অন্দর মহলে যেতেই নিখিলের ভীত মুখটা নজরে পড়লো। রুদ্রের দিকে চাইতেই হিম ধরে আসলো তার। চোখ জোড়া লাল হয়ে রয়েছে, চোয়াল শক্ত। অবাক উমা কারণ বুঝলো না। এতোক্ষণ তো ভালোই ছিলো। হুট করে কি এমন হলো! রুদ্রের নজর উমার দিকে পড়তেই বললো,
"বাড়ি চলো এখনই। এখানে এক মূহুর্ত নয়"
"কিন্তু...."
"কথা কি কানে গেলো না নাকি? এক কথা ক বার বলতে হয় তোমাকে! তোমার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য যে আমি এই ছোটলোকের ঘরে কদম রেখে ছিলুম৷ কিন্তু সেটাই আমার ভুল৷"
রুদ্রের রাগের স্পষ্ট কারণ বুঝতে পারছে না উমা। নিখিল বাবুর লম্বাটে মুখখানি আরোও লম্বা হয়ে গেলো। তাকে নিতান্ত অসহায় ভীত কন্যের পিতার মতো লাগছে যার প্রতি মূহুর্ত একটাই চিন্তা, জামাই যেনো সন্তুষ্ট হয়। নতমস্তকে এগিয়ে এলেন তিনি। আকুল আবেদনের স্বরে বললেন,
"বাবা জীবন কি গোসা করলে?"
নিখিল বাবু অসহায়ত্বের ভনীতা সহ্য হলো না রুদ্রের। নিখিল বাবুর মতো মানুষেরা শিরদাঁড়াহীন হয়, ভীতু হয়, কাপুরুষ হয়। শুধু তাই নয় তাদের নিজস্ব সত্তা থাকে না। তারা পরজীবের ন্যায় বাঁচে। অন্যের সাহায্য দয়া ব্যাতীত একমূহুর্ত ও তারা জীবিত থাকতে পারে না। নিখিলবাবুর এই স্বভাব রুদ্রকে বিরক্ত করতো না যদি না উমাকে নিয়ে রতীরাণী কটুক্তি করতো।
কিছুক্ষণ পূর্বের কথা, রুদ্র বাড়ির পেছনের কলপাড়ে হাত ধুতে গিয়েছিলো। হেসেলে তখন রতীরাণী এবং গ্রামের কিছু মহিলারা পিঠা বানাচ্ছিলো। চেয়ারম্যান পুত্রের আপ্পায়নের কমতি রাখবে না সে। এর মাঝেই এক নারী হিনহিনে স্বরে বললো,
"রাজীর মার তো ভাগ্য খুলে গেলো লো। মেয়ে এখন অভিনব সিংহের বাড়ির বউ। এখন তোমার ভাব ই তো আলাদা। উমার শাড়িখান দেখেছো, কি দামি! অন্তত পাঁচশ-হাজার টাকা তো হবেই। আর গয়না, বাবা রে পুরো সোনায় মুড়িয়ে রেখেছে। তা তোমাদের জন্য তো তেমন কিছু আনলো না!"
"আরে সবুরে মেওয়া ফলে। মাত্র তো কদিন হলো বিয়ের। এখন কি সব হাতাতে পারবে। আস্তে আস্তে সব ই হবে।"
"উমা রাজী হবে? অত্যাচার, খোটা তো কম দাও নি। দেখো মেয়ে না আবার চোখ উল্টায়"
রহিমার কথায় খানিকটা বিরক্ত বোধ হলো রতীর। মুখখানা বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
"কেনো গো! দেখবে না কেনো? আরে চেয়ারম্যানের বাড়ির বউ হয়েছিস কি নিজ যোগ্যতায়। হয়েছিস আমার জন্য। আমি তোরে খাওয়াইছি পড়াইছি! মা তো ছেড়ে গেছিলো সেই ছোটকালেই। ওই অলক্ষীরে ঘরে না রাখলে এতো ধিঙ্গি কেমনে হতো? এখন টাকা হয়েছে বলে তুই চোখ উল্টাবি! এতো সহজ হয় গো! এতো সহজ নয়। আমার নামও রতী, দেখো না এই বছরেই এই চালা ঘর পাকা যদি না করি আমার নাম ও রতী না।"
"তাহলে কি ডাকবো, ফুলবানু?"
হেসেলে হাসির ঢল পড়লো। কিন্তু অপরদিকে রুদ্রের মাথায় আগুন জ্বললো, মাথার শিরা ফুলে উঠলো অসম্ভব ক্রোধে। পত্নীর মাতা না হলে জিব ছিড়ে ফেলতো সে। কিন্তু রতী সম্পর্কে তার শ্বাশুড়ি। উপরন্তু গতরাতে যা করেছে তারপর পুনরায় একই কাজ করাটা ভালো হবে না। কিন্তু রুদ্রের রাগ ও পড়লো না। আরোও রাগ হলো উমার প্রতি। এতো অবুঝ মানুষ কি করে হয়! যে বাড়িতে তার আপ্পায়ন শুধুমাত্র পয়সার লোভে হয় সেই বাড়িতে আসার জন্য এতো উতলা ছিলো এই মেয়ে। রুদ্র এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না। বসার ঘরে এসে হুংকার ছাড়তে লাগলো। বিষের মতো গায়ে বিধছে এই বাড়ি। এক মূহুর্ত এই বাড়িতে থাকলে হয়তো তার গা ঝলছে যাবে।
নিখিলের প্রশ্নে অগ্নিদৃষ্টি প্রয়োগ করলো রুদ্র। নিখিল বাবুকে দেখে রাগ সংবরণ হচ্ছে না। ঘাড়টা শক্ত করে ধরে বললো,
"তুই কি ভাবিস? আমি নেশা করি বলি আমার মাথা কাজ কররে না? তোরা তলে তলে জাহাজ চালাচ্ছিস সেই খবর আমার আছে। অভিনব সিংহের আত্নীয় হয়েছিস বলে বেশি উড়িস না। ডানা ভেঙ্গে মাটিতে পড়লে একেবারেই চিত পটাং"
রুদ্রের এমন ব্যাবহারে উমা ছুটে আসে। রুদ্রের হাত থেকে বাবাকে ছাড়ায় সে। তীব্র স্বরে বলে উঠে,
"পাগল হয়ে গেলেন নাকি? কি করছেন?বাবার লাগবে?"
"লাগুক, ইচ্ছে তো করছে এখানেই পুতে ফেলতে।"
উমা নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। সবকিছুর সীমা থাকে। আজ রুদ্র সীমা লঙ্গন করছে। শেষমেশ তার বাবার অসম্মান করতেও পিছপা হচ্ছে না। এক বাড়ি লোকের সামনে নিজের বাবার অপমান সইতে পারলো না উমা। রুদ্রকে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারলো। তাল সামলাতে না পেরে দু কদম পিছিয়ে গেলো রুদ্র। উমা কাঁপছে, শুকনো কাঠির ন্যায় শরীরটা কোনো মতে মাটি আকড়ে দাঁড়িয়ে রইলো। উমার চোখ বেয়ে নোনাজল গড়াচ্ছে। কিন্তু তেজ দমলো না। রুদ্রের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইলো সে। রুদ্র অবাক হলো, উমার এমন রুপে যেনো ধাতস্থ হতে পারলো না। এদিকে জড়ানো কন্ঠে তীব্র স্বরে উমা বললো,
"অনেক হয়েছে, এবার থামুন। রেহাই দেন আমাদের। আপনি বাড়ি যাবেন তো। চলুন, এক মূহুর্ত থাকবো না আমি এখানে। আমার সামনে আমার বাবাকে অপমান করবেন আর আমি সেটা মুখ বুজে মেনে নিবো তা হতে পারে না।"
উমার কন্ঠ কাঁপছে, চোখ লাল হয়ে আছে। এক বাড়ি লোকের সামনে নিজের অপমান যেনো হজম হলো না রুদ্রের। ক্রোধে গা কাঁপছে। রোষের তাড়নায় নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না সে। উমার নরম হাতটা শক্ত করে ধরে টানতে টানতে বেড়িয়ে গেলো সে। নিখিল বাবু মেয়েকে বাঁচানোর আকুতি করলো,
"বাবা, উমার ভুল হয়ে গেছে। ও বাচ্চা মেয়ে। বুঝে নি।"
কিন্তু কে শুনে কার কথা! টানতে টানতে ভ্যানে তুললো সে। ভ্যান ওয়ালা রুদ্রের শক্ত মুখখানা দেখে কিছু বলতে পারলো না। এদিকে কাঁচের চুড়ি ভেঙ্গে হাতে বিধছে উমার। ব্যাথায় রীতিমতো কুকিয়ে উঠছে সে। কিন্তু সেই আর্তনাদ রুদ্রের কানে গেলো না। সে তার বাঁধন হালকা করলো না। ভ্যান থামলো চেয়ারম্যান বাড়ি। উমাকে টানতে টানতে দোতালায় নিয়ে গেলো সে। রুদ্রের রুদ্রমূর্তি যেনো সবার অবগত, ফুলির মা চেয়েও কিছু বললো না। মালিনী নিজের ঘরে চলে গেলো। লক্ষী দেবী তার ঠাকুরের ঘরেই বসে রইলেন। উমার আকুল নিবেদন কারোর কারে গেলো না। বারংবার বললো,
"আমার ব্যাথা লাগছে ছাড়ুন। ব্যাথা লাগছে"
ফুলির মা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনে মনে বললো,
"এই বাড়িতে সব মাইয়াগোর এই একই হাল"
রুদ্র ঘরে ঢুকেই ডোর দিলো। ছুড়ে ফেললো উমাকে মাটিতে। তারপর হাটু গেড়ে বসলো তার সামনে। মুখটা শক্ত করে ধরে নিজের দিকে নিলো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
"খুব তেজ না? খুব তেজ? বাপের বাড়ি গিয়ে তোর তেজ বেড়েছে! একটু আদর কি করেছি মাথায় উঠে নাচতে লেগেছিস? আজ এমন শাস্তি দেবো চিরটাকাল মনে রাখবি"
উমা কোনো কথা বলার পূর্বেই........
—————
রুদ্র ঘরে ঢুকেই ডোর দিলো। ছুড়ে ফেললো উমাকে মাটিতে। তারপর হাটু গেড়ে বসলো তার সামনে। মুখটা শক্ত করে ধরে নিজের দিকে নিলো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
"খুব তেজ না? খুব তেজ? বাপের বাড়ি গিয়ে তোর তেজ বেড়েছে! একটু আদর কি করেছি মাথায় উঠে নাচতে লেগেছিস? আজ এমন শাস্তি দেবো চিরটাকাল মনে রাখবি"
উমা কোনো কথা বলার পূর্বেই রুদ্র তার বাহু ধরে তাকে মাটি থেকে উঠায়। আজ যেনো রুদ্রের ক্রোধের দাবানলের উত্তাপে ঝলছে যাবে উমা। ষোড়শীর বুকের কোনে ত্রাশের কালো ছায়া উঁকি দিলো। বারংবার ভেতরটা চুরমার হচ্ছে। সকালেও লোকটার অন্য রুপ নজরে এসেছিলো তার। শান্ত কোমল স্নিগ্ধ রুপ। অগ্রহায়নের উষ্ণ সোনালী রোদ্দুরের ন্যায় ওম তার। কিন্তু পরমূহুর্তেই বরফের চেয়েও শীতল, প্রলয়কারী। রুদ্রের মনোভাবের পরিবর্তন উমাকে বারংবার আহত, চূর্ণবিচূর্ণ করে। চোখ জোড়া থেকে অবিরত নোনাজলের বর্ষণ হচ্ছে। রুদ্রের রোষানলের সম্মুখে আর্তনাদ ছাড়া কিছুই বের হচ্ছে না। রুদ্র নিজের মাঝে নেই। তার মাথায় কেবল একটাই চিন্তা উমাকে প্রচন্ড শাস্তি দিবে সে। রুদ্রকে আজ অবধি কেউ অপমান করার স্পর্ধা দেখায় নি অথচ এই ছোট মেয়েটি তাকে চোখ রাঙিয়েছে। একটু কোমল কি হয়েছে মাথায় উঠে নাচছে! উমাকে নিজের জায়গা দেখানো প্রয়োজন। নয়তো সে ভুলে যাবে রুদ্র কে! সে উমার বাহু ধরে টানতে টানতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। উমা নিজের বাহু ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। তার কবজি থেকে রক্ত চুয়ে চুয়ে পড়ছে। কিন্তু সেদিকে রুদ্রের খেয়াল নেই। রুম থেকে বের হয়ে উমাকে টানতে টানতে বাড়ির পেছনে নিয়ে যেতে লাগলো রুদ্র। উমা চাপা আর্তনাদ করতে লাগলো,
" ছাড়ুন আমায়। আমার লাগছে"
রুদ্র যখন তাকে ঘর থেকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন সাহায্যের আকুতিও সে করলো।
"মা, উনাকে থামান। মা"
কিন্তু তার আকুতির স্বর কারোর কানে গেলো না। রুদ্র নিজের বল প্রয়োগ করে বাড়ির পেছনে এক ঘরে নিয়ে গেলো উমাকে। এই ঘরটি বড্ড পুরোনো। পুরোনো জমিদার বাড়ির শাস্তি ঘর ছিলো এটা। বলা হয়ে থাকে, পুরোনো দিনে যে গ্রামবাসি তাদের খাজনা দিতে পারতো না এই ঘরেই তাদের বন্দি রাখা।হতো। কাঠের দরজা খুলে সিড়ি দিয়ে নেমে গেলো রুদ্র। চরম অন্ধকার ঘরটিকে গ্রাস করছে। এক চিলতে আলোর কিরণ ও নেই। ঘরটি রুদ্রের চরম পরিচিত। না জানি কোনো দিবা রজনী শাস্তি স্বরুপ বাবা তাকে এই ঘরে আটক রেখে তার হিসেব নেই। প্রথম ভয় পেতো রুদ্র। কিন্তু পরে যেনো অন্ধকারের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিলো। আজ একই শাস্তি সে উমাকে দিবে। উমার গায়ে হাত তুলার মতো কাজ সে করবে না। নিজের খেলনাকে ভাঙ্গার ইচ্ছে তার নেই। সে শুধু উমাকে ভয় দেখাতে চায়, প্রচন্ড কালো ভয়। যা উমার সাহসের বীজকে ভেঙ্গে ভুরমার করে দিবে। অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করতেই ভয়ের শীতল পরশে সারা শরীর কেঁপে উঠে উমার। নিজেকে ছাড়ানোর শেষে চেষ্টা করে সে। কিন্তু অপারগ। রুদ্র উমাকে অন্ধকার ঘরে ছুড়ে মারে। তারপর তীব্র স্বরে বলে,
"বেশ তেজ বেড়েছে। আমিও দেখতে চাই তোর তেজ কোথায় থাকে?"
বলেই সেখান থেকে বেড়িয়ে যায় রুদ্র। লাগিয়ে দেয় কাঠের দরজা। উমা ছুটে আসে। আর্তনাদ করতে লাগে,
"খুলুন, দরজা খুলুন।"
উমার অন্ধকারের ত্রাশ ভীষণ পুরোনো। নিগাঢ় আধার তাকে হিম ধরিয়ে দেয়। ষোড়শীর মনের পুরোনো ভয় আবারো জাল কেটে বেড়িয়ে আসে। মনের আঙিনায় কালো মেঘ জড়ো হয়। চোখ নিরন্তন বর্ষণে লিপ্ত। বেদনার্ত ষোড়শীর জানা ছিলো না প্রতিবাদের ফলাফল এতো ভয়ংকর হয়। ভয়ে চিৎকার করলেও তার কন্ঠ কেউ শুনবে না। পোকামাকড়ের দল আক্রমন করছে বারে বারে। চিৎকার করে উঠছে উমা। কিন্তু সেই চিৎকার এই অন্ধকার গুহার দেওয়াল ব্যাতীত কেউ ই শুনতে পাবে না।
রুদ্র অন্দরে এলো, ফুলির মা তখন ঘর মুছছিলো। রুদ্র তার দিকে সরু দৃষ্টি প্রয়োগ করলো। হিনহনে স্বরে বললো,
"খবরদার, আজ যেনো কোনো প্রকার খাবার না দেওয়া হয় উমাকে। শালীর তেজ আজ শেষ করবো।"
ফুলির মা চুপ করে থাকে। এ বাড়িতে বিগত বিশ বছর যাবৎ কর্মরত সে। নিজস্ব আপন বলতে এই দুনিয়ায় কেউ নেই তার। যে বিয়ে করেছিলো সে আজ অন্যতে মগ্ন। একটা মেয়ে ছিলো সেও তাকে একা করে পরলোকে গমন করেছে। সেখান থেকে এই বাড়িতেই পড়ে থাকে সে। অভিনব এবং রুদ্রের সকল কর্ম স্বভাব ভালো করেই জানা তার। বাপ যতটা হিংস্র ছেলেও তার চেনানো পথ ধরেই এগোবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ফুলির মার মনে হয়েছিলো রুদ্র হয়তো পিতার মতো জানোয়ার হবে না। কিন্তু সে ভুল, অভিনব সিংহের চেয়ে অধিকগুন হিংস্র এবং নিষ্ঠুর সে। উমার প্রতি তার করুনা হলো। কিন্তু তা প্রকাশ করলো না ফুলির মা। অহেতুক অন্যের জন্য নিজের গলায় কোপ দিতে পারবে না সে।
সিনিয়ার সাংবাদিক কামাল আহমেদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শাশ্বত। তার বদলির ব্যাপারে বিস্তর আলোচনা করার জন্যই তাকে ডাকা। এতোকাল কামালের অধীনেই কাজ করেছে সে। সকল খবর যোগাড়, তার রিপোর্ট সব কিছু শাশ্বত ই করতো। কামাল আহমেদ তার উপরে নিজের সকল তদন্তের ভার দিয়ে দিতেন চোখ বুজে, এবং নিপুন ভাবে শাশ্বত কাজ গুলো করতো। কামাল তার উপর চোখ বুঝে ভরসা ও করতেন। কারণ এতোটা কর্মঠ, সৎ সাহসী সাংবাদিক পাওয়া ভার। টাকার সামনে সে ঝুকতে নারাজ। সে চাইলেও নেতাগোতা মানুষের কাছ থেকে বেশ মোটা অংক হাতাতে পারতো। ফলে সামান্য তিনহাজার টাকার চাকরী করতে হতো না তার। মুল্যস্ফিতি এতোই বাড়ছে এখন ঢাকার মতো শহরে তিন হাজার টাকায় চলা সামান্য কথা নয়। কিন্তু শাশ্বতকে বদলি করতে চাচ্ছে নিয়ন্ত্রকেরা। শুধু তাই নয় তার বেতন ও বেড়ে যাবে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এতো ভালো সাংবাদিককে হারাতে চান না কামাল। হাতের সামনের পেপারওয়েট্টা নাড়াতে নাড়াতে কামাল বললেন,
“দেখো শাশ্বত, তুমি চাইলেই এই ঝামেলা দূর করা সম্ভব, আমি জানি বেতন বাড়ছে, কিন্তু অজপাড়াগায়ে তোমার ভবিষ্যৎ নেই। সাতক্ষীরার মতো শহরে কি রিপোর্ট করবে তুমি? ঢাকায় এখন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, হরতাল, অবরোধ। নেতাগোতাদের চুরি চামারি। বুঝতে পারছো হয়তো”
“জ্বী স্যার, আমি বুঝছি। কিন্তু আমি নিজ থেকেই তাদের বলেছি আমাকে সাতক্ষীরার অফিসে দিতে। আমি জানি আমার কতোটা সামর্থ্য। আমি চাইলে ওখানেও ভালো খবর খুজে নিতে পারবো। আর খবর শুধু ঢাকায় আছে কথাটা কিন্তু ভুল, এরশাদ শিকদার কিন্তু খুলনায় রাজত্ব করছেন। তার সকল কার্য খুলনা থেকেই চলছে। ওখানেই তার ত্রাশ। তাই ছোট শহরে দূর্নীতি নেই। বা গ্রামে অন্যায় হচ্ছে না। বরং আমার মতে সেখানে অন্যায়ের পরিমান শতগুন বেশি। কারণ ওইদিকে জোড়ালো সংবাদ মাধ্যম নেই। তাই আমি নিজ থেকেই সেখানে যেতে চাই। আমার সিনিয়ার হিসেবে আমাকে উৎসাহ দিবেন এটাই আমার কামনা”
শাশ্বতের স্পষ্ট বক্তব্যের পর কিছুই বলার অবকাশ থাকে না কামালের। সে এক রাশ হতাশা এবং বিরক্তি নিয়ে শুধু ছোট করে “হু” বলে। শাশ্বত কামালের কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। মুখে প্রশান্তির হাসি। ধীরে ধীরে গন্তব্যের দিকে সিড়ি বানাচ্ছে সে। ঝোপ বুঝে কোপ মারবে সে। ন্যায় অন্যায়ের ভেতর সে সর্বদা ন্যায় কেই বাঁচবে। এর জন্য নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে হলেও ভয় নেই তার। এটাই শাশ্বত, এটাই তার মূল্যবোধ।
৭!!
অন্ধকারের সাথে থাকতে থাকতে অন্ধকারের প্রতি ভয়টা কেটে যায়। এক নিখুঁত বন্ধুত্ব তৈরি হয়। কেউ বলেছিলো,
“কাউকে এতোটা ভয় দেখানো উচিত নয় সে ভয়ের প্রতি ভয়টাই দূর হয়ে যায়”
উমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক তেমন ই হয়েছে। অন্ধকার ঘরে বন্দি অবস্থায় প্রথম দিন চিৎকার করলেও আজ সে শান্ত। পেটে আট ঘন্টা যাবৎ খাবারের দানা পড়ে নি। কিন্তু তার ক্ষুধা নেই, পানির পিপাসায় গলা কাঠ হয়ে এসেছিলো। কিন্তু এখন সেই পিপাসাটাও লাগছে না। প্রথমে ভেবেছিলো আত্নহত্যা করলে হয়তো নরকে যেতে হবে। আর নরকে খুব কষ্ট। কিন্তু আজ সেটা মনে হচ্ছে না। এখন মনে হচ্ছে বেঁচে থেকেও নরকীয় যন্ত্রণা সে ভোগ করছে। এর থেকে মৃত্যু হয়তো আরোও মধুর হতো। রুদ্রের মতো অমানুষের সাথে জীবন ব্যাতীত করার থেকে মৃত্যু অধিক কাম্য উমার। এখন আর কষ্ট হচ্ছে না। কান্না পাচ্ছে না। হাটুগেড়ে নির্বিকারভাবেই বসে রয়েছে উমা। আশা নামক এক চিলতে কিরণও উদয় হচ্ছে না তার বুকে। হয়ত এভাবেই অন্ধকার গহ্বরে থেকে যাবে চিরকাল। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। প্রতিবাদ নামক শব্দটা অর্থহীন মনে হচ্ছে। চোখ বুজে আসছে অচিরেই। হয়তো মৃত্যু দারে এসেছে। উমার আক্ষেপ নেই, সে মরতে চায়, তার মুক্তি চাই। হটাৎ………………