আমার একটাই যে তুই - পর্ব ০৯ - সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি - ধারাবাহিক গল্প


তখনি হাসান ভাই বললেন,,

--এট্যানশন গাইজ, ওল রেডি ফর সিংগিং!

সবাই এসে কেম্প ফায়ার ঘিড়ে গোল করে বসলো। হাসান ভাই গিটারে টুংটাং শব্দে গান ধরলো,,

--" প্রেম কি বুঝিনী আগে তো খুজিঁনি
     আজ কি হলো রে আমার"

গানের মাঝে হাসান ভাইকে চাপড় মরে গিটার নিয়ে নিলেন ফুয়াদ ভাই। আর বললেন,,

--" শালা তোর এখন না বুঝলেও চলবে! ছোট তুই..!"

হাসান ভাই তখন গাল ফুলিয়ে বলল,,

--" আমারো দিন আসবে সব কটাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিব! হুহ!"

হাসান ভাইয়ার কথা সবাই হো হো করে হেসে দিল।তারপর ফুয়াদ ভাই গিটার নিয়ে ধরিয়ে দিল ইউসুফ ভাইকে। ইউসুফ ভাই আমার দিক এক পলক তাকিয়ে গান ধরলেন,,

--"তোর মন পাড়ায়, থাকতে দে আমায়
আমিচুপটি করে দেখবো আর ডাকবো ইশারায় ।
তুই চাইলে বল, আমার সঙ্গে চল
ওই উদাস পুরের বৃষ্টিতে আজ ভিজবো দুজনায় ।
অভিমানী মন আমার চায় তোকে বারেবার
অভিমানী মন আমার চায় তোকে বারেবার
তাই বলি আয়রে ছুটে আয়.
তোরমন পাড়ায়, থাকতে দে আমায়
আমিচুপটি করে দেখবো আর ডাকবো ইশারায় ।
তুই চাইলে বল,আমার সঙ্গে চল
ওই উদাস পুরের বৃষ্টিতে আজ ভিজবো দুজনায় ।
তোর হৃদয় আঙিনায়,থাকতে আমি চাই
তুই ছাড়া বাঁচার নেই রে উপায়
কিভাবে ওরে, তোকে ছেড়ে
একাকী আমি জীবন কাটাই ।
অভিমানী মন আমার চায় তোকে বারেবার
অভিমানী মন আমার চায় তোকে বারেবার
তাই বলি আয় রে ছুটে আয়...
তোর মন পাড়ায়,থাকতে দে আমায়
আমি চুপটি করে দেখবো আর ডাকবো ইশারায় ।
তুই চাইলে বল,আমার সঙ্গে চল
ওই উদাস পুরের বৃষ্টিতে আজ ভিজবো দুজনায় ।
শুধু তোকে ঘিরে, শত স্বপ্নের ভিড়ে
এখন আমার বসবাস তুই এলে জীবনে,
পাবো বাঁচার মানে পাবো সুখেরি আভাস.
অভিমানী মন আমার চায় তোকে বারেবার
অভিমানী মন আমার চায় তোকে বারেবার
তাই বলি আয় রে ছুটে আয় ।
ওই উদাস পুরের বৃষ্টিতে আজ ভিজবো দুজনায় ।
তোর মন পাড়ায়,থাকতে দে আমায়
আমি চুপটি করে দেখবো আর ডাকবো ইশারায় ।
তুই চাইলে বল,আমার সঙ্গে চল
ওই উদাস পুরের বৃষ্টিতে আজ ভিজবো দুজনায় ।

গানের পুরোটা সময় ইউসুফ ভাইয়া চেয়ে রইল আমার  দিক। তার এভাবে তাকানোতে লজ্জায় গাল দুটি লাল হয়ে গেল আমার। আমি এদিক ওদিক বার বার তাকিয়ে আর চোখে দেখলাম তাকে। তিনি বুঝতে পেরে হাসলেন। বাট চোখ সরালেন না। তার দৃষ্টি ঘুড় পাক খেলো আমার দিকেই।গান যে আমাকে ডেডিকেট করেছে বুঝতে বাকি নেই আমার। গান শেষ হতে হাততালি শুরু করলো সবাই।আর বলতে লাগে "ওয়ান্স মোর ""ওয়ান্স মোর "। ঘুরতে আসা অনেক মানুষ যোগদিল আমাদের সাথে। আড্ডা তখন অনেক জমেছে। সাথে চলছে বারবিকিউর আয়োজন। তার সাথে সাথে গানের থিম কন্টিনিউ চলছে। এবার ফুয়াদ ভাইয়া শুরু করলো গান। ঠিক রিয়ার মুখামুখি বসে,,

--"জানিনা কেনো যে শুধু এ তোর কথা
ভাবতে ভালো লাগে
দুচোখে এতো যে সপ্ন লুকোচুরি
করেনি কেনো আগে
প্রিয়া রে জিয়া রে আর মানে না
হিয়া টারে কি বলে বুঝাই..
যে দেশে নয়ন বলে স্বপ্ন দেখে যাই
ইচেছ করে তরে নিয়ে যাই
যে দেশে চেনা জানা মানুষ কোনো নাই
ইচেছ করে তরে নিয়ে যাই
প্রিয়া রে জিয়া রে কথা শুনে না
হিয়া টারে কি বলে বুঝাই..
যে দেশে নয়ন বলে স্বপ্ন দেখে যাই
ইচেছ করে তরে নিয়ে যাই
হাই..ইচেছ করে তরে নিয়ে যাই"

গান শেষে হতেই সবাই চিল্লিয়ে হু হো অ শব্দ করেতে করতে। রিয়া লজ্জায় মুখে হাত দিয়ে বসেই রইলো।তখনি জায়েদ ভাই তার জায়গা ছেড়ে এসে গিটার নিয়ে নিলো ফুয়াদ ভাইয়ার থেকে তিথির দিক নেশা তার দৃষ্টিতে তাকিয়ে গান ধরলো সে,,

--"বলতে চেয়ে মনে হয়
বলতে তবু দেয় না হ্নদয়
কতটা তোমায় ভালবাসি...
চলতে গিয়ে মনে হয়
দুরত্ব কিছু নয়
তোমারি কাছেই ফিরে আসি
তুমি তুমি তুমি শুধু এই মনের
আনাচে কানাচে....
সত্যি বলোনা কেউ কি প্রেম হিনা
কখনো বাঁচে.....
তুমি তুমি তুমি শুধু এই মনের
আনাচে কানাচে....
সত্যি বলোনা কেউ কি প্রেম হিনা
কখনো বাঁচে.....
বলতে চেয়ে মনে হয়
বলতে তবু দেয় না হ্নদয়
কতটা তোমায় ভালবাসি

গানের মাঝে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল তিথি। আমার হাতে জোড়ে ধরে রেখিছিল বরাবর। মুখে তার লাজুক হাসি।
জায়েদ ভাইয়ার এইটুক গাওয়ার পর তাল মিলালো ইউসুফ ভাইয়া।  নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসে দাঁড়ালো জায়েদ ভাইয়ার পাশে আমার দিক তার বিলাই চোখে তাকিয়ে রইলো কিচ্ছুক্ষণ। তারপর সে গাওয়া শুরু করলো,,

--"মেঘের খামে আজ তোমার নামে
উড়ো চিঠি পাঠিয়ে দিলাম
পড়ে নিয়ো,তুমি মিলিয়ে নিয়ো
খুব যতনে তা লিখে ছিলাম..
মেঘের খামে আজ তোমার নামে
উড়ো চিঠি পাঠিয়ে দিলাম
পড়ে নিয়ো,তুমি মিলিয়ে নিয়ো
খুব যতনে তা লিখে ছিলাম..
ও-চায় পেতে আরো মন
পেয়েও এতো কাছে...
বলতে চেয়ে মনে হয়
বলতে তবু দেয় না হ্নদয়
কতটা তোমায় ভালবাসি.."

তাদের সাথে তাল মিলালো ফুয়াদ ভাইও...!

--"মন অল্পতে-প্রিয় গল্পতে
কল্পনায় স্বপ্ন আঁকে...
ভুল ত্রুটি আবেগী খুনসুটি
সারাক্ষন তোমায় ছুঁয়ে রাখে
মন অল্পতে-প্রিয় গল্পতে
কল্পনায় স্বপ্ন আঁকে...
ভুল ত্রুটি আবেগী খুনসুটি
সারাক্ষন তোমায় ছুঁয়ে রাখে
ও-চায় পেতে আরো মন
পেয়েও এতো কাছে...
বলতে চেয়ে মনে হয়
বলতে তবু দেয় না হ্নদয়
কতটা তোমায় ভালবাসি"

তিন জনের এমন ভাবে আমাদের তিন জনের জন্য গানের মাধ্য নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে দেখে বিস্মিত। লজ্জায় যেন আর মাথা তুলতে পারছি রা আমরা। আর আমাদের সামনের প্রেমিক পুরুষ গুলো আমাদের এভাবে লজ্জা পেতে দেখে তারা মিটমিটিয়ে হাসচ্ছে।

রাত গভীর হতে লাগলো। আনন্দের আমেজ বাড়তে লাগলো। বারবিকিউ খাওয়া-দাওয়া হলো। এবার পালা যে যার রুমে চলে যাওয়ার।সবাই সবার রুমে চলে যেতে লাগলো।আমি যাচ্ছি। তিথি জায়েদ ভাইয়ার সাথে আসচ্ছে। ফুয়াদ ভাই রিয়াকে তার রুমে দিতে গেছেম ইউসুফ ভাইযার কোনো পাত্তা নেই সে কই জানি গেছে। আমি গুন গুন করতে করতে রুমে যাচ্ছিলাম। তখনি কেউ টান দিয়ে একটি রুমে এনে দরজা লাগিয়ে দেয়।  আমি পিছনে ফিরে দেখি লিয়া।তাকে কিছু বলবো তার আগেই ঠাসস করে চড় পরে আমার গালে। সাথে সাথে হাত চলে যায় আমার গালে। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আমি। যখন বুঝতে পাড়ি কি হলো সাথে সাথে তেড়ে গেলাম আমি,,

--"হাউ ডেয়ার ইউ??  মারলে কেন আমায়??"

লিয়া তাচ্ছিল্যে হাসি দিয়ে হাত থাকা ছুড়িটা গলার খাঁজে গিথে দিলো আমার। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগে। আমি ব্যথায় সহ্য করতে না পেরে ধাক্কা দিতে লাগি তারে। কিন্তু সে আরো গিথে ধরে মনে হচ্ছিল যে কণ্ঠনালী কেঁটে যাচ্ছে। আমি ভয়ে সেটে আছি।লিয়াকে ধাক্কা দিতে পাড়চ্ছি না। লিয়া আবার ডেবিল মার্কা হাসি দিয়ে বলে উঠে,,

--" ব্যথা হচ্ছে বেবী? আমারও হচ্ছে (বুকে হাত দিয়ে)  এখানে! কিভাবো তুমি? ইউসুফকে পেয়ে যাবা এতো সহজ! হুম? আমি থাকতে তো কখনো না!উমহুম?"

আমি ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠি।আর ব্যথাতুর  স্বরে বলি,,

--" লিয়া আপু ছাড়ো কি করছো লাগচ্চে! আহ্!"

কিন্তু সে ছাড়লো না আরো চেপে ধরলো। ব্যথায় কান্না করে দিলাম আমি। লিয়া বললো,,

--"কান্না করছিস কেন? ছাড়বো তো বেবী!  একে বারে ছাড়বো! যেন ইউসুফকে দেখতে না পাশ তুই!কান্না করিস না। খুব রং তোর শরীরে তাই না!রং বের করছি। "

বলেই লিয়া ছুড়ি নামিয়ে যেই না পেটের কাছে নিবে অমনি ওরে ধাক্কা দিয়ে বেডে ফেলে চেপে ধরি। ওর হাতের চাকু নিয়ে ওর গলায় চেপে ধরে বলতে লাগি,,

--" লিয়া আপু আমি চাইলে তোমাকে এখানে তুমি যা করেছ তা রিপিট করতে পারি।  কিন্তু তুমি বড় তাই করলাম না। কিন্তু নেক্সটাইম এমন কিছু করলে আমি তোমায় ছাড়বো না।"

ওরে সেভাবে ছেড়ে চলে এলাম। গলায় ব্যথা হচ্ছে । ওরণা দিয়ে চেপে চলে এলাম রুমে। তিথি আসার আগে পরিস্কার করে মেডিসিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে নিলাম। চাই না ঝামেলা হোক কোনো! কিন্তু কান্না আসচ্ছে খুব।হু হু করে কেঁদে দিলাম। কিছুক্ষণ আগের কথা ভেবে ভয়ে জমে যাচ্ছে হাত পা।কাঁপচ্ছে প্রচুর। আজ কি হতে চলছিল। আমি একটুর জন্য এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতেম।চলে যেতাম ইউসুফ ভাইকে ছেড়ে আমার ভালবাসা অসম্পূর্ণ থেকে যেতে। এসব ভেবে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলাম কখন জানা নেই।

দরজার কড়া নাড়ার শব্দ ঘুম ভাঙ্গলো আমার। পাশেই তিথি বেগোড় ঘুম। আমি হাতরে ফোনটা নিয়ে সময় দেখি ৩.৪০ বাজে। এতো রাতে কে হবে? লিয়া নয়তো? তখনের কথা মনে পড়তেই ভয়ে হাত পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে আমার।ধীরে ধীরে উঠে গেলাম দরজার কাছে মৃদু স্বরে জিগ্যেস করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো ইউসুফ ভাইয়ার কন্ঠ। সাথে ওড়না গলায় চেপে চাদর  পড়ে বের হতেই ভাইয়া হাত ধরে বলল,,

--"চল!"

আমি অবাক হয়ে বললাম,

--"কই?"

তিনি ভ্রু কুচকালো। বিরক্তি ভঙ্গিতে বলল,,

--" জাহান্নামে!"

আমি মিনমিন গলায় বললাম,,

--" যাবো না আমি!"

তিনি চোখ গরম করেলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,,

--"যাবি না তোর চৌদ্দগুষ্টি যাবে।" 

বলে টেনে নিয়ে এলেন ছাদে। ছাদ এসে আমি অবাক। ছাদটা অনেক সুন্দর। ছাদের চারিদিক ফুলের বাগান করা। নানা রঙ্গের নাম না জানা অনেক ফুল তাতে। আমি এসব দেখচ্ছি তখনি ইউসুফ টেনে নিয়ে গেলেন ছাদের কর্নারে। পা ছড়িয়ে বসে পড়লেন তিনি। সাথে আমাকে বসালেন। তারপর বললেন,,

--"বাবুইপাখি আকাশের দিকে তাকা!"

আমি আকাশের দিকে তাকাতেই বিস্মিত হলাম। আকাশ পরিস্কার চাঁদ নেই কিন্তু আকাশের কোটি কোটি তারার মেলা, প্রাণ জুড়িয়ে গেল আমার নিমিষেই। ইউসুফ ভাই ওখানে শুয়ে পড়লেন। আর আমাকে বললেন,,

--"শুযে দেখ! মনে হবে আকাশ কত নিচে। আর তারা গুলো যেন তোর হাতের নাগালে।"

আমি তাই করলাম। ইউসুফ ভাইয়ার হাতে শুলাম। সত্যি আকাশ যেন নেমে এসেছে অনেক কাছে। তখনি ইউসুফ ভাই উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন,,

--"কুহু ওই দেখ মিল্কিওয়ে "

আমি বুঝতে না পেরে বললাম,,

--"কি?"

ইউসুফ ভাইয়া আবার বললেন,,

--"মিল্কিওয়ে চিনিস না? যাকে বলে ছায়াপথ।"

আমি ভাবলাম মজা করছে তাই পাত্তা না দিয়ে বললাম,,

--" মজা করবেন না ইউসুফ ভাই!"

ইউসুফ ভাই খানিকটা রেগে গেলেন।ধমকে বললেন,,

--"তোর সাথে কি মজার সম্পর্ক? যে মজা করবো? বেদ্দপ?"

আমি তার ধমকে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকি লোকটি আমাকে খালি বকে! তখন উনি আমার থুতনিতে হাত দিয়ে ডান ঘুড়িয়ে হেসে বললেন,,

--"দেখ? ওই যে!"

আমি দেখতে পেয়ে চমকে উঠি। খুশিতে গদ গদ হয়ে দাঁড়িয়ে যাই। ইউসুফ ভাইয়াও দাঁড়ায়। আমি লাফাতে লাফাতে জড়িয়ে ধরে "থ্যাঙ্ক ইউ " বলি তাকে। ছোট বেলায় বইয়ের পাতায় দেখা মিল্কিওয়ে আজ স্বচোখে দেখচ্ছি। সবটা ইউসুফ ভাইয়ার জন্য। আমার স্বপ্নের চাবিকাঠি এক মাত্র যে উনি বুঝতে বাকি নেই আমার। এবার তাকে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে ধরিছি আমি।  নিচ ইচ্ছায়। ইউসুফ ভাইয়াও ধরছেন আকাঁড়ে আমায়।তার বাবুইপাকিকে।

কিছুক্ষণের মাঝে উকি দিল সূর্যি মামা। সূর্য উদয় দেখার জন্য নিয়ে এলেন ইউসুফ হেলিপ্যাডে।  ধীরে ধীর সূর্যি মামা তার ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখতে হাজির হচ্ছে ধীরে ঘুড়তে আসা মানুষগন।আমি ইউসুফ ভাইয়ার হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছি। খুশিতে আমার চোখ মুখ চক চক করছে।  যা দেখে যাচ্ছে ইউসুফ ভাই। কিছুক্ষণের মাঝে লাল, হলুদ  রং রাঙ্গিয়ে উদিত হলো সূর্যি মামা।

সেখান থেকে নিয়ে গেলেন ইউসুফ অন্য সাইডে যেখানে কাশফুল ফুটে আছে একা ধারে। ঠিক নিচে তাকাতেই আবার দেখা মিললো মেঘের ভেলার।যারা নিজের নিজের খুশিতে ভেসে বেড়াচ্ছে। এত সুন্দর দৃশ্য দেখে আমি মুগ্ধ, বিমোহিত।  মন চাইছিল এখানে থেকে যাই। আর না যাই শব্দ যুক্ত পরিবেশে। নিচেও ভেসে যাই মেঘের ভেলার মতো।

সকাল ১০ঃ০০ টার মাঝে রেডি হয়ে বের হয় গেল সবাই তাদের নতুন জায়গা ঘুড়তে। চাঁন্দের গাড়িতে আগের মতো উঠে বসে গেল সবাই। তখনি ড্রাইভার বললো......!

—————

--"মামা আমার গাড়ি কি জানি হইছে স্টার্ট লইতেসে না।"

ড্রাইভারের কথায় সবার মুখে চিন্তার ছাপ। তখন জায়েদ ভাই বলল,,

--" কি কও মামা! এখন যামু কেম্নে আমরা? এত দূর?"

--" মামা চিন্তা কইরেন না গাড়ি ঠিক করে দিতাসি আমি! আপনাগো নিয়া যাইবো আর লইয়া আইবো।  কি কমু কোন বিপদতো লইয়া,  কইয়া আহে না।"

তারপর ড্রাইভার কংলাক পাহাড় যাওয়া একটি চান্দের গাড়িতে তুলে দিল। বিপত্ত ঘটল তখন যখন দুজনে জায়গা হলো না। আর সে দুজন ইউসুফ ভাই আর আমি। তাই একটি সি এন জি ভাড়া করা হলো।আর উঠে রওনা দিলাম কংলাক পাহাড়। 

রাস্তার মাঝে আপ হিল, ডাউন হিল হওয়াতে পড়ে যাওয়ার ভয়ে ইউসুফ ভাইয়াকে ঝাপটে ধরে বসে ছিলাম আমি। মাঝে মাঝে এ মোর ও মোর নিতেই কতবার যে তার গায়ের উপর পড়েছি হিসেব নেই। তিনি শুধু মিটমিটে হেসেই গেছেন।

আঁকা বাঁকা রাস্তা ধরে উপরে উঠে গেল আমাদের গাড়ি! কংলাক পাহাড়ের সামনে এসে থেমে গেল।অনেক মানুষ উপরে উঠে যাচ্ছে পাহরের উপর। কংলাক পাহাড়  হচ্ছে সাজেক ভ্রমণে আসা পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। 

এটা হচ্ছে সব থেকে উঁচু পাহাড়।এখান থেকে সূর্য উঠার দৃশ্য সুন্দর করে ফুঁটে উঠে। আমারা ধীরে উপরে উঠে গেলাম। সেখানে অধিবাসী বাসা বাড়ি। এখানের হেট মেনের ঘর।  এই হেট মেন কথায় সব হয় তাদের।

আমরা পাহারের একদম শেষে চল এলাম। আশে পাশে মেঘ মালা দেখে মনে হচ্ছে কোনো সমুদ্র। সেখানে বসে আমরা কিছুক্ষন রেস্ট করলাম। ইউসুফ ভাইয়ার রোদে গাল দুটো লাল টমেটো লাগচ্ছে।তিনি বার বার ঘাম ঝাড়চ্ছেন।

আমি বসে দেখছি তাকে তখনি হুট করে লিয়া এসে আমার পাশে নানা কথা জুড়ে দিলো। আজ লিয়ার হয়েছেটা কি? কাল রাতে মারার জন্য উঠে পড়ে লেগেচ্ছে আর আজকে সকাল থেকে এমন ভাবে কথা বলছে যেন আমার মায়ের পেটের বোন! হুহ! না জানি তার মনে কিচলেছে? আল্লাহ মালুম।

দেখতে দেখতে ৩ টা বেঁজে গলে এবার যাওয়ার পালা।এ দিকে হুট করে  পরিষ্কার আকাশ মুহূর্তে  কালো হয়েছে এসেছে।  তাই সবাই নেমে যাচ্ছে। কারণ বৃষ্টি হলে গাড়ি নিয়ে নিচে যাওয়া রিস্কি।  রাস্তা বৃষ্টির জন্য অনেক খারাপ হয়ে যায়।

আমি নামছি ধীরে পাশেই বড় খাদ। এক বার পড়লে বাঁচা মুশকিল। ইউসুফ ভাই আমার সামনে ঠিক। এদিকে পাহাড় কেটে সিঁড়ি  করা হয়েছে উঠা নামার সুবিধার্থে। 

আমি আশে পাশে তাকাতে তাকাতে হাটতে লাগলাম তখনি কেউ পিছন থেকে আমাকে খুব জোড়ে ধাক্কা দেয়। পাহাড়ের ঠিক কিনারায় থাকতে পড়ে যেতে নেই। সাথে সাথে পিছন থেকে ইউসুফ ভাইয়ার জ্যাকেট টেনে ধরি। ইউসুফ ভাইয়ার পায়ে তখন স্লিপ কাটতে সাথে সাথে পাহাড় থেকে নিচে পড়ে যাই দুজন। এদিকে এমন ঘটনায় হতভম্ব সবাই।

 চারিদিকে হৈ চৈ  শুরু হয়ে গেল।  ইউসুফ তখন একটি আগাছা গাছের ডালে ধরে ফেলে আরেক হাতে আমার হাত। আমি ভয়ে কান্না করে চলছি। রীতিমত হাত পা কাঁপচ্ছে আমার শ্বাস আঁটকে আসচ্ছে। ইউসুফ ভাই আমাকে টেনে তার কাছে এনে অভয় দিতে লাগে,,

--" বাবুইপাখি ভয় পাস না আছি তো আমি তোর সাথে। প্লীজ কাঁদিস না। কিচ্ছু হবে না।?"

কিন্তু আমি কিছুতেই কান্না থামাতে পাড়চ্ছি না। চোখ নিচে গেলেই শরীর হাত পা রিম ঝিম করছে।বার বার চোখ দুটো সিটে বন্ধ করে ফেলছি।কারণ নিচে সমতল দেখাই যাচ্ছে না। না কোনো ঘড় বাড়ি। এখান থেকে পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু। 

উপর থেকে চিল্লা চিল্লির আওয়াজ ভেসে আসচ্ছে। জায়েদ ভাই, ফুয়াদ ভাই,  রশির ফেলার কথা বলছে। পাশ থেকে তিথি, নুশরা, বুশরার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসচ্ছে। সাথে ভেসে আসচ্ছে অপরিচিত মানুষের কন্ঠ।

আমার এদিকে শরীর অসাড় হয়ে আসচ্ছে। মাথা ভাড় ভাড় লাগচ্ছে।  নিজের সব টুকু ভাড় ইউসুফ ভাইয়ার উপর ছেড়ে দিতেই চেঁচিয়ে উঠেন তিনি,,

--" বাবুইপাখি  না দেখ আমার দিকে, প্লীজ তাকা বাবুইপাখি আমার দিকে তাকা। এমন করিস চোখ বন্ধ করিস না।  প্লীজ বাবুইপাখি।  "

তারপর উপরের দিক তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,,

--"তাড়াতাড়ি কর তোরা! রশি ফেলতে এতো লেট কেন হচ্ছে??(আমার দিক তাকিয়ে) বাবুইপাখি আর একটু ওয়েট কর! আর আমার দিকে তাকা। একদম চোখ বন্ধ করবি না..!"

আমি ঢুলুঢুলু চোখে তার দিকে তাকালাম। এই মাতাল করা চোখ দুটোতে আজ পানি টলটল করছে। সুন্দর মুখ খানায় ভয়ের ছাপ।কেন জানি তাকে দেখতে ভাল লাগচ্ছে। হয়তে এটা শেষ মুহূর্ত বলে? আমি তাকিয়ে রইলাম তার বিড়াল চোখে।তখনি একটা ঝাঁকি অনুভব হলো। উপরে চেয়ে দেখি আগাছার ডালটা ভাঙ্গেতে শুরু করেছে। যে কোনো মুহূর্তে উপড়ে যাবে। 

এখানে একজন থাকলে আরো কিছুক্ষন ঝুলতে পারবে। সেই একজন ইউসুফ ভাই। দুজন থাকলে দুজনেরেই মরতে হবে! তার থেকে বরং আমি স্বরে যাই। বেঁচে যাবে ইউসুফ ভাই।আমি বেঁচে থেকেই বা কি হবে? না পাবো ভালবাসা, না ভালবাসার মানুষ।বরং আমি মরে গেলে কেউ কাঁদবে না। ইউসুফ ভাইয়ার কিছু হলো তার পরিবার পরিজন অভিশাপ করবে আমায়। তাই নিজে চলে যাওয়া ভাল। আগাছা আরেকটু হেলতেই ইউসুফ ভাইয়ার হাত ছুটাতে ছুটাতে বলি,,

--" ভাই ছাড়ুন আমাকে! ছাড়ুন প্লীজ?"

--"কি যাতা বলছিস! এতো নড়চ্ছিস কেন? নড়িস না!নড়া বন্ধ। একদম বন্ধ। এভাবে নড়লে তোর কি মনে হয় ছেড়ে দিব তোকে? কখনো না! এ প্রান থাকতে না।"

--" ভাইয়া বুঝতে চেষ্টা করুন।  এখানে দুজন থাকলে দুজনকে মরতে হবে! তার থেকে বরং আমি চলে যাই!"

--" ফালতু কথা কেন বলছিস তুই? বাঁচলে এক সাথে বাচঁবো মরলে এক সাথে।"

--"আপনি বুঝতে চেষ্টা করুন...!

আমাকে বলতে না দিয়ে,,

--প্লীজ বাবুইপাখি!  আমাকে এমন শাস্তি দিস না যাতে করে সারা জীবন বেঁচে থেকেও মরতে হয়..!"

ভেজা কন্ঠ শুনালো ইউসুফ ভাইয়ার। ধক করে উঠলো আমার মন। এখন কি আবেগী হলে চলবে! এদিকে আগাছা আরো ঝুলতেই আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর মৃদু হেসে ইউসুফ ভাইয়ার গালে হাত রেখে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠি,,

--" আপনাকে অনেক কিছু বলার ছিল! কিন্তু হলো শুধু একটি কথা বলবো! ভাল থাকবেন ভাইয়া।" 

বলে হাত ছেড়ে দিলাম সাথে সাথে ইউসুফ ভাই চিৎকার করে বলে উঠে "বাবুইপাখি "। আমি উপরে দিক তাকিয়ে ইউসুফ ভাইয়ার মুখ খান্না ভাসচ্ছে সে কান্না করছে।আজ হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যাবে আমার কাহিনী। কিন্তু তখনি...!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন