা অবাক হয়ে গেছে যে একটা কথাও বলতে পারছে না। আয়ান সেটা বুঝতে পেরেই মায়রাকে টেনে নিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজে পাশের একটা চেয়ার টেনে বসলো। মায়রা বিস্ময়ের প্রথম ধাপটা কাটিয়ে উঠে আবার আয়ানের দিকে তাকালো। আয়ান ততক্ষণে একটা প্লেটে মায়রার জন্য খাবার সার্ভ করে নিয়েছে। আয়ান টোস্টে সামান্য বাটার লাগিয়ে মায়রার মুখের সামনে ধরতেই মায়রা আয়ানের হাতটা ধরে ফেললো। 

-আরে? খাও না কেন? হা করো তো দেখি?

-আয়ান? এগুলো! এগুলো কে করলো?

-কেন? আমাকে কি চোখে পড়ে না ম্যাডাম? আমি এতো কষ্ট করে তার জন্য নাস্তা বানালাম, আর সে বলে কিনা কে করেছে--। হুহ।

-আরে! তুমি এতো কিছু করতে গেলে কেন? আমাকে ডেকে দিলেই তো পারতে---। 

-তুমি যে সারাটা রাত জেগে ছিলে? তুমিও তো আমাকে একবার ডেকে দিতে পারতে? তাহলে?

-উফ! কিসের সাথে কি?

-হুম। এখন তো এসব বলবাই তুমি। এখন দেখি হা করো তো? খেয়ে বলো তো কেমন হয়েছে। খারাপ হলেও কিছু করার নেই। এই প্রথমবার বানালাম। কিছু কম বেশ হলে সরি--।

-তুমি আমার জন্য-------?

-আরে হ্যাঁ রে বাবা। এখন খেয়ে বলো না কেমন হয়েছে?

-সে কি? মা কি খাবে সে ব্যবস্থা করতে হবে তো? এক্ষুণি তো উঠে যাবে----।

-উফফ। মেয়েটা এতো নাচানাচি করে কেন? মা এতো তাড়াতাড়ি উঠবে না। চুপচাপ বসে খাও। মায়ের জন্যও টোস্ট, ডিম পোচ আর জুস আছে। 

-মা এসব খেয়ে ওষুধ খাবে?

-আমমম। সেসব তুমি খেতে খেতেই ভাবো নাহয়। হা করো?

আয়ান যত্ন করে মায়রাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর মায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা কিছু না বলেই চুপচাপ খাচ্ছে। আয়ানের মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল। মনে হলো হয়তো ভালো হয়নি বলে মায়রা কিছু বলছে না। আয়ানের মুখটা দেখে মায়রা আর হাসি চাপতে পারলো না। জোরেই হেসে ফেললো। আয়ান মায়রার দিকে তাকাতেই মায়রা এবারে খিলখিল করে হেসে ফেললো। আয়ানের ভ্রু জোড়া এবারে কুঁচকে গেল খানিকটা। 

-কি হলো? পাগলের মতো হাসছ কেন এভাবে?

-তোমার করুণ মুখটা দেখে---। হি হি।

-খাবারটা ভালো হয়নি জানি। থাক আর খেতে হবে না। আমি তো আগেই বললাম প্রথমবার করেছি--।

-কি! না না। হবে না। আমি খাবো?

-হুম। কি?

-অসম্ভব মজা হয়েছে খাবারগুলো। এর চেয়ে টেস্টি নাস্তা আমি কক্খনো খাই নি বিশ্বাস করো।

-জানি জানি। আমার মন রাখার জন্য বলছ এসব। 

-তুমিও খাও না? আসলেই অনেক ভালো হয়েছে নাস্তা। সো ইয়াম্মি! আর তুমি এতো ভালোবেসে বানালে মজা না হয়ে পারে বলো?

-হয়েছে হয়েছে? খাও তাহলে---।

আয়ান একটু লাজুক হেসে মায়রাকে খাইয়ে দিল। মায়রাও আয়ানকে খাইয়ে দিল। জুসটা খাওয়া শেষ হলে আয়ান মায়রার মুখটা মুছিয়ে দিল। মায়রা মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে নিজের কাজে লেগে পড়লো। আয়ান কিছুক্ষণ মায়রাকে দেখে হুট করে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। এভাবে হঠাৎ ধরায় মায়রা একটু কেঁপে উঠলো। 

-আরে? কি করছ কি তুমি? পাগল হয়েছ?

-হুম---। পাগল তো হয়েছি তোমার প্রেমে গো চাঁদপরী----।

-এই অবস্থাতেও এতো রোমান্স তোমার কি করে আসে আমি বুঝি না বাপু---।

-তুমি বুঝবা কি করে? আনরোমান্টিক বউ একটা জুটেছে কপালে---।

-এই কি বললা তুমি? কি বললা আবার বলো?

-কই? কি বললাম? কিচ্ছু বলি নি বউসোনা। সত্যি---।

-আমি যেন কানে শুনি না। হুহ।

-শুনই তো না। তাহলে তো এতোক্ষণে আমার বুকের মধ্যে কি চলছে সেটা জানতে পারতে। সারাটা রাত তোমার শূন্যতায় বুকটা যে হু হু করেছে সেটা তো বুঝবা না--। 

-ইশ! তাই বুঝি জনাব?

-হ্যাঁ গো বউসোনা।

-মা যে রুমে একা আছে সেই খেয়াল আছে জনাবের? এখনও বুঝি তার দুষ্টুমি করতেই হবে?

-হুমমমমম। বুঝলাম। আজ আর কপালে কিছু জুটবে না। কি কপাল কি কপাল!

-অসভ্য একটা লোক! নাস্তা করা হয়ে গেছে তোমার? এবার মায়ের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ বসো যাও?

-হুমমমম। কি আর করা! তুমি কি করবা?

-আমি মায়ের জন্য একটু ভেজিটেবল স্যুপ বানাই। তাহলে দুর্বলতাটা একটু কমবে। 

-হুমমম। আর আমার উইকনেসের কি হবে ম্যাডাম?

-কেন? তোমার কি হলো?

-ওই যে বললাম না? তুমি বুকে না থাকলে বুকটা ভিষণ পোড়ে। আর আমার আজ সকালের মিষ্টিটাও পেলাম না এখনো---। কি আর বলবো দুঃখের কথা ম্যাডাম? বউটা আর আগের মতো আমাকে ভালোপায় না গো---।

-দুষ্টু লোক একটা। 

মায়রা আয়ানের দিকে ফিরে ঘুরে চট করে আয়ানের গালে একটা চুমো দিয়ে সরে আসার চেষ্টা করলো। আয়ান মায়রাকে সরে আসতে না দিয়ে নিজের সাথে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

-হয়েছে তো? এবার ছাড়ো না প্লিজ?

-আরে? এমন করো কেন?

-যাও না? মা উঠে পড়বে তো? ছাড়ো না? আমার কাজ আছে তো---।

-পাগলিটা----।

আয়ান আলতো করে মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। তারপর মায়রাকে ছাড়তেই মায়রা একটু লাজুক হেসে আয়ানকে ঠেলে রান্নাঘর থেকে বের করে দিলো।

-হয়েছে এবার যাও। মায়ের কাছে গিয়ে বসো। 

-হুম। আচ্ছা তুমি কাজ করো। আমি যাচ্ছি---।

মায়রা নিজের কাজে মন দিলো। শাশুড়িকে নাস্তা করিয়ে ওষুধ খাওয়াতে হবে সেটাই মায়রার মাথায় ঘুরছে। আর আয়ানও মায়ের রুমে এসে মায়ের আবার জ্বরটা বাড়ছে দেখে জলপট্টি দেয়ায় মন দিলো। জ্বরটা কমার বদলে আরো বাড়ছে দেখে এবারে রীতিমতো ভয় করছে আয়ানের। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না বেচারা। কি হতে চলেছে কে জানে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন