মায়াবতী (পর্ব ০৬)


১১!! 

সারাটা রাত প্রায় নির্ঘুম কেটেছে রাহাতের। ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করলেই মায়ার করা প্রত্যেকটা পাগলামি চোখের সামনে ভেসে উঠে ঘুমটাকে অসম্ভব করে তুলছে রাহাতের। না চাইতেও মায়ার লাজুক ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শটা বারবার মনের আকাশে উঁকিও দিচ্ছে রাহাতের। মায়ার এই প্রশ্রয়ের হাতছানির পরও রাহাত কিভাবে শান্ত ছিল সেটা শুধু রাহাতই জানে। মায়ার সাথে কথাগুলো তখনই ক্লিয়ার করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল রাহাত। কিন্তু ততক্ষণে মায়াবতী আবার নিজের ঘুমের জগতে হারিয়ে গেছে। এবারে অবশ্য আর একবারও ঘুম ভাঙ্গে নি মেয়েটার। মায়াকে তাই বাসায় পৌঁছে দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি রাহাতের। কিন্তু মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি, কিসের একটা খচখচানি তখন যে শুরু হয়েছে একটা নির্ঘুম রাতের পরেও সেটা কমেনি রাহাতের। বহু চেষ্টার পর ভোরের দিকে চোখ জোড়া একটু লেগে এসেছিল রাহাতের। সেটাও অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বাবা প্রায় হাঁক-ডাক ছেড়ে পুরো বাড়িটা মাথায় তুলে ফেলেছেন। আর বাড়ির সব কাজের লোকেরাও তাই ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে শুরু করেছে। রাহাত বিরক্ত হয়ে বালিশ দিয়ে নিজের কান মাথা চেপে ধরে সবার এই হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ ঠেকানোর চেষ্টা করলো। তাতেও অবশ্য শেষ রক্ষা হলো না। ততক্ষণে বাবা স্বয়ং দলবল নিয়ে রাহাতের রুমে চলে এসেছেন।

-রাহাত? এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছিস কেন আজকে? রাতে তো বেশি দেরি হয়নি পার্টিতে। তাহলে? বাসায়ও তো ফিরলি তাড়াতাড়িই? এতো ঘুমাচ্ছিস কেন? ওঠ? কতো কাজ বাকি এখনো?

-ড্যাড প্লিজ ঘুমাতে দাও না? প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। আর তোমাদের যা করার যা ইচ্ছে হয় করো না? কে ধরে রেখেছে? শুধু আমাকে মাফ করো প্লিজ?

-আমি তোর বাপ হই রে ব্যাটা। এভাবে কেন কথা বলছিস? খুব বিরক্ত করছি নাকি তোকে? শুধু কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবো তোকে। 

-ড্যাড প্লিজ? এখন না। আম রিয়েলি টায়ার্ড। 

-কিন্তু কথাগুলো জরুরি রাহাত। প্রশ্নের উত্তর না পেলে তো পরের ধাপে যেতে পারছি না আমরা। বল না বাবা? কাল কি হলো------।

-ড্যাড? তোমার যা ইচ্ছে হয় করো। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। নাউ লেট মি স্লিপ প্লিজ?

-ওকে ওকে। কেমন ঘুম পাগল ছেলে রে আমার! ঘুমের চোটে বাবার কথা শোনারও সময় নেই তার! কি কপাল করে এমন একটা ছেলে পেয়েছি!

-বাবা?

-ওপস সরি সরি। তুই ঘুমা। তুই উঠলে তারপর নাহয় আমরা রওনা দিবো-----।

শেষের কথাগুলো আর রাহাতের কানে পৌঁছে নি। তার আগেই সে ঘুমে অচেতন। বারোটার দিকে ঘুম ভাঙার পর রাহাতের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। বাসায় একটা হৈ হৈ অবস্থা চলছে। সবাই মনে হয় বেশ সুন্দর পরিপাটি হয়ে সেজে গুজে রাহাতের ঘুম ভাঙ্গারই অপেক্ষা করছিল। আর প্রায় সবার চোখেমুখেই একটা চাপা উত্তেজনার ঝিলিকও চোখে পড়ছে রাহাতের। রাহাত কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আজীজ মাহমুদ চৌধুরী এসে রাহাতের হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল। 

-তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে আয় রাহাত। তোর রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট করা হয়ে গেলেই আমরা সবাই বের হবো।

-বের হবো মানে? কোথায় যাবে বাবা?

-আরে বাবা। ইম্পর্ট্যান্ট একটা মিটিং আছে।

-ড্যাড? আজকে একটা দিন অফিসটা অফ দিয়েছি। তুমি এই ভরদুপুরেও মিটিং নিয়ে পড়লে?

-আরে বাবা। এ মিটিং সে মিটিং না। এখন তাড়াতাড়ি কর। আমাদের বের হতে হবে তো নাকি? এমনিতেই কতো দেরি হয়ে গেছে!

-কিন্তু যাবে কোথায় সেটা তো বলো?

-সারপ্রাইজ। 

-ওহ! ড্যাড! তুমি আর তোমার সারপ্রাইজ। আসছি আমি----।

রাহাত শাওয়ার নিয়ে বাবার দেয়া সাদা ফরমাল শার্ট গায়ে জড়িয়ে রেডি হতে হতে চিন্তা করলো মায়াকে একবার কল করবে কি না। পর মূহুর্তেই চিন্তাটা আবার মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলো। তারপর বাবার সাথে পাড়ি জমালো অজানার উদ্দেশ্যে। গাড়ির পিছনের সিটে ওদের কয়েকজন বিশ্বস্ত কাজের লোক আর বেশ কতোগুলো বড় সড় র‍্যাপিং করা বক্স দেখেও রাহাত কিছুটা অবাক হলো। কিন্তু জানে বাবা আপাতত রাহাতকে সাসপেন্সে রাখতে চাইছে। হাজার বার জিজ্ঞেস করলেও কিছুই বলবেন না। তাই আপাতত রাহাত কিছু না বলে নিজের ভাবনায় ডুব দিলো। মায়ার সাথে গত রাতের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলবে কি বলবে না সেটা নিয়েই দোটানায় আছে রাহাত। রাতে নেশার ঘোরেই যদি মেয়েটা এসব বলে থাকে তাহলে হয়তো কথাগুলো জানার পর লজ্জায় পড়ে যাবে। আর কিন্তু যদি মন থেকেই বলে থাকে? তাহলে কি করবে রাহাত? 

ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এসে রীতিমতো ধাক্কা খেল রাহাত। রাহাতদের গাড়ি সোজা মায়াদের বাসার সামনেই এসে থেমেছে। আধ পুরোনো রঙ ওঠা বিল্ডিংটা এই এলাকার অন্য সব বিল্ডিংগুলোর মতোই শক্তপোক্ত হয়েই মাথা উঁচিয়ে টিকে আছে সগর্বে। দোতলা এই ছোট মতো বাড়িটায় লোকজন বলতে শুধু মায়া আর ওর মা ই থাকে। এ শহরে হয়তো ওদের তেমন কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। তাই পাড়া প্রতিবেশীরাই সেই কমতিটা পূরণ করে দেয়। মাঝেমাঝে পুরো এলাকাটাকে একটা গোটা একান্নবর্তী পরিবার ভেবেও হয়তো ভুল হতে পারে কারো। আজকাল এতো তালমেল সাধারণত কোথাও দেখা যায় না। কিন্তু এই মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো এভাবেই একে অন্যের বিপদে আপদে একজোট হয়ে নিজেরাই যে কোনোরকমে টিকে থাকার চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত। আটপৌরে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কাউকে উপরের ঝুলবারান্দায় উঁকি দিয়ে পালাতে দেখলো রাহাত। মিনিটের মধ্যে বাসার ভিতরে থাকা মানুষগুলোর যে ছুটোছুটি শুরু হয়ে যাবে সেটা বুঝতে রাহাতের দেরি হলো না। কিন্তু ওরা এখানে কেন এসেছে সেটাই বুঝতে পারছে না রাহাত। মায়ার কি বাড়াবাড়ি রকমের কিছু হয়েছে নাকি?

-রাহাত? এভাবে হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল ভিতরে যাই?

-বাবা! আমরা এখানে কেন এলাম? মায়া ঠিক আছে? ওর কি কিছু হয়েছে? কাল তো ও সুস্থই ছিল। হঠাৎ এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে কি এমন হলো? নাকি আন্টির কিছু---?

-আরে বাবা! আগে বাসার ভেতরে চল। তারপর নিজেই বুঝতে পারবি। 

-কিন্তু------।

রাহাত আর কিছু বলার আগেই আজীজ সাহেব ওকে নিয়ে মায়াদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লেন। আর তাদের পিছনে কাজের লোকেরা চললো র‍্যাপিং করা গিফ্ট বক্সগুলো নিয়ে। বাসার ভিতরে ঢুকে রাহাতের চোখ আটকে গেল। মায়াদের বাসায় আজ রীতিমতো উৎসবের আয়োজন চলছে। প্রতিবেশী কয়েকজন মহিলা হাতে হাতে মায়ার মাকে কাজে সাহায্য করছেন আর বয়স্ক দাদী গোছের কয়েকজন পাশে থেকে সবকিছুর তদারকি করছে। রাহাতের বাবাকে দেখে মায়ার মা এগিয়ে এসে সালাম দিলেন। রাহাতের বাবা সালামের জবাব দিতেই রাহাতও কিছুটা থতমত খেয়ে সালাম দিয়ে বাবার সাথে ড্রইংরুমে গিয়ে বসলো। উৎসাহী খালা, চাচি সম্বন্ধের মহিলারা একটু পর পর যে রুমটায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে সেটা রাহাত টেরও পাচ্ছে। তাই কেমন একটা অস্বস্তিও লাগছে রাহাতের।

 রাহাতের অস্বস্তিটা আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়ার জন্যই কি না কে জানে ঠাট্টার সম্পর্কের কয়েকজন মিলে মায়াকেও এনে রাহাতের সামনাসামনি একটা সোফায়  বসিয়ে দিলো। মায়ার পড়নের টুকটুকে লাল বেনারসি টাইপের একটা শাড়ি আর পরিপাটি করে সাজগোজ দেখে রাহাত কিছুটা চমকে উঠলো। মায়াবতীটাকে একটা টুকটুকে লাল পুতুলের মতো লাগছে আজকে। ছোট করে টানা ঘোমটার আড়াল থেকে মেয়েটার লজ্জারাঙা মুখটা চোখে পড়ছে রাহাতের। কিন্তু এতো আয়োজন, এতো সাজগোজ, এতো হাসাহাসি -কানাকানির ঘটনা রাহাতের মাথায় ঢুকলো না। মায়া তো সুস্থই আছে। তাহলে ওরা এ বাড়িতে এসেছে টা কেন? বাবাকে প্রশ্নটা করার জন্য মুখ খোলার আগেই একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনে থেমে গেল রাহাত। হা করে রুমে আসা মানুষ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলো রাহাত। এরা দুজনও এখানে কেন এসেছে এবারে সেটাও রাহাতের মাথার উপর দিয়ে গেল। 

-এই তো আমরাও চলে এসেছি। অনুষ্ঠানটা এখনো শুরু হয়নি না? থ্যাংক গড! আমি আরো ভাবলাম এই মেয়ের মেকাপের চক্করে আজকে বুঝি সব মিস হয়ে যাবে। না বাবা। শেষ রক্ষা হয়েছে তাহলে---। উফ! আরে রাহাত? তোকে তো দারুণ লাগছে ইয়ার! অবশ্য লাগবে না ই বা কেন? কার বন্ধু দেখতে হবে না? আর মায়া? ওপস! সরি ভাবি আপনাকেও দারুণ লাগছে। জুলি মায়াকে দেখে অন্তত শেখো? বি ন্যাচারাল ইউ নো? লাইক এই ইঞ্চি খানেক মেকাপের আস্তরণ না দিয়ে যদি----।

-কি হচ্ছে কি এখানে? সোহান? জুলি? তোরা এখানে? আর মায়া এভাবে এই সাজে কেন? ড্যাড? আমরা এখানে কেন এসেছি? জাস্ট স্পিক আপ প্লিজ।

রাহাত সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলায় সবাই কিছুটা ভড়কে গেল। সোহান কিছু বলার জন্য এগিয়ে আসায় রাহাত নিজের হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিয়ে বাবার দিকে তাকালো। আজীজ মাহমুদ চৌধুরীও উঠে দাঁড়িয়ে রাহাতের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাকই হলেন।

-ড্যাড? কি হচ্ছে এখানে শুধু সেটা আমাকে বলো। প্লিজ?

-তোর আর মায়ার বিয়ের ব্যাপারে আমরা---।

-আমি কি তোমাদের কাউকে একবারও বলেছি আমি মায়াকে বিয়ে করতে চাই? ও আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। ওর সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক নেই যে সেটা বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে---।

-রাহাত? কিন্তু জুলি আর সোহান তো বললে গতকাল তোরা নিজেদের মনের কথা---। তাছাড়া আমিও চাই তুই মায়াকে বিয়ে কর।

-বাবা। তোমরা আমার দিকটা বোঝার চেষ্টা করো না কেন বলো তো? কেন বারবার একই কথা মনে করিয়ে আমার কষ্টটাকে বাড়াও তোমরা? সব কিছু ভুলে একটু কি শান্তিতে থাকতে দিবে না? প্লিজ? 

-মায়া অনেক লক্ষী একটা মেয়ে রাহাত। মেয়েটাকে এভাবে অপমান করিস না তুই।

-মায়া অনেক ভালো লক্ষী একটা মেয়ে বাবা। শি ডিজার্ভ এ বেটার পারসন। আই এম নট ইভেন গুড ফর হার। আর আমার কাছ থেকে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাবে না ও। মায়া? এই মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিংটার জন্য আ'ম রিয়েলি সরি। বিয়েটা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়---। সরি।

-রাহাত?

রাহাত হাত জোড় করে কথাগুলো বলে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। আর রাহাতের পিছন পিছন থতমত খেয়ে সোহান আর জুলিও রাহাতকে বোঝাতে ছুটলো। এতোক্ষণ রাহাতের কথাগুলো সবাই চুপচাপ করে শুনলেও এবারে মায়াদের বাসায় একটা ছোটখাটো গুঞ্জন শুরু হলো। বাড়িতে আসা প্রতিবেশীরা একে অন্যের সাথে কথাগুলো বলাবলি করতে করতে যে যার বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। মায়ার মায়ের কাছে হাত জোড় করে বারবার মাফ চাইছে আজীজ মাহমুদ চৌধুরী। আর মায়াই শুধু নির্বিকার হয়ে আগের জায়গায় বসে রইলো পাথরের মতো। কয়েকটা মিনিটেই যেন ওর পুরো পৃথিবীটাই কেউ লন্ডভন্ড করে গিয়ে গেছে।

১২!! 

-স্যার? স্যার? বাড়িতে পৌঁছে গেছি।

 
ড্রাইভার চাচার ডাকে চোখ মেলে তাকাল রাহাত। চাচা গাড়ির দরজা খুল একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেটা দেখতে রাহাতের একদমই ভালো লাগছে না কেন জানি। মা মারা যায় পর এই মানুষটাই রাহাতকে বাবার সাথে বুকে আগলে বড় করেছে। এই দুদিন বাবার মতো এই মানুষটাও খুব বেশি প্রয়োজন না হলে রাহাতের সাথে কথা বলে নি। কথাগুলো ভেবে রাহাত ধীর পায়ে ড্রাইভার চাচার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধ চেপে জড়িয়ে ধরলো। 

-আরে ছোট সাহেব কি করছেন?

-এমন কেন করছ চাচা? না তুমি ঠিক করে কথা বলছ, না বাবা ঠিক করে কথা বলছে। কেন এতো শাস্তি দিচ্ছ তোমরা আমাকে?

-কি যে বলেন স্যার। আমি সামান্য এক গরীব ড্রাইভার। আপনাদের দয়ায় ঘর সংসার নিয়ে----। 

-চাচা? প্লিজ? এসব বন্ধ করো এবার। আমি আর পারছি না এসব নিতে। কি চাইছ কি তোমরা? কিসের শাস্তি দিতে চাও আমাকে? আর কত শাস্তি দিবে বলো? 

-দোষ তো ওই মেয়েটারও ছিল না। তাহলে ওকে কিসের শাস্তি দিলে রাহাত বাবা? একজনের অন্যায়ের শাস্তি অন্যজন কেন  ভোগ করবে? তুমিই বলো?

-তোমরা কেন বুঝতে পারছ না বলো তো? মায়াকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি চাই না ও কোনো মিথ্যে আশা বুকে আঁকড়ে তিলে তিলে কষ্ট পাক। এর চেয়ে অন্য কারো সাথেই মেয়েটা সুখি হোক। 

-মেয়েটা তো কষ্ট পেয়েছেই রাহাত বাবা। আর সুখ! সেটা যদি ওর কপালে থাকত, তাহলে তো তুমি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও বিয়েতে মত দিতে। ওভাবে সবার সামনে মেয়েটাকে একা ফেলে রেখে চলে আসতে না।

-একবার বিশ্বাসটা কেউ ভাঙ্গলে সহজে যে আর কাউকে বিশ্বাস বা ভরসা কোনোটাই করা যায় না চাচা।

-একজনের বিশ্বাস ভাঙ্গার দায় তুমি কেন পাঁচটা বছর বয়ে বেড়াবে? তোমার কি সুখী হতে ইচ্ছে হয় না? বড় সাহেব তোমার মুখে হাসি ফোটাবার জন্য যাকে তোমার সাথে বাঁধতে চাইলেন, তুমি কিনা নিজের সেই খুশিটাকে নিজের থেকে দূর করে দিতে চাইছ? কেন? ওই একজনই কি সব ছিল তোমার জীবনে? আমরা এতোগুলো মানুষ কেউ কিচ্ছু না? আমরা গরীব মানুষ, চাকর বাকর, তাই নাহয় আমাদের কথা বাদই দিলাম। কিন্তু তোমার বাবা? তোমার অবহেলা হবে ভেবে যে নিজের জীবনের এতোগুলো বছর একাই কাটিয়ে দিল? তার কথাটা একবারও ভাববে না?

-চাচা? 

-তুমি কি সিদ্ধান্ত নিবে সেটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার রাহাত। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের কারণে যদি কাউকে কষ্ট পেতে হয় তাহলে সে দায়টাও তো তোমাকেই নিতে না। বড় সাহেবের রাগ তুমি কি করে ভাঙ্গাবে আমি জানি না রাহাত বাবা, কিন্তু মায়ার সাথে যে অন্যায়টা তুমি করেছ সেটার জন্য আমি তোমাকে কখনো মাফ করবো না। কখনো না। অনেক বছর তো তোমাকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ দিয়ে লালন পালন করেছি। সেই সন্তানই যদি আজ ভুল করে তাহলে আর কি ই বা করার থাকে একজন হতাশ পিতার? 

-চাচা?  আমার কথাটা শোনো একবার?

-আমি তোমার চাচি আর নয়নাকে নিয়ে আজই গ্রামে চলে যাবো। আমি চোখের সামনে না থাকলে তোমারও তাহলে হয়তো নিজের কাজের জন্য গ্লানিটা কিছুটা হলেও কম হবে---।

-চাচা? কিসব বলছ? আমার কথাটা তো শোনো? রহিম চাচা?

রাহাতের ডাক উপেক্ষা করেও ড্রাইভার চাচা নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। রাহাত কি করবে ভেবে না পেয়ে আজীজ মাহমুদ চৌধুরীর রুমে ছুটলো। এই একটা মানুষের কথাই এই মূহুর্তে রহিম চাচার যাওয়া আটকাতে পারে। রুমে এসে রাহাত দেখলো বাবা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে আছেন। রাহাত ছুটে এসে বাবার পায়ের কাছে এসে পড়লো। কোনমতে বাবার পা জড়িয়ে ধরতেই আজীজ মাহমুদ চৌধুরী চোখ মেলে ছেলের দিকে একনজরে তাকিয়ে রইলেন। রেগে থাকলেও ছেলের এমন বেহাল অবস্থা দেখে উনিও তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন।

-কি হয়েছে রাহাত? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? 

-বাবা? বাবা? রহিম চাচা চাচি আর নয়নাকে নিয়ে চলে যাবে বলছে। তুমি--তুমি ওদের আটকাও না প্লিজ? তুমি বললে চাচা আর যাবে না দেখো--?

-রহিমও একটা মেয়ের বাবা রাহাত। সে মায়ার কষ্টটা বোঝে। আবার তোমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করার কারণে তোমার কষ্টটাও সে জানে। তাই সে যদি এসব থেকে দূরে গিয়ে শান্তিতে থাকতে চায়, তার অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলো যদি সে ভুলে থাকতে চায় তাহলে তাকে আমি আটকাবো কেন?

-তোমরা সবাই মিলে কেন এমন করছ বাবা? মানছি আমি মায়ার সাথে অন্যায় করেছি। কিন্তু তোমরা তো সবটা জানো। তবু কেন জেদ ধরে বসে আছো? কেন এমন করছ আমার সাথে? বারবার ভুলে থাকতে চাইলেও কেন আমাকে বারবার সেই একই ঘটনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছ? 

-তোমাকে তো কেউ জোর করছে না রাহাত। তুমি বিয়ে করবে না বলেছ। আমরা সবাই মেনে নিয়েছি। মায়াও মেনে নিয়েছে। নিজের দায়িত্ব গুলো লিজাকে বুঝিয়ে দিয়েই তো গেছে। মায়ার কারণে তো তোমার কোনো কাজ আটকে নেই রাহাত।

-কিন্তু তোমরা সবাই আমার সাথে এমন কেন করছ? তুমি ঠিক করে কথা বলছ না। না রহিম চাচা, না চাচি, না নয়না। কেন কেন কেন?

-তুমি যেমন নিজের ইচ্ছেটা সবার কাছে প্রকাশ করেছ। তেমনি বাকিরাও করছে। তো তারপর বলো? তোমার আজকের প্ল্যান কি সাকসেসফুল হয়েছে? জুলি কি সোহানকে বিয়ে করবে জানিয়েছে?

-বাবা? তুমি কি করে জানলে?

-তোমার বাবা হই আমি রাহাত। তোমার সাথে কথা না বলতে পারি। কিন্তু তোমার মনের খবরটা তোমার চেয়ে আমি একটু হলেও বেশি জানি। রাতেই তো সোহানকে জানিয়েছিলে যে জুলিকে আজকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করবে। তুমিও জানতে কথাটা শোনার পর সোহান চুপ করে থাকবে না। তাই না?

-বাবা?

-কিন্তু কি জানো তো রাহাত? অন্যের ভালোবাসাকে সফল করতে গিয়ে নিজের ভালোবাসাটা হারিয়ে ফেলো না। একবার হারিয়ে গেলে সেটা খুঁজলেও যে ফিরে পাবে সেটা তো না ও হতে পারে। তোমার মাকেও আমি আর ফিরত পাই নি। ভেবেছিলাম যৌবনে অনেক টাকা কামাবো, আর বৃদ্ধ বয়সে তোমার মায়ের সাথে সারা দুনিয়া দেখবো। অর্থ সম্পদ সবই অর্জন করতে পেরেছি। কিন্তু এই অর্থ সম্পদের পিছনে ছুটতে ছুটতে তোমার মা ই আমাকে একা ফেলে চলে গেল। হয়তো অনেক অভিমান জমা হয়েছিল ওর মনেও। সময় দিতে পারতাম না ওকে। আর এখন? এতোগুলো বছর পর আমি একা। সম্পূর্ণ একা। তুমিও আমার মতো একা হয়ে যাওয়ার আগে নিজের ভুলগুলো শুধরে নাও রাহাত। নয়তো সত্যি অনেক দেরি হয়ে যাবে। অনেক দেরি হয়ে যাবে।

রাহাত আর কিছু না বলে সোজা নিজের রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। সারাদিনের ছুটোছুটি আর চিন্তায় একরাশ ক্লান্তি এসে ভর করেছে রাহাতের শরীরে আর মন। না চাইতেও চোখ জোড়া ক্লান্তিতে বুজে আসছে বারবার। এক নিমিষেই চোখের সামনে ঘন কালো অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে রাহাতের। সেই ঘন কালো ভেদ করে একটা দীপ্তিময় হাসিমাখা মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাহাতের। এই মুখটার সাথে রাহাতের সমস্ত হাসি, আনন্দ, ব্যথা, বেদনার অনুভূতিগুলো মিশে আছে এতোগুলো দিন ধরে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এই হাসি মাখা মুখটাই রাহাতের চোখের ঘুম আর মনের সুখ শান্তি উড়িয়ে দিয়েছিল। আজ থেকে বেশ কয়েকবছর আগে রাহাত আয়ারল্যান্ডের 'ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিন' এর 'কলেজ অব বিজনেস' থেকে নিজের পোস্ট গ্রাজুয়েশন নেয়ার জন্য যায়। পোস্ট গ্রাজুয়েশনের শেষ সেমিস্টারের ক্লাস করে ভার্সিটির বাইরে বেরিয়েই এই নির্মল হাসিমাখা মুখটার দেখা পায় রাহাত। ডাবলিনের কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও মেয়েটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাখিদেরকে খাবার ছিটিয়ে খাওয়াচ্ছিলো। পাখিগুলো মেয়েটার গায়ে, মাথায়, হাতে বসে হাতে ধরা কর্নের বীজগুলো খাওয়ার চেষ্টা করছে দেখেও মেয়েটা বাচ্চাদের মতো খিলখিলিয়ে হাসছে। হাতের কর্নটা পুরো খালি করে পাখিগুলো উড়ে গেলে মেয়েটা সোজা এসে রাহাতের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। 

-হ্যালো মিস্টার? হোয়াট আর ইউ লুকিং এট? 

-হাই? আম রাহাত। রাহাত মাহবুব চৌধুরী। 

-আপনি বাঙ্গালি? ওহ গড! এতোদিন পর বাংলায় শান্তিতে কথা বলতে পারবো। উফ! ভেবেই তো খুশিতে নাচতে মন চাচ্ছে--। বাই দা ওয়ে। আমি স্মৃতি। অরিজিন বাংলাদেশী। আপনি কি বাংলাদেশী? নাকি ভারতীয়?

-বাংলাদেশী। আপনি এখানে?

-আজকের ফ্লাইটেই আয়ারল্যান্ডে আসলাম। একটা ফ্রেন্ডের রিসিভ করার কথা ছিল। কি হলো কে জানে ও এয়ারপোর্টে এলোই না। এখন আর কি! ওর জন্য পথে পথে ঘুরছি। 

-আপনার ফ্রেন্ডের ঠিকানা বা ফোন নাম্বার নেই? 

-আরে নাহ। ও তো বলেছিল এয়ারপোর্টেই অপেক্ষা করবে। আমিও তাই বোকার মতো আর--।

-হয়েছে তাহলে। আপনার ফ্রেন্ডটি তাহলে পগার পার হয়ে গেছেন। উনি আর আসবেন না। 

-আআআ। তাহলে আমি এখন কোথায় যাবো? আমি তো কিছু চিনিও না এখানকার! শিট শিট শিট!

-আপনি চাইলে আমার বাসায় থাকতে পারেন। 

-হোয়াট? আপনার বাসায় থাকতে যাবো কেন? আপনাকে তো আমি চিনিও না।

-ও। ওকে লেট'স ইন্টিডিউস আওয়ারসেল্ভস। আমি রাহাত মাহবুব চৌধুরী। ডাবলিন কলেজ অব বিজনেস থেকে নিজের পোস্ট গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট করছি। এটা লাস্ট সেমিস্টার। আর ছোটোখাটো একটা বিজনেস ফার্ম আছে ডাবলিনেই। ইয়া। দ্যাটস ইট। 

-হোয়াট? আপনার নিজের বিজনেস ফার্ম? রিয়েলি?

-ইয়াপ! আপনারও মে বি পরিচয়টা দিলে একটু ভালো হয়।

-আমি মৌনতা খান স্মৃতি। নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতেই আসা আয়ারল্যান্ডে। এখন তো দেখছি পরিচয় তৈরির আগেই শেষ--। 

-নাইস নেইম। সো মিস স্মৃতি? আর ইউ জয়েনিং মি? এই ঠান্ডায় এভাবে আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো জমেই যাবো। 

-ওয়েট ওয়েট ওয়েট। আমম। আমি যাবো আপনার সাথে।

-দ্যাটস গুড। দ্যান লেট'স গো? বাই দা ওয়ে? আপনার লাগেজ?

-ওহ শিট! লাগেজের কথা তো একদমই ভুলে গেছি আমি। পাশেই একটা হোটেল আছে না? গ্রান্ডভ্যালি? ওটায় লাগেজ রেখে তারপর তো ফ্রেন্ডকে খুঁজতে বেরিয়েছি---।

-আপনার কাছে আপনার ফ্রেন্ডের ঠিকানা, ফোন নাম্বার কিছুই নেই। তবু হোটেলে রুম বুক করে তাকে খুঁজতে বেরিয়ে গেছেন? নট ব্যাড।

-ইশ! কি বোকার মতো কান্ড করি আমি! ধ্যাত!

-চলুন আপনার ফ্রেন্ড পরে খুঁজে বের করা যাবে। আপাতত আপনার লাগেজটা পিক করে আমার বাড়িটা দেখিয়ে আনি। যদি আপনার পছন্দ হয় আর কি এই গরীবের কুঁড়ে ঘরটা। 

-হি হি। কুঁড়ে ঘর! এই আয়ারল্যান্ডে? ঠান্ডায় জমে যান না? হি হি। 

রাহাতের নিজের গাড়ি চালাতে চালাতে এই বাকপটু মিষ্টি মেয়েটার বকবকানি শুনছে। সাধারণত খুব বেশি কথা বলা রাহাত পছন্দ করে না। কিন্তু এই মেয়েটার বকবকানি শুনতেও বেশ লাগছে রাহাতের। হাত জোড়া নাড়িয়ে, মুখে একেক বার একেক ভঙ্গি করে কতো কিছু বলে চলেছে মেয়েটা। কখন যে কি বলছে তারও যেন ঠিক নেই। রাহাত অবশ্য তেমন মনোযোগ দিয়ে শুনছেও না কথাগুলো। বেচারা একমনে ভাবার চেষ্টা করছে একটা মানুষ এতো কথা বলে কি করে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন