অচেনা অতিথি - পর্ব ০১ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


- মা পরকিয়াতে লিপ্ত ছিল তাই দাদী আর বড় আম্মু মিলে মাকে খুব মারছে। পরকিয়া কি জিনিস এটাই মাথায় আসছে না ছোট্ট "তিতিরের"। দুরে চাচীর কোল থেকেই তিতিরটা কেঁদেই চলছে তার মায়ের চিৎকার শুনে। চোখের পাপড়ি ভেদ করে ছোট্ট ছোট্ট মুক্তার মত পানি পড়ে যাচ্ছে দু'চোখ দিয়ে।

.

- তোর স্বামী থাকা সত্বেও কোন নাগরের পিরিতে মজেছিস মাগী বলে আরও কয়েকটা হোঁচনা দিল তিতিরের মাকে ওর দাদী।

মরতে পারিস না! ছেলেটা আমার বিদেশ খাটে আর তুই পায়ের উপর পা তুলে ফস্টিনষ্টি শুরু করে দিছিস?

হাবিব এরশাদ রে ফোন দে তো বাপ। তার সখের বৌ কি করে বেরাচ্ছে সেটা ওর তো জানা উচিত।

.

- আম্মা ওরে ছেড়ে দেন বলে হাবিব দৌড়ে এসে মনুজান বিবিরে জোড় করে দুরে সরে নিয়ে আসে। তোমরা ওকে এভাবে মারলে তো ও মরে যাবে। এদিকে তিতিরের মা "রুবিনার" অবস্থা খুবই খারাপ। রক্ত বমি করতে শুরু করে দিছে।

.

- রুবিনার দেবর শামীম তাড়াহুড়া করে ডাক্তার ডাকতে গেল। প্রায় আধাঘন্টার পর একটা গ্রাম্য ডাক্তার নিয়ে হাজির হল।

ডাক্তার সাহেব রুবিনাকে দেখে শিউরে উঠল। এই তোরা মানুষ! কেউ কাউকে এভাবে ধরে মারে? এখন যদি এর কিছু হয়ে যায় তাহলে ওর বাবা মা তোদের অবস্থা কি করবে ভেবেছিস? আহাহা না জানি কতটা কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। মা বলতো তোমার কি কি সমস্যা হচ্ছে ? রুবিনার সেন্স থাকলে তো কিছু বলবে!

.

- এই মেয়ে মানুষের বুদ্ধি সব সময় হাটুর নিচে থাকে। আম্মা মারছেন ঠিক আছে তাই বলে এভাবে মারবেন? এখন কি হবে? (হাবিব)

.

- ডাক্তার কিছু ঔষুধ, স্যালাইন এবং ইনজেকশন হাতে পুশ করে দিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল হাবিব আল্লাহ্ রে ডাকো। মাইয়াটার অবস্থা ভাল ঠেঁকছেনা। গ্রামের চেয়ারম্যান রে খবর দিয়ে রাইখো আগে থেকেই। আমার যা পরামর্শ দেওয়ার কথা আমি দিছি। বাঁকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।


- ও দাদী আমি আম্মুর কাছে যাবো। তোমরা ভাল না। আমার আম্মুরে তোমরাই মারছো। আমি এখানে থাকবোনা। আব্বু এলে আব্বুরে সব বলে দিব। তোমরা কেমন করে আম্মুরে মারছো বলে ফিকরাতে লাগল তিতির।

.

- ছোট্ট তিতিরের কান্না দেখে মনুজান বিবিও ডুকরে কেঁদে উঠল। এত্ত সুন্দর পুতলের মত মাইয়া রাইখা কেউ অন্য মরদের লগে নষ্টামি করে! কতবার এরশাদরে কইছি এই মাইডারে বিয়া করিস না বাপ। এহন শুধু এই ছোড মাইডা ভাসবো। মাইডার কপালে আর বুজি সুখ নাই। তোর মায়ের জন্যই তুই ভাঁসবি।


- রাত ৯ টার দিকে রুবিনার সেন্স ফিরলো। চোখ দুটি মেলে শুধু মেয়েকেই খুঁজছে। বড় জা বলে উঠল কারে খুঁজিস! যারে খুজোস তারে আর পাবিনা। সকালে উঠেই বাপের বাড়ী ঘাটা ধর।

.

- ভাবী "তিতির" কই! আমার মেয়েটারে একটু এনে দেন না আমার কাছে। ও কি খাইছে?

.

- তোর লজ্জা করে না! সব শেষ করে দিয়ে এখন মাইয়ার চিন্তা করোস। চোখে থুতা দিয়ে কান্দা বন্ধ কর। এরশাদ তোর জন্য বিদেশ খাটতে গেছে আর তুই কি করছোস? শেষে কিনা পরকিয়া! ছিহ্ঃ মরতে পারলিনা মাগী। বেশি পাওয়া হয়ে গেছে তাই গতরে ত্যাল ধরছে তাইনা! তোর ত্যাল বের করছি দ্বারা! আজই এরশাদ রে সব কিছু খুলে বলমু। তারপর তোর চেটাং চেটাং কথা কই থ্যাইকা ব্যাড় হয় সেটাও দেখমু।

.

- ভাবী যা ভুল করার আমি করছি। তিতিরের আব্বুরে কিছু বলেন না বলেই রুবিনা ওর জায়ের পা জড়িয়ে ধরল । আমারে মাফ করে দেন ভাবী। আমার দ্বারা অনেক বড় অন্যায় হয়ে গেছে। আপনারা যা বলবেন তাই শুনবো তবুও এমন ভাবে আমায় শাস্তি দিয়েন না।

.

- আগে হুস ছিলনা! কুত্তার লাজ কোন দিনও সোজা হয়না। সব সময় ব্যাঁকাই থাকে। তাই তুইও কোন দিন সোজা হবিনা। তোর মুখের ব্যাড় কি কম ছিল! কম জ্বালাইছোস আমাদের! পা ছাড় বলেই মর্জিনা বেগম চলে গেলেন।


- সকাল ৭ টা বাজতেই মনুজান বিবি রুবিনার ঘরে এসে চুলের মুঠি ধরে বের করল ঘর থেকে। এখুনি বাইর হ ঘর থেকে। তোর বাপরে আর এরশাদ রে কালই কল দিয়ে সব বলছি। এখন দুই পরিবার মিলে তোদের তালাকের ব্যবস্থা করা হবে। যা এখুনি বাড়ি থাইকা।

.

- আম্মা তিতির কই! কাল থেকে মেয়েটারে দেখি নাই। আমি ভুল করছি তাই বলে আমার অবুঝ মেয়েটারে আমার কাছ থেকে দুর করেন না।

রুবিনার কাকুতি মিনতি কারো কানে যায় না। মনুজান বিবি সহ সবার হাত-পা ধরল তাও কাজ হলনা। তাদের একটাই কথা এ বাসায় তার আর জায়গা হবে না।

রুবিনা বাধ্য হয়ে বাবার বাসায় রওনা দিল। কারন সে নিজেও ভালো করে জানে কতটা ভুল সে করেছে। কাল ছিল রানীর হালে আর আজ তার কি হল। সাপের লিখন আর বাঘের দেখন কখনও বিফলে যায়না।


- রুবিনার বাবা রুবিনার মায়েরে ধরে আচ্ছামত বকা দিচ্ছে। মা ভাল হলে তো বেটি ভালো হবে। ও যদি আজ বাড়িতে ঢোকে তাহলে তোদের মা-মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দিব। গ্রামের মানুষের কাছে মুখ দেখাবো ক্যামনে। এই কথাটা শোনার আগে আমার মরন হল না কেন?

.

- রুবিনার মা শুধু ঝুপ ঝুপ করে চোখের পানি ফেলছে। কাল থেকে খবরটা শোনার পর থেকে বাসার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সকাল থেকে চুলা অবদি জ্বলেনি। রুবিনার বড় ভাই তোফাজ্জল চুপ করে বারান্দায় বসে আছে। বৌ কয়েকবার কথা বলতে আসছিল কিন্তু স্বামীর রুক্ষ চোখে তাকেও চুপ করে দিছে। কারোই জানা নাই আজ কি হতে চলেছে।


- সকাল ১০ টার দিকে রুবিনা বাবার বাসায় কেবল উঠানে এসে দাড়াইছে এমন সময় তোফাজ্জল কোথা থেকে একটি খড়ির চলা এনেই রুবিনাকে এলো পাথারি মারতে লাগল। মানসম্মান সব শেষ করে এসে এখানে আসছিস? রাস্তায় আক্সিডেন্ট করে তোর মরন হলো না! ৭ দিন কান্নাকাটি করে চুপ করে থাকতাম। এভাবে তো আর সম্মান নষ্ট হত না আমাদের।

.

- ভাইয়া আর মাইরেন না আমি সহ্য করতে পারছি না। আর কত মারবেন বলে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগল রুবিনা।

কিন্তু কে কার কথা শোনে তোফাজ্জলের মুখ আর হাত সমান ভাবে চলছেই।

.

- মাইয়াটারে মেরে ফেলবি বলেই রুবিনার মা এসে তোফাজ্জল কে আটকায়।

এমনি গতকাল মাইর খাইছে রুবিনা তারপর আজ এমন মাইর আবার। রুবিনা যেন নাজেহাল হয়ে পড়ল। উঠান থেকে উঠার মত শক্তি আর রইলনা।

রুবিনার মা আর ভাবি ধরে ওকে ঘরের মধ্য নিয়ে গেল।


- মা আমার ভুল হয়ে গেছে। এমন কাজ কখনো করবো না শুধু তিতিরটাকে আমার কাছে এনে দাও। ওকে ছাড়া যে আমি থাকতে পারছিনা বলে বিলাপ করে কাঁদতে লাগল রুবিনা।


- তোফাজ্জলের মা ওরে ঘরের ভিতর তুললি ক্যান! আজ যদি ওরে বাড়ি থেকে বের করে না দিস তাহলে তোরে সুদ্ধু বিদায় করবো বলে রাগে কাঁপতে কাঁপতে রুবিনার বাবা এসে বান্দায় উঠতেই তোফাজ্জলের বৌ দরজা বন্ধ করে দিল যাতে শশুর ঘরের ভিতর আর না ঢুকতে পারে।


এভাবে আরও ৩ টা দিন কেটে গেল। ওদের সাথে অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করে কিন্তু কোন লাভ হয় না। এরশাদ কেও অনেকবার রিং দেওয়া হল কিন্তু কাজ হলনা। তিতিরটা কেমন আছে সেটাও জানা সম্ভব হচ্ছেনা।

রুবিনা বাধ্য হয়ে ওর বড় ননদের বাসায় রওনা দেয়। দেখি আপাকে বুঝিয়ে কিছু করা যায় কিনা! আপার কথাতো সবাই শোনে।

এই ক'দিনে বাবা বা বড় ভাই কেউ কথা বলেনা রুবিনার সাথে। বিকেলে রুবিনা বাসা থেকে বের হয় ননদের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্য কিন্তু পথি মধ্য এরশাদের কল আসে।

রুবিনা কিছুটা স্বস্তি পেয়ে কল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই এরশাদ বলে উঠল কই যাচ্ছিস?

এবার রুবিনা থতমত খেয়ে বলল তুমি কিভাবে জানলা আমি বাসা হতে বের হয়েছি?

.

- তোর মা ফোন দিয়ে বলল। কোথায় যাচ্ছিস সেটা বল। (এরশাদ)

.

- আপার বাসায় যাচ্ছি।(রুবিনা)

.

- মরতে পারিস না বেলজ্জাহীন ! আপার বাসায় যদি যাস তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না। তোর নিজের বাসায় ফিরে যা বলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এরশাদ।

.

- রুবিনা ফোন কেটে দিয়েই বাসায় ফিরে এসে কাঁদতে কাঁদতে ঘরের দরজা লেগে দিল। অনেক্ষন কান্না করল তারপর ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত্যুকে বরন করে নিল। নিজের ছোট্ট মেয়েটার কথা ভাবার মত একবারও সময় হল না তার। মা ছাড়া একটা শিশুর জন্য পৃথিবীটা যে কতটা কষ্টকর সেটা একবারও ভাবল না রুবিনা। একটু ধৈর্য্য ধরলে হয়ত সব সমস্যা সমাধান হয়ে যেত।


- অনেকক্ষন ধরে রুবিনার রুমে দরজা না খোলা দেখে রুবিনার মা দরজা ধাক্কাতে লাগল। একে একে পাড়ার সবাই এসে উঠানে জড় হল। বাড়িতে রুবিনার বাবা আর ভাই ছিলনা বলে প্রতিবেশি দু'জন ছেলে মানুষ দরজা ভেঙ্গে ফেলল। ততক্ষনে রুবিনা পরপারে। রুবিনা নিজে শেষ হল আর মেয়েটার জিবনও দুনিয়ার নরকে বসবাস করার জন্য ব্যবস্থা করে দিল।

লাশ নিয়ে দু'পরিবারে অনেক কথা কাটাকাটি হয়ে যায়। অবশেষে দুই পরিবারের মিমাংসায় রুবিনার দাফন কার্য সমাধান হয়ে যায়।


- বাসার সবাই কান্নাকাটি করছে। ছোট্ট তিতির বুঝতেই পারছেনা তার মা পৃথিবীতে আর নাই। দাদীর কান্না দেখে তিতিরও কাঁদছে কিন্তু বুঝতে পারছেনা মা নামক অমূল্য ধন তার জিবনে আর নাই। সে জানেনা তার ছোট্ট মনে কত আঘাত অপেক্ষা করে আসছে। যার নিজের মা ই ভাবলনা তার বাচ্চার পরবর্তী জিবন তাকে ছাড়া কতটা কষ্টকর হবে সেখানে অন্য কারো ভাবার একদমও সময় হওয়ার কথা নয়।


- তিতির ওর দাদা- দাদীর কাছে থাকতে লাগল। মোটামুটি ভালয় জিবন কাটছিল। এভাবে আরও ৩ মাস কেটে যায় এর পর এরশাদ দেশে ফিরে আসে। ছোট্ট তিতিরকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করে। তার ২ মাসের মাথায় এরশাদ আদরী নামে এক ডির্ভোস প্রাপ্ত মেয়েকে বিয়ে করে বাসায় আনে। তারপর থেকে নেমে আসে তিতিরের জিবনে অন্ধকার। ওর সৎ মা মিশতে দেয়না কারো সাথে। এমনকি নিজের দাদা-দাদি বা পাড়া প্রতিবেশি কারো সাথে না। রুমের ভিতর একা-একাই কাটাতে লাগল তার জিবন। যেখানে ছোট্ট শিশুদের খেলাধুলা করার সময় তখন তিতির বাসায় বন্দী জিবন কাটাতে লাগল দিনের পর দিন। এরশাদও হয়ে গেল আদরীর হুকুমের গোলাম। ন্যায় বিচার বলে তার কোন বিবেকই নাই।


- একদিন তিতির লুকিয়ে বড় আব্বুর বাসায় যায় আর সেই কথা এক প্রতিবেশি ওর সৎ মাকে বলে দেয় যে তিতির ওর চাচার বাসায় গেছে।

.

- কথাটি শুনে আদরী প্রচন্ড রেগে যায়। বাসার গেটের সামনে দাড়িয়ে তিতির বলে কয়েকটা ডাক দিতেই তিতির দৌড়ে এসে হাজির হয় ওর মার কাছে। ভয়ে চোখমুখ শুকিয়ে যায়। বাসার ভিতর গেলেই মায়ের হাতে মাইর খাইতে হবে।

.

- চুলের ঝুটি ধরে টেনে হিঁচরে তিতিরকে বাসার ভিতর নিয়ে গেল আদরী। তিতিরের দাদি কয়েকটা কথা বলতে যেতেই সবার সামনে মুখের উপর গেট লেগে দেয় আদরী। বাসায় এসে তিতিরকে অনেক মারধোর করে।

.

- তিতির কান্না করতে করতে বিষম উঠে যায়। কান্নার চোটে মুখের লালা পড়তে লাগে। আদরী তিতিরে মুখ চিঁপে ধরে বলল এই চুপ করবি না আরো মাইর খাবি বলে আরও কয়েটা থাপ্পড় মারল তিতির কে। তিতিরের বাবা ততদিনে আদরীর গোলাম হয়ে গেছে।

.

- এরশাদ এসে আদরীকে বলল কি হয়েছে ওকে মারছো কেন?

.

- সাধে কি আর মারি আমি! তোমার মেয়ে আমাদের শত্রুর বাসায় গিয়ে ভাত গিলছে। এত বিশাল বাসা দিয়েও ওর হয়না। ওর সাহস হয় কিভাবে! ও আমাদের শত্রুর বাসায় যায়?

.

- এরশাদ ছোট্ট তিতিরের হাত ধরে গেটের সামনে নিয়ে এসে সবাইকে শুনিয়ে বলল ওকে আরো মারো। যাতে জন্মের মত ঐ বাসায় যাওয়ার কথা ভুলে যায় বলেই রুমের ভিতর চলে গেল। আদরীকে আর পায় কে। কর্তা হুকুম দিছে বলে ইচ্ছামত তিতিরকে মারতে লাগল। তিতিরের কান্নার শব্দে আশেপাশের মানুষ পর্যন্ত কেঁদে উঠল। শেষে পাশের বাসার এক মুরুব্বি মহিলা এসে চিৎকার করে বলে উঠল এরশাদ তুই বাপ হয়ে মা মরা মাইয়াটারে মাইর খাওয়াচ্ছিস? তুই কি মানুষ না পশু? মেয়েটারে ভাল না লাগলে এতিম খানায় দিয়ে আয়। তাও মেয়েটা একটু মারের হাত থেকে বাঁচবে।

.

- আরো কয়েকজন এসে যখন বকাবকি করতে লাগল তখন আদরী থেমে যায় আর তিতিরকে নিয়ে রুমের ভিতর চলে যায়। একজন মেয়ে হয়ে কিভাবে এতটা মনুষত্ব্য হীন হয় সেটা আদরীকে না দেখলে কেউ কল্পনাও করতে পারবেনা।

.

- এরশাদের সাথে ওর বাবা মা ভাইবোন সহ সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। এভাবে ২ বছর কেটে গেল। আদরী একটা ছেলে সন্তানের জন্ম দেয়। ছেলে বুকের দুধ পায়না বলে ১ লিটার প্রতিদিন গরুর দুধ নেওয়া হলেও তিতিরের মুখে কোনদিনও এক ফোঁটা দুধ খাওয়ার ভাগ্যও জোটেনা। মা বেঁচে থাকতে যতগুলো শীতের পোশাক কিনে দিয়েছিল সেগুলোই এই বছরগুলো ব্যবহার করেছে।

.

- একদিন তিতির এসে ঘুমিয়েছে এমন সময় আদরী এসে তিতিরকে টেনে তুলে বলল তোর আর একটা কানের দুল কোথায়!

.

- তিতির ভয়ে কানে হাত দিয়ে দেখে সত্যি দুল নেই। ঘুমানোর আগেও দেখেছিল দুল ছিল তাহলে কই গেল বলেই বিছানায় খুঁজতে লাগল কিন্তু বিছানায় থাকলে তো পাবে?

.

- আদরী রেগে গিয়েই চড় মারতে শুরু করল তিতির কে। বল কই হারাইছিস দুলটা। বাপের বিশাল টাকশাল আসছে যে আজ দুল হারাবি কাল আবার কিনে দিব।

.

- মা আমি জানিনা। কিভাবে কোথায় পড়ে গেছে বলেই নিঃশব্দে কেঁদেই চলছে। তিতিরটাও শিখে গেছে মা মারলে জোরে শব্দ করে কাঁদতে নেই। শব্দ বাহিরে গেলেই ডাবল মাইর।

.

- আদরী অন্য দুলটাও খুলে নিয়ে চলে গেল। অপায়া মেয়ে কোথাকার সারাদিন কাজ নাই কাম নাই শুধু অকাম করে বেড়াবে।


- এরশাদ একবারে বিদেশ থেকে চলে এসেছে। গ্রামে ২ তলা বাসা করেছে। বউকে নিয়ে খুব সুখেই আছে এরশাদ তার উপর একটা ছেলে হয়েছে। এরশাদের খুঁশি আর ধরে না। শুধু সুখে নাই তিতিরটা।


- তিতিরটা কবে থেকে যে বাবার সাথে খাবার খায়নি সেটা ওর নিজেরই মনে নাই। আজ বাবার সাথে একটু খাবার খাবে তাই অপেক্ষা করছে তিতির। বাবা হাটে গেছে। এশার আযানের পর আসবে। তাই তিতির চুপ করে বসে আছে।


- কি রে বসে আছিস কেন! ভাত গিল..........


- আব্বু আসুক আব্বুর সাথে খাবার খাবো আম্মু। একটু পর খাই!


- চুপপপ....... । যা খাবার দিচ্ছি তাই গিলে উপরে গিয়ে সুয়ে পর। বাবারে যদি কিছু বলছিস তাহলে তোর লল্লির উপর পা তুলে দিব। যা খেয়ে নে বলে আদরী চলে যায়।


- তিতিরটা না খেয়েই উপরে এসে সুয়ে পড়ে। আম্মু তুমি কেন আমাকে ছেড়ে গেলে। আব্বু আমার খোঁজও নেয়না। এরা খুব খারাপ বলে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। শব্দ করে কান্না করাটাও আজ তিতির ভুলে গেছে। ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে তিতির।


- এরশাদ রাত সাড়ে আটটার দিকে বাসায় ফিরে বাজারের ব্যাগটা আদরীর হাতে দিয়ে ওয়াস রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে খাবার খেতে বসল।

আদরী তিতির কই! ও কি খেয়েছে?


- ছোট মেয়ে আর কতক্ষন জেগে থাকবে! তাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি খেয়ে নাও বলে আদরী এরশাদের প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজের জন্যও বাড়ল। আদরী বুঝতে পারল তিতির খায়নি। কারন যেরকম খাবার রাখা হয়েছিল ততটুকুই আছে ওমন ভাবে। কিন্তু এতে আদরীর যায় আসেনা। ঠিকিই এরশাদের সাথে পেট পুরে খেয়ে ঘুমাতে গেল।


- এরশাদ কেমন বাবা যে নিজের মেয়ে খেল কি খেলনা তার কোন খোঁজ রাখল না। আদরী যা বলল তাই বিশ্বাস করলো। এরশাদ কি তিতিরকে গিয়ে ডেকে তুলে নিজের সাথে নিয়ে আসতে পারতো না!

বলতে কি পারতো না মা যা খেয়েছ.... খেয়েছ আমার সাথে বসে আবার খাও। যতটুকু পারো ততটুকুই খাও। মা মারা যাবার পর বুঝি সব বাবারা এমনই পর হয়ে যায়।


- একদিন মনুজান বিবি এসে তিতিরের হাতে তরকারির বাটি দিয়ে বলল তিতির কি খাস না খাস সেটা তো দেখতে পাইনা। এটা নিয়ে গিয়ে ভাত খা বলে মনুজান শাড়ীর আচল দিয়ে নিজের চোখটা মুছল। নিজের চোখের সামনে কত নির্যাতনের শিকার হইছে তার এই ছোট্ট নাতনীটা। কলিজা ছিড়ে যায় কিন্তু কিছু বলতে পারেনা।


- তিতির তরকারির বাটিটা নিয়ে কেবল বাসায় ঢুকছে এমন সময় আদরী তিতিরের নাম ধরে ডাকতেই তিতির ভয়ে দাড়িয়ে পড়ল।


- হাতে কি দেখি বলেই আদরী তিতিরের কাছে আসল। তরকারির বাটি দেখেই ক্ষেপে গিয়ে বলল এগুলো কে দিছে?


- দাদি দিছে আম্মু।


- তিতিরের হাত থেকে বাটিটা নিয়েই গালে দুটা থাপ্পর দিয়ে আদরী বলল কতবার নিষেধ করেছি বাহিরের জিনিস খাবিনা! কেউ কিছু দিলে নিবি না বলে বাটিটা নিয়ে বাহিরে গেল ফুঁসতে ফুসতে। মনুজানের সামনে দিয়ে বাটির সব তরকারি পুকুরে ফেলে দিয়ে বলল অশিক্ষিতের জাত কোথাকার নিজেদের তো ভাল পরিবেশ নেই এই মেয়েটারেও ওদের মত করে ছাড়বে। আমি একা হয়ে আর কতদিকে সামাল দিব। শয়তানের বাচ্চাটাও কথা শোনেনা। যেদিন কিছু হবে তখন বুঝবে বলে মনুজানের হাতে বাটিটা দিয়ে বলল ভবিষ্যতে তিতির কে যেন এত দরদ না দেখাতে আসে। কে কি করে দিবে আর তার ভোগ আমাকে পোহাতে হবে। তিতির কে আমি যথেষ্ট খাওয়ায় বুঝলেন!


- মনুজান বিবিও কম নয়। মনুজানের এবার মুখ ছুটল।

ম্যাট্রিক পাশ করে নিজেরে শিক্ষিত বলে দাবি করিস ফকিন্নির বাচ্চা। তোর থেকে ঢের শিক্ষিত মানুষ এই গায়ে আছে কিন্তু তোর মত এত খারাপ স্বভাবের নয় তারা। বাড়ানির বাচ্চা এখানে এসে বড়লোকি ভাব দেখাস্! আমার ছেলের খাবি আর আমায় বলবি আমি অশিক্ষিত! মনুজান বেঁচে থাকতেই এত তোর ব্যাড়! আজ এরশাদ আসুক দশ গায়ের মানুষের সামনে তোর বিচার করবো। তিতিরের দাদী দশলোকের সামনে আদরীকে একেবারে ধুয়ে দেয় অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে। আদরী আর মুনুজানের ঝগড়ায় পাড়ার আসেপাশের বাড়ির সবাই এসে জড়ো হল। আরও দুটা বৃদ্ধা মহিলা মনুজানের সাথে যোগ দিল। আদরী না পেরে উঠে বাসার ভিতর এসে তিতির বলে চিৎকার দিয়ে ডেকে উঠল। কুত্তার বাচ্চা শুধু তোর জন্য এত কিছু হয়ে গেল আজ। কিছু বলিনা দেখে সাহস পেয়ে সবার সাথে জোট পাকিয়েছিস! আজ তোর সব জোট ছুটাবো বলে আদরী আশেপাশে বেত খুঁজতে লাগল। হাতের কাছে একটা পেয়েও গেল আর সেটা নিয়ে তিতিরের কাছে গেল।


- এদিকে মায়ের ডাকে ছোট্ট তিতির থরথর করে কাঁপতে লাগল। আজ ওর মা ওকে জান্ত ছেড়ে দিবেনা সেটা ও ভাল করেই বুঝতে পেরেছে। দু'চোখ দিয়ে লেবুর রসের মত টপটপ করে জল পড়েই যাচ্ছে তিতিরের।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন