বকুল ফুলের মালা - পর্ব ২৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৪৯!! 

-আয়ান? বউমাকে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়?

আয়ান তখনো থমকে দাঁড়িয়ে ছিল দরজার বাইরে৷ ও নিজেই এমন একটা পরিস্থিতিতে রীতিমতো চমকে গেছে, মায়রাকে আর কি বলে শান্তনা দিবে? এবারে বাবার মোলায়েম কণ্ঠস্বর শুনে মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে যেন একটু আশার আলো দেখতে পেল আয়ান। মায়রা তখনো কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গেছে মেয়েটা। আয়ান ধরে না থাকলে হয়তো এতোক্ষণে দরজার বাইরেই লুটিয়ে পড়তো। আয়ান মায়রার দিকে একবার তাকিয়ে আবার বাবার দিকে তাকালো।

-কি রে? এমন গাধার মতো তাকিয়ে আছিস কেন? বউমা? আর কেঁদো না মা। ঘরে এসো। এটা তো তোমারই বাড়ি মা। এভাবে বাড়ির বই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদে নাকি? এসো ভিতরে এসো?

আয়ান মায়রার দিকে আরেকবার ফিরে তাকালো। বাবার কোনো কথাই যেন মেয়েটার কানে ঢুকছে না। মায়রা কথাগুলো আধো শুনতে পেল কিনা সেটা নিয়েও আয়ানের সন্দেহ হলো। আয়ান মায়রাকে এক হাতে আলতো করে ঝাঁকি দিতেই মায়রা বেশ একটু চমকে গিয়ে কেঁপে উঠলো।

-মায়রা? বাবা ডাকছে তো? চলো ভিতরে যাই?

-কিন্তু আয়ান? মা-----?

মায়রা কথা শেষ করতে পারলো না। আরেকবার কান্না দমকে গলা বন্ধ হয়ে এলো। আয়ানের বাবা এগিয়ে এসে মায়রার মাথায় হাত রাখলেন।

-এভাবে কাঁদতে আছে মা? বাবা এখনো আছি না? দেখবি বাবা সব ঠিক করে দিবো। কিন্তু তার আগে তোরা দুজনেই আমার প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিবি। কিচ্ছু লুকাবি না একদম---।

-জি বাবা---।

-এখন বাসায় আসো তো? আসো? নাইওর গিয়ে তো বাপটাকে একদমই ভুলে গেছ--। এতোদিনে আসার কথা মনে পড়লো তাহলে-----।

আয়ানের সাথে মায়রা বাড়ির ভিতরে পা রাখতেই আয়ানের বাবাও কথা বলতে বলতে ড্রইংরুমের দিকে চলেছেন৷ এটা ওটা বলে মায়রার মন ভালো করার চেষ্টা করছেন। অথচ উনার কথাগুলো মায়রার কানে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মস্তিষ্ক যেন তার কিছুই বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে কোনো এক দুর্বোধ্য ভাষায় তিনি কথা বলছেন। যার অর্থ, ব্যবহার কিছুই মায়রার জানে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে যেন এক শেষ না হওয়া পথে যাত্রা করছে মায়রা৷ যেন এই পথে একবার চলা শুরু হলে আর শেষ হওয়ার উপায় নেই। আজীবন যেন এই পথ ধরে সামনের দিকে চলতেই হবে, চলতেই হবে----।

আয়ান কখন মায়রাকে ড্রইংরুমে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছে সেটাও একদম টের পায় নি মায়রা। একটু পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো কোথায় আছে। পাশে যে আয়ান চিন্তিত মুখে বসে আছে সেটাও টের পেল মায়রা। আয়ান তখনও মায়রার বাম হাতটা শক্ত করে ধরে আছে দেখে মায়রা একটু ইতস্তত করে হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই আয়ান মায়রার মুখের দিকে তাকালো। 

-কি হয়েছে মায়রা? কিছু লাগবে তোমার?

-উঁহু----।

-আর কেঁদো না এভাবে প্লিজ? শরীর খারাপ করবো তো? সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো তুমি?

-কিভাবে! আমি এজন্যই চাইনি বিয়েটা করতে। তুমিই তো শুনলে না। এখন দেখলে তো-----? মা কতো কষ্ট পেল! আর কি ভাবলো? 

-মায়রা! আর কয়বার বলবো তোমাকে এভাবে কান্নাকাটি না করার জন্য? মা এখন রাগ করেছে, একটু পরে রাগ পড়ে গেলে দেখবে আবার তোমাকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে কাছে ডেকে নিবে--। সো এতো টেনশন করার কিছু নেই।

মায়রা আবার কিছু না বলে ফোঁপাচ্ছে দেখে আয়ান আলগা করে মায়রাকে জড়িয়ে নিলো। একটু পরেই আয়ানের খেয়াল হলো বাবা সামনেই বসা। তাই বাবার দিকে তাকাতেই দেখলো বাবার চোখে মুখে অনেকগুলো প্রশ্ন ফুটে আছে। আয়ান ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবার দিকে চেয়ে রইলো।

-বাবা তুমি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিলে----।

-আমাকে সবটা শুরু থেকে বল আয়ান। আমার কাছে ব্যাপারগুলো কেমন গোলমেলে লাগছে। মায়রা কেন বলছে ও চায় নি বিয়েটা করতে? আর তুই ই বা কেন চারটা মাস সময় নিয়েছিলি? আর এখন এসব! মায়রার আগে একবার---।

-বাবা! তোমাকে আর মাকে আমি কয়েকটা মিথ্যে কথা বলেছিলাম সেদিন। আমার কোনো কলিগের থ্রুতে মায়রার সাথে পরিচয় হয়নি। ওকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনি। চার বছরের রিলেশন ছিল আমাদের। 

-হোয়াট?

-হ্যাঁ বাবা। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে মায়রা একজনকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। ঠিক বাধ্য হয় বললে ভুল হবে, ওর পরিবারই নিজেদের সম্মানের দোহাই দিয়ে ওকে লোকটার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের পরে কি ঘটেছে আমি জানি না। জানতে চাইও না। আমি ওকে ভুলে থাকার অনেক চেষ্টা করেছি বাবা। কিন্তু পারি নি। আরুদের সাথে কক্সবাজার গিয়ে সেখানে আবার মায়রার সাথে দেখা হয়। সেখানেই ওর অবস্থা দেখে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারি নি বাবা বিশ্বাস করো। ওই লোকটা কক্সবাজার এসেও এক হোটেল মানুষের সামনে সিনক্রিয়েট করেছে, ডিভোর্স লেটার ধরিয়ে দিয়ে গেছে মেয়েটাকে। ভাবতে পারো কতোটা অমানুষ!

-তো? তারপর?

-তারপর আর কি? এই মেয়ে সেখান থেকেও আমাকে কিছু না বলেই চলে এসেছে। এতো রাগ হচ্ছিল বিশ্বাস করবা না। কক্সবাজার থেকে সোজা চট্টগ্রাম ফিরে একজন লইয়ারের কাছে গেলাম। মায়রাকে আমার যে করেই হোক চাই। তাই আইনি আর ধর্মীয় সব জটিলতা কাটিয়ে উঠতে চার মাসের মতো সময় চেয়েছিলাম তোমাদের কাছে। এর মধ্যে একটা বারের জন্যও মায়রার সাথে আমার কথা হয়নি। ও আমার এসব প্ল্যানিংয়ের কিছুই জানতো না বিশ্বাস করো? আমি শুধু ওকে নিজের করে পেতে চেয়েছি। আর চেয়েছি ওর অতীতটা নিয়ে যেন কেউ না ঘাটায়--।

-কাজটা ঠিক কি ভুল সেটা নিয়ে আমি তোকে কিছু বলবো না আয়ান। কিন্তু আমার মনে হয় তোর উচিত ছিল আর কাউকে কিছু না জানালেও আমাকো আর তোর মাকে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখা। তাহলে অন্তত আজকের পরিস্থিতিটা এতো জটিল হতো না।

-সরি বাবা---। আমার মনে হয়েছিল তোমরা হয়তো মায়রাকে---।

-তোর পছন্দে কি আজ পর্যন্ত কখনো অমত করেছি রে ব্যাটা? 

-সরি বাবা।

-মায়রা মা? যদিও আমার ছেলের প্রতি আমার নিজের চেয়েও বেশি ভরসা আছে৷ তবু তুমি একটা কথা বলো তো? ও যা বলেছে সব সত্যি?

-জি বাবা---।

-তোমার বাবা মা তোমাকে হঠাৎ জোর করে কেন বিয়ে দিলেন? সেটা বুঝলাম না।

-আমার আপুর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সীমান্তের সাথে। বাবা মার ভিষণ পছন্দ হয়েছিল উনাকে৷ কিন্তু আপু বিয়ে করবে না জানায়। তবু বাবা মা জোর করে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। আর তাই আপু চলে যায় বাড়ি থেকে---।

-ওহ! তাই এক মেয়ের বদলে অন্য মেয়েকে বিয়ে দেয় উনারা! আশ্চর্য!

-বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পর সীমান্ত নাকি নিজে থেকেই চেয়েছিল আমাকে বিয়ে করতে----।

-যা ঘটেছে সবটা মন থেকে মুছে ফেলো মা। আজকের পর এই বাড়িতে এসব নিয়ে আর একটা কথাও হবে না। সো স্মাইল?

-কিন্তু? মা? উনি তো আমার উপরে রেগে আছেন---।

-আরে ব্যাপার না। তোমার শাশুড়ি এমন একটু আধটু রাগ করে। আমি ওকে সবটা বুঝিয়ে বলবো। তাহলেই সব মিটে যাবে। তুমি এতো চিন্তা করো না। এখন যাও তো তোমাদের রুমে যাও। ফ্রেশ হয়ে নাও। বাড়ির বউ এমন কান্নাকাটি করে চোখ মুখ ফুলিয়ে রাখলে কেমনে লাগে? বাড়ির বউ হবে হাসিমুখি। সবসময় লাজুক লাজুক হাসি ঠোঁটের কোণে লেগেই থাকবে, তবেই না বাড়ির বউ? কি বলিস আয়ান?

-বাবা? তুমি---?

-আরে ব্যাটা বউমাকে নিয়ে ঘরে যা। আমি আপাতত তোর মাকে ম্যানেজ করি---। তার রাগ তো সহজে পড়ে না জানিসই তো? কতো সাধ্য সাধনা করতে হবে এখন আমাকে?

কথাটা বলেই আয়ানের বাবা হা হা করে গলা ছেড়ে হাসলেন। আয়ান নিজেও হেসে ফেললো। মায়রারও যেন বুকের উপরে এতোক্ষণ ধরে চেপে থাকা বোঝাটা কিছুটা হালকা হলো। সবটা ঠিক হবে কিনা কে জানে তবে আজকের পর মায়রা আর পিছনে তাকাবে না। অতীতটাকে বন্দি করে কবর দিয়ে দিবে আজীবনের মতো। আজকের পর মায়রা ওর জীবনের এই অন্ধকার অংশটা যে করেই হোক ভুলে যাবে, চিরদিনের জন্য মুছে ফেলবে নিজের জীবন থেকে৷ আয়ানের বাবা আয়ানকে নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন কিভাবে আয়ানের মায়ের রাগটা ভাঙাবেন৷ আর এতো কিছুর মাঝে ওদের কারোরই চোখে পড়লো না একটা ছায়ামূর্তি সবার অলক্ষ্যে আড়ালে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ ধরে সবকিছু শুনছিলো। তারপর খুব ধীর পায়ে আবার চলেও গেল। গভীর চিন্তায় মগ্ন এই তিনটে মানুষ তার উপস্থিতি আর চলে যাওয়া কোনটাই বিন্দুমাত্র টের পেল না। 

৫০!! 

ঘন্টা খানেক কেটে যাওয়ার পর মায়রাকে রুমে রেখে এসে আয়ান মায়ের রুমে গেল। মা খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছেন, আর পাশেই সায়না বসে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছিলো। আয়ানকে আসতে দেখেই সায়না তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো। আয়ান চুপচাপ এসে মায়ের পায়ের কাছে এসে বসতেই মা পা একটু সরিয়ে আয়ানকে বসার জায়গা করে দিলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। আয়ান মুখ তুলে বিছানার পাশে দাঁড়ানো সায়নার দিকে একবার তাকালো।

-আমি মায়ের সাথে কথা বলবো। তুই কি এখন এখানে সঙয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকবি কথা শোনার জন্য?

-খালামনি আমি রুমে গেলাম---।

হড়বড় করে কথাটা বলেই সায়না একছুটে রুম থেকে পালালো। আয়ান আবার মায়ের মুখের দিকে তাকালো। মা অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে দেখে আয়ান আরেকটু এগিয়ে এসে মায়ের পা জড়িয়ে ধরলো। মা তাড়াতাড়ি আয়ানের হাত থেকে নিজের পা ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন। আয়ানও সহজে ছাড়ার পাত্র না। আরেকটু আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো মায়ের পা দুটো। 

-আম সরি মা। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি তোমাদেরকে অনেক বড় কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো মা? আমি চাই নি তোমরা কষ্ট পাও।

-পা ছাড় আয়ান---। তোর আমার পায়ে ধরে মাফ চাওয়ার মতো কিছু ঘটে নি এখানে--। তবে সামনে কি ঘটতে চলেছে সেটা আমি নিশ্চিত নই।

-মা বিশ্বাস করো আমি মায়রাকে ছাড়া থাকার কথা কল্পনাও করতে পারছিলাম না---। ওকে খুব ভালোবাসি আমি মা--। মাফ করে দাও প্লিজ----।

-পা ছাড় আয়ান---।

-সরি তো মা? ও মা? আর কখনো কিচ্ছু লুকাবো না তো? প্রমিস---।

-যে একবার কোনো কিছু গোপন করে সে বারবারই গোপন করে আয়ান। তুই লুকাবি না বললেই তো আর আমি বিশ্বাস করতে পারবো না৷ 

-মা আমি সত্যি বলছি-। আমি শুধু চেয়েছিলাম তোমাদের আর মায়রার মাঝে যে ভুল বুঝাবুঝি না হয়। আর কিচ্ছু না বিশ্বাস করো?

-যে মেয়ে আগেরবার সংসার করতে পারে নি সে তোর সঙ্গে সংসার করবে! হাহ! তা তোদের যেমন ভালো লাগে কর। আমার এখানে কথা বলার তো আর কিছু নেই----।

-লোকটা রীতিমতো নির্যাতন করছিল ওর সাথে মা। তারপরও কি করে এমন একজন লোকের সঙ্গে---?

-এটা তোর বউ তোকে বলেছে, আর তুই বিশ্বাস করেছিস--। কিন্তু অন্য একজন তোর বলা এই কথাগুলো বিশ্বাস না ও তো করতে পারে। দোষটা তো তোর বউয়েরও থাকতে পারে? নাকি? হতে পারে ছেলেটা ওর এতো এতো চাহিদা পূূরণ করতে পারে নি বলে----।

-মা!

-তুই যা এখন আয়ান। তোর বাবাও অনেকক্ষণ এসব বকে মাথা ধরিয়ে দিয়ে গেছে আমার। আর ভালো লাগছে না এসব--। যা তুই আমার সামনে থেকে এখন---। 

-মা? তুমি কি চাইছ সেটা বলো? আমি মায়রাকে নিয়ে চলে যাবো এখান থেকে? সেটাই বলছো কি?

-এটা হওয়ারই বাকি ছিল--। অবশ্য মেয়েটা শুনলাম আগেরবারও কাজটা করেছে। বিয়ের পর দিনই মা বাপের কাছ থেকে তাদের ছেলেকে দূর করে দিয়েছে--। তাও তোকে কথাটা বুঝাতে তিনটা দিন সময় নিয়েছে--। মন্দ কি?

-মা? সব কথায় মায়রাকে কেন টানছো?

-টানছি কারণ এর আগে যাই হয়েছে, তুই রাগ করেছিস, জেদ করেছিস-কিন্তু কক্খনোই আমাকে মিথ্যে বলিস নি। আর এর আগে কখনোই তুই বাড়ি ছাড়ার কথাও বলিস নি তুই---। 

-মা---। তুমিই তো বললে চলে যেতে--। তাই ক্লিয়ার হয়ে নিচ্ছি আরকি--। মায়রা বাড়িতে থাকলে তোমার আবার কোনো সমস্যা হয় কিনা---। এখন তো তোমাকে বুদ্ধি দেয়ার লোকের অভাব নেই----।

-একদম কথা পেঁচাবি না আয়ান। আর একদম সায়নাকে কিছু বলবি না। ও তোদের রিসেপশনের ছবিটা শেয়ার করায় না এতো বড় ঘটনাটা জানতে পারলাম--। নয়তো কাল কোন অনুষ্ঠানে সবার সামনে যদি কেউ কথাটা তুলতো তাহলে তো আমি নিজেই লজ্জায় মরে যেতাম--।

-তাহলে যত নষ্টের মূলে এই মেয়েটাই? আমার আগেই বুঝা উচিত ছিল। আর মা? আমি বা মায়রা এমন কিছু করি নি যে তোমাকে মরে যেতে হবে। বরং আমি মনে করি একজন মা, একজন নারী হিসেবে তোমার তো ওকে নিয়ে অহংকার হওয়া উচিত। সম্মান, বংশমর্যাদা, দায়িত্ব-সমাজের এসব মিথ্যেমিথ্যির নিয়মের আগল ভেঙ্গে ও নিজের আত্মসম্মানটাকে বেছে নিয়েছে। ও মুখ বুজে পড়ে পড়ে মার না খেয়ে এই মিছেমিছির সংসারটা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে---। আমাদের সমাজের হাজারটা মেয়ের মতো নিয়তি মেনে নিয়ে তিলেতিলে মরার রাস্তাটা বেছে নেয় নি ও---।

-এসব জ্ঞানের কথা বই আর টকশোতেই ভালো মানায় আয়ান। কিন্তু আমাদেরকে একটা সমাজে বাস করতে হয় আয়ান--। তোরা সমাজের এসব স্বভাবসিদ্ধ নিয়ম মানিস না বলে তো আর সব বদলে যাবে না?

-ঘটনাটা যদি তোমার মেয়ের জীবনে ঘটতো তাহলেও কি একই কথা বলতে পারতে মা? বুঝলাম মায়রা ভুল করেছে লোকটাকে ডিভোর্স দিয়ে। ভুল করেছে আমি জোর করে বিয়ে করতে চাওয়ার পর রাজি হয়ে--। ভুল করেছে নিজের অতীত ভুলে আমার সাথে সুখে থাকার স্বপ্ন দেখে---। কিন্তু কাজটা যদি তোমার নিজের মেয়ে করতো? তাকে বলতে পারতে যে সে ভুল করেছে? বলো? পারতে?

-আয়ান?

-তুমি জানো মা? আমি মায়রাকে নিয়ে এই বাড়িটা ছেড়ে চলে যেতে চাইলেও ও কখনোই রাজি হবে না। ওকে তো আমি চিনি--। ও কেমন মানুষ জানি বলেই এতোটা ভালোবাসি ওকে। যেদিন তুমি ওকে মন থেকে জেনে যাবে, চিনতে পারবে ওই পাগলী মেয়েটা কেমন, সেদিন তুমিও ওকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিবে---। দেখে নিও? সেদিনটা  আসতে খুব বেশি দেরি হবে না। শুধু ওকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখো? তাহলেই দেখবে মায়রা কতো সহজে তোমার মনটা জয় করে নেয়--। আসছি মা---। আর একটা কথা মা? প্রয়োজনে কাকে পাশে পাওয়া যায় সময় থাকতে সেই মানুষটাকে চিনে নিও--। অহেতুক কাউকে বিশ্বাস করে ঠকো না। পরে হয়তো এতো দেরি হয়ে যাবে যে নিজেকে তুমি নিজেই ক্ষমা করতে পারবে না। 

কথাগুলো বলেই আয়ান মায়ের সামনে থেকে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আর আয়ানের মা ছেলের শেষ কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে এই মূহুর্তে। আয়ানের উপরে নয়। রাগটা হচ্ছে মায়রার উপরে। ছেলের পছন্দ নিয়ে আয়ানের মায়ের কোন আপত্তিই নেই। আর সমস্ত রাগ মায়রা আয়ানকে এমন করে নিজের আয়ত্তে বশ করে নিয়েছে সেই কারণে। যে ছেলে মা গলা উঁচিয়ে কথা বললে কখনো চোখ তুলে তাকায় নি পর্যন্ত, আজ তার সেই ছেলেই কিনা এই মেয়ের হয়ে তাকে এতো কথা শুনিয়ে দিয়ে গেল! তাও আবার কিনা সেই মেয়ের জায়গায় নিজের মেয়েকে রেখে চিন্তা করতে বলে! ঠিক কতোটা পরিমাণ ব্রেইন ওয়াশ করলে আয়ান এই কথাগুলো মুখে আনতে পারে ভেবে আরো বেশি রাগ হচ্ছে উনার। প্রতি মিনিটে রাগটা যেন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। সেটা টেরও পাচ্ছেন তিনি। কিন্তু কিছুতেই রাগ দেখানোর উপায়ও পাচ্ছেন না, আবার রাগ কন্ট্রোলও করতে পারছেন না। 

আয়ান মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে এলো। মায়ের সাথে হওয়া কথাগুলো জানলে মায়রা কতোটা কষ্ট পাবে ভাবতেই আয়ানের কেমন পাগল পাগল লাগছে। পরিস্থিতি ঠিক হওয়ার বদলে কেন যেন আরো বেশি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। সামনে যে কি হবে কে জানে! আপাতত কিছু একটা বলে মায়রাকে শান্ত করবে ভাবলো আয়ান। যদিও মেয়েটা ওর মুখ দেখেই বুঝে ফেলবে কি ঘটেছে। তবু মেয়েটার মন ভালো করতে একটু না হয়----। আয়ান কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুমে এসেছে। রুমে মায়রাকে না দেখতে পেয়ে আয়ানের দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হল ও বুঝি দম বন্ধ হয়ে এখনই মরে যাবে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো আয়ান। মায়রা আশেপাশে কোথাও আছে। হয়তো ওয়াশরুমে। বা বারান্দায়। বা ড্রইংরুমে। আছে আশেপাশে কোথাও। এতো ভয়ের কিছু নেই। 

আয়ান লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে থেকে ওয়াশরুমের দরজাটা বন্ধ। এবার ধীর পায়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালো আয়ান। কয়েক কদমের দূরত্ব পার পারতেও আয়ানের মনে হচ্ছে বছর পেরিয়ে যাবে। বারান্দায় গিয়ে কি দেখবে এটা ভেবে কেন যেন হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে আয়ানের। কেমন ভয় ভয় করছে ওর। দরজার সামনে এসে আর হাত বাড়িয়ে দরজাটা খোলার শক্তিটুকুও পেল না আয়ান। তবু শেষমেশ নিজের সমস্ত মনের জোর এক করে বারান্দার দরজাটা হালকা করে ধাক্কা দিতেই মায়রার শাড়ির আঁচলটা দেখতে পেল। মায়রাকে দেখতে পেয়েই আয়ানের যেন বুকের উপর থেকে কয়েক টন ওজনের একটা পাথর সরে গেল। আয়ান প্রায় ছুটে এসে মায়রাকে শক্ত করে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো। আর সাথে সাথেই তার চোখ বেয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে এসে পড়লো মায়রার কাঁধের উপরে। আর এদিকে আয়ানের এমন কাজে মায়রা পুরোই থমকে গেল। বেচারি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না এমন হঠাৎ করে আয়ানের কি হয়েছে যে! এভাবে কেন বেসামাল হয়ে পড়ছে লোকটা?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন